‘মানসিং তোমর ও মৃগনয়না’

রানা চক্রবর্তীঃ শিল্প ও সঙ্গীতের ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে রাজা মানসিং ও মৃগনয়নার প্রেমোপাখ্যান। ঘটনার ঘনঘটায় মানবিক সম্পর্ক ইতিহাসের গভীরে দাগ না কাটলেও, গোয়ালিয়রের ইতিহাসের দিকে তাকালে সেটা অন্ততঃ মনে হয় না। তাই ওই ঘটনার পরে বহু যুগ পেরিয়ে এসেও গোয়ালিয়র আজও মানসিং ও মৃগনয়নার যুগল প্রেমের পরিচয় বহন করে চলেছে। সেখানকার প্রাসাদ, মন্দির, মহলের পর মহল, চিত্রশালা, সঙ্গীতভবন সর্বত্র শুধু উক্ত যুগলের উপস্থিতি দেখতে পাওয়া যায়, তাঁদের ঘিরে আজও সেখানে অজস্র কিংবদন্তী প্রচলিত রয়েছে। যদিও সেই কিংবদন্তী কিন্তু বলে, মৃগনয়না কে? তাঁর আসল নাম তো ‘নিন্নি’।

মানসিং তোমরের সঙ্গে নিন্নির প্রথম দেখা হওয়ার ঘটনাটা গল্পের মতোই। মানসিং যখন গোয়ালিয়রের রাজা ছিলেন, তখনও পানিপথের প্রথম যুদ্ধ হয়নি। এই ‘তোমর’ বংশীয় রাজপুত বীর যতদিন গোয়ালিয়রের সিংহাসনে আসীন ছিলেন, ততদিন কোন বিদেশি আক্রমণের আঁচ তাঁর গায়ে লাগেনি। ‘বাহলোল লোদী’ পাঁচবার গোয়ালিয়র আক্রমণ করেও মানসিংয়ের রাজ্য থেকে একফালি মাটিও কখনো কেড়ে নিতে পারেননি। প্রত্যেকবার হয় সম্মুখ যুদ্ধে, আর না হয় কূটকৌশলে মানসিং প্রতিবারই তাঁকে পরাজিত করেছিলেন। বাহলোলের পরে দিল্লীর তখতে বসেছিলেন ‘সিকন্দর লোদী’, তিনি মানসিংকে জব্দ করবার জন্য একটি নতুন নগরের পত্তন করেছিলেন (১৫০৫ খৃষ্টাব্দে)। সেই নগরটি হল আগ্রা। যদিও মানসিংয়ের তাতে কোন ক্ষতি হয়নি। তিনি ১৪৮৬ খৃষ্টাব্দ থেকে ১৫১৭ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত স্বমহিমায় স্বগৌরবে রাজত্ব করেছিলেন। ওই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে সিকন্দর শুধুমাত্র নরবরের দুর্গটি ধ্বংস করতে পেরেছিলেন। নরবর আসলে কাছোরার বংশীয় রাজসিংহের দুর্গ ছিল। কোন একসময়ে মানসিং সেটা দখল করে নিয়েছিলেন। আর সম্ভবতঃ সেই সময়েই এই সদা সতর্ক যোদ্ধা রাজার সঙ্গে একদিন নিন্নির দেখা হয়ে গিয়েছিল। তখন সাক নদীর তীরে ছোট্ট রাই গ্রামে গুর্জরীরা বাস করতেন। প্রধানতঃ শিকারজীবী সেই খেটে খাওয়া মানুষগুলোর ঘরের মেয়ে ছিলেন নিন্নি। অতীতে একসময়ে ভারতের বাইরে থেকে এলেও কয়েক পুরুষ ধরে গুর্জররা আর্যদের সংস্কৃতির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ভারতীয়দের সঙ্গে মিলেমিশে এক হয়ে গিয়েছিলেন। একই সঙ্গে তাঁদের নিজস্ব একটি সাধনা ও সমাজধারাও ছিল। বিশেষ করে শিল্প ও সঙ্গীতে তাঁদের অসামান্য উত্তরাধিকার ছিল। নিজেদের দৈনন্দিন জীবনকে তাঁরা হাস্যে, লাস্যে, নৃত্যে, সঙ্গীতে ভরিয়ে রাখতেন। ভারতীয় সংগীতের ‘গুর্জরীরাগ’ আসলে সেই গুর্জরীদেরই জাতীয় সুরের শুদ্ধিকৃত রূপ। ঐতিহাসিকদের মতে সম্ভবতঃ মধ্য এশিয়া থেকে আসবার সময়ে সেই সুর যাযাবর গুর্জরদের কণ্ঠে ভর দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেছিল। পরে ভারতীয় সঙ্গীতভাণ্ডারের সেটি মিশে গিয়ে একটি নতুন রূপ লাভ করেছিল। সে সব অবশ্য অনেক পরের কথা। সাক নদীর ধারের বনজঙ্গল থেকে যে নিন্নি কাঠ কুড়িয়ে আনতেন, তীর ধনুক দিয়ে শিকার করে আনতেন, তিনি কিন্তু রাগ-রাগিণীর রূপতত্ত্ব সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। শুধু তাঁর কণ্ঠে সাতটি সুর সাতটি পোষা পাখির মতই খেলা করত। প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা সেই মেয়েটিকে ওই ছোট্ট গ্রামের সবাই ভালোবাসতেন। তিনি যোগ না দিলে সব উৎসবই সেখানে ম্লান হয়ে যেত। মধ্যভারতের বীরগাথা ‘রাসো’তে অবশ্য নিন্নির সখী ‘লাখি’র কথাও পাওয়া যায়। সেই দুই সখী নিজেদের মধ্যে গলাগলি করে নির্ভয়ে ঘুরে বেড়াতেন। লাখি নিজের মন দিয়েছিলেন নিন্নির দাদা ‘অটল সিং’কে। রূপসী নিন্নির মন অবশ্য তখনও কোথাও বাঁধা পড়েনি। তারপরেই কোন একদিন ঘটে গিয়েছিল সেই ঘটনাটি।

সেদিন মানসিং গোয়ালিয়র থেকে কোন একটা কাজে বের হয়েছিলেন। মাত্র আঠারো মাইল পথ তাঁর শিক্ষিত ঘোড়া সহজেই পেরিয়ে গিয়েছিল। সাক নদীর ধারে, বনের মধ্যে পৌঁছেই রাজা চমকে উঠেছিলেন, তাঁর ঘোড়া সেখানেই থমকে দাঁড়িয়েছিল। নিন্নি তখন বনের মধ্যে তীর ধনুক নিয়ে বিদ্যুৎগতিতে একটি শিকারকে ধাওয়া করে এগিয়ে চলেছিলেন। মানসিংহ চুপ করে দাঁড়িয়ে সেই দৃশ্য দেখতে শুরু করেছিলেন। তারপরে নিন্নি যখন সুকৌশলে নিজের শিকারকে পরাস্ত করে ঘুরে দাঁড়িয়েছিলেন, মানসিংহের মুগ্ধ চোখে তখন ছিল শুধুই বিস্ময়। কে এই রূপসী? তন্বী, শ্যামা, সুকেশী, সুস্তনী যেন মুর্তিমতী গুর্জরী রাগিণী। তাঁর রাজঅন্তঃপুরে দু’শো জন রানী ছিলেন, তাঁদের মধ্যে প্রধানা রানী ছিলেন আটজন, তাঁদের সকলেই ছিলেন সদ্বংশজাতা ও অতিব সুন্দরী। কিন্তু অমন মেয়ে তো তিনি আগে কখনও দেখেননি। মেয়েটির পোশাক ছিল অতি সাধারণ রঙচঙে একটা ঘাঘরা ও কাঁচুলি, হাতে পায়ে ছিল সামান্য রুপোর গয়না। কালভুজঙ্গিনীর মতো তাঁর দীর্ঘ বেণীটির রুক্ষ, চূর্ণ কুম্ভলগুলি ঘামে ভিজে কপালে, গালে, পিঠে লেপটে গিয়েছিল। একটা ছোট্ট টিপ ছাড়া তাঁর মুখে প্রসাধনের অন্যকোন চিহ্নমাত্র ছিল না, কিন্তু তবুও মানসিং সেই অনন্ত যৌবনা মেয়েটিকে দেখে নিজের চোখের পলক ফেলতে পারেন নি। কিন্তু তিনি রাজা, তাই পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে তিনি বলে উঠেছিলেন, ‘শাবাশ, তোমার হাতের টিপ অসাধারণ।’ তাঁর প্রশংসা শুনে নিন্নির ভ্রুদুটো ধনুকের মতো বেঁকে উঠেছিল, চোখের পলকে সন্দেহ ফুটে উঠেছিল। কে এই সুদর্শন পুরুষ? যে-ই হোন না কেন, নিন্নি অত সহজে কাউকে ভয় পাওয়ার মত নারী ছিলেন না। কিন্তু তিনি কিছু বলবার আগেই শুনেছিলেন যে সেই রূপবান মানুষটি গভীর স্বরে তাঁকে বলছেন, ‘তোমাকে দেখেই আহত হয়েছি গুর্জরী, দৃষ্টি বাণে আর আমায় বিঁধো না। রাজহত্যার পাপ হবে যে!” যিনি রাজা! নিন্নি চমকে উঠেছিলেন। তারপরে তড়িঘড়ি নিজের হাতের শিকারটা মাটিতে নামিয়ে রেখে খাটো ওড়নাটা একটু টেনেটুনে চেহারায় সভ্য ভব্য ভাব আনবার একটা চেষ্টা করেছিলেন। বন্য হরিণীর টানা টানা চোখে তখন লজ্জার মায়াকাজল নেমেছিল। রাজার মনে হয়েছিল যে, তাঁর রাওলায় যে সৌন্দর্য বন্দী হয়ে নেই, সেই সৌন্দর্যই এই গুর্জরী মেয়েটির সর্বাঙ্গ দিয়ে উপচে পড়ছে। মেয়েটি প্রচলিত ধারার রূপসী হয়ত নয়, কিন্তু তাঁর ঘন অরণ্যের মতো নিবিড় চুল আর হরিণীর মতো কাজলটানা দুটি কালো গহিন চোখ ইতিপূর্বে রাজা কোথাও দেখেছেন বলে মনে করতে পারেন নি। এক অনাস্বাদিত পুলকে তাঁর মন ভরে উঠেছিল। তাঁর পরিচয় পেয়ে মেয়েটি ততক্ষণে মাথা নিচু করে তাঁকে বিনয়ের সঙ্গে জানিয়েছিল, ‘আমার নাম নিন্নি। এই নদীর ধারে রাই গ্রামেই আমার বাড়ি।’ … ‘বাড়িতে তোমার কে কে আছেন?’ … ‘আমার বাবা-মা নেই। পুরোহিতজী আমাদের মানুষ করেছেন।’ … ‘তোমাদের মানে?’ … ‘আমাকে আর আমার দাদা অটল সিংহকে।’ সেকথা শুনে মানসিংহ যেন হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিলেন। নিন্নি যদি অন্য কারোর হত, তাঁর হয়ত সেখানে তাঁর বুক ফেটে যেত। সেই আশঙ্কা দূর হওয়ার পরে তিনি সেখানেই নিজের মনের কথা বলে ফেলেছিলেন, ‘তোমাকে দেখেই আমি নিজেকে হারিয়েছি। নিন্নি তুমি কি আমাকে বিয়ে করবে?’ নিন্নি তাঁর প্রশ্নের কোন উত্তর দিতে পারেন নি। এমনিতেই তো কাউকে তাঁর মনে ধরত না। তবে সেদিন এক যাযাবরী তাঁর হাত দেখে বলেছিল বটে যে, নিন্নি একদিন রানী হবেন। কিন্তু সত্যিকারের কোন রাজা, বিশেষ করে অত রূপবান এক যুবক রাজা যে তাঁকে বিয়ে করতে চাইবেন, নিন্নি সেটা স্বপ্নেও ভাবেননি। তাই নিজের মনের খুশি মনে চেপে রেখেই, মুখে ছদ্ম রাগ ফুটিয়ে শিকারটি হাতে তুলে নিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি কি বলব? পুরোহিতজী আছেন … দাদা আছেন।’ মানসিংহ সেই ইঙ্গিত বুঝতে পেরে হেসে বলেছিলেন, ‘ঠিক আছে, আমি যাবো তোমাদের গ্রামে পুরোহিতজীর সঙ্গে দেখা করতে।’ তারপরে নিজের গ্রামের দিকে ফিরে যেতে যেতে নিন্নি বারবার পিছনে ফিরে তাকিয়েছিলেন। যতদূর গিয়েই তাঁকান না কেন, প্রত্যেকবার দেখতে পেয়েছিলেন যে, রাজা একইভাবে ঘোড়ার পিঠে বসে তাঁর দিকে তাকিয়ে ছিলেন। তাঁর নিজের মনটিও তখন যেন আর তাঁর নিজের কাছে ছিল না। সেই মুহূর্তে নিন্ন রাজাকে ভালোবেসে ফেলেছিলেন। তাঁর প্রিয় সখী লাখি শুধু জানতে পেরেছিলেন যে, তাঁর সখী বনে শিকার করতে গিয়ে সেখানেই নিজের মন হারিয়ে এসেছেন। যদিও নিন্নি একই সাথে আশঙ্কাতেও ছিলেন যে, রাজা শেষকালে তাঁকে ভুলে যাবেন না তো? তবে অতবড় ঘটনার পরেও তিনি আগের মতোই থেকে গিয়েছিলেন। কখনও বল্লম নিয়ে ঘোড়ার পিঠে চেপে বরাহ শিকার করতে ছুটতেন, তো কখনও আবার দুরন্ত উল্লাসে সাক নদীর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়তেন।
ঘটনার কয়েকদিন পরেই মানসিং রাই গ্রামে উপস্থিত হয়েছিলেন। সেদিন রাজা আসছেন খবর পেয়ে গ্রামের সবাই মন্দিরের সামনে জড়ো হয়েছিলেন। সেখানেই রাজা ঘোড়া থেকে নেমেছিলেন। তাঁকে দেখে গ্রামের মানুষের আনন্দ আর ধরছিল না। কিন্তু অত মানুষের মধ্যে রাজার ব্যাকুল চোখ দুটি যেন অবাধ্য হয়েই নিন্নিকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল। পুরোহিতজী যেন সেকথা বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, তাঁর শকুন্তলার জন্যই দুষ্মন্ত রাই গ্রামে এসেছেন। তাই নিজের পালিতা কন্যাকে তিনি মন্দিরে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। রাজার সঙ্গে নতুন করে তাঁর পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘নিন্নি হচ্ছে এই গ্রামের সেরা মেয়ে। ওর হাতে তীর ধনুক থাকলে শিকার হার মানবেই।’ মানসিং সেকথা জানতেন। শুধু হাতের তীর ধনুক দিয়ে নয়, নিন্নি তো নিজের নয়ন বাণেও তাঁকে বধ করে ফেলেছিলেন। আর সেজন্যই তো তিনি সেখানে গিয়েছিলেন। কিন্তু তখন সেকথা না বলে তিনি বলেছিলেন, ‘তাই নাকি? তা আমি সেই শিকার দেখবার সুযোগ পাব কি?’ তাঁর কথা শুনে গ্রামবাসীরা হৈহৈ করে উঠে বলেছিলেন, ‘নিশ্চই পাবেন। নিন্নি তো প্রতিদিনই শিকারে যায়।’ এরপরে নিন্নি একটি তীর আর ধনুক নিয়ে শিকারে বের হয়েছিলেন। অনেক খোঁজাখুঁজির পরে তিনি পড়েছিলেন একটি বুনো মোষের সামনে। কিন্তু হয় সেদিন তাঁর কপাল মন্দ ছিল, কিংবা মন চঞ্চল থাকবার জন্য তাঁর ছোঁড়া তীর লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছিল। ফলে বুনো মহিষটি সোজা তাঁর দিকেই তেড়ে এসেছিল। মুহূর্তের মধ্যেই নিন্নির চোখের সামনে মৃত্যুর ভীষণ ছায়া উঁকি দিয়ে গিয়েছিল। তারপরই তিনি নিজের দিকে ধেয়ে আসা সেই মহিষের শিং ধরে বনবিড়ালীর মতো ঝুলে পড়েছিলেন। উভয়ের মধ্যে সেই মরণপণ যুদ্ধ শেষ হয়েছিল মানসিংয়ের হস্তক্ষেপে। তিনিই নিন্নিকে সেদিন প্রাণে বাঁচিয়েছিলেন। একই সাথে সেদিন তিনি গ্রাম্য ভারতীয় নারীর এক নতুন রূপ দেখতে পেয়েছিলেন। ওই বীর্যবতী নারীর জন্য প্রমোদক্লান্ত পুরুষের মন ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল। তাই নিজের গলা থেকে মোতির মালা খুলে নিয়ে তিনি সবার সামনে নিন্নির হাতে তুলে দিয়ে বলেছিলেন, ‘আশা করি পুরোহিতজী একদিন এই মালা পরিয়ে দেওয়ার অনুমতি আমাকে দেবেন।’ তাঁর সেকথা শুনে রাই গ্রামের মানুষেরা সেদিন খুব খুশি হয়েছিলেন। অত বড় একজন রাজা যদি তাঁদের গ্রামের মেয়েকে জোর করে তুলে নিয়ে যেতেন, তাহলে তাঁরা কীই বা করতে পারতেন? পুরোহিতজী নিন্নির মাথায় হাত রেখে সস্নেহে বলেছিলেন, ‘বল নিন্নি তোর মনের কথা? মহারাজের প্রস্তাবে সম্মতি আছে তোর?’ তখন গুর্জরী সমাজে মেয়েরা স্বাধীন ছিলেন, নিজের পছন্দ অপছন্দের কথা তাঁরা নিজেরাই সবার সামনে বলতেন। সেই সময়ের রাজপুতানী কিংবা অন্যান্য উচ্চবর্ণের কন্যাদের মতো অভিভাবকদের পছন্দকে তাঁরা নীরবে স্বীকার করে নিতেন না। নিন্নি তো সেই প্রথম দেখার দিনটিতেই মানসিংকে নিজের মন দিয়েছিলেন, কিন্তু সে কথা তিনি গ্রামের সবার সামনে স্বীকার করতেন কী ভাবে? তাই পুরোহিতজীর কথার উত্তরে নিন্নি বলেছিলেন, ‘মহারাজ যদি আমার শর্তে রাজি হন তবেই আমি এই বিয়েতে সম্মতি দেবো।’ শঙ্কিত পুরোহিতজী প্রশ্ন করেছিলেন, ‘কি শর্ত?’ রাজার মনেও সেই একই প্রশ্ন ছিল। এই গ্রাম্য কিশোরী কি মৎস্যগন্ধার মতোই তাঁকে দিয়ে কোন কঠিন প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিতে চান? কিংবা তাঁর পাটরানির আসনটি অধিকার করতে চান? নিন্নি কিন্তু সে সবের ধার দিয়েও যাননি, তিনি বলেছিলেন, ‘আমার বিয়ে এই রাই গ্রামেই হবে। মহারাজকে বর সেজে আসতে হবে।’ তাঁর কথা শুনে দরিদ্র রাই গ্রামের অধিবাসীরা প্রমাদ গুনেছিলেন। নিন্নি কি জানেন না যে, রাজপুত রাজাদের বিয়েতে কনেই বরের বাড়িতে যায়। ওটাই সেদেশের নিয়ম। মানসিংহ অবশ্য নিন্নির কথা শুনে হেসে উঠে বলেছিলেন, ‘এই কথা। বেশ তাই হবে। আসব আমি বরের বেশে। এখন থেকেই বিয়ে করে নিয়ে যাবো রাই গ্রামের মেয়েকে।’ প্রজারা খুশিতে ধন্য ধন্য করে উঠেছিলেন। তাঁদের আদরের মেয়েটি গ্রামের নাম রেখেছে। রাজা যদি জোর করে নিন্নিকে সেদিনই নিজের সঙ্গে নিয়ে যেতে চাইতেন, তাঁকে বাধা দেওয়ার সাধ্য কি তাঁদের ছিল? এরপরে মানসিং গোয়ালিয়রে ফিরে নিজের মন্ত্রী, পাত্র-মিত্রদের ডেকে বলেছিলেন, ‘গোয়ালিয়র থেকে রাজধানী তুলে নিয়ে যেতে হবে রাই গ্রামে। আপনারা সেই ব্যবস্থা করুন।’ তাঁর কথা শুনে সবাই অবাক হয়েছিলেন। মন্ত্রী বলেছিলেন, ‘সে কি মহারাজ? সুরক্ষিত রাজধানী ছেড়ে সীমান্তের একটি গ্রামে …’ তিনি নিজের কথা শেষ করবার আগেই মানসিংহ হেসে বলেছিলেন, ‘মাত্র সাতদিনের জন্য।’ রাজার সেই হাসি দেখে মন্ত্রী কিছুটা হলেও ব্যাপারটা আন্দাজ করতে পেরেছিলেন। তাই তিনিও হেসে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘কেন মহারাজ?’ রাজা আরো রহস্যময় হাসি হেসে তাঁকে বলেছিলেন, ‘রাই গ্রামের রাজকন্যের হুকুম।’ মানসিং অন্য কারোর হুকুম মানবার পাত্র ছিলেন না। কিন্তু প্রেম অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারে। তাই সামান্য এক গ্রাম্য নারীর সামান্য ইচ্ছাপূরণের জন্য তিনি তাঁর গোটা রাজধানী রাই গ্রামে তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেই সঙ্গেই তিনি ইতিহাসের পাতায় ওই অখ্যাত গ্রামটিকে চিরকালের মতো বিখ্যাত করে দিয়েছিলেন।

আরো পড়ুন- বিশ্বের সবথেকে সুন্দর আর রঙীন গাছ

বিবাহের দিন নিন্নিকে তাঁর সখীরা গান গেয়ে গেয়ে সাজিয়ে দিয়েছিলেন। গান তো গুর্জরীদের জীবনের একটা অঙ্গ। রাই গ্রামে সেদিন আনন্দের ঢেউ উঠেছিল। পুরোহিতজী নিন্নির কপোতির মতো কোমল হাতটি মানসিংহের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। তখন থেকেই নিন্নি আর দুরন্ত গ্রাম্য কিশোরী থাকেন নি, তিনি হয়ে গিয়েছিলেন গোয়ালিয়রের রাজবধূ। এরপরে তাঁর নতুন নামকরণ হয়েছিল। হয়ত তাঁর রূপের সঙ্গে মিলিয়ে রাজাই সেই নাম রেখেছিলেন – ‘মৃগনয়না’ মতান্তরে ‘মৃগনয়ন’। আর সেই নামের আড়ালেই তখন থেকে চিরকালের মত হারিয়ে গিয়েছিল তাঁর নিজের আসল নামটি। রাজা মানসিং পেয়েছিলেন তাঁর প্রিয়তমাকে, আর মৃগনয়না পেয়েছিলেন তাঁর প্রেমাস্পদকে। তাঁদের দু’জনেরই মনে হয়েছিল যে, সেই পরম প্রাপ্তির পরে তাঁদের আর কিছুই চাওয়ার নেই। বিবাহের পরে তাঁরা প্রতিদিন প্রেমকে নতুন নতুন রূপে আবিষ্কার করেছিলেন। অবশেষে সাতদিন পরে মানসিং নববধূকে নিয়ে গোয়ালিয়রে ফিরে গিয়েছিলেন। হয়ত রাই গ্রাম ছাড়বার সময়েই তিনি অটল সিংয়ের হাতে নরবর দুর্গের ভার তুলে দিয়েছিলেন। বিদায়ের আগে গ্রামের সবাই চোখের জল মুছে তাঁদের সৌভাগ্যবতী মেয়েকে বলেছিলেন, ‘আমাদের ভুলে যেও না।’ প্রকৃতির কোলে বড় হওয়া মৃগনয়না শেষে রাজপুত রাওলায় গিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন। বনের পাখি খাঁচার পাখি হয়ে গোয়ালিয়রে এসেছিলেন। গোয়ালিয়রের রাজ অন্তঃপুরে তখন কড়া পর্দাপ্রথা থাকলেও রাজা জানতেন যে, মৃগনয়না সেই চার দেওয়ালের গণ্ডির মধ্যে বদ্ধ থাকতে পারবেন না। তাই তিনি তাঁকে বলে দিয়েছিলেন, ‘এখানকার রাওলার নিয়ম তোমায় মেনে চলতে হবে না। তোমার যেমন খুশি তেমনই থেকো।’ … ‘তাহলে কথা দাও, আমার কোন আচরণে অসন্তুষ্ট হলে সঙ্গে সঙ্গে আমাকে জানাবে। আমাদের মনে কোন আড়াল থাকবে না।’ মানসিংহ তাঁর কথায় চমৎকৃত হয়ে বলেছিলেন, ‘আর কেউ তো এমন কথা আমায় বলেনি। কেমন কথা তুমি কোথা থেকে শিখলে?’ … ‘মনের কথা মুখে বলছি। এ তো শেখানো বুলি নয় মহারাজ।’ … ‘ঠিক। তুমি শিক্ষা পেয়েছো প্রকৃতির কাছে। জীবনের কাছে। তোমার সঙ্গে কার তুলনা।’

