ছত্রপতি শিবাজী খুব বিচক্ষণ রাজা ছিলেন। কিন্তু তাঁর দুই ছেলে এই গুণ পাননি

শিবাজী বেশিদিন বাঁচেননি। কোন সালে তাঁর জন্ম, তাও ঠিক করে বলা চলেনা। ১৬২৭ হতে পারে, আবার কারও মতে ১৬৩০ সাল । ( স‍্যার যদুনাথ সরকারের মতে, প্রায় ৫৩ বছর বয়সে ছত্রপতি ইহলোক ত‍্যাগ করেন। )

ঔরঙ্গজেব আরও আঠারো বছর বেঁচে ছিলেন। শিবাজীর বড় ছেলে শম্ভাজি সাহসী যোদ্ধা ছিলেন, কিন্তু তার আর কোন গুণ ছিল না। অনেকে বলত, তার একজন বন্ধুর কুপরামর্শে তিনি অধঃপাতে যাচ্ছিলেন। বন্ধুটির উপাধি ছিল কবিকুলেশ অর্থাৎ কবিদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। তখনকার লোকেরা একটু বদল করে বলত কবিকলুষ, অর্থাত পাপের কবি।

নবছর রাজত্ব করার পর শম্ভাজি ঔরঙ্গজেবের একজন সেনাপতির হাতে ধরা পড়লেন।

ঔরঙ্গজেব তখন দাক্ষিণাত্যে l তাঁকে এবং তাঁর বন্ধুকে আওরঙ্গজেবের কাছে ধরে নিয়ে যাওয়া হল এবং সম্রাটের আদেশে তাদের মেরে ফেলা হল।
( ঔরঙ্গজেব শম্ভাজীকে খুব বীভৎস অত্যাচার করেছিলেন মৃত্যুর আগে। ধর্মান্তর করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শাহুজি রাজি হলেন না। একটু একটু করে তাঁর শরীরের চামড়া ছাড়িয়ে নেওয়া হয়, অঙ্গচ্ছেদ করা হয়। কিন্তু তবু শম্ভাজী ধর্ম পরিবর্তন করতে রাজি হন না।
বাবার মত বীর না হলেও মহারাষ্ট্রে শম্ভাজীকে স্বরাজ‍্যরক্ষক ও ধর্মবীর হিসাবে খুব সম্মানের সাথে স্মরণ করা হয়। )

এরপর শিবাজীর ছোট ছেলে রাজারাম রাজ্যশাসনের ভার নিলেন। রাজারাম ঠিক রাজা নন, রাজার প্রতিনিধি।শম্ভাজির ছেলে শাহু মোগল শিবির থেকে যদি ফিরে আসেন, তিনি তিনি রাজা হবেন l

ঔরঙ্গজেব দাক্ষিণাত্য থেকে আর দিল্লি ফিরে যেতে পারেননি। আহমেদনগরের কাছে তার মৃত্যু হয়। তখন ১৭০৭ সাল। ইতিমধ্যে মারাঠা অশ্বারোহীরা মোগল সাম্রাজ্যে ঢুকে খুব উৎপাত আরম্ভ করেছিল। মোগল সেনাপতি জুলফিকার খাঁ ভাবলেন, শাহুকে মুক্ত করে দিলে ফল খারাপ হবে না। মারাঠারা দুই দলে ভাগ হয়ে যাবে। নতুন সম্রাট আওরঙ্গজেবের বড় ছেলে মুয়াজ্জেম তখন প্রথম বাহাদুর শাহ নামে সিংহাসনে বসেছেন। মুক্তি পাওয়ার সময় শাহু অঙ্গীকার করেছিলেন যে, তিনি মোগলদের বশম্বদ হয়ে থাকবেন।

ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর মাস তিনেক পরে তিনি নিজের রাজ্যে ফিরে এলেন। রাজারামেরও দিন শেষ হয়ে এসেছিল। জালনা দুর্গ থেকে মোগল সৈন্যের তাড়া খেয়ে পালিয়ে তিনি সিংহগড়ে এসে পৌঁছলেন। সেখানে মাসখানেক অসুস্থ থাকার পরে তাঁর মৃত্যু হয় l

জুলফিকার খাঁ যা ভেবেছিলেন তাই হল। রাজারামের বিধবা স্ত্রী তারাবাঈ রাজ্যের উপর দাবি ছাড়লেন না। শম্ভাজির দুষ্কৃতীর ফলে সিংহাসনের উপর শাহুর দাবি নষ্ট হয়ে গিয়েছে। কিন্তু প্রথম পেশোয়া বালাজি বিশ্বনাথ শাহুর পক্ষে ছিলেন। প্রধানত তার সাহায‍্যে শাহু ক্ষমতাশালী হয়ে উঠলেন। তারাবাঈ নিজের জায়গা রাখতে পারলেন না। তিনি সাতারার দূর্গে প্রায় বন্দিনীর মতন থাকতে লাগলেন।

শাহুর ছেলে ছিল না। তিনি দত্তক নেওয়ার চেষ্টা করতে লাগলেন। তারাবাঈ বলে পাঠালেন যে, তার নিজের বংশেরই তো একজন আছে, সেই হবে সিংহাসনের প্রকৃত উত্তরাধিকারী। তারও নাম রাজারাম l তারাবাঈ বললেন, তাকে খুব অল্প বয়স থেকে পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে। সে এতদিন এক গন্ধানি পরিবারে মানুষ হয়েছে।

গন্ধানিদের পেশা হচ্ছে নাচ-গান করা। তরুণ রাজারামকে সাতারায় আনা হল। সাতারা দূর্গের নীচে তার প্রাসাদ। তারাবাঈ তো স্বামীর নাম ধরে তাকে ডাকতে পারেন না, কাজেই তার নাম বদলে তাকে বলা হতো রামরাজা l কিন্তু তাকে দিয়ে তারাবাঈয়ের ইচ্ছাপূরণ হলো না। পেশোয়ার সঙ্গে লড়াই করবার শক্তি বা ইচ্ছে কোনটাই তার ছিল না।
তারাবাঈ এতে ভীষণ রেগে গেলেন। রামরাজা ও তার স্ত্রীকে চম্পাষষ্ঠী ব্রত উপলক্ষে দুর্গে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে এলেন তিনি। খাওয়া-দাওয়া ভালোই হল, কিন্তু রামরাজা দূর্গ থেকে বিদায় নিতে গিয়ে দেখলেন যে, তারাবাঈয়ের হুকুমে প্রথ দুর্গের সব দরজা বন্ধ। বের হবার উপায় নেই। কেউ কেউ বলেছেন, রামরাজার উচিত ছিল রক্ষীদের আক্রমণ করা। তারা নিশ্চয়ই শিবাজীর বংশধরকে বাধা দিতে সাহস পেত না। দরজা খুলে দিত। এ-কথা হয়তো ঠিক।

কিন্তু রামরাজা সে- ধরনের মানুষ ছিলেন না। তার বদলে তিনি তারাবাঈকে জিজ্ঞাসা করতে গেলেন যে, তার এরকম ব্যবহারে কারণ কি? তারাবাঈ দেখা করলেন না।

রামরাজা আর নিজের প্রাসাদে ফিরে যাওয়া হল না। তিনি সস্ত্রীক সাতারায় থাকতে লাগলেন। ধীরে ধীরে এই পরিবেশের সঙ্গেই মানিয়ে নিতেও শিখলেন। তারাবাঈয়ের মৃত্যুর পরে রামরাজার অবস্থার উন্নতি হলো, কিন্তু তাকে মুক্তি দেওয়ার কথা কারও মনে হলো না। সাতারায় বন্দি অবস্থায় থাকার সময় রামরাজা ও তাঁর বংশধররা শুনতেন যে, তার সৈন্যরা সর্বত্র জয়ী হচ্ছে। তার অশ্বারোহীরা পাঞ্জাব অতিক্রম করে গিয়েছে, মারাঠারাই উত্তর ভারতবর্ষের অধীশ্বর। পেশোয়া বছরে একবার এসে তার কাছ থেকে রাজ্যশাসন ও যুদ্ধবিগ্রহের অনুমতি নিয়ে যেতেন। দুর্গের মধ্যে বসে শিবাজী বংশধর রাজ্যশাসনের খেলা খেলতেন l

রামরাজা ২৭-২৮ বছর এইরকম রাজা-রাজা খেলা খেললেন। তার ছেলে ছিল না বলে তিনি দত্তক নিয়েছিলেন। নাম রেখেছিলেন দ্বিতীয় শাহু। তার রাজত্বকাল ছিল ১৭৭৭ থেকে ১৮১০পর্যন্ত অর্থাৎ ইংরেজরা যখন দক্ষিণ ভারতে খুব প্রতিপত্তিশালী হয়ে উঠেছিল। ১৮১০ সাল পর্যন্ত তিনি বেঁচে ছিলেন। দ্বিতীয় মারাঠা যুদ্ধে পেশোয়া তখন ইংরেজদের কাছে হেরে গিয়েছেন। ১৮০২ সালে বেসিনের সন্ধির ফলে পেশোয়ার ক্ষমতা অনেক কমে যায়।

তাহলেও পেশোয়া প্রকৃতপক্ষে সাতরার রাজার প্রভু। সামান্য ব্যাপারেও রাজাকে পেশোয়ার কৃপার উপর নির্ভর করতে হতো। তার প্রার্থনা পূর্ণ হয় পেশোয়ার মর্জির উপর। দু-একটি উদাহরণ দিচ্ছি।রাজার কর্মচারীদের পেশোয়া নিয়োগ করতেন। তাদের উপর রাজার ক্ষমতা সবসময় খাটত না। এমনও হয়েছে যে রাজা তাদের অপরাধের জন্য শাস্তি দিলে পেশোয়া সেই শাস্তি মুকুব করে দিয়েছেন। একবার রাজার ইচ্ছে হল দুজন নর্তকীকে মাইনে দিয়ে রাখবেন। প্রত্যেকের মাইনে মাসে চল্লিশ টাকা। পেশোয়া সম্মতি দিয়েছিলেন। আর একবার রাজপ্রাসাদের জল আনবার ব্যবস্থা হচ্ছিল। খরচ বেশি পড়বে বলে পেশোয়া এই ব্যবস্থা নাকচ করে দেন l

১৮১০ সাল থেকে সাতারার রাজা হলেন প্রতাপ সিং।

ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধ বাধলে পেশোয়া দ্বিতীয় বাজিরাও ১৮১৭ সালে পুনে থেকে পালিয়ে গেলেন। পালাবার সময় সাতারা দুর্গ থেকে রাজা প্রতাপ সিং ও তার পরিবারের কাউকে কাউকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন। তার কারণ স্পষ্ট। ইংরেজরা যদি এই সুযোগে প্রতাপ সিং কে মারাঠাদের রাজা বলে ঘোষণা করেন, তাহলে পেশোয়া অসুবিধায় পড়ে যাবেন।

এভাবে কয়েক মাস ধরে ইংরেজদের কাছে ছুটে গিয়ে পালাতে পালাতে ১৮১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পেশোয়ার সর্বনাশ হয়ে গেল।

অষ্টির যুদ্ধের সেনাপতি বাপু গোকলা, যার উপর তার সব আশাভরসা, মারা গেলেন। প্রতাপসিংকে রেখে বাজীরাও পালিয়ে গেলেন।

তাঁর ফেলে যাওয়া এক কোটি টাকা ইংরেজদের হাতে এল। এলফিনস্টোনের কাছে সাতারার রাজাকে রেখে জেনারেল স্মিথ পেশোয়াকে আবার তাড়া করে বেড়াতে লাগলেন। প্রতাপ সিংয়ের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর এলফিনস্টোন লিখলেন, প্রতাপ সিংয়ের আচরণ স্বাধীন রাজার মত। এলফিনস্টোনকে দেখে আসন থেকে উঠে দাঁড়ালেন না, নিচু হয়ে অভিবাদনও করলেন না। তার ব্যবহার খুব ভদ্র, কথাবার্তা মার্জিত, তিনি দেখতে সুদর্শন নন বরং তার ভাই তার চাইতে দেখতে ভালো তবে দুজনার চেহারার মিল আছে। তাদের মাকে দেখে এলফিনস্টনে মনে হল তিনি খুব বুদ্ধিমতী। একসময় সুরূপা ছিলেন বোঝা যায়। পেশোয়ার হাত থেকে মুক্তি পেয়ে প্রতাপসিং খুব আনন্দিত হয়েছেন বোঝা গেল। এপ্রিলের ১০ তারিখে সাতারাতে প্রতাপসিংয়ের অভিষেক হল l

প্রতাপসিংয়ের সঙ্গে প্রথম দিকে ইংরেজদের সদ্ভাব ছিল। এলফিনস্টোন তাঁর গুণমুগ্ধ ছিলেন। বন্ধুর কাছে লেখা চিঠিতে থেকে তিনি তাকে সবচেয়ে যোগ্য মহারাষ্ট্রীয় বলে বর্ণনা করেছেন। ভেলভেট মোড়া টেবিলের একদিকে বসে সাতারার রাজা নিজের হাতেই চিঠি লিখছেন এবং অন্যান্য কাজ করছেন।

এলফিনস্টনের মনে হয়েছিল এ দৃশ্য দেখে শিবাজী কী ভাবতেন !

এলফিনস্টোন বলেছেন প্রতাপ সিংহ যেভাবে রাজ্য শাসন করেছেন রাজ্যে কোন ইউরোপীয়ের পক্ষেই গর্বের বিষয় হত। বিখ্যাত ঐতিহাসিক জেমস কানিংহাম গ্ৰান্ট প্রায় তিন বছর সাতারার রাজার অভিভাবকের কাজ করেছেন। তিনি এই কাজ থেকে অবসর নেওয়ার পর এলেন ক‍্যাপ্টেন ব্রিগস। তিনিও পরে ঐতিহাসিক হয়েছিলেন। প্রতাপ সিং মহাবালেশ্বরে যাবার জন‍্য একটি পথ নির্মাণ করে দিয়েছিলেন এবং ইউরোপীয়দের জন্য সেখানে একটি সুদৃশ্য গ্ৰীষ্মাবাস তৈরী করান। তার বদলে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রতাপগড়ের বিখ্যাত শিবাজী মুর্তি রাজাকে ফেরত দিয়েছিলেন।

তাঁর লেখাপড়ায় উৎসাহ ছিল, কলকাতায় এশিয়াটিক সোসাইটির সঙ্গেও তাঁর যোগ ছিল।

কিন্তু কোম্পানির সঙ্গে সদ্ভাব স্থায়ী হল না।
কেউ কেউ বলতে লাগলেন তিনি কোম্পানির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন।

একবার খবর এসেছিল প্রতাপ সিং ও বিঠুরে নির্বাসিত পেশোয়া বাজিরাও ইংরেজদের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করছেন। তখন কিন্তু এই কথা কেউ বিশ্বাস করেনি।

কিন্তু যে কারণেই হোক অবশেষে প্রতাপসিং এর রাজত্ব গেল। ১৮৩৯ সালে তাকে সরিয়ে দিয়ে তাঁর ভাই শাহজীকে রাজা করা হল।

প্রতাপ সিংয়ের রাজ্য যখন কেড়ে নেওয়া হয়েছিল তখন তিনি প্রতিবাদ করার চেষ্টা করেছিলেন। কাগজপত্র সমেত ইংল্যান্ডের দূত পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু কোনো ফল হয়নি।
দূতদের একজন দরকারি কাগজপত্র আর অনেক টাকা নিয়ে অন্তর্ধান করেছিলেন।

প্রতাপ সিংয়ের সঙ্গে কোম্পানির ভালো ব্যবহার করেনি।

যে ইংরেজ কর্মচারী তাঁকে কাশী নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি সমস্ত পথ তাঁর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছিলেন। প্রতাপ সিং কিন্তু শেষ পর্যন্ত আশা ছাড়েননি।

জর্জটাউন নামে একজন ইংরেজ সাংবাদিককে বিলেতে পাঠিয়েছিলেন।

তখনকার দিনে জর্জটাউনকে অনেকেই জানত।

কিন্তু তাতে কিছু কাজ হল না। বারাণসীতে অবহেলার মধ্যে শিবাজীর বংশধরের মৃত্যু হল l

প্রতাপ সিংয়ের ভাই শাহজীর মৃত্যুর পর সম্পূর্ণ সাতারা ইংরেজদের হাতে এসে যায়। শিবাজী রাজত্বের আর কোন চিহ্ন রইল না।

ইতিহাসের গল্প
লেখক ; প্রতুলচন্দ্র গুপ্ত
প্রকাশক; আনন্দ পাবলিশার্স
প্রথম সংস্করণ ; ১৯৮৬
তৃতীয় মুদ্রণ ; ১৯৯৮
পৃষ্ঠা ; ৬৬ – ৭১

প্রতুলচন্দ্র গুপ্ত ( ১৯৬০ – ) কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃতিত্বের সাথে অধ‍্যাপনা করেছেন ( ১৯৩৯ – ১৯৬১ )
১৯৬১ সালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রধান অধ‍্যাপক। অল্পকালের জন‍্য উপাচার্যও হয়েছিলেন। উপাচার্য ছিলেন বিশ্বভারতীর ( ১৯৭০ – ৭৫ ) ও রবীন্দ্রভারতীর (১৯৭৫ – ৭৯ )। ১৯৭৫ সালে ‘পদ্মভূষণ ‘ পুরস্কার পান। ১৯৮১ – ৮৩ সাল পর্যন্ত তিনি এশিয়াটিক সোসাইটির সভাপতি ছিলেন।

রাজা বাদশার নামের ফর্দ নয়, নয় সাল তারিখের কচকচি, মানুষের ধারাবাহিক জীবনযাত্রার চলমান প্রতিচ্ছবির নামই ইতিহাস।
ইতিহাসের পৃষ্ঠা হাতড়ে এমনই কিছু কৌতুহলকর সত‍্য হাতড়ে ছোটদের জন‍্য সাজিয়ে দিয়েছিলেন লেখক। অতীতের এই সত‍্য ঘটনার মধ‍্যেই রয়েছে জাতীয়তাবোধের উপাদান।

রাজারাম ১৬৮৯ থেকে ১৭০০ সাল প্রায় এগারো বছর তৃতীয় ছত্রপতি হিসেবে রাজ্যভার চালান এবং মুঘল আক্রমন প্রতিরোধ করেন। ১৭০০ সাল থেকে ১৭০৭ এই সাত বছর আওরঙ্গজেবের সুবিশাল মোগল বাহিনীকে প্রতিরোধ করেন রাজারামের বিধবা পত্নী তারাবাঈ। তিনি মস্ত বীরাঙ্গনা ছিলেন এবং নিজে যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে সৈন্য পরিচালনা করতেন। ভদ্রকালীর অবতার বলা হত তাঁকে।

The reigning families in Mahratta are divided into two branches. The first Prince is Xaú (Shahu) Raja, with his Court at Satara ; the other, Sambagy Raja, at Calapur ( Kolhapur). Xaú (Shahu) Raja, taking advantage of the decadence of the Mughal Empire, now governs the vast territories from the kingdom of Cambay as far as Bengal.”
~ English translation of an excerpt from Goa Portuguese Governor Marquez de Alrona’s letter to the King of Portugal.

সাতারা রাজ‍্য ডালহৌসীর আমলে কোম্পানি বাহাদুর নিয়ে নিলেও কোলহাপুর রাজ‍্যে কিন্তু ছত্রপতির বংশ রয়ে গিয়েছিল। কোলহাপুরের মহারাজবাহাদুর শাহুর কীর্তির কথা কে না শুনেছে ? সে একটা অন‍্য গল্প।

মধ্যযুগের ভারতে নারীর রূপসজ্জা

রানা চক্রবর্তীঃ ‘মুসলমান শাসকদের সমকালীন’ ভারতবর্ষকে আমরা সাধারণতঃ ‘মধ্যযুগ’ বলে থাকি৷ কিন্তু ‘প্রাচীনযুগের’ নিঃশেষ সমাপ্তির পরেই যে ‘মধ্যযুগের’ শুরু হয়েছিল, তা নয়। কোন বিশেষ রীতি রেওয়াজ ওভাবে শুরু বা শেষ হয় না, বিশেষ করে ভারতের মতো দেশে। এখানে বৈচিত্র্য ও স্বাতন্ত্র্য বড় বেশি৷ নতুন রীতিনীতিকে যত সহজে গ্রহণ করা হয়, পুরনো রীতিকে তত সহজে বর্জন করা হয় না, অর্থাৎ এখানে থেকেই যায় সব কিছু। সেইজন্যই ‘অজন্তার গুহাচিত্রে’ দেখতে পাওয়া যায় বিভিন্ন ধরনের সাজপোশাকের একত্র সমাবেশ। এই ‘মধ্যযুগেই’ ভারতীয় বস্ত্রশিল্পের চরমোৎকর্ষ দেখা দিয়েছিল৷ সাধারণতঃ সব দেশেই বিজিত বিজয়ীর অনুকরণ করে। শোনা যায়, ‘আর্য নারীদের’ উন্মুক্ত বক্ষ দেখে ‘দ্রাবিড় নারীরা’ লজ্জায় লুকিয়ে ফেলেছিলেন তাঁদের ‘কঞ্চুলিকা’। সব দেশেই দেশের রাজা রানীর সাজসজ্জার অনুকরণ করেন অভিজাত সমাজ, অভিজাতদের দেখাদেখি সাধারণ মানুষ। বহুদিনের ব্যবধানে সবাইকে এক সময়ের বলে মনে হয়। ভারতে আসা লুণ্ঠনকারী বিদেশী রাজারা যখন এদেশেই শাসক হয়ে বসেছিলেন তখন তাঁরাও ‘বর্ণাঢ্য ভারতীয় সাজসজ্জা’ দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। মুসলমান শাসকরা ভারতে আসার আগেই ‘চীন ও পারস্যের বস্ত্রশিল্পের’ সঙ্গে পরিচিত ছিলেন এবং ঐ দুটি দেশের বস্ত্রশিল্প চরমোৎকর্ষ লাভ করেছিল বহু পূর্বেই। কিন্তু ‘ধর্মীয় অনুশাসন’ মেনে মুসলমান শাসকরা যে পোশাক পরতেন সেগুলো ছিল সাদাসিধে, ঘোর রঙের এবং মোটা সুতি বস্ত্রের। তাতে না ছিল নকশা, না ছিল রঙ। সেই পোশাক অবশ্যই ‘যুদ্ধক্ষেত্রের উপযোগী’ ছিল। মেয়েরাও পরতেন একরঙা ‘পেশওয়াজ’ ও ‘পাজামা’। ভারতে এসে ‘রাজস্থানের মেয়েদের’ মতো তাঁরাও ‘ওড়না’র ব্যবহার শুরু করেছিলেন। প্রথমে এই ‘ওড়না’ বা ‘দোপাট্টা’ আকারে খুব ছোট ছিল, পরে ক্রমশই বড় হয়েছে। এই ‘ওড়না’র ক্রমবিবর্তনই বোধহয় ভারতীয় পোশাকের জগতে সবচেয়ে বড় বিস্ময়৷ সে প্রসঙ্গে পরে আলোচনা করা যাবে। তার আগে ‘হারেমের’ কথা বলা যাক। মুসলমানেরা ‘রাজ অন্তঃপুর’কে বলতেন ‘হারেম’; যতদূর মনে হয়, ‘হারেমে’ কড়াকড়ি বা পাহারা দেবার কঠোর ব্যবস্থার চল্ ছিল। হিন্দু রাজাদের সমযয়ে রানী বা ‘পুরাঙ্গনারা’ সত্যিই সম্পূর্ণ ভাবে অন্তরালবাসিনী ছিলেন কিনা সেই বিষয়ে ঐতিহাসিকদের যথেষ্ট সন্দেহ আছে। তবে ‘রাজপুত রাজাদের অন্তঃপুর বা রাওলা’র ‘পর্দা’ এবং কড়াকড়ি ‘মুঘল হারেমের’ মতোই যে ছিল সেই বিষয়ে ঐতিহাসিকদের কোন সন্দেহ নেই। সেই ব্যবস্থা বহিরাগত শত্রুর হাত থেকে নারীদের রক্ষা করবার জন্যে রাজারা নিজেরাই নিয়ম করেছিলেন, না কী, শাসকদের রীতি-রেওয়াজের অনুকরণে অন্তঃপুরে ‘পর্দা’র চল হয়েছিল, সেটা গবেষণার বিষয়। তবে দেখা যায় যে, ‘মুঘল হারেমে’ ‘রাজপুত রাজকন্যারা’ আসতেন ‘বেগম’ হয়ে – ভিন্ন রুচি ও ভিন্ন সংস্কৃতি নিয়ে। ‘হারেমের’ প্রাঙ্গণে ‘তুলসীগাছ’ রোপণের ব্যবস্থা দেখে বোঝা যায় তাঁরা নিজের নিজের ধর্মাচরণে যেমন বাধা পাননি তেমনি বাধা পাননি নিজস্ব সংস্কৃতির অনুশীলনে। ‘হারেমে’ তাঁরা এনেছিলেন ‘রাওলার রঙ ও ঔজ্জ্বল্য’। নিশ্চয় তাঁদের বর্ণাঢ্য ‘ঘাগরা’, ‘কাঁচুলি’, ‘ওড়না’ মুগ্ধ করেছিল একরঙা ‘পেশওয়াজ’ ও ‘পাজামা’ পরা ‘বেগমদের’। অনেকে বলেন, ‘রাজস্থানের’ প্রকৃতি এত রুক্ষ বলে ‘রাজপুতানী’র অঙ্গে এত রঙ। যাঁদের দেশের প্রকৃতি হরিৎ-শ্যামল, ফুলে-ফলে রঙিন, সে দেশের মেয়েরা পরেন ‘সাদা শাড়ি’। এখনও ভারতের অন্যান্য রাজ্যের চেয়ে ‘রাজস্থানে’ রঙের ব্যবহার বেশি। তবে এখন আর কোন রাজ্যই পিছিয়ে নেই। যাক সে কথা।
‘রাজপুত রাজাদের’ পোশাকের মধ্যে ‘কোমরবন্ধ’ বা ‘পটকা’র সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন ‘বাদশাহ’ এবং ‘শাহজাদারা’। এবং তাঁরাও ‘রাজপুতদের’ দেখাদেখি ‘সূক্ষ্ম জরির কাজ করা পটকা’ ব্যবহার করতে শুরু করেছিলেন। ‘জাহাঙ্গীরের’ সময়ের রকমারি নকশার ‘কোমরবন্ধ’ পাওয়া গেছে। সেই ‘পটকা’ ‘রাজপুত মেয়েরা’ও ব্যবহার করতেন ‘ঘাগরা’র সঙ্গে। ‘পটকা’ শুধু যে ‘বেল্টের’ কাজ করত তা নয়, তাঁদের কোমরটিকেও সরু রাখতে সাহায্য করত। মুসলিম সমাজে প্রথমদিকে ‘চিত্রিত পোশাক’ পরার ‘ধর্মীয় নিষেধ’ ছিল। তাঁরা ছবি আঁকতেন না কোন জীবিত বস্তু বা ব্যক্তির। সেজন্যে ‘কোরানের হরফগুলি’ সুন্দর করে চিত্রিত করা হত, বোনাও হত। অপরদিকে ‘চীনে’ ছিল কাপড়ের ওপর ‘সুতো’ বা ‘জরি’ দিয়ে ছবি আঁকার চল্। এছাড়া ছিল নানারকমের ‘ডোরা দেওয়া কাপড়’৷ ‘পারস্য’ প্রভৃতি অঞ্চলের মানুষেরা ‘ডোরা দেওয়া কাপড়ের জামা কিংবা পাজামা’ তৈরি করতেন, ‘পাগড়ি’ জাতীয় ‘শিরস্ত্রাণ’ও তৈরি করতেন। ভারতে হিন্দুদের মধ্যে সব জিনিসেরই প্রচলন ছিল – ‘ডোরা’, ‘নকশা’, ‘ছবি’, ‘অলঙ্কারের’ মতো ‘জড়োয়া সোনা-রুপোর ফুল’ বসানো ছাড়াও তাঁদের ঝোঁক ছিল ‘বস্ত্রের সূক্ষ্মতা’র ওপর। ভারতের উষ্ণ আবহাওয়ার জন্যেও প্রাচীন যুগে ভারতীয়রা ‘পাতলা কাপড়’ পছন্দ করতেন। নতুন যে কোন জিনিসকে পরম সমাদরে গ্রহণ করার মতো উদার মন ও সুন্দরকে চিনে নেবার মতো শিল্পসম্মত দৃষ্টিও ভারতীয় নারীর সাজসজ্জাকে উন্নততর করতে বহুলাংশে সাহায্য করেছে। ‘মুঘল আমলের’ আগে এবং পরে সাধারণভাবে ‘ইসলাম ধর্মাবলম্বী বেগমদের’ পোশাকে ‘ডোরা কাটা সিল্ক’ ও ‘মসলিনের’ প্রাধান্য চোখে পড়ে। পুরনো আমলের আঁকা ছবিতে দেখতে পাওয়া যায় যে ‘হারেমের মেয়েরা’ পরতেন ‘সাদা পাজামা’ ও ‘আঁটসাট কুর্তা’। সেই ‘কুর্তা’র নিচের দিকটা ‘আধুনিক কামিজের’ মতো সমান ছিল না – চারটে বা ছ’টা কোণ থাকত তাতে, অনেকটা ত্রিভুজের মতো দেখাত সেগুলি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেই পোশাক ছিল সাধারণ মেয়েদের পোশাক। ছবিতে দেখা যায়, পরিচারিকা সেইরকম ‘কুর্তা’ পরে ‘সুরা’ পরিবেশন করছেন। ভৃত্যদের পোশাকেও সেই কোণ চোখে পড়ে। এমনকি সেই পোশাক ‘রাজস্থানে’ও দুর্লভ ছিল না। গবেষকদের যতদূর মনে হয়, সেই পোশাকটিতে ‘ভারতীয় রীতি’র সঙ্গে ‘পারসীক রীতি’র মিশ্রণ ঘটেছিল। ‘কুর্তা’র সেই কোণের সঙ্গে দেখা যেত ইংরেজি ‘ভি’-এর মত গলা, এবং সেখানে থাকত ‘জরি বা সামান্য সুতোর কাজ’। ‘মুসলমান শাসকদের পোশাকে’ বহুদিন পর্যন্ত কোন ‘নকশা’ ছিল না। কিন্তু ‘বেগমদের পোশাকে’ পরিবর্তন এসেছিল দ্রুতভাবে। এবং সেই সময় থেকেই বস্ত্রশিল্পের, বিশেষ করে ‘কিংখাবের’ প্রভূত উন্নতি দেখা দিয়েছিল। সেই ‘খানদানী’ ব্যাপার আজও চলে আসছে ‘বেনারসী’র জগতে। সেখানে এখনও ‘তসবীর’, ‘লহরিয়া’, ‘চারখানা’, ‘খানজুরি’, ‘ডোরিয়া’, ‘সালাইদার’, ‘মোটরা’, ‘ইলায়েচা’, ‘সঙ্গী’, ‘বুলবুলচশম’, ‘চশমানকশা’, ‘আড়িবেল’, ‘খাজুরিবেল’, ‘পানবুটি’, ‘ফুল বুটি’, ‘কলগাবুটা’, ‘শিকারগাহ’, ‘গুলদাউদি’, ‘চিনিয়াপট মখমলী’, ‘বুটি মানাতাশি’, ‘জামেয়ার বুটি’, ‘ফর্দি বুটি’, ‘পাংখা বুটি’, ‘আসরফি বুটি’, ‘জালি কী তুরঞ্চ বুটি’, ‘বুটা ঝাড়দার’, ‘মেহরাব’, ‘তনছই’, ‘ভাসকট’, ‘আড়াগুঞ্জর’, ‘গুলবদন’, ‘বেলদার’, ‘কাঙ্গুরী’, ‘ফুলোয়ার’ প্রভৃতি নামের ছড়াছড়ি। এই নামগুলো মনে পড়িয়ে দেয় ‘বেনারসী শিল্পের’ বিশেষ একটা জগৎকে। সে জগটা শুধু ‘নকশার জগৎ’ নয়, বস্ত্রশিল্পের প্রতি আগ্রহী ব্যক্তিদেরও জগৎ। ‘সম্রাট জাহাঙ্গীর’ এবং ‘সম্রাজ্ঞী নূরজাহান’ দু’জনেই ছিলেন শিল্পপ্রেমিক। ‘নূরজাহান’ নিজেই ছিলেন শিল্পী। সূক্ষ্ম কারুকাজ করতে পারতেন কাপড়ের ওপর। অনেক নকশা নাকি তাঁরই আবিষ্কার। আসলে ‘নূরজাহান’ ভারতীয় নারীর পোশাকে এনেছিলেন নতুনত্ব ৷ অবশ্য তিনি ‘হারেমে’ ‘পারসিক প্রভাব’টিকে পুরোমাত্রায় বজায় রাখতে চেয়েছিলেন; তবে সেটা বহু পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে। প্রথমদিকে ‘হারেমের’ মেয়েরা ‘কিংখাব’ ব্যবহার করতেন না। ‘একরঙা’ বা ‘ডোরাকাটা’ ‘জামা ও পাজামা’র ওপরে তাঁরা পরতেন মাকড়সার জালের মতো সূক্ষ্ম ‘মসলিনের পেশওয়াজ’। ‘কিংখাব’ জিনিসটা নারীদের পোশাকের উপকরণ হিসেবেও ছিল বেমানান। সেটা ছিল ভারী এবং জরির কাজের জন্য কিছুটা কর্কশ৷ এছাড়া ভারতীয় মেয়েরা পরতেন গা ভর্তি সোনা রুপোর অলঙ্কার। তাই তাঁদের পোশাকে সোনার ফুল রুপোর পাতার বাহারের প্রয়োজন কী! দুইয়ে মিলে রূপ খুলত না, গয়না-পোশাক দুই-ই মাঠে মারা যেত। তাই ‘কিংখাবের অঙ্গরাখা’ পরতেন পুরুষেরা। মুঘল সম্রাটেরা – ‘জাহাঙ্গীর’, ‘শাহজাহান’ ও ‘ঔরঙ্গজেব’ তিন জনেই ছিলেন ‘কিংখাবের’ সমঝদার। ‘ঔরঙ্গজেব’ পছন্দ করতেন নানা ধরনের ‘মসলিন’, বিশেষ করে কাজকরা ‘জামদানী মসলিন’। ‘আবরোয়া নয়নসুখ’ ও ‘জামদানী’ও সেই সময়েই উন্নতির চরম শিখরে উঠেছিল। ‘চিকন কাপড়ে’ও দেখা গিয়েছিল নানা বৈচিত্র্য। ভারতীয় নারীদের মধ্যে জুতো পরার চল্ খুব বেশি ছিল না। যদিও ‘বেলুরের’ দু-একটি ‘মদনিকা’র পায়ে দেখা যায় ‘হাই-হিল হাওয়াই চটি’র মতো পাদুকা। ‘হারেমবাসিনীরা’ সকলেই জুতো পরতেন, সেই জুতোর সামনেটা ছিল কারুকাজ করা ঢাকা, পিছনের দিকটা ছিল কারুর ঢাকা আবার কারুর বা চটির মতো খোলা। তাঁদের জুতোর কারুকাজ করা অংশে ‘কিংখাবের’ ব্যবহার শুরু হয়েছিল। ‘পারসীক নারীরা’ ‘ওড়না’ ব্যবহার করতেন কিনা সেই বিষয়ে কোন তথ্য পাওয়া যায় না। হয়ত রুমালের মতো ছোট ‘ওড়না’র ব্যবহার তাঁরা জানতেন। সেটার পরিবর্তে তাঁদের মাথায় উঠেছিল ‘টুপি’। তবে ভারতীয় নারীরা টুপি পরতেন না, ‘মুকুট’ পরতেন রানীরা। মুসলমান সমাজে নারী-পুরুষ উভয়েরই ‘টুপি’ পরার চল ছিল। ‘বেগমদের’ ‘টুপি’ও তৈরি হত মহার্ঘ ‘জরির ফুলদার কিংখাব’ দিয়ে, তাতে বসানো হত ‘দামী জহরৎ’ ও ‘মুক্তো’। মুঘল ‘হারেমে’ ‘টুপি’র ওপরে বাঁদিকে ‘বোতাম’ বসানো হত। ভারতে এসে মুঘল অন্তঃপুরের নারীরা দেখেছিলেন ‘কাঁচুলি’, ‘ঘাগরা’ ও ‘ওড়না’ পরা সুবেশা ‘রাজপুতানী’দের। তাঁরা মুগ্ধ হয়েছিলেন সেই পোশাকটির সুন্দর সাবলীলতায়। প্রথমে ‘রাজপুতানী’দের, বিশেষ করে ‘কাংড়া অঞ্চলের’ মেয়েদের ‘পটকা’ এবং পরে তাঁদের ‘কাঁচুলি’ ও ‘ওড়না’টিও ‘হারেমবাসিনীরা’ গ্রহণ করেছিলেন। ‘নূরজাহানের’ ছবিতে দেখা যায় যে তাঁর পরনে ‘ডোরাকাটা পাজামা’র ওপরে থাকত ‘হ্রস্ব জামা’, যা ‘কাঁচুলি’ ও ‘কুর্তা’র সমন্বয়ে তৈরি হয়েছিল এবং ‘মসলিনের পেশওয়াজ’। ‘হারেমবাসিনী’ যেমন ‘টুপি’ বা ‘তাজ’ পরতেন, সেটি গ্রহণ করেছিলেন ‘রাজস্থানের’ কোন কোন ‘রাওলার নারীরা’। ‘বুঁদী’র রাজকন্যারা ‘লম্বা টুপি’ পরতেন৷

