এখন যতই আমরা আশ্বিন মাসে দুর্গাপুজো করি না কেন, বাঙালির আদি দুর্গাপুজো বাসন্তী পূজো ( Basanti Puja) হত এই চৈত্র মাসেই।
অশুভ শক্তির বিনাশের জন্য সব কালেই মানুষ আদ্যাশক্তির আরাধনা করে। রামায়ণ অনুযায়ী, অশুভ শক্তির বিনাশের উদ্দেশ্যে শ্রীরামচন্দ্র শরৎকালে দেবী দুর্গার আরাধনা করেছিলেন, যা অকাল বোধন হিসেবে খ্যাত। আর পুরাণ অনুযায়ী, সমাধি নামক বৈশ্যের সঙ্গে মিলে রাজা সুরথ বসন্তকালে ঋষি মেধসের আশ্রমে দেবী দুর্গার আরাধনা করেন। যা পরে বাসন্তী পুজো (Basanti Puja) নামে প্রসিদ্ধ হয়। দেবী দুর্গার প্রথম পুজোরী হিসাবে চণ্ডীতে রাজা সুরথের উল্লেখ রয়েছে।
সুরথ সুশাসক ও যোদ্ধা হিসেবে বেশ খ্যাত ছিলেন। কোনও যুদ্ধে নাকি তিনি কখনও হারেননি। কিন্তু প্রতিবেশী রাজ্য একদিন তাঁকে আক্রমণ করে এবং সুরথ পরাজিত হন। এই সুযোগে তাঁর সভাসদরাও লুটপাট চালায়। কাছের মানুষের এমন আচরণে স্তম্ভিত হয়ে যান সুরথ। বনে ঘুরতে ঘুরতে তিনি মেধাসাশ্রমে পৌঁছোন। ঋষি তাঁকে সেখানেই থাকতে বলেন। কিন্তু রাজা শান্তি পান না। এর মধ্যে একদিন তাঁর সমাধির সঙ্গে দেখা হয়। তিনি জানতে পারেন, সমাধিকেও তাঁর স্ত্রী এবং ছেলে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। তবুও তিনি বৌ-ছেলের ভালোমন্দ এখনও ভেবে চলেছেন।
তাঁরা দুজনেই তখন ভাবলেন, যাদের কারণে তাদের সব কিছু হারিয়েছে, তাদের ভালো আজও তারা চেয়ে যাচ্ছেন। ঋষিকে একথা বলায়, তিনি বলেন সবই মহামায়ার ইচ্ছা। এরপর ঋষি মহামায়ার কাহিনি বর্ণনা করেন। ঋষির উপদেশেই রাজা কঠিন তপস্যা শুরু করেন। পরে মহামায়ার আশীর্বাদ পেতেই বসন্ত কালের শুক্ল পক্ষে রাজা পুজো শুরু করেন। শুরু হয় বাসন্তী পুজো।
বাঙালি কিন্তু তার আদি দুর্গাপুজোকে কোনওদিনই পুরোপুরি ভুলে যায়নি। সে এখনও দুর্গাপুজোর আদিরূপ বাসন্তী পুজোর আয়োজন করে। যদিও এই পুজো কোনও দিনই বারোয়ারির আকার নেয়নি। যে সময়ে রমরম করে বাসন্তী পুজো হত তখনও তা আয়োজিত হত মূলত জমিদার নায়েব গোমস্তা গোষ্ঠীর লোকজনদের দ্বারাই। এই পুজো কোনও দিনই সাধারণের পুজো হয়ে ওঠেনি।
এখনও এই পুজো পরিবার-তন্ত্রেই আটকে, বারোয়ারি হয়নি। এবং খোঁজ করলে দেখা যাবে, আজও এ শহরের (kolkata) কিছু ভুঁইফোঁড় উঠতি বড়লোকের বাড়ির হঠাৎ-শুরু-হওয়া বাসন্তী পুজো ছাড়া তা মূলত হয় বনেদি বড়লোকদের বাড়িতেই। পড়তি বড়লোকের বাড়িতে হলেও এই পুজোর সঙ্গে ধন-তন্ত্রের যোগ প্রবলই।
কেন এক সময় রমরম করে বাসন্তী পুজো হত, তার একটা অন্য কারণও কেউ কেউ বলে থাকে। বসন্ত ঋতুর শেষে গ্রীষ্মের শুরুর এই সময়টায় সেকালে বসন্ত রোগের (pox) খুব প্রকোপ ছিল। টিকাহীন চিকিৎসাহীন সেই অতীতে দুর্বার বসন্তের সঙ্গে লড়াইয়ের জন্য মায়ের আরাধনা করে মায়ের কৃপা প্রার্থনা করা হত হত। রোগকে প্রশমিত করার জন্য়ও তাই বাসন্তীদেবীর পুজোর চল হয়েছিল বলে ধরে নেওয়া যেতেই পারে।