কিন্তু রাজা যতই অনুমতি দিন না কেন, অন্তঃপুরের রানীরা কিন্তু মৃগনয়নাকে অত সহজে মেনে নিতে পারেন নি। যদিও রাজার রাওলায় থাকতেন দু’শো রানী, তাঁদের মধ্যে আটজন ছিলেন তাঁর প্রধান মহিষী। তাই নতুন আরেকজন রানীকে নিয়ে তাঁদের অত ভাবনা-চিন্তা করবার কোন দরকার ছিল না। কিন্তু তবুও মৃগনয়নাকে নিয়ে তাঁদের সকলেই মুখর হয়ে উঠেছিলেন। আসলে রাজার ঐসব রানীরা সকলেই কোন না কোন রাজপরিবার থেকে এসেছিলেন। তাঁরা সামান্যা একজন গ্রাম্য গুর্জরী নারীকে নিজের সমপর্যায়ভুক্ত করতে নারাজ ছিলেন। তাই মৃগনয়নার জন্য তাঁদের সকলেরই চোখেই ছিল অবজ্ঞা, মুখে ছিল ছিঃ ছিঃ। রানীদের মধ্যে মৃগনয়নার সাথে সবচেয়ে নিষ্ঠুর ব্যবহার করেছিলেন মানসিংহের তৃতীয় রানী। তিনি রূপসী এবং মানসিংহের প্রিয় স্ত্রী বলেই বোধহয় সেই নতুন রানীকে প্রতি পদে অপমান করবার একটা তীব্র আকাঙ্ক্ষা তাঁকে পেয়ে বসেছিল। মৃগনয়না অবশ্য কারোর সঙ্গেই খারাপ ব্যবহার করেন নি, তাঁদের দুর্ব্যবহারে তিনি দমেও যাননি। মেয়েমহলের ষড়যন্ত্রে কানও দেন নি। তিনি শুধু রাজার ভালোবাসায় নিজেকে শুধু উজাড় করে দেননি, তিনি মহারাজার শিল্পরুচির সঙ্গে তাঁর নিজস্ব কল্পনাকেও মিশিয়ে দিয়েছিলেন। গোয়ালিয়র রাজপ্রাসাদে আসবার সময়ে মৃগনয়না তাঁর নিজের সঙ্গে করে গুর্জরী রাগিণীর ঐশ্বর্য নিয়ে এসেছিলেন। সঙ্গীতরসিক রাজা তাঁর সেই গান শুনে মুগ্ধ হয়ে বলেছিলেন, ‘আমার সভাগায়ক বৈজনাথ নায়েককে তোমার গান শোনাবো। তিনি মস্ত বড় সুরসাধক।’ মৃগনয়না বলেছিলেন, ‘আমার গান শুধু তোমার জন্য। আমি তো ওঁদের মতো সঙ্গীতসাধনা করিনি।’ মানসিং তাঁর আপত্তি নাকচ করে দিয়ে বলেছিলেন, ‘তোমার গান তাঁকে হয়ত নতুন রাগ-রাগিণীর সন্ধান দেবে।’ তাঁর অনুমানই সত্যি হয়েছিল। মৃগনয়নার কণ্ঠ, মৃগনয়নার গান বৈজনাথকে প্রেরণা জুগিয়েছিল। ভারতের ইতিহাস তাঁকে ‘বৈজু বাওরা’ নামে চেনে। মৃগনয়নার মধ্যে বৈজনাথ মূর্তিমতী সঙ্গীতকে দেখতে পেয়েছিলেন। তাঁর কণ্ঠে টোরি গুর্জরী টোরি রাগিণীর মধ্যে নতুন রূপ পরিগ্রহ করেছিল। গুর্জরী রাগে শৃঙ্গার রসের প্রাধান্য দেখতে পাওয়া যায়। বৈজনাথ মঙ্গল ও কৌশিকী কানাড়াকেও মৃগনয়নার নামে বেঁধেছিলেন। ওদিকে গোয়ালিয়রের অন্দরমহলে সেসব নিয়ে কানাকানি ও ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছিল। রটে গিয়েছিল, মানসিংয়ের গুর্জরী রানী স্বেচ্ছাচারিণী। তিনি পরদা মানেন না। রাজার প্রেয়সী আবার কখনো গায়কের প্রেরণদাত্রী হতে পারে না কি? ও সবই ছলাকলা। গুর্জরীরা যাযাবর। তাঁরা বশীকরণ বিদ্যা জানে। সেই বিদ্যা দিয়েই মৃগনয়না রাজাকে বশ করে তাঁর সভা গায়কের সঙ্গে অবাধে মেলামেশার সুযোগ নিচ্ছেন। মৃগনয়না সব শুনতেন, কিন্তু তাতে কান দিতেন না। কখনও রাজার সভাগায়কের কণ্ঠে নতুন তিনি সাগ্রহে নতুন সুর শুনতেন, তো কখনও আবার তাঁকে তাঁদের পুরুষানুক্রমিকভাবে পাওয়া গুর্জরী রাগিণীর অপ্রচলিত কোন রূপ গেয়ে শোনাতেন। বৈজনাথ আবার সেই সুর ভেঙে গড়ে কোন নতুন রাগ সৃষ্টি করতেন। মধ্যভারতের রাগাশ্রয়ী সঙ্গীতে মৃগনয়নী নামের একটি স্বতন্ত্র রাগের খোঁজ পাওয়া যায়, মারবা ঠাটের অন্তর্গত সেই রাগ রাত্রির চতুর্থ প্রহরের বক্রগতির মিশ্ররাগ। কিন্তু শুধুই কি বৈজনাথ? ভারতীয় রাগপ্রধান সঙ্গীতের আশ্চর্য বালক ‘তানসেনের’ মধ্যে থাকা সুপ্ত প্রতিভার আবিষ্কর্ত্রীও তো মৃগনয়নাই ছিলেন। জনশ্রুতি রয়েছে যে, মাত্র দশ বছর বয়সে তানসেন গোয়ালিয়রে গিয়েছিলেন। তাঁর সঠিক জন্মসাল জানা যায় না, তবে প্রচলিত মত অনুসারে তিনি নাকি ১৫০৬ সালে জন্মেছিলেন। মানসিংয়ের রাজত্বকালের একেবারে শেষের দিকে তিনি গোয়ালিয়রে গিয়েছিলেন। গোয়ালিয়র রাজসভায় উপস্থিত হয়ে তিনি ধ্রুপদী আঙ্গিকে মৃগনয়নার বন্দনাগান রচনা করে শুনিয়ে সেখানে উপস্থিত সকলের প্রশংসালাভ করেছিলেন। মানসিং সঙ্গীতের সঙ্গে স্থাপত্যেও নিজের অসাধারণ আগ্রহের পরিচয় দিয়েছিলেন। যদিও স্থানীয় মানুষেরা বলেন যে, মহারাজ আসলে খুব বড় যোদ্ধা ছিলেন, মৃগনয়নাই তাঁকে শিল্পী করে তুলেছিলেন। আসলে মানসিং ভেবে পাচ্ছিলেন না যে, কিভাবে তিনি মৃগনয়নাকে সুখী করবেন। সেজন্য তিনি গোয়ালিয়রকে প্রাসাদ, মন্দির, উদ্যান দিয়ে স্বর্গের মত সাজিয়ে তুলেছিলেন। নতুন নতুন উপহার দিয়ে তিনি মৃগনয়নাকে সুখী করতে চেয়েছিলেন। তাঁর উপহারে খুশি হয়ে মৃগনয়না রাজাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন যে, কিভাবে পাথরে প্রাণের উষ্ণ স্পর্শ ফুটে উঠবে। কিভাবে ভাস্কর্য হয়ে উঠবে কবিতা। এরপরেই গোয়ালিয়র প্রাসাদে রানী মৃগনয়নার জন্য তৈরী করা হয়েছিল একটি অপরূপ মহল। সেটির নাম দেওয়া হয়েছিল – ‘গুর্জরীমহল’। মৃগনয়না পাথর ভালোবাসেন মৃগনয়না, তাই সেই মহলের সর্বত্র ছিল পাথরের কারুকাজ। ওই মহলটি সম্পূর্ণ হওয়ার পরে রাজা সেই মহলের সামনে তাঁর প্রিয়তমা রানীকে নিয়ে গিয়ে বলেছিলেন, ‘আজ থেকে এই মহল তোমার।’ … ‘আমার?’ … ‘হ্যাঁ। এই মহল আমি তোমার জন্য তৈরি করেছি। তোমার পছন্দ হয়েছে কি?’ … ‘অনবদ্য। কিন্তু আমার জন্য এত কেন? আমি তো আমার নিজের জন্য কখনো কিছু চাইনি মহারাজ।’ … ‘তুমি চাও না বলেই তো আমি বুঝতে পারি না যে তুমি কি চাও।’ … ‘আমার তো কিছু চাইবার নেই মহারাজ। তোমায় পেয়ে আমি সব কিছু পেয়েছি।’ হেসে হেসে বলেছিলেন মৃগনয়না। তারপরে গুর্জরীমহলের চারপাশ খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে বলেছিলেন, ‘ইস, এখানে যদি সাক নদী বইত তাহলে কি ভালোই না হত। আমি সেই জলে স্নান করতে পারতাম।’ মানসিং বলেছিলেন, ‘তাই হবে।’ মৃগনয়নার অন্ততঃ একটা সাধের কথা জানতে পেরে তিনি শান্তি পেয়েছিলেন। এরপরে দীর্ঘ আঠারো মাইল পাথুরে পথ কেটে রাই গ্রামের পাশ থেকে সাক নদীকে রাজা গোয়ালিয়রে নিয়ে এসেছিলেন, একেবারে গুর্জরীমহলের পাশে। তারপরে মৃগনয়নাকে গুর্জরীমহলে তুলে নিয়ে এসে তিনি নিশ্চিন্ত হতে চেয়েছিলেন। ইতিমধ্যে মৃগনয়না রাজাকে দুটি পুত্র উপহার দিয়েছিলেন। তাঁদের একজনের নাম ছিল ‘রাজসিং’, অপরজনের নাম ছিল ‘বলসিং’। আর তাতেই রাজার বড়রানীর মনের শান্তি আর রাতের ঘুম ঘুচে গিয়েছিল। তিনি মৃগনয়নাকে খুব ভয় পেয়েছিলেন। রাজা তাঁর কথায় উঠতেন বসতেন। মৃগনয়না নিশ্চই নিজের ছেলেদের জন্যই গোয়ালিয়রের সিংহাসনটি দাবি করবেন। তাহলে বড় রানীর ছেলে ‘বিক্রমাদিত্য’ কি পিতার সিংহাসনে আর কখনো বসতে পারবেন? কাজেই তিনি মৃগনয়নার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে শুরু করেছিলেন। প্রথমে রাজার কাছে মৃগনয়নাকে অবিশ্বাসিনী প্রমাণ করবার চেষ্টা করেছিলেন, সেই চেষ্টায় ব্যর্থ হওয়ার পরে তিনি মৃগনয়নাকে একেবারে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিলেন। রাজা সেই ষড়যন্ত্রে আভাস পেয়েই মৃগনয়নাকে ওই নতুন মহলে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। মৃগনয়না তাঁকে বলেছিলেন, ‘মহারাজ, মন্দির না হলে নগর মানায় না। কয়েকটা মন্দির তৈরি করতে হবে।’ … ‘তুমি যেমনটি বলবে তেমনই হবে।’ তারপরে একে একে তৈরি হয়েছিল ‘সহস্রবাহুর মন্দির’, ‘ত্রৈলোক্য মন্দির’ এবং আরো অনেক অপূর্ব সুন্দর। গোয়ালিয়রের প্রতিটি ঐতিহাসিক স্থাপত্যে আজও যেন মৃগনয়নার কোমল স্পর্শ লেগে রয়েছে। ইতিহাসও স্বীকার করে যে, মানসিং তাঁর প্রিয়তমা রানী মৃগনয়নাকে পাশে নিয়েই রাজধানী গোয়ালিয়রকে নতুন এক রূপ দিয়েছিলেন। দেখতে দেখতে গোয়ালিয়রে তৈরি হয়েছিল মানমন্দির, চিত্রশালা, সঙ্গীতমহল। আজও সেখানে কোথাও একা রাজা বা রানীর অস্তিত্ব নেই, সর্বত্র তাঁরা দু’জনে একত্রে, একসঙ্গে রয়েছেন। গোয়ালিয়র সেই যুগল প্রেমের স্রোতে ভেসে গিয়েছিল।
ওদিকে মৃগনয়নার বিরুদ্ধে অন্তঃপুরের ষড়যন্ত্র কিন্তু অব্যাহত ছিল। মানমন্দির প্রতিষ্ঠার দিন পানের মধ্যে সেঁকো বিষ দিয়ে মৃগনয়নাকে হত্যা করবার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু মৃগনয়না সে খবর আগেই পেয়েছিলেন, তাই ওই পান মুখে দিতে গিয়ে তিনি ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন। সেই খবরটা মানসিংয়ের কানে পৌঁছেছিল। তিনি বিস্মিত হয়ে দেখেছিলেন যে, মৃগনয়না একবারও তাঁর কাছে কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ জানান নি। কেন? তাহলে তিনি কি রাজাকেও সন্দেহ করেন? মানসিং সোজা গুর্জরীমহলে গিয়ে তাঁকে বলেছিলেন, ‘আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছি মৃগনয়না, সকলের হয়ে।’ … ‘কেন মহারাজ?’ তারপরে দুটি উদাস চোখ তুলে তাঁর দিকে তাকিয়ে গুর্জরী রানী বলেছিলেন ‘আমি তো আপনার কাছে কোন অভিযোগ জানাইনি।’ … ‘সে তোমার মহত্ত্ব। আমি জেনেছি অন্তঃপুরের ষড়যন্ত্রে তোমার প্রাণসংশয় হয়েছিল। মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেয়েছ। ক্ষমা করো তুমি ওদের।’ মৃগনয়না শুধু হেসেছিলেন। কোন উত্তর দেননি, অভিযোগও করেন নি। এমনকি কোন কৌতূহলও প্রকাশ করেন নি। মানসিং বিভ্রান্ত হয়ে সেখান থেকে ফিরে গিয়েছিলেন। এরপরেও কিন্তু ষড়যন্ত্র চলেছিল। তবে সেবার বড় রানী বিষ আর প্রয়োগ করে মৃগনয়নাকে হত্যা করবার কথা ভাবেন নি, তিনি সোজাসুজি মহারাজকে আর্জি জানিয়েছিলেন, ‘আপনি নিজের উত্তরাধিকারীর নাম ঘোষণা করুন।’ সেকথা শুনে রাজা ভ্রু কুঁচকে গম্ভীর স্বরে তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘কি বলতে চাও তুমি?’ … ‘সব মানুষই বয়স হলে নিজের উত্তরাধিকারীর কথা ভাবে। ঈশ্বর আপনাকে দীর্ঘজীবী করুন, কিন্তু আপনার পরে যে আপনার রাজ্য শাসন করতে পারবে, তাঁর নাম ঘোষণা করতে ক্ষতি কি?’ বিরক্ত হয়ে রাজা মানসিং তাঁকে বলেছিলেন, ‘আমার রাজ্য শুধু মৃগনয়নাই শাসন করতে পারে।’ তাঁর উত্তরটা এতটাই প্রাঞ্জল ছিল যে, বড়রানী আর কোন কথা বলতে পারেন নি। ওই খবরটা মৃগনয়নার কাছেও পৌঁছেছিল। তিনি রাজাকে নিজের মহলে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। রাজা সেখানে যাওয়ার পরে তিনি হাসতে হাসতে তাঁকে বলেছিলেন, ‘রাজ্যশুদ্ধু লোক কত কি বলছে। সত্যিই কি এসব তোমার নিজের কথা।’ … ‘সব কথাই সত্যি। যা শুনেছ, আমি তা-ই বলেছি।’ … ‘কি বলছো তুমি? আমি শুধু তোমার কল্পনার রূপকার মহারাজ। রাজ্যশাসনের আমি কি জানি? তোমার স্বপ্নই গোয়ালিয়র রাজ্যকে সুন্দর করেছে।’ … ‘সবই হয়েছে তোমার জন্য।’ মানসিং হেসে বলেছিলেন, ‘আমাকে স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছ তুমি। আমার স্বপ্নকে সাকার করেছ তুমি।’ … ‘তুমি বীর।’ … ‘আমি যোদ্ধা। পাথরের বুকে কবিতা লেখা আমার পক্ষে কোনদিনই সম্ভব হত না, যদি তুমি আমার পাশে না থাকতে।’ … ‘শুধু এটুকুই চাই মহারাজ।’ … ‘আরো অনেক বেশি যোগ্যতা তোমার আছে।’ তারপরেই হঠাৎ ভুলে যাওয়া একটা কথা মনে পড়ে যাওয়ার মতো মৃগনয়না বলে উঠেছিলেন, ‘যার জন্য তোমাকে নিমন্ত্রণ করেছি, সে কথাটাই বলতে ভুলে গিয়েছি। মহারাজ, চলো আমার চিত্রশালায়।’ … ‘নিশ্চই যাবো। তুমি যখন চিত্রশালায় নিয়ে যেতে চাইছ তখন নিশ্চই কোন দুর্লভ চিত্র সেখানে দেখতে পাবো।’ … ‘সেটা আগে বলব না।’ এরপরে রাজাকে নিয়ে মৃগনয়না গুর্জরীমহল সংলগ্ন চিত্রশালায় পৌঁছেছিলেন। সেখানে ছবি দেখতে দেখতে রাজার অনেকটা সময় কেটে গিয়েছিল। মানসিংহ মুখে যাই বলুন না কেন, তিনিও প্রকৃত শিল্পরসিক ছিলেন। তারপরে একটা সময়ে গুর্জরী রানী রাজার হাতে একটি তুলট কাগজের চিঠি তুলে দিয়েছিলেন। গোল করে পাকানো চিঠি। রাজা প্রথমে সেটাকে নতুন কোন ছবি ভেবেছিলেন, কিন্তু তারপরেই সেটাকে খুলে তিনি চমকে উঠেছিলেন। ওই চিঠির লেখা পড়ে তিনি নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছিলেন না, তাই আবার চিঠিটি পড়েছিলেন। তাঁর গুর্জরী রানী মৃগনয়না নিজের হাতে সেই চিঠিটি লিখেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, ‘চিরকালের প্রথা আমার জন্য বদলাতে পারে না। গোয়ালিয়রের মহারাজার অভিলাষ যাই হোক, আমার সিদ্ধান্ত যে, আমার পুত্র রাজসিং বা বলসিং কোনদিনই গোয়ালিয়র রাজ্যের সিংহাসনে বসবার অধিকারী হবে না। সেই অধিকার একমাত্র মহারাজা মানসিংয়ের জ্যেষ্ঠা মহিষীর জ্যেষ্ঠপুত্র বিক্রমাদিত্যের।’ মানসিং চিঠিটি আরো কয়েকবার পড়ে মৃগনয়নার দিকে তাকিয়েছিলেন। তাঁর সেই দৃষ্টিতে শুধু বিস্ময় আর প্রেম নয়, প্রগাঢ় শ্রদ্ধাও মিশে ছিল। এই আশ্চর্য নারী কি করে জানল যে ভিতরে ভিতরে তিনি ভাবনা ও চিন্তায় ক্ষয়ে যাচ্ছিলেন! একদিকে চিরকালের নিয়মের অপমান করা, আর অন্যদিকে বড়-রানীর ষড়যন্ত্র; নিরপরাধ বিক্রমকে পিতার সিংহাসন থেকে বঞ্চিত করতে তাঁর নিজের মনও সায় দেয়নি, অথচ তিনি মৃগনয়নাকেও সুখী করতে চেয়েছিলেন। যদিও মৃগনয়না তাঁর নিজের ছেলেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনদিন কোন কথাই তাঁকে বলেননি। তিনি প্রশ্ন করেছিলেন, ‘সত্যই কি এই তোমার মনের কথা?’ মৃগনয়না বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ। এর প্রতিলিপি এতক্ষণে বড়রানীও পেয়ে গিয়েছেন।’… ‘কিন্তু কেন? তোমার সাজানো রাজ্যপাটে নিজের ছেলেকে তুমি কেন বসাতে চাও না?’ … ‘আমি যা কিছু করেছি মহারাজ, তোমাকে ভালোবেসেই করেছি। তোমার কল্পনাকে আমি নিজের সাধ্যমত রূপ দিয়েছি। সেটা আমার ছেলেদের ভবিষ্যৎ গড়বার জন্য নয়।’ … ‘আমিও তো তোমায় ভালোবেসেই …’ … ‘মহারাজ, আমি তোমাকে সবরকমের চিন্তা, পারিবারিক ষড়যন্ত্র, এবং সব ধরনের অন্যায় কর্ম থেকেও মুক্ত রাখতে চাই। তাই আমি এই সিদ্ধান্ত স্বেচ্ছায় এবং সানন্দে নিলাম।’ আর কোন কথা বলতে না পেরে মানসিং দু’হাতে মৃগনয়নাকে নিজের বুকের মধ্যে টেনে নিয়েছিলেন।
কেউ কেউ বলেন যে, মৃগনয়না নাকি তাঁর ছেলেদের নিজের সমাজে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। তারপরে নিজেও একদিন রাজ্যসমেত সকলকে কাঁদিয়ে বিদায় নিয়েছিলেন। তবে তাঁর সেই স্বেচ্ছানির্বাসন নিশ্চই মানসিংহের মৃত্যুর আগে ঘটেনি। পার্থিব জীবনে কেউ কোনদিন তাঁদের বিচ্ছেদ ঘটাতে পারেন নি। মধ্যভারতের কবিরা কখনোই সেসব দিনের কথা ভুলতে পারেন নি। তাই ইতিহাস তেমনভাবে মনে না রাখলেও, তাঁরা কিন্তু সেই আশ্চর্য রানীকে মনে রেখেছিলেন। আজও শুধু সাক নদী নয় ঐতিহাসিক গোয়ালিয়র দুর্গও রাজা মানসিং ও মৃগনয়নার প্রেমের গল্প শোনায়। নিঃস্বার্থ প্রেম আত্মত্যাগ করতে শেখায়।

(তথ্যসূত্র:
১- The Glory of Gwalior, CHOB SINGH VERMA.
২- History of the Fortress of Gwalior, Balwant Row Bhaiyasaheb.
৩- Gwalior, Scindias & Their Sardār Oligarchs, A. R. Rajwade.
৪- Tomar Architecture of Gwalior (1486-1526 A.D): Potential Precursor to Mughal Architecture, Prof. R. Nath.
৫- Dhrupad: tradition and performance in Indian music, Ritwik Sanyal & Richard Widdess.
৬- Gwalior Fort: Art, Culture, and History; Kalyan Kumar Chakravarty.)

বিশ্বের সবথেকে সুন্দর আর রঙীন গাছ

পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর এবং রঙিন গাছটির নাম রেইনবো ইউকালিপটাস। মিন্দানাও গাম বা রেইনবো গাম নামেও পরিচিত এই ইউক্যালিপটাস।

দেখে মনে হবে যেন রঙধনুর সাতটি রঙে গড়া এই গাছ। এই গাছের দেখা মেলে প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপ নিউ ব্রিটেন,পাপুয়া নিউগিনি সেরাম , সুলাবেসি এবং মিন্দানাওতে।

ঐ সমস্ত এলাকায় এই অসম্ভব আকর্ষণীয় এবং বর্ণিল গাছগুলির বনে গেলে চোখ ফেরানো দায় হয়ে যাবে।

এই গাছের বাকলগুলো নীল, বেগুনী , কমলা এবং মেরুন রঙের সন্নিবেশে গড়া।

কাগজের মণ্ড তৈরিতে ব্যবহৃত এই গাছের বনায়ন উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই গাছের মণ্ড দিয়ে সবচেয়ে বেশী কাগজ তৈরি করে ফিলিপাইন।

আজ পল্লীকবি জসীমউদ্দিন এর ১২০- তম জন্মদিনে জানাই শ্রদ্ধাঞ্জলি

জসীমউদ্দীন একজন বিখ্যাত বাঙালি কবি। তিনি বাংলাদেশে ‘পল্লীকবি’ হিসেবে পরিচিত। তার লেখা ‘কবর’ কবিতাটি বাংলা সাহিত্যে এক অবিস্মরণীয় অবদান। পুরো নাম জসীমউদ্দীন মোল্লা হলেও তিনি জসীমউদ্দীন নামেই পরিচিত। ১৯০৩ সালের ১ জানুয়ারি ফরিদপুর জেলার তাম্বুুলখানা গ্রামে মাতুলালয়ে তার জন্ম। পৈতৃক নিবাস একই জেলার গোবিন্দপুর গ্রামে। পিতা আনসারউদ্দীন মোল্লা ছিলেন একজন স্কুলশিক্ষক। শৈশবে ফরিদপুর হিতৈষী স্কুলে জসীমউদ্দীনের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয়। তারপর ফরিদপুর জিলা স্কুল থেকে প্রবেশিকা (১৯২১), রাজেন্দ্র কলেজ থেকে আইএ (১৯২৪) ও বিএ (১৯২৯) এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলাভাষা ও সাহিত্যে তিনি এমএ (১৯৩১) পাস করেন।

জসীমউদ্দীনের কর্মজীবন শুরু হয় পল্লীসাহিত্যের সংগ্রাহক হিসেবে। স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে অধ্যয়নকালে দীনেশচন্দ্র সেনের আনুকূল্যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক এ কাজে তিনি নিযুক্ত হন। এমএ পাস করার পর থেকে ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত তিনি ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে দীনেশচন্দ্র সেনের অধীনে রামতনু লাহিড়ী গবেষণা সহকারী ছিলেন। ১৯৩৮ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে লেকচারার পদে যোগদান করেন। এখানে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত চাকরি করার পর ১৯৪৪ সাল থেকে তিনি প্রথমে বঙ্গীয় প্রাদেশিক সরকার এবং পরে পূর্ব পাকিস্তান সরকারের প্রচার বিভাগের কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬২ সালে এখান থেকে ডেপুটি ডাইরেক্টর হিসেবে অবসর গ্রহণ করে তিনি ঢাকার কমলাপুরে নিজ বাড়িতে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন।

জসীমউদ্দীনের কবিত্ব শক্তির প্রকাশ ঘটে ছাত্রজীবনেই। তখন থেকেই তিনি তার কবিতায় পল্লীপ্রকৃতি ও পল্লীজীবনের সহজ-সুন্দর রূপটি তুলে ধরেন। পল্লীর মাটি ও মানুষের সঙ্গে তার অস্তিত্ব যেন মিলেমিশে এক হয়ে গিয়েছিল। কলেজজীবনে ‘কবর’ কবিতা রচনা করে তিনি বিপুল খ্যাতি অর্জন করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালেই তার এ কবিতাটি প্রবেশিকা বাংলা সংকলনের অন্তর্ভুক্ত হয়। কবি হিসেবে এটি তার এক অসামান্য সাফল্য। তার সাহিত্যের নানা শাখায় কাজ করেছেন, যেমন গাথাকাব্য, খণ্ডকাব্য, নাটক, স্মৃতিকথা, শিশুসাহিত্য, গল্প-উপন্যাস ইত্যাদি। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘রাখালী’ প্রকাশিত হয় ১৯২৭ সালে।

তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হলো : নকশীকাঁথার মাঠ (১৯২৯), সোজন বাদিয়ার ঘাট (১৯৩৩), রঙিলা নায়ের মাঝি (১৯৩৫), মাটির কান্না (১৯৫১), সুচয়নী (১৯৬১), পদ্মা নদীর দেশে (১৯৬৯), ভয়াবহ সেই দিনগুলিতে (১৯৭২), পদ্মাপার (১৯৫০), বেদের মেয়ে (১৯৫১), পল্লীবধূ (১৯৫৬), গ্রামের মায়া (১৯৫৯), ঠাকুর বাড়ির আঙিনায় (১৯৬১), জার্মানীর শহরে বন্দরে (১৯৭৫), স্মরণের সরণী বাহি (১৯৭৮), বাঙ্গালীর হাসির গল্প, ডালিম কুমার ইত্যাদি। তার রচিত বাঙ্গালীর হাসির গল্প (দুই খণ্ড, ১৯৬০ ও ১৯৬৪) ও বোবা কাহিনী (১৯৬৪) উপন্যাসটি সুখপাঠ্য।

জসীমউদ্দীন জারিগান (১৯৬৮) ও মুর্শীদ গান (১৯৭৭) নামে লোকসংগীতের দুখানি গ্রন্থ সংকলন ও সম্পাদনা করেন। ১৯৬৮ সালে তার সম্পাদনায় কেন্দ্রীয় বাঙলা উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক প্রকাশিত হয় জারিগান। জারিগান একান্তভাবেই বাংলাদেশের নিজস্ব সৃষ্টি। এ গ্রন্থে জারিগানের মোট ২৩টি পালা সংকলিত হয়েছে। গ্রন্থের ভূমিকায় জসীমউদ্দীন জারিগানের উৎস এবং বিভিন্ন এলাকার জারিগানের বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেন। দ্বিতীয় গ্রন্থটি তার মৃত্যুর পরে প্রকাশিত হয়।

তার নকশীকাঁথার মাঠ কাব্যটি দি ফিল্ড অব এমব্রয়ডার্ড কুইল্ট এবং বাঙ্গালীর হাসির গল্প গ্রন্থটি ফোক টেল্স অব ইস্ট পাকিস্তান নামে ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে। বাংলা কবিতার ধারায় জসীমউদ্দীনের স্থানটি বিশিষ্ট। তার কবিতা অনাড়ম্ব্বর কিন্তু রূপময়। গ্রামবাংলার ঐতিহ্য ও লোকজীবন জসীমউদ্দীনের কবিতায় নতুন রূপ লাভ করেছে।

বাংলাদেশের মানুষের সুখ-দুঃখ, হাসিকান্না ও জীবন সংগ্রামের কাহিনীই তার কবিতার প্রধান উপজীব্য। জসীমউদ্দীন প্রেসিডেন্টের প্রাইড অব পারফরমেন্স পুরস্কার (১৯৫৮), রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানসূচক ডক্টর অব লিটারেচার ডিগ্রি (১৯৬৯), বাংলাদেশ সরকারের একুশে পদক (১৯৭৬) ও স্বাধীনতা দিবস পুরস্কারে (মরণোত্তর, ১৯৭৮) ভূষিত হন। তিনি ১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কারের জন্যও মনোনীত হয়েছিলেন, কিন্তু তা প্রত্যাখ্যান করেন।

১৯৭৬ সালের ১৩ মার্চ তিনি ঢাকায় মারা যান।

পৃথিবীর এমন একটি জায়গা, যেটি ৬ মাস এক দেশে, ৬ মাস অন্য দেশে! বদলে যায় আইনও

এত বৃহৎ পৃথিবীতে রহস্য রোমাঞ্চের শেষ নেই। কোনো জায়গায় ছোট্ট একখানা জমির জন্য লড়াই চলে, তো কখনো একটা গোটা দেশকেই গ্রাস করে নেয় আগ্রাসী শক্তি। তবে আজ আমরা এমন এক জায়গার কথা বলবো যেখানে ৬-৬ মাস করে সরকার চালায় দুই দেশ! হ্যাঁ, এমনও জায়গা রয়েছে বিশ্বে। ইউরোপে অবস্থিত এই বিশেষ জায়গাটি অবস্থিত ফ্রান্স ও স্পেনের সীমান্তে। সেখানে দুই দেশই ৬-৬ মাস করে নিজেদের সরকার চালায়। মজার ব্যাপার হলো দুই দেশেরই সম্মতি রয়েছে এ ব্যাপারে।

আরো পড়ুন- এই ৫টি খাবার আপনার যৌন ক্ষমতা দশ গুণ বাড়িয়ে তুলবে

কোনো রক্তক্ষয়ী, প্রাণনাশি যুদ্ধ ছাড়াই একে অপরের সাথে মিলেমিশে ফ্রান্স এবং স্পেন দুজনে মিলে সরকার চলায় ফিজান্ট নামের একটি দ্বীপে। বছরের ১লা ফেব্রুয়ারি থেকে ৩১শে জুলাই অবধি দ্বীপটির মালিকানা থাকে থাকে স্পেনের কাছে। এরপর ১লা আগস্ট থেকে ৩১ শে জানুয়ারি অবধি ফ্রান্স নিয়ন্ত্রণ করে এই দ্বীপটি।

বিগত ৩৫০ বছর ধরে উভয় দেশ এই রীতি মেনে চলেছে। দুই দেশের সীমান্তের মাঝে বয়ে চলেছে বিদাসোয়া নামের একটি নদী। নদীর ওপর রয়েছে এই বিশেষ দ্বীপ। ফিজান্ট নামের এই দ্বীপে কেও বসবাস করেন না। দ্বীপে ফরাসি এবং স্প্যানিশ, উভয় বাহিনীর জওয়ানরাই অবস্থান করছে সেখানে।

দ্বীপের ওপর একটি ঐতিহাসিক ভবনও নির্মিত হয়েছে। এই দ্বীপের মালিকানা নিয়ে দুই দেশের মধ্যে চুক্তি হয় ১৬৫৯ সালে। আরো অবাক করা বিষয় এই যে, এক রাজকীয় বিয়ের মাধ্যমে এই চুক্তি সম্পন্ন হয়। স্পেনের রাজা চতুর্থ ফিলিপ বিয়ে করেন ফরাসি রাজা লুই চতুর্দশের কন্যাকে। তখন এই দ্বীপ নিয়ে দুদেশের বিরোধীতার শেষ হয়। প্রসঙ্গত একই দ্বীপে উভয় দেশের শাসনকে বলা হয় কনডমিনিয়াম।