শিল্পানুরাগিণী ‘নূরজাহান’ ছিলেন অনেকগুলি কাপড় ও নকশার আবিষ্কর্ত্রী। তিনি একে একে প্রবর্তন করেছিলেন ‘পাচতোলিয়া ওড়না’, ‘দুদামী পেশওয়াজ’, ‘বাদলা’ বা ‘এক ধরনের কমদামী জরি’, ‘কিনারি’ বা ‘লেস’, ‘আতর ই জাহাঙ্গিরী’, ‘নূরমহালী কিংখাব’ এবং আরও কত কী। ‘নূরজাহান’ পোশাকের ওপর সূক্ষ্ম কাজ পছন্দ করতেন। অনেকের মতে ‘চিকনের নকশা’ও তাঁরই আবিষ্কার। তা যদি না-ও হয়, তিনিই যে সেই শিল্পটির প্রভূত উন্নতি করেছিলেন তাতে গবেষকদের কোন সন্দেহ নেই। ‘বেগমদের’ বিয়ের সাজ তৈরি হত জমকালো ‘কিংখাব’ দিয়ে। ‘নূরজাহান’ স্থির করেছিলেন, বিয়ের সময় সকলেই ‘জমকালো জরির পোশাক’ পরবেন। আহা গরীবদেরও তো ইচ্ছে করে একদিনের জন্যে ‘বাদশা-বেগম’ হতে! সেই এক দিনটি তাঁদের জীবনে আর কবে হতে পারে বিয়ের দিনটি ছাড়া! সম্রাজ্ঞীর খেয়াল! তাঁর কোন অভাব ছিল না, কিন্তু তাঁর দাসীরা? প্রতিদিন যাঁরা তাঁকে সাজিয়ে দিতেন, তাঁরা সাজবেন না! কিন্তু ‘কিংখাবের’ পোশাক ছিল বড় দামী। গরীবরা সেটা পরবেন কি করে? ভেবে চিন্তে ‘নূরজাহান’ নিজেই একটা নকশা তৈরি করে ফেলেছিলেন। ‘ফাঁকা’র ওপর ‘জমকালো’। যে সব নকশা খুব সূক্ষ্ম নয়, অথচ পুরো জমিটা ভরে থাকত, সেটাকে বলা হত ‘ফাঁকার কাজ’। ‘নূরজাহানের’ পরিকল্পনা মতো সেই কাপড় বুনতে সময় কম লাগত, দেখতে ঝলমলে হলেও পরিশ্রম কম বলে সেগুলোর দামও ছিল কম। সেই নতুন জরির পোশাকের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘নূরমহালী’। ‘নূরজাহান’ নিজের পরিচারিকা ও তাঁদের কন্যাদের বিয়েতে উপহার দিতেন ‘নূরমহালী’ পোশাক। সেই পোশাক তৈরি করতে তখনকার দিনে খরচ পড়ত পঁচিশ টাকা, মতান্তরে পঁচিশ মোহর বা একশো টাকা। আজও সেই রীতি আমাদের দেশে জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে পালিত হচ্ছে। অর্থাৎ ‘নূরজাহানের’ সেই সঙ্কল্প ভারতীয় নারীর পোশাকে নিয়ে এসেছিল এক নতুন দিগন্ত। ইতিপূর্বে ‘বিয়ের সাজ’ বলে আলাদা কিছু ছিল না। ‘রাজ্যশ্রী’র বিয়ের বড় মাপের আয়োজনের কথা ‘বাণভট্ট’ লিখেছিলেন কিন্তু সেই সাজপোশাকের স্তূপ থেকে ‘রাজ্যশ্রী’র ‘রক্তিম পট্টবস্ত্র’টিকে আলাদা করে চিনে নেওয়া যায়নি, বরং ‘ভারতীয় সনাতন রীতি’ অনুযায়ী বিয়ের সাজ ছিল সাদা এবং সেখানে ঔজ্জ্বল্যের পরিবর্তে পবিত্র ও সুন্দরেরই প্রাধান্য ছিল। এখানেই মধ্যযুগের সাজের ক্ষেত্রে একটা বড় রকমের পরিবর্তন ঘটিয়ে দিয়েছিলেন ‘নূরজাহান’। এরপর থেকে ‘বিয়ের কনের সাজ’ মানেই ‘জমকালো জড়োয়ার প্রাচুর্য’।
এই প্রসঙ্গে ‘অভিজাত ঘরের মুসলমান মেয়েরা’ ‘বিয়ের সাজে’ কেমন সাজতেন সেটার একটা নিখুঁত বিবরণ ‘আন্না হ্যারিয়েট লিউনাউসের’ বর্ণনা থেকে পাওয়া যায়। ‘আন্না’ ভারতে এসেছিলেন খ্রীস্টিয় ঊনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে। তখন ‘খানদানী পরিবারের সাবেকী ধারা’ পুরোমাত্রায় বজায় ছিল। ‘লিউনাউসের’ নিজের ভাষায়, ‘‘… she wore a purple silk petticoat embroidered with a rich border of scattered bunches of flowers, each flower formed of various gems, while the lines and stems were of embroidered gold and silk threads. The bodice was of the same meterial as the petti coat, the entire vest being marked with circular rows of pearls and rubies. Hair was parted in the Greek style and confined at the back in a graceful knot bound by a fillet of a gold. On her forehead rested a beautiful flashing star of diamonds. Her slippers, adorned with gold and seed pearls, were open at the heads showing her henna-tinted feet and curved up in front towards the instep, while from her head flowed a delicate kincauli scarf woven from gold thread, of the finest texture and of a transperant, sunbeam like appearance. This was draped round her person and concealed her eyes and nose revealing only the mouth and chin …’’ নারীসুলভ আগ্রহ ও ঔৎসুক্য নিয়ে লেখিকা বধূটির সাজ পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। তাঁর লেখা বর্ণনার মধ্যে সবার আগে যেটা চোখে পড়ে সেটা হল ‘জাঁকজমকের প্রাচুর্য’। ‘মুঘলযুগের আড়ম্বর’ যেন পরবর্তীকালের নারীদের সাজসজ্জাকে সম্পূর্ণভাবে প্রভাবিত করেছিল। একই সঙ্গে সব কিছুকে ‘সোনাদানা’, ‘রঙ’, ‘কারুকাজ’ দিয়ে ভরিয়ে দেওয়ার সেই প্রবণতা ‘হিন্দুযুগে’ ছিল না। নববধূটির পরণের ‘বেগুনি-লাল ঘাগরা’, লেখিকা যেটাকে ‘পেটিকোট’ বলেছিলেন, সেই ‘কুর্তা’ বা ‘কাঁচুলি’তে ‘জরি’র সঙ্গে ‘জড়োয়া পাথর’ বসানো হয়েছিল, ‘কাঁচুলি’তে ছিল ‘মুক্তোর সারি’; নববধূর চুলে, কপালে, এমনকি জুতোতেও ছিল ‘সোনা’ এবং মাথার উপরে ছিল স্বচ্ছ সোনালী রঙের ‘ওড়না’ – এগুলো সব মিলে যা সৃষ্টি করেছিল তাতে ছিল না একটুও অবসর। অথচ কোন কিছুর অভাব চোখে পড়ে না, এবং সেটাই হয়ে দাঁড়ায় সৌন্দর্য নির্ণয়ের পথে প্রধান অন্তরায়। বস্তুতঃ এরপর থেকেই নারীর সাজসজ্জায় ‘প্রাচুর্যের ভূমিকা’ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। গবেষকদের যতদূর মনে হয়, ‘অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে’ নারী কিছুটা নিরাপত্তার অভাব বোধ করতে শুরু করেছিলেন সেই সময় থেকে। একই সঙ্গে স্বামীকে ‘সপত্নী’দের হাত থেকে রক্ষা করে নিজের প্রতি আকৃষ্ট করবার বাসনাও তাঁদের মধ্যে প্রবল হয়ে উঠেছিল। বস্তুতঃ, নারীসমাজের সেই অবস্থা যে ‘হিন্দুযুগে’ও ছিল না তা কিন্তু নয়, কিন্তু ‘হারেম সংস্কৃতি’তে এর বাড়াবাড়ি চোখে পড়ে। তাছাড়া মুঘলরা সকলেই ছিলেন ‘আড়ম্বরপ্রিয়’। তাঁদের ‘সাজসজ্জার আড়ম্বর’ তৎকালীন অভিজাত সমাজে গৃহীত হয়েছিল ‘ফ্যাশান’ হিসেবে। সেই ‘ফ্যাশনে’ সর্বপ্রথম প্রভাবিত হয়েছিলেন ‘রাজপুত নারীরা’, পরে সেই প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছিল ‘গুজরাট’ ও অন্যান্য সব অঞ্চলে।
‘মুঘল আমলে’ আড়ম্বরের মধ্যেও নারীর সাজকে রুচিসম্মত করে তুলতে ‘নূরজাহান’ চেষ্টার ত্রুটি করেননি, কিন্তু তাঁর এবং তাঁর সময়কার সাজে-প্রসাধনে ‘অলঙ্কার’ হিসেবে গৃহীত হয়নি কোন ‘ফুল’ কিংবা ‘কচি পাতা’, ‘আধফোটা ফুলের কুঁড়ি’ বা ‘পদ্মের মৃণাল’। তার বদলে তাঁরা ব্যবহার করতেন ‘সোনার ফুল’, ‘হীরের ফুল’, ‘দামী পাথর বসানো রুপোর ফুল’, ‘জরির ফুল’। তবে ‘মুঘলরা’ সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়েছিলেন ‘রাজপুত রাজা ও রাজকন্যাদের সাজপোশাকে’। সেই পোশাকের অনুকরণ অব্যাহত ছিল সর্বক্ষণই। ‘কাংড়া’র মেয়েরা পরতেন ‘লম্বা চোলি’, সেটার ‘আস্তিন’টা কবজি ছুঁতো। সেটিও ‘মুঘল অন্তঃপুরে’ প্রবেশ করেছিল। এছাড়া সেখানে এসেছিল আর-এক ধরনের জামা, সেটির নাম ছিল ‘জাঙ্গুলি’ – লম্বায় সেটি ছিল হাঁটু পর্যন্ত, সামনে-পিছনে ছিল হীরে-জহরতের ছড়াছড়ি। জামাকাপড়ে ‘জহরৎ’ বসানোর চল শুরু করেছিলেন ‘জাহাঙ্গীর’, তাঁর আগে ‘মুসলমান শাসক’ বা ‘আমীর-ওমরাহরা’ জামায় ‘হীরে-মুক্তো’ বসাতেন না, নিজেরাও গয়না পরতেন না। কিন্তু ‘রাজপুত রাজারা’ গয়না পরতেন, কতদিন আর গয়না না পরে থাকা যায়! মেয়েদের ‘গয়না-প্রীতির’ অনেক গল্প শোনা যায়। প্রায়ই সে সব গল্পে লোভ শোভনতার সীমা অতিক্রম করে। কিন্তু ভারতীয় পুরুষেরাও গয়না পরতে কম ভালবাসতেন না। বেশবাস সম্বন্ধে অতিমাত্রায় সচেতন ছিলেন বলেই ‘জাহাঙ্গীর’ একদিন কান বিঁধিয়ে ফেলে দু’কানে দুটি উজ্জ্বল ‘মুক্তো’ পরে ফেলেছিলেন। শোনা যায় হিন্দুরা কান বিঁধিয়ে গয়না পরতেন, কারণ তাঁদের ধারণা ছিল যে কান বেঁধালে চোখ ভাল থাকে। ওরকম হাস্যকর ধারণার কোন কারণ ছিল বলে তো মনে হয় না। ‘জাহাঙ্গীর’ শখ করেই কানে গয়না পরেছিলেন এবং তাঁর দেখাদেখি ‘আমীর-ওমরাহরা’ও কানে গয়না পরা শুরু করেছিলেন। ‘মধ্যযুগের’ ভারতে গয়নাগাটির চল ভালোমতোই ছিল এবং আগেই বলা হয়েছে যে সেই পর্বে ছিল ‘সোনা-রুপো’ ও ‘হীরে-জহরতের’ ছড়াছড়ি। ‘হিন্দুযুগের’ সেই ‘শুচিস্মিত লাবণ্যে পূর্ণ তনু’টিকে ‘পুষ্পাভরণে’ সাজাবার প্রবণতা ‘মধ্যযুগে’ অন্তর্হিত হয়ে গিয়েছিল। সেই পর্বের জন্য ‘ভাস্কর্যের’ কোন উদাহরণ নেই, আছে ‘চিত্র’। সেসব ছবিতে দেখতে পাওয়া যায় ‘হারেম কন্যাদের’ নানারকম সাজ। ‘ডোরাকাটা বা ছাপা কাপড়ের আঁট পাজামা’, তার ওপরে ‘মসলিনের অঙ্গাবরণ’ ও ‘ওড়না’ প্রায় সকলকেই ঘিরে থাকত। অনেক সময় মনে হয় ‘আঁটসাট পাজামা’র ওপরে তাঁরা পরতেন ‘মসলিনের স্বচ্ছ ঘাগরা’। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাঁরা ‘লম্বা হাতাওয়ালা চোলি’ পরতেন। এছাড়া তাঁদের সর্বাঙ্গে থাকত অজস্র গয়না৷ ‘মুঘল আমলে’ অজস্র নতুন ধরনের গয়না এসেছিল। সেগুলোর কোনটি ছিল ‘পুরনো গয়নার নতুন সংস্করণ’ কোনটি বা সম্পূর্ণ নতুন। ‘পারসী’রা অলঙ্কারের ওপরে ‘মিনার কাজ’ করতে পারতেন। তাঁদের স্থাপত্যেও পাওয়া যায় নয়নাভিরাম ‘মিনাকারী’। ‘কুন্দন-মিনাকারী’ আজও প্রসিদ্ধ।
মুঘল অলঙ্কারের মধ্যে ‘তাজ’ ও ‘ঝাপটা’ এসেছিল নতুন করে। ‘হিন্দুযুগে’ সেই দুটি মেয়েদের ‘শিরোভূষণ’ ছিল না, ছিল না ‘টায়রা’ কিংবা ‘টিকলি’, তবে ‘মাথায় ফুল’ ও ‘ফুলের মালা’র ব্যবহার ছিল, সিঁথিতে ফুল পরাও চলত, নববধূর ‘সিথিমৌর’ এসেছিল পরবর্তীকালে ‘টায়রা’ ও ‘টিকলি’র যোগফল হিসেবে। গবেষকদের মনে হয়, ‘টায়রা’ এসেছিল সমুদ্র পার হয়ে ‘বিদেশিনীদের অলঙ্কার’ হিসেবে। এই প্রসঙ্গে অতীতের ‘টায়ার’ রাজ্যের কথা মনে হওয়া স্বাভাবিক। তারপর সেটাকে ভারতীয় করে নেওয়া হয়েছিল। মেয়েবা মাথায় পরতে শুরু করেছিলেন ‘চৌঙ্ক’, ‘শিসফুল’, ‘ছোটি’, ‘মৌলি’। তাঁরা কপালে পরতেন ‘দম্‌নি’, ‘কুটবি’, ‘তাওইট’, ‘চাঁদটিকা’, ‘ঝুমর’, ‘গুছই’, ‘বারওয়াট’ ও ‘বিন্দলি’। সেগুলো সবই ছিল ‘কপাল অলঙ্করণের অলঙ্কার’। প্রাচীন ভারতীয় সাজসজ্জায় সেসব একেবারেই ছিল না। নারীরা সাজতেন ‘টিপ’ ও ‘অলকা তিলকা’য়৷ ‘মুসলমান সমাজে’ ‘টিপ’ বা ‘চন্দন-কস্তুরী’ পরার চল্ ছিল না, অবশ্য তাঁরা হাত-পা এবং নখ রাঙাতেন ‘মেহেদী’ বা ‘হেনা’ দিয়ে এবং সেটা তাঁরা শিখেছিলেন ‘রাজপুত-ললনাদের’ কাছ থেকে। এছাড়া তাঁরা মুখে ব্যবহার করতেন নানারকমের ‘ধাতব অলঙ্কার’ – সেগুলি সবই ছিল ‘টিপ’, ‘টিকলি’ প্রভৃতির সমগোত্রীয়। এ তো গেল ‘মাথার অলঙ্কার’। কানেও উঠেছিল নানারকম গয়না! যদিও ভারতে এর আগেও ‘কর্ণাভরণের’ অভাব ছিল না, ‘কাশী’র ‘মণিকর্ণিকা’ ঘাট তো সেই প্রাচীন কাল থেকে ‘পার্বতীর কর্ণাভরণের স্মৃতি’ বহন করে চলেছে। ‘মুঘল অলঙ্কারে’ দেখা গিয়েছিল আরও কয়েকটি নতুন নাম – ‘গোসওয়াড়া’, ‘বাহাদুরি’, ‘ঝমকা’, ‘বালা’, ‘খুংরিদার’, ‘মছলিয়ান’, ‘পতং’, ‘তানতুর’ এবং ‘মোর ফুলওয়ার’। সেসব অলঙ্কার কিছুটা নাম পালটে কিংবা সামান্য রূপ বদল করে বিশ শতকের গোড়াতেও দেখা গিয়েছিল৷ বাঙালীদের মধ্যে ‘মদনকড়ি’ ও ‘বীরবৌলী’ নামের দুটি ‘কর্ণাভরণের’ কথা শোনা যায়। এছাড়া ‘কানবালা’, ‘কানপাশা’, ‘কান’ – এ সবেতেই ‘মুঘল প্রভাব’ প্রত্যক্ষ করা যায়। ‘নাকের অলঙ্কার’ হিসেবে নতুনভাবে পাওয়া গিয়েছিল ‘নথ’, ‘বুলক’, ‘লটকান’, ‘লং’, ‘নোলক’ প্রভৃতি। প্রাচীন ভারতে সেগুলির কোনটাই ছিল না। পরবর্তীকালে ‘নথ’ ও ‘নোলক’ হয়ে দাঁড়িয়েছিল ‘আয়তির চিহ্ন’। ‘ফাদি নথ’ নাকি এতবড় আকারের হত যে সেটার ভেতর দিয়ে অনায়াসে ভাত খাওয়া যেত, গ্রাস তোলবার সময় ‘নথ’টিকে ‘টানা’ দিয়ে আটকে রাখতে হত না। বলা বাহুল্য সেই অলঙ্কার ছিল পরবর্তীকালের। তবে ‘মুঘল হারেমের’ কোন ছবিতে এত ‘বিশাল নথ’ চোখে পড়ে না। ‘নথ’ সবাই যে পরতেন তা নয়, ‘নবাবী আমলে’ স্বামীর সম্মান অনুযায়ী স্ত্রীর ‘নথ’ পরবার অধিকার জন্মাত। ‘শ্রীহট্টের’ ‘গৌররাম রৈ’ ছিলেন সম্পন্ন ‘বারুজীবী’, তিনি নিজের স্ত্রী-কন্যাকে ‘নথ’ পরাবার জন্যে অনুমতি চেয়েছিলেন আঠারো’শো শতকের মাঝামাঝি সময়ে। তারপর ১১৫৬ সালের ২২শে আষাঢ় তিনি পেয়েছিলেন তাঁর বহু ইপ্সিত প্রার্থনার উত্তর – তাঁর বাড়ির মেয়েদের পুরুষানুক্রমে ‘নথ’ পরবার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। এসব উদাহরণ দেখে গবেষকরা মনে করেন যে, অলঙ্কার ধারণের ওপর নানারকম বিধিনিষেধ ‘উচ্চবর্ণের সম্প্রদায়ের’ জন্য না হলেও ‘শ্রমিক সমাজের’ জন্য প্রচলিত ছিল। ‘রাজপরিবারের মেয়েরা’ ছাড়া অন্য কেউ পায়ে ‘সোনার নূপুর’ বা অন্য গয়না পরতে পারতেন না। ‘ব্রহ্মানন্দ’ ‘কেশবচন্দ্র সেনের’ তিন কন্যার বিবাহ হয়েছিল রাজপরিবারে – তাঁরা যখন ‘সোনার নূপুর’ পরে বসতেন তখন তাঁদের, বিশেষ করে তাঁদের ‘নূপুর’ পরা পা দু’খানি দেখবার জন্যে মেয়েরা ভিড় করতেন। ‘মুকুট’ পরা সম্বন্ধেও সেই ধরনের বিধি-নিষেধ ছিল। সেই নিয়ম ছিল বিবাহিতা ও অবিবাহিতা নারীর অলঙ্কারের ক্ষেত্রেও, কোথাও ‘মঙ্গলসূত্র’, কোথাও ‘টিকলি’, তো কোথাও ‘নোলক’ বা ‘নাকছাবি’ – এগুলো সবই ছিল ‘সধবার চিহ্ন’। ‘আঠারো’শো শতকের বঙ্গদেশে কতরকমের ‘নাকের গয়না’ পাওয়া যেত সেটা জানতে ইচ্ছে হলে ‘মঙ্গলকাব্যের’ পাতায় উঁকি মেরে দেখতে হবে। মেয়েরা ‘বাপের বাড়ি’ এসে পুরনো গয়না ভেঙে নতুন গয়না গড়াতেন। ‘দুর্গা’ও ‘কৈলাসে’ গিয়ে ‘নথ’ ভেঙে ‘নাকচনা’ গড়াচ্ছেন – ‘মঙ্গলকাব্যে’ এই দৃশ্য দুর্লভ নয়। সেগুলোর নামও ছিল নানারকম – ‘মাক্কি’, ‘বেশর’, ‘পিপলিপাত’, ‘ডাইলিবালি’, ‘চমকিবালি’, ‘ঝিলকিবালি’, ‘আন্নিবালি’, ‘চুন্নিবালি’, ‘ডালবোলাক’, ‘চানবোলাক’, ‘হীরাকাট বোলাক’। ‘নাকছাবি’ও ছিল নানারকমের – ‘ডালিমফুল’, ‘লবঙ্গ’, ‘বড়ইফুল’, ‘চালতাফুল’, ‘দামালকাট’ – সবই নকশা অনুযায়ী নাম। সেই আমলে ‘দাঁতের অলঙ্কার’ হিসেবে ‘রখন’ অভিনবত্ব এনেছিল। ‘সোনা বাঁধানো দাঁতের’ চল ছিল একসময়। ‘গলায় হার’, ‘মালা’, ‘লহর’ বা ‘মুক্তোর ছড়া’ পরার চল্ ছিল ‘হিন্দু আমলে’। অল্পবিস্তর সব ভারত-ললনাই ‘কণ্ঠাভরণ’ ব্যবহার করতেন। সেগুলোর নতুন নামকরণ হলেও ‘চম্পাকলি’, ‘হাম্বুলি’, ‘ইতরাদন’, ‘গুলবন্ধ’, ‘কান্দি’, ‘মোহরণ’, ‘হাউলদিল’ – এগুলো সবই ছিল আগে থেকেই। ‘মুঘল হারেমে’ ‘আঁটসাট গলাবন্ধ জামা’ পরার চল্ ছিল, সেখানে সুযোগ ছিল না বিশেষ কোন ‘হার’ পরার, তবুও সেখানে ‘মুক্তোর মালা’, ‘চিক’ ও ‘গুলবন্ধের’ ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। ‘হাতের গয়না’ সম্বন্ধেও একই কথা বলা চলে। ‘বাজুবন্ধ’, ‘জৌসান’, ‘তাবিজ’, ‘অনন্ত’, ‘বাউটি’, ‘ভাওটা’, ‘জশমবাঁক’ এগুলো সবই ছিল নতুন ও পুরনো মেশানো ‘হস্তাভরণ’। সেই যুগের বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য দুটি অলঙ্কার হচ্ছে ‘মানতাসা’ ও ‘রতনচূড়’। ‘হিন্দুযুগের ভাস্কর্যে’ সে দুটির দেখা পাওয়া যায় না। ‘মানতাসা’য় ছিল ‘যুদ্ধক্ষেত্রের কবচের স্মৃতি’, অনেক সোনা দিয়ে তৈরি করা সেই অলঙ্কারে সুক্ষ্মতার অভাব ছিল এবং সেজন্যই সেটি হিন্দু নারীদের পছন্দসই অলঙ্কার হয়ে ওঠেনি। প্রাচীনযুগের নারীরা নিচের হাতে কোন আঁটসাট অলঙ্কার’ পরতেন না – ‘চুড়ি’, ‘বালা’ ও ‘কঙ্কণ’ই ছিল প্রধান আভরণ। ‘মানতাসা’, ‘চূড়’, ‘ব্রেসলেট’, ‘রিস্টলেট’, ‘চেন’, ‘ব্যাঙ্গেল’ সবই এসেছিল পরে; তবে ‘চূড় বালা’ – ‘কঙ্কণের’ মতোই অলঙ্কার, ‘খিল দেওয়া চূড়’ বা ‘চূড়ের মতো গয়নার’ চল্ কবে থেকে হয়েছিল সেটা জানা যায়না। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে ‘কুলুপিয়া’ শঙ্খের উল্লেখ পাওয়া যায়। ‘রতনচূড়’ পরা হত (আজও অনেকে পরেন) ‘হাত ও হাতের পাঁচ আঙল মিলিয়ে’। খুব সুন্দর অলঙ্কার। ‘বাঈজীদেব অলঙ্কার’ হিসেবে সেটি সুপরিচিত ছিল, নিশ্চিত করে বলা না গেলেও গবেষকরা মনে করেন যে, সেটিতে ‘রাজপুত ঘরানার ছাপ’ রয়েছে। ‘মুঘলযুগের অলঙ্কারে’ ‘রাজস্থান’ ও ‘গুজরাটের’ মহিলাদের অলঙ্কারের প্রভাব সবচেয়ে বেশি লক্ষ্য করা গিয়েছিল। আবার তাঁরাই মুঘল অলঙ্কারের অনুকরণ করেছিলেন অন্যদের চেয়ে বেশি, তাই তাঁদের ‘শিল্পরুচি’ অভিন্ন ছিল বলে মনে হতে পারে। আসলে ‘রাজ অন্তঃপুরের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য’ তাঁদের মধ্যে ছিল, কারণ ‘রাজপুত-ললনারা’ ‘মুঘল হারেমে’ ‘বেগম’ হয়ে প্রবেশ করতেন। অপরদিকে ‘বেগম’ ও ‘শাহজাদীদের’ সাজ ছিল সম্ভ্রান্তবংশীয়া বধূ-বিবিদের অনুকরণীয়। এখন যেমন, তখনও তেমনি তাঁরা উন্মুখ আগ্রহে প্রতীক্ষা করতেন ‘হারেমের’ ‘ফ্যাশান’ বা নতুন সাজপোশাক কি আসছে তা জানবার জন্যে এবং সেটাই হয়ে যেত তাঁদের সমকালীন সাজ। দূরের দেশগুলিতে সবসময় সেটা সম্ভব হত না। ‘প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা’ না থাকায় তাঁদের ‘কল্পনার আশ্রয়’ নিতে হত। অর্থাৎ মূল গয়নাটি তৈরি হত ঠিকই কিন্তু তাতে যুক্ত হত সেই দেশের শিল্পীদের পরিচিত কোন নকশা। পোশাকের ক্ষেত্রেও সেটাই ঘটত। ‘শালে’ ছিল না ‘ধানের ছড়ার নকশা’, ‘বালুচরী শাড়ি’র লতাপাতায় কোনদিন ফোটেনি ‘চিনার পাতার আদল’। ‘মুঘল হারেমে’ কি ‘রাজপুত রাওলা’য় ছিল না ‘মাছের আদলে গড়া কানফুল’ কি ‘শাড়ির পাড়ে শাঁখের নকশা’। ‘দক্ষিণ ভারতে’ ছিল ‘গোপুরমের’ মতো মাথা উঁচু করা নকশা, ‘শিকারের নকশা’ এসে কোনদিন ছায়া ফেলেনি সেখানে। ‘আংটি’ পরার অভ্যাস যে প্রাচীন ভারতে ছিল সেটা ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলম্‌’ পড়েই বোঝা যায়। শুধু তাই নয়, রাজার ‘আংটি’ অনেক সময় ‘অভিজ্ঞান’ হিসেবে ব্যবহৃত হত। ‘মুঘলযুগে’ ‘আরশি’ আর ‘ছল্লা’ ‘আঙুলের অলঙ্কার’ হিসেবে পরিচিত ছিল। সেগুলো ছিল একটু বড় আকারের আংটি এবং পরা হত ‘তর্জনীতে। সাধারণতঃ মহিলারা কেউই গয়না হিসেবে ‘তর্জনী’ বা ‘অঙ্গুষ্ঠে’ ‘আংটি’ পরেন না, পরেন বাকি তিন আঙুলে, বিশেষ করে ‘অনামিকা’য়। ‘বেলুরের মদনিকার অঙ্গুষ্ঠে’ কিংবা ‘ভুবনেশ্বরের নায়িকার তর্জনী’তে ‘আংটি’ রয়েছে বলে দেখা যায়, তবে তাঁদের সংখ্যা বেশি নয়। ‘আরশি’তে মুখ দেখাও চলত; অনেক সময় আংটির পাথরের নিচে লুকোনো থাকত ‘উগ্র বিষ’, পান করে মৃত্যুবরণ করবার জন্যে। বলা বাহুল্য সেসব আয়োজন ছিল রাজা ও রাজপরিবারের জন্যে। সাধারণ মানুষের তো হঠাৎ আত্মহত্যা করবার দরকার পড়ত না, তাই তাঁদের নাগালের বাইরেই থাকত সেসব ‘আংটি’। কোমর থেকে পা পর্যন্ত খুব বেশি গয়না পরবার অবকাশ ছিল না বলে ভারতীয় নারীরা সেই অংশ পোশাকে আবৃত করে রাখতে ভালবাসে, আর দেখা না গেলে গয়না পরে লাভ কি! মজার ব্যাপার এই যে, ‘নবাবী আমলে’ ‘হারেমে’ আবার ‘দেখা-গয়না’ পরার ভারী নিন্দে ছিল। অর্থাৎ গয়না পরা হবে, অথচ দেখা যাবে না – তা কি করে হয়? সম্ভ্রান্ত পরিবারের নারীরা হাতে-বাহুতে গয়না পরে তার ওপরে ‘মসলিনের পটি’ জড়িয়ে রাখতেন। স্বচ্ছ ‘মসলিনের’ ভেতর থেকে দেখা যেত অলঙ্কারের দ্যুতি। সরাসরি গয়না পরতেন ‘নর্তকী’ এবং ‘গায়িকা’ অর্থাৎ ‘পেশাদার বাঈজীরা’। যাঁরা পুরো হাত ঢাকা জামা পরতেন তাঁদের হাতের কিছুটা অংশ কেটে সেখানে ‘মসলিনের টুকরো’ কিংবা পরবর্তীকালে ‘নেট’ লাগানো হয়েছিল। কোমরে পরার জন্যে মধ্যযুগে এসেছিল ‘পাহজেব’, ‘বঞ্জর’, ‘জিঞ্জির’ ও ‘ঘুংরু’। আগেকার ‘মেখলা’, ‘চন্দ্রহার’ ও ‘কিঙ্কিণী’ই নাম বদল করেছিল বলা চলে। পায়ে ‘মল’, ‘ছানলা’, ‘চুটকি’ এসব তো ছিলই। নিম্নমধ্যবিত্তরা ব্যবহার করতেন কোমরে ‘গোটহার’ ও ‘নিমফল’ – এগুলো কিছুদিন আগেও ছিল। এছাড়া ‘মুঘল শাহজাদী’ অর্থাৎ ‘রাজকুমারীরা’ ব্যবহার করতেন ‘মুক্তোর জালের চাদর’। ‘ওড়না’র মতো সেই ‘মুক্তোর চাদর’ তাঁদের দুই কাঁধের দু’পাশে ঝুলত। লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য যা, তা ছিল, সেই পর্বে গয়না ও সাজসজ্জায় অতিরিক্ত আড়ম্বর। সৌন্দর্য নয়, ‘সংখ্যাধিক্য’ই যেন লক্ষ্য ছিল। এর রেশ ছিল আধুনিক যুগের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত।