দ্বীপটি অবশ্য আকার আয়তনে খুবই ছোট। ২০০ মিটার লম্বা এবং ৪০ মিটার চওড়া দ্বীপ নিয়ে উদ্বিগ্ন দুই দেশের স্থানীয় জনগণ। নদী বক্ষে ডুবতে বসেছে দ্বীপটি। যদিও দুদেশের সরকার এক টাকাও খরচ করতে রাজি নয় দ্বীপটিকে বাঁচিয়ে রাখতে।

‘বাংলা সাহিত্যের অভ্যুদয়’

রানা চক্রবর্তীঃ ভাষার জন্ম হয় দেশের মাটিতে। মানুষের অলক্ষ্যে জলবায়ুসহ সে মাটি যেমন নিয়ত পরিবর্তিত হয়, তেমনি ভাষাও পরিবর্তিত হয়। পৃথিবীর প্রতিটি ভাষা থেকে কত শব্দ অহরহ লোপ পাচ্ছে, আবার কত নতুন নতুন শব্দ এসে জায়গা করে নিচ্ছে। ভাষার প্রকাশ ভঙ্গিরও ক্রমাগত বদল ঘটছে। কোথা থেকে এই শব্দসম্ভার আসে, বা কেমন করে পুরানো শব্দগুলি অচল হয়ে যায় – এই প্রশ্নের জবাব কেউ দিতে পারেন না। বৈয়াকরণরা এসব নিয়ে মাথা ঘামান, কিন্তু তরঙ্গের গতি রোধ করবার সাধ্য তাঁদেরও নেই। নতুন মৌলিক শব্দ সৃষ্টির সাধ্যও কারো নেই। সেগুলো নিজে থেকেই সৃষ্ট হয়। পৃথিবীর সর্বদেশে সর্বকালে এই চলমান ভাষা সাহিত্যের ভিতর দিয়েই ফলেফুলে বিকশিত হয়। প্রাচীন ভারতের শিক্ষিত পণ্ডিত ব্যক্তিরা সংস্কৃত ভাষায় কথা বলতেন, তাই ওই ভাষাতেই তাঁদের, তথা বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন গ্রন্থ বেদ রচিত হয়েছিল। চার খণ্ডে সমাপ্ত সেই বিরাট গ্রন্থের ভাষা ছিল আদিযুগীয় সংস্কৃত। এর কয়েক শতাব্দী পরে উপনিষদের যুগে পৌঁছে দেখা গিয়েছিল যে, সংস্কৃতর রূপ ঈষৎ পরিবর্তিত হয়েছে, ঋষিদের চিন্তাধারা আরো গভীরতর হয়েছে। বিশ্বপ্রকৃতির বর্ণনা প্রসঙ্গে তাঁরা বলেছিলেন, “সূর্য্য সেখানে কিরণ দেয় না, চন্দ্র-তারকা অগ্নি-বিদ্যুৎও কিরণ দেয় না; তিনি আলোক বিকীরণ করলে তবেই তারা আলোকিত হয়। সেই অমর ব্রহ্ম তোমার সম্মুখে পশ্চাতে দক্ষিণে বামে বিদ্যমান রয়েছেন।” –
“ন তত্র সূৰ্য্যো ভাতি ন চন্দ্রতারকং নেমা বিদ্যুতো ভান্তি কুতোহয়মগ্নিঃ।
তমেব ভান্তিমনুভাতি সর্বং তস্য ভাসা সর্বমিদং বিভাতি৷৷”
(মুণ্ডকোপনিষদ, ১১)
উপনিষদের দর্শন চার হাজার বছর পরে জার্মানীতে পৌঁছে ‘Schlegel’ ও ‘Schopenhaur’ সহ সমগ্র বিদগ্ধ সমাজের জীবনদর্শন বদলে দিয়েছিল। সেখান থেকে ওই মহাগ্রন্থ ইংল্যাণ্ডে গিয়ে ‘Carlyle’, ‘Coleridge’, ‘Shelley’, ‘Wordsworth’ প্রভৃতি মনীষীদের চিন্তাধারাকে প্রভাবিত করেছিল; আমেরিকায় গিয়ে ‘Emerson’, ‘Thoreau’ সহ বহু চিন্তানায়ককে নতুন আলোকের সন্ধান দিয়েছিল। এইভাবে উপনিষদ সারা বিশ্বকে আলোকিত করলেও সেটির ভাষা কিন্তু জার্মান বা ইংরাজী ছিল না, ছিল আদিযুগীয় সংস্কৃত। সে যুগের পণ্ডিতেরা যে ভাষাতে কথা বলতেন, উপনিষদের ঋষিরা সেই ভাষাতেই তাঁদের সাহিত্য সৃষ্টি করেছিলেন। সংস্কৃত কোনদিন প্রাচীন ভারতের সাধারণের কথ্য ভাষা ছিল কিনা, তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে পরস্পরবিরোধিতা রয়েছে। তবে একথা ঠিক যে, সংস্কৃত ভাষায় যদি বৈদিক যুগের জনসাধারণ তাঁদের নিজেদের মধ্যে ভাবের আদান প্রদান একেবারেই না করতেন, তাহলে এর ভিতর দিয়ে সেই মহান সাহিত্যের বিকাশ কখনোই সম্ভব হত না। কারণ, কল্পনায় গড়া শব্দ ও ‘empirical’ ব্যাকরণ দিয়ে একটি আস্ত গ্রন্থ রচনা করা তো দূরের কথা, একটি ছোট বাক্য রচনা করাও সম্ভব নয়। সেকাজ করবার মত যদি তেমন কোন শক্তিধর থাকেন, তাহলে তাঁর জায়গা ঈশ্বরের পাশে হবে। সুদূর অতীতের একটা সময়ে সংস্কৃতের প্রভাব সীমান্তের ওপারেও ছড়িয়ে পড়েছিল বলে পার্শীদের ধর্মগ্রন্থ ‘আবেস্তা’র গাথাগুলিতে বৈদিক যুগীয় সংস্কৃত ও বৈদিক আচারের প্রাধান্য দেখতে পাওয়া যায়। সময়ের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে বৈদিক সংস্কৃতেরও রূপের পরিবর্তন ঘটেছিল, কারণ আর্যদের কথ্য ভাষারও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদল ঘটেছিল। তাই বেদোত্তর যুগে কপিল মুনি রচিত ‘সাংখ্যদর্শনের’ ভাষা কিছুটা স্বতন্ত্র ছিল, রামায়ণ-মহাভারতের যুগে পৌঁছে সেই ভাষা আরও স্বতন্ত্র হয়েছিল। তার পরবর্তী যুগে রচিত ‘ভাগবদ্গীতা’র সংস্কৃত বেশ সরল ও সহজবোধ্য। অতীতে মানুষের জীবনযাত্রাকে নিয়ন্ত্রণের জন্য মনু, পরাশর, যাজ্ঞবল্ক্য প্রভৃতি যে স্মৃতিগ্রন্থগুলি রচনা করেছিলেন, সেগুলির ভাষা গুরুগম্ভীর। ওই সময়ে রচিত বিজ্ঞান, গণিত ও জ্যোতিষের ভাষাও তাই। কিন্তু জনসাধারণের জন্য লিখিত ‘পঞ্চতন্ত্র’ ও ‘হিতোপদেশের’ গল্পগুলির ভাষা সাবলীল। সেই সব গল্প পরে বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে নতুন নতুর সাহিত্যের সৃষ্টি করেছিল। অনেকের মতেই ‘Aesop’s Fables’-এর গল্পগুলি সেই দুই পুস্তক থেকে সংগৃহিত করা হয়েছিল, তবে ইউরোপ পৌঁছে জন্তুগুলির অবয়ব বদলে গিয়েছিল। ভারতের শিয়াল হয়েছিল গ্রীসের খ্যাঁকশিয়াল! ‘কথাসরিৎসাগরের’ প্লটগুলি সর্বদেশের সাহিতের পুষ্টি জুগিয়েছিল। শেক্সপিয়ার লিখিত ‘মার্চেন্ট অফ ভেনিস’ নাটকের বণিককের নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী আন্টোনিওর বুক থেকে এক পাউণ্ড মাংস তুলে নেওয়ার কাহিনীর সাথে ‘শিবি রাজা’র উপাখ্যানের আশ্চর্জ্জনক মিল খুঁজে পাওয়া যায়। এরপরে নন্দ যুগে পৌঁছে সংস্কৃতর রূপের আরো বদল ঘটেছিল; কারণ, তখন লোকের কথ্য ভাষা বদলে গিয়ে নতুন রূপ পরিগ্রহ করেছিল। তাই পাণিনিকে তাঁর ‘অষ্টাধ্যয়ী’ রচনায় জন্য যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছিল। সেই যুগে রাজনীতি নিয়ে লিখিত কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্রের’ ভাষা বলিষ্ঠ, আবার তখনকার জনসাধারণকে জ্ঞানদানের জন্য সেই একই লেখক যে নীতিমালার রচনা করেছিলেন, সেটির ভাষা কত সরল! নীতিসারে তিনি বলেছিলেন – “যে দেশে লোকে তোমাকে সম্মান করে না, যেখানে বৃত্তির অভাব, বন্ধু বলতে কেউ নেই বা কৃষ্টিবান লোক নিয়ে যেখানকার সমাজ গঠিত নয়, সে দেশ তুমি অবশ্য‍ই পরিত্যাগ করবে।”
“যস্মিন্ দেশে ন সম্মানো ন রতিন চ বান্ধবঃ।
ন চ বিদ্যাগমঃ কশ্চিৎ ত দেশং পরিবজ্জয়েং॥”
নন্দ যুগ থেকে মৌগ্যযুগের ব্যবধান খুব একটা বেশী কিছু ছিল না, কিন্তু সে যুগে পৌঁছে দেখা গিয়েছিল যে, রাজসভায় ও বিদগ্ধ সমাজে সংস্কৃত ভাষার আগের মর্যাদা অক্ষুণ্ণ থাকলেও মগধের জনসাধারণের কথ্যভাষা কিন্তু বহু আগে থেকেই, শিশুনাগ বংশীয় রাজাদের সময়েই, ‘পালি’তে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। পালি ছিল জনগণের প্রকৃত – তাই ‘প্রাকৃত’ ভাষা সংস্কৃতের মত ‘classical’ ভাষায় ধর্মাচার্য্যদের চলত না বলে তাঁরা জনসাধারণকে সেই প্রাকৃতেই নিজেদের ধর্মকথা শোনাতেন। গৌতম বুদ্ধের মহাপ্রয়াণের পরে শিষ্যমণ্ডলী তাঁর বাণীগুলিকে সংগ্রহ করে যে ‘ত্রিপিটক’ রচনা করেছিলেন, সেটির ভাষা ছিল পালি ৷ ধম্মপদে বুদ্ধ তাঁর শিষ্যদের সম্বোধন করে বলেছিলেন, “কিসের হাসি? কি আনন্দ এই জগত যখন নিয়ত পুড়ে যাচ্ছে? অন্ধকারে আচ্ছন্ন থেকে প্রদীপের সন্ধান করবে না? জ্ঞানাভাবে গৃহকারকের সন্ধানে আমি বহু জন্ম অতিক্রম করেছি; পুনঃপুনঃ জন্মগ্রহণ দুঃখ। কিন্তু, গৃহকারক! এইবার তুমি ধৃত হয়েছ, আর তুমি গৃহ নির্মাণ করতে পারবে না। তোমার পর্শুকাসমূহ ভগ্ন ও গৃহকূট বিদীর্ণ হয়েছে। আমার চিত্ত নির্বাণগত, তৃষ্ণা ক্ষয়প্রাপ্ত।”

“কো নু হাসো কিমানন্দো নিচ্চং পজ্জ্বলিতে সতি।
অন্ধকারেন ওনদ্ধা পদীপং ন গবেথ॥ ১১।১
অনেক জাতিসংসারং সংধাবিস্সং অনিব্বিসং।
গহকারকং গবেসন্তো দুক্খা জাতি পুনপ্প নং॥ ১১।৮
গৃহকারক দিটঠোসি পুন গেহং ন কাহসি।
সব্বা তে ফাসুকা ভগ্‌গা গহকূটং বিসংখিতং।
বিসংখারগতং চিত্তং তহ্নানং খয়মাগা॥ ১১।৯”
এর দুই শতাব্দী পরেও পালি ভারতে একটি সজীব ভাষা ছিল, অশোকের শিলালিপিগুলি পালিতে লিখিত হয়েছিল। কিন্তু আরো দু’শো বছর পরে, কংসপাত্রের আঘাতে মৃৎপাত্রে ফাটল ধরেছিল, তখন পালিকে কোণঠাসা করে সংস্কৃত আবার মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল। কুষাণ বংশীয় শ্রেষ্ঠ সম্রাট কনিষ্কের উদ্যোগে যে তৃতীয় বৌদ্ধ-সঙ্গীতির অধিবেশন আয়োজিত হয়েছিল, তাতে নাগার্জুনের নেতৃত্বে মহাযানপন্থীরা পালি ভাষার আশ্রয় ছেড়ে দিয়ে সংস্কৃতকে গ্রহণ করে নিয়েছিলেন। অশ্বঘোষের ‘বুদ্ধচরিত’ গ্রন্থটি সুললিত সংস্কৃতে রচিত হয়েছিল। সেই সময়ে রচিত ‘সদ্ধর্মপুণ্ডরীকাক্ষ’, ‘ললিতবিস্তার’ প্রভৃতি বৌদ্ধ গ্রন্থগুলির ভাষাও সংস্কৃত। মহাযানপন্থীরা কনিষ্কের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করবার ফলে বিশাল কুষাণ সাম্রাজ্যের সর্বত্র ওই মত প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে সংস্কৃত সাহিত্যও ছড়িয়ে পড়েছিল। ওই ভাবে সংস্কৃত ভাষার আধিপত্য তখন পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বটে, কিন্তু সেটির রূপ যে তখনও প্রতিনিয়ত বদল হচ্ছিল, বিভিন্ন সময়ে রচিত গ্রন্থগুলি পাঠ করলেই সেকথা বুঝতে পারা যায়। এরপরে গুপ্তযুগে সংস্কৃত ভাষার প্রাণশক্তি সারা বিশ্বকে উদ্ভাসিত করেছিল, কিন্তু সেটির রূপ বৈদিক যুগের ভাষা থেকে স্বতন্ত্র ছিল। শুদ্রকের ‘মৃচ্ছকটিক’ বা কালিদাসের ‘মালবিকাগ্নিমিত্র’ ও ‘অভিজ্ঞানশকুন্তলম’ প্রভৃতি নাটকের ভিতরে সে যুগের কথ্য ভাষারও কিছু কিছু নিদর্শন দেখতে পাওয়৷ যায়। সপ্তম শতাব্দীতে রচিত ভবভূতির ‘উত্তররামচরিত’ বা শ্রীহর্ষের ‘রত্নাবলী’র ভাষাও যথেষ্ট স্বতন্ত্র ছিল। আরো পরে দ্বাদশ শতাদ্বীতে গৌড়েশ্বর লক্ষ্মণসেনের সভাকবি জয়দেব তাঁর কোমলকান্ত পদাবলীতে সারা ভারতে এক নতুন মূর্ছনার সৃষ্টি করেছিলেন, কিন্তু তার মধ্যে সংস্কৃতের সঙ্গেই অনাগত বাংলা ভাষার পদধ্বনি শুনতে পাওয়া গিয়েছিল। সেই মহাকবি বলেছিলেন, “ওগো সুন্দরী! যমুনার তীরে ধীর সমীরণ বইছে, আর তার মাঝে সচকিত নয়নে তোমার পথ চেয়ে বসে আছেন বনমালী।”
“ধীরসমীরে যমুনাতীরে বসতি বনে বনমালী।
পীনপয়োধর পরিসরমদ্দন চঞ্চল করযুগশালী॥ ৫-১
পতিত পতত্রে বিগলিত পত্রে শঙ্কিতভবদুপযানম।
রচয়তি শয়নং সচকিত নয়নং পশ্যতি তব পন্থানম॥ ৫-১১”
আলোচ্য সময়ে রচিত ‘কালিকাপুরাণের’ মধ্যেও একই ধরণের বাংলাঘেঁষা সংস্কৃত ভাষার সাক্ষাৎ পাওয়া যায়।
‘গীতগোবিন্দ’ প্রকাশের কিছু কাল পরে তুর্কীরা আয্যাবর্তের তিনটি রাজ্য অধিকার করে নিলে তখন যেসব পণ্ডিত সেইসব রাজ্যের সভাগুলিকে অলঙ্কৃত করতেন, তাঁদের অনেকেই ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে চলে গিয়েছিলেন। লক্ষ্মণসেনের জনৈক সৈন্যাধ্যক্ষ বটুদাসের পুত্র ‘শ্রীধরদাস’ অন্য রাজ্যে গিয়ে তাঁর ‘সদুক্তিকর্ণামৃত’ গ্রন্থটি প্ৰকাশ করেছিলেন। অনুরূপ আরো বহু গ্রন্থই সেই সময়ে বিভিন্ন রাজ্যে প্রকাশিত হয়েছিল। তুর্কী শাসিত ভারতে যখন মামলুকদের তাণ্ডব চলছিল, স্বাধীন রাজ্যগুলিতে তখন কৃষ্টি সাধনার বন্যা বইছিল। হয়সালারাজ দ্বিতীয় বীর বল্লালের সময়ে ১২০৬ খৃষ্টাব্দে ধর্মঘোষ লিখিত ‘শতপদিকা’ গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছিল। একই বছরে জীবদত্তসূরী তাঁর ‘বিবেক বিলাস’ গ্রন্থটি প্রকাশ করেছিলেন। ত্রিবাঙ্কুরাধিপতি ইরামন কেরল বর্মনের সভাপণ্ডিত সোমেশ্বরের ‘কীর্তিকৌমুদী’ প্রকাশিত হয়েছিল তার তিন বছর পরে – ১২৩৯ খৃষ্টাব্দে। এর আগে ১২১১ খৃষ্টাব্দে মালবে অজুনবর্মণ অমরু-শতকের টীকা ‘রসিকমঞ্জরী’ লিখে যশস্বী হয়েছিলেন। তার পাঁচ বছর পরে অজিতদেবসূরী ‘যোগসিদ্ধি’ রচনা করেছিলেন; উক্ত গ্রন্থটি বর্তমানে লুপ্ত হলেও বিভিন্ন প্রাচীন পুস্তকে সেটির থেকে যেসব উদ্ধৃতি পাওয়া যায়, তা থেকে গ্রন্থকারের প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায় ৷ একই সময়ে প্রকাশিত জীবদত্তের ‘বিবেক-বিলাস’ একটি উচ্চাঙ্গের গ্রন্থ। জীনদেবসূরীর শিষ্য অভয়দেবসূরীর ‘জয়ন্ত বিলাস’ সেই সময়েই প্রকাশিত হয়েছিল। অনুরূপ মূল্যবান ঐতিহাসিক গ্রন্থ আরো রয়েছে। সেইসব লেখকেরা সবাই যে শরণার্থী ছিলেন তা নয় ৷ তবে একই সময়ে ওই ধরণের সাহিত্যস্রোত প্রবাহিত হওয়ার ফলে এটা অনুমান করা যায় যে, ওই সময়ে তুর্কী অধিকারের মধ্যে প্রতিভা বিকাশের সুযোগ লুপ্ত হয়ে গিয়েছিল বলেই বহু মনীষী বিভিন্ন স্বাধীন রাজ্যে চলে গিয়েছিলেন। পণ্ডিতদের সেই দেশত্যাগ তারপরেও অব্যাহত গতিতে চলেছিল। পঞ্চদশ শতাব্দীতে নবদ্বীপবাসী পণ্ডিত বাসুদেব সার্বভৌম মিথিলায় নিজের শিক্ষা সমাপনের পরে উড়িষ্যায় গিয়ে রাজা কপিলেন্দ্রদেবের সভা অলঙ্কৃত করেছিলেন।
বুদ্ধদেবের সময়ে মগধে সংস্কৃত ভাষা যে পালিতে পরিণত হয়েছিল, সেকথা আগেই বলা হয়েছে। গৌড়ের জনসাধারণ তখন কোন ভাষায় কথা বলতেন, সেটা জানবার কোন উপায় এখন নেই। তবে তার হাজার বছর পরে পাল যুগে যে ভাষাটি গৌড়ে প্রচলিত ছিল, সেটির কিছু কিছু নমুনা এখনও বিদ্যমান রয়েছে। কিন্তু গৌড়ের তৎকালীন রাজশক্তি সংস্কৃত ছাড়া অন্য কোন ভাষাকে আমল দিত না বলেই, সেই বিশাল মহীরুহ নিজের হাজার শাখা বিস্তার করে উদ্যানকে এমনভাবে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল যে, ক্ষুদ্রতর বৃক্ষগুলি তখন অঙ্কুরোদগমের সঙ্গে সঙ্গেই শুকিয়ে গিয়েছিল। মহীরুহ সুমিষ্ট ফল প্রদান করে একথা সত্যি, কিন্তু লতাগুল্মের স্ফূরণ না ঘটলে ওষুধ তৈরী হওয়া সম্ভব নয়। ধর্মাচার্য্যরা কোন ভাষা দিয়ে আপামর জনসাধারণের ক্ষতের উপরে তাঁদের মতবাদের প্রলেপ দিতেন? তাই রাজশক্তির ঔদাসিন্য সত্ত্বেও তাঁদের উদ্যোগে গৌড়-বঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলের কথ্য ভাষাগুলি ধীরে ধীরে বিকশিত হয়ে উঠেছিল। ঐতিহাসিকদের মতে অনুরূপ ৩৪টি ভাষা দ্বাদশ শতাব্দীতে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে বিদ্যমান ছিল। সেগুলির প্রায় সব ক’টি সংস্কৃত থেকে উদ্ভূত হলেও সেগুলোর নিজস্ব রূপও ছিল। গৌড়ের পালরাজারা নিজেরা বৌদ্ধ হয়েও যখন সংস্কৃতে রাজকার্য পরিচালনা করছিলেন, ও সেই সঙ্গে বিভিন্ন শিক্ষায়তনে পালি ভাষাকে পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছিলেন, তখন রামাই পণ্ডিত প্রভৃতি ধর্মাচার্য্যরা কিন্তু জনসাধারণের মধ্যে প্রচলিত গৌড়ীয় ভাষায় শ্রীবুদ্ধের মহিমা প্রচার করছিলেন। রামাই পণ্ডিতের লেখা থেকে সেই ভাষার কিছু নমুনা নিম্নরূপ –
“বন্ন সুন্নী করতার সভ সুন্নী অবতার
সব্ব সুন্নী মধ্যে আরোহণ।
চরণে উদয় ভানু কোটী চন্দ্র যিনি তনু
ধবল আসন নিরঞ্জন॥”
রামাই পণ্ডিতের শতাধিক বছর পরে বজ্রযানপন্থী বৌদ্ধরা যে সব ডাক পুরুষের বচন রচনা করেছিলেন, সেগুলিও গৌড়ীয় ভাষায় লিখিত হয়েছিল। যথা –
(১) “আদি অন্ত ভুজশী।
ইষ্ট দেবতা পূজসি॥
মরনর জদি ডর বাসসি।
অসম্ভব কভু না খাওসি॥”
(২) “ভাষা বোল পাতে লেখি।
বাটা হুবো বোল কটি সাখি॥
মধ্যস্থ জনে সমাবে নিয়াঅ।
বোলে ডাক রত সুখ পাঅ।
মধ্যস্থ জবে হেমাতি বুঝে।
বোলে ডাক নরকে পইচে।”
এই গৌড়ীয় ভাষার উদ্ভব যে কখন ঘটেছিল, সেটা বলা যায় না; তবে দ্বাদশ শতাব্দীতে গুর্জররাজের সভাপণ্ডিত হেমচন্দ্র ভাষাতত্ত্ব সঙ্গন্ধে যে পুস্তকটি রচনা করেছিলেন, তাতে দেখা যায় যে, সেই সময়ে গৌড়ে ‘গৌড়ী’ ও বঙ্গে ‘প্রাচ্য’ ভাষা নামের দুটি ভাষা প্রচলিত ছিল। চতুর্দশ শতাব্দীতেও ভাষার সেই অবস্থার যে কোন পরিবর্তন হয় নি, সে কথা কবি আমীর খসরু তাঁর ‘কিরানা সালাতিন’ নামক পুস্তকে এই প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেছিলেন, “আমার জন্ম হিন্দে। … বর্তমান সময়ে এ দেশের প্রতি প্রদেশে একটি করে ভাষা আছে যা তার নিজস্ব ও কারও কাছে ধার করা নয়। সিন্ধি, লাহোরী, কাশ্মীরী, ডোগরী, তেলেঙ্গী, গুজরাটী, মেবারী, গৌড়ী, বাংলা – এই সব হিন্দের বিভিন্ন অঞ্চলের ভাষা।” খসরুর ভাষ্য থেকে বোঝা যায় যে, গৌড়ীয় ভাষা তখনও পর্যন্ত লোপ পায় নি, এবং বঙ্গের প্রাচ্য ভাষা তখন বাংলা নামে অভিহিত হচ্ছিল। এরপরে পূর্বোল্লিখিত গৌড়ীয় ভাষা একটা সময়ে বিবর্তিত হোতে হোতে ক্রমে বাংলায় রূপান্তরিত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সেই শুভক্ষণটি যে কবে এসেছিল, বা মহাকাশের কোন গ্রহ যে তখন কোন জায়গায় অবস্থান করছিল, তা কেউ বলতে পারেন না। তবে বাংলা ভাষাটি যখন সূতিকাগৃহে অবস্থান করছিল, সেই সময়কার অল্পস্বল্প যে সব লেখা এখনও বিদ্যমান রয়েছে, সেগুলো থেকে দেখতে পাওয়া যায় যে, মহাবৌদ্ধ রামাই পণ্ডিতের যুগ চলে গিয়ে লুইপাদ, সবরিপাদ, ভুষুকপাদ প্রভৃতি সিদ্ধাচার্য্যরা বৌদ্ধদের নেতৃত্ব গ্রহণ করে নিজেদের মতবাদ প্রচারের জন্য যে সব ছড়া রচনা করেছিলেন, সেগুলিতে বাংলার ছোঁয়া লেগেছিল। নিজের একটি ছড়ায় ভুষুকপাদ বলেছিলেন – “কার কাছে, কি ভাবে আছ? শিকারীরা এসে সব দিক থেকে তোমাকে ঘিরে ফেলেছে। জান না, হরিণ আপন মাংসের জন্য সকলের বৈরী হয়? ভুষুকপাদের দশাও তাই, ব্যাধেরা ক্ষণকালের জন্য তাকে ছাড়ে না।”
“কাহেরে ঘিনি মেলি অচ্ছ কিস।
ভেঢ়িল হাক পড়অ চৌদিশ॥
আপনা মাংসে হরিণা বৈরী।
ক্ষণহ ন ছাড়অ ভুষুক অহেরী॥”
সাহিত্য হিসাবে বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের সেই ছড়াগুলির বিশেষ কোন মূল্য বিশেষ নেই, কিন্তু সেগুলির ভিতর দিয়ে বাংলা ভাষার ক্রমবিকাশের ধারা সম্বন্ধে জানতে পারা যায়। হিন্দী সাহিত্যের প্রথম কাব্যগ্রন্থ চাঁদকবি রচিত ‘পৃথ্বিরাজ রাসৌ’-এর ভাষা যতখানি হিন্দী সিদ্ধাচার্য্যদের, উপরোক্ত ধরণের প্রাচীন ছড়াগুলি তার চেয়ে কম কিছু বাংলা নয়। তাই সেই সিদ্ধাচাৰ্য্যদেরকে বাংলা সাহিত্যের পুরোধা বলা যেতে পারে। তাঁদের লেখা বিবর্তিত হতে হতে চতুর্দশ শতাব্দীর মধ্যভাগে যে রূপ নিয়েছিল, সেটা দিয়েই বর্তমান বর্ধমান জেলার কুলীনগ্রাম নিবাসী কবি মালাধর বসু ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’ নামের যে কাব্যগ্রন্থটি রচনা করেছিলেন, সেটাকেই বাংলা সাহিত্যের আদি গ্রন্থ বলা যেতে পারে। শ্রীকৃষ্ণবিজয়ে কবি লিখেছিলেন –
“কেহ বলে পরাই পীত বসন।
চরণে নূপুর দিমু বলে কোহ্ন জন॥
কেহ বলে বনমালা গাঁথি দিমু গলে।
মণিময় হার দিমু কোহ্ন সখি বলে॥
কটিতে কঙ্কন দিমু বলে কোহ্ন জন।
কেহ্ন বলে পরাইমু অমূল্য রতন॥
শীতল বাতাস করিমু অঙ্গ জুড়ায়।
কেহ্ন বলে সুগন্ধি চন্দন দিমু গায়॥
কেহ্ন বলে চূড়া বানাইমু নানা ফুলে।
মকর কুন্তল পরাই শ্রুতিমূলে॥
কেহ্ন বলে রসিক জন বড় কাল।
কর্পূর তামুল সনে জোগাইব পান॥”
মালাধর বসুকে বাংলা সাহিত্যের ‘Chaucer’ (১৩৪০-১৪০০) বললে কিছুমাত্র অত্যুক্তি করা হয় না। চসারকে দিয়ে যেমন ইংরাজী সাহিত্যের উন্মেষ ঘটেছিল, মালাধরকে দিয়ে তেমনি বাংলা সাহিত্যের উন্মেষ হয়েছিল। উভয় কবিই কিন্তু পরস্পরের সমসাময়িক ছিলেন। চসারের ‘Canterbury Tales’ ইংরেজি ভাষায় লিখিত প্রথম সুসম্পূর্ণ গ্রন্থ, এদিকে মালাধরের শ্রীকৃষ্ণবিজয়ও বাংলা সাহিত্যের প্রথম সুসম্পূর্ণ গ্রন্থ। ‘Canterbury Tales’-এর উপাদানগুলি যেমন বিভিন্ন বিদেশী গ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছিল, মালাধরের শ্রীকৃষ্ণবিজয়ও তেমনি ভাগবতের কৃষ্ণচরিত্রের রূপ অবলম্বনে রচনা করা হয়েছিল। চসারের আগে যেমন ‘Beowulf’ প্রভৃতি বিচ্ছিন্ন কবিতা ইংল্যাণ্ডে প্রচলিত ছিল, মালাধরের আগেও গৌড়ে যে বহু বিচ্ছিন্ন কবিতার অস্তিত্ব ছিল, সেকথা আগেই বলা হয়েছে। ‘Beowulf’-এর ভাষা ছিল প্রাক-ইংরেজী যুগীয় ‘Anglo-Saxon’ ভাষা, মালাধরের আগে রচিত ছড়াগুলির ভাষাও প্রাক-বাংলা যুগীয় গোড়ীয় ভাষা ছিল।

গাছেদের কথা বলা

জার্মান লেখক পিটার উললেবেনের বক্তব্য সাড়া ফেলে দিয়েছে গোটা বিশ্বে। উনি বলছেন যে নিজেদের মধ্যে কথোপকথন করে থাকে গাছেরাও অনেকটা আড়ালে আড়ালেই ভূগর্ভস্থ মাইসেলিয়াল তন্তুর মধ্যে দিয়েই,
অর্থাৎ মাটির নীচে ইন্টারনেট’-এর মতো!

অরণ্যের মধ্যে দিয়ে এঁকেবেঁকে চলে গেছে সরু পথ। এই পথ ধরেই প্রতিদিন হেঁটে বাড়ি ফিরতেন তিনি। সে-সময় প্রায়শই তাঁর মনে হত, নিঃশব্দে কারা যেন ফিসফিসিয়ে কথা বলে চলেছে এই জনহীন অরণ্যে। কিন্তু কোথাও যে কোনো মানুষের চিহ্ন মাত্র নেই। তবে কাদের এই ফিসফিসানি? বড়ো হওয়ার পর তাঁর মনে হয়েছিল, আসলে নিশ্চুপে, সকলের দৃষ্টির আড়ালে কথা বলে গাছেরা। বড়ো গাছ, মহীরুহেরা সযত্নে আগলে রাখার চেষ্টা করে তার সন্তানদের।

পিটার উললেবেন (Peter Wohlleben)। এই জার্মান লেখকের লেখা গ্রন্থ ‘দ্য হিডেন লাইফ অফ ট্রিস’ (The Hidden Life Of Trees) ইতিমধ্যেই সাড়া ফেলে দিয়েছে গোটা বিশ্বজুড়ে। জার্মানি তো বটেই, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য-সহ বর্তমানে ১১টি দেশে বেস্টসেলার তাঁর এই গ্রন্থ। এমনকি এই গ্রন্থের জন্য একাধিক পুরস্কারের স্বাদও পেয়েছেন ৫৩ বছর বয়সি লেখক। এই গ্রন্থের প্রতিটি পাতায় ফুটে উঠেছে কীভাবে একে অন্যের সঙ্গে কথা বলে গাছেরা, তাদের আদৌ কোনো মন আছে কিনা, যদি মন থেকেই থাকে তবে কী কী অনুভূতি অনুভব করতে পারে গাছেরা— এসব প্রশ্ন নিয়েই দীর্ঘ আলোচনা করেছেন পিটার।

আরো পড়ুন- পৃথিবীর এমন একটি জায়গা, যেটি ৬ মাস এক দেশে, ৬ মাস অন্য দেশে! বদলে যায় আইনও

স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, পিটারের এই দাবি এবং তত্ত্বের সত্যতা ঠিক কতটা? না, এই গ্রন্থের উপস্থাপিত তথ্য একেবারে মনগড়া নয়। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গবেষণাকেন্দ্র এবং প্রতিষ্ঠান থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন গবেষণাপত্রের ওপর ভিত্তি করেই লেখা হয়েছে এই বই। অর্থাৎ, গাছেদের কথোপকথনের প্রমাণ হিসাবে যে যে বিষয়গুলি তিনি তুলে ধরেছেন, সেগুলি সকলই কোনো না কোনো বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার ফলাফল।

গাছেদের কথা বলা

এই প্রসঙ্গে আবশ্যিকভাবেই উঠে আসে ১৯৯০ দশকের শেষের দিকে অধ্যয়ন করা একটি গবেষণার কথা। মিসিসিপি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জেসন হোয়েকসেমা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এই গবেষণার। ল্যাবরেটরি পরীক্ষার মাধ্যমে তিনিই প্রথম দেখান, একটি গাছ থেকে অন্য গাছের মধ্যে খাদ্য, খনিজ এবং তথ্য সরবরাহিত করে অন্য গাছ। আর এই গোটা প্রক্রিয়াটাই ঘটে মাটির নিচে। অন্যদিকে তথ্য ও খাদ্য আদানপ্রদানের এই নেটওয়ার্কের মধ্যস্থতা করে মাইসেলিয়াম গোত্রের বিভিন্ন ছত্রাক। গাছের থেকে তারা সংগ্রহ করে পুষ্টি, বিনিময়ে শর্করা বহন করে পৌঁছে দেয় অন্য গাছকে। উল্লেখ্য, এই ধরনের ছত্রাকের উপস্থিতি দেখতে পাওয়া যায় সর্বত্রই।

এখানেই শেষ নয়, ১৯৯৭ সালে নেচার পত্রিকায় প্রকাশিত হয় শেফিল্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ডঃ সুজান সিমার্ডের আরও একটি গবেষণাপত্র। সেখানেও একইধরনের পরীক্ষালব্ধ ফলাফল উপস্থাপন করেন তিনি। ‘উড-ওয়াইড-ওয়েব’ নামের এক আশ্চর্য তত্ত্ব সামনে আনেন তিনি। জানান, আমাদের ‘ইন্টারনেট’-এর মতোই, আন্তর্জাল রয়েছে গাছেদের। ভূগর্ভস্থ মাইসেলিয়াল তন্তুর মধ্যে দিয়েই এক গাছ অন্যগাছের সঙ্গে কথোপকথন করে। কোনো বৃহৎ মহীরুহের পাশে চারা গাছ জন্মালে, সাধারণত সূর্যের আলো পায় না তারা। এক্ষেত্রে মহীরুহরাই গ্লুকোজ জাতীয় শর্করা স্থানান্তরিত করে এই ধরনের চারা গাছের দেহে। এই আদানপ্রদানের সময় ছত্রাকদের ভূমিকাও কম থাকে না।

দু’-একটি নয়, এধরনের একাধিক গবেষণার ফলাফল নিজের গ্রন্থে তুলে ধরেছেন পিটার। বা বলা ভালো, তাঁর গ্রন্থ গাছ সংক্রান্ত একাধিক গবেষণার এক সংকলন। সেইসঙ্গে তাঁর নিজস্ব কল্পনা তো রয়েছেই। আগামীদিনে গাছেদের এই কথোপকথনের পাঠোদ্ধার হবে, সে-ব্যাপারেও সম্পূর্ণ আস্থা রয়েছে পিটারের। তবে বৈজ্ঞানিক গুরুত্বের বাইরে, তাঁর এই গ্রন্থ নতুন করে উদ্ভিদ নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা গড়ে তুলছে, তাতে সন্দেহ নেই কোনো।

ব্ল্যাক হোলের অজানা রহস্য। – দ্বিতীয় পর্ব

কৃষ্ণ গহ্বরের ভেতরে গেলে ঠিক কি দেখতে পাবো আমরা ? হ্যাঁ এই মোক্ষম আর অমোঘ প্রশ্নটা শুধুমাত্র সাধারণ পাঠকদের মনের মধ্যেই নয় এমনকি খোদ মহাকাশ বিজ্ঞানিদের মনের মধ্যেও ঘুরপাক খাচ্ছে বহু বছর ধরে। কিন্তু সমস্যা হলো এই যে কৃষ্ণ গহ্বরের ভেতরে ঠিক কোন বিস্ময় অপেক্ষা করে রয়েছে আমাদের সবার জন্য তা সম্ভবত থেকে যাবে চির অজানা রহস্যের ঘন কুয়াশার অন্তরালে। এর কারণ কৃষ্ণ গহ্বরের ভেতরে কোন প্রাণী বা বস্তুর পক্ষে একবার প্রবেশ করে আর ফিরে আসা অসম্ভব। কিন্তু তা বলে গবেষণা আর কল্পনা করা থেকে একদিনের জন্যও নিজেদের বিরত রাখেননি মহাকাশ বিজ্ঞানীরা। মহাকাশ বিজ্ঞানিদের জনপ্রিয় মতবাদ অনুসারে কৃষ্ণ গহ্বর দ্বারা উদরীকৃত যাবতীয় বস্তু ব্ল্যাক হোলের গর্ভের একেবারে কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত সিঙ্গুলারিটি পয়েন্টে উপস্থিত হয়। সিঙ্গুলারিটি পয়েন্টে পৌঁছনোর পর সেইসব বস্তুর আয়তন যারপরনাই ক্ষুদ্র হয়ে যাবার সাথে সাথে প্রভূত পরিমাণে ভর অর্জন করে আর সেই সাথে তাদের ঘনত্ব আর মাধ্যাকর্ষণ শক্তি অনন্ত আর অসীম হয়ে যায়। মহাকাশ বিজ্ঞানিদের মতবাদ বা কল্পনা অনুসারে কৃষ্ণ গহ্বরের ভেতরে অবস্থিত এই অঞ্চলে কাজ করে না পৃথিবীর কোন সাধারণ পদার্থ বিজ্ঞানের নিয়ম। এমনকি কাজ করে না এলবার্ট আইনস্টাইনের থিয়োরি অফ রিলেটিভিটি মতবাদও।

আরো পড়ুন-  ব্ল্যাক হোলের অজানা রহস্য – প্রথম পর্ব

সিঙ্গুলারিটি পয়েন্ট বোঝানোর জন্য মহাকাশ বিজ্ঞানিরা থিয়োরি অফ গ্রাভিটির সাথে কোয়ান্টাম ফিজিক্সের সাহায্য নিয়ে কোয়ান্টাম গ্রাভিটি নামধারী এক নতুন মতবাদ (Theory) বা কল্পনার আশ্রয় নিয়েছেন। বর্তমানে মহাকাশ বিজ্ঞানিদের নিকটে এই কোয়ান্টাম গ্রাভিটি মতবাদ একেবারে নব্য পর্যায়ে রয়েছে। আইনস্টাইন ফিল্ড সমীকরণ কোয়ান্টাম গ্রাভিটি মতবাদেরই একটি শাখা। আমার লেখা আগের পোস্ট পড়ে আপনারা জানতে পেরেছেন কিভাবে এলবার্ট আইনস্টাইন আর ন্যাথান রোজেন তাঁদের ফিল্ড সমীকরণের সাহায্যে মহাকাশে অবস্থিত স্পেস আর টাইম অর্থাৎ সময়কে দুমড়ে মুচড়ে এক ব্রহ্মাণ্ড থেকে বহু আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত অন্য একটি ব্রহ্মাণ্ডে অনায়াসে যাবার জন্য মহাজাগতিক সুড়ঙ্গপথ ওয়ার্মহোলের মতবাদ সমীকরণ আবিষ্কার করেছিলেন। যদিও ওয়ার্মহোল মহাকাশ আর পদার্থ বিজ্ঞানীদের কল্পনা বা মতবাদ মাত্র, কিন্তু বিজ্ঞানিদের মতে বাস্তবে ওয়ার্মহোল নির্মাণ করা সম্ভব হলে শুধুমাত্র এক ব্রহ্মাণ্ড থেকে বহু আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত অন্য ব্রহ্মাণ্ডে অনায়াসে পৌঁছনোই নয়, এমনকি প্রয়োজনে টাইম ট্রাভেল করে অতীত বা ভবিষ্যৎকালেও ভ্রমণ করা যাবে। খ্রিষ্টোফার নোলানের ইন্টারস্টেলার চলচ্চিত্রেও দেখানো হয়েছিল ওয়ার্মহোল।

বাস্তবে অনন্ত এই মহাকাশে ওয়ার্মহোলের অস্তিত্বের সন্ধান না মিললেও সন্ধান মিলেছে ব্ল্যাক হোল অর্থাৎ কৃষ্ণ গহ্বরের। পদার্থ আর মহাকাশ বিজ্ঞানিদের মতানুসারে কৃষ্ণ গহ্বরের সিঙ্গুলারিটি পয়েন্ট অনেকটা ওয়ার্মহোলের মতো কাজ করে। অত্যাধিক ভর, অনন্ত ঘনত্ব আর অসীম মাধ্যাকর্ষণ শক্তির প্রভাবের ফলে কৃষ্ণ গহ্বরের সিঙ্গুলারিটি পয়েন্টে অবস্থিত স্পেস-টাইম দুমড়ে মুচড়ে গিয়ে সৃষ্টি করে এক ওয়ার্মহোলের। এর ফলে সিঙ্গুলারিটি পয়েন্টকে সেতু হিসেবে ব্যবহার করে হয়তো পৌঁছে যাওয়া যাবে অন্য কোন ব্রহ্মাণ্ডে বা পৃথিবীর কার্বন কপি হিসেবে পরিচিত অন্য কোন parallel অর্থাৎ সামন্তরাল গ্রহে বা টাইম ট্রাভেল করে পৌঁছে যাওয়া যাবে অতীত বা ভবিষ্যৎকালে।

কিন্তু এসবই হচ্ছে পদার্থ আর মহাকাশ বিজ্ঞানীদের কল্পনা মাত্র। বাস্তবে কৃষ্ণ গহ্বরের ভেতরে তার কেন্দ্রস্থলে ঠিক কি সংগঠিত হচ্ছে তা জানা হয়তো সম্ভব নয় কোনকালেই। ইন্টারস্টেলার চলচ্চিত্রের প্রযোজক নোলান সাহেবও মহাকাশ বিজ্ঞানীদের এই কল্পনারই সাহায্য নিয়েছেন। বাস্তবে যদি কুপারের মতো কোন জীবিত মহাকাশচারী কৃষ্ণ গহ্বরের দিকে যাত্রা শুরু করতেন তাহলে যারপরনাই করুন দশার সম্মুখীন হতে হতো তাঁকে।

কি হতো যদি আপনি পাড়ি জমাতেন কৃষ্ণ গহ্বরের দিকে ?
=========================================
খ্রিষ্টোফার নোলানের ইন্টারস্টেলার ছায়াছবি দেখার পর এখন হয়তো অনেকেরই মনের মধ্যে এই প্রশ্নটি ঘুরপাক খাচ্ছে। তাহলে আসুন সংক্ষেপে জেনে নেই ঠিক কোন কোন অবস্থার মুখোমুখি হতেন যদি আপনি বাস্তব জগতে কুপারের মতো আপনার মহাকাশযান সমেত স্লিং শট করে কৃষ্ণ গহ্বরের দিকে ধাবিত হতেন।

আমরা জানি সূর্যের মাধ্যাকর্ষণ শক্তি পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তির থেকেও প্রায় ২৮ গুণ বেশি। অর্থাৎ কখনও কোন মানুষ যদি সূর্য পৃষ্ঠে অবতরণ করতে সফল হন তাহলে তাঁর ওজন ২৮ গুণ বৃদ্ধি পাবে। এর ফলে সেই মহাকাশচারী মানুষের পক্ষে সূর্যপৃষ্ঠে চলাফেরা করাই দায় হয়ে উঠবে। মহাকাশ বিজ্ঞানিদের মতে মহাকাশের সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষ্ণ গহ্বর হচ্ছে মধ্যবর্তী আকারের Stellar black hole প্রজাতির। এই Stellar black hole এর ব্যাসার্ধ আমাদের সূর্যের ব্যাসার্ধের চেয়েও কুড়িগুণ বেশি। অর্থাৎ প্রায় চারটে সূর্যকে সঙ্কুচিত করে তাদের যাবতীয় পদার্থ সিঙ্গুলারিটি পয়েন্টে নিয়ে আসতে পারলে তবেই নির্মাণ করা সম্ভব একটি Stellar black hole এর। এর থেকেই অনুমান করা যায় এইসব কৃষ্ণ গহ্বরের অসম্ভব মাধ্যাকর্ষণ শক্তির কথা। এই মাধ্যাকর্ষণ শক্তির প্রভাব এতটাই বেশি যে আলোর পক্ষেও তাকে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না। ঠিক এই কারনেই কৃষ্ণ গহ্বরের Event Horizon Point থেকে আমাদের মানব জগতের প্রচলিত পদার্থ আর জ্যোতির্বিজ্ঞানের নিয়ম কানুন কাজ করা বন্ধ করে দেয়। তার পরিবর্তে শুরু হয় কৃষ্ণ গহ্বরের নিজস্ব নিয়ম কানুন।

মহাকাশ বিজ্ঞানিদের মতে প্রত্যেক কৃষ্ণ গহ্বরের নিকটে রয়েছে Event Horizon বা Point of No Return নামে একটি অঞ্চল। এই ইভেন্ট হরাইজন অঞ্চলের মাধ্যাকর্ষণ শক্তির প্রভাব এতটাই সাংঘাতিক যে আলোকেও মুহূর্তের মধ্যে নিজের উদরে শুষে নেয় কৃষ্ণ গহ্বর। আপনি যদি একবার এসে পড়েন এই Event Horizon অঞ্চলে তাহলে আর কখনোই ফিরে যাওয়া সম্ভব হবে না আপনার পক্ষে। কারণ Event Horizon থেকে প্রত্যাবর্তন করতে চাইলে আপনার Escape Velocityর গতিবেগ আলোর গতিবেগের থেকেও বেশি হতে হবে আর আজ পর্যন্ত পৃথিবীর বৈজ্ঞানিকরা আলোর চেয়েও দ্রুতগতি সম্পন্ন কোন মহাকাশযান নির্মাণ করতে সফল হননি। এই ইভেন্ট হোরাইজন পয়েন্টের পর থেকে স্থান বা স্পেস বদলে হয়ে যায় সময় বা টাইম আর সময় বদলে হয়ে যায় স্পেস। অর্থাৎ আপনি ব্ল্যাক হোলের ইভেন্ট হোরাইজন পয়েন্ট অতিক্রম করে সিঙ্গুলারিটি পয়েন্টের দিকে যত এগিয়ে যেতে থাকবেন ততই স্থানের বদলে আপনি টাইম ট্রাভেল করতে থাকবেন। হয়তো আপনি সময় ভ্রমন করে পৌঁছে যাবেন আপনার সুখ স্মৃতিময় অতীতের শৈশবের দিনগুলিতে বা আরও প্রাচীনকালে গুপ্ত সাম্রাজ্যের সময়কালে। কিন্তু দুঃখের বিষয় আলোর অভাবে আপনি দেখতে পারবেন না আপনার টাইম ট্রাভেলের দৃশ্য।

Event Horizon বা Point of No Returnএ উপস্থিত হলে আপনি দেখতে পাবেন আপনার সম্মুখে কিছুটা দূরবর্তী স্থানে মহাকাশ কেমন যেন দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে আর এক অতিকায় কালো গহ্বর যেন রাক্ষসের ন্যায় হাঁ করে গিলতে আসছে আপনাকে। এটাই হচ্ছে কৃষ্ণ গহ্বরের প্রবেশ মুখ। এরপর আপনি যত এগিয়ে যাবেন কৃষ্ণ গহ্বরের দিকে ততই প্রবল মাধ্যাকর্ষণ শক্তির প্রভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকবে আপনার গতিবেগ। আপনার দুই পদযুগল যদি নিচের দিকে অবস্থিত থাকে তাহলে প্রবল মাধ্যাকর্ষণ প্রভাবে প্রথমে আপনার দুই পদযুগল প্রসারিত হতে থাকবে আর তারপর আপনার শরীরের বাকি অংশও দীর্ঘায়িত হতে থাকবে। যদি কৃষ্ণ গহ্বরটি Stellar black hole প্রজাতির হয় তাহলে সেটির ব্যাসার্ধ ৯ মাইল পর্যন্ত হবে এবং আপনি ২০টি সূর্যের সমান মাধ্যাকর্ষণ শক্তির মুখোমুখি হবেন। এর ফলে ইভেন্ট হরাইজন বা পয়েন্ট অফ নো রিটার্নে উপস্থিত হবার আগেই আপনার সমস্ত শরীরের সমস্ত অনু-পরমানু প্রলম্বিত হতে হতে শেষে দুমড়ে মুচড়ে একাকার হয়ে মৃত্যু ঘটবে আপনার। বিজ্ঞানের ভাষায় এধরনের প্রলম্বনকে Spaghettification বলে অভিহিত করা হয়।

যদি কৃষ্ণ গহ্বরটি সুপার ম্যাসিভ প্রজাতির হয় তাহলে সেটির আকার সূর্যের চেয়ে কয়েক মিলিয়ন ভারি হবে। সেক্ষেত্রে আপনি হয়তো জীবিত অবস্থায় ইভেন্ট হরাইজন এলাকা পর্যন্ত পৌঁছতে সফল হবেন। কিন্তু ইভেন্ট হরাইজন পয়েন্ট অতিক্রম করে আপনি যত কৃষ্ণ গহ্বরের ভেতরে প্রবেশ করতে থাকবেন ততই আপনার শরীরের উপর ভয়ানক প্রভাব পড়তে শুরু হবে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির। যদি আপনি জীবিত অবস্থায় সিঙ্গুলারিটি পয়েন্টে উপস্থিত হতে সফল হন তাহলে হয়তো সাথে সাথে আপনার শরীরের ঘনত্ব অনন্ত আর অসীম হয়ে গিয়ে মুহূর্তের মধ্যে সিঙ্গুলারিটি পয়েন্টে আটকে পড়ে আপনি নিজেও রূপান্তরিত হয়ে যাবেন এক কৃষ্ণ গহ্বরে। অর্থাৎ শুধু আপনার নশ্বর শরীরই নয়, যদি আত্মার অস্তিত্ব থেকে থাকে তাহলে আপনার আত্মাও চিরতরে আটকা পড়বে কৃষ্ণ গহ্বরের ফাঁদে। সেক্ষেত্রে বাস্তবে খ্রিষ্টোফার নোলানের ইন্টারস্টেলার ছায়াছবির মহাকাশচারী কুপারের মতো কোনমতেই আর কোন অবস্থাতেই কৃষ্ণ গহ্বর ভেতর থেকে জীবিত বা মৃত অবস্থায় (যদি আত্মার অস্তিত্ব থেকে থাকে) বেরিয়ে আসতে সফল হবেন না আপনি। আবার কৃষ্ণ গহ্বরের অপরপ্রান্তে যদি অস্তিত্ব থাকে শ্বেত গহ্বর বা হোয়াইট হোলের তবে আপনি হয়তো সিঙ্গুলারিটি পয়েন্টের ভেতর দিয়ে সেই শ্বেত গহ্বরের সাহায্যে পৌঁছে যাবেন সম্পূর্ণ নতুন কোন সামন্তরাল ব্রহ্মাণ্ডে বা উচ্চতর কোন ডাইমেনশনে বা অতীত অথবা ভবিষ্যতের অন্য কোন টাইমলাইনে। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা কৃষ্ণগহ্বর আবিষ্কার করতে সফল হলেও শ্বেতগহ্বরের অস্তিত্ব আজ পর্যন্ত আবিষ্কার হয়নি। হোয়াইট হোল আজ পর্যন্ত হাইপথিসিস হিসেবেই রয়ে গিয়েছে।

আপনি যখন কুপারের মতো দ্রুতগতিতে এগিয়ে যেতে থাকবেন ব্ল্যাক হোল নামক মৃত্যুফাঁদের দিকে তখন ডঃ অ্যামিলিয়া ব্র্যান্ডের মতো আপনার কোন সাথি মহাকাশচারী যদি দূর থেকে লক্ষ্য করতে থাকে আপনাকে তাহলে বাস্তবে ঠিক কি দেখতে পাবেন তিনি ? প্রবল মাধ্যাকর্ষণ শক্তির প্রভাবে আপনি যত দ্রুতবেগে এগিয়ে যেতে থাকবেন কৃষ্ণ গহ্বরের দিকে আপনার সাথির চোখে ততই মন্থর থেকে মন্থরতম হতে থাকবেন আপনার যাত্রা আর সেই সাথে আপনার অবয়বও ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে থাকবে। সেই সাথে আপনার সাথির চোখে এক অদ্ভুত রক্তিম আভায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠবে আপনার অবয়ব। এরপর তাঁর চোখে আপনার অবয়ব কৃষ্ণ গহ্বরের ইভেন্ট হরাইজন পয়েন্টের সামনে এসে একেবারে জমাট বাঁধা এক পাথরের মূর্তিতে পরিণত হবে। সে আর আপনাকে ইভেন্ট হরাইজন পয়েন্ট অতিক্রম করতে দেখতে পাবে না।

কেন এরকম সম্পূর্ণ বিপরীত দৃশ্য দেখতে পাবেন আপনার সাথি ? এর জবাবে বিজ্ঞানীরা বলেছেন কৃষ্ণ গহ্বরের সম্মুখে স্পেস অর্থাৎ মহাকাশ আর টাইম অর্থাৎ সময়ের ভূমিকা সম্পূর্ণ বিপরীত মুখী হয়ে যায়। ইভেন্ট হরাইজন পয়েন্টে সময় একেবারে থমকে যায় কিন্তু স্পেস বা মহাকাশ ক্রমাগত সম্মুখে এগিয়ে যেতে থাকে। এই কারনেই আপনি যত এগিয়ে যেতে থাকবেন কৃষ্ণ গহ্বরের দিকে ততই আপনার সাথির চোখে মন্থর হতে থাকবে আপনার যাত্রা আর ইভেন্ট হরাইজনে এসে একেবারে জমাট বেঁধে যাবে আপনার অবয়ব। যেহেতু কৃষ্ণ গহ্বরের নিকট থেকে রেহাই মেলে না আলোরও তাই আলোর অভাবের কারনে আপনার সাথির চোখে ক্রমে ফ্যাকাসে হতে থাকবে আপনার অবয়ব।

কৃষ্ণ গহ্বর কি চির অমর নাকি মরণশীল ?
=============================
কৃষ্ণ গহ্বর কি অক্ষয়-অমর নাকি মহাকাশে উপস্থিত অনান্য গ্রহ, নক্ষত্র আর এমনকি ব্রহ্মাণ্ডের মতোই কৃষ্ণ গহ্বরও ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে থাকে বিনাশের দিকে ? এই প্রশ্নটা নিয়ে বহুকাল ধরে বিজ্ঞানিদের মধ্যে চলছে নানান তর্ক-বিতর্ক। অনেক মহাকাশ বিজ্ঞানীদের মতানুসারে যখন উদরস্থ করবার মতো আর কোন বস্তু অবশিষ্ট থাকে না কৃষ্ণ গহ্বরের নিকটে তখনই ধীরে ধীরে বিনাশের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে কৃষ্ণ গহ্বর। বিখ্যাত পদার্থ বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং এর মতানুসারে কৃষ্ণ গহ্বরের ইভেন্ট হরাইজন পয়েন্ট থেকে সংগঠিত নানাবিধ কোয়ান্টাম প্রভাবের কারনে একটি কৃষ্ণ গহ্বরের ভেতর থেকে ক্রমাগত থার্মাল ইলেক্ট্রো ম্যাগ্নেটিক রেডিয়েশনের বিকিরণ ঘটতে থাকে। এই বিকিরণ আজ হকিং রেডিয়েশন নামে সুপরিচিত। ব্ল্যাক হোলের দ্বারা নির্গত হকিং রেডিয়েশন বিকিরণকে বিজ্ঞানীরা ব্ল্যাক হোল ইভাপোরেশন অর্থাৎ কৃষ্ণ গহ্বর বাষ্পীভবন পক্রিয়া নামে উল্লেখ করেছেন। এই বাষ্পকরণের ফলে কৃষ্ণ গহ্বরের ভেতরে অবস্থিত যাবতীয় ভর আর তেজ ধীরে ধীরে নিঃশেষিত হয়ে আসতে থাকে। এর ফলে একটি কৃষ্ণ গহ্বরের নিকটে গিলবার মতো আর কোন বস্তু বা গ্রহাণু যখন অবশিষ্ট থাকে না তখন হকিং রেডিয়েশনের কারনে ধীরে ধীরে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে কৃষ্ণ গহ্বর।