কিন্তু ‘নূরজাহান’ সেই ‘সংখ্যাধিক্যে’ বিশ্বাসী ছিলেন বলে মনে হয় না। ‘বার্ণিয়েরের’ বর্ণনা থেকে জানা যায়, ‘মুঘল হারেমের পোশাক’ এতটাই সূক্ষ্ম হত যে, কোন কোন পোশাক একরাত্রির বেশি ব্যবহার করা যেত না। সেই পোশাকে থাকত ‘সোনার ঝালর’, ‘সূক্ষ্ম নকশা’, ‘রেশমের ফুল’, ‘জরির কাজ’ – ‘নূরজাহান’ নিজে আবিষ্কার করেছিলেন অনেক ‘নকশা’, ‘কিনারি’ বা ‘লেস’। শোনা কথা, অন্যান্য অনেক জিনিসের মতো ‘বোতামের’ আবিষ্কর্ত্রী ছিলেন তিনিই। গল্পটি হল, ‘নূরজাহান’ একদিন রাজদরবারে যাবেন, মুঘল মহিষীদের মধ্যে একমাত্র তিনিই রাজসভায় যেতেন বলে জানা যায়, দরবারে যাবার উপযুক্ত বেশবাস সম্পূর্ণ হবার পর দেখা গিয়েছিল তাঁর পোশাকের এক জায়গায় ফিতে বসাতে ভুলে গিয়েছিলেন দর্জি। কী হবে? দর্জির বুঝি গর্দান যায়! তখন সম্রাজ্ঞীর এক প্রত্যুৎপন্নমতি পরিচারিকা নিজের কান থেকে ‘সোনার ঝুমকো’ দেওয়া ‘কুণ্ডল’টি খুলে সেটি দিয়ে আটকে দিয়েছিলেন জামার দুটি প্রান্তভাগ। মুগ্ধ হয়েছিলেন ‘নূরজাহান’। আদেশ দিয়েছিলেন, তাঁর সব পোশাকে ‘ফিতে’ বা ‘পটি’র বদলে সেই নতুন জিনিসটি লাগানো হবে, আর যে পরিচারিকার কল্পনা থেকে সেটি উদ্ভূত হয়েছিল তাঁকে তিনি শুধু ‘পারিতোষিক’ই দেননি, তাঁর নামেই সেটির নাম হয়েছিল ‘বাট্টান’। এখন এটিকে নিছক গল্প বলে মনে হলেও মনে রাখতে হবে ‘নূরজাহান’ এজাতীয় অনেক কিছু আবিষ্কার করেছিলেন। ‘প্রসাধন সামগ্রী’ হিসেবে তাঁর অসামান্য আবিষ্কার হল ‘আতর’। ‘প্রসাধনের’ ক্ষেত্রে ‘মুঘল-রমণীরা’ ‘হিন্দুদের প্রসাধন’ ব্যবহার করতেন না। ‘কাজলের’ বদলে তাঁরা চোখে পরতেন ‘সুরমা’, ‘আলতা’র বদলে পরতেন ‘মেহেদি’। তবে শুধু পায়ে নয়, নিজেদের হাত দু’খানিতেও তাঁরা ‘মেহেদির পাতা’ দিয়ে নানারকম নকশা আঁকতেন। দরিদ্র মেয়েরা ‘রতনচূড়’ পরতে পারতেন না, তাঁরা হাতের ওপরদিকেও নানারকম নকশা এঁকে ‘রতনচূড়ের’ অভাব দূর করতেন। আরো দরিদ্র গ্রামবাসীরা গয়নার বদলে হাতে-গলায় গয়না পরবার জায়গায় ‘উলকি’ দিয়ে আঁকিয়ে নিতেন গয়নার নকশা। বিহারের গ্রামাঞ্চলে এখনও এ দৃশ্য দুর্লভ নয়। অপরদিকে সম্ভ্রান্ত পরিবারে, বিশেষতঃ বঙ্গদেশে, নারীদের ‘উলকি’ পরা নিষিদ্ধ ছিল বলা চলে। ‘মুঘল সাজপোশাকের’ সঙ্গে ‘দাক্ষিণাত্যের বিজাপুর রাজ্যের’ মেয়েদের সাজপোশাকেরও মিল ছিল। তাঁরা পরতেন ‘পিরান’, ‘দোপাট্টা’ ও ‘পাজামা’, তবে তাঁরা ‘মুকুট’ পরতেন না। ‘মুসলমান সমাজে’ ‘খোঁপা’ বাঁধারও চল্ ছিল না, তাঁরা ‘লম্বা বেণী’ বাঁধতেন ‘মুক্তোর গুছি’ দিয়ে৷ তাঁরা ‘টিপ’ পরতেন না, তাঁদের কপালে থাকত নানারকম অলঙ্কার৷ ‘বুঁদি’র রাজপরিবারের মেয়েরাও পরতেন ‘পিরান’, ‘পাজামা’, ‘পটকা’ ও ‘দোপাট্টা’; মাথায় পরতেন ‘লম্বা টুপি’। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যেটি বেশি চলত তা হল – ‘ঘাগরা’, ‘চোলি’ ও ‘ওড়না’। ‘পাহাড়ী চিত্রে’ এর প্রাধান্য চোখে পড়বেই। তাঁদের ‘ঘাগরা’র ঘের ছিল বেশি, প্রায় মাটি-ছোঁয়া ৷ তাঁদের ‘ওড়না’ও ছিল বিশাল, মাথা ও বুক ছাড়িয়েও পেছনে থাকত পর্যাপ্ত অংশ। ‘কাংড়া চিত্রে’ও সেই পোশাকের প্রাধান্য দেখা যায়৷ কোন কোন ছবিতে দেখা যায় ‘ওড়না’র একপ্রান্ত কোমরে গোঁজা। তার ফলে ‘ঘাগরা’ও ঢেকে গিয়েছিল ‘ওড়না’য়। অনেক গবেষকের মতে, আধুনিক যুগে ভারতীয় নারীর সবচেয়ে প্রিয় পরিচ্ছদ ‘শাড়ি’ জন্ম নিয়েছিল সেই ‘ওড়না’ থেকেই। ‘হিন্দুযুগে’ ‘চাদর’ ব্যবহারের কোন বাধ্যবাধকতা ছিল না। বধূ ছাড়া কাউকে ‘ঘোমটা’ টানতে হত বলেও কোথাও দেখা যায় না। তাই নানারকম ‘খোঁপা’ বাঁধার চল্ ছিল পুরোমাত্রায়। ‘মুঘল আমলে’, যদিও ‘পারস্যে’ ‘ওড়না’র প্রচলন হয়েছিল কিনা – সেই বিষয়ে কিছু জানা যায় না, তবে ‘অবগুণ্ঠন’ নারীর জন্য অত্যাবশ্যকীয় হয়ে উঠেছিল। সেই ‘ওড়না’ ছিল খুব ছোট, শুধু মাথা-মুখ ঢাকা দেবার জন্যে, ‘বোরখার ঝরোকা’র মতো। ভারতে সেই ছোট্ট ‘ওড়না’টি রূপ বদল করতে শুরু করেছিল এদেশের ‘চাদরের’ অনুকরণে। ‘রাজস্থানে’ ‘ওড়না’ নিয়ে বেশ কড়াকড়ি ছিল এবং সেই সময় থেকেই মেয়েরা ধীরে ধীরে ‘অন্তরালবর্তিনী’ হতে শুরু করেছিলেন। ‘মুসলিম কন্যাদের’ বাইরে বেরোতে হলে ‘বোরখা’ পরতে হত। হিন্দু মেয়েরা টানতেন দীর্ঘ ‘ঘোমটা’, যদিও তাঁরা ক্রমেই লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যেতে শুরু করেছিলেন। হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়েরই সম্ভ্রান্ত পরিবারে ‘বালিকা বধূ’ একবার দীর্ঘ ‘ঘোমটা’ টেনে পিত্রালয়ের গণ্ডি পার হয়ে সেই যে শ্বশুরবাড়িতে প্রবেশ করতেন আর কখনও সে বাড়ির চৌকাটের ওপারে পা রাখতেন না। ‘লক্ষ্মণের অদৃশ্য গণ্ডি’ টানা হয়ে যেত তাঁদের চারপাশে। এর মূলে কী ছিল? লজ্জা? না, শত্রুর হাত থেকে আত্মরক্ষার কৌশল? ‘আসামের শিবসাগর অঞ্চলে’ ‘আহোম রাজাদের’ বাসস্থান হিসেবে যে ‘গড়গাঁও কারেং’ তৈরি হয়েছিল, সেখানে আলো-হাওয়া যুক্ত সুন্দর ঘরগুলিতে থাকতেন ‘রাজবাড়ির পরিচারিকা’ ‘লিগড়ি দাসীরা’, আর রানী ও রাজপরিবারের কন্যা ও বধূরা থাকতেন মাটির নিচের অপেক্ষাকৃত আলো-বাতাসহীন ঘরগুলিতে। কারণ? শত্রু আক্রমণ করলে এবং রাজবাড়িতে প্রবেশ করলে তাঁরা ‘সুসজ্জিতা দাসীদের’ সুসজ্জিত ঘর থেকে রানী ভেবে ধরে নিয়ে যাবে। ওদিকে নিচে, সাধারণ পোশাকে লুক্কায়িতা রানী রক্ষা পাবেন দুর্বৃত্তদের হাত থেকে। কম বেশি সেই মনোভাব থেকেই সম্ভবতঃ এদেশে ‘পর্দা’র উৎপত্তি ঘটেছিল। অনেক গবেষক মনে করেন যে, ‘শাড়ির আবিষ্কর্ত্রী’ ছিলেন দরিদ্র নারীরা। ধনী হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে যখন তিনটি করে পোশাক পরতেন – ‘ঘাগরা’, ‘কাঁচুলি ও ওড়না এবং পিরান’, ‘পাজামা ও দোপাট্টা’; তখন গরীব মানুষেরা নিরুপায় হয়েই একখানি কাপড়ে নিজেদের সর্বাঙ্গ আবৃত করতে শুরু করেছিলেন। সেই কাপড়টি প্রথমে ছিল ‘ওড়না’, পরে রূপান্তরিত হয়েছিল ‘শাড়ি’তে। ‘ওড়না’ যখন বড় হতে শুরু করেছিল তখন অন্য দুটি অর্থাৎ ‘ঘাগরা’, ‘কাঁচুলি’ পর্যবসিত হয়েছিল ‘সায়া’ ও ‘ব্লাউজে’। সেটা অবশ্য অনেক পরের কথা, অনেক জল ঘোলা হয়ে যাবার পরের ঘটনা। দীর্ঘদিন ধরে এক বস্ত্রই ছিল সাধারণ ঘরের মেয়েদের একমাত্র পোশাক৷ সেই বস্ত্ৰই হচ্ছে ‘শাটি’ বা ‘শাড়ি’ বা ‘ধুতি’। ‘ধুতি’ শুধু পুরুষেরা পরতেন না – মেয়েরাও পরতেন অভাবের দিনে। ‘শ্রীমতী লিওনাউস’ এক হিন্দু বধুর সাজও দেখেছিলেন এবং মুগ্ধ হয়েছিলেন একখানি শাড়িকে অপূর্ব ভঙ্গিতে সর্বাঙ্গে জড়িয়ে আবার সেই ‘শাড়ির আঁচল’ দিয়েই ‘ঘোমটা’ টানা দেখে। তাঁর মনে হয়েছিল সেই সাজটি নারীকে শুধু যে নতুন ব্যক্তিত্ব দেয় তা নয়, তাতেই ভারতীয় চারিত্র-বৈশিষ্ট্য সবচেয়ে বেশি প্রকাশ পায় ৷

আরো পড়ুন- সেকালের কলকাতার বসন্তোৎসব

তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, ভারতীয় নারীর সাজসজ্জার ক্রমবিবর্তনের মধ্যে ‘পরিবর্তন’ থাকলেও তার মধ্যে ‘সম্পূর্ণ বৈপরীত্য’ কখনও ছিল না। সেই ‘সূক্ষ্ম বস্ত্র’, সেই ‘মনোরম নকশা ও রঙ’, সেইসব ‘নয়নমোহন অলঙ্কার’ এবং ‘প্রসাধন’ – ‘প্রাচীনযুগে’ও যা ছিল, ‘মুসলমান শাসকদের’ সময়েও তা একেবারে বর্জিত হয়নি। বরং বদলেছিল ‘বিদেশিনীদের পরিচ্ছদ’ – তাঁরা যা এনেছিলেন ‘পারস্য’ থেকে, সেই ‘পারসীক পোশাক’ আবার প্রভাবিত হয়েছিল ‘চীন’ থেকে আসা বস্ত্রের প্রভাবে। ‘চীনা সিল্কের বয়নরীতি’তে মিশে গিয়েছিল ‘পারসীক নকশা’ – ভারতে সবই এসেছিল। আগেও আসত, তবে এতটা ব্যাপকভাবে নয়। নবাগত শাসকরা তাঁদের নিজস্ব পোশাক বলে সেগুলিকে কিছুদিন সযত্নে ব্যবহার করেছিলেন, ‘আমীর-ওমরাহ’, ‘রাজা-উজির’রা অনুকরণ করবার জন্যে সেগুলো নিয়ে গিয়েছিলেন নিজেদের অন্তঃপুরে এবং ভারতীয় পোশাকের সঙ্গে সেগুলো কিভাবে মিলেমিশে গিয়েছিল তা তাঁরা নিজেরাও বুঝতে পারেননি। ভারতীয় পোশাকের আর একটি বৈশিষ্ট্য ছিল লক্ষ্য করবার মতো। সব সময়ই যে কোন পোশাকের ‘সৌন্দর্য এবং সৌকর্য’-গুণটি সে নিজের পোশাকের সঙ্গে মিশিয়ে দিতে পারত। যা অন্য কোন দেশের পোশাকের মধ্যে নেই। যা ছিল শুধু ‘আচ্ছাদন’, ভারতে এসে তা হয়ে উঠেছিল ‘রমণীয়’, ‘সুন্দর’ ও ‘আরামপ্রদ’। এই তিনটি গুণ যে ভারতীয় পোশাকে নেই, সে পোশাক এখানে স্থায়ীভাবে থাকতে পায়নি, ‘ফ্যাশানের’ মতো এসেছে, আবার চলেও গেছে। ‘শ্রীমতী লিওনাউস’ আরো একটি জিনিস লক্ষ্য করেছিলেন, সেটি হল ‘ভারতীয় নারীদের রঙ নির্বাচনের আশ্চর্য ক্ষমতা’ এবং সেই ক্ষমতা বিশেষভাবে দেখা যেত ‘হিন্দু নারীদের নিজস্ব নির্বাচনে’। তাঁর মতে, নিতান্ত সাদাসিধে মেয়েরাও ‘বর্ণ বৈচিত্র্য’ সম্বন্ধে নিখুঁত জ্ঞানের পরিচয় দিয়েছিলেন এবং তার ফলে তাঁরা নিজেদের সাজপোশাকের মধ্যে একটি ‘Perfect harmony’ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

(তথ্যসূত্র:
১- Indian dress: A brief history, Charles Louis Fabri, Orient Longman.
২- Dress and ornaments in ancient India, Indu Prabha Pandey, Bharatiya Vidya Prakashan.)

সেকালের কলকাতার বসন্তোৎসব

রানা চক্রবর্তীঃ কলকাতার বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায় যে, অতীতের কলকাতা শহরে বসবাসকারী বিভিন্ন প্রদেশের ও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ দোল উৎসবকে একটি উচ্ছৃঙ্খল আমোদে পরিণত করে তুলেছিলেন। কিন্তু পরিবেশ, রুচি ও শিক্ষা সংস্কৃতির সমন্বয়ে তখনকার দোল উৎসবটি কেমন মনোরম ও শিল্পশ্রীমণ্ডিত হয়ে উঠেছিল, সেকথা জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবারের তিন প্রজন্মের স্মৃতিচারণে খুব স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এই প্রসঙ্গে ‘অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর’ অনেক কথা জানিয়েছিলেন। দোলের আমোদে-প্রমোদে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির সেদিনগুলো বড়ই আনন্দের দিন ছিল। তখন ঠাকুরবাড়ির বন্ধুবান্ধবেরা দোল উপলক্ষ্যে সেখানে এসে মিলিত হতেন। অক্ষয়বাবুর তানপুরা বাজানো সকলে মুগ্ধ হয়ে শুনতেন। শুধুই কী তানপুরা বাজানো আর সংগীত পরিবেশনেই ওই সময়ের ঠাকুরবাড়ির দোলের আনন্দ মিটে যেত, মোটেই তা নয়! একই সাথে আরো মনোহর আয়োজনও করা হত। এমনকি নৃত্যগীতি পরিবেশনের জন্য তখন বাইরে থেকে ‘নাচিয়ে’ও সেখানে আসতেন। প্রিন্স দ্বারকানাথের কাল ততদিনে অস্তমিত হয়েছিল; তাঁর বিলাসী-জীবন তখন প্রায় গল্পকথা হয়ে গেলেও, ঠাকুরবাড়ির দোলের আমোদে কিন্তু কোন ভাটা পড়েনি। অবনীন্দ্রনাথ তাঁর ‘জোড়াসাঁকোর ধারে’ গ্রন্থে পিতা ‘গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুরের’ কথা বলেছিলেন। শিল্পী মনের মানুষ গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুরবাড়ির দোল উৎসবকে মনোরম ও সৌন্দর্যমণ্ডিত করে তুলেছিলেন। অবনীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “দোতলায় বাবামশায়ের বৈঠকখানায় হোলি উৎসব হত। সেখানে যাবার হুকুম ছিল না। উঁকিঝুঁকি মারতুম, এদিক ওদিক থেকে। আধহাত উঁচু আবীরের ফরাস। তার উপর পাতলা কাপড় বিছানো। তলা থেকে লাল আভা ফুটে বের হচ্ছে। বন্ধুবান্ধব এসেছেন অনেক …। ঘরে ফুলের ছড়াছড়ি। বাবামশায়ের সামনে গোলাপ জলের পিচকারি। কাঁচের গড়গড়া, তাতে গোলাপ জলে গোলাপের পাপড়ি মেশানো। নলে টান দিলেই জলে পাপড়িগুলো ওঠানামা করে। সেবার এক নাচিয়ে এল। ঘরের মধ্যে নন্দ ফরাস এনে রাখল মস্ত বড় আলোর ডুম। নাচিয়ে ডুমটি ঘুরে ঘুরে নেচে গেল। নাচ শেষ হলে দেখা গেল পায়ের তলায় একটি আলপনার পদ্ম আঁকা। … অদ্ভুত সে নাচ!” তবে সেই আনন্দযজ্ঞে সবার নিমন্ত্রণ ছিল না। ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধবদের মাঝে বসে, খানিক আভিজাত্যের গরিমায় গুণেন্দ্রনাথ তারিয়ে তারিয়ে সেই আনন্দ উপভোগ করতেন। ৬নং জোড়াসাঁকোর বাড়িতে ‘দেবেন্দ্রনাথ’ ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করবার পরে হিন্দুধর্মের পৌত্তলিক অনুষ্ঠানাদি বর্জন করলেও – জামাইষষ্ঠী, ভাইফোঁটা, দোল প্রভৃতি অনুষ্ঠান ও লোকাচার বজায় রেখেছিলেন। তাই ৬নং বাড়িতেও দোল খেলা হত। অবনীন্দ্রনাথ তাঁর ছোট বয়সে নিজেদের দোল খেলার কথা বলতে গিয়ে লিখেছিলেন, “আমাদের জন্য আসত টিনের পিচকারি৷ … বালতি ভরা লাল জলে ডুবিয়ে যাকে সামনে পাচ্ছি পিচকারি দিয়ে রঙ ছিটিয়ে দিচ্ছি। আর তাঁরা চেঁচামেচি করে উঠছে। দেখে আমাদের ফূর্তি কি।” এরপরে তিনি আরো লিখেছিলেন, “দোলের দিনে আবির নিয়ে এ বাড়ি (৫নং) ও বাড়ি (৬নং) অন্দরে ঢুকে বড়দের পায়ে দিতুম, ছোটদের মাথায় মাখাতুম।” দোলের দিন ঠাকুরবাড়ির ছোটদের আনন্দলাভের মধ্যে যে নির্মলতা ছিল, বড়দের ক্ষেত্রে অবশ্য সেটার ঘাটতি থেকে যেত। তবে সেদিন ঠাকুরবাড়ির দেউড়িতে অন্য ছবি দেখতে পাওয়া যেত। সেখানে আনন্দ বিতরণের দেদার ব্যবস্থা করা হত; ঢোল বাজত, গানের সঙ্গে নাচও হত। এমনকি ‘রাজপুতানী’ নিয়ে এসে কোথাও নাচের আসরও বসানো হত, এবং সেই আসরে ছোটদেরও অবাধ প্রবেশাধিকার ছিল। দোলের দিন ঠাকুরবাড়ির আনন্দকে আরো বাড়িয়ে তোলার জন্যই প্রকাণ্ড একটা পাত্রে সিদ্ধি গোলা হত। দেউড়ির দিকে ঢোলের তালে তালে আবির উড়ত, আর মাঝে মাঝেই ‘হোরি হ্যায় হোরি হ্যায়’ বলে আনন্দোল্লাস শুনতে পাওয়া যেত। দোলের দিন ঠাকুরবাড়ির ছোটরা দারোয়ানদের একটুও ভয় পেত না। ফলে দোলের দিনে মনোহর সিংয়ের দাড়িতেও রং লেগে তাঁর ধপধপে সাদা দাড়ি রং বদল করে টকটকে লাল হয়ে উঠত। বাড়ির ছোটরা তাঁর কাছে গিয়ে দাড়িতে আবির মাখিয়ে দিত। দেউড়িতে দারোয়ানদের দোলোৎসবই অবনীন্দ্রনাথকে বেশি আকর্ষণ করত। তাঁর মনে হয়েছিল, “বৈঠকখানা আর দেউড়ির উৎসব, এ দুটোর মধ্যে আমার লাগত ভালো রাজপুত দারোয়ানদের উৎসবটাই। বৈঠকখানায় শখের দোল, শৌখিনতার চূড়ান্ত সেখানে লটকানে-ছোপানো গোলাপি চাদর, আতর, গোলাপ, নাচ, গান, আলো ফুলের ছড়াছড়ি। কিন্তু সত্যি দোল-উৎসব করত দারোয়ানরাই – উদ্দণ্ড উৎসব, সব লাল, চেনবার জো নেই। সিদ্ধি খেয়ে চোখ দুটো পর্যন্ত সবার লাল। দেখলেই মনে হত হোলিখেলা এদেরই। … বৈঠকখানার উৎসব ছিল কৃত্রিম, তাই তা ভালো লাগত না আমার।” পরবর্তীকালে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির সেই দোল যে রবীন্দ্র ভাবনায় শান্তিনিকেতনে নতুনতর ব্যাপ্তি পেয়েছিল, সেটা এখন আর কারো অজানা নয়। তাঁর লেখা “ওরে গৃহবাসী খোল দ্বার” – গানে গানে মানুষের মনের রুদ্ধ দরজা আনন্দ-হিল্লোলে আজও খুলে যায়। তবে সেটা অন্য প্রসঙ্গ। সেকালের ঠাকুরবাড়িতে দোলের আনন্দ বাড়ির সকলেই উপভোগ করতেন, তাঁরা যে যাঁর নিজের মতো করে আনন্দ খুঁজে নিতেন। ছোটরা সমবয়েসিদের রং দিতেন, বড়দের আবির দিতেন। বড়রা ‘শখের দোলে, শৌখিনতার চূড়ান্তে’ মেতে উঠতেন। বাড়ির মেয়ে-বউরাও সেই আনন্দ থেকে বঞ্চিত হতেন না। তাঁরাও সানন্দে, সাড়ম্বরে সেই উৎসবে শামিল হতেন। তখন ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা দোলের দিন নিজেদের শুধু সাজিয়ে তুলতেন না, রাঙিয়ে তুলতেন। সকালের দিকে রঙে রঙে রঞ্জিত হয়ে সেই রং ধুয়েমুছে সাফ করে বিকেলে তাঁরা নতুন করে সেজে উঠতেন। তবে তখনকার ঠাকুরবাড়ির সব উৎসবে তাঁরা একই রকমভাবে নিজেদের সাজিয়ে তুলতেন না। তাঁদের সাজসজ্জায় যথেষ্ট বৈচিত্র ছিল। কারণ খালি সাজলেই তো হয় না, সেই সাজ পরিবেশ পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিয়ে উপযোগী হওয়ারও প্রয়োজন রয়েছে। সেকালের ঠাকুরবাড়ির দোল খেলা নিয়ে গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মেয়ে ‘পূর্ণিমা’ও অনেক কথা লিখেছিলেন। “দোলের দিন সকাল থেকে তোড়জোড় চলত। পিচকারি, রং আসছে। আগের দিন ঠাকুরের পুজোর চাঁচর হত। তার পরদিন বারটা অবধি আবির খেলা হত। বাগান, বাড়ি লাল হয়ে যেত। বোতল বোতল গোলাপ জল ঢেলে রং গোলা হত! আমাদের খেলার পর বাবা-কাকাদের খেলা শুরু হত। খেলা শেষ করে খেতে তিনটে চারটে বেজে যেত। পাড়ার এ বাড়ি ও বাড়ি থেকে অনেকেই আসতেন। … তারপর সন্ধ্যের সময় বসে গানবাজনা হত।” ‘দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের’ পৌত্র ‘সৌম্যেন্দ্রনাথ’ও সেকালের ঠাকুরবাড়ির দোলের কথা লিখতে গিয়ে বলেছিলেন, “আমরাও দোল খেলতুম প্রতি বৎসর। ও বাড়ির (৫নং) বাগানে লতা ঢাকা চায়ের ঘরে বসত আমাদের ছেলেদের আড্ডা। আমাদের বন্ধুরা এসে জুটতো। গাইতুম আমি হোলির গান আর আমার জ্যাঠতুতো ভাই নরেন্দ্র (গগনেন্দ্রনাথের ছেলে) নাচত। বাড়ির মধ্যে মেয়েরাও দোল খেলতেন।” রবীন্দ্রনাথের কনিষ্ঠা কন্যা ‘মীরা’ এবং সৌম্যেন্দ্রনাথের স্মৃতিতে অতীতের ঠাকুরবাড়ির একটি পারিবারিক দোল খেলার মধুর স্মৃতি চিরকাল উজ্জ্বল হয়ে ছিল। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী ‘জ্ঞানদানন্দিনী দেবী’, একবার জোড়াসাঁকো পরিবারের প্রায় সকলকেই তাঁদের স্টোর রোডের বিশাল বাড়িতে দোল খেলতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। এই প্রসঙ্গে মীরা লিখেছিলেন, “একবার দোলের দিন মেজমা (জ্ঞানদানন্দিনী) জোড়াসাঁকো বাড়ির সবাইকে দোল খেলতে নিমন্ত্রণ করেছিলেন। রং খেলা হয়ে গেলে সবাই গেলেন পুকুরে স্নান করতে। স্টোর রোডের বাড়িতে দুটো পুকুর ছিল। একটা পুকুর ছিল একটু পিছন দিকে। বউঠানরা এইখানে স্নান করবেন ঠিক করলেন। সেদিন বউঠানদের খুব আমোদ হয়েছিল। জোড়াসাঁকো বাড়িতে থাকেন তাঁরা, পুকুরে স্নানের এরকম সুযোগ পাবেন কেমন করে। স্নানের পর মেজমা ছেলেদের ও বউদের সবাইকে নতুন কাপড় দিলেন পরতে। একতলার একটা বড় ঘরে খাওয়ার আয়োজন করা হয়েছিল। সাদা পাথরের মেঝের উপর কলাপাতার বদলে দিয়েছিলেন বড় বড় পদ্মপাতা৷” সৌম্যেন্দ্রনাথও জ্ঞানদানন্দিনী আয়োজিত সেই বিশেষ দোলের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে লিখেছিলেন, “একবার মনে আছে আমার মেজদিদিমা জ্ঞানদানন্দিনীদেবী, সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী, ১৯নং স্টোর রোডের বাড়িতে দোল খেলবার নেমন্তন্ন করেছিলেন সবাইকে। সেবার তিনপুরুষের দোল খেলা হয়েছিল – ১৯নং স্টোর রোডের বিরাট বাগানে। মেজদাদা সত্যেন্দ্রনাথ, নতুনদাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, মেজদিদি জ্ঞানদানন্দিনী – এঁদের দল, তারপর বাবা কাকা কাকিদের দল আর আমাদের ভাইবোনদের দল।” অবনীন্দ্রনাথ জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবারে সেকালের দোল উপলক্ষে পুরুষদের একটি বিশেষ সাজের কথা বলেছিলেন – “লটকান ছোপান গোলাপি চাদর, আতর, গোলাপ।” তাঁর ভাগ্নি, বিনয়নীদেবীর কন্যা ‘প্রতিমা’ দোল পূর্ণিমায় সেকালের ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের বিশেষ সাজের কথা লিখতে গিয়ে বলেছিলেন, “দোল পূর্ণিমারও একটি সাজ ছিল। সে হল হালকা মসলিনের শাড়ি, ফুলের গয়না আর আতর গোলাপের গন্ধমাখা মালা। দোলের দিন সাদা মসলিন পরার উদ্দেশ্য ছিল যে আবিরের লাল রং – সাদা ফুরফুরে শাড়ির উপর রঙিন বুটি ছড়িয়ে দেবে।” তাঁর লেখা থেকে ওই সময়ের ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের সেই শ্রীমণ্ডিত সাজের কথার পরে আরও জানা যায় যে, তখন ঠাকুরবাড়ির পুরুষেরা – “সন্ধ্যেবেলা শান্তিপুরি ধুতি চাদর পরতেন।” এছাড়া তখন ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা গলায় মালা পরতেন, ও আতর ব্যবহার করতেন। তারপরে দোলপূর্ণিমার আকাশে যখন মস্ত বড় চাঁদটি নিজের রুপো-গলা আলোয় চারপাশকে প্লাবিত করে দিত, সেই জ্যোৎস্না আলোয় তাঁরা আরও সুন্দরী হয়ে উঠতেন। একবার ৫ ও ৬নং বাড়ির পুরুষেরা মিলে মহা আড়ম্বরে জোড়াসাঁকো বাড়ির বাগানে বসন্তোৎসবের আয়োজন করেছিলেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনীকার ‘বসন্তকুমার চট্টোপাধ্যায়’ জ্যোতিরিন্দ্রনাথের বয়ানেই সেকথা লিখেছিলেন – “একদিন এক বসন্ত সন্ধ্যায় সমস্ত উদ্যান বিবিধ রঙিন আলোকে আলোকিত হইয়া নন্দনকাননে পরিণত হইয়া উঠিল। পিচকারি, আবির, কুঙ্কুম প্রভৃতি প্রয়োজনীয় সমস্ত সরঞ্জাম উপস্থিত হইয়া গেল। খুব আবীর খেলা হইতে লাগিল, তারপর গান বাজনা, আমোদ-প্রমোদও কিছুমাত্র বাদ গেল না। ইহাতে অনেকগুলি টাকাও খরচ হইয়া গেল।”