আমাদের সূর্য কি কখনও কৃষ্ণ গহ্বরে রূপান্তরিত হতে পারে ?
=====================================
জানি এই অন্তিম পর্যায়ে উপস্থিত হয়ে এই প্রশ্নটাই হয়তো এখন আপনাদের মনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি শঙ্কা সৃষ্টি করেছে। তাহলে নিশ্চিত হন এই জেনে যে আমাদের সূর্যের পক্ষে একটি কৃষ্ণ গহ্বরে পরিণত হওয়া প্রায় অসম্ভব ব্যপার। কৃষ্ণ গহ্বরে রূপান্তরিত হবার জন্য যে বিপুল পরিমাণ ভরের প্রয়োজন সৌভাগ্যবশত সেই ভর নেই আমাদের সূর্যের নিকটে। আজ থেকে কয়েক লক্ষ বছর পর সূর্য যখন তার যাবতীয় তেজ আর ভর হারিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাবে ধ্বংসের দিকে তখন প্রথমে সেটি পরিণত হবে একটি Red Giant নক্ষত্রে। এরপর যখন সূর্যের সমস্ত জ্বালানি নিঃশেষিত হয়ে আসবে তখন সেটি পরিণত হবে Planetary Nebula তে। এরপর ধীরে ধীরে শীতল হয়ে মৃত নক্ষত্র সূর্য রূপান্তরিত হবে White Dwarf নক্ষত্রে। কিন্তু কৃষ্ণ গহ্বরে কখনই পরিণত হবে না সূর্য। কিন্তু কৃষ্ণ গহ্বরে পরিণত হোক বা না হোক, সূর্যের আলো নিঃশেষিত হয়ে এলে তার সাথে সাথে পৃথিবীর মাটি থেকে লুপ্ত হয়ে যাবে সমস্ত প্রানের চিহ্নও।

নিচের ছবিতে দেখছেন সূর্যের ভরের থেকে ১.৫ বিলিয়ন অধিক ভরযুক্ত কৃষ্ণ গহ্বর Poniua’ena। মহাকাশ বিজ্ঞানীদের মতানুসারে এই Poniua’ena কৃষ্ণ গহ্বরের চারপাশে অবস্থিত কুয়াসার হলো এখনও পর্যন্ত বৈজ্ঞানিকদের দ্বারা আবিষ্কৃত প্রাচীন ব্রহ্মাণ্ডের সবচেয়ে বৃহৎ আকারের কুয়াসার।

ব্ল্যাক হোলের অজানা রহস্য। – প্রথম পর্ব

রামায়ন, মহাভারত, গ্রীক পুরান, নর্স পুরান, মিশরীয় পুরান, সুমেরীয় পুরান সহ প্রাচীন পৃথিবীর বিবিধ পৌরাণিক গাঁথায় আমরা পড়েছি অতিকায় রাক্ষসদের লোকগাথা। সেইসব রাক্ষসদের ক্ষুধা নাকি ছিল অসীম। যা খাবার দেওয়া যেতো তাই উদরস্থ করতো। এমনকি হাতের মুঠোয় পুরে বেমালুম টপাটপ গিলে ফেলতো জলজ্যান্ত মানুষ আর বড় বড় গাছপালাকেও। হালের হলিউড চলচ্চিত্রেও আমরা দেখেছি অতিকায় কিংকং, গর্জিলা, ডায়নোসর, কাইজুদের মতো অতিকায় রাক্ষসদের। এইসব পৌরাণিক গাঁথা পাঠ করে এবং চলচ্চিত্র দেখে কিশোরকালে আমাদের মনে উদয় হয়েছে একটি অমোঘ প্রশ্ন, বাস্তবে সত্যিই কি আছে রাক্ষসদের অস্তিত্ব ? বড় হয়ে আমরা বুঝতে পেরেছি না বাস্তব নয় এইসব রাক্ষসদের অস্তিত্ব রয়েছে কেবলমাত্র কাল্পনিক জগতেই। কিন্তু সেই সাথে জানতে পেরেছি আরেকটি মহা সত্য। বাস্তবে প্রাণী জগতে রাক্ষসের অস্তিত্ব না থাকলেও রহস্যময় এই অনন্ত মহাকাশে কিন্তু সত্যিই রয়েছে রাক্ষসের অস্তিত্ব। না চমকে উঠবার কোন কারণ নেই। মহাকাশে অবস্থিত এই সর্বভুক রাক্ষসের নাম কৃষ্ণ গহ্বর। ইংরেজিতে আমরা যাকে ব্ল্যাক হোল নামে। ব্ল্যাক হোল নিয়ে পৃথিবীবাসীর মধ্যে রয়েছে অদম্য কৌতূহল আর নানাবিধ জিজ্ঞাসা। আজকের এই পোস্টে চেষ্টা করা হবে সহজ সরল বাংলা ভাষায় যতদূর সম্ভব তাঁদের সেই কৌতূহল নিরসনের।

কৃষ্ণ গহ্বর কি ?
==========
অনাদি আর অনন্ত এই ব্রহ্মাণ্ডে লুকিয়ে রয়েছে নানাবিধ অজানা রহস্য। সিংহভাগ রহস্যের সমাধান আজও করে উঠতে পারেননি পৃথিবীর তুচ্ছ মানব বৈজ্ঞানিকরা। কিন্তু সৌভাগ্যের বিষয় তারই মধ্যে কিছু কিছু রহস্যের সমাধান করতে সফলও হয়েছেন তাঁরা। ব্রহ্মাণ্ডের অজানা আর অমীমাংসিত রহস্যগুলোর মধ্যে আজ সবচেয়ে জনপ্রিয় হলো কৃষ্ণ গহ্বর অর্থাৎ ব্ল্যাক হোলের রহস্য। কৃষ্ণ গহ্বর জিনিষটা ঠিক কি ? সংক্ষেপে বলতে গেলে অনন্ত এই মহাকাশের কিছু কিছু রহস্যময় স্থানে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির প্রভাব আচমকা এতটাই অধিক মাত্রায় বেড়ে যায় যে সেইসব স্থানের নিকটে কোন বস্তু উপস্থিত হলেই রহস্যময় সেই স্থান তার মাধ্যাকর্ষণ শক্তির সাহায্যে পুরানে বর্ণিত রাক্ষসের ন্যায় নিমেষের মধ্যে গিলে ফেলে সেইসব বস্তুকে। প্রবল সেই মাধ্যাকর্ষণের টান থেকে নিস্তার মেলে এমনকি আলোর গতিরেখাও। আলোকেও গিলে ফেলে সেই স্থান। এইসব রহস্যময় স্থানগুলিকেই পৃথিবীর মহাকাশ বিজ্ঞানীরা ব্ল্যাক হোল অর্থাৎ কৃষ্ণ গহ্বর বলে আখ্যায়িত করেছেন।

কৃষ্ণ গহ্বর তৈরি হয় কিভাবে ?
==================
কৃষ্ণ গহ্বর ঠিক কি বস্তু সেটা তো আপনারা জানলেন কিন্তু কিভাবে তৈরি হয় এই কৃষ্ণ গহ্বর তা জানেন কি ? কৃষ্ণ গহ্বরের উপস্থিতির বিষয়ে সর্ব প্রথম মতবাদ প্রকাশ করা হয়েছিল ১৭৮৪ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে। তৎকালীন সমাজের আইজ্যাক নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ থিয়োরির কথা মাথায় রেখে নিজের সেই মতবাদে খুব সহজ সরলভাবে ইংরেজ পাদ্রি জন মিচেল জানিয়েছিলেন যে যদি কোন বিশাল তারকার ভেতরে অবস্থিত যাবতীয় পদার্থ কোন এক ক্ষুদ্র পরিসরের মধ্যে সঙ্কুচিত করে রেখে দেওয়া যায় তাহলে সেই তারকা রূপান্তরিত হবে এক কৃষ্ণ গহ্বরে। কিন্তু কোন জাদুমন্ত্র বলে এক বিশাল তারকার সমস্ত পদার্থ খুব ক্ষুদ্র পরিসরের মধ্যে সঙ্কুচিত করে রাখা সম্ভব ? না সেদিন এর বেশি কিছু আর জানাতে পারেননি জন মিচেল।

কিন্তু যত গড়িয়েছে সময়ের চাকা ততই উন্নত হয়েছে বিজ্ঞান, নিত্য নতুন প্রযুক্তি হস্তগত হয়েছে বিজ্ঞানীদের। তাঁরা তাঁদের গবেষণার মাধ্যমে আরও বিস্তারিতভাবে জানতে পেরেছেন কৃষ্ণ গহ্বরের সৃষ্টির কারণ। আধুনিক বিজ্ঞানীদের মতানুসারে মহাকাশে যখনই কোন তারকার ভেতরে অবস্থিত হাইড্রোজেন গ্যাস সহ যাবতীয় ইন্ধন আর তেজ নিঃশেষিত হয়ে এসে সেই তারকাটি পৌঁছে যায় ধ্বংস বা মৃত্যুর মুখে তখনই ঘটে যায় সুপারনোভা বিস্ফোরণ। আমরা জানি যে মহাকাশে অবস্থিত একেকটি অতিকায় তারকা বা নক্ষত্রের মাধ্যাকর্ষণ শক্তি সূর্যের থেকেও অনেকটাই বেশি। এই মাধ্যাকর্ষণ শক্তি আরও বৃদ্ধি পায় নক্ষত্রের ভেতরে কেন্দ্রস্থলের দিকে। একটি নক্ষত্র যে সব পদার্থ নিয়ে গঠিত সেইসব পদার্থগুলোকে প্রবলভাবে ভেতরের দিকে টানতে থাকে এই মাধ্যাকর্ষণ শক্তি। নক্ষত্রের ভেতরে উপস্থিত হাইড্রোজেন এবং অনান্য জ্বালানি গ্যাসের প্রভাবে আবার নক্ষত্রের অন্দরে সৃষ্টি হয় প্রবল তাপের। মাধ্যাকর্ষণ শক্তি বিরোধী হিসেবে কাজ করা এই প্রবল তাপ নক্ষত্রের ভেতর থেকে আসা প্রবল মাধ্যাকর্ষণ শক্তির প্রভাব খর্ব করে নক্ষত্রের পদার্থগুলোকে তাদের মূল স্থানে থাকতে সাহায্য করে।

আরো পড়ুন –  ব্ল্যাক হোলের অজানা রহস্য। – দ্বিতীয় পর্ব

কিন্তু যত নক্ষত্রের বয়স বৃদ্ধি পায় ততই নক্ষত্রের ভেতরে অবস্থিত হাইড্রোজেন সহ অনান্য জ্বালানি গ্যাস নিঃশেষিত হয়ে আসতে থাকে। একসময় ঘটে সুপারনোভা বিস্ফোরণ। এর ফলে আচমকা একটি নক্ষত্রের যাবতীয় জ্বালানি খতম হয়ে যায়। জ্বালানি খতম হবার সাথে সাথেই বাতাসের অভাবে বেলুন যেমন চুপসে যায়, ঠিক তেমনি নক্ষত্রের কেন্দ্রস্থল থেকে আসা প্রবল মাধ্যাকর্ষণ শক্তির প্রভাবে নক্ষত্রের যাবতীয় পদার্থ তার গহ্বরে প্রবেশ করে এক ক্ষুদ্র পরিসরের মধ্যে সঙ্কুচিত হয়ে জন্ম দেয় কৃষ্ণ গহ্বরের।

আধুনিক মহাকাশ বিজ্ঞানীদের মতে এই ব্রহ্মাণ্ডে অবস্থিত যে কোন বস্তু দ্বারাই নির্মিত হতে পারে কৃষ্ণ গহ্বর। এমনকি থিয়োরি অনুসারে আমার বা আপনার দেহাবশেষ দিয়েও গঠন করা যেতে পারে কৃষ্ণ গহ্বর। শুনে চমকে উঠলেন ? না চমকানোর কোন প্রয়োজন নেই। বিজ্ঞানীদের মতানুসারে প্রত্যেক বস্তুই ভরযুক্ত। যদি কোন বস্তুর সমস্ত ভর সেই বস্তুর Schwarzschild radius এর সীমার মধ্যে সঙ্কুচিত করে পুরে দেওয়া যায় তাহলে সেই বস্তু তৎক্ষণাৎ রূপান্তরিত হবে ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণ গহ্বরে। আমরা জানি যে একটি গোলক বা বর্তুলকার গোলকের সীমান্তবর্তী স্থান থেকে তার মধ্যবর্তী স্থান পর্যন্ত দূরত্ব একই থাকে। এই দূরত্বকে একটি সরলরেখা দ্বারা যুক্ত করা হলে তাকে ইংরেজিতে বলে radius অর্থাৎ ব্যাসার্ধ। Schwarzschild radius ও অনেকটা এরকমই একটা ব্যাসার্ধ। কিন্তু সাধারণ ব্যাসার্ধ আর Schwarzschild ব্যাসার্ধের মধ্যে সবচেয়ে বড় পার্থক্য হলো আমরা যদি কোন বস্তু বা গোলক বা বর্তুলকার গোলকের যাবতীয় ভর তার Schwarzschild ব্যাসার্ধের মধ্যে সঙ্কুচিত করে পুরে দিতে সফল হই তাহলে তৎক্ষণাৎ সেই বস্তু বা গোলক বা বর্তুলকার গোলক রূপান্তরিত হবে ব্ল্যাক হোলে।

প্রত্যেক বস্তুর Schwarzschild ব্যাসার্ধ ভিন্ন ভিন্ন হয়। এই ব্যাসার্ধ বের করবার জন্য ১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দে বিখ্যাত জার্মান বিজ্ঞানী Karl Schwarzschild একটি সূত্র বের করেছিলেন। বৈজ্ঞানিক কার্ল সুয়ার্সচাইল্ডের সূত্র দ্বারা নির্ণয় করা সূর্যের সুয়ার্সচাইল্ড ব্যাসার্ধ হলো প্রায় ৩ কিলোমিটারের মতো। অর্থাৎ আমরা যদি কোন উপায়ে সূর্যের ভেতরে অবস্থিত যাবতীয় পদার্থ সঙ্কুচিত করে সেইসব পদার্থ ৩ কিলোমিটার ব্যাসার্ধ যুক্ত কোন বর্তুলকার গোলকের ভেতরে পুরে দিতে সফল হই তাহলে সূর্য পরিণত হবে কৃষ্ণ গহ্বরে। আবার পৃথিবীকে ব্ল্যাক হোলে পরিণত করতে গেলে পৃথিবীর যাবতীয় পদার্থ ৯ মিলিমিটার ব্যাসার্ধ যুক্ত কোন গোলকের মধ্যে পুরে ফেলতে হবে। বাস্তবে পৃথিবী বা সূর্যের সমস্ত পদার্থ এতো ক্ষুদ্র পরিসরের মধ্যে সঙ্কুচিত করে রাখা প্রায় অসম্ভব। কিন্তু ব্রহ্মাণ্ডে অবস্থিত একাধিক সুবিশাল নক্ষত্রের সুয়ার্সচাইল্ড ব্যাসার্ধ সূর্যের সুয়ার্সচাইল্ড ব্যাসার্ধের চেয়ে অনেকটাই বেশি হয় এবং বয়স বাড়ার সাথে সাথে যখন তাদের হাইড্রোজেন গ্যাস সহ অনান্য জ্বালানির পরিসমাপ্তি ঘটে তখন আর সেইসব তারকা গুলি নিজেদের আগের মতো তপ্ত বা গরম রাখতে পারে না। এর ফলে সুপারনোভা বিস্ফোরণ ঘটে আর তারকাগুলির যাবতীয় ভর আর পদার্থ সঙ্কুচিত হয়ে খুবই অল্প পরিসরের মধ্যে আশ্রয় নিয়ে তারকা গুলিকে ব্ল্যাক হোলে পরিণত করে। মহাকাশ বিজ্ঞানের ভাষায় এই অতি স্বল্প পরিসরকে “সিঙ্গুলারিটি পয়েন্ট” নামে অভিহিত করা হয়েছে।

কৃষ্ণ গহ্বরকে চিহ্নিত করা হয় কিভাবে ?
========================
এই পর্যন্ত পাঠ করে এখন নিশ্চয়ই আপনাদের অনেকের মনের ভেতরে উদিত হয়েছে এক নতুন প্রশ্নের। কৃষ্ণ গহ্বর যদি আলোকেও গিলে ফেলে তাহলে বিজ্ঞানিরা কিভাবে সন্ধান পায় ব্ল্যাক হোলের উপস্থিতির ? যার অনন্ত আর অফুরান ক্ষুধা থেকে রেহাই মেলে না আলোরও তাহলে কোন জাদুমন্ত্র বলে তাকে শনাক্ত করে পৃথিবীর বৈজ্ঞানিকদের দ্বারা আবিষ্কৃত টেলিস্কোপ গুলি ?

যখনই কোন নক্ষত্র কৃষ্ণ গহ্বরে পরিণত হয় তখনই তার ঘনত্ব অর্থাৎ “density” infinite অর্থাৎ অসীম হয়ে যায় আর এর ফলে সেই কৃষ্ণ গহ্বরের মাধ্যাকর্ষণ শক্তি প্রবলভাবে বৃদ্ধি পায়। এর ফলে সংশ্লিষ্ট কৃষ্ণ গহ্বরটি এক রাক্ষস বা দৈত্যের ন্যায় তার নিকটে অবস্থিত যাবতীয় গ্রহাণুকে মুহূর্তের মধ্যে নিজের দিকে টেনে এনে গিলে ফেলে। এমনকি আলোর গতিরেখারও রেহাই মেলে না কৃষ্ণ গহ্বরের গ্রাস থেকে। কিন্তু তার মানেই এই নয় যে ব্ল্যাক হোলের নিকটে উপস্থিত যাবতীয় গ্রহাণু আর বস্তু কৃষ্ণ গহ্বরের মাধ্যাকর্ষণের টানে সোজা গিয়ে প্রবেশ করে ব্ল্যাক হোলের ভেতরে। ব্ল্যাক হোলের সম্মুখে উপস্থিত হয়ে সেইসব বস্তুগুলো ব্ল্যাক হোলের মাধ্যাকর্ষণের টানে এক চক্রাকার চাকির ন্যায় কৃষ্ণ গহ্বরের চারপাশে এক বিশেষ কক্ষপথ সৃষ্ট করে তিরবেগে ঘুরতে থাকে। এইভাবে প্রবল বেগে ঘুরতে ঘুরতে একসময় গ্রহাণু আর অনান্য বস্তুরা প্রবেশ করে কৃষ্ণ গহ্বরের ভেতরে। এই চক্রাকার চাকিকে বিজ্ঞানের ভাষায় অভিহিত করা হয় Accleration Disk নামে। যখন একসাথে অনেক গ্রহাণু বা বস্তু কোন কৃষ্ণ গহ্বরের চারপাশে অবস্থিত এই Accleration Disk বলয়ের মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে তখন প্রবল ঘর্ষণ আর মাধ্যাকর্ষণ শক্তির প্রভাবে তাদের মধ্যে প্রবল তাপের সৃষ্টি হয়। এই প্রবল তাপের কারনে সেইসব বস্তুগুলি থেকে নির্গত হয় এক ঘন আর অপার্থিব আলোকরশ্মি দ্যুতির বিকিরণ। এর ফলে ব্ল্যাক হোলের নিজস্ব কোন আলোকরেখা না থাকলেও (আলোকে পর্যন্ত গিলে ফেলে ব্ল্যাক হোল) এই আলোকরশ্মি দ্যুতির বিকিরণের সাহায্যেই অনেকটা দূরবর্তী স্থানে অবস্থিত হ্যাবল বা অন্য কোন শক্তিশালী মহাকাশ দূরবীক্ষণ স্পেস টেলিস্কোপ থেকে মহাকাশ বিজ্ঞানীরা খুঁজে বের করেন কৃষ্ণ গহ্বরের উপস্থিতি। খ্রিষ্টোফার নোলানের সাইফাই চলচ্চিত্র “ইন্টারস্টেলার” এ এরকমই এক হতভাগ্য গ্রহকে গরগন্তুয়া কৃষ্ণ গহ্বরের চারপাশে চক্কর খেতে দেখা গিয়েছিল। বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় এই আলোক রশ্মির দ্যুতিকে কুয়াসার (Quasar) বলা হয়।

এই পর্যন্ত পড়ে অনেকে হয়তো প্রশ্ন করতে পারেন যে যদি বস্তুগুলোর মধ্যে ঘর্ষণের ফলে আলোকরশ্মির দ্যুতি বিচ্ছুরিত না হতো তাহলে বিজ্ঞানীরা কিভাবে টের পেতেন ব্ল্যাক হোলের উপস্থিতি ? এর উত্তর হলো মহাসাগরের বুকে কোন নৌকো বা জাহাজকে প্রবলবেগে ঘুরপাক খেতে খেতে কোন বিশেষ একটি দিকে প্রবাহিত হতে দেখে নাবিক বা মাল্লারা যেমন অতি সহজেই বুঝে যান সাগরের বুকে ঘূর্ণির উপস্থিতির কথা ঠিক তেমনি বিজ্ঞানীরাও তাঁদের টেলিস্কোপে যখনই মহাকাশে কোন একটি বিশেষ স্থানকে কেন্দ্র করে তার চারপাশে অনবরতভাবে প্রবলবেগে ঘুরপাক খেতে দেখবেন কিছু গ্রহাণুকে তখনই তাঁরা বুঝে যাবেন এসব কিছু হচ্ছে সেই স্থানে উপস্থিত প্রবল মাধ্যাকর্ষণ শক্তির প্রভাবে আর একমাত্র কৃষ্ণ গহ্বরের দ্বারাই এহেন মাধ্যাকর্ষণ শক্তি প্রাদুর্ভাব ঘটানো সম্ভব।

একটি কৃষ্ণ গহ্বরের চারপাশে ঠিক কতকাল দেখা যেতে পারে আলোকরশ্মির দ্যুতি কুয়াসার (Quasar) ?
মহাকাশ বিজ্ঞানীদের মতানুসারে যখন কোন নতুন নক্ষত্রপুঞ্জ বা ছায়াপথের (Galaxy) মধ্যে সৃষ্টি হয় কোন কৃষ্ণ গহ্বরের তখন ক্ষুণ্ণি বৃত্তির জন্য তার চারপাশে মজুদ থাকে প্রচুর পরিমাণে গ্রহাণু আর স্পেস ডেব্রিস। এছাড়া যখন কোন দুটি ভিন্ন ভিন্ন ছায়াপথের মধ্যে আচমকা সংঘর্ষ হয় তখনও অনেক গ্রহ আর নক্ষত্র টুকরো টুকরো হয়ে ব্ল্যাক হোলের ক্ষুণ্ণিবৃত্তি করে। এর ফলে সৃষ্ট হয় অপার্থিব আলোকরশ্মির দ্যুতির বিকিরণ কুয়াসার (Quasar)। কিন্তু ছায়াপথ যত প্রাচীন হতে থাকে ততই শেষ হয়ে আসতে থাকে গ্রহাণু আর স্পেস ডেব্রিস বস্তুর সংখ্যা। যখন আর গিলবার মতো কোন বস্তু বা গ্রহাণু উপস্থিত থাকবে না ব্ল্যাক হোলের সম্মুখে তখন হয়তো আর দেখা যাবে না Quasar দ্যুতিও। মহাকাশ বিজ্ঞানিদের মতানুসারে একটি সর্ব বৃহতাকারের সুপার ম্যাসিভ কৃষ্ণ গহ্বর প্রতি বছর আমাদের সূর্যের ভরের সমান ওজনের বস্তু গলাধঃকরণ করে। এর ফলে এইসব সুপার ম্যাসিভ ব্ল্যাক হোল তাদের উত্তর আর দক্ষিণ মেরু দিয়ে প্রভূত পরিমাণে এনার্জি অর্থাৎ তেজ উদ্গিরণ করে। মহাকাশ বিজ্ঞানের ভাষায় এই পক্রিয়াকে কসমিক ইজেক্ট নামে অভিহিত করা হয়েছে। এই কুয়াশার (Quasar) আলোকরশ্মি দ্যুতি বিকিরণকে অনেক মহাকাশ বিজ্ঞানী আবার নতুন ছায়াপথ সৃষ্টির প্রাথমিক পর্ব বলেও অভিহিত করেছেন।

কৃষ্ণ গহ্বর কয় প্রকার ?
==============
আকারগত দিক দিয়ে বিচার করে মহাকাশ বিজ্ঞানীরা কৃষ্ণ গহ্বরকে মূলত তিন ভাগে বিভক্ত করেছেন। সবচেয়ে ক্ষুদ্রাকারের কৃষ্ণ গহ্বরকে Primordial black hole নামে অভিহিত করা হয়। মহাকাশ বিজ্ঞানিদের মতে বিগ ব্যাং মহা-বিস্ফোরণের পর পরই সৃষ্টি হয়েছিল Primordial black hole এর। Primordial black hole আকারে পরমাণুর ন্যায় ক্ষুদ্র হলেও তাদের ভর হিমালয় পর্বতের আকারের ন্যায় বিশাল হয়। মধ্যম আকারের কৃষ্ণ গহ্বরকে Stellar black hole নামে অভিহিত করা হয়। মহাকাশে সবচেয়ে অধিক পরিমাণে দর্শন মেলে এই Stellar black hole এরই। Stellar black hole এর ভর আমাদের সূর্যের ভরের থেকেও কুড়ি গুণ অধিক হয়। কিন্তু ব্ল্যাক হোলে পরিণত হবার পর তাদের অভ্যন্তরের যাবতীয় পদার্থ মাত্র ১০ মাইল ব্যাসার্ধের বর্তুলকার গোলকের মধ্যে সঙ্কুচিত হয়ে থেকে যায়। আবার কিছু কিছু কৃষ্ণ গহ্বর বিশাল আকারের হয়। এদের Super Massive black hole নামে অভিহিত করা হয়। আমাদের সূর্যের আকারের সাথে সাথে আরও দশ লক্ষ তাঁরার আকার একত্রিত হয়ে যতটা ভরের (Mass) সৃষ্টি হবে একটা সুপার ম্যাসিভ কৃষ্ণ গহ্বরের ভর ঠিক ততটাই। কিন্তু কৃষ্ণ গহ্বরে পরিণত হবার পর এদের সমস্ত পদার্থ আমাদের সৌর মণ্ডলের ব্যাসরেখার সমান আয়তন যুক্ত বর্তুলকার গোলকের মধ্যে সঙ্কুচিত হয়ে থেকে যায়।

মহাকাশ বিজ্ঞানিদের মতানুসারে প্রায় সমস্ত গ্যালাক্সি বা ছায়াপথের কেন্দ্রস্থলে এরকমই এক সুপার ম্যাসিভ কৃষ্ণ গহ্বরের অস্তিত্ব রয়েছে।
(পরবর্তী পর্বে আমরা জানবো ব্ল্যাক হোলের নানান অজানা রহস্য, কি হতো যদি আপনি ইন্টারস্টেলার মুভির মহাকাশচারী জোসেফ কুপারের মতো বাস্তবে পাড়ি জমাতেন ব্ল্যাক হোলের দিকে, ব্ল্যাক হোল কি চির অমর নাকি ধ্বংসযোগ্য আর আমাদের সূর্য কি কখনও রূপান্তরিত হতে পারে একটি ব্ল্যাক হোলে)

আধুনিক যুদ্ধের নিঃশব্দ স্বয়ংক্রিয় মৃত্যুদূত গাইডেড ক্ষেপণাস্ত্র

মহাভারতের রয়েছে নারায়ণাস্ত্র, পাশুপাত অস্ত্র, ব্রহ্মদণ্ড অস্ত্র সহ এমনসব একাধিক অস্ত্রের বিবরণ যাদের সাথে হুবুহু মিল রয়েছে বর্তমান যুগের স্যাটেলাইট দ্বারা নিয়ন্ত্রিত আর পরিচালিত গাইডেড ক্ষেপণাস্ত্রের। মহাভারতের বিবরণ অনুসারে মানবজাতির আদি পূর্বপুরুষ ভিনগ্রহী যোদ্ধাদের দ্বারা ব্যবহৃত ওইসব অস্ত্রগুলি স্বয়ংক্রিয়ভাবে শত্রুদের চিহ্নিত করে তাদের দিকে নির্ভুল লক্ষ্যে বিদ্যুৎ বেগে ধেয়ে এসে এক দক্ষ শল্যচিকিৎসকের দ্বারা ব্যবহৃত ছুরিকার ন্যায় মুহূর্তের মধ্যে তাঁদের সুনিপুণভাবে ধ্বংস করে দিতো। বর্তমান যুগের স্যাটেলাইট দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ক্ষেপণাস্ত্রগুলির ওয়ারহেডে সংরক্ষিত থাকে শক্তিশালী বোমা। ক্ষেপণাস্ত্রগুলি নিক্ষিপ্ত হবার পর মহাভারতের অস্ত্রের ন্যায় সেগুলিও তাঁদের শত্রুপক্ষকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে চিহ্নিত করে নির্ভুল লক্ষ্যে ধেয়ে এসে সুনিপুণভাবে ধ্বংস করে দেয় শত্রুদের। বর্তমান যুদ্ধে দুই ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র দেখা যায়। প্রথমটি আন্তর্মহাদেশীয় ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র আর দ্বিতীয়টি কৃত্রিম উপগ্রহ দ্বারা পরিচালিত গাইডেড ক্ষেপণাস্ত্র।