সেকালের কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির বিশিষ্ট ব্যক্তিদের উপরোল্লিখিত বিবরণ থেকে এটা পরিষ্কার বুঝতে পারা যায় যে, পুরানো কলকাতায় দুর্গোৎসবের পরে যে উৎসবকে ঘিরে ব্যাপক আনন্দ ও হুল্লোড় হত, সেটা হল দোল বা বসন্তোৎসব। পুরানো কলকাতা সম্পর্কিত নানা গ্রন্থে, কিছু ব্যক্তিগত স্মৃতিচর্চায় সেই আমোদ-উল্লাসের ছবি আজও খুঁজে পাওয়া যায়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলের বাংলায় একটানা পাঁচদিন দোলের ছুটি থাকত। তখন কলকাতার দোলকে নিয়ে ছাতুবাবু-লাটুবাবুদের আনন্দ-ফুর্তির ব্যাপকতাকে সেই ছুটি-পরিসরই বুঝিয়ে দেয়। পুরানো কলকাতায় দোল-আনন্দে নাচ-গানের ব্যবস্থাও করা হত। সেটা ঘরোয়া পরিবেশে সাধারণ কোন নৃত্যগীতি ছিল না, দোল উপলক্ষ্যে তখন রীতিমতো বাঈনাচের আসর বসত। রংখেলাও প্রবল উৎসাহে হত। ওই সময়ে দোলের কথা ভেবে রং গোলার জন্য কলকাতার ধনীবাড়িগুলির ছাদে আগে থেকেই চৌবাচ্চাও তৈরী করা থাকত। তখন দোল খেলার জন্য গোলা-রঙে গাজিপুরের গোলাপজল মেশানো হত। তবে দোলের সেই আনন্দ-হুল্লোড়ে প্রায়শঃই বিশৃঙ্খলাও দেখা দিত। এমনকী চাবুকের আস্ফালন, নির্দয় রক্তপাত ইত্যাদিও বাদ পড়ত না। একবার পুরানো কলকাতার জমিদার চৌধুরি-বাড়িতে দোল খেলা দেখতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কয়েকজন মত্ত ইংরেজ কর্মচারী ঢুকে পড়েছিলেন। সেদিন সেখানে তাঁদের সেই অনধিকার প্রবেশ নিয়ে হুলুস্থুল কাণ্ড বেঁধে গিয়েছিল। জমিদার-কর্মচারীরা প্রবল প্রতাপে তাঁদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর ফলে হাতাহাতিতে রক্তও ঝরেছিল। সেই বার্তা পেয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে চাবুক উঁচিয়ে স্বয়ং জোব চার্নক সেখানে ছুটে এসেছিলেন। কথিত রয়েছে যে, সেদিন কবিয়াল এন্টনী ফিরিঙ্গীর পিতামহ, যিনি তখন চৌধুরিদের সেরেস্তায় কাজ করতেন, চার্নকের হাতে প্রহৃত হয়েছিলেন। পুরনো কলকাতার দোলোৎসবে ওই সব ঘটনা যেমন ঘটেছিল, তেমনই প্রীতিময় সৌহার্দ্যের পরিবেশ রচনার উদ্যোগও দেখতে পাওয়া গিয়েছিল। তখন দোল উপলক্ষ্যে আত্মীয়কুটুম্বের বাড়ি-বাড়ি তত্ত্ব পাঠানোর চল ছিল। আর সেই তত্ত্বে মঠ-ফুটকড়াই অপরিহার্য ছিল। তখন দোলে শুধু রং-আবির খেলা নয়, দোল-রাতে বাজিও পোড়ানো হত। দোল নিয়ে গানের রেকর্ডও বের হত। মঞ্চে মঞ্চে ‘দোললীলা’ অভিনীত হত। পুরানো কলকাতার বাবুদের বাড়িতে দোলের রকমারি আমোদপ্রমোদের মাঝে নাটক-যাত্রার আসরও বসত। এক কথায় বলতে গেলে, পুরনো কলকাতার দোল-চিত্র আমোদেপ্রমোদে বড়ই বৈচিত্রময় ছিল। কলকাতার ইতিহাস বলে যে ‘প্রিন্স দ্বারকানাথের ঠাকুর’ পরিবার বরাবরই স্বাতন্ত্র্যে উজ্জ্বল ছিল। শিক্ষায়-দীক্ষায় বৈভবে সেকালের কলকাতার অন্য দশটি পরিবারের সঙ্গে সেই পরিবার কখনওই তুলনীয় ছিল না। তখন দোলোৎসবকে ঘিরে বাংলার সমাজজীবনে যে উন্মাদনা দেখা দিয়েছিল, সেটার আঁচ কিন্তু জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতেও গিয়ে লেগেছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলার অন্যতম ধনাঢ্য ব্যক্তি হিসাবে সমাজে দ্বারকানাথের সম্ভ্রম ছিল। তাঁর আমলে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির দুর্গাপুজোর জাঁকজমক ঢের বেড়ে গিয়েছিল। অবশ্য জোড়াসাঁকোর দুর্গাপুজোর প্রবর্তক তিনি ছিলেন না, সেই ‘নীলমণি ঠাকুরের’ আমলেই সেখানে দুর্গাপুজো শুরু হয়েছিল; আর ব্রাহ্মধর্মাবলম্বী দেবেন্দ্রনাথের কালে জোড়াসাঁকোয় দুর্গাপুজো পাকাপাকিভাবে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের জন্মের বছর তিনেক আগেই ঠাকুরবাড়ির সমস্ত পুজো বন্ধ হয়ে গেলেও, পুজোর আনন্দ কিন্তু রবীন্দ্রনাথকেও প্রবলভাবে স্পর্শ করত। শুধু রবীন্দ্রনাথকে নয়, ঠাকুরবাড়ির সকলকেই স্পর্শ করত। ঠিক তেমনভাবেই দোলের আনন্দও ঠাকুরবাড়ির সকলকে স্পর্শ করেছিল। তাই ব্রাহ্ম পরিবার হলেও, ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হলেও, তাঁরা কোনদিনই নিজেদের দোলের আনন্দ থেকে কখনও দূরে সরিয়ে রাখেননি। একটু আগেই জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ‘জীবনস্মৃতি’ গ্রন্থ থেকে সেকালের ঠাকুরবাড়ির আনন্দ মুখরিত রং-আবিরময় একটি দিনের বর্ণনা তুলে ধরা হয়েছে। তখন বসন্তোৎসবকে সামনে রেখে ঠাকুরবাড়িতে নাটকও লেখা হয়েছিল। শুধু লেখাই নয়, সেই নাটক অভিনয়ের ব্যবস্থাও করা হয়েছিল। একবার ‘স্বর্ণকুমারী দেবী’ ‘বসন্ত উৎসব’ নামের একটি নাটক লিখেছিলেন, এবং জোড়াসাঁকোতে সেই নাটকের অভিনয়ও হয়েছিল। পরে সেই চল্লিশ পৃষ্ঠার ছোট্ট গীতিনাট্যটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছিল। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের উৎসাহ ও প্রেরণাতেই স্বর্ণকুমারী ‘বসন্ত উৎসব’ লিখেছিলেন। স্বর্ণকুমারী নিজেও সেই নাটকে অভিনয় করেছিলেন, এবং জ্যোতিরিন্দ্রনাথ তাতে নায়ক সেজেছিলেন। নাটকটির নায়িকা ‘লীলা’র ভূমিকায় ‘কাদম্বরী দেবী’ ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তখন বিলেতে থাকবার জন্য সেই নাটকটির অভিনয়ের সাক্ষী হতে পারেন নি। অবশ্য তারপরেও ‘বসন্ত উৎসব’ জোড়াসাঁকোয় অভিনীত হয়েছিল, এবং রবীন্দ্রনাথও তাতে অভিনয় করেছিলেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ‘বসন্ত উৎসব’ গীতিনাট্য রচনায় স্বর্ণকুমারীকে শুধু প্রাণিত করেননি, তিনি নিজেও সম্ভবতঃ প্রাণিত হয়েছিলেন। আর তাই তিনিও ‘বসন্তলীলা’ নামের একটি গীতিনাট্য লিখেছিলেন। রবীন্দ্রসাহিত্যে, বিশেষতঃ সংগীতে বহুবার ঋতুরাজ বসন্তের কথা এসেছে। ঠাকুরপরিবারের আরও কারো কারো রচনাকর্মেও বসন্তোৎসবের উল্লেখ পাওয়া যায়। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ‘বসন্ত লীলা’ লেখবার বছরখানেক আগে ‘পুনর্বসন্ত’ নামেও একটি গীতিনাট্য লিখেছিলেন। ‘পুনর্বসন্ত’-এ রয়েছে – “এসো এসো বসন্ত এ কাননে, আন কুহুতান প্রেম গান, / আন গন্ধমদ-ভরে অলস সমীরণ,/ আন নবযৌবন-হিল্লোল নবপ্রাণ,/ প্রফুল্ল নবীন বাসনা এ কাননে।” ‘বসন্তলীলা’র একটি গানে প্রকৃতির অনুষঙ্গে ‘হোরি’ খেলার যে শব্দ-ছবি রয়েছে, সেটা বড়ই জীবন্ত। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “(আজি) আইল বসন্ত, হিম-ঋতু অন্ত,/ প্রকৃতি আনন্দে৷/ তরুলতাগুলি, অলসে হেলিদুলি/ হরষে কোলাকুলি করিছে।/ কিশোরী সাথে হরি খেলিবে আজ হোরি,/ রঙ্গে ব্রজপুরী মাতিছে।” এভাবেই ঠাকুরবাড়ির সাহিত্যে বারবার মাধুর্যময় বসন্ত, বসন্তোৎসবের কথা ফুটে উঠেছিল।

ফাগুনের আগুন রঙে যখন প্রকৃতি রঙিন হয়ে ওঠে, ঠিক তখন বাঙালির মনেও রঙের ছোঁয়া লাগে। সেই রং আসলে উৎসবে, আনন্দে, আবেগে মেতে ওঠার এক উপলক্ষ মাত্র। তাই সেকাল থেকে একাল পর্যন্ত কলকাতার ‘দোল-বিলাস’ এখনও চালু রয়েছে। শুধু সময়টা বদলে গিয়েছে। অতীতের দোল বিলাসের কত না কাহিনী আজ কিংবদন্তী। এক কালে কলকাতার বাবুদের বিলাসিতার আরেক নাম ছিল হোলি খেলা। প্রাচীন কালের ‘মদনোৎসবের’ সঙ্গে মিল ছিল সেই দোল উৎসবের। ইতিহাসে কান পাতলে শোনা যায় দোলের বিচিত্র গল্পের কথা।
জোব চার্নক ১৬৮৬ সালে কলকাতায় এসেছিলেন। কিন্তু, বেশি দিন একটানা এখানে থাকতে পারেননি। পরে, ১৬৯০ সালের ঘোর বর্ষায় চার্নক যখন তৃতীয় বার এখানে এলেন, তখন কলকাতা এক গণ্ডগ্রাম। সেখানে না ছিল বাবু, না ছিল অভিজাত সমাজ। প্রাসাদোপম সেই সব বাড়িও ছিল না তখন। তাই নবাগত ইংরেজদের তখন ঠাঁই বলতে কখনও তাঁবু তো কখনও বা নৌকা। বেশ কিছু দিন থাকার পরে জীবনযাত্রায় একঘেয়েমি কাটাতে চার্নক এবং তাঁর সাঙ্গপাঙ্গরা চাইলেন নেটিভদের সঙ্গে মেলামেশা করতে। কিন্তু নেটিভরা সেই সময় তাঁদের পাত্তাও দিতেন না। প্রায় ৩২৫ বছর আগে এমনই এক বসন্তে, কয়েক জন ফিরিঙ্গি ছোকরা গ্রামের ভেতরে ঘুরতে বেরিয়েছিল। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ তাঁদের কানে এল গানের সুর। সেই সুর অনুসরণ করে তাঁরা এগোতে এগোতে পৌঁছলেন এক দীঘির পাড়ে। সেখানে তাঁরা যা দেখলেন, তা বিস্ময়কর! দীঘির দক্ষিণে এবং উত্তরে দু’টি খাড়াই মঞ্চ। তার একটিতে গোবিন্দজি এবং অন্যটিতে শ্রীরাধিকার অধিষ্ঠান। দুই দেব-দেবীকে মাঝে রেখে চলছিল দোল খেলা। যাঁরা দোল খেলছিলেন তাঁদের পোশাকেও ছিল অভিনবত্ব। আবিরে চার দিক লাল। পিচকারিতে তরল রং নিয়ে চলছিল খেলা। কাতারে কাতারে লোক এসেছেন সেই উৎসবে। বসেছিল মেলাও। দীঘির উত্তর পাড়ে অর্থাৎ রাধাবাজারে, স্তূপ করে রাখা ছিল আবির। পথঘাটের সঙ্গে দিঘির জলও লাল হয়ে গিয়েছিল। গোপিনীদের নৃত্য, উত্তেজক চটকদারি সঙ্গীত আর চারপাশের পরিবেশ সেই ইংরেজ ছোকরাদের প্ররোচিত করে তোলে। এই গোপিনীরা যে আসলে সকলেই পুরুষ তা ভাবতেও পারেননি ওই ফিরিঙ্গি ছোকরারা। প্রাচীন গ্রিসের ‘স্যাটারনালিয়া’র সঙ্গে এই রং-উৎসবের মিল খুঁজে পেয়ে তাঁরা ভেবেছিল বুঝি ‘কামোৎসব’। এর পরে তাঁরাও অংশ নিতে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করেন। ফলে এক কাণ্ড ঘটে বসল! এটা ফিরিঙ্গিদের বেয়াদপি মনে করে নেটিভরা তাঁদের উৎসবে ঢুকতে বাধা দিলেন। শুধু তাই নয়! তাঁদের পিঠে পড়েছিল চড় থাপ্পড়। ‘বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের’ একটি প্রবন্ধে ঘটনাটির উল্লেখ মেলে। পরে ইংরেজরা এ দেশে আসার পরে ঔপনিবেশিকতার প্রভাবে যে নব্য বাবুসমাজ গড়ে উঠেছিল, হোলি উৎসব তাতে প্রাধান্য পেয়েছিল। আর যে বাবুরা “দিনে ঘুমিয়ে, ঘুড়ি উড়িয়ে, বুলবুলির লড়াই দেখে রাতে বারাঙ্গনা দিগের আলয়ে গীতবাদ্য ও আমোদ করিয়া কাল কাটাইত” তাঁদের হোলি উদযাপনও বিচিত্র ধরনের ছিল। আর জীবনযাত্রায় এই সব ভোগ-বিলাসের লীলাসঙ্গিনী ছিল গণিকাকুল। ভবনীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নব বাবুবিলাস’-এ সেই সব বাবুদের জীবনযাপনের উল্লেখ মেলে। বাবু-বিলাসের নিধুবন ছিল তাঁদের সখের বাগানবাড়ি। রুপোর রেকাবিতে রাখা আতর মেশানো আবির উড়িয়ে, রুপোর পিচকারির সুগন্ধী রঙিন জল ছিটিয়ে, গেলাসে রঙিন পানীয় ঢেলে, হোলির ঠুমরি কিংবা দাদরার তালে তালে দোস্ত ইয়ারদের নিয়ে মাতাল হয়ে ওঠার আনন্দটা কেমন ছিল তা শুধু বাবুরাই জানতেন! বাবু কালচারের হোলির বিবরণ দিতে গিয়ে কবি ‘ঈশ্বর গুপ্ত’ লিখেছিলেন “ক্রমেতে হোলির খেলা, নবীনা নাগরী মেলা, ছুটে মুটে যায় এক ঠাঁই। … যাঁর ইচ্ছা হয় যারে, আবির কুমকুম মারে, পিচকারি কেহ দেয় কায়। উড়ায় আবীর যত, কুড়ায় লোকেতে কত, জুড়ায় দেখিলে মন তায়। ঢালিয়া গোলাপ জল, অঙ্গ করে সুশীতল, মাঝে মাঝে হয় কোলাহল।” পুরানো কলকাতার দোল প্রসঙ্গে ইতিহাসের পাতায় প্রমাণ মেলে যে, “সে সময়ে কোনও ব্যক্তির বেদাগ বস্ত্র থাকিত না, দলে দলে মিছিল বাহির হইতেছে, পিচ্কারি ও আবিরে পথঘাট ঘরবাড়ি লালে লাল হইয়া যাইতেছে।” সে কাল থেকে এ কাল দোলের একটা জিনিস বদলায়নি, সেটা হল আবেগ। ধনী দরিদ্র নির্বিশেষে সকলে দোলের আনন্দে মেতে উঠতেন।

‘বালথাজার সলভিন্স’ তাঁর ‘Les Hindoues’ গ্রন্থে দোলযাত্রার একটি ছবির বর্ণনায় সে কালের রং উৎসবের বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি উল্লেখ করেছিলেন যে, হিন্দুদের এই দোল উৎসবে খ্রিস্টান ও মুসলমানেরাও আমোদ-প্রমোদে মেতে উঠতেন। লখনৌর নির্বাসিত নবাব ‘ওয়াজেদ আলি শাহ’ যখন মেটিয়াবুরুজে থাকতেন, তখন তিনিও তাঁর মিত্র-পারিষদদের নিয়ে সাড়ম্বরে হোলি খেলতেন। এমনকি, হোলি উপলক্ষে তিনি নতুন গানও রচনা করতেন। দোল উপলক্ষে এক কালে কলকাতার বিভিন্ন রাজবাড়িতে বাঈনাচের আসর বসত। তেমনই এক আসরে সেকালের বিখ্যাত বাঈজি ‘গহরজান’ উপস্থিত ছিলেন। মেঝেতে পুরু করে আবির বিছিয়ে তার উপর কাপড় ঢেকে সেখানে হয়েছিল নাচ। নাচের শেষে আবিরের উপর থেকে কাপড় সরিয়ে দেখা গিয়েছিল, সেই আবিরের উপর পদ্মের আকৃতির নকশা হয়ে গিয়েছে। পাথুরিয়াঘাটার রাজবাড়িতে ধ্রুপদী সঙ্গীতের আসর বসত। সেখানে গাইতেন ‘অঘোর চক্রবর্তী’, ‘পিয়ারা সাহেব’, কিংবা ‘আহমদ খান’। গবেষকদের মতে সাবেক কলকাতার দোল উৎসব প্রাচীন কালের মদনোৎসবের আদলে গড়া ছিল। বর্তমানে যাঁরা দোলের সময় রাস্তাঘাটে চটুল পরিবেশের কথা বলে রে-রে করে ওঠেন, তাঁরা শুনলে অবাক হবেন সে কালেও দোলে চটুলতা ছিল। সেটার প্রমাণ ইতিহাসের পাতায় পাওয়া যায়। “… মিছিলওয়ালারা সুশ্রাব্য ও অশ্রাব্যগীতিতে পাড়া মাতাইয়া এবং নরনারী যাহাকে সম্মুখে পাইত, তাহাকে আবির ও পিচকারিতে ব্যতিব্যস্ত করিয়া চলিয়া যাইত। এমন অশ্রাব্য গীত এবং কুৎসিত সং প্রকাশ্যে পথে বাহির করিতেন যে, এখনকার লোকে তাহা কল্পনা করিতে পারে না। কর্তারা কিন্তু তাহা লইয়া আমোদ করিতেন। গৃহিনীও বালক-বালিকাদের সহিত শ্রবণ ও দর্শন করিতেন।” তবে বিলাসিতা কিংবা আমোদ-প্রমোদ যতই হোক না কেন, এই সব বিলাসী বাবুরা ছিলেন সাবেক হিন্দু ধর্মে বিশ্বাসী। তাই দোল উপলক্ষে এই সব বাড়িতে বিশেষ পুজোআচ্চা হত। তৈরি হত বিশেষ মিষ্টি এবং শরবতও। কিছু কিছু পুরনো পরিবারে আজও সেই সব রীতি দেখা যায়। বাবু-বিলাসের দিন ফুরলেও ফুরোয়নি সেই ঐতিহ্যের রং। কালের গরিমায় অনেক কিছু হারালেও বনেদি পরিবারগুলিতে আজও অটুট এবং অক্ষুণ্ণ দোল বিলাসের সেই মেজাজটা। সময়ের স্রোতে বাঙালির দোলযাত্রায় পড়েছে প্রাদেশিকতার ছাপ। তবু তার মাঝেই পুরনো কলকাতার দোল বিলাস স্মৃতির সুরভি নিয়ে অতীত আর বর্তমানের মাঝে একটা রঙিন যোগসূত্র।
‘দেল’ (দেউল), ‘দোল’, ‘দুর্গোৎসব’ – এই তিন নিয়েই ছিল প্রাচীন কলকাতার ধর্মার্চনা, আনন্দ-উৎসব। বঙ্গদেশে সেদিন দেউল বা মন্দিরের অভাব ছিল না। সেই সব মন্দিরে প্রধানতঃ রাধা-কৃষ্ণের যুগল মূর্তির আরাধনা চলত নিরবচ্ছিন্নভাবে। বৈষ্ণবদের তখন রমরমা ছিল। সময়টা ছিল ষোড়শ-সপ্তদশ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ। কৃষ্ণনগরের মহারাজা ‘কৃষ্ণচন্দ্র’ এই বৈষ্ণবীয় পরিমণ্ডলে লালিত-পালিত হয়েও বাংলায় শক্তিদেবীর আরাধনা – বৈষ্ণব বিরোধী শাক্ত সাধনাকে প্রসারিত করবার জন্য রাষ্ট্রশক্তিকে কাজে লাগিয়েছিলেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে যুদ্ধে সিরাজউদ্দৌল্লার পরাজয়ের পরে (১৭৫৭) বণিকের মানদণ্ড রাজদণ্ড রূপে দেখা দেওয়ায় বাংলার অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের পাশাপাশি রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা চরমে পৌঁছেছিল। সেই দিনগুলিতে অভিজাত-অভাজনেরা বিপর্যয় থেকে মুক্তি পেতে কৃষ্ণের বাঁশির পরিবর্তে শক্তিদেবীর অসিকেই প্রাধান্য দিয়েছিলেন। কিন্তু কালে-কালান্তরে দেখা গিয়েছিল, জমিদার-ইজারাদার-ইমানদার তথা ভূস্বামীরা কৃষ্ণ আরাধনার পাশাপাশি শক্তি আরাধনাকেও গুরুত্ব দিয়েছিলেন। সেই পরিপ্রেক্ষিতেই বঙ্গদেশে দুর্গা ও কালীপুজোর সূচনা ঘটেছিল। তাতে কৃষ্ণের বংশীধ্বনির মাধুর্য কিন্তু হারিয়ে যায়নি। তখনকার অভিজাত ব্যবসায়ী এবং সাধারণ কুলীন মানুষেরা যাঁদের মধ্যে ‘বেনিয়ান’, ‘মুৎসুদ্দি’, ‘রাইটার’, ‘কেরানি’, ‘মুন্সি’ প্রমুখরা ছিলেন, তাঁরা রাধাকৃষ্ণের মধুর লীলার আস্বাদন ও আরাধনাকে নতুন রূপ দিয়েছিলেন। জোব চার্নকের উদ্যোগে নগর কলকাতা গড়ে ওঠার পরে দেখা গিয়েছিল যে, সেখানকার অভিজাত ধনবান মানুষদের বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত দেউল অর্থাৎ মন্দিরে সাড়ম্বরে রাধা-কৃষ্ণের আরাধনা নানাভাবে চলছে। অতীতে ‘সুতানুটি’, ‘গোবিন্দপুর’ ও ‘কলকাতা’ – এই তিনটি গ্রাম নিয়েই তৈরি হয়েছিল নগর কলকাতা। যা বর্তমানে কলকাতা মহানগরীতে রূপান্তরিত। প্রাচীনকাল থেকেই এই তিন জনপদের অস্তিত্ব লক্ষ্যণীয় ছিল। চার্নক গঙ্গা পূর্বতীরবর্তী এই তিন গ্রামকে কেন্দ্র করে কলকাতা মহানগরীর রূপরেখাটি চিত্রায়িত করেছিলেন। সুতানুটি অর্থাৎ উত্তর কলকাতা যেখানে সুতো তথা বস্ত্র নিয়ে কাজ কারবার ও সেসবের ব্যবসাই তখন প্রধান ছিল। গোবিন্দপুর ছিল বর্তমানে ফোর্ট উইলিয়াম ও সন্নিহিত গড়ের মাঠ অঞ্চলটি। আর কলকাতা ছিল দক্ষিণ অংশের কালীঘাট-ভবানীপুর থেকে বড়িশা-বেহালা পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চল। সেই অংশটির মালিক ছিলেন ‘সাবর্ণ গোত্রীয় রায়চৌধুরী’রা। কালীঘাটের মন্দির তাঁদের হাতেই গড়ে উঠেছিল। কলকাতা ফোর্ট যখন গড়ে উঠল, তখন গোবিন্দপুরে বসবাসকারী তাঁতি-বস্ত্র ব্যবসায়ীরা বর্তমান ‘বড়বাজারে’, ‘পাথুরিয়াঘাটা’ অঞ্চলে উঠে গিয়েছিলেন। প্রসঙ্গতঃ ‘পিরালি ঠাকুর পরিবার’ ওই গোবিন্দপুরেই প্রথমে বসবাস করতেন। পরে তাঁরা পাথুরিয়াঘাটা-জোড়াসাঁকোতে চলে গিয়েছিলেন। আর সুতানুটি সুতানুটিতেই থেকে গিয়েছিল। পুরনো কলকাতার দোল উৎসব বিশেষভাবে পালিত হতো সুতানুটি, গোবিন্দপুর এবং মধ্যবর্তী বড়বাজার সন্নিহিত অঞ্চলে। আর অভিজাত ব্যবসায়ী, কোম্পানির শাসকদের কৃপায় রাজা-জমিদার-ইজারাদার প্রমুখের প্রধানতঃ সুতানুটি অঞ্চলে নির্মিত অট্টালিকা সংলগ্ন মন্দিরে নিত্য রাধা-কৃষ্ণের আরাধনার ব্যবস্থা ছিল। সংলগ্নবাগান বাড়িতে দোল উৎসব হত।

কলকাতার বাঙালী সমাজে দোল এখন প্রায় অস্তগামী। অথচ আজ থেকে একশো বছর আগেও দোল কলকাতার একটা বেশ বড় উৎসব ছিল। তখনকার লোক কোনও বর্ধিষ্ণু পরিবারের উল্লেখ করতে গিয়ে প্রায়ই বলতেন যে, “এঁদের বাড়ি দোল-দুর্গোৎসব হয়।” অর্থাৎ, তখন এটি দুর্গোৎসবের মতই একটা বড় উৎসব ছিল। এর সমর্থন পাওয়া যায় ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির ১৭৮৭ সালের সরকারি ছুটির তালিকা থেকে। সেই সময়, অন্যান্য পরবে সরকারি অফিস যেখানে দু’-এক দিনের বেশি বন্ধ রাখা হত না, সেখানে দুর্গোৎসবের জন্য আটদিন ও দোলযাত্রার জন্য পাঁচদিনের ছুটি বরাদ্দ ছিল। পুরনো কলকাতার এই পাঁচটি দিন রঙের অনুষঙ্গে কাটতো। সেই সময় দোল উপলক্ষে বিভিন্ন জায়গায় ‘সঙ’-ও বের হত। মিছিল করে লোকে এমন কুৎসিত সঙ প্রকাশ্যে বের করত ও তাঁরা এমন অশ্রাব্য গান গাইত যে আজকালকার মানুষ তা কল্পনাতেও আনতে পারবেন না। সেই মিছিলের চলার রাস্তায় নারী-পুরুষ যাঁকেই সামনে পাওয়া যেত, তাঁরই গায়ে রং দিয়ে দেওয়া হত। ওই ধরণের মিছিলে কারুর গায়েই রঙ ছাড়া অন্য কোন কাপড় থাকত না! তাছাড়া, আবির ও নানা রঙে পথঘাট লাল হয়ে যেত। আর লোকে তা নিয়ে খুব আমোদ করত। পুরানো কলকাতার বড়লোকদের বাড়িতে খুব ঘটা করেই দোল উৎসব পালিত হত। যেমন – অতীতের কলকাতার ‘রানী রাসমণি দেবী’র বাড়িতে ‘রঘুনাথ জীউ’ থাকার জন্য দোল, রাস ও জন্মাষ্টমীর উৎসবগুলি নিয়মিতভাবে পালিত হত এবং প্রতিটি উৎসবে রাসমণি দেবী পূজা ছাড়াও দানধ্যান ও দরিদ্রনারায়ণের সেবায় প্রচুর অর্থ ব্যয় করতেন। এছাড়া সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেরও অভাব ছিল না। উৎসব মানেই আনন্দ – সেই আনন্দ উপভোগের জন্য যা কিছু করণীয় তার সবই করতেন রাণী রাসমণি দেবী। রাসমণি দেবীর বাড়িতে দোলৎসবের বর্ণনা প্রসঙ্গে ‘প্রবোধচন্দ্র সাঁতরা’ তাঁর ‘রাণী রাসমণি’ গ্রন্থে লিখেছিলেন, “রঘুনাথ জীউ ঠাকুরের দোল ও রাসোৎসব হইত। যে দেখে নাই, সে বুঝিবে না, দোলের সময় কি বিরাট ব্যাপার হইত। গোয়ালিয়রের বিখ্যাত গায়ক ‘জ্বলাপ্রসাদ’ আসিয়া সন্ধ্যার পর দোলের দিবস সকলকে গানে পরিতৃপ্ত ও মোহিত করিতেন। তেমন গায়ক বুঝি আর ভারতে জন্মিবেন না।” দোলের দিন সকালে রঘুনাথ জীউকে ঠাকুর দালানে এনে ও মঞ্চে স্থাপন করা হত। রাণীর জামাতারা স্নান করে ও পট্টবস্ত্র পরে আগে আগে গঙ্গাজল ছিটাতে ছিটাতে আসিতেন আর তাঁদের পিছন পিছন পুরোহিত ‘ঠাকুর’ নিয়ে আসতেন। ঠাকুরের অভিষেক কার্য্য শেষ হলে, সকলে ঠাকুর প্রণাম, ব্রাহ্মণ গুরুজনকে প্রণাম, প্রণামী প্রদান করে দোলের পার্বনী নিয়ে দোল খেলা শুরু করতেন। জানা যায় যে, ১০/১২ টি গরুর গাড়িতে করে পিচকারী, ফাগ, আবির, কুমকুম, নানাবিধ চিনির খেলনা আসত। নববস্ত্র, পার্ব্বনী, পিচকারী, রং সকলকে দেওয়া হত। ফাগ, আবির, কুমকুম রাণীর বাড়ির ভিতরে বাইরে স্তরে স্তরে রাখা হত। যাঁর যত ইচ্ছা নিত, মাখিত, খেলত, পরস্পরের অঙ্গে দিত, কারও কোন নিষেধ ছিল না। কেউ কাউকে কুমকুম দিতেন, কেউ আবার কাউকে পিচকারী দিয়ে রং দিতেন, রং গোলাপ জলে ভিজিয়ে নেওয়া হত ফলে চারিদিক সৌরভে ভরে থাকত। রাণীর বাড়ির অন্তঃপুরে, বাইরে, উপরে, নীচে, ভিত্তিগাত্রে, উঠানে এত ফাগ ও আবির পড়ে থাকত যে দোলের পরেও অন্তঃত এক সপ্তাহ ধরে ফাগের উপর দিয়েই সকলকে যাতায়াত করতে হত। এই কারণে দোলের পরে রাণীর বাড়ি পুনরায় সংস্কার করতে হত, না হলে বাড়ি বসবাসযোগ্য হত না। প্রবোধচন্দ্র সাঁতরার লেখা থেকে জানা যায় যে, “… সর্বোপরি দৌবারিকদিগের আমোদ অত্যাধিক। লাল রঙে রঞ্জিত হইয়া নানাবিধ বাদ্য সহযোগে গান করিত। কোলাহলে আকুল করিত। কয়েক দিবস নিদ্রাই হইত না। মনে হইত, যেন নিবৃত্ত হইলেই রক্ষা পাওয়া যায়।” এই উৎসবে রাণী দীন দরিদ্র কাউকেই অভুক্ত রাখতেন না। রাণীর বাড়ির রাস্তার ধারে নানান ধরণের খেলনা আর খাবারের দোকান বসত। এছাড়াও নাচ ও তামাসারও বন্দোবস্ত করা হত। রাণী রাসমণির বাড়ির দোল উৎসবের বর্ণনা থেকে তখনকার দিনের দোলৎসবের নির্দোষ আনন্দের একটা ছবি দেখতে পাওয়া যায়, যা বর্তমানে অনেক ক্ষেত্রে কুৎসিত, মারাত্মক ও বিপদজ্জনক আনন্দে পরিণত হয়েছে – একথা মেনে নেওয়াই সঙ্গত।

বিংশ শতাব্দীর ত্রিশের দশকের শুরু পর্যন্ত প্রতিটি গৃহস্থকে তাঁদের জামাইবাড়িতে ‘দোলের তত্ত্ব’ পাঠাতে হত। সেই তত্ত্বে থাকত – কাপড়-জামা, মিষ্টান্ন, পিতলের পিচকারি, পিতলের বালতি, রঙের বাক্স, আবির, সাদা বাতাসা, সাদা ও রঙিন ‘মঠ’, চিনির মুড়কি, ফুটকড়াই, তিলেখাজা ইত্যাদি। এখন এটা বন্ধই হয়ে গিয়েছে। এখন থেকে সত্তর-আশি বছর আগের কলকাতা শহরে দোলের দিন সকালে যেরকম মাতামাতি হত, সেটার বর্ণনা ভাষায় ফুটিয়ে তোলা কঠিন। তখন ‘জার্মানি’ থেকে সস্তার রঙ আসত, সেজন্য রাস্তাঘাটে রঙ ছোড়াছুঁড়িটাও খুব বেশি রকমের হত। তাছাড়া সেই সময়ে পিচকারির দামও ছিল খুব সস্তা। গোলাপি-সবুজ-গাঢ় নীল ইত্যাদি রং এলেও সাধারণ মানুষ কিন্তু লাল রংটিই পছন্দ করত বেশি। রঙের উৎসব দোল খেলার পর পথঘাট লাল হয়ে থাকত বেশ কয়েকদিন পর্যন্ত। একটা বাঁশের পিচকারির দাম ছিল এক পয়সা। টিনের পিচকারি, সাইজ অনুযায়ী দু’-পয়সা থেকে দু’-আনা ও ছ’-আনা থেকে দশ আনা পয়সায় একটা পিতলের পিচকারি পাওয়া যেত। ধনী-অভিজাত বাড়ির দোলখেলায় পিতলের পিচকিরি, পিতলের বালতিতে রং, কিংবা সুগন্ধী আবির, পিতল বা কাঁসার রেকাবিতে অভ্র ও ফুলের পাপড়ি ছড়ানো আবির ইত্যাদি ব্যবহার করা হতো। তুলনায় সাধারণ মধ্যবৃত্তের সম্বল বলতে ছিল বাঁশ-টিনের পিচকিরি। বাড়ির অন্তঃপুরে মেয়েরাও রঙ নিয়ে খুব মাতামাতি করতেন। আর বাইরে রাস্তায় ছেলের দল যাঁকেই সামনে পেত, তাঁর গায়েই রঙ দিয়ে দিত। সেজন্য সেকালে দোলের দিন লোকে ছেঁড়া জামা-কাপড় পরে রাস্তায় বের হত। তবে তখন কনিষ্ঠরা কখনও নিজেদের গুরুজনদের গায়ে রং দিতেন না। তখন গুরুজনদের পায়ে আবির দেওয়াটাই প্রথা ছিল। ওই সময় সকালে রঙের খেলা শেষ হয়ে গেলে, বিকালে আবির খেলা হত। এছাড়া বিকালে কনসার্ট পার্টি ও গানও বের হত। বিকেল-সন্ধ্যায় ঘরোয়া গানের আসর যেমন থাকত, তেমন কেউ কেউ ওস্তাদ গাইয়ে-বাজিয়েদেরও আমন্ত্রণ জানাতেন বাড়িতে। ‘নিধুবাবুর টপ্পা’, ‘যদু ভট্টের গান’ – এর মধ্যে উল্লেখ্য। বাঈজি নাচও হতো। বৈষ্ণবরা আয়োজন করতেন কীর্তন গানের। এছাড়া কবিগান, তরজা, আখড়াই-হাফ আখড়াই গানেরও ব্যবস্থা হতো। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে নাট্যাভিনয়ের কালে ‘দোললীলা’, ‘বসন্তলীলা’, ‘প্রহ্লাদচরিত’, ‘কংসবধ’ বিষয়ক নাটকও অভিনীত হয়েছিল। সব মিলিয়ে দোলের উৎসবের প্রেক্ষাপট ছিল রঙিন এবং বর্ণাঢ্য।
সেকালে নগর কলকাতায় কোনও পরিবার বর্ধিষ্ণু কি না জানতে মানুষ জিজ্ঞেস করত, সেই পরিবারে কি দোল ও দুর্গোৎসবের আয়োজন হয়? দুর্গাপুজোর মতোই দোল উৎসব ছিল জাঁকজমকপূর্ণ এবং সম্মানসূচক; যেটাকে বলে ‘স্ট্যাটাস সিম্বল’। তখন মন্দিরে রাধাকৃষ্ণের বিগ্রহের নতুন সাজ, ফুলের অঙ্গসজ্জা, বিশেষ ভোগরাগের ব্যবস্থা থাকত। বিগ্রহের পায়ে-গায়ে ছোঁয়ানো হত আবির। সাদা, গোলাপি বাতাসা, সাদা ও রঙিন মঠ (চিনি দিয়ে তৈরি ত্রিভূজাকৃতির মিষ্টি) – নানা পাখি, ফুল ইত্যাদির ছাঁচ তৈরি করে এই ‘মঠ’কে বিভিন্ন আকৃতি দেওয়া হত। এছাড়াও মুড়কি-কদমা-ছোলা ও চিনি সহযোগে তৈরি একরকমের মিষ্টি যা ‘ফুটকড়াই’ নামে জনপ্রিয় ছিল, সেটাও পুজোয় দেওয়া হত। আর সেই প্রসাদ বাচ্চা-বুড়ো সবার কাছেই ‘দোল স্পেশাল’ হিসেবে খুবই জনপ্রিয় ছিল।
প্রাচীন কলকাতার ব্রিটিশ পুলিস বিভাগ থেকে দোলের বেশ কয়েকদিন আগেই প্রচার করা হতো শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখা এবং অনিচ্ছুক ব্যক্তিদের গায়ে রং না দেওয়ার জন্য। এখনকার মাইক-মাইক্রফোন বা প্রিন্ট ইলেক্ট্রনিকস মিডিয়ার মাধ্যমে যে প্রচার জনস্বার্থে করা হয়, সেই সময়ে ‘ঢুলি’ সম্প্রদায় ঠিক সেই জাতীয় প্রচারই করত। তখন বিভিন্ন জরুরি খবর সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার কাজটি সেই ঢুলিরাই করতেন। কলকাতার জনবহুল অঞ্চলগুলি – বারোয়ারিতলা, বাজার-হাট, কখনও বা যাত্রাপালা, কীর্তনের আসরের আগে পরে ঢুলিরা ঢোল বাজিয়ে পুলিস, আদালত ইত্যাদির সরকারি আদেশ-নির্দেশ প্রচার করতেন। সেবিষয়ে যদি কোনও রকম অভিযোগ থানায় যায়, তবে সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তি বা ব্যক্তিবর্গকে আটক করা হবে বলেও তখন জোর প্রচার চালানো হত। অনেক ধনী বা জমিদার ব্যক্তি, ব্যক্তিগত উদ্যোগে নিজের বাড়ি কিংবা বাগানবাড়িতে তখন যে দোল খেলার এলাহি আয়োজন করতেন, সেটার প্রচারও ওই ঢুলিদের দিয়েই করানো হত। তারা ‘ঢ্যাঁড়া’ পিটিয়ে সেইসব বাবু সম্প্রদায়ের মানুষজনের মহিমা প্রচার করতেন। তখনকার অনেক বিত্তশালী-জমিদার আবার কলকাতার বিভিন্ন বস্তি অঞ্চলে ঢুলিদের ঘর দিয়ে বিভিন্ন প্রচারের স্বার্থে তাঁদের সেখানে থাকতে দিতেন। সেই ঢুলিরা ডোম সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন।
পুরানো কলকাতার যে সব ধনীর বাড়িতে বেশ জাঁক করে দোল উৎসবের আয়োজন হতো তাঁরা ছিলেন – ‘প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর’, ‘মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর’, ‘প্রসন্নকুমার ঠাকুর’, ‘রাজেন্দ্রলাল মিত্র’, ‘দিগম্বর মিত্র’, ‘বলরাম বসু’, ‘পশুপতি বসু’, ‘বাবু পীতরাম দাস’, ‘বাবু বৈষ্ণবচরণ শেঠ’, ‘রাধাকান্তদেব বাহাদুর’, ‘বাবু আশুতোষ দেব’, ‘বাবু নবীনচন্দ্র বসু’, বাগবাজারের ‘ভুবন নিয়োগী’, অমৃতবাজার পত্রিকার সম্পাদক ‘শিশিরকুমার ঘোষ’ প্রমুখ। ইংরেজরা অতিথি হয়ে আসতেন সেই আয়োজনে। খানাপিনার সঙ্গে নাচ-গানও তখনকার দোল উৎসবের অপরিহার্য অঙ্গ ছিল। ইংরেজ প্রশাসকদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে নিজের খ্যাতি প্রতিপত্তিতে আরও খানিকটা জৌলুস আনার চেষ্টাও অনেক সময়েই থাকত। তখনকার অর্থবান মানুষেরা এই রঙের উৎসবে প্রিয়জনদের বাড়িতে তত্ত্ব পাঠাতেন। আত্মীয়স্বজন, বন্ধু বয়স্যদের বাড়িতে বিলিতি রঙের বাক্স নানা আকৃতির পিতলের পিচকিরি, পিতলের বালতি, আবির, গন্ধদ্রব্য, রঙিন মিষ্টি, কখনও বা বিলিতি প্রসাধন সামগ্রীও উপহার হিসেবে যেত বড় পিতল-কাঁসার পরাতে, বা কাঠের সুদৃশ্য বারকোশে। বিদেশ থেকে আমদানি করা লেসের ঢাকনা দেওয়া এইসব উপহার সামগ্রী তাঁদের আভিজাত্যেরই স্মারক।

আগেই বলা হয়েছে যে, পুরনো কলকাতায় দোল উপলক্ষে সঙের দল বেরত। কৃষ্ণ আরাধনা কেন্দ্রিক দোল উৎসবের সঙ্গে অবশ্য কলকাতার সেকালের নিম্নবর্গের মানুষজনের বিশেষ সংযোগ ছিল না। তাঁদের সাধনা-আরাধনা ছিলেন লৌকিক দেবদেবীরা; শীতলা, ষষ্ঠী, ধর্মঠাকুর, বাশুলী, শিব প্রমুখ। কিন্তু দোলের দিন কলকাতার জেলে ও কৈবর্তপাড়া থেকে সং বের হত। গাজন উৎসবে সঙের রমরমা থাকলেও দোলেও তা নেহাত কম হতো না। অভিজাতজনেরা অনেকাংশে তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। শীতলা, ষষ্ঠী, ধর্মঠাকুর, বাশুলী, শিব, মনসার পুজো করলেও দোলের দিন তাঁরা নিজেদের মতো করে কৃষ্ণ কথা নিয়ে মুখে মুখে রসরসিকতায় গান বাঁধতেন। বলাবাহুল্য যে, সেই সব গান, সব সময় জনরুচির উপযুক্ত হত না। সেই সঙেরা সমসাময়িক সমাজব্যবস্থার বিভিন্ন বিষয় নিয়েও দোলের দিন মুখে মুখে গান বাঁধতেন। ‘বউবাজার’ থেকে ‘ক্রিক রো’ ও সন্নিহিত অঞ্চলে সেই সঙের দল ঘুরে বেরাত। তাঁদের সঙ্গেও রং ও আবির থাকত। রাস্তায় ছেলে-বুড়ো যাঁকে পাওয়া যেত, তাঁকেই রং মাখানো চলত। তাঁরা নিজেদের মধ্যেও রং খেলতেন। কৃষ্ণ কথা ছাড়াও দোলের দিন সমসাময়িক বিষয় নিয়ে ছড়া বেঁধে তাঁদের গান গাওয়া চলত। সেসব উন্নত রুচির না হলেও তাতে সাধারণ মানুষ খুব আমোদ পেতেন। শুধু সংই নয়, সেকালে ‘বউবাজার’ থেকে ‘বাগবাজার’ পর্যন্ত বহু পল্লিতে দোলযাত্রার দিন নগর সংকীর্তনের দল বের হত। বহু দল ‘রূপচাঁদ পক্ষী’র গান গাইতেন। একটি দৃষ্টান্ত দেওয়া যেতে পারে –
“হোরি খেলিছে শ্রীহরি, সহ রাধাপ্যারী,
কুঙ্কুম ধূম, শ্যাম অঙ্গভরি।।
পুস্পমালা, হিন্দোল সাজায়ে ব্রজনারী,
রাই শ্যাম, অনুপম, দোলে তদুপরি।”
এছাড়া ‘রাম বসু’ ও ‘হরু ঠাকুরের’ কথকথাও সেকালের দোল-হোলিকে কেন্দ্র করে জনপ্রিয় হয়েছিল।
পুরনো কলকাতার দিনকাল গত হয়েছে। পরিবর্তনের শত-সহস্র স্রোত মানুষের জীবন ও সমাজের উপর দিয়ে প্রবাহিত। পরিপ্রেক্ষিত কিন্তু পাল্টায়নি। আজও ফাল্গুনী পূর্ণিমায় রঙের উৎসব দোল শুধু পালিত হয় না, সাড়ম্বরেই পালিত হয়। এই দিনটিতেই ১৪৮৬ খ্রিস্টাব্দে চৈতন্যদেব আবির্ভূত হয়েছিলেন। তাঁর ৫০০ বছর পূর্তি থেকে জন্মোৎসব উদযাপনের গুরুত্ব বহুগুণ বেড়েছে। দু’য়ে মিলে বৃন্দাবনের ‘বর্ষানা’ (রাধার জন্মস্থান), ‘নন্দ্‌গাঁও’ (কিশোর কৃষ্ণের অবস্থান) নদীয়ার নবদ্বীপের সঙ্গে মিলেমিশে বর্তমানের কলকাতা মহানগরী নব বৃন্দাবন সদৃশ হয়ে ওঠে বাঙালি-অবাঙালিদের দোল-হোলির উৎসবে।

(তথ্যসূত্র:
১- Fairs and Festivals of India, S.P. Sharma.
২- Festival of colours, Kabir Sehgal & Surishtha Sehgal.
৩- রাণী রাসমণি, প্রবোধচন্দ্র সাঁতরা।
৪- কলিকাতার সেকাল ও একাল, হরিসাধন মুখোপাধ্যায়।
৫- প্রাচীন কলিকাতা পরিচয়, হরিহর শেঠ।
৬- কলিকাতার কথা, প্রমথনাথ মল্লিক।
৭- জোড়াসাঁকোর ধারে, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
৮- জীবনস্মৃতি, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর।
৯- যাত্রী, সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর।
১০- স্মৃতি চিত্র, প্রতিমা দেবী।
১১- কলিকাতা দর্পণ, রাধারমণ মিত্র।
১২- শহর কলকাতার ইতিবৃত্ত, বিনয় ঘোষ।)

ঊনিশ শতকের রাজনীতিতে বালগঙ্গাধর তিলক

রানা চক্রবর্তীঃ ঊনিশ শতকে ভারতের জাতীয় আন্দোলন কিছুটা দ্বিধাগ্রস্তভাবেই শুরু হয়েছিল। কংগ্রেসের প্রথম যুগের নেতারা তখনকার শিক্ষিত উচ্চ-মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে এসেছিলেন। ফলে এটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার যে, সমসাময়িক অবস্থা সম্বন্ধে তাঁরা মোটামুটি সন্তুষ্টই ছিলেন। প্রধানতঃ প্রতিনিধিত্বমূলক সরকারই তাঁদের কাম্য ছিল। কিন্তু কংগ্রেসের দাবীর প্রতি সরকারের বিমাতৃ-সুলভ মনোভাবই ঐ প্রতিষ্ঠানকে ক্রমশঃই সরকার-বিরোধিতায় সক্রিয় করে তুলেছিল। ফলে কংগ্রেসের বক্তারা ক্রমশঃ অগ্নিবর্ষী হয়েছিলেন। ব্রিটিশ সরকারের প্রতি তাঁদের সমালোচনার পরিধি বৃদ্ধি পেয়েছিল এবং গভীরতর হয়েছিল। সেসবের ফলে, প্রথমদিকে ইংরেজ শাসনের সুফল সম্বন্ধে তাঁদের মধ্যে যে সরব সচেতনতা দেখা গিয়েছিল, সেটাও ক্রমে বন্ধ হয়ে, বরং একটা অশ্রদ্ধার ভাবই ক্রমশঃ প্রকাশ পেয়েছিল। একথা অস্বীকার করবার কোন উপায় নেই যে, শুধুমাত্র কৃতজ্ঞতার ভিত্তিতে একটা রাজনৈতিক আন্দোলনের সূত্রপাত করাটা কোন দূরদর্শীরই কাম্য নয়। কিন্তু ঊনিশ শতকের শেষ দশকে, এবং বিংশ শতকের প্রথম দশকের মধ্যেই ভারতের জাতীয় সংগ্রামে বিপ্লববাদের সূচনা দেখা দিয়েছিল। কংগ্রেসের প্রথম যুগের নেতাদের চেয়ে সেই বিপ্লবীবাদীদের বক্তব্য আরও সুস্পষ্ট ছিল, এবং তাঁদের মনোভাবে ব্রিটিশ সরকারের প্রতি এক প্রকার মৌল বিদ্বেষ ছিল। মারাঠী নেতা বাল গঙ্গাধর তিলক তখনকার সেই বিপ্লববাদী দলের অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন। ভারতের ইতিহাস থেকে সেই বিপ্লববাদের বিকাশের কারণ বিশ্লেষণ করলে দেখতে পাওয়া যায় যে, প্রথমতঃ, তখনকার শহরাঞ্চলের পেটি বুর্জোয়া শ্রেণীর, অর্থাৎ দরিদ্র ছাত্র, অর্ধভুক্ত বুদ্ধিজীবি আর ক্রমবর্ধমান বেকারদের, ধূমায়িত অসন্তোষ সেটার পিছনে ছিল। তাঁদের সামনে তখন অগ্রগতির কোন পথই প্রশস্ত ছিল না। ওই সময়ে তাঁদের জীবনযাত্রা হয়ে উঠেছিল ক্রমশঃই দুর্বিষহ হয়ে উঠছিল। স্বভাবতঃই তখনকার উচ্চ-মধ্যবিত্তশ্রেণীর নেতাদের ধীর-স্থির-প্রগতি তত্ত্বে আস্থা রাখাটা তাঁদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। দ্বিতীয়তঃ, ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের দাবীর প্রতি তখনকার সরকারী মনোভাব ক্রমশঃই বিরূপ হয়ে ওঠার ফলে, তৎকালীন কংগ্রেসের মিতাচারী নায়কদের (যাঁরা ‘মডারেট’ বলে পরিচিত ছিলেন) মধ্যেও সরকার-বিরোধী মনোভাব দানা বেঁধে উঠেছিল। তাছাড়া, তাঁরা যখন বুঝতে পেরেছিলেন যে, ভবিষ্যৎ ক্ষমতা অর্পণের আয়োজন অযথাই বিলম্বিত হচ্ছে, তখন তাঁরা আর সেই কৃতজ্ঞতা-বোধ আশ্রিত, নিয়ম-তান্ত্রিক আন্দোলনে বিন্দুমাত্র বিশ্বাসী থাকতে পারেন নি। তৃতীয়তঃ, ওই সময়ে সত্যিকারের কার্যকরী কিছু করবার প্রয়োজনীয়তা সকলেই উপলব্ধি করছিলেন। জাতীয় নেতারা বেশ বুঝতে পারছিলেন যে, শুধুমাত্র মৌখিক বুলির সাহায্যে কখনোই অভীষ্ট সংস্কার-সাধন সম্ভব নয়। চতুর্থতঃ, নেতাদের আপোষ-মীমাংসার নীতির প্রতি সাধারণের অসহিষ্ণুতা যতক্ষণ দিনে দিনে বেড়েই চলেছিল। আর সেই কারণেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ও পরাধীনতার বিরুদ্ধে আপোষহীন ও চূড়ান্ত সংগ্রামের ব্যাকুলতা দেখা দিয়েছিল। তাছাড়া, পশ্চিমী শিক্ষা ও সভ্যতার প্রভাবে ভারতীয় সমাজের তথাকথিত ‘বিজাতীয়করণের’ ফলে, বিক্ষুব্ধ রক্ষণশীল সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্রিটিশ-বিরোধিতা প্রকট হয়ে উঠেছিল। পরিশেষে, তখন যেখানে বিপ্লববাদের সূচনা ঘটেছিল, সেই মহারাষ্ট্রে, ব্রিটিশ শাসনের প্রতি অসহিষ্ণু বিদ্বেষ বহুদিনের ঐতিহ্যগত ছিল। আসলে মারাঠীরাই শেষ ভারতীয় শক্তি ছিলেন, যাঁরা এদেশে ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে দৃঢ়-প্রতিজ্ঞ সংগ্রাম চালিয়েছিলেন। এমন কি ১৮৬২ সালে এবং ১৮৭৯ সালে পর্যন্ত মহারাষ্ট্রে বিদ্রোহ দেখা দিয়েছিল। কিন্তু শেষপর্যন্ত নতি স্বীকার করতে বাধ্য হলেও ওই সব বিদ্রোহের স্মৃতি মারাঠীদের একটি বিরাট অংশকে সব সময়েই প্রভাবিত করেছিল। মহারাষ্ট্রের চিৎপাবন ব্রাহ্মণ শ্রেণী, যাঁদের মধ্যে থেকে সেই বিপ্লববাদের নায়ক তিলক উঠে এসেছিলেন, পেশোয়াদের আমল থেকেই তাঁরা দেশের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে চলেছিলেন। মারাঠীদের দেশে তাঁরাই তখন রাজনীতিতে ও মননশীলতায় অভিজাত ছিলেন; সেখানে তাঁরাই তখন আইন, শিক্ষা এবং সরকারী কাজের পুরোধা ছিলেন। তাঁদেরই মধ্যে কেউ কেউ পেশোয়াদের লুপ্ত গৌরব পুনরুদ্ধারের স্বপ্নও দেখতেন।

ওই সময়ের জাতীয় আন্দোলনে চরমপন্থীদের ভূমিকা যাঁরা নিয়েছিলেন, প্রকৃতপক্ষে ভারতে তাঁরা এক নতুন রাজনৈতিক ভাবধারার প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন, যেটা মূলতঃ নিশ্চিত এবং চূড়ান্তরূপে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে সব সম্পর্ককে চুকিয়ে দিতে চেয়েছিল। তখনকার রাজনৈতিক দিক থেকে সেটা প্রগতিধর্মী ছিল। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে আপোষহীন সংগ্রামই তাঁদের নীতি ছিল, এবং সেটার জন্য তাঁরা সারা দেশ জুড়ে আন্দোলনের ব্যবস্থাও করেছিলেন। তৎকালীন কংগ্রেসী আন্দোলনের মধ্যে তাঁরা বিরোধীপক্ষের ভূমিকা নিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁদের সেই আন্দোলন কখনোই গণ-আন্দোলনের রূপ নিতে পারে নি। কিছু সীমিতসংখ্যক লোকের ব্যক্তিগত এষণাই সেই আন্দোলনের মূল অনুপ্রেরণা ছিল। প্রকৃতপক্ষে ওই আন্দোলন স্বল্পসংখ্যক বিক্ষুব্ধ নিম্ন-মধ্যবিত্ত-শ্রেণীতে নিহিত ছিল, জনগণের সাথে যেটার সংযোগই ছিল না। আর সেই কারণেই তাঁদের অভীষ্টসিদ্ধি অসম্ভবপ্রায় ছিল। এর ফলে, ওই আন্দোলন ব্যক্তিগত কয়েকজনের অরাজক কার্যধারায় পর্যবসিত হয়েছিল। ওই চরমপন্থী রাজনৈতিক আন্দোলনে কিছুটা অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্বের অস্তিত্বও ইতিহাস থেকে অনুধাবন করা যেতে পারে। রাজনৈতিক দিক থেকে যথেষ্ট উন্নত হয়েও সেই আন্দোলন, সামাজিক ও ধর্মীয় রক্ষণশীলতার দ্বারস্থ হয়ে ছিল, এবং সেই প্রাচীন রক্ষণশীল হিন্দু সামাজিক ও ধর্মীয় ব্যবস্থাকেই জাতীয় আন্দোলনের মূল উপজীব্য করতে চেয়েছিল। এরই ফলে সেই আন্দোলনের রূপ বেশ কিছুটা সাম্প্রদায়িকও হয়ে উঠেছিল। আধুনিক কালের একজন চিন্তাবিদের মতে, আন্দোলনটির সেই বিশেষ রূপ পরিগ্রহণের যথার্থ কারণ এটাই ছিল যে, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে সঙ্গে ভারতে যে সাম্রাজ্যবাদী বুর্জোয়া সংস্কৃতির প্রবর্তন ঘটতে শুরু করেছিল, সেকালের শিক্ষিত মধ্যবিত্তসমাজ, সেটার কোন বিকল্প খাড়া করতে পারেন নি। চরমপন্থীরা আসলে যতটা ছিলেন ব্রিটিশ শাসনের আনুষঙ্গিকের বিরোধী ছিলেন, ততটা পাশ্চাত্য-সভ্যতা বিরোধী ছিলেন না। তাঁরা সাম্রাজ্যবাদী প্রভুত্বের দোষগুলোকেই পাশ্চাত্য সভ্যতার অভিশাপ ভেবে ভুল করেছিলেন। ঊনিশ শতকের অধিকাংশ সামাজিক ও ধর্মীয় আন্দোলনই, অংশতঃ বা সামগ্রিকভাবে পুরাতন প্রতিষ্ঠিত সমাজ ও ধর্মব্যবস্থার মোহান্ধতায় নিহিত ছিল। এমন কি ১৮৫৭ খ্রীষ্টাদের সিপাহী বিদ্রোহও কিছুটা হলেও, নতুন নীতির বিরুদ্ধে প্রাচীনের জেহাদ ছিল। অবশ্য উপরোক্ত দু’ প্রকার ব্যাখ্যাই আপাতঃ অর্থে সত্যি; বর্তমান জ্ঞানের পরিধিতে সেসবের কোন নির্দিষ্ট ও চূড়ান্ত ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব নয়।