আমেরিকার LGM বা রাশিয়ার RS আর RT বা চিনের ডংফেং বা ভারতের অগ্নি সিরিজের দূরপাল্লার পরমানু অস্ত্র সংবাহক আন্তর্মহাদেশীয় ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলি (ICBM) একবার নিক্ষেপণের পর মহাকাশে উড্ডীন হয়ে ধনুকের ন্যায় পূর্বনির্ধারিত একটি বক্র গতিপথ (Arcing Trajectory) অনুসরন করে শত্রু শিবিরের দিকে ধেয়ে গিয়ে আছড়ে পড়ে আঘাত হানে। ওই সময় শত্রুপক্ষ তাঁদের স্থান পরিবর্তন করলেও আন্তর্মহাদেশীয় ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলি আর তাদের গতিপথ পরিবর্তন করতে পারবে না। এছাড়া ICBM ক্ষেপণাস্ত্র গুলি Mass Destruction অর্থাৎ একঘায়ে ব্যপক গণবিধ্বংসী তাণ্ডবলীলা চালায়। কিন্তু কোন এক বিশেষ লক্ষ্যবস্তুকে দক্ষ শিকারির ন্যায় নিঃশব্দে ধ্বংস করতে অক্ষম। অর্থাৎ ICBM গুলির কার্যক্ষমতা অনেকটা মহাভারতের ব্রহ্মাণ্ড অস্ত্র আর ব্রহ্মশীর্ষ অস্ত্রের মতো। অপরদিকে শত্রুপক্ষকে প্রাথমিকভাবে চিহ্নিত করে টার্গেট লক একবার নিক্ষেপণ করার পরেও কৃত্রিম উপগ্রহ দ্বারা পরিচালিত গাইডেড ক্ষেপণাস্ত্রগুলির গতিপথ প্রয়োজনে পরেও পরিবর্তন করা সম্ভব। এছাড়া উপগ্রহের সাহায্যে কম্যান্ড সিস্টেম থেকে শত্রুপক্ষের উপর নিরন্তর নজরদারি চালিয়ে গাইডেড ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে এক দক্ষ শিকারির ন্যায় নিঃশব্দে কোন এক বিশেষ লক্ষ্যবস্তুকে নিকেশ করা সম্ভব। শত্রুপক্ষ তাঁদের স্থান পরিবর্তন করলে গাইডেড ক্ষেপণাস্ত্রগুলিও স্বয়ংক্রিয়ভাবে তাদের যাত্রাপথ পরিবর্তন করে এবং অবশেষে নির্ভুল লক্ষ্যে সাক্ষাৎ যমদূতের ন্যায় শত্রুপক্ষের উপর আছড়ে পড়ে তাঁদের সুনিপুণভাবে ধ্বংস করে। ঠিক যেমন মহাভারতের আমলে করতো নারায়ণাস্ত্র, পাশুপাত অস্ত্র, ব্রহ্মদণ্ড অস্ত্র সহ অনান্য অস্ত্রগুলি। আধুনিক যুগের মানব বিজ্ঞানী আর প্রযুক্তিবিদরা কিভাবে তৈরি করতে সফল হলেন এইরকম অভূতপূর্ব গাইডেড ক্ষেপণাস্ত্র ? সবার প্রথম সেমি গাইডেড ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করেছিল কারা ? আসুন বিস্তারিত ভাবে জেনে নেই গাইডেড ক্ষেপণাস্ত্রের ইতিহাস আর প্রযুক্তি।

আরো পড়ুন- ব্ল্যাক হোলের অজানা রহস্য – প্রথম পর্ব

আধুনিক মানব সভ্যতার ইতিহাসে অ্যাডলফ হিটলারের নাৎসি বাহিনীর দ্বারা নির্মিত V2 রকেটই ছিল দুনিয়ার প্রথম সামরিক কৌশলযুক্ত (Tactical) দূরপাল্লার গাইডেড ক্ষেপণাস্ত্র। নাৎসি বাহিনীর V সিরিজের অত্যাধুনিক অস্ত্র নির্মাণ প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত এই V2 ক্ষেপণাস্ত্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটেন সহ ইউরোপের অনান্য দেশগুলির মাটিতে লাগাতার আছড়ে পড়ে মিত্র বাহিনীর রাতের ঘুম কেড়ে নিতে সফল হয়েছিল। যদিও নাৎসি বাহিনীর V2 ক্ষেপণাস্ত্রগুলি মিত্র বাহিনীর সামরিক ঘাঁটি সহ গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলিতে প্রায় নির্ভুল লক্ষ্যে আঘাত হেনে একসাথে অনেকগুলি লক্ষ্যবস্তুকে ধ্বংস করে মিত্র শিবিরে ব্যপক তাণ্ডবলীলার সৃষ্টি করেছিল কিন্তু সেইসব ক্ষেপণাস্ত্রগুলি কোন বিশেষ একজন শত্রু বা কোন বিশেষ একটি লক্ষ্যবস্তুতে নির্ভুল লক্ষ্যে আঘাত হেনে সেই শত্রু বা লক্ষ্যবস্তুকে ধ্বংস করতে অপারগ ছিল। এর কারন তৎকালীন সময়ের V2 ক্ষেপণাস্ত্রগুলির স্বয়ংক্রিয় গাইডেড পরিচালন ব্যবস্থা ততটা উন্নতমানের ছিল না। অর্থাৎ এককথায় V2 ক্ষেপণাস্ত্রগুলি ছিল কিছুটা আজকের যুগের ICBM ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলির মতো। সমগ্র শত্রুশিবির গুঁড়িয়ে দিয়ে অযথা বিশ্বের দরবারে শোরগোল না ফেলে নিঃশব্দে শত্রু শিবিরে আরও নির্ভুল ও যথাযথ ভাবে আঘাত হেনে শত্রুপক্ষের কোন এক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বা লক্ষ্যবস্তুকে নিকেশ বা ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে সমর বিজ্ঞানী আর প্রযুক্তিবিদদের নিরন্তর গবেষণা আর প্রয়াসের ফলেই আবিষ্কার হয় আজকের কৃত্রিম উপগ্রহ দ্বারা পরিচালিত অত্যাধুনিক গাইডেড ক্ষেপণাস্ত্র। আধুনিক যুদ্ধের ইতিহাসে মানব বিহীন শিকারি ড্রোন থেকে এই গাইডেড ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেই ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে নিঃশব্দে নির্ভুল লক্ষে আঘাত হেনে ইরাকের মাটিতে আমেরিকা নিকেশ করেছে ইরানের কট্টরপন্থী জিহাদি সেনাপ্রধান কাশেম সুলেমানিকে। আবার এই বছরেরই জুলাই মাসে আরেকটি ড্রোন থেকে বিস্ফোরক হীন তরবারির ন্যায় সুতীক্ষ্ণ ব্লেড যুক্ত গাইডেড ক্ষেপণাস্ত্র হেলফায়ার নিক্ষেপ করে মার্কিন বাহিনী নিঃশব্দে নিকেশ করেছে আল কায়দায় সর্বোচ্চ জিহাদি নেতা আয়মান আল জুয়াহরিকে। বলাই বাহুল্য গাইডেড হেলফায়ার ক্ষেপণাস্ত্রের এই সংস্করণের সাথে অভূতপূর্ব সাদৃশ্য রয়েছে মহাভারতে বর্ণিত শ্রীকৃষ্ণের গাইডেড সুদর্শন চক্রের সাথে।

বর্তমানে আধুনিক যুগের গাইডেড ক্ষেপণাস্ত্রগুলিতে বিস্ফোরক যুক্ত বোমা ছাড়াও সুদর্শন চক্রের ন্যায় ধারালো ব্লেড, জৈবিক কীটাণুযুক্ত ভাইরাস সহ নানাবিধ মারণাস্ত্র সংযুক্ত করা যায়। বর্তমান কালের অত্যাধুনিক গাইডেড ক্ষেপণাস্ত্রগুলি সর্বোচ্চ ৯,৬৬০ কিলোমিটার দূরত্ব পর্যন্ত নির্ভুল লক্ষ্যে শত্রুদের নিকেশ করতে সক্ষম। এছাড়া আজকের যুগের এইসব গাইডেড ক্ষেপণাস্ত্রগুলি পরমানু বোমা বহনেও সক্ষম। এইসব কারনে অগ্নি ৫ এর মতো আন্তর্মহাদেশীয় ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলি পরিবর্তে কৃত্রিম উপগ্রহ দ্বারা পরিচালিত গাইডেড ক্ষেপণাস্ত্রগুলি আমেরিকা, রাশিয়া, চিন, ইজরায়েল, ভারত সহ বিশ্বের অনান্য শক্তিধর রাষ্ট্রগুলিতে দ্রুতবেগে জনপ্রিয় হচ্ছে। কিন্তু ঠিক কিভাবে নির্ভুল লক্ষ্যে শত্রুদের নিকেশ করতে সফল হয় এই গাইডেড ক্ষেপণাস্ত্র ?

প্রত্যেকটি গাইডেড ক্ষেপণাস্ত্র মোট চারটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান দ্বারা নির্মিত হয়। সেগুলি হলো যথাক্রমে তাদের ইঞ্জিন, ওয়ারহেড, ফ্লাইট কন্ট্রোল সিস্টেম আর গাইডেন্স সিস্টেম অর্থাৎ পরিচালন ব্যবস্থা। অনেকটা মহাকাশযান গুলোর মতোই গাইডেড ক্ষেপণাস্ত্রের ইঞ্জিন সেই ক্ষেপণাস্ত্রটিকে তার লঞ্চার থেকে আকাশে উড্ডীন হয়ে লক্ষ্যবস্তুর দিকে ধাবিত হতে পরিচালনা করে। লঞ্চার বা উৎক্ষেপণ স্থল হলো সেই প্ল্যাটফর্ম যেখানে যার ইন্ধন শক্তির সাহায্যে যে কোন ক্ষেপণাস্ত্রকে উৎক্ষেপণ করা হয়। নাসা বা ইসরোর মহাকাশযান উৎক্ষেপণও লঞ্চার প্ল্যাটফর্মের সাহায্যেই করা হয়। কিন্তু ক্ষেপণাস্ত্রের লঞ্চার অনেক ছোট আকারের হয়। রামায়ন আর মহাভারতের আমলে ধনুক ছিল মানবজাতির আদি পূর্বপুরুষ ভিনগ্রহীদের ক্ষেপণাস্ত্র লঞ্চারের রূপক উৎক্ষেপণ স্থল।

যে কোন আধুনিক ক্ষেপণাস্ত্রের ওয়ারহেডে সংরক্ষিত থাকে বিস্ফোরক যুক্ত বোমা বা ভাইরাস যুক্ত জীবাণু অথবা ধারালো ব্লেড। এরপর ক্ষেপণাস্ত্রের ফ্লাইট কন্ট্রোল সিস্টেম ক্ষেপণাস্ত্রটিকে আকাশে তার উড়ানপথ সঠিকভাবে বজায় রেখে লক্ষ্যবস্তুর দিকে ধাবিত হতে পরিচালনা করে। গাইডেন্স সিস্টেমের কাজ হলো ক্ষেপণাস্ত্রের যাত্রাপথে শত্রুশিবিরের নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুর উপর নিরন্তর নজরদারি চালিয়ে ক্ষেপণাস্ত্রটিকে সঠিক পথে বা লক্ষ্যে পরিচালিত করা। নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে যে এই গাইডেন্স সিস্টেমই হচ্ছে যে কোন নিয়ন্ত্রিত ক্ষেপণাস্ত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর জটিল অঙ্গ। কৃত্রিম উপগ্রহ থেকে সংগৃহীত তথ্যের সাহায্যে শত্রু শিবিরের নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুর উপর নিরন্তর নজরদারি চালিয়ে লক্ষ্যবস্তুর সর্বশেষ সঠিক স্থান নির্ণয় করে সেই স্থানে পৌঁছনোর জন্য সঠিক আর নির্ভুল দিকে ক্ষেপণাস্ত্রটিকে নিরলস ভাবে পরিচালিত করাই হচ্ছে গাইডেন্স সিস্টেমের একমাত্র কাজ।

যে কোন গাইডেড ক্ষেপণাস্ত্রর পরিচালনা ব্যবস্থা মূলত পাঁচটি মৌলিক ব্যবস্থার উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে। সেগুলি হলো যথাক্রমে
১) কম্যান্ড অর্থাৎ চালনা করা
২) ইনার্শিয়াল (পদার্থ বিজ্ঞানের Inertia থেকে এই শব্দের উৎপত্তি)
৩) অ্যাকটিভ (সক্রিয়)
৪) সেমি অ্যাকটিভ (আধা সক্রিয়)
৫) প্যাসিভ (নিস্ক্রিয় বা অসাড়)

সিংহভাগ গাইডেড ক্ষেপণাস্ত্র গুলোকে মূলত দুই ধরনের পরিচালন ব্যবস্থার দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা হয়। সবচেয়ে অত্যাধুনিক গাইডেড ক্ষেপণাস্ত্রের পরিচালন ব্যবস্থা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দ্বারা ক্ষেপণাস্ত্রের মধ্যেই সংরক্ষণ করা থাকে। এর ফলে উৎক্ষেপণের পরে এইসব ক্ষেপণাস্ত্রগুলিকে আর ম্যানুয়ালি নিয়ন্ত্রণ করার প্রয়োজন হয় না। আর দ্বিতীয় পরিচালন ব্যবস্থায় ক্ষেপণাস্ত্রটির উৎক্ষেপণ কেন্দ্র অথবা উৎক্ষেপণ কেন্দ্র থেকে কিছুটা দূরে অন্য কোন দপ্তরে কৃত্রিম উপগ্রহের সাহায্যে ম্যানুয়ালি নিয়ন্ত্রণ করা হয় ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তিবিদ আর বিজ্ঞানীদের দ্বারা।

কম্যান্ড গাইডেন্স প্রক্রিয়ার অন্তর্ভুক্ত প্রযুক্তিবিদরা উৎক্ষেপণ কেন্দ্র অর্থাৎ লঞ্চ সাইট থেকে ক্ষেপণাস্ত্রের গতিপথ পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করে। এরপর তাঁরা রেডিও, রাডার আর লেসার ইমপালস অর্থাৎ লেসার রশ্মির স্পন্দন দ্বারা ক্ষেপণাস্ত্রটিকে নির্দেশিকা জারি করে যথাযথ ভাবে পরিচালনা করে। আধুনিক যুগে যে কোন সামরিক বাহিনীর রাডার বিভাগের কর্মীরা তাঁদের অত্যাধুনিক প্রযুক্তির রাডারের সাহায্যে শত্রু শিবিরের মূল লক্ষ্যবস্তুকে নির্ভুলভাবে চিহ্নিত আর শনাক্তকরণ করে লক্ষ্যবস্তুর সঠিক অবস্থান আর গতিপথ সম্বন্ধে যাবতীয় তথ্যবলী ক্ষেপণাস্ত্রের কম্যান্ড বিভাগকে প্রেরন করে। অপরদিকে সামরিক বাহিনীর কন্ট্রোল বিভাগ ক্ষেপণাস্ত্রের অপটিমাল ট্রাজেক্টরি অর্থাৎ সঠিক গতিপথ নির্ণয় করে সাঙ্কেতিক মাধ্যামে সেই গতিপথের নির্দেশ প্রেরন করে ক্ষেপণাস্ত্রটিকে।

বিভিন্ন প্রকারের গাইডেড ক্ষেপণাস্ত্র
=========================
গাইডেড ক্ষেপণাস্ত্র মূলত ৪ ধরনের হয়। সেগুলি হলো যথাক্রমে:

১) সেমি অ্যাকটিভ হোমিং সিস্টেম
=========================
যুদ্ধবিমান থেকে নিক্ষিপ্ত সেমি অ্যাকটিভ হোমিং সিস্টেম দ্বারা পরিচালিত গাইডেড ক্ষেপণাস্ত্রগুলির মূল অঙ্গের মধ্যেই একটি প্যাসিভ অর্থাৎ অক্রিয় রাডার রিসিভার সংযুক্ত করা থাকে। বর্তমান যুগের অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান গুলিতে সংযুক্ত শক্তিশালী হাল্কা ওজনের রাডার শত্রুপক্ষের লক্ষ্যবস্তুকে উদ্দীপ্ত (illuminate) করে তোলে। এরপর সেই যুদ্ধবিমানের হার্ড পয়েন্ট লঞ্চার থেকে নিক্ষিপ্ত গাইডেড ক্ষেপণাস্ত্রের সেমি অ্যাকটিভ হোমিং সিস্টেমের অন্তর্ভুক্ত অক্রিয় রাডারটি অতি সহজেই সেই উদ্দীপ্ত লক্ষ্যবস্তুকে চিহ্নিত করে (অর্থাৎ target lock করে) সেটির উপর নির্ভুল নিশানায় আছড়ে পড়ে লক্ষ্যবস্তুকে ধ্বংস করে দেয়। কিন্তু এই ক্ষেত্রে শত্রুপক্ষের লক্ষ্যবস্তুর দিকে নিক্ষিপ্ত ক্ষেপণাস্ত্রটির সঠিক গতিপথ বজায় রাখার জন্য সংশ্লিষ্ট যুদ্ধবিমানটির অন্তর্ভুক্ত রাডারকে ক্ষেপণাস্ত্রের সংঘর্ষের আগে পর্যন্ত সদা সর্বদা শত্রু শিবিরের লক্ষ্যবস্তুকে চিহ্নিত কুরে যেতে হয়। একবার যদি যুদ্ধবিমানের রাডার থেকে শত্রুপক্ষের লক্ষ্যবস্তু মুছে যায় তাহলে নিক্ষিপ্ত ক্ষেপণাস্ত্র তার লক হারিয়ে নিশানা চ্যুত হয়ে ভুল জায়গায় গিয়ে আছড়ে পড়ার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে। এই কারনে সংশ্লিষ্ট যুদ্ধবিমানের পাইলটকে ক্ষেপণাস্ত্রের গতির সাথে সাযুজ্য রেখে লক্ষ্যবস্তুকে নিজের বিমানের রাডারে ধরে রাখার জন্য ক্রমাগত দ্রুতবেগে বিমান চালিয়ে যেতে হবে। বাস্তবের আকাশ যুদ্ধে অনেকসময় শত্রুপক্ষের লক্ষ্যবস্তুকে নিজের বিমানের রাডারে ধরে রাখতে গিয়ে যুদ্ধবিমানের পাইলটরা বিপদজনক ভাবে বিমান পরিচালনা করে তাঁর বিমান সমেত শত্রুদের ডেরায় প্রবেশ করে পাল্টা ক্ষেপণাস্ত্র বা কামানের গোলা বা অ্যান্টি এয়ারক্রাফট গানের গুলি খেয়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়ে শহীদ হয়েছে। অনেক পাইলট আবার ইজেক্ট করে নিজেদের জীবন রক্ষা করতে অফল হলেও পরে শত্রুসেনাদের হাতে বন্দি হয়েছে। Jarhead: Law of Return সিনেমায় প্যালেস্টাইনের জিহাদি শিবিরের লক্ষ্যবস্তু ধ্বংস করার জন্য এইরকম কসরত করতে গিয়ে ইজরায়েলের বিমান বাহিনীর পাইলট ধরা পড়ে বন্দি হয় ইসলামিক জিহাদি গোষ্ঠীর হাতে।

২) অ্যাক্টিভ গাইডিং সিস্টেম
====================
বিপদের ঝুঁকির কারনে যে কোন রাষ্ট্রের বিমান বাহিনীর পাইলটরা তাঁদের যুদ্ধবিমানে সেমি অ্যাকটিভ হোমিং সিস্টেম দ্বারা পরিচালিত ক্ষেপণাস্ত্রের চেয়ে অ্যাক্টিভ গাইডিং সিস্টেম দ্বারা পরিচালিত ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করতেই বেশি পছন্দ করে। অ্যাক্টিভ গাইডিং সিস্টেম দ্বারা পরিচালিত ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণের পর তার মূল অঙ্গের মধ্যে সংযুক্ত একটি অত্যাধুনিক রাডার ট্রান্স রিসিভারের সাহায্যে নিজে নিজেই শত্রুশিবিরের লক্ষ্যবস্তুকে শনাক্ত করে সেই দিকে ধাবিত হয়ে মুহূর্তের মধ্যে নির্ভুল নিশানায় গুঁড়িয়ে দেয় লক্ষ্যবস্তুকে। যেহেতু লক্ষ্যবস্তুর শনাক্তকরণের জন্য এই ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র পূর্বের সেমি অ্যাকটিভ হোমিং সিস্টেম দ্বারা পরিচালিত ক্ষেপণাস্ত্র গুলির মতো তার উৎক্ষেপণ কেন্দ্র থেকে প্রেরিত সিগন্যালের উপর নির্ভরশীল নয় সেহেতু এই ধরনের ক্ষেপণাস্ত্রের উৎক্ষেপণ স্থল বা উৎক্ষেপণকারী যুদ্ধবিমান গুলিকে সঠিকভাবে শনাক্ত করাও প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে শত্রুদের পক্ষে। এছাড়া এই ধরনের ক্ষেপণাস্ত্রটির সঠিক গতিপথ বজায় রাখার জন্য যুদ্ধবিমানের পাইলটকেও অযথা প্রানের ঝুঁকি নিতে হয় না।

এছাড়া অ্যাক্টিভ গাইডিং সিস্টেম দ্বারা পরিচালিত ক্ষেপণাস্ত্রের অঙ্গের সাথে সংযুক্ত প্যাসিভ গাইডেন্স সিস্টেম পূর্বের সেমি অ্যাকটিভ হোমিং সিস্টেম দ্বারা পরিচালিত ক্ষেপণাস্ত্রগুলির মতো নিজের অঙ্গ থেকে কোনরকম এনার্জিও নির্গত করে না আর অন্য কোন বহিরাগত দূরবর্তী কম্যান্ড দপ্তর থেকেও নির্দেশ গ্রহণ করে না। এর পরিবর্তে এই ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র গুলি শত্রুশিবিরের লক্ষ্যবস্তু থেকে নির্গত গ্যাস বা রশ্মিবিচ্ছুরণ (radiation) এর সাহায্যে স্বয়ংক্রিয় ভাবে লক্ষ্যবস্তুকে শনাক্ত করে নির্ভুল নিশায় আছড়ে পড়ে ধ্বংস করে দেয়। অ্যাক্টিভ গাইডিং সিস্টেম দ্বারা পরিচালিত গাইডেড ক্ষেপণাস্ত্রের ইতিহাসে প্রাথমিক পর্বে নির্মিত পুরাতন আমলের ক্ষেপণাস্ত্রগুলি মূলত লক্ষ্যবস্তু থেকে নির্গত তাপের (heat seeking) সাহায্যে তাদের শনাক্ত করতো। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে প্রযুক্তির অভূতপূর্ব উন্নয়নের কারনে হাল আমলের অ্যাক্টিভ গাইডিং ক্ষেপণাস্ত্রগুলি তাপ ছাড়াও লক্ষ্যবস্তু থেকে নির্গত অতি বেগুনি রশ্মির বিচ্ছুরণ (Ultraviolet radiation) সহ অনান্য গ্যাস আর রশ্মির সাহায্যেও লক্ষ্যবস্তুকে শনাক্ত করে।

৩) ইনার্শিয়াল সিস্টেম
================
ইনার্শিয়াল সিস্টেম দ্বারা পরিচালিত গাইডেড ক্ষেপণাস্ত্রগুলির গতিপথ পূর্ব নির্ধারিত ভাবে প্রোগ্রামিং করা থাকে। কম্যান্ড বিভাগের কর্মীরা বিভিন্ন কৃত্রিম সামরিক উপগ্রহ দ্বারা পরিচালিত জাইরোস্কোপিক প্ল্যাটফর্ম আর ন্যাভিগেশন সিস্টেমগুলির সাহায্যে নিরন্তরভাবে মহাকাশে উড্ডীন ক্ষেপণাস্ত্রগুলির উপর নজরদারি চালিয়ে সেগুলির গতিপথ সঠিক দিশায় পরিচালিত করতে থাকে। কৃত্রিম উপগ্রহের সাহায্যে ক্ষেপণাস্ত্রগুলির সঠিক অবস্থান সম্বন্ধে যথাযথ তথ্য সংগ্রহ করার পর কম্যান্ড বিভাগের কর্মীরা তাঁদের অত্যাধুনিক কম্পিউটারের সাহায্যে ক্ষেপণাস্ত্রগুলির সঠিক গতিবেগ আর সঠিক দিক চিহ্নিত করে সেই মুহূর্তে ক্ষেপণাস্ত্রটি তার লক্ষ্যবস্তু থেকে ঠিক কতটা দূরত্বে আছে সেটা সঠিকভাবে নির্ণয় করে একটি বিশেষ সফটওয়্যারের সাহায্যে কৃত্রিম উপগ্রহ দ্বারা রিমোট সিগন্যাল প্রেরন করে উড়ন্ত ক্ষেপণাস্ত্রটিকে তার লক্ষ্যবস্তুর সর্বশেষ সঠিক অবস্থান আর সাম্ভাব্য গতিপথ সম্বন্ধে নিত্য নতুন নির্দেশ প্রেরন করতে থাকে। এর ফলে ক্ষেপণাস্ত্র আর ক্ষেপণাস্ত্রের উৎক্ষেপণ স্থলের লঞ্চ প্ল্যাটফর্ম থেকে কোন প্রকার বৈদ্যুতিন নিষ্ক্রমণ হয় না। এই কারনে সংশ্লিষ্ট ক্ষেপণাস্ত্রটির শনাক্তকরণ বেশ কঠিন হয়ে পড়ে শত্রুপক্ষের কাছে।

কিভাবে লক্ষ্যবস্তুকে সন্ধান করে ধ্বংস করে গাইডেড ক্ষেপণাস্ত্র
=============================================
গাইডেড ক্ষেপণাস্ত্রগুলি মূলত প্রান্তিক পরিচালন ব্যবস্থার (Terminal Guidance System) সাহায্যে নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুর সঠিক অবস্থান সম্বন্ধে অবগত হয়। সংঘর্ষের স্থান হয় পূর্ব নির্ধারিত ভাবে প্রোগ্রামিং করা থাকে অথবা ডিজিটাল সিন ম্যাচিং এরিয়া কো-রিলেটার সিস্টেমের সাহায্যে লক্ষ্যবস্তুর সঠিক অবস্থান সম্বন্ধে অনুসন্ধান করে সংঘর্ষের স্থান আর সময় নির্ধারণ করা হয়। অনেক গাইডেড ক্ষেপণাস্ত্র থার্মাল ইমেজিং আর ইলুমিনেশন সেন্সর দ্বারা সজ্জিত থাকে। থার্মাল ইমেজিং সেন্সরের সাহায্যে লক্ষ্যবস্তুর অঙ্গ থেকে নির্গত তাপ প্রবাহের দ্বারা আর ইলুমিনেশন সেন্সরের সাহায্যে লক্ষ্যবস্তুর অঙ্গ থেকে নির্গত আলোক রশ্মির বিচ্ছুরণের সাহায্যে লক্ষ্যবস্তুকে শনাক্ত করতে সফল হয় এইসব গাইডেড ক্ষেপণাস্ত্র।

একবার লক্ষ্যবস্তুকে শনাক্ত করে শিয়রে সমনের ন্যায় গাইডেড ক্ষেপণাস্ত্র লক্ষ্যবস্তুর সন্নিকটে উপস্থিত হয়ে মূল অভিঘাত স্থলে আছড়ে পড়ে একাধিক উপায়ে বিস্ফোরণ আর সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। মূলত গাইডেড ক্ষেপণাস্ত্রগুলি যেসব প্রকার বিবিধ উপায়ে লক্ষ্যবস্তুর সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয় সেগুলি হলো যথাক্রমে

১) ইমপ্যাক্ট অর্থাৎ সরাসরি সংঘাত
=========================
এই পদ্ধতিতে ক্ষেপণাস্ত্রটি সরাসরি এসে আছড়ে পড়ে লক্ষ্যবস্তুর উপর। এর ফলে ক্ষেপণাস্ত্রের ওয়ারহেড কায়িকভাবে লক্ষ্যবস্তুর সাথে সংস্পর্শে আসে। এই সংস্পর্শের ফলে ওয়ারহেডে অবস্থিত বোমাগুলি প্রবল বিস্ফোরণ করে লক্ষ্যবস্তুকে ধ্বংস করে। আল জুয়াহরির ক্ষেত্রে সংস্পর্শের সাথে সাথে হেলফায়ার ক্ষেপণাস্ত্রের ওয়ারহেডে সংরক্ষিত ধারালো শলাকাগুলি উন্মুক্ত হয়ে তিরবেগে ধেয়ে এসে চারদিকে থেকে আমূল বিদ্ধ করে আল কায়দার জিহাদি নেতাকে। এর ফলে নিঃশব্দে মুহূর্তের মধ্যে টুকরো টুকরো হয়ে যায় জুয়াহরির শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। ঠিক যেমনভাবে শ্রীকৃষ্ণের তীক্ষ্ণধার সুদর্শন চক্র নিমেশের মধ্যে টুকরো টুকরো করে দিয়েছিল মগধ নরেশ শিশুপালের দেহ আর বিষ্ণুর সুদর্শন চক্র টুকরো টুকরো করে দিয়েছিল সতীর দেহ। এক্ষেত্রে সুদর্শন চক্র আসলে হয়তো মানবজাতির পূর্বপুরুষ ভিনগ্রহীদের দ্বারা ব্যবহৃত কোন অত্যাধুনিক ড্রোন ছিল আর সেই ড্রোন থেকে নির্গত ওয়ারহেডে বোমার পরিবর্তে ধারালো শলাকা সংরক্ষিত ছিল।