জাতীয় আন্দোলনের চরমপন্থীরা সাধারণতঃ বাল গঙ্গাধরের ব্যক্তিত্বকে কেন্দ্র করেই সঙ্ঘবদ্ধ হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন চিৎপাবন ব্রাহ্মণ ছিলেন। বোম্বাই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক হলেও, তাঁর ওপরে পশ্চিমী শিক্ষার প্রভাব সামান্যই পড়েছিল। তাছাড়া তিনি একজন সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত ছিলেন, এবং অচিরেই শিক্ষাব্রতী ও সাংবাদিক হিসেবে প্রখ্যাত হয়েছিলেন। তিলকের দৃঢ়সংকল্প চরিত্র, মনীষা ও পাণ্ডিত্য, ইংরেজী ও মারাঠী ভাষায় অসীম দখল এবং বাগ্মিতার জন্য, মহারাষ্ট্রে তাঁর গুণমুগ্ধ অনুগামীর সংখ্যা ক্রমেই বাড়তে শুরু করেছিল। পশ্চিমী সভ্যতার প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়েও তিলক কিন্তু তাঁর অভীষ্ট সাধনের জন্য পশ্চিমী বিপ্লবপন্থাকেই বেছে নিয়েছিলেন। তাঁর প্রথম কাজ ছিল দুটি সংবাদপত্রের প্রতিষ্ঠা – ‘কেশরী’ ও ‘মারাঠা’। সেই দু’টিরই বৈশিষ্ট ছিল উগ্র ব্রিটিশ বিরোধিতা, আর সেগুলির ভাষা ছিল আপোষহীনতার চরম নিদর্শন। অচিরেই, ‘রাণাডের’ নেতৃত্বাধীন বোম্বাই সমাজের প্রগতিশীল অংশের সাথে বিরোধ দেখা দিয়েছিল। সেই সুযোগে তিলক তাঁদের থেকে ‘পুণ্য সার্বজনিক সভা’, এবং ‘দাক্ষিণাত্য শিক্ষা সমিতি’ নামের সংস্থা দু’টিকে ছিনিয়ে নিতে চেয়েছিলেন। তবে সেই ব্যাপারে তিনি শুধু যে ব্যর্থ হয়েছিলেন তাই নয়, ওই দু’টি প্রতিষ্ঠান থেকেই তাঁকে বিতাড়িতও করা হয়েছিল। ইতিমধ্যে, ১৮৯০ খ্ৰীষ্টাব্দে ‘সহবাস সম্মতি আইনের’ বিলটি (Age of Consent Bill) পাশ হওয়ায়, তিলকের কর্মতৎপরতা আরো বৃদ্ধি পেয়েছিল। ওই সময়ে ‘কেশরী’তে প্রকাশিত কতগুলো প্রবন্ধে তিনি সরকারের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করেছিলেন। তাঁর বক্তব্য ছিল যে, সরকার হিন্দুদের প্রাচীন ধর্মীয় রীতিতে হস্তক্ষেপ করেছে, এবং হিন্দুরা প্রয়োজন হলে নিজেদের প্রাণের বিনিময়েও তাঁদের ধর্মীয় স্বার্থকে রক্ষা করবেন। তখন যে সমস্ত হিন্দুরা ওই বিলটির স্বপক্ষে ছিলেন, তাঁদেরও তিনি দেশদ্রোহী ও স্বধর্মত্যাগী আখ্যা দিয়েছিলেন। ফলে তিলকের সঙ্গে বোম্বাইয়ের প্রগতিপন্থী নেতাদের, যেমন ‘ভাণ্ডারকার’, ‘চন্দ্রাভরকর’ ও ‘গোপালকৃষ্ণ গোখলে’ প্রমুখের বিবাদ দেখা দিয়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিলক, ‘নাটু’ ভাইদের সহযোগিতায় সেই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে স্কুল-কলেজে জোর প্রচারকার্য চালাতে সমর্থ হয়েছিলেন, এবং ইংরেজ শক্তিকে আটকানোর জন্য বলপ্রয়োগের প্রয়োজনীয়তার ওপরে জোর দিয়েছিলেন। ওই সময়েই মহারাষ্ট্রে বিভিন্ন ব্যায়ামচর্চার আখড়া গড়ে উঠেছিল, এবং সেগুলোই পরে সশস্ত্র বিপ্লবের কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। ১৮৯৩ সালেই বোম্বাইতে একটা অবাঞ্ছিত হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা দেখা দিয়েছিল। অতঃপর তিলক ‘গো-রক্ষা সমিতি’ নামে একটি প্রতিক্রিয়াশীল সমিতি গঠন করেছিলেন, যেটার মূল উদ্দেশ্যই ছিল মুসলমানদের বিরুদ্ধাচরণ করা। আজও ঐতিহাসিকেরা অভিযোগ করেন যে, সেই সমিতি থেকে প্রকাশিত পুস্তকাদিতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার তীব্র উস্কানি দেওয়া হত। এরপরে তিলক বোম্বাইতে ‘গণপতি উৎসবেরও’ প্রবর্তন করেছিলেন। তখন প্রত্যেক বছর দশদিন ধরে সেই উৎসব পালন করা হত। এখনকার মত তখনও ওই উৎসবের সময়ে শোভাযাত্রা বের করা হত, এবং তাতে এমন কিছু আমোদ প্রমোদের আয়োজন থাকত, যেগুলি স্বভাবতঃই মুসলমানদের পক্ষে আপত্তিকর ও অস্বস্তিকর হয়েছিল। ফলে মুসলমানেরা ওই জাতীয় আমোদ-প্রমোদের বিরুদ্ধে নিজেদের আপত্তি জানিয়েছিলেন, এবং রাউলাট কমিটির রিপোর্টেও সেই উৎসব পরিচালকদের বিরুদ্ধে নানারকম অভিযোগ আনা হয়েছিল। তিলকের সময়ে ‘ম্লেচ্ছ’দের বিরুদ্ধে ঘৃণার মনোভাব জাগিয়ে তোলবার জন্য গণপতি উৎসবে বিভিন্ন ধর্মীয় সঙ্গীতানুষ্ঠান, এবং ধর্মীয় শ্লোক আবৃত্তির ব্যবস্থাও করা হয়েছিল; তাছাড়া ওই উৎসবের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তখন ভারতে বিদেশী শাসনের প্রতি নিন্দার সঙ্গে সঙ্গে মুসলমানদের আচার ব্যবহারের নিন্দা করাও চলত। সুতরাং ঐতিহাসিকদের মতে, তিলক প্রবর্তিত ‘গণপতি উৎসব’ তখন অংশতঃ সাম্প্রদায়িক এবং অংশতঃ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ছিল। উক্ত সময়ে ‘পুণা সার্বজনিক সভা’র মত মিতাচারী সংস্থাও সেই উৎসবের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলতে উদ্যত হয়েছিল। শিবাজীই প্রথম মোঘল শাসনের বিরুদ্ধে মারাঠাদের একত্র করেছিলেন; তিলক তাই শিবাজীর স্মৃতি-স্তম্ভ সংস্কার সম্পর্কীয় একটা আন্দোলন গড়ে তোলবার বিষয়ে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন, এবং শিবাজীর স্মৃতির উদ্দেশ্যে একটি উৎসবের প্রবর্তন করেছিলেন। সেই ‘শিবাজী উৎসবের’ মাধ্যমে তিলক মারাঠাদের মধ্যে একটা বলিষ্ঠ জাতীয়তাবোধের সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন, এবং দেশবাসীকে শিবাজীর আদর্শ অনুসরণের জন্য আবেদন জানিয়েছিলেন। ১৮৯৫ সালের প্রথম শিবাজী উৎসবের সময়ে একটি সংস্কৃত শ্লোকের সাহায্যে হিংসাত্মক কার্যকলাপের প্রতি খোলাখুলি আস্থা ঘোষণা করা হয়েছিল, এবং একজন ব্রাহ্মণ মহৎ লোকেরা নৈতিকতার সাধারণ আদর্শের ঊর্ধ্বে বলে শিবাজীর সঙ্গে আফজল খাঁর সংঘর্ষকে সমর্থন জানিয়েছিলেন। তখন একথাও বলা হয়েছিল যে, নিঃস্বার্থ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপরাধও সমর্থনীয়। উক্ত সময়ে তিলক দেশবাসীকে পেনাল কোডের বাধ্যবাধকতার বাইরে এসে শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার উচ্চমার্গে প্রবেশ করবার উপদেশ দিয়েছিলেন। এরপরে তিলক তদানীন্তন বোম্বাইয়ের বিধান পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। সংসদের মধ্যেও তাঁর বক্তৃতার ভাষা, তাঁর গণভাষণ ও সম্পাদকীয়ের ভাষার মতই উগ্র ছিল। পরিষদে চরমপন্থীদের মনোভাব ও অনুভূতি তাঁর মধ্য দিয়ে বাণীরূপ পেয়েছিল। দাক্ষিণাত্যে ১৮৯৬ সালে মর্মান্তিক দুর্ভিক্ষের সময়ে তিলক খাজনা-বন্ধ আন্দোলন সংগঠিত করেছিলেন। সেই সময়ে তিনি দুর্ভিক্ষ-পীড়িত অঞ্চলগুলির রায়তদের কাছে নিজস্ব প্রতিনিধি পাঠিয়ে এই মর্মে মিথ্যা ঘোষণা করতে বলেছিলেন যে, সরকার ঐ বছরের জন্য রাজস্ব সংগ্রাহকদের কর আদায় করতে নিষেধ করেছেন। তাঁর সেই কৌশল বেশ ভালোভাবেই কাজ করেছিল। এরপরে বোম্বাইতে চাপেকার ভাইদের একজন, রাণী ভিক্টোরিয়ার মূর্তিটির ক্ষতি সাধন করেছিলেন। ওই ধরনের বৃটিশ-বিরোধী মনোভাবের প্রকাশ ছাড়াও সেই আন্দোলন খুব শীঘ্রই একটা কদর্য রূপ নিয়েছিল; যেমন – ভারতীয় মডারেটদের রাস্তায় নিগ্রহের চেষ্টা, এবং গুণ্ডামী ইত্যাদির দ্বারা অরাজক অবস্থার সৃষ্টি করা। চাপেকার ভাইয়েরা ‘হিন্দুধর্মের প্রতিবন্ধক দূরীকরণ সমিতি’ নামে (যদিও নামটা কিছুটা প্রতিক্রিয়াশীল) একটা বিদ্রোহী সংস্থাও গঠন করেছিলেন। ইতিমধ্যে বোম্বাইতে প্লেগ রোগ দেখা দিলে সরকার প্রতিবিধানের সুব্যবস্থার জন্যে ‘W. C. Rand’-এর হাতে ক্ষমতা দিয়েছিলেন। প্লেগ নিবারণে র‍্যাণ্ডের ব্যবস্থা মারাঠী সমাজের গোঁড়া লোকেদের মনঃপূত হয়নি। উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে যে, র‍্যাণ্ড বৃটিশ সৈন্যদের দ্বারা তৎকালীন বোম্বাইয়ের প্রতিটি ভারতীয় গৃহের স্বাস্থ্য-ব্যবস্থা পরিদর্শনের জন্য গৃহতল্লাসীর ব্যবস্থা করেছিলেন। সত্য-মিথ্যা যাই হোক না কেন, সেই সৈন্যদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ক্ষেত্রে আতিশয্যের অভিযোগ আনা হয়েছিল, এর ফলে সরকারকে উগ্র সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছিল। ১৮৯৭ সালে র‍্যাণ্ডের ব্যবস্থার তীব্র সমালোচনা করে ‘কেশরী’তে পর পর কয়েকটি প্রবন্ধ ছাপা হয়েছিল, এবং সেই বছরেরই ২২শে জুন তারিখে, চাপেকার ভাইদের হাতে র‍্যাণ্ড এবং আয়ার্টের মৃত্যু ঘটেছিল। আধুনিক ভারতের ইতিহাসে সেটাই প্রথম রাজনৈতিক হত্যা ছিল, এবং অভিযুক্ত ব্যক্তিদের স্বীকারোক্তি থেকে জানা গিয়েছিল যে, ওই হত্যাকাণ্ডের প্রেরণা হিসেবে তিলকের চিন্তা ও প্রচার কার্যকরী ভূমিকা নিয়েছিল। সেই হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত অভিযুক্ত ব্যক্তিরা আদালতে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছিলেন, এবং ওই বিচারে তিলকেরও ১৮ মাস সশ্রম কারাদণ্ডের আদেশ হয়েছিল। বিচারকদের মতে, উক্ত সময়ে ‘কেশরী’তে প্রকাশিত প্রবন্ধগুলি প্ররোচনা ও রাজদ্রোহমূলক ছিল। এক বছর পরে তিলক জেল থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন। কিন্তু ১৮৯৯ সালেই মহারাষ্ট্রে আরো দুটো রাজনৈতিক হত্যার (সরকারী গুপ্তচর হত্যা) পরিকল্পনা ও রূপায়ণ হয়েছিল। চাপেকার ভাইদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত সমিতির কয়েকজন সভ্য সেই হত্যাকাণ্ডের মূলে ছিলেন। তিলকের কারাদণ্ড অথবা সরকারের দমননীতি, কোনটাই কিন্তু মহারাষ্ট্রে তিলকের প্রভাবকে বিন্দুমাত্র কমাতে পারেনি। এরপরে ‘কেশরী’ আরো উগ্র ভাষায় প্রকাশিত হতে শুরু করেছিল, এবং তিলক যথার্থই জাতীয় নেতা হয়ে উঠেছিলেন। ১৮৯৭ সালের কংগ্রেসে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তিলকের প্রতি তাঁর সর্বান্তঃকরণ সমর্থন জানিয়ে বলেছিলেন যে, তিলকের বন্দী অবস্থা সমগ্র দেশকে শোকাচ্ছন্ন করেছে। তৎকালীন বঙ্গদেশেও বঙ্গভাষী পত্রিকাগুলিতে কেশরীর অনুকরণে খোলাখুলি বিপ্লবাত্মক ভাবনা ও প্রেরণা প্রকাশিত হতে শুরু করেছিল।

ইতিহাস বলে যে, তিলকের সেই চরমপন্থা বিপ্লবী রাজনীতির উদ্ভবে অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছিল, এবং ভারতের অন্যান্য অংশের কাছে আদর্শ হয়ে উঠেছিল। ভারতবর্ষে পরবর্তীযুগের বিপ্লবী আন্দোলন তিলকের ধারণা এবং সংগঠন প্রণালীকে, প্রায় পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অনুসরণ করেছিল। তিলক পরিচালিত আন্দোলনে রাজনৈতিক উগ্রতা ও সামাজিক প্ৰতিক্রিয়ার এক বিপত্তিকর সম্মিলন হয়েছিল বলে ঐতিহাসিকেরা মনে করেন। সেই অদ্ভুত সংমিশ্রণের প্রভাব মারাঠী জাতীয় আন্দোলনের ইতিহাসেই ছড়িয়ে পড়েছিল। এর ফলে, রাজনৈতিক সচেতনতার প্রসার বিলম্বিত হয়েছিল, আর ভারতীয় শিক্ষিত সমাজে উদারনৈতিক রাজনীতির বিস্তারও বিনষ্ট হয়েছিল। আরও দুর্ভাগ্যজনক হল যে, সেসবের ফলে তখন এদেশের প্রগতিশীল শক্তিগুলির মধ্যেও নীতিগত বিরোধ দেখা দিয়েছিল। তক্ষকের রাজনীতিতে যাঁরা মিতাচারী ছিলেন, তাঁরা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে চরমপন্থীদের চেয়ে উন্নত ছিলেন বলে গবেষকরা মনে করেন। আবার জওহরলালের পিতা পণ্ডিত মতিলাল নেহেরু তৎকালীন রাজনীতিতে সেই মডারেটদের শ্রেণীভূক্ত না হলেও, তিলকের প্রতিক্রিয়াশীলতার প্রতি তাঁর কোন সহানুভূতিই ছিল না; সুতরাং তিনি তিলকের সাথে কখনোই হাত মেলান নি। তাছাড়া ওই আন্দোলন কিছুটা সাম্প্রদায়িক রূপ নেওয়ার ফলে সেখান থেকে মুসলমানদের বাদ দিতে বাধ্য হতে হয়েছিল। ওই আন্দোলনের প্রত্যক্ষ ফলসমূহ দুর্বল, এবং কতগুলি ব্যক্তিগত পর্যায়ের বিপ্লববাদী কর্মধারার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু সেই ব্যক্তিগত পর্যায়ের বিপ্লববাদ ভারতে ও অন্যান্য দেশে ব্রিটিশ রাজের মনে গভীরভাবে রেখাপাত করতে সমর্থ হয়েছিল। ফলে ভারতের জরুরী অবস্থা সম্পর্কে ইংরেজরা যথেষ্ট সচেতন হয়ে উঠেছিলেন।

(তথ্যসূত্র:
১- Bal Gangadhar Tilak: His Writings And Speeches.
২- Indian Unrest, Valentine Chirol.
৩- A History Of The Indian Nationalist Movement, Verney Lovett.
৪- The Sedition Committee Report, 1918.
৫- The Tilak Trial, 1897.)

‘চর্যাপদের যুগে বাংলার সামাজিক অবস্থা’ (দ্বিতীয় পর্ব)

রানা চক্রবর্তীঃ এবারে ‘ময়নামতির গান’ অনুসরণ করে একাদশ শতকের বাঙালীর সামাজিক রীতিনীতির চিত্তের সন্ধান করা যাক। তখন ব্রাহ্মণদের দরবারী বেশভূষা কি ছিল? ধুতি শালকিরাণি, চটক ও মটক, কোমরবন্ধ, চল্লিশ পাগড়ি (চল্লিশ বার পাক দিয়ে যেটা তৈরী করা হত), এক হাতে অঙ্গদ, অপর হাতে বলয়, কণ্ঠে স্বর্ণ-মালা, গলায় জোড়া জোড়া পৈতা, কক্ষে একরাশি পুঁথি – ঠিক যেন হিন্দুস্তানী ব্রাহ্মণ পণ্ডিত। আলবেরুনি তাঁর লেখায় একাদশ শতকের বাংলার পুরুষদের অলঙ্কার ও প্রসাধন-প্রীতি কথার ঐতিহাসিক সাক্ষ্য দিয়ে গিয়েছেন। তিনি লিখেছিলেন যে, তখন পুরুষেরাও স্ত্রীলোকের মত যেমন প্রসাধন-দ্রব্য ব্যবহার করতেন, তেমনি অলঙ্কারও পড়তেন; যথা – কানে মাকড়ি, হাতে বালা, হাতের আঙুলে আর পায়ের বুড়ো আঙুলে নানা ধরণের আংটি। এর পাশেই ‘হীর নটি’র বেশভূষার বাহারের যে বর্ণনা পাওয়া যায়, সেটা এরকম – নাসের কাকই, বহুপ্রকারের খোঁপা (নিচু করে চুল বাঁধলে সেটাকে বলা হত ‘খোপ্যক’, আর উঁচু করে চুল বাঁধলে সেটাকে বলা হত ‘ঘোড়াচূড়’ বা ঘোড়াচুলা), নিয়র-মেলানি শাটী (মসলিন), নাকের নত (নথ), হেট কানে (কানের লতিতে) পেন্দে ঢেরি, উপর কানে চাকি, শতেশ্বরি হার, পায়ে বাঁকামল, সোনার কাচলি (কাঁচুলি), আর হরে পানের খিলি। বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, ওই সময়ের নিয়র-মেলানি শাড়ি এত সূক্ষ্ম হত যে, রাতে সেটাকে দেখা যেত না; ফলে ওই শাড়ি পরে থাকলেও রাতে নটিকে বিবসনা বলেই বোধ হত – “শাড়ি আর নটি গেইল মিলিয়া।” তখনকার ভদ্র বাঙালী পরিবারের মেয়েদের বেশবাশ ছিল – নিচের হাতে শাঁখা, উপরের হাতে ‘বাহ খড়’, গলায় সাতেসরী বা দেবচ্ছন্দ হার, মাথায় হংসপদিকা, কানে সোনার তারঙ্গ বা কচি তালপাতার অবতংস তালীপত্র (কুণ্ডল হিসাবে), আর পরনে সূক্ষ্ম কার্পাসবস্ত্র, মলমল বা পাটের কাপড়; সেই কাপড়গুলোর নামও ছিল বিচিত্র, যথা – ‘মেঘ-উদুম্বর’, ‘গঙ্গাসাগর’, ‘লক্ষ্মীবিলাস’, ‘দ্বারবাসিনী’, ‘সিলহটি’, ‘গাঙ্গেরী’ ইত্যাদি আরো কত নাম! এছাড়া ছিল পট্ট ও নেতবস্ত্র (সিল্ক)। পাটের শাড়ির প্রচলন বাংলায় এখনো থাকলেও, ‘নেতের’ অধোগতি হতে হতে এখন সেটা ঘর পরিষ্কার করবার ‘ন্যাতা’য় পরিণত হয়েছে, যদিও উড়িষ্যায় সেটার গৌরব এখনো অক্ষুণ্ণ রয়েছে। উপরোক্ত সব কাপড়ই তখন বাংলাতেই তৈরী করা হত। ওই সময়ে বাংলার প্রতিটি ঘরেই ‘মলমলের’ সুতা কাটা হত। তখন বাঙলার তৈরী কাপড়ের কদর সারা উত্তর ভারত জুড়ে ছিল; আর তাতে বাঙলার ঘরে ঘরে আর্থিক স্বচ্ছলতা এসেছিল। তখন শুধু বাংলায় নয়, ভারতবর্ষের সর্বত্রই সবাই পান চিবাতে অভ্যস্ত ছিলেন। তাম্বুল দান ও গ্রহণ তখনকার ভারতীয় সভ্যতার এক অঙ্গবিশেষ ছিল। কবে থেকে যে সেই রীতিটির সৃষ্টি হয়েছিল, সেটা বলা যেমন দুষ্কর, তেমনি তাম্বুল-লতার উদ্ভবের কথাও ইতিহাসে অজ্ঞাত। অথচ, ভারতের ইতিহাসের সব শতকেই কিন্তু তাম্বুলের প্রতিপত্তির কথা পাওয়া যায়। তখন ধনীদের সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের তাম্বুলবাহী সেবকও ঘুরে বেড়াতেন। ওই সময়ে আদর-আপ্যায়নে পানের স্থান সবার উপরে ছিল; পানের জায়গায় ‘তামাক’ এসেছিল অনেক পরে – মাত্র ষোড়শ শতকে। তখন শুধু সধবারাই নন, বিধবারাও পান খেতেন। ‘ময়নামতীর গানের’ ময়না যে পান খেতেন, তাতে থাকত – লং (লবঙ্গ), জায়ফল, এলাঞ্চি (এলাচ), দালচিনি (দারুচিনি), গুআমুরি, ধনিয়া, করপুর ও জৈষ্ঠমধু (যষ্টিমধু)। সেকালেও বিবাহের কথা পাকা হলে ‘দরগুআ’ করা হত; অর্থাৎ, তখনও শুভ সংবাদে ‘গুয়াপান’ বিলানো হত। এই প্রসঙ্গে বলে রাখা দরকার যে, সুপারি কথাটা কিন্তু কোনও আধুনিক শব্দ নয়; চতুর্দশ শতকের বাংলা সাহিত্যে ‘সিপরি’ নামে এর স্পষ্ট উল্লেখ পাওয়া যায়। তখন সবাই ছবিও আঁকতেন; হয়ত গুপ্তযুগে, অর্থাৎ, চতুর্থ, পঞ্চম শতকে চিত্রাঙ্কন-বিদ্যার ব্যাপক প্রসারের ফলেই সেটা সম্ভব হয়েছিল। ওই সময়ের গরীবেরাও নিজেদের ঘরের দেওয়ালে অন্ততঃ দুটো ময়ূরের ছবি এঁকে রাখতেন। বেণেদের বাড়ীর দু’পাশে তখন দুটো টাকার থলি, তার সঙ্গে একপাশে একটা শাঁখ আর অন্যদিকে একটা পদ্ম আঁকা থাকত। ছবি আঁকার ব্যাপারটা তখন গৃহসজ্জার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে ছিল। শুধু তাই নয়, তখন নারী হোন বা পুরুষ, তাঁরা সকলেই কিন্তু নাচতে জানতেন। তবে মেয়েরা যে তাতে বিশেষভাবে পারদর্শী ছিলেন, তাতে কোন সন্দেহ নেই। ওই সময়ের নটীরা শুধু নন, নিতান্ত সাধারণ ভদ্র পরিবারের মেয়েরা, এমনকি রাজবাড়ির রাজবধূও নৃত্য পটিয়সী ছিলেন। ময়না নিজেই রাজবধূ ছিলেন – “ময়না গর খ্যামটা আড়খ্যামটা নাচে হাততালি দিয়া”।
ইতিহাস বলে যে একাদশ শতকে পৌঁছেও বাঙালীর সমাজ কিন্তু তখনও দানা বাঁধতে পারেনি। সমাজের উচ্চপর্যায়ে তখন যেমন ‘গুভাজু’ বা সদ্ধর্মী বা বৌদ্ধ ও ‘দেবভাজু’ বা হিন্দুর মধ্যে একটা লড়াই চলছিল, তেমনি সমাজের নিম্নপর্যায়ে তখন সম্পূর্ণ স্বতন্ত্রভাবে বিপুলসংখ্যক বাঙালী – তাঁতি, ডোম, বাগদী, হাড়ী, শবর ইত্যাদি বাস করছিলেন। ওই সময়ে সমাজের উচ্চপর্যায়ের সঙ্গে নিম্নপর্যায়ের কোনো সম্পর্কই ছিল না, সমাজের নিম্নপর্যায়ের মানুষেরা তখন শহর ও গ্রামের বাইরে থাকতেন। তাঁরা তথাকথিত অন্ত্যজ, অস্পৃশ্য ছিলেন। আলবেরুনি তাঁর লেখাতে একাদশ শতকের বাংলার সমাজের সেই সামগ্রিক বিচ্ছন্নতার কথা স্পষ্টভাবেই উল্লেখ করেছিলেন। একাদশ শতকের মধ্যভাগে ভারতে এসে তিনি বহুদিন ধরে এখানে বাস করেছিলেন। তৎকালীন বাংলার সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে তাঁর লেখা থেকে যা জানা যায়, সেটার কিছুটা অংশ এরকম – “অন্ত্যজ গোষ্ঠীর এক-একটি জাতি এক-একরকমে সমাজসেবা করে; সেবাই তাঁদের পেশা। তাঁদের বৃত্তি আট প্রকারের – রজক, চর্মকার, ঐন্দ্রজালিক, বেত ও বাঁশের তৈরী জিনিসের কারিগর, নৌ-চালক, মৎস্যজীবী, ব্যাধ অর্থাৎ মৃগয়াজীবী ও তাঁতী। রজক, চর্মকার ও তাঁতীর সঙ্গে অন্য পাঁচটির কোনো বৈবাহিক সম্পর্ক নেই; নিজ নিজ দলের মধ্যেই তাঁদের বিবাহাদি চলে। অন্য পাঁচটি দলের মধ্যে বিবাহাদি চলে। … হাড়ী, ডোম (ডোম্ব) ও চণ্ডাল শ্রেণীর মানুষ কোনো বিশিষ্ট বৃত্তিভোগী বলে গণ্য হয় না; তাঁরা নানা ধরণের কাজকর্ম করে। যে যে বৃত্তি অবলম্বন করে সেই অনুসারেই তাঁদের শ্রেণীবিভাগ করা হয়। মোটের উপরে তাঁদের সংকরশ্রেণী বলেই ধরা হয়; তাঁরা উচ্চশ্রেণীর বর্ণ-সংকর বিবাহজাত পুত্রকন্যারূপে অধঃপতিত। তাঁদের মধ্যে হাড়ীকে একটু উচ্চপর্যায়ে ধরা হয় – তাঁদের পরিচ্ছন্নতার জন্য। ডোমের স্থান এরই পরে; তাঁরা বাঁশি বাজায় ও গান করে।” তবে ওই সময়ের ডোমেদের বা ডোম্বদের বৃত্তি সম্পর্কে আলবেরুনির মন্তব্য ইতিহাসগতভাবে প্রামাণিক নয়; কারণ সমসাময়িক অন্য সব পুঁথিতেই সেই সময়ের ডোমদেরকে বাংলার দুর্ধর্ষ ঘোড়সওয়ার সেনা হিসাবে চিত্রায়িত করা হয়েছে। ওই সময়ের “ডোমকে নেই যমের ভয়”, “ডোমের পুত যমের দূত” – বর্তমানে বাঙলার প্রবাদবাক্যে পরিণত হয়েছ গিয়েছে, আর –
“আগডোম বাগডোম ঘোড়াডোম সাজে
ডাল, মৃগল ঘাঘর বাজে,
বাজতে বাজতে পড়ল সাড়া
সাড়া গেল বামনপাড়া।”
এই কিছুকাল আগেও বাঙলার শিশুদের ছড়ার বই আলো করে থাকত। ওই বাগদীরা পদাতিকও ছিলেন; তাঁরা ছিলেন দুর্ধর্ষ ও বিশালকায়, তাঁদের মাথায় ছিল বাবরিকাটা চুল, তাঁদের হাতে থাকত একটা বড় বাঁশের লাঠি, যেটার নাম ছিল ‘রায় বাঁশ’। তাঁরাই হয়ত বাংলার ‘রায়বেঁশে নাচের’ আদি কর্তা।

আরো পড়ুন- ‘চর্যাপদের যুগে বাংলার সামাজিক অবস্থা’, (প্রথম পর্ব)