২) বিলম্বিত সংঘাত
==============
মাঝেমধ্যে লক্ষ্যবস্তুর সাথে সংস্পর্শের পর ক্ষেপণাস্ত্রের ওয়ারহেডের বিস্ফোরণের ডেটোনেটের সময় পূর্ব নির্ধারিত প্রোগ্রামিং এর দ্বারা ইচ্ছাকৃতভাবে কিছুটা বিলম্বে করা হয়ে থাকে। সাধারণত শত্রুপক্ষের ডেরায় উপস্থিত নিজ দলের কম্যান্ডো সেনাদের নিরাপদ দূরত্বে সরে আসার জন্য যথাযথ সময় প্রদানের জন্য এই ধরনের বিলম্বিত ডেটোনেট প্রোগ্রামিং করা হয়ে থাকে।

৩) লেসার রশ্মি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত সংঘাত
==========================
এই পদ্ধতিতে একটি গাইডেড ক্ষেপণাস্ত্র মূল লক্ষ্যবস্তুর নিকটবর্তী স্থানে এসে উপস্থিত হবার পর তার অঙ্গে সজ্জিত রাডার, লক্ষ্যবস্তু থেকে নির্গত শব্দ তরঙ্গ, চৌম্বকীয় সেন্সর আর লেসার রশ্মির সাহায্যে ওয়ারহেডে সংরক্ষিত বিস্ফোরক বা শলাকার ডেটোনেটের সঠিক সময় নির্ধারণ করে।

সময়ের রথের চাকা যত সম্মুখপানে গড়াবে আমাদের মানবজাতির বিজ্ঞান আর প্রযুক্তিও ততধিক উন্নত হতে থাকবে। ভবিষ্যৎকালে সমর বিজ্ঞানীরা হয়তো এমন অত্যাধুনিক গাইডেড ক্ষেপণাস্ত্র নির্মাণ করতে সফল হবেন যা কোন প্রকার মানব দ্বারা পরিচালিত কম্যান্ড সেন্টারের সাহায্য ছাড়াই সম্পূর্ণভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে আরও অত্যাধুনিক কৃত্রিম উপগ্রহ থেকে ফুটেজ সংগ্রহ করে নিজে নিজেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে একাধিক লক্ষ্যবস্তুকে খুঁজে বের করবে। এরপর মাত্র একটি গাইডে ক্ষেপণাস্ত্র তার ওয়ারহেডে অবস্থিত একাধিক ওয়ারহেড থেকে একাধিক বোমা আর শলাকা নির্গত আর ডেটোনেট করে একসাথে বিভিন্ন স্থানে উপস্থিত একাধিক লক্ষ্যবস্তুকে মুহূর্তের মধ্যে সফলভাবে নিকেশ করবে, ঠিক যেমন মহাভারতে অর্জুনের ধনুক থেকে নিক্ষিপ্ত মাত্র একটি তির শূন্যে উৎক্ষেপিত হয়ে একাধিক তিরের সৃষ্টি করে একসাথে একাধিক শত্রুদের নিধন করতো। সমর বিজ্ঞানের পরিভাষায় এই ধরনের গাইডেড ক্ষেপণাস্ত্রকে। বাস্তবে দূরপাল্লার গণবিধ্বংসী ICBM ক্ষেপণাস্ত্রগুলি ইতিমধ্যেই এই ধরনের প্রযুক্তি আহরণ করতে কিছুটা সফলও হয়েছে। সমর বিজ্ঞানের পরিভাষায় এই ধরনের ICBm কে Multiple independently targetable reentry vehicle বা সংক্ষেপে (MIRV) নামে অভিহিত করা হয়। কিন্তু টোমাহক বা ব্রাহ্মসের মতো গাইডেড ক্ষেপণাস্ত্রের নিকটে এই ধরনের অর্জুন জাতীয় প্রযুক্তি এখনও অধরা।

ঈশ্বরের সন্ধানে বিজ্ঞান

ঈশ্বর বলতে আমরা ঠিক কি বুঝি ? এমন কোন মহাশক্তি যাকে দেখা যায় না, স্পর্শ করা যায় না, এমনকি মাপাও যায় না কিন্তু আমাদের মানব জীবন সহ সমগ্র জীব জগতে যার বা যাদের প্রভাব অসীম। কিন্তু এখানে অনেকেই প্রশ্ন তুলবেন

১) ঈশ্বর বলে যদি কিছু থেকেই থাকে তবে যুগ-যুগান্তর কাল ধরে তাঁর বা তাঁদের অস্তিত্ব এখনও পর্যন্ত কোন ভক্ত কেন প্রমান করতে পারলেন না। কেন আজ পর্যন্ত কেউ তাঁর বা তাঁদের দেখা পেলেন না। কেনই বা আজ পর্যন্ত কোন তথাকথিত ঈশ্বর বা ঈশ্বরদের ভিডিও ফুটেজ পাওয়া গেল না। টাইম ট্রাভেল, ওয়ার্ম হোল, টাইম ডাইলেশন, ব্ল্যাক হোলের মতবাদও আজ পর্যন্ত কেউ নিজের চোখে দেখতে বা দেখাতে পারেননি। কিন্তু অঙ্কের সমীকরণ দিয়ে অন্তত প্রমানিত করেছেন। তাহলে আজ পর্যন্ত কোন ভক্ত কেন নিদেন অঙ্কের সমীকরণ দিয়েও ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমান করতে পারলেন না ?

২) এছাড়া ইতিহাস অনুসারে যুগে যুগে যখন সনাতনী ধর্মের ঈশ্বরদের উপাসনালয় আর মূর্তিগুলি আক্রান্ত হয়েছে আব্রাহামিক ধর্মের জিহাদিদের দ্বারা, আবার আব্রাহামিক ধর্মের ইহুদি আর খ্রিস্টানদের উপাসনালয় গুলি আক্রান্ত হয়েছে ইসলামের দ্বারা আবার স্পেন, ইজরায়েল, চিন, পাকিস্তান, আফগানিস্থান, ইরাক সহ অনান্য জায়গায় যখন ইসলামের উপাসনালয় গুলিও আক্রান্ত হয়েছে রাষ্ট্রীয় বাহিনী আর জিহাদি সংগঠনগুলোর দ্বারা তখনই বা কেন কোন ঈশ্বর মর্ত্যে আবির্ভূত হলেন না তাঁদের মূর্তি আর উপাসনালয় গুলি রক্ষা করার জন্য ?

৩) ঈশ্বরই যদি ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টিকর্তা হবেন তাহলে ঈশ্বরকে সৃষ্টি করলো কে বা কারা ?

৪) মহাদেব, ইন্দ্র, কৃষ্ণ, কার্তিক, জিউস, অ্যাথেনা, আর্টিমিস, গণেশ, থর, ওডিন, বালডুর, জুপিটার, হোরাস, সেথ, থট, আনুনাকি, সহ হিন্দু আর অন্যান্য প্রাচীন সনাতনী ধর্মীয় পুরানগুলিতে বর্ণিত দেব-দেবীরা যদি সত্যিই ঈশ্বর হবেন তাহলে তাঁদের দ্বারা ব্যবহৃত প্রযুক্তি আর অস্ত্রের সাথে এখনকার দিনের ড্রোন, ক্ষেপণাস্ত্র, যুদ্ধবিমান, টাইম ডাইলেশন থিয়োরি, স্ট্রিং থিয়োরি ইত্যাদি মিলে যাচ্ছে কিভাবে ? ঈশ্বরের দ্বারা ব্যবহৃত দৈবিক অস্ত্রসস্ত্র, প্রযুক্তি আর বিজ্ঞান তো মানুষের পক্ষে জানা বা আহরণ করা সম্ভব নয়।

এসব প্রশ্ন শুনেই বোঝা যাচ্ছে ঈশ্বর আসলে আলৌকিক শক্তির অধিকারী কোন সৃষ্টিকর্তা নন। তবে ঈশ্বর কে বা কারা ? বিজ্ঞানের পরিভাষায় ঠিক কাকে বা কাদের ঈশ্বর বলে অভিহিত করা উচিত ? ঈশ্বর হচ্ছে সেই বস্তু যাকে দেখা যায় না, স্পর্শ করা যায় না আর মাপাও যায় না। কিন্তু যার প্রভাব আমাদের জীব জগতের উপর অসীম অর্থাৎ

১) মাধ্যাকর্ষণ শক্তি
============
মাধ্যাকর্ষণ শক্তি হচ্ছে এমন এক শক্তি যার দ্বারা পৃথিবীতে জোয়ার, ভাঁটা সহ নানাবিধ কাজকর্ম হয়। হজম প্রক্রিয়া, হাঁটাচলার প্রক্রিয়া, দেহের কোষের বৃদ্ধি সহ মানব আর জীব দেহে পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তির প্রভাব অসীম

২) সময়
======
সময় হচ্ছে আরেক বৃহৎ শক্তি যাকে দেখা যায় না, শোনা যায় না। তবে অঙ্কের সমীকরণ দিয়ে প্রমান পাওয়া যায় আর ঘড়ি ও ক্যালেন্ডার দিয়ে মাপা যায়। সময়ের প্রভাবেই মানুষের জন্ম হয়, বয়স বাড়ে, বৃদ্ধ হয় ও শেষে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। এই কারনে সময়কে মহাকাল বলে অভিহিত করা হয়।

৩) স্থান বা স্পেস
===========
বিজ্ঞানের মতে ব্রহ্মান্ডের বিস্তার অনন্ত। বিগ ব্যাঙ বিস্ফোরণের পূর্বে সমস্ত কিছু একটা সিঙ্গুলারিটি বিন্দুতে সীমাবদ্ধ থাকলেও বিস্ফোরণের পরে ক্রমেই অনন্ত দিগন্তে প্রসারিত হচ্ছে আমাদের ব্রহ্মান্ড। অর্থাৎ অনন্ত দিগন্ত বলতে infinite space বা অসীম স্থানকে বোঝানো হচ্ছে। স্থানের অস্তিত্ব না থাকলে মহাকাশ বা মহাশূন্যের অস্তিত্ব থাকতো না। মহাকাশের অস্তিত্ব না থাকলে পৃথিবী, চন্দ্র, সূর্য, মঙ্গল, বৃহস্পতি গ্রহ সহ ব্রহ্মান্ডের কোন গ্রহ আর নক্ষত্রেরও অস্তিত্ব থাকতো না।

৪) পৃথিবীর জিও ম্যাগনেটিক পোল
=====================
পৃথিবীর চৌম্বকীয় মেরু শুধুমাত্র কম্পাসের সাহায্যে পৃথিবীর দিক নির্ণয় করতেই সাহায্য করে না। সূর্য থেকে ধেয়ে আসা আলট্রা ভায়োলেট রশ্মি, গামা রশ্মি সহ একাধিক ক্ষতিকারক রশ্মির আগ্রাসনের হাত থেকে পৃথিবীর বায়ু মণ্ডল ও পৃথিবীবাসী প্রাণীদের রক্ষা করে

৫) মৌলিক কনা
==========
মৌলিক কণা বা প্রাথমিক কণা হল সেসব কণা , যাদের ক্ষুদ্রতর কোন ভিত্তি বা গাঠনিক একক নেই অর্থাৎ এরা অন্য কোনো ক্ষুদ্রতর কণার সন্নিবেশে গঠিত হয়নি। আপ, ডাউন, চার্ম, ইলেকট্রন, ফোটন, হিগস বোসন, ইলেকট্রন নিউট্রিনো, টাও নিউট্রিনো সহ অনান্য মৌলিক কনাগুলোর দ্বারাই মানুষ ও অনান্য জীবজন্তু সহ ব্রহ্মাণ্ডের যাবতীয় জড় ও অজড় পদার্থের গঠন হয়েছে। এগুলোর মধ্যে অনেকগুলোর অস্তিত্ব বিজ্ঞান আজ আবিস্কার করেছে। কিন্তু হিগস বোসন সহ কিছু কিছু মৌলিক কনার আবিস্কার এখনও পর্যন্ত সম্ভব হয়নি। তবে তাদের অস্তিত্ব অনুভব করা যায়।

৬) হিগস ফিল্ড আর হিগস বোসন কনা
========================
হিগস ফিল্ড হচ্ছে এমন এক অদৃশ্য ক্ষেত্র যা আমাদের ব্রহ্মাণ্ড গঠনে প্রতিনিয়ত সাহায্য করছে। এই হিগস ক্ষেত্রের মধ্যে রয়েছে হিগস-বোসন নামের এমন এক মৌলিক কনা যা ইলেকট্রন, কোয়ার্ক সহ ব্রহ্মাণ্ডের অনান্য মৌলিক কনাগুলি ভর বা মাস প্রদান করতে সাহায্য করে। অর্থাৎ এক কথায় হিগস বোসন কনার সাহায্যেই আমরা ভর পাই। যদি হিগস বোসন কনার অস্তিত্ব না থাকতো তাহলে এই ব্রহ্মাণ্ডে ইলেকট্রন, প্রোটন, কোয়ার্ক সহ কোন পদার্থরই নিজস্ব ভর থাকতো না। ফলে কোন পদার্থই আর একে অপরকে আকর্ষণ করতো না আর তারা আলোর সমান গতিবেগে ক্রমাগত ভ্রমন করতে থাকতো। এর ফলে পৃথিবী সহ অন্য কোন গ্রহেই জীব জগতের অস্তিত্ব থাকতো না

৭) ঘোস্ট পার্টিকেল
============
ঘোস্ট পার্টিকেল অর্থাৎ ভৌতিক কনা নিউট্রিনো হচ্ছে সাব অ্যাটমিক পর্যায়ের এক মৌলিক কনা যাকে দেখা যায় না, শোনা যায় না, স্পর্শ করাও যায় না। কিন্তু নিউট্রিনো হচ্ছে সাব অ্যাটমিক পর্যায়ের লেপটনের অন্তর্ভুক্ত ইলেকট্রনের negetively charged এমন এক মহাগুরুত্বপূর্ণ মৌলিক কনা প্রোটন, নিউট্রন আর পরমানু গঠনে যার ভূমিকা বা অবদান অপরিসীম। আবার এই পরমানু দিয়েই গঠিত হয়েছে জীব জগত সহ ব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত দ্রষ্টব্য জড় ও অজর পদার্থ।

৮) ডার্ক ম্যাটার আর ডার্ক এনার্জি
=====================
আমাদের বিজ্ঞানীদের মতে আমরা মানবজাতি আজ পর্যন্ত অনন্ত এই ব্রহ্মাণ্ডের মাত্র ৬% পদার্থের সন্ধান পেয়েছি। বাকি ৯৪% পদার্থ এখনও পর্যন্ত অধরাই রয়ে গিয়েছে। এই ৯৪% পদার্থ হচ্ছে ডার্ক ম্যাটার আর ডার্ক এনার্জি। বিজ্ঞানীদের মতে ব্রহ্মাণ্ড গঠনে এই অদৃশ্য শক্তি ডার্ক ম্যাটার আর ডার্ক এনার্জির ভূমিকা অপরিসীম। ভবিষ্যতে যদি মানবজাতি কোনদিন ডার্ক ম্যাটার আর ডার্ক এনার্জির সামান্য কিছু অংশেরও সন্ধান পায় তাহলে বিজ্ঞানের বলে বলীয়ান মানবজাতির ক্ষমতা রামায়ন, মহাভারত, বেদ, বেদান্ত, সুমেরীয়, মিশরীয় নর্স, মায়ান, গ্রীক পুরান, হিব্রু আর খ্রিস্টান বাইবেল ও কোরানে বর্ণিত তথাকথিত ঐশ্বরিক ক্ষমতার সমতুল্য হয়ে যাবে। সেদিন মানুষ হয়তো ডার্ক ম্যাটারের সাহায্যে শারীরিক ভাবে নিজেদের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে চোখের নিমেষে টেলিপোর্ট করতে আর কৃত্রিম ওয়ার্মহোল নির্মাণ করে ইন্টারস্টেলার মহাকাশ ভ্রমন ও টাইম ট্রাভেল করতেও সফল হবে

৯) অ্যান্টি ম্যাটার
===========
বাস্তব বিজ্ঞানের জগতে ডার্ক ম্যাটার আর ডার্ক এনার্জির মতো অ্যান্টি ম্যাটারেরও আবিস্কার হয়নি। কিন্তু অঙ্কের সমীকরণ দ্বারা অ্যান্টি ম্যাটারের অস্তিত্ব প্রমানিত হয়েছে। অ্যান্টি ম্যাটার হলো বিজ্ঞানের দ্বারা আবিষ্কৃত আমাদের চির পরিচিত মৌলকনা গুলোর সম্পূর্ণ বিপরীত। বিজ্ঞানীদের মতে অ্যান্টি ম্যাটার আর সাধারন ম্যাটারের মধ্যে সামঞ্জস্যের কারনেই আমাদের ব্রহ্মাণ্ডের অস্তিত্ব টিকে রয়েছে। কিন্তু যদি কোনদিন সাধারন মৌলকনা আর অ্যান্টি ম্যাটারের মধ্যে সংঘর্ষ হয় তবে সেদিন আমাদের পৃথিবী সহ সমগ্র ব্রহ্মাণ্ড ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়ে অস্তিত্ব বিলোপ ঘটবে। অ্যান্টি ম্যাটারকে অনেকে এক্সোটিক ম্যাটার বলেও অভিহিত করেন। অনেক বিজ্ঞানীদের মতে মানুষ যদি কোনদিন কৃত্রিম উপায়ে ওয়ার্মহোল নির্মাণ করতে সফলও হয় বা ইন্টারস্টেলার সিনেমার মতো মহাকাশে যদি কোন পূর্ব নির্মিত ওয়ার্মহোলের সন্ধান লাভ করে তাহলেও সেই ওয়ার্মহোলের মধ্যে দিয়ে মহাকাশযান সমেত যাতায়াত করা সম্ভব হবে না। কারন ওই ওয়ার্মহোল এতটাই অস্থির থাকবে যে সেটা যে কোন মুহূর্তে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। তবে মানুষ যদি সত্যি সত্যি কোনদিন অ্যান্টি ম্যাটারের অস্তিত্বের সন্ধান পায় তবে এই বিশেষ পদার্থের সাহায্যে কৃত্রিমভাবে নির্মিত ওয়ার্মহোলকে মহাকাশযান যাতায়াতের জন্য যথেষ্ট স্থিতিশীল করে তোলা যাবে।

১০) ব্ল্যাক হোল আর হোয়াইট হোল
=====================
ব্রহ্মাণ্ডের আরেক বিস্ময়ের নাম কৃষ্ণ গহ্বর আর শ্বেত গহ্বর। আধুনিক বিজ্ঞানীদের মতানুসারে যদি কোন বিশাল নক্ষত্রের ভেতরে অবস্থিত যাবতীয় পদার্থ কোন এক ক্ষুদ্র পরিসরের মধ্যে সঙ্কুচিত করে রেখে দেওয়া যায় তাহলে সেই তারকা রূপান্তরিত হবে এক কৃষ্ণ গহ্বরে। এতো ক্ষুদ্র পরিসরে এতো বিপুল পরিমানে অনন্ত এনার্জির উপস্থিতির কারনে কৃষ্ণ গহ্বরের মাধ্যাকর্ষণ শক্তি এতো বিপুল আর অজুদ পরিমানে থাকে যে সেই মাধ্যাকর্ষণ শক্তির প্রভাব খণ্ডন করা সম্ভব হয়না আলোর মতো ব্রহ্মাণ্ডের সবচেয়ে দ্রুততম পদার্থের পক্ষেও। এই কারনে ব্ল্যাক হোলের ভেতরে বিরাজ করে চিরস্থায়ী ঘন অন্ধকার। ব্ল্যাক হোলের ভেতরে স্থান বদলে যায় কালে আর কাল বদলে যায় স্থানে। কৃষ্ণ গহ্বরের ক্ষমতা অসীম। কোন বস্তু একবার কোন কৃষ্ণ গহ্বরের হরাইজন বিন্দুতে প্রবেশ করলে সেই বস্তুর পক্ষে আর ফিরে আসা সম্ভব হয়না। সেই বস্তু বা বস্তুগুলো চিরতরে আটকে পড়ে কৃষ্ণ গহ্বরের ভেতরে। এই কৃষ্ণ গহ্বরের কেন্দ্রস্থলে রয়েছে সিঙ্গুলারিটি পয়েন্ট। হকিংস বিকিরণের প্রভাবে ধীরে ধীরে ক্ষয় হতে হতে একসময় বিনাশ ঘটে কৃষ্ণ গহ্বরের। সেই সাথে অস্তিত্ব বিলোপ হয় কৃষ্ণ গহ্বরের ভেতরে আটকে পড়া যাবতীয় পদার্থগুলোরও। এই ব্ল্যাক হোলকেই অন্ধকার জগতের শয়তানদের প্রধান ডরমামু হিসেবে উপস্থাপিত করা হয়েছিল ২০১৬ সালের ডক্টর স্ট্রেঞ্জ সিনেমায়।

কৃষ্ণ গহ্বরের ঠিক উল্টো রূপ হচ্ছে শ্বেত গহ্বর। কৃষ্ণ গহ্বর তার অনন্ত মাধ্যাকর্ষণ শক্তির দ্বারা আলো সহ যেমন এই ব্রহ্মাণ্ডের যাবতীয় পদার্থকে গিলে খেয়ে নেয় শ্বেত গহ্বর ঠিক তার উল্টোটা করে। শ্বেত গহ্বর তার ভেতরে অবস্থিত যাবতীয় পদার্থকে বাইরে উগড়ে দিয়ে নিত্য নতুন সৃষ্টি করে। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা ব্ল্যাক হোলের অস্তিত্বের সন্ধান পেলেও হোয়াইট হোলের বাস্তবিক অস্তিত্বের সন্ধান আজপর্যন্ত মেলেনি। শুধুমাত্র অঙ্কের সমীকরণ আর তাত্ত্বিক পদার্থ বিজ্ঞানেই সীমাবদ্ধ রয়েছে শ্বেত গহ্বর। কৃষ্ণ গহ্বর আর শ্বেত গহ্বরের শক্তি অপরিসীম। বিজ্ঞানীদের মতে কেউ একবার কৃষ্ণ গহ্বরের হরাইজন পয়েন্টে পৌঁছে গেলে সে এতটাই তীব্র টাইম ডাইলেশনের শিকার হবে যে তার ঘড়ির কাঁটায় যতক্ষণে এক ঘণ্টা সময় অতিবাহিত হবে পৃথিবীবাসীদের ক্যালেন্ডারে ততদিনে হয়তো ১০০০ বছর সময় অতিক্রান্ত হয়ে যাবে। এছাড়াও তাত্ত্বিক ভাবে যদি কোন ব্যক্তি ব্ল্যাক হোলের ভেতরে প্রবেশ করে সিঙ্গুলারিটি বিন্দুর দিকে ধাবিত হতে থাকে তবে সে স্থান পরিবর্তনের বদলে টাইম ট্রাভেল করবে। কিন্তু আলোর অভাবে সে সেই টাইম ট্রাভেলের দৃশ্য দেখতে পাবে না। এছাড়া তাত্ত্বিক ভাবে যদি কোন কৃষ্ণ গহ্বরের অপরপ্রান্তে কোন শ্বেত গহ্বরের অস্তিত্ব থাকে তবে কোন ব্যক্তি যদি একবার ব্ল্যাক হোলের সিঙ্গুলারিটি বিন্দু অতিক্রম করতে পারে তবে সে তার চিরপরিচিত ব্রহ্মাণ্ড আর সময়কে পরিত্যাগ করে কোন সামন্তরাল ব্রহ্মাণ্ড বা অতীত অথবা ভবিষ্যৎকালের অন্য কোন সময় সরণিতে পৌঁছে যাবে। তাই ব্রহ্মাণ্ডের অন্যতম বিস্ময়কর শক্তির নাম কৃষ্ণ আর শ্বেত গহ্বর।

ব্রহ্মাণ্ড (Universe), স্থান (Space) আর কালের (Time) সাথে হিন্দু পুরানের মিল
=====================================================
পরিশেষে বলা যায় যে ব্রহ্মাণ্ড সহ ব্রহ্মাণ্ডের এইসব শক্তিগুলোকেই বিজ্ঞানের পরিভাষায় ঈশ্বর বলা চলে। আমরা জানি যে জীব জগত সহ সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডের যাবতীয় জড় ও অজড় পদার্থ অনু, পরমানু সহ যাবতীয় মৌলকনা দ্বারা গঠিত। মানুষ বা অন্য কোন প্রাণীর মৃত্যু ঘটলে তাঁদের শরীরের অনু-পরমানু সহ যাবতীয় মৌলকনা গুলোর কিন্তু অস্তিত্ব বিলোপ হয় না। ঠিক একইরকম ভাবে কোন বই পুড়িয়ে ফেললে বা গাছ কেটে ফেললে বা চেয়ার ভেঙে ফেললেও সেগুলোর মৌলকনা গুলোর কোনরূপ ক্ষতি বা অস্তিত্ব বিলোপ হয় না। মৌলকনা গুলো নিজেদের আকার পরিবর্তন করে মাত্র। বিজ্ঞান আজ প্রমান করেছে যে মানবদেহ প্রায় ৭ অক্টালিয়ন পরমানুর দ্বারা গঠিত (৭,000,000,000,000,000,000,000,000,000)। এইসব পরমানু গুলো কোটি কোটি বছর প্রাচীন। বিজ্ঞানীদের মতে বিগ ব্যাং বিস্ফোরণের সময় সিঙ্গুলারিটি পয়েন্ট থেকে ব্রহ্মাণ্ড চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে স্থান আর কালের (অর্থাৎ টাইম আর স্পেস) সাথে এইসব পরমানু গুলোও সৃষ্টি হয়েছিল। এসবের মধ্যে ব্রহ্মাণ্ড আর মানবদেহের সবচেয়ে সাধারণ আর প্রাচীন পরমানু হাইড্রোজেনের বয়স ১৩.৭ বিলিয়ন বছর। অর্থাৎ বিগ ব্যাং বিস্ফোরণের সময়ের। অর্থাৎ এর থেকে এটা প্রমানিত হচ্ছে যে ব্রহ্মাণ্ডই মানুষ সহ সমস্ত জীব জগতের সৃষ্টিকর্তা। এই ব্রহ্মাণ্ডকেই হিন্দু পুরানে ব্রহ্মা বলে অভিহিত করে হয়েছে। অর্থাৎ ব্রহ্মা আসলে ব্রহ্মাণ্ডের রূপক। শিব বা মহাদেবকে হিন্দু পুরানে মহাকাল বলে অভিহিত করা হয়েছে। অর্থাৎ মহাদেব সময়ের রূপক। আর বিষ্ণুকে অনন্ত বলে অভিহিত করা হয়েছে। আগেই লেখা হয়েছে যে বিগ ব্যাং বিস্ফোরণের পর অনন্ত ব্রহ্মাণ্ডের পরিধি দ্রুত গতিতে চতুর্দিকে সম্প্রসারিত হয়েই চলেছে। আগেই লেখা হয়েছে যে বিজ্ঞানের ভাষায় ব্রহ্মান্ডের এই অনন্ত সম্প্রসারণকে ইনফাইনাইট স্পেস অভিহিত করা হয়। অর্থাৎ বিষ্ণু হচ্ছে আদতে স্পেস বা স্থানের রূপক। আবার সময় আর স্থান (Space & Time) হচ্ছে মূল ব্রহ্মাণ্ডেরই অন্তর্ভুক্ত এক প্রক্রিয়া যাদের অস্তিত্ব বিগ ব্যাঙের আগে ছিল না।

অর্থাৎ সংক্ষেপে বলতে গেলে বাস্তবে ঈশ্বর বলে যদি কিছু থেকে থাকে তবে সে হচ্ছে আমাদের এই অনন্ত আর রহস্যময় ব্রহ্মাণ্ড। বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির সাহায্যে ব্রহ্মাণ্ডের এখনও পর্যন্ত মাত্র ৬% জানতে পেরেছেন বিজ্ঞানীরা। ২০১৬ সালের মুভি “ডক্টর স্ট্রেঞ্জ” এর মুভির গুরুমা “Ancient One” আর খোদ ডক্টর স্ট্রেঞ্জের মতে সঠিক পদ্ধতিতে যোগাসন আর ধ্যান করতে পারলে অ্যাস্ট্রাল ট্রাভেলের সাহায্যে হয়তো মানুষ তাঁর চেতনাকে স্ট্রিং থিয়োরিতে বর্ণিত এই ব্রহ্মাণ্ডের বিভিন্ন প্রান্তে আর বিভিন্ন মাত্রায় (ডায়মেনশন) নিয়ে যেতে সফল হবে। ২০২১ সালের মুভি “ডক্টর স্ট্রেঞ্জ ইন দ্যা ম্যাডনেস অফ মাল্টিভার্স” এও এই সাইকিক অর্থাৎ আধ্যাত্মিক শক্তিকে কাজে লাগিয়েই ব্রহ্মাণ্ডের একাধিক মাত্রায় ইচ্ছেমতো ভ্রমন করেছিল ডক্টর স্ট্রেঞ্জ। কিন্তু বিজ্ঞানের জগতে আর বাস্তব দুনিয়ায় আধ্যাত্মবাদ আর অ্যাস্ট্রাল ট্রাভেল স্বীকৃত নয়। অর্থাৎ কাল্পনিক। কিন্তু আগেই বলা হয়েছে বিজ্ঞানের পরিধির বাইরে অজানা ব্রহ্মাণ্ডে অনেক অজানা শক্তি (এনার্জি) আর অমীমাংসিত রহস্য লুকিয়ে রয়েছে।