তখনো বাঙালী সমাজে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সৃষ্টি হয়নি, সেটা আরো অনেক পরে হয়েছিল। তখনকার সমাজের একদিকে ছিলেন মুষ্টিমেয় মহাযানী বা শূন্যবাদী বৌদ্ধ সওদাগর ও অভিজাত সম্প্রদায়রা, আর সমাজের অন্যদিকে তাঁদের সঙ্গে পাল্লা দিতেন অল্পসংখ্যক হিন্দু ব্রাহ্মণ ও ব্রাহ্মণেতর জাতি, নানা বৃত্তিজীবী কিন্তু বিত্তশালী মানুষেরা। তাঁরা মূলতঃ পৌরাণিক ধর্মী হলেও, বৈদিক ধর্মী ছিলেন না; হয়ত তাঁদের বেশিরভাগই তখন বিষ্ণু-উপাসক ছিলেন, কারণ পালযুগের সকল ক্ষেত্রেই পালরাজাদের মন্ত্রীরা বিষ্ণু-উপাসক ছিলেন বলে ইতিহাস থেকে দেখা যায়। তাই বলে শাক্তরা যে তখন একেবারেই ছিলেন না, তা নয়। ‘শ্রীধর দাস’ সংকলিত ‘সদুক্তিকর্ণামৃত’ গ্রন্থেই সেই প্রমাণ লিপিবদ্ধ রয়েছে। উক্ত গ্রন্থটি ত্রয়োদশ শতকের আগে সংস্কৃত ভাষায় রচিত বিভিন্ন কবির নির্বাচিত কবিতাংশের একটি প্রখ্যাত ঐতিহাসিক সংকলন। ঐতিহাসিকদের কাছে ওই গ্রন্থটি ভারতের সংস্কৃত সাহিত্যের অন্যতম প্রাচীন সংকলনের মধ্যে একটি বলে গণ্য হয়। গ্রন্থটিতে ‘শতানন্দ’ নামক একজন কবির একটি কালীধ্যান রয়েছে। কালী মার্কণ্ডেয় পুরাণোক্ত চণ্ডিকারই রুদ্র রূপ। পুরাণের মধ্যে ‘বায়ুপুরাণ’ সর্বাপেক্ষা প্রাচীন বলে ইতিহাসে গণ্য হয়; আর তারপরেই প্রাচীনত্বের দিক থেকে মার্কণ্ডেয় পুরাণের স্থান। মার্কণ্ডেয় পুরাণ রচনার কাল সঠিকভাবে বলা দুষ্কর, তবে সেটি চতুর্থ শতক রচিত হয়েছিল বলে ঐতিহাসিকেরা অনুমান করে থাকেন। কালী বাঙালীর প্রিয়তম দেবী। তবে যে রূপে তিনি এখন পূজিত হন, সেটা অবশ্য অনেক পরে এসেছে, এবং কেন উক্ত দেবীটি বাঙালীর জীবন- সূত্রের সঙ্গে একান্তভাবে গ্রথিত হয়ে গিয়েছেন, সেটার মূলও অন্যত্র রয়েছে। কিন্তু এই প্রবন্ধটি সেকথা আলোচনার উপযুক্ত স্থান নয় বলে, এই প্রসঙ্গটি আপাততঃ মুলতবি রাখা যেতে পারে। ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, শতানন্দ নবম শতকের প্রথমার্ধে পালরাজাদের রাজকবি ছিলেন। আর্যা ছন্দে লেখা তাঁর কালীবন্দনার শ্লোকাংশটি নিম্নরূপ –
“জয়তি তব কূপিতেক্ষণমশ্বত্যা দশনপেষমসুরাস্থি।
কল্পশিখিস্ফুটদদ্রিক্কাণকরালঃ কউকার॥”
(ক্ষণ = রাত্রি; পেষ = পিষ্ট করা, চর্বিত করা; কল্প = মাদক দ্রব্য)
তখন ব্রাহ্মণদের মধ্যে যাঁরা পণ্ডিতশ্রেণীর ছিলেন, তাঁরা সবাই স্মার্ত ছিলেন; তাই শ্রুতি নিয়ে তাঁদের কারবার বেশি ছিল না। তাঁদের মতে বেণেরা যেহেতু শূদ্র ছিলেন, তাই গৃহ্যসূত্রোক্ত সংস্কার হলেই তাঁরা চাতুর্বর্ণ্য সমাজে স্থান পেতে পারতেন। মজার ব্যাপার হল যে, ওই সময়ের বাংলার বৌদ্ধেরা যেমন বুদ্ধের মন্দিরে ধূপধুনা দিতেন, তেমনি আবার মনুসংহিতার অনুশাসন মেনে চলতেন, এবং ব্রাহ্মণ পুরোহিত দিয়ে দশকর্মও করাতেন। তবে তখনকার সেই উচ্চতর সমাজের বাইরে বাঙালীর যে বৃহত্তম অংশটি ছিল, তাঁদের সঙ্গে উচ্চতর সমাজের কারো কোন ধরণের যোগাযোগই ছিল না; না বৌদ্ধদের, আর না পৌরাণিক ধর্মীদের। বস্তুতঃ তাঁদের ধর্ম বিভিন্ন আর সমাজ মূলতঃ গোষ্ঠীসীমাবদ্ধ ছিল। ধর্মের দিক থেকে হয় তাঁরা বৌদ্ধ সহজপন্থী, অর্থাৎ লুইসিদ্ধার চ্যালা ছিলেন, আর নয়ত নাথপন্থী ছিলেন; তখন সহজপন্থী ও নাথপন্থীদের মূলগত দৃষ্টিভঙ্গিতে ও সাধনপন্থায় বিশেষ কোন পার্থক্য ছিল না। ওই নাথপন্থীরা পূর্বভারতীয় তান্ত্রিক পর্যায়ের এক বৃহৎ শৈব সম্প্রদায়ভুক্ত গোষ্ঠী ছিলেন। ঐতিহাসিকদের মতে নবম বা দশম শতকে, সম্ভবতঃ চন্দ্রদ্বীপে, অর্থাৎ পূর্ববাঙলার অধুনাতন বাখরগঞ্জ জেলায় সেই পন্থার জন্ম হয়েছিল। মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে ভেলকি বা নিম্নস্তরের যাদুবিদ্যায় অশেষ পারদর্শিতা অর্জনই তখন নাথপন্থীদের পরম লক্ষ্য ছিল। তাঁদের মধ্যে যাঁরা তখন সেই লক্ষ্যে পৌঁছে যেতেন, তাঁদেরকেই ‘নাথ’ বলা হত। তাঁরা সবাই সমাজের নিম্নস্তরের লোক ছিলেন, তাই তাঁদের রচিত তান্ত্রিক গ্রন্থের সংস্কৃত ভাষাও অশুদ্ধ ও দুর্বোধ্য। তবে আধুনিক সময়ের গবেষকদের মতে হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মন্তব্য হয়ত আংশিক সত্যি। ময়নামতির গানের ময়নামতী ‘গোরক্ষনাথের’ শিষ্যা ছিলেন, ‘হাঁড়িপা’ বা ‘হাঁড়িপাদ’ও তাই ছিলেন। গবেষকদের মতে হাঁড়িপা বাঙালী হলেও গোরক্ষনাথ হয়ত পাঞ্জাবী ছিলেন। প্রবাদ রয়েছে যে, গোরক্ষনাথই নাকি কালীঘাটের কালীকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। অবশ্য এই প্রবাদের কোন ঐতিহাসিক ভিত্তি পাওয়া যায় না। ‘মৎস্যেন্দ্রনাথ’ উক্ত সময়ের নাথসিদ্ধদের অন্যতম শীর্ষমণি ছিলেন, কিন্তু তাঁর প্রকৃত পরিচয় নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে বহু তর্কবিতর্ক রয়েছে। তবে যেটা নিয়ে কোন মতদ্বৈধ নেই, সেটা হল যে, মৎস্যেন্দ্ৰনাথই মহাযান বৌদ্ধপন্থার সঙ্গে নাথপন্থার মিলন ঘটিয়েছিলেন। তাই নাথপন্থা বৌদ্ধমতেরই অঙ্গ হয়ে গিয়েছিল। অনেকের মতে সেই সময়ের নাথপন্থীদের ভেলকিবাজির মূলে হয়ত অথর্ববেদের মন্ত্রই ছিল, যা পরবর্তীকালে তান্ত্রিক সাধনায় পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিল। অথর্ববেদ সংকলিত হয়েছিল ঋগ্বেদের পরে, কিন্তু তা বলে এটা মনে করবার কোন কারণ নেই যে, অথর্ববেদে গ্রথিত অনেকগুলি মন্ত্রই ঋগ্বেদ রচনার আগেই রচিত হয়নি। কারণ, মানুষ সেই আদিম কাল থেকেই মরণাপন্ন রোগে, শত্রুদমনে, পুত্রলাভের আশায়, সর্পভয় দূর করতে, এবং অন্যান্য অনুরূপ কারণে মন্ত্র-তন্ত্র, তুকতাকের আশ্রয় গ্রহণ করেছিল। অথর্ববেদের অনেকাংশই সেই ধরণের মন্ত্র-তন্ত্রে ভর্তি রয়েছে। অর্থবদেবের ভাষ্যকার ‘সায়ণ’ বলেছিলেন যে, অতীতের রাজাদের জন্য অথর্ববেদ অপরিহার্য ছিল; তখন রাজপুরোহিতকেও অথর্ববেদের উপরে দখল রাখতে হত। সেই সময়ের সর্বসাধারণের কাছেও, বিশেষ করে গৃহস্থের কাছে, ওই সব মন্ত্র বা প্রক্রিয়ার মূল্য সমধিক ছিল, তাই সেগুলির অনেকাংশ পরে গৃহ্যসূত্রেও স্থান পেয়েছিল। লক্ষ্যণীয় যে, মানুষের, বিশেষ করে হিন্দুদের মন থেকে এই সংস্কার কখনো যায় নি। তাই আজও সিংহভাগ হিন্দু তুকতাকে বিশ্বাস করে থাকেন। বলা বাহুল্য যে, হিন্দুধর্মে যুগযুগ ধরে প্রচলিত শান্তি-স্বস্ত্যয়ন, প্রায়শ্চিত্ত প্রভৃতি ওই সব তুকতাকেরই রকমফের মাত্র; সুদূর অতীতের তাবিজ, কবচ, ঝাড়ফুঁক, সাপের মন্ত্র প্রভৃতিরই সমগোত্রীয়। এই কথাটা রূঢ় হলেও ঐতিহাসিক দিক থেকে সত্যি। কারো কারো মতে, বুদ্ধের জ্ঞাতসারেই তাঁর শিষ্যদের মধ্যে অনেকেই তখন তন্ত্র-মন্ত্রের সাধনাও করতেন। তাঁদের ঐন্দ্রজালিক ক্ষমতার কথা ‘বিনয় পিটকের’ কোনো কোনো গল্পেও পাওয়া যায়। ঐতিহাসিকদের মতে বৌদ্ধসঙ্ঘেই তান্ত্রিক সাধনার সূচনা ঘটেছিল, এবং প্রথম বৌদ্ধতন্ত্র লেখা হয়েছিল ‘গুহ্যসমাজে’ – যেটার জন্মকাল ছিল খৃষ্টীয় তৃতীয় বা চতুর্থ শতক। এটার দ্বিতীয় ধাপ দেখা দিয়েছিল ‘সংগীতি’র আকারে, সেটাও মহাযানপন্থার পরবর্তীকালে; এবং উক্ত পন্থার সহজ ছিদ্রপথের মাধ্যমে সেসব জিনিস বৌদ্ধধর্মের মধ্যে অনুপ্রবেশও করেছিল। এরপরে জনসাধারণের পরম চিত্তগ্রাহী হয়ে এসেছিল হিন্দুদের পৌরাণিক পূজা। ফলে, পৌরাণিক ধর্মের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় মহাযানকেও বিভিন্ন তান্ত্রিক দেবদেবীর সন্ধানে তৎপর হতে হয়েছিল। সেই ক্রমবর্ধমান প্রতিযোগিতার ফলে পৌরাণিক ধর্মেও একটা সময়ে তান্ত্রিক সাধনা ঢুকে গিয়েছিল, যেটা অনেক ক্ষেত্রেই বৌদ্ধতান্ত্রিক সাধনার রূপান্তর মাত্র ছিল। তখন সমগ্র পূর্বাঞ্চলে, বিশেষ করে বাঙলায় ও প্রাগজ্যোতিষপুরে, বৌদ্ধধর্মের মহাযান পন্থা ও হিন্দুদের পৌরাণিক ধর্মের মধ্যে বিষম প্রতিযোগিতা ও দ্বন্দ্ব শুরু হয়ে গিয়েছিল, যার ফলে কালক্রমে ওই উভয় ধর্মকেই অতিক্রম করে সর্বত্র তান্ত্রিকবাদই প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল। তাই বাঙালীর পৌরাণিক ধর্মের মধ্যে বারো আনাই তান্ত্রিক খাদ মেশানো বলে গবেষকরা মনে করে থাকেন। এই তান্ত্রিকতার পটভূমিকাই বাঙালীর প্রকৃত পরিচয় – এই কথা বিস্মৃত হলে বাঙালীর জাতীয়-মানস স্পষ্ট করে বোঝা সম্ভব নয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে যে, ‘ষোড়শমাতৃকা’ পূজা তান্ত্রিক অথচ, এই পূজাটি প্রথমে না করে বৈদিক কর্ম – অন্নপ্রাশন, উপনয়ন, বিবাহ প্রভৃতি করা বাঙালী সমাজে আজও বিধিবহির্ভূত। এরকম আরো দৃষ্টান্ত রয়েছে, কিন্তু সেসব নিয়ে বিস্তারিত লিখতে গেলে পাতার পর পাতা ভর্তি হবে বলে, এখানে শুধু একটি মাত্র দৃষ্টান্তের কথাই উল্লেখ করা হল। আর যে প্রতিযোগিতার কথা আগে উল্লেখ করা হয়েছে, একাদশ শতক পর্যন্ত বাঙলার সর্বত্রই সেটা প্রবল হয়ে উঠেছিল। এবার আবার একাদশ শতকের বাঙলার সমাজ-কথায় ফিরে আসা যাক। উক্ত শতকে সহজপন্থার সিঁড়ি ধরে তৎকালীন বাঙালী সমাজে ব্যভিচারের স্রোত প্রধানতঃ নিম্নশ্রণীর বাঙালীর সাজে, আর নাথপন্থার তুকতাক অগ্নি-পরীক্ষা, জলপরীক্ষা, সর্পপরীক্ষা, জলপড়া, চালপড়া, নলচালা, বাটিচালা প্রভৃতি রূপে এসেছিল। এর ফলেই উদ্ভব হয়েছিল ‘শার্কুন’ শাস্ত্রের; অর্থাৎ, সুলক্ষণ-দুর্লক্ষণ সংহিতার। ক্রমে বাঙালীর মনে সেটা নিজের স্থায়ী আসন গেড়ে বসেছিল। উক্ত ‘শার্কুন-শাস্ত্র’ই বাঙালীর মনে হাঁচি-টিকটিকির এক অলঙ্ঘ্য বাধার প্রাচীর গড়ে তুলেছিল। পরে অনেক ক্ষেত্রেই সেসব প্রায় প্রবাদ-বাক্যরূপে, যেমন ‘ডাকের বচনে’ প্রকাশ পেয়েছিল। এখানে প্রবাদের আগে ‘প্রায়’ বিশেষণটি এই কারণেই জুড়ে দেওয়া হল যে, প্রবাদের প্রাণ শুধু শব্দের স্বল্পতা ও শব্দার্থের আধিক্য নয়, সেটার সঙ্গে সেটার উপযোগিতাও জুড়ে থাকে। এর উপযোগিতা হল যে, প্রবাদ-বাক্যের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত থাকে সেটির অভিপ্রায় ও সংকেত, যা প্রবাদটি শোনামাত্র মর্মের মধ্যে প্রবেশ করে যায়। ময়নামতীর গানেও ‘ডাকের বচনের’ হাঁচি-টিকটিকির কথা পাওয়া যায়।
“হাঁচি জিঠি যে জন বারে
বিঘ্নের সময় সে জন তরে।”
(জিঠি অর্থাৎ জ্যেষ্ঠী = টিকটিকি)
ডাক ও খনার বচনের উদ্ভব একাদশ শতকের পূর্বে হয়েছে বলে ধরা চলে। তবে দুটোর মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। ডাকের বচনে সামাজিক বার্তা, মানুষের চরিত্র প্রভৃতির কথা পাওয়া যায়; আর সেখানে খনার বচন মূলতঃ বাংলার চাষবাস, জলহাওয়া, শুভক্ষণ বা তিথি গণনা নিয়ে। বলা বাহুল্য যে, দুটিরই আদিম ভাষা লোকের মুখে মুখে ক্রমে ক্রমে বদলে গিয়েছে, আর ডালে ও চালে মিশে খিচুড়ির সৃষ্টিও হয়েছে; তবে সেই খিচুড়িতাপে নয়, কালধর্মে তৈরী হয়েছে। ফলে অতীতে দু’য়ের মধ্যে কোনো ভাষাগত আদিম পার্থক্য ছিল কি না, সেটা এখন আর বোঝার কোন উপায় নেই। তবে কৃষিভিত্তিক ও তুকতাক-ভক্ত অতীতের বাঙালী সমাজে যে দুটিরই বহুল প্রচার ও প্রসার ঘটেছিল, তাতে কোন সন্দেহ নেই। পরবর্তীকালে কৃষিকর্ম যতই অনাদর পেয়েছে খনার বচনও তত ক্ষীণ হয়ে এসেছে, কিন্তু বাঙালীর তুকতাক ভক্তি ‘ডাক’কে এখনও পর্যন্ত বাঁচিয়ে রেখেছে। এখনো বাঙালী সমাজের সিংহভাগ মানুষই জানেন –
“অজা জালি, পাকা মেষ, দই-এর আগা, ঘোলের শেষ,
শাকের ছা, মাছের মা, ডাক বলে, বেছে খা৷৷”
(অজা জালি = কচি পাঁঠা)
অথবা, চার্বাকপন্থীদের –
“দধি দুগ্ধ করিয়া ভোগ, ঔষধ দিয়া খণ্ডাব রোগ
বলে ডাক, এই সংসার, আপনে মইলে কিসের আর?”
খিচুড়ির নমুনা –
“ভরা হতে শূন্য ভাল, যদি ভরতে যায়
আগে হতে পিছে ভাল যদি ডাকে মায়।
মরা হতে তাজা ভাল যদি মরতেও যায়
বাঁয়ে হতে ডানে ভাল যদি ফিরে চায়।
বাঁধা হতে খোলা ভাল (যদি) মাথা তুলে চায়
হাসা হতে কাঁদা ভাল যদি কাঁদে বাঁয়।”
(ভরা = কলসী, মরা = মৃতদেহ, মরতে চায় = গঙ্গাযাত্রী, “বায়ে হতে ডানে ভাল যদি ফিরে চায়” = শেয়ালের কথা বলা হয়েছে, “বাঁধা হতে খোলা ভাল” = গরুর কথা বলা হয়েছে।)
এগুলি সবই যাত্রার সুলক্ষণ চিহ্ন নিয়ে বলা হয়েছে।
ওদিকে খনার বচনে –
“খাটে খাটায় লাভের গাঁতি, তার অর্ধেক মাথায় ছাতি
ঘরে বসে পুছে বাত, তার কপালে হাভাত।”
“যদি বর্ষে আগনে রাজা যায় মাগনে”
“যদি বর্ষে মাঘের শেষ, ধন্য রাজা পুণ্য দেশ”
(আগনে = অগ্রহায়ণে)
সময়ে সময়ে ডাক ও খনার বচনের মধ্যে নানা শতকের এত ধরণের খাদ মিশে গিয়েছে যে, সেটা থেকে একাদশ শতকের চিত্র বাছাই করা রীতিমত দুঃসাধ্য ব্যাপার। তবে মনে হয় যে, তখন পিঁড়িতে বসে কলাপাতে ভাত খাওয়াই রীতি ছিল; আর সুলক্ষণা কন্যা দেখে তবেই বধূ বাছাই করা হত। কারণ, ‘পিঙ্গল আঁখি’, ‘ডাগর ওষ্ঠ’, ও ‘পেট পিঠ উচ্চ ললাট’-ওয়ালা মেয়েকে ঘরে আনতে বারবার নিষেধ করে দেওয়া হয়েছিল। উক্ত সময়ে বাংলার ফলের মধ্যে আখ, আম, কাঁঠাল, কলা, নারকেল, সুপারি এবং ধনে ও পান যে প্রধান ছিল, তাতে কোন সন্দেহ নেই।
(পরবর্তী পর্বে সমাপ্ত)

(তথ্যসূত্র:
১- হরপ্রসাদ শাস্ত্রী রচনা সমগ্র।
২- বৌদ্ধধর্ম, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী।
৩- বাঙ্গালীর ইতিহাস, আদিপর্ব, নীহাররঞ্জন রায়।
৪- বাঙ্গালার ইতিহাস, রাখালদাস বন্দোপাধ্যায়।
৫- বাংলা দেশের ইতিহাস, রমেশচন্দ্র মজুমদার।
৬- বাংলার সামাজিক ইতিহাসের ধারা, বিনয় ঘোষ।
৭- বাঙ্গালার ইতিহাস (সামাজিক বিবর্তন), ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত।
৮- বাংলা মঙ্গলকাব্যের ইতিহাস, আশুতোষ ভট্টাচার্য।
৯- বাংলা ও বাঙালীর বিবর্তন, অতুল সুর।
১০- পূজা পার্বণের উৎস কথা, পল্লব সেনগুপ্ত।
১১- ইতিহাসের আলোকে বৈদিক সাহিত্য, সুকুমারী ভট্টাচার্য।
১২- প্রাচীন বাঙ্গলা সাহিত্যের ইতিহাস, ডঃ তমোনাশ চন্দ্র দাশগুপ্ত।)

ধর্মগুরু বিবেকানন্দ

রানা চক্রবর্তীঃ উপনিষদের ঋষি বলেছিলেন যে, শিক্ষা কল্প নিরুক্ত ছন্দ জ্যোতিষ ব্যাকরণ বেদ প্রভৃতি ‘অপরাবিদ্যা’, আর যে বিদ্যা দিয়ে ব্রহ্মকে জানা যায় সেটা হল ‘পরাবিদ্যা’। ধর্মের পথে চালনা করে বলে শিক্ষা বা বেদশিক্ষার প্রয়োজন রয়েছে। প্রাচীন ভারতে ধর্মই সকল কাজের উৎস ছিল। প্রাচীন ভারতের আদি-সাহিত্য – ঋগ, সাম, যজুর্বেদ, অথর্ববেদ, ব্ৰাহ্মণ, আরণ্যক, উপনিষৎ প্রভৃতি সবই আসলে ধর্মসাহিত্য। প্রাচীন ভারতে প্রৌঢ় অবস্থায় মানুষ যখন বানপ্রস্থে যেতেন, তখন বয়সের জন্য ক্রিয়াবহুল যাগযজ্ঞ করা তাঁদের পক্ষে সম্ভব হত না বলে, তাঁদের দার্শনিক চর্চা ‘আরণ্যক’ বলে পরিচিত হয়েছিল। সেই দার্শনিক চর্চা উপনিষদে আরও গভীর হয়ে উঠেছিল। বলা হয় যে, উপনিষদে জ্ঞানকাণ্ড নিজের পূর্ণতা লাভ করেছে। উপনিষৎ তাই জানার শেষ সীমায় উপনীত – বেদান্ত। প্রাচীন ঋষিরা যা দেখেছিলেন, অর্থাৎ, ধ্যানযোগে তাঁরা যা অনুভব করেছিলেন, সেটাই তাঁরা উপনিষদে উল্লেখ করেছিলেন। গুরু শিষ্যকে ‘তত্ত্বমসি’ শিক্ষা দিয়েছিলেন। জীব ও ব্রহ্ম অভিন্ন হলেও মানুষের অজ্ঞানতার জন্যই সেগুলিকে ভিন্ন বলে মনে হয়। ‘শঙ্করাচার্য’ উপনিষদের জ্ঞানমূলক ভাষ্য করেছিলেন। তিনি নিজের অসাধারণ প্রতিভাবলে তৎকালীন প্রধান পণ্ডিতের মত খণ্ডন করে নিজস্ব ‘অদ্বৈতমত’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। শঙ্করের আগেও কিন্তু বেদান্তভাষ্য ছিল, তবে শঙ্করের ভাষ্যের পরে বেদান্তভাষ্য বলতে শুধু তাঁর ভাষ্যকেই বোঝায়। কিন্তু তবুও বলা চলে যে, প্রাচীন ভারতের এইসব জ্ঞানের ঐতিহ্য কেবলমাত্র পণ্ডিতদের পক্ষেই বোঝা সম্ভব। সাধারণের শিক্ষার জন্য এসব ব্যবহার করা চলে না। অথচ এই জ্ঞানের কথা, আশার কথা সাধারণে না জানলে চলবে কেন? বিশ্ববাসীকে সহজ করে কি জ্ঞানের সার পরিবেশন করা যায় না? এই প্রশ্নকে সামনে রেখেই স্বামীজি সরল ভাষায় বেদান্ত বোঝাতে আরম্ভ করেছিলেন। তবে কেবল বোঝানো নয়, ব্যবহারিক জীবনে যে বেদান্তের সত্যি উপলব্ধি করা সম্ভব – সেটাও তিনি প্রমাণ করেছিলেন। নিজে না দেখে না বুঝে, কেবলমাত্র অন্যের কথায় মেনে নেওয়ার লোক তিনি ছিলেন না। উপনিষৎ বলেছে, ব্রহ্ম এক ও অদ্বিতীয়। স্বামীজি বলেছিলেন যে, এমন সময় আসে যখন ঐ একত্বের উপলব্ধি হয়। উপনিষদের উক্তি অভ্রান্ত। তিনি বলেছিলেন যে, তাঁর জীবনে সেই অনির্বচনীয় অনুভূতি তখন হয়েছিল, যখন দক্ষিণেশ্বরের বাগানে রামকৃষ্ণ পরমহংস তাঁর বুকে হাত দিয়েছিলেন। এছাড়া তাঁর সেই অনুভূতি আরেকবার হয়েছিল আমেরিকায়, লেকের ধারে। সেই পরমমুহূর্তে তিনি দেখেছিলেন যে, বাড়িঘর দুয়ার জানালা বারান্দা গাছপালা চন্দ্র সূর্য সব যেন কোথায় কি হয়ে গেল! সব যেন ভেঙেচুরে অনু-পরমাণু হয়ে আকাশে বিলীন হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর চৈতন্য, অহঙ্কার সব অবলুপ্ত হয়ে গেল। তাঁর আর কিছু মনে রইল না। তারপরে ক্রমে তাঁর দেহজ্ঞান আবার ফিরে এসেছিল, আবার তিনি সবই দেখতে পেয়েছিলেন – সেই বাড়ি বাগান সব। তখন তাঁর কথা শুনে কেউ কেউ বলেছিলেন যে, মস্তিষ্কের বিকারের ফলেও লোকে নাকি ওরকম দেখে। স্বামীজি বলেছিলেন, “বিকার কি হে! দেখলাম যখন, তখন কোন রোগও হয়নি, নেশাও করিনি। তাছাড়া অনুভূতিগুলি যে বেদের কথার সঙ্গে মিলে যাচ্ছে!” সেটাই ছিল সেই দর্শন, জীব ব্রহ্ম ছাড়া অন্য কিছুই নয়। কলসীতে সমুদ্রের জল ধরা হল। বলা হল কলসীর জল আর সমুদ্রের জল। কিন্তু কলসী ভেঙে দিলে সমুদ্রের জল আর কলসীর জল ভিন্ন থাকে না। দৃশ্যমান জগৎ ভ্রমমাত্র – রজ্জুতে সর্পভ্রম, সূর্যকিরণে মরীচিকা ভ্রম। ভেদবুদ্ধি থাকা সত্ত্বেও অঘটন-ঘটন-পটিয়সী মায়ার প্রভাবে যাঁর সেই সৌভাগ্য হয়, তাঁর জন্য সেই আবরণ অপসৃত হয়। শ্রীরামকৃষ্ণ ব্রহ্মস্বরূপ উপলব্ধি করেছিলেন। সমাধিকালে মায়াজনিত দেশ কাল নাম ও রূপের বিন্দুমাত্র জ্ঞান থাকে না, নাম-রূপধারী জগৎ তখন লীন হয়ে যায়, আর কোন ভেদজ্ঞান থাকে না। শ্রীরামকৃষ্ণ স্বামীজিকে কেবলমাত্র স্পর্শদ্বারা সেই উপলব্ধি করিয়ে দিয়েছিলেন। স্বামীজি কেবল বেদান্ত পড়েননি, তিনি বেদের সার অনুভব করেছিলেন বলেই তাঁর বলা কথা ও লেখা এত উদ্দীপ্ত হতে পেরেছিল।
হিন্দুধর্মকে সনাতন ধর্ম বলা হয়। স্বামীজি সেই কথাটি সহজ করে বুঝিয়েছিলেন। ভারতের ধর্ম উদার। ‘পতঞ্জলি’ বলেছিলেন, মোক্ষলাভের চারিটি পথ হল – ঈশ্বরের ধ্যান, ঈশ্বরের বাচক শব্দের জপ, মহাপুরুষে চিন্তা, এবং যা ভাল লাগে তার ধ্যান। তিনি সেই পথগুলির মধ্যে কোন তারতম্য করেননি। তাঁর মত ছিল যে, যে কোনো পথে চললেই – যাঁর আবেগ আছে তিনি অবশ্যই মোক্ষলাভ করবেন। রাজার ধর্ম হল প্রজার সুখ-সুবিধা দেখা। প্রাচীন ভারতে অভিষেকের সময়ে রাজারা প্রজাদের উদ্দেশ্য করে এই শপথ গ্রহণ করতেন যে, প্রজাদের উপরে অত্যাচার করলে তিনি যেন নিজের সারাজীবনের অর্জিত সুকর্মের ফল, সন্তান-সন্ততি, ইহকাল-পরকাল সব কিছু থেকেই বঞ্চিত হন। হিন্দুদের ধর্মশাস্ত্রগুলি বার বার বলেছে যে, বিভিন্ন পথে প্রবাহিত নদীর গন্তব্যস্থান যেমন সমুদ্র, তেমনি বিভিন্ন পথ অবলম্বী মানুষের গন্তব্যস্থানও সেই ঈশ্বর। অতীতে গুরু তাঁর শিষ্যকে বলেছিলেন, গুরু বা গুরুজনদের যা সদগুণ সেটাই গ্রহণ করো, যা দোষের সেটার অনুকরণ কোরো না। প্রাচীন সাহিত্যে ভারতের উদারতার আরও উদাহরণ পাওয়া যায়। দাসী ‘জবালা’র ছেলে ‘সত্যকাম’, যাঁর পিতাকে জানা ছিলনা, তিনিও উত্তরকালে নিজের গুণের জন্য ঋষি বলে অভিহিত হয়েছিলেন। ক্ষত্রিয়রাও তখন ব্রহ্মবিদ্যা অর্জন করতেন। ঋষি বিশ্বামিত্র এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ। তখন ব্রাহ্মণও ক্ষত্রিয়ের কাছে ব্রহ্মবিদ্যালাভের জন্য যেতেন। পাঞ্চালদেশের রাজা ‘প্রবহণ’-এর কাছে ঋষিপুত্র ‘শ্বেতকেতু’ ব্রহ্মবিদ্যা শিক্ষার জন্য গিয়েছিলেন। রাজা তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, জান কি দেহী কি করে দেহত্যাগ করেন? জান কি বিদেহী আত্মা কেমন করে আবার দেহ ধারণ করে? শ্বেতকেতু এসব প্রশ্নের উত্তর জানতেন না, এমনকি তাঁর পিতা ব্রাহ্মণ হয়েও সেই তত্ত্ব জানতেন না। তখন পিতাপুত্র মিলে রাজার কাছে জানবার জন্য গিয়েছিলেন। আসলে বৈদিক যুগে জাত্যাভিমান বলে কিছু ছিল না। মত ও পথের উদারতাই হিন্দুধর্মকে সনাতন করে তুলেছে। একথা এত সহজে স্বামীজির আগে অন্য কেউ মানুষকে জানাননি। নিজের গভীর অধ্যয়ন ও অনুভূতির ফলস্বরূপ যে তত্ত্ব তিনি আবিষ্কার করেছিলেন, সেটাই তিনি জগতবাসীকে বলে গেছেন। তিনি মনেপ্রাণে বুঝেছিলেন বলেই উদাত্তকণ্ঠে বলতে পেরেছিলেন যে, হিন্দু অন্য ধর্ম-অবলম্বীকে হিংসা করেনি। রোমানদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়েএকদা খৃষ্টান উদ্বাস্তুরা দক্ষিণ-ভারতের উপকূলে এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন। জরথ্রুষ্টপন্থী পারসীক জাতিও বহুকাল ধরে ভারতের বাসিন্দা। বটগাছের মত প্রাচীন হিন্দু-ধর্মের নানা মতের ঝুরি নেমে গিয়ে সেগুলি ভারতের ভিত্তিতে সুদৃঢ় হয়ে বসেছে।