পৃথিবীর সবচেয়ে দামি খাবার

পৃথিবীতে অনেক ধরনের খাবার রয়েছে। কিন্তু দামি খবার তো কিছু রয়েছে। এর মধ্যে সব থেকে দামি খাবারের নামটি তো সবারই জানতে ইচ্ছা করে। আপনাদের সুবিধার্থে দিলাম পৃথিবীর সবচেয়ে দামি খাবার।

আরো পড়ুন- রামমোহন ডিরোজিও সম্পর্ক

ব্ল্যাক ক্যাভিয়ার

২৫০ গ্রাম ক্যাভিয়ার খেতে হলে আপনাকে গুনতে হবে ১ হাজার ৮৭৫ ইউরো মানে টাকায় প্রায় ১ লাখ ৮৮ হাজার ৮৬০ টাকা। কি চেখে দেখবেন নাকি একবার। ক্যাভিয়ার আসলে স্টার্জন মাছের ডিম। এই মাছগুলোর দেখা মেলে উত্তর ও মধ্য এশিয়া, ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকায়। সবচেয়ে উৎকৃষ্টমানের ক্যাভিয়ার হলো ব্ল্যাক ক্যাভিয়ার। এই স্টার্জন মাছ শীতকালে নদীর মোহনায় পাওয়া যায়। শেক্সপিয়ার তার বিখ্যাত নাটক ‘হ্যামলেট’ এ ক্যাভিয়ারের কথা উল্লেখ করেছেন।

সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপে একটু মোটা ক্যাভিয়ার তাদের কাছে প্রধান খাদ্য হিসেবে বিবেচিত হয়। তারা ক্যাভিয়ার ভোদকা সহযোগে খেয়ে থাকে। ক্যাভিয়ার প্রস্তুতির সময় ডিমের গা থেকে সতর্কতার সঙ্গে আঁশ এবং চর্বি সরিয়ে ফেলা হয়। তারপর লবণ মাখিয়ে ছোট জারে কিংবা টিনে ভরে রাখা হয়। এর লবণাক্ত স্বাদ অনেক চমৎকার। দামি এ খাবার সবার ভাগ্যে জোটে না। ক্যাভিয়ার মূলত খাওয়া হয় ব্রেড বা টোস্ট দিয়ে কিংবা ড্রিংকের সঙ্গে ছোট ছোট বিস্কুটের ওপর রেখে। ধূসর, হালকা সবুজ ও কালো ক্যাভিয়ার ছাড়াও লাল ক্যাভিয়ার ও আছে।
এগুলো স্যামন মাছের ডিম দিয়ে বানানো হয়।

রামমোহন ডিরোজিও সম্পর্ক

রানা চক্রবর্তীঃ রাজা রামমোহন রায় ও হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিয়োর মধ্যে কি কখনো সাক্ষাৎ হয়েছিল? তাঁদের উভয়ের মধ্যে কেমন ধরণের সম্পর্ক ছিল? ‘ইলিয়ট ওয়াল্টার ম্যাজ’ই (Elliot Walter Madge) প্রথম তাঁর ‘Henry Derozio: The Eurasian Poet and Reformer’ (Calcutta, 1905) গ্রন্থে লিখেছিলেন যে, ডিরোজিওর বন্ধুদের মধ্যে রামমোহন রায় অন্যতম ছিলেন। তবে নিজের গ্রন্থে তিনি কথাটি উল্লেখ করলেও, সেবিষয়ে কোন বিস্তারিত তথ্য দেননি। ডিরোজিও হিন্দু কলেজের শিক্ষক ছিলেন, আর রামমোহনের সঙ্গে হিন্দু কলেজের কোনো সম্পর্ক ছিল না। তাহলে কোথায় তাঁদের আলাপ হয়েছিল? ‘অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন’-এর সভায়? কিন্তু সেখানে রামমোহন কখনো উপস্থিত থাকতেন বলে কোন ঐতিহাসিক দলিল থেকে জানতে পারা যায় না। তাহলে কি কোনো স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা সভায় তাঁদের উভয়ের মধ্যে পরিচয় হয়েছিল? কিন্তু রামমোহন যেহেতু সেই জাতীয় অনুষ্ঠানে খুব কমই যেতেন, তাই সেই সম্ভাবনাও অল্প। সম্ভবতঃ উভয়ের কোনো বন্ধু বা অনুরাগীর গৃহে (যেমন তারাচাঁদ চক্রবর্তী) তাঁদের দেখা হয়েছিল। ডিরোজিও ও রামমোহনের জীবন সম্পর্কে যাঁরা কিঞ্চিৎ অবগত রয়েছেন, তাঁরা সকলেই জানেন যে, তাঁদের উভয়েই সতীদাহ প্রথা রদে উৎসাহী ছিলেন। সেই সূত্রেও তাঁদের মধ্যে যোগাযোগ হওয়া সম্ভব। সতীদাহ নিরোধক আইন পাশ হওয়ার পরে ‘লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক’কে সম্ভ্রান্ত হিন্দু সমাজের পক্ষ থেকে একটি মানপত্র দেওয়া হয়েছিল। সেই মানপত্রে স্বাক্ষরদাতাদের মধ্যে ‘কালীনাথ রায়চৌধুরী’, ‘রামমোহন রায়’, ‘প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর’, ‘প্রসন্নকুমার ঠাকুর’ প্রমুখরা ছিলেন। অন্যদিকে তৎকালীন কলকাতার খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ও বেন্টিঙ্ককে একটি সংবর্ধনা দিয়েছিলেন। সেই সংবর্ধনার মানপত্রে যাঁরা সই করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে শুধুমাত্র চারজনের নামই ছাপা হয়েছিল, বাকি সবাই প্রমুখের দলে ছিলেন। (The Days of John Company: Selections from Calcutta Gazette, Compiled & edited by Aml Chandra Das Gupta, n. d. item no. 428, p- 427) এই প্রসঙ্গে ‘নগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়’ তাঁর রামমোহন জীবনীতে একটি ঘটনার উল্লেখ করেছিলেন। সেই কাহিনীটি তিনি ‘রামতনু লাহিড়ী’র মুখ থেকে শুনেছিলেন। ওই ঘটনা সম্পর্কে নগেন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “যে সময়ে গবর্ণর জেনারেলকে অভিনন্দনপত্র প্রদান করা হয়, সেই সময়ে বাবু রামগোপাল ঘোষ, বাবু রসিককৃষ্ণ মল্লিক, বাবু দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায় প্রভৃতি হিন্দু কলেজের প্রথম শ্রেণীর ছাত্র ছিলেন। তাঁহারা এক দিবস কলেজের এক ঘরে বসিয়া অভিনন্দনপত্ৰ লইয়া অত্যন্ত উৎসাহের সহিত এই তর্কে প্রবৃত্ত হইয়াছেন যে উক্ত পত্রের ইংরেজী রচনা রামমোহন রায়ের কি অ্যাডাম সাহেবের। এমন সময়ে প্রাতঃস্মরণীয় ডিরোজিও সাহেব আসিয়া বিশেষ বৃত্তান্ত শুনিয়া বলিলেন, ‘তোমরা মানুষ, না এই দেয়াল? নারীহত্যারূপ ভীষণ প্রথা দেশ হইতে উঠিয়া গেল, ইহাতে তোমরা কোথা আনন্দ করিবে না অভিনন্দনপত্রের ইংরেজী কাহার রচনা এই বৃথা তর্কে তোমরা মত্ত। রামমোহন রায় ইংরেজীতে কিরূপ সুপণ্ডিত ব্যাক্তি জানিলে তোমরা উহা অ্যাডাম সাহেবের বলিয়া মনে করিতে না।’ …” (মহাত্মা রাজা রামমোহন রায়ের জীবনচরিত, নগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, দে’জ সংস্করণ, পৃ- ১৯৬) এখানে ডিরোজিওর উক্তি থেকে এটাই মনে হয় যে, রামমোহনকে তিনি ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন ও জানতেন। এছাড়া ইংরেজিতে ‘উপেন্দ্রনাথ বল’ লিখিত রামমোহনের জীবনচরিতেও ডিরোজিওর উল্লেখ পাওয়া যায়। উপেন্দ্রনাথের ইংরেজি বক্তব্যের বঙ্গানুবাদ করলে হয়, “অ্যাঙলো ইন্ডিয়ান তরুণ হেনরি ডিরোজিওর হাতে নাস্তিক শিক্ষা পেয়ে হিন্দু কলেজের বাঙালি অল্পবয়েসি ছাত্রেরা যেরকম আচরণ করছিলেন তাতে তিনি খুবই বিচলিত হন।” (“… he was shocked at the way the young Bengalis were behaving after receiving godless education in the Hindu Collage at the hands of an Anglo-indian young man named Henry Derozio.” Rammohan Roy: A study of his Life, Works and Thoughts, Upendra Nath Ball, Calcutta, 1933, p- 175) রামমোহন নিজে নাস্তিকতার ঘোর বিরোধী ছিলেন। তাঁর কোনো একজন ভক্ত শিষ্য একবার জনৈক ব্যক্তি প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছিলেন যে, “ভদ্রলোক আগে deist (একেশ্বরবাদী) ছিলেন, পরে নাস্তিক atheist হন।” সেকথা শুনে রামমোহন নাকি তাঁকে বলেছিলেন, “এরপরে ‘beast’ (পশু) হবে।” (The Life and Letters of Raja Rammohan Roy, Sophia Dobson Collection, Edited by Dilip Kumar Biswas & Prabhat Chandra Ganguli, Calcutta, 3rd edition, 1962, p: 228-29) কিন্তু ‘রাধাকান্ত দেব’ প্রমুখের কাছে রামমোহনের আস্তিক্যবাদ এবং সেযুগের হিন্দু কলেজের ছাত্রদের মধ্যে তথাকথিত নাস্তিক্যবাদের মধ্যে কোনো প্রভেদ ছিলো না। তাই ইতিহাস থেকে দেখা যায় যে, বস্তুতঃ রাধাকান্তের উষ্মার কারণেই ডিরোজিওর দুই শিষ্য ‘রসিককৃষ্ণ মল্লিক’ এবং ‘কৃষ্ণমোহন বন্দোপাধ্যায়’ যেমন পদচ্যুত হয়েছিলেন, তেমনই ওই একই ব্যক্তির আপত্তিতে রামমোহনের বন্ধু ‘উইলিয়াম অ্যাডাম’-এরও হিন্দু কলেজে চাকরি হয়নি। রাধাকান্তের মতে, “For my part, I cannot entrust the morals and education of those I regard, to such an one that was once a Missionary, then a Vaidaentic or disciple of Rammohun Roy and lastly a unitarian.” (দিলীপকুমার বিশ্বাস লিখিত রামমোহন-সমীক্ষা গ্রন্থের ৪৬৫ নং পৃষ্ঠা থেকে উদ্ধৃত)
এখনো পর্যন্ত রামমোহন ও ডিরোজিও সম্পর্ক নিয়ে যত গ্রন্থে লেখা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে ‘দিলীপকুমার বিশ্বাস’ লিখিত ‘রামমোহন-সমীক্ষা’ গ্রন্থে সেই প্রসঙ্গ সবচেয়ে বিস্তারিতভাবে আলোচিত হয়েছে। উক্ত গ্রন্থের সপ্তম অধ্যায়টির শিরোনাম হল – ‘রামমোহন রায়, ডিরোজিও ও ইয়ং বেঙ্গল’। গবেষক দিলীপকুমার বিশ্বাস ‘দ্য এনকোয়ারার’ পত্রিকার ফাইলপত্রগুলি অন্বেষণ করবার সুযোগ পেয়েছিলেন। তাঁর লেখার সুবাদে সেই সময়ের ‘ডিরোজিয়ান’দের, বিশেষ করে ‘দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়’, ‘রসিককৃষ্ণ মল্লিক’, ‘কৃষ্ণমোহন বন্দোপাধ্যায়’, ‘শিবচন্দ্র দেব’ প্রমুখের জীবনে রামমোহনের প্রভাব বিষয়ে অনেক কিছু জানতে পারা যায়। তাঁদের অনেকের কাছেই রামমোহন ‘আধা-উদারনৈতিক’ ছিলেন। উল্লেখ্য যে, স্বয়ং ডিরোজিও কিন্তু ‘দ্য ইস্ট ইন্ডিয়ান’ পত্রিকার ১৮৩১ সালের ৫ই অক্টোবর 5 অক্টোবর সংখ্যায় রামমোহনের ধর্মমতের কঠোর সমালোচনা করেছিলেন। তাঁর মতে, “কী যে তাঁর (রামমোহনের) মতামত, তা তাঁর বন্ধু কিংবা শত্রু, কেউই জানেন না। সেগুলি কী বলার চেয়ে সেগুলি কী নয় বলা বরং সহজ। … এটা সবারই জানা যে রামমোহন বেদ, কোরান এবং বাইবেল সমানভাবে মানেন – এর সবগুলিকেই তিনি হয়তো সমদৃষ্টিতে বিচার করেন, সব ধর্মের অসিদ্ধ প্রমাণ অংশ বর্জন করে ভালোটি তিনি গ্রহণ করেছেন। … তাঁর জীবন যাপন সব সময়ে হিন্দুর মতো। … তাঁর অনুসারীদের, অন্ততঃ কারো কারো মধ্যে আচরণে কোনো সঙ্গতি নেই। তাঁর নামের ছত্রচ্ছায়ায় থেকে তাঁরা শাস্ত্রবিরোধী সবরকম অনাচার খাদ্য পানীয়ের ব্যাপারে চালিয়ে যাচ্ছেন; আবার একই সঙ্গে ‘ব্রাহ্মণদের’ দক্ষিণা দিচ্ছেন, হিন্দু ধর্মে আস্থা নেই বলছেন এবং বাড়িতে পুজো-আর্চায় যাতে কোনো অবহেলা না হয় সেদিকে নজর রাখছেন।” (“What his (Rammohun Roy’s) opinions are, neither his friends nor foes can determine. It is easier to say what they are not than what they are … Rammohun, it is well known, appeals to the Vedas, the Koran, and the Bible, holding them all probably in equal estimation extracting the good from each, and rejecting from all whatever he considers apocryphal … He has always lived like a Hindoo … His followers, at least some of them, are not very consistent. Sheltering themselves under the shadow of his name, they indulge in everything forbidden in the Shastras, as meat and drink; while at the same time they fee the Brahmins, profess to disbelieve Hinduism, and never neglect to have poojas at home.” The East Indian, October 1831, quoted in the India Gazette, 5th October 1831; Social Ideas and Social Change in Bengal: 1818-1835, A. F. Salahuddin Ahmed, Calcutta, 2nd edition, 1976, p- 49.) কৃষ্ণমোহন বন্দোপাধ্যায়ও রামমোহন সম্পর্কে একই অভিযোগ করে প্রশ্ন তুলেছিলেন যে, তিনি কেন হিন্দু ধর্মের বন্ধন ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে পারেননি। দিলীপকুমার বিশ্বাস তাঁর গ্রন্থে ‘দ্য এনকোয়ারার’ পত্রিকা থেকে কৃষ্ণমোহনের কিছু কিছু রচনা উদ্ধৃত করেছিলেন। তাতে দেখা যায় যে কৃষ্ণমোহন বলেছিলেন, “এমনই হচ্ছে হিন্দুধর্মের স্বরূপ যে তাঁর (রামমোহনের) মতো ক্ষমতাবান ব্যক্তির বহু চেষ্টা সত্ত্বেও সম্ভব হয়নি তার মধ্যে যুক্তিবাদের আবরণ দেওয়ার।” (“… for really such is the visage of Hinduism that it was impossible even for such a talented an individual (Rammohun) in spite of all his efforts, to cast a veil of rationality on it.” রামমোহন-সমীক্ষা, দিলীপকুমার বিশ্বাস, পৃ- ৪৪৭) আরেক জায়গায় তিনি বলেছিলেন, “ব্রহ্মণ্যবাদকে … তাই বলা যেতে পারে দেশের কেন্দ্রস্থলে রোপিত নষ্টবৃক্ষ … কোনো ব্যক্তি … যদি হতভাগ্য হিন্দুদের উদ্ধার করতে চান তো তাঁকে বৃক্ষমূলে কুঠারঘাত করতে হবে। যতোদিন এর অস্তিত্ব থাকবে, ততোদিন পর্যন্ত কোনো সুফল আশা করা যাবে না।” (“Braminism … may therefore be called a corrupt tree planted in the midst of the country … If a person wishes to benefit the poor Hindus he must lay the axe at the root of this tree. While it exists, good fruit cannot be expected.” রামমোহন-সমীক্ষা, দিলীপকুমার বিশ্বাস, পৃ- ৪৭৭) তবে তখনকার সব ডিরোজিয়ানরাই যে কৃষ্ণমোহনের মতাবলম্বী ছিলেন এমন নয়। রসিককৃষ্ণ মল্লিক তাঁর লেখায় রামমোহনের প্রতি হিন্দুদলপতিদের অবিচারের উল্লেখ করলেও, হিন্দুধর্ম সংস্কার ও পুনরুজ্জীবনে তাঁর বিশিষ্ট ভূমিকার ওপরে জোর দিয়েছিলেন। দিলীপকুমার বিশ্বাসও মনে করতেন, “… রসিককৃষ্ণ তাঁর ধর্মানুশীলনে ও ধর্মবিশ্বাসে রামমোহনের দ্বারা বিশেষতঃ রামমোহন রচিত ‘তুহফাৎ-উল্-মুওহাহিদিন’-এর বক্তব্যের দ্বারা যথেষ্ট প্রভাবিত হয়েছিলেন। দেখা যায় তিনি রামমোহনের মতই উদার সার্বভৌম একেশ্বরবাদে গভীর বিশ্বাসী। … রসিককৃষ্ণের অধ্যাত্মদর্শনে রামমোহনের প্রেরণা যে ক্রিয়াশীল, ‘হিন্দু পেট্রিয়ট’-এ প্রকাশিত তাঁর এই সুদীর্ঘ বিবৃতি পাঠ করলে সে বিষয়ে সংশয় থাকে না।” (রামমোহন-সমীক্ষা, দিলীপকুমার বিশ্বাস, পৃ: ৪৪৪-৪৫) দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের ওপরে রামমোহনের ধর্মমতের প্রভাব সম্ভবতঃ আরো গভীর ছিল। এই প্রসঙ্গে দিলীপকুমার বিশ্বাস তাঁর গ্রন্থে ‘রাজনারায়ণ বসু’ লিখিত ‘আত্মচরিত’ গ্রন্থটি থেকে যে উদ্ধৃতি দিয়েছিলেন, সেটা অবশ্য উল্লেখ্য – “দক্ষিণাবাবু ব্রাহ্ম ছিলেন, কিন্তু রামমোহন রায়ের সময়ে ব্রাহ্মসমাজে যেমন কেবল উপনিষদ পাঠ ও সঙ্গীত হইত, কেবল তাহাই হওয়া কর্তব্য মনে করিতেন। আমাদের ব্রাহ্মসমাজকে অহিন্দু জ্ঞান করিতেন। … দক্ষিণারঞ্জন উপনিষদকে এত মান্য করিতেন কিন্তু আমাদিগের ন্যায় বেদের প্রত্যাদেশে বিশ্বাস করিতেন না। … কিন্তু উপনিষদের প্রতি তাঁহার বিশেষ ভক্তি ছিল এবং উপনিষদই ব্রাহ্মসমাজের প্রধান ধর্মগ্রন্থ হওয়া উচিত এমন মনে করিতেন। তাঁহাকে ঔপনিষদিক ব্রাহ্ম বলিলে হয়।” (আত্মচরিত, রাজনারায়ণ বসু, পৃ- ৪৫৪) তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, রামমোহনের ধর্মবিশ্বাস বিষয়ে ডিরোজিওর শিষ্যদের সবার দৃষ্টিভঙ্গি এক ছিল। তবে ধর্ম ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে তাঁদের ওপরে রামমোহনের প্রভাব সম্পর্কে দিলীপকুমার বিশ্বাসের অভিমত ছিল, “… সমস্ত রকম প্রগতিশীল প্রশ্নে রামমোহনের সঙ্গে ডিরোজিও ও তাঁর শিষ্যবর্গের সাধারণভাবে মতৈক্য ছিল। ১৭ই ফেব্রুয়ারী ১৮৩০ সংখ্যা ‘ইন্ডিয়া গেজেট’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘ইয়ং বেঙ্গল’ গোষ্ঠী পোষিত যে সব মতবাদের উল্লেখ পূর্বে করা হয়েছে সেগুলিকে বিশ্লেষণ করলে দাঁড়ায় – (১) প্রগতিশীল সমাজসংস্কার (social reform) (২) শিক্ষাবিস্তার (education), বিশেষতঃ নারীজাতির মধ্যে শিক্ষার প্রসার (female education); (৩) চিন্তায় ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা (freedom of thought and expression); (৪) অ্যাডাম স্মিথ ব্যাঘ্যাত অর্থনীতি সম্মত ব্যবসাক্ষেত্রে একচেটিয়া অধিকার (monopoly) বর্জন ও অবাধ বাণিজ্যের প্রচলন (freedom of trade), (৫) ভারতে উঁচুদরের ইউরোপীয়গণ কর্তৃক উপনিবেশস্থাপন (colonization of India by intelligent Europeans which they believed would lead the welfare of the country)। এই আদর্শসমূহের সব কয়টিই রামমোহনের চিন্তায় ইতিপূর্বেই রূপ গ্রহণ করেছে।” (রামমোহন-সমীক্ষা, দিলীপকুমার বিশ্বাস, পৃ: ৪৩৯-৪০) ডিরোজিয়ানদের চিন্তাধারায় রামমোহনের অভিঘাত প্রসঙ্গে গবেষক ‘সুমিত সরকার’ও তাঁর ‘The Complexities of Young Bengal, A Critique of Colonial India’ গ্রন্থে একই মত পোষণ করেছিলেন। সামগ্রিক বিচারে সুমিত সরকারের ধারণা ছিল যে, দু’-একটি ব্যতিক্রম বাদ দিলে ডিরোজিয়ানদের রাজনৈতিক প্রগতিশীলতা রামমোহন প্রচারিত নির্দিষ্ট সীমানার মধ্যেই থেকে গিয়েছিল। রামমোহনের মতো তাঁরাও ব্যবসা-বাণিজ্যে কোম্পানির একচেটিয়া অধিকার এবং কিছু কিছু শাসনব্যবস্থার সমালোচনা করলেও আদতে বৃটিশ শাসনের প্রতি অনুগত ছিলেন। আর তাঁরাও হিতবাদী দর্শন দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। দু’জন ঐতিহাসিকের মূল্যায়নের পার্থকা শুধু এটাই যে, সামগ্রিক বিচারে এর অধিকাংশ ভাবধারা কতটা প্রগতিশীল ছিল, সে বিষয়ে তাঁদের দু’জনেই সম্পূর্ণ বিপরীত মতাবলম্বী ছিলেন।
রামমোহনের মৃত্যুর পরে ‘জ্ঞানান্বেষণ’ পত্রিকায় (১৮৩৪ সালের ২৬শে জানুয়ারি) যে শোকসংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল, তাতে রামমোহনকে নিয়ে অনেক প্রশস্তি থাকলেও, তিনি যে ডিরোজিওর ইয়ং বেঙ্গল দলের একজন আদর্শ গুরু ছিলেন, এরকম কোনো ধারণা হয় না। (Death of Rammohun Roy, Selections from Jnanannesan, compiled by Suresh Chandra Maitra, Calcutta, 1979, P: 137-40) আসলে তাত্ত্বিকভাবে রামমোহন তাঁদের অনুপ্রাণিত করতে পেরেছিলেন, কারণ তাঁদের মূল লড়াইটা ছিল তৎকালীন রক্ষণশীল সমাজের সঙ্গে। উল্টোদিকে রামমোহনের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা সেটাই ছিল, কিন্তু তাঁর ব্যক্তিত্ব এবং প্রভাব প্রতিপত্তি ডিরোজিয়ানদের মধ্যে ছিলনা। নিজেদের প্রথম জীবনে তাঁদের শক্তি ও উদ্যমের অনেকটাই অভিভাবক এবং পরিবার পরিজনদের সঙ্গে সংঘর্ষে ও সংঘাতে ব্যয়িত হয়েছিল। সেজন্য নিজেদের কর্মজীবনে তাঁরা বিশেষভাবে সামাজিক প্রতিষ্ঠার প্রতি আগ্রহী হয়েছিলেন। তবে নিজেদের শিক্ষাগুরু ডিরোজিওর আদর্শবাদ তাঁরা কখনোই ভোলেননি, আবার একইসঙ্গে নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকে তাঁরা এটাও বুঝেছিলেন যে, তথাকথিত রক্ষণশীল সমাজপতিদের মূল আরো গভীরে প্রোথিত রয়েছে, এবং সম্মুখ সমরে তাঁদের কিছুতেই পরাস্ত করা সম্ভব নয়। সেজন্যই তাঁরা সমন্বয়ের পথ অবলম্বন করেছিলেন। বলা বাহুল্য যে, সেজন্য তাঁদের অনেক দামও দিতে হয়েছিল। ‘রামকমল সেন’ প্রসঙ্গে ‘প্যারীচাঁদের’ মূল্যায়ন, অথবা রাধাকান্ত দেব বিষয়ে ‘রামগোপাল ঘোষের’ মত পরিবর্তন, সেই সমন্বয়সাধনার অনিবার্য পরিণাম ছিল। এই প্রসঙ্গে ‘কৈলাসচন্দ্র বসু’ (১৮২৭-৭৮) রামগোপাল ঘোষের স্মৃতিসভার যে ঘটনাটি উল্লেখ করেছিলেন, সেটি হল – “আপনাদের অনেকেই শুনিয়া আনন্দিত হইবেন যে এই দু’জনই (রাধাকান্ত দেব এবং রামগোপাল ঘোষ) প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তি, দুইটি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের নেতা হইয়াও ঈর্ষা বা ঘৃণার পরিবর্তে পরস্পরকে ভক্তি ও শ্রদ্ধা করিতেন। আমি একটি ঘটনা জানি যাহাতে পরস্পরের এই শ্রদ্ধা ও ভক্তির ভাব বিশেষভাবে পরিদৃষ্ট হইয়াছিল। ১৮৫৩ খ্রীষ্টাব্দে জুলাই মাসে টাউন হলে চার্টার সভায় রামগোপাল তাঁহার সর্ব্বজন-হৃদয়গ্রাহিণী অগ্নিময়ী বক্তৃতা শেষ করিয়া বক্তৃতামঞ্চ হইতে অবতীর্ণ হইলে, সেই সভায় সভাপতি স্যর রাজা রাধাকান্ত তাঁহার আসন পরিত্যাগ করিয়া দন্ডায়মান হইলেন এবং রামগোপালকে তাঁহার সুললিত বক্তৃতার জন্য ধন্যবাদ প্রদান করিয়া প্রেমভরে সম্ভাষণ করিয়া বলিলেন, ‘ঈশ্বর আপনাকে দীর্ঘজীবী করুন, আপনি আপনার দেশের সেবায় আপনার সমস্ত শক্তি নিয়োগ করিতে সমর্থ হউন। আপনি আমাদের সমাজের মুখপাত্র, আপনি আমাদের জাতির অলঙ্কারস্বরূপ।’ রামগোপাল নম্রভাবে নমস্কার করিয়া তাঁহাকে ধন্যবাদ প্রদান করিয়া বলিলেন, ‘আপনারা আমা হইতে যাহা আশা করিয়াছিলেন তাহা সুসম্পন্ন করিতে সমর্থ হইয়াছি, ইহা আপনার মুখে শুনিয়া আমি গৌরব অনুভব করিতেছি। কিন্তু মহাশয়, আমি যতদুর করিতে পারিব, দেশ আপনার নিকট হইতে তদপেক্ষা অধিকতর কল্যাণের আশা করে।’ …” (সেকালের লোক, মন্মথনাথ ঘোষ, দ্বিতীয় সংস্করণ, পৃ: ৫৭-৫৮) ডিরোজিওর ‘fury brand’ ছাত্রকে রাধাকান্ত দেব – “আপনি আমাদের সমাজের মুখপাত্র, আপনি আমাদের জাতির অলঙ্ককারস্বরূপ” – বলে সম্বোধন করেছিলেন! জানা নেই যে ডিরোজিও তখন বেঁচে থাকলে সে বিষয়ে কী বলতেন? অবশ্য এর দুই দশক আগেই (২৬শে ডিসেম্বর ১৮৩১ সাল) সেই নিঃসঙ্গ নায়কের প্রয়াণ ঘটেছিল।