প্রতিভার বিকাশে ও কর্মক্ষমতায় শঙ্করাচার্যের সঙ্গে স্বামীজির তুলনা করা যেতে পারে। শঙ্কর মাত্র বত্রিশ বছর বয়স পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন। কিন্তু সেই স্বল্প সময়ের মধ্যেই তাঁর শেখা ও শেখানো আজও অম্লান হয়ে রয়েছে। স্বামীজি ঊনচল্লিশ বছর বেঁচেছিলেন। স্কুল, কলেজ ও অনন্তের পথে প্রস্তুতির কাল বাদ দিলে তাঁর শেখা আর শেখানোর কাল পনরো বছরের বেশি নয়। ওরই ভেতরে তাঁর রচনাকাল মাত্র নয় বছরের। শঙ্করাচার্য তাঁর স্বল্প-পরিসর জীবনে এগারোটি উপনিষদ, ব্রহ্মসূত্র ও গীতার ভাষ্য রচনা ও অদ্বৈতমত প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পায়ে হেঁটে তিনি কন্যাকুমারিকা থেকে বদ্রীনাথ, দ্বারকা থেকে পুরী – এই সুদীর্ঘ পথ ঘুরেছিলেন। চারধাম – শৃঙ্গেরী, যোশী, সারদা, ও গোবর্ধন মঠ – প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আজও তাঁর অদ্ভুত কর্মশক্তি নিয়ে ভাবলে বিস্ময় লাগে। স্বামীজিও তেমনি করেছিলেন, তাঁর প্রব্রজ্যার দৈর্ঘ্য কম কিছু ছিল না। নিজের সময়ে সব পথ যেমন তিনি পদব্রজে অতিক্রম করেননি, তেমনি তাঁর পথের দৈর্ঘ্য পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে অতিক্রম করে গিয়েছিল – পূর্ব থেকে পশ্চিম দেশে। তাঁর পথ চলা শুধু আসমুদ্র হিমাচলেই আবদ্ধ থাকেনি। তখনকার দিনে শঙ্করকে হয়তো হিন্দু বৌদ্ধধর্ম ছাড়া আর অন্য কোন ধর্মের বা ম্লেচ্ছ ভাষার পাঠ নিতে হয়নি। সে যুগে তার দরকারও ছিল না। নিজের স্বল্পপরিসর জীবনে স্বামীজি সেটাও শিক্ষা করেছিলেন। ইংরেজি ভাষাটা তিনি এত ভাল শিখেছিলেন যে, উত্তরকালে তাঁর সমালোচকেরা তাঁর লেখা ও বলা ইংরাজি ভাষায় কোনো খুঁত ধরতে পারেননি। আর সংস্কৃত ভাষায় তাঁর পাণ্ডিত্যের কথা না বললেও চলবে। এর উপরে তিনি ছিলেন সঙ্গীতঙ্গ। তিনি ভালো গান গাইতে পারতেন। তাঁর গানের লহরীতে শ্রীরামকৃষ্ণ ভাবাবিষ্ট হতেন। অসাধারণ পরিশ্রম করবার ক্ষমতাকেই লোকে প্রতিভা বলে। তাই স্বামীজির মতো প্রতিভার এমন উজ্জ্বল মডেল আর কোথায় পাওয়া সম্ভব?
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে যে, ধর্মজগতে স্বামীজির মৌলিক দান কি? স্বামীজি বিশ্বসভায় ভারতের ধর্ম-আসন সুপ্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, বলতে গেলে নিজের প্রথম ভাষণেই তিনি সেটা করতে পেরেছিলেন। স্বামীজীর আগে কেউই জোর গলায় বলেন নি যে, আধ্যাত্মিকতাই ভারতের প্রাণকেন্দ্র। সেটাই তো তাঁর বড় দান। পাশ্চাত্য জগতকে এবং সেই সঙ্গে আত্মবিস্মৃত ভারতবাসীকে তিনি হিন্দুধর্মের অখণ্ড সার্বভৌমত্ব দেখিয়েছিলেন। তাঁর মতো, হিন্দুধর্মের মূলনীতিগুলির অমন সহজ সরল ভাষ্য আর কোন দ্বিতীয় ব্যক্তি এখনও পর্যন্ত করেননি। বৈদিক যুগের উজ্জ্বল ধর্ম ও দর্শন একটা সময়ে কালপ্রবাহে তমসাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল। আচার-আচরণ তখন ক্লিন্ন হয়ে উঠেছিল। তাই সেসব বাদ দিয়ে, হিন্দুধর্মের সারবস্তু খুঁজে বের করে তিনি জগতের সামনে সেগুলিকে তুলে ধরেছিলেন। এমনিভাবে আর এমন ভাষাতে তিনি সেগুলিকে ধরে দিয়ে গিয়েছেন, যা এড়ানো কঠিন। প্রাচীন ভারতের বৈশিষ্ট্য গীতা উপনিষদে থাকলেও সময়ের প্রভাবে সকলেই সেকথা বিস্মৃত হয়েছিলেন। তাঁর কোথায় সেসবের নতুন করে সন্ধান আরম্ভ হয়েছিল। জনসাধারণকে তিনি বেদান্ত বলতে কি বোঝায়, আর বেদান্তের অন্তর্নিহিত সত্য বোঝাতে পেরেছিলেন।

অদ্বৈতবাদ উপনিষদসম্মত। আচার্য ‘গৌড়পাদ’ অদ্বৈতবাদের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন। গৌড়পাদ ‘গোবিন্দাচার্যের’ গুরু ছিলেন। গোবিন্দাচার্য ছিলেন শঙ্করাচার্যের গুরু। গৌড়পাদ যে বাদের সূচনা করেছিলেন, শঙ্কর সেই অদ্বৈতবাদকে পূর্ণ পরিস্ফুট করে তুলেছিলেন। শঙ্কর বলেছিলেন যে, ব্রহ্ম এক ও অদ্বিতীয়; জীব ও ব্রহ্মে কোন ভেদ নেই, সেই ভেদজ্ঞান অজ্ঞানতার জন্যই হয়; ব্রহ্ম সত্য আর জগৎ মিথ্যা। ‘রামানুজাচার্য’ বলেছিলেন যে, ব্রহ্ম এক ও পূর্ণ, এবং জীব ব্রহ্মেরই অংশ মাত্র। জীব ও ব্রহ্ম ভিন্ন, অভেদ নয়। জীব ব্রহ্ম থেকেই উদ্ভূত, জগৎও ব্ৰহ্ম থেকে উদ্ভূত। জগৎ মিথ্যা নয়, জগৎ আসলে ব্রহ্মেরই বিকাশ বা শরীর। রামানুজের মতবাদ ‘বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ’ নামে পরিচিত। ‘মাধবাচার্য’ বলেছিলেন দ্বৈতবাদ-এর কথা। তাঁর মতে জীব ও ব্রহ্ম সম্পূর্ণভাবে ভিন্ন। জীব ঈশ্বরের অংশ নয়, তাঁর দাস। জীবের কর্তব্য ঈশ্বরের সেবা করা, আর তাতেই তাঁর মুক্তি। শ্রীরামকৃষ্ণ অদ্বৈত, বিশিষ্টাদ্বৈত ও দ্বৈত – তিন ভাবই মানতেন। প্রসঙ্গতঃ তিনি মহাজ্ঞানী হনুমানের কথা বলতেন। হনুমানের যখন দেহবুদ্ধি বলবৎ থাকত তখন তিনি অনুভব করতেন যে, তিনি দাস আর রামচন্দ্র তাঁর প্রভু (দ্বৈতভাব)। যখন তাঁর বোধ হত যে, তিনি মন-বুদ্ধি-আত্মাযুক্ত জীবাত্মা, তখন তিনি দেখতেন রামচন্দ্র পূর্ণ আর তিনি তাঁর অংশ (বিশিষ্টাদ্বৈতভাব)। আর যখন তিনি ভাবতেন যে, তিনি নামরূপরহিত শুদ্ধ আত্মা, তখন দেখতেন তিনিও যা শ্রামচন্দ্রও তাই, তাঁদের মধ্যে কোনো ভেদ নেই (অদ্বৈতভাব)। শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন যে, তিনটি ভাবই মনের উন্নতির অবস্থা অনুযায়ী উপনীত হলেও অদ্বৈতভাবই ধর্মোন্নতির শীর্ষবিন্দু। তিনি নিজের জীবন দিয়ে উপলব্ধি করে সেকথা বলে গিয়েছিলেন। তাঁর পূর্বসূরীরা যেসব মতবাদ প্রচার করে গিয়েছিলেন, সেগুলো যে কেবলমাত্র মস্তিষ্কপ্রসূত ছিল না, সেগুলো যে প্রত্যক্ষ ছিল, তা তিনি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। স্বামীজি তাই বেদান্তের অদ্বৈতবাদ কেবল সহজ কথায় বুঝিয়ে ক্ষান্ত হননি, অদ্বৈতবাদের সঙ্গে তিনি বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ আর দ্বৈতবাদেরও সমন্বয় সাধন করেছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ যেমন বলতেন, ঈশ্বর সাকারও বটে আবার নিরাকারও বটে। নিরাকার হলেও তিনি আকার নেন – যেমন জল আর বরফ। স্বামীজিও তেমনি বলতেন, একেন তিনি অভিব্যক্তি – দ্বৈত, বিশিষ্টাদ্বৈত, আর অদ্বৈত। দ্বৈত আর বিশিষ্টাদ্বৈত অবস্থা থেকে অদ্বৈতভাবে পৌঁছানো যায়। অবশ্য অদ্বৈতভাবই ধর্মপথের চরম লক্ষ্য – তত্ত্বমসি; একমেবাদ্বিতীয়ম্। শ্রীরামকৃষ্ণ ভাগবত পাঠ শুনতে শুনতে শ্রীকৃষ্ণের জ্যোতির্ময় মূর্তি, আর তাঁর পাদপদ্ম থেকে জ্যোতি বেরিয়ে আসছে বলে দেখতে পেয়েছিলেন, যা প্রথমে ভাগবতকে, ও তারপরে তাঁকে স্পর্শ করেছিল। তাঁর উপলব্ধি হয়েছিল যে, বস্তু পৃথক হলেও, সেটা অনন্তেরই প্রকাশসম্ভূত – তিনে এক, এবং একে তিন। এখানেই স্বামীজির ধর্মবাদের উৎকর্ষ। শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁকে সেটাই দেখিয়েছিলেন। নিজে আচরণ দিয়ে তিনি ‘যত মত তত পথ’ শিখিয়েছিলেন। জীবাত্মা ও পরমাত্মা অভিন্ন। অভ্যাসযোগে সেটা উপলব্ধি করা সম্ভব। জীবন চলাই ধর্ম। কর্ম যদি অনাসক্ত হয়, ভক্তি যদি বিশ্বাসভিত্তিক হয়, জ্ঞান যদি শুদ্ধ হয়, তাহলে পথ যা-ই হোক না কেন, সিদ্ধিলাভ একদিন হবেই। জড়তা ও নিষ্ক্রিয়তা কর্মবিরতি নয়। সক্রিয়তাই ধর্ম। সক্রিয়তাতেই রয়েছে প্রাণের পরিচয়। যুদ্ধক্ষেত্রের সব কোলাহলের মাঝেও শ্রীকৃষ্ণ ধর্মের সংহত সুরটি তাঁর শিষ্য অর্জুনকে জানিয়েছিলেন। সংসারের দৈনন্দিন জীবনে ছোট বড় সব কাজের মাঝে সেই সুরটি বাজিয়ে যেতে হবে, সেই নিষ্কাম কর্মের সুর, ফলবাসনার হিতের সুর। স্বামীজি বলেছিলেন যে, অভ্যাসযোগে সাধারণ মানুষ জীবনে সেটা করতে পারে। ব্যবহারিক জীবনে সেটা অবশ্য‍ই সম্ভব। স্বামীজির ও তাঁর গুরুভাইদের, তাঁদের শিষ্যপ্রশিষ্যদের মধ্যে কর্মের প্রাবল্য ও অনাসক্তি, তার অপূর্ব সাফল্য দেখা গিয়েছিল। বিরাটের উপলব্ধি এসেছিল। প্রাণ বড় হয়েছিল। হৃদয় সরস হয়েছিল। অনুভূত হয়েছিল যে, জীবই শিব। জীবের সেবাই শিব বা ঈশ্বরের সেবা। জ্ঞানচক্ষু খুলেছিল। স্পষ্টই দেখা গিয়েছিল যে, শিল্প বিজ্ঞান ধৰ্ম সবই সত্যের অভিনব প্রকাশ। তবে সেটা বোঝার জন্য তাঁদের মনে রাখতে হয়েছিল যে, সবেতে একেরই বিকাশ, দ্বিতীয় আর কিছুই নেই। এসব বলা ও ভাবা সহজ হলেও জীবনে প্রতিফলিত করা শক্ত। অভ্যাসযোগে ও একজীবনে সেটা নাও হতে পারে। স্বামীজির কিন্তু সেই সৌভাগ্য হয়েছিল। তিনি দেখেছিলেন, রামকৃষ্ণকে বুঝেছিলেন, যিনি দেখেছিলেন মহৎকে, যিনি নিত্য অনুভব করতেন উপনিষদের বাণী – ‘তত্ত্বমসি’।
যুগে যুগে প্রদীপ, তেল, সলতে, শলাকা সবই থাকে। কিন্তু আঁধার এলে তবেই দীপ জ্বালা হয়। ধর্মের জগতে যখন আঁধার নেমেছিল, তখন স্লটে শলাকা তেল সংগ্রহ করে স্বামী বিবেকানন্দ যে দীপ জ্বেলেছিলেন, সেটার আলো আজও ম্লান হয় নি, বরং উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হচ্ছে।

(তথ্যসূত্র:
১- বিবেকানন্দ চরিত, সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার।
২- বিবেকানন্দ রচনা সংগ্রহ।
৩- যুগপ্রবর্ত্তক বিবেকানন্দ, স্বামী অপূর্বানন্দ।)

বাংলার প্রথম নমঃশূদ্র ধর্মঘট

রানা চক্রবর্তীঃ অতীতের ভারতীয় সমাজ গঠনে জাতিভেদ প্রথা অনড় থাকবার ফলে, ভারতের বিভিন্ন জাতির জীবনযাত্রা এক বিচিত্র পথে পরিচালিত হতে বাধ্য হয়েছিল। তখন প্রাচীন শাস্ত্রের বিচিত্র শাসনকে কোন সমাজই উপেক্ষা করতে পারেনি। গুণ ও কর্মের ভিত্তিতেই অতীতের ভারতীয় সমাজে চারটি বর্ণের সৃষ্টি হয়েছিল। গীতা ও মহাভারতে যে গুণ ও কর্মের প্রশ্নকে সামনে রেখেই যে বর্ণবিভেদ নির্ণীত হয়েছিল, সেই দৃষ্টান্ত ‘নহুষ’ ও ‘যুধিষ্ঠিরের’ কথাবার্তা থেকে পাওয়া যায়। সর্পরূপী নহুষের প্রশ্নের উত্তরে যুধিষ্ঠির ব্রাহ্মণের লক্ষণ বিচারে বলেছিলেন, “সত্য, অনিষ্ঠুরতা, দান, ক্ষমা, তপস্যা ও দয়া যে ব্যক্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয় তিনিই ব্রাহ্মণ।” যুধিষ্ঠিরের মুখে এই ধরনের উক্তি শুনে নহুষ তাঁকে পুনরায় প্রশ্ন করেছিলেন, “সত্য, দান, ক্ষমা প্রভৃতি গুণ যদি শূদ্রের মধ্যে দেখা যায়?” এই প্রশ্নের উত্তরে যুধিষ্ঠির জানিয়েছিলেন, “শূদ্রের জাতিগত গুণ (পরিচর্যা প্রভৃতি) যদি ব্রাহ্মণের মধ্যে দেখা যায়, তাহলে তাঁকে শূদ্র বলে স্বীকার করব। আর ব্রাহ্মণের গুণ (শম, দম প্রভৃতি) যদি শূদ্রের মধ্যে দেখা যায় তবে সেই শূদ্রকে ব্রাহ্মণ বলব।” অর্থাৎ, জন্মগত বা বর্ণগত শ্রেণী বিভাজনকে মহাভারতের ওই আখ্যায়িকায় স্বীকার করা হয়নি। অথচ ভারতবর্ষের প্রাচীন বর্ণ ব্যবস্থায় জন্মগত অধিকারই বরাবর মর্যাদা পেয়েছিল (এবং এখনও সম্ভবতঃ পাচ্ছে)। সেখানে কর্ম বা গুণগত বর্ণভেদের কোন দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া যায় না। সেখানে ব্রাহ্মণের ঔরসজাত সন্তান ব্রাহ্মণ, এবং শূদ্রের ঔরসজাত সন্তান শূদ্র হিসাবেই বিবেচিত হয়েছিল (এখনও সেটাই হয়)। তখন কোন শূদ্রের সন্তান গুণ ও কর্মে যতই মেধাসম্পন্ন হোন না কেন, তিনি তাঁর জন্মগত কুলবৃত্তি ত্যাগ করে কখনোই অন্য কোন বৃত্তি গ্রহণ করতে পারতেন না ৷ জন্মগত অধিকারই তাঁকে অন্য কোন শ্রেণীর সম-মর্যাদা থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে বাধ্য করত। এই বর্ণ বিভাজনই প্রাচীন ভারতবর্ষের সামাজিক গঠনের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল। সেই সময়ে জন্মগত বৃত্তি পরিবর্তন করলে ‘জাতি-চ্যুতি’ ঘটবার আশঙ্কায় কোন সমাজই সহজে বৃত্তি পরিবর্তনের সাহস পেতো না। কারণ মনু তাঁর ‘মেধাতিথি ভাষ্যে’ সেই বিষয়ে কতগুলি নির্দেশ পালনের প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছিলেন যে –
(১) পৃথিবীর যাবতীয় সম্পদ ও সম্পত্তি ব্রাহ্মণের। কারণ ব্রাহ্মণের সৃষ্টি ঈশ্বরের মুখ থেকে হয়েছে।
(২) বৈশ্য ও শূদ্র কতগুলো বিশেষ কাজ করতে বাধ্য। কারণ তাঁরা কাজ না করলে গোটা বিশ্বের অবস্থা চরমে পৌঁছাবে।
(৩) ক্ষমতা থাকলেও, শূদ্রের সম্পদ সংগ্রহের কোন অধিকার নেই। শূদ্র সম্পদ সংগ্রহ করলে ব্রাহ্মণের কষ্ট বৃদ্ধি পাবে।
মনু আরো জানিয়েছিলেন যে, এইসব শাস্ত্রীয় নীতি লঙ্ঘন করলে পরলোক সুখের হবে না ইত্যাদি ইত্যাদি। এইসব শাস্ত্রীয় প্রবচন তখন নিম্নবর্ণের ক্ষেত্রে এক বিভ্রান্তিকর অবস্থার সৃষ্টি করেছিল। সেই সময়ে, ব্রাহ্মণ এবং শূদ্রের একই অপরাধের ক্ষেত্রে সামাজিক দণ্ডবিধিরও তারতম্য ছিল। দুই বর্ণের সামাজিক শাস্তি কিন্তু একই ছিল না। তখন ব্রাহ্মণের উপরে গুরু পাপে লঘু দণ্ড, শূদ্রের উপরে লঘু পাপে গুরুদণ্ড প্রযুক্ত হত। তৎকালীন সমাজের অসমনীতির ফলে শূদ্রেরা বরাবরই পদানত থেকেছিলেন, আর সেটাই ছিল সেকালের ভারতের বর্ণব্যবস্থার সবচেয়ে বড় কুফল। প্রাচীন ভারতের ব্রাহ্মণ্য সমাজ ব্যবস্থার অসাম্য নীতি কখনোই শূদ্রদের মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে দেয়নি। অথচ ব্রাহ্মণদের সেই বিভেদনীতিকে অন্যান্য বর্ণরা, অর্থাৎ ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য সম্প্রদায় কিন্তু কখনোই মেনে নেননি। ব্রাহ্মণদের সৃষ্ট ওই সব অসম নীতি কিংবা অসঙ্গত জুলুমের বিরুদ্ধে তাঁরা প্রয়োজনে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন, সেগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলেন।
ঊনবিংশ শতাব্দীর ভারতে জাতিভেদ বা বর্ণভেদ প্রথার নগ্ন রূপ সবচেয়ে বেশি করে ফুটে উঠেছিল। তখন নানা মত ও মতান্তরে জাতিভেদ বিষয়ে এদেশের নির্যাতিত অংশরা প্রশ্ন তুলেছিলেন। তখন থেকেই তাঁরা নানাভাবে জাতিভেদ প্রথার মূলোচ্ছেদ ঘটাতে চেয়েছিলেন। উক্ত শতাব্দীতে এই দেশের এই শ্রেণীর মানুষ জাতিভেদ প্রথার অভিশাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য বার বার প্রতিবাদ জানিয়ে জনমত গঠনেরও চেষ্টা করেছিলেন। বস্তুতঃ রাজা রামমোহন রায়ের যুগ থেকেই বঙ্গদেশে বর্ণভেদের বিরুদ্ধে অনেক প্রতিবাদের ঝড় বয়ে গিয়েছিল। আর সেইসব প্রতিবাদের ফলে হিন্দুদের সমাজ কাঠামোর বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে বর্ণভেদের বিবর্তন লক্ষ্য করা গিয়েছিল। সেই বিবর্তন মূলতঃ কর্ম ও গুণের ভিত্তিতেই ঘটেছিল। তাই প্রাচীন কাল থেকে আধুনিক কালের সূচনা পর্যন্ত বঙ্গদেশে যে বর্ণ-বিবর্তন লক্ষ্য করা যায়, সেটা হল –
(ক) প্রথম যুগের বর্ণ বিভাজন: ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র।
(খ) দ্বিতীয় যুগের বর্ণ বিভাজন:

(১) উত্তম সংকর (সৎ শূদ্র): বৈদ্য, কায়স্থ, নাপিত, মোদক, বারুজীবী, তাম্বলী, মালাকার, কর্মকার, শঙ্খকার, তন্তুবায়, কুম্ভকার প্রভৃতি।
(২) মধ্যম সংকর (অশুদ্র): ছুতোর, স্বর্ণকার, আভীর, তৈলিক, কৈবর্ত, রজক, শুঁড়ি প্রভৃতি।
(৩) অধম সংকর (অন্ত্যজ শ্রেণী): ব্যাধ, হাড়ি, ডোম, মুচি, মেথর, চামার, চণ্ডাল প্রভৃতি।
(গ) তৃতীয় যুগের বর্ণ বিভাজন: (১) ব্রাহ্মণ, (২) বৈদ্য ও কায়স্থ, (৩) নবশাখ সম্প্রদায় (উত্তম সংকর): গোপ, মালি, তাম্বুলী, শঙ্খকার, কর্মকার, তন্তুবায়, নাপিত প্রভৃতি।
(ঘ) চতুর্থ যুগের (ঊনিশ শতকের) বর্ণ বিভাজন: (১) ব্রাহ্মণ, (২) কায়স্থ ও বৈদ্য, (৩) নবশাখ সম্প্রদায় (মধ্যভাগ): (অ) গোপ, মালি, তাম্বুলি, শঙ্খকার, কাংস্যকার, তাঁতি, নাপিত, তিলি, বারুজীবী, গন্ধবণিক ও মোদক; (আ) কৈবর্ত, মাহিষ্য, উগ্রক্ষত্রিয়, সুবর্ণবণিক, সাহা, শুঁড়ি, তেলি, কলু ও ধোপা; (ই) যুগী, চাঁড়াল, নমঃশূদ্র, চামার, মুচি, হাড়ি, ডোম, বাগদী প্রভৃতি (এঁরা সকলই অস্পৃশ্য ছিলেন)।
উপরোক্ত সারণিগুলি থেকে সহজেই বুঝতে পারা যায় যে, এদেশের বর্ণ ব্যবস্থা কখনোই একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকেনি। ইতিহাস বলে যে, বঙ্গদেশের বর্ণ ব্যবস্থায় এমন বিবর্তন বিভিন্ন সময়েই ঘটেছিল, এবং ঊনবিংশ শতাব্দীতেই সেটা সবচেয়ে বেশি পরিমাণে ঘটেছিল। কারণ, উক্ত শতাব্দীর অর্থনৈতিক ব্যবস্থাই বঙ্গদেশের প্রচলিত বর্ণভেদ প্রথার ক্ষেত্রে শিথিলতা এনে দিয়েছিল। কলকাতা শহরের বৃদ্ধি ও তৎকালীন বাংলার গ্রামীণ আর্থ-সমাজ-ব্যবস্থার ভাঙনই সেটার একমাত্র কারণ ছিল বলে গবেষকেরা মনে করে থাকেন। ওই সময়ে কলকাতা শহরের আয়তন যতই বৃদ্ধি পেয়েছিল, ততই বঙ্গদেশের কৃষি নির্ভর সমাজেও পরিবর্তনের জোয়ার এসেছিল। এর ফলে তৎকালীন বাংলার গ্রামীণ সমাজ ব্যবস্থাও ভাঙতে শুরু করেছিল। আর সেই ভাঙনের পথ ধরেই, কলকাতা শহরে বহু লোকের আনাগোনা আরম্ভ হয়েছিল। তখনকার বাংলার ব্যবসা-বাণিজ্যও মূলতঃ কলকাতা নগরীকে আশ্রয় করেই বেড়ে উঠতে শুরু করেছিল। আর কলকাতা শহরে যেহেতু বর্ণভেদের কোন বলাই ছিল না, তাই নিম্নবর্ণের অনেকেই নিজেদের আর্থিক অবস্থা ফেরানোর জন্য কলকাতাকেই বেছে নিয়েছিলেন। এরই সঙ্গে ঊনিশ শতকের প্রথম দিকের কলকাতার ‘ধর্মতলা অ্যাকাডেমি’র মতো কয়েকটি স্কুলের, এবং দেশীয় ব্যক্তিদের প্রচেষ্টায় স্থাপিত ‘হিন্দু কলেজে’র শিক্ষিত দেশীয় যুবকেরা সেই সময়ের নতুন চিন্তা ও চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠেছিলেন। তাতে বঙ্গদেশে এক নতুন ধরণের সামাজিক আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল, যার ফলে নতুন ও পুরানো আদর্শের মধ্যে সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। কিন্তু তৎকালীন বাংলার বিদেশী শাসকেরা সেই বিষয়ে সম্পূর্ণ উদাসীন ছিলেন। তাঁরা একদিকে যেমন বঙ্গদেশের ধর্মীয় ও সামাজিক ব্যাপারে কখনোই হস্তক্ষেপ করতে চাননি, অপরদিকে সেটাকে তেমনি সমর্থনও করেননি। এর ফলে কলকাতার দেশীয় সমাজের বাঁধন শিথিল হতে কোন বাধা পায় নি। ফলে, ওই সময়ের কলকাতাকে আশ্রয় করে অতীতের বঙ্গদেশের বর্ণ-বিন্যাসে ভাঙ্গনের অবকাশে সৎ-শূদ্র পর্যায়ের লোকেরা যেমন সামাজিক মর্যাদালাভের জন্য সচেষ্ট হয়েছিলেন, তেমনি অন্য শ্রেণীও অর্থকৌলীন্যে প্রতিষ্ঠিত হয়ে ওঠবার পরে নিজেদের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধির দাবিতে আবেদন-নিবেদন না করে গণ-আন্দোলনের পথকেই বেছে নিয়েছিলেন। সেই সময়ে অনেকেই বর্ণ গোত্র অর্থাৎ আত্ম-পরিচয় ছিন্ন করে নতুনভাবে সমাজে পরিচিত হতে চেয়েছিলেন। যেমন, মৎসজীবী কৈবর্তরা তখন অধিকতর সামাজিক মর্যাদার দাবি করে নিজেদের মাহিষ্য বলে পরিচয় দিতে শুরু করেছিলেন। একইভাবে তখনকার গোপ ও তেলি সমাজও অপরাপর ‘নবশাখ’ সম্প্রদায়ের সমান সামাজিক মর্যাদার দাবীতে আন্দোলন আরম্ভ করেছিলেন। ওই সব বর্ণগোষ্ঠীকৃত সামাজিক আন্দোলনের ফলে অপরাপর বহু বর্ণের তখন মানুষ ‘জলচল নবশাখ’ সম্প্রদায়ে উন্নীত হতে পেরেছিলেন। কিন্তু তখনও পর্যন্ত বঙ্গদেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী, যাঁরা অর্ধ-সংকর হিসাবে সমাজে চিহ্নিত ছিলেন, তাঁরা নিজেদের দাবীকে তেমনভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন নি।
উক্ত শতাব্দীতে বঙ্গদেশের অন্যান্য বর্ণের অবস্থার দিকে লক্ষ্য রেখেই শূদ্র-জাগরণ সূচিত হয়েছিল। পূর্ববঙ্গের (অধুনা বাঙলাদেশের) নমঃশূদ্র জাতির ভেতরেই সেই শূদ্র জাগরণ প্রথম দেখা গিয়েছিল। তাঁরাই ওই সময়ে প্রথম নিজেদের সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে উঠে পড়ে লেগেছিলেন। কিন্তু তাঁদের সেই সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই নিয়ে কিছু বলবার আগে, প্রাচীন এবং সমকালীন সমাজে তাঁদের কি পরিচয় বা ভূমিকা ছিল – সে প্রসঙ্গে কিছু জানবার প্রয়োজন রয়েছে। প্রাচীন গ্রন্থগুলি থেকে শূদ্র পিতা এবং ব্রাহ্মণ মাতার ঔরস-জাত সন্তান হিসাবে নমঃশূদ্র জাতির বর্ণ-পরিচয় পাওয়া যায়। ওই সময়ে নমঃশূদ্রদের বসবাস গোটা বঙ্গদেশ জুড়ে না হলেও, পূর্ববঙ্গে তাঁরাই তখন সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিলেন। সেই সময়ের বর্ণগত বৃত্তিতে দেখা যায় তাঁরা মূলতঃ – “Engaged for the most part in boating and cultivation. Bengali Namasudras are for the most part peaceful, hard working, cheerful cultivators.” বাংলার নমঃশূদ্র জাতির পরিচয় সম্পর্কে আরো জানা যে, একদা রাজা বল্লালসেন তাঁর পিতার রোগ মুক্তির যজ্ঞ অনুষ্ঠানের জন্য কান্যকুব্জ থেকে ৫ জন বৈদিক ব্রাহ্মণকে আনিয়েছিলেন। তাঁদের সঙ্গে পাঁচ জন কায়স্থও এসেছিলেন, এবং তাঁদের বংশধরেরা পরবর্তীকালের বাংলার ব্রাহ্মণ কায়স্থ সমাজে কুলীন হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিলেন। প্রথমে কান্যকুব্জরাজ বঙ্গদেশে ব্রাহ্মণদের পাঠাতে অরাজী হলে বল্লালসেন ৫০০ জন অনার্যকে গরুর পিঠে চড়িয়ে তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবার জন্য পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। তখন গোহত্যার ভয়ে কান্যকুব্জরাজ কোন যুদ্ধ না করে তাঁর রাজ্য থেকে ৫ জন ব্রাহ্মণকে বঙ্গদেশে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। এরপরে বল্লালসেন প্রতিদানে সেই ৫০০ জন অনার্যকে তৎকালীন হিন্দু সমাজে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, এবং তাঁর সেই অনাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে ব্রাহ্মণদেরই একটি সম্প্রদায় রাজরোষে পতিত হয়েছিলেন। প্রাণভয়ে সেই ব্রাহ্মণেরা তখন নদী বহুল পূর্ববঙ্গে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন, এবং নিজেদের পরিচয় গোপন করবার জন্য তাঁরা পৈতা ছিঁড়ে ফেলেছিলেন ও জীবিকার জন্য মৎস্যশিকার ও কৃষিকার্যে লিপ্ত হয়েছিলেন। প্রয়োজনের খাতিরে শূদ্রদের পেশা গ্রহণ করলেও তাঁরা নিজেদের শূদ্রের নমস্য, অর্থাৎ, ‘নমঃশূদ্র’ নামে পরিচয় দিয়েছিলেন। কিন্তু রাজার নির্দেশে শিক্ষা ও সামাজিক মর্যাদায় বঞ্চিত হয়ে, দারিদ্র্য ও হীনতর জীবনযাত্রার জন্য তাঁরা অবশেষে ‘জল অচল’ সমাজে পরিণত হয়েছিলেন। সেই থেকেই হিন্দুদের সমাজ-ব্যবস্থায় নমঃশূদ্র জাতি একটি অস্পৃশ্য জাতি হিসাবেই গণ্য হয়ে এসেছিল। শূদ্র হিসাবে তাঁরা কোন সামাজিক মর্যাদা কোনদিনই পাননি। অবহেলা, অবজ্ঞা, ও বঞ্চনাতেই তাঁদের কাল কেটেছিল। কারণ, তৎকালীন বর্ণহিন্দু সমাজের কাছে – “Like & sudra … the servant of another, to be removed at will, to be slain at will.” কিন্তু সেই সামাজিক শোষণকে, বিশেষ করে নমঃশূদ্র সম্প্রদায় – ঊনিশ শতকের মধ্যভাগ থেকেই অস্বীকার করতে শুরু করেছিলেন। তাঁরা সেই সামাজিক শোষণ থেকে নিজেদের মুক্তি ঘোষণা করতে চেয়েছিলেন। ফলে, তাঁদের সঙ্গে তৎকালীন সমাজের উচ্চ-বর্ণের সংঘাত অনিবার্য হয়ে হয়েছিল। দেখতে দেখতে ব্যাপক অঞ্চল জুড়ে গোটা নমঃশূদ্র সমাজেই সেই প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছিল।
তৎকালীন পূর্ববঙ্গের বরিশাল, যশোহর, খুলনা, ফরিদপুর ও পদ্মা-মধুমতীর তীরের নমঃশূদ্রেরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিলেন। তখন তাঁদের জীবিকা মূলতঃ ছিল কৃষিকার্য। কিন্তু সেই উচ্চবর্ণের লোকেরা তাঁদের দিয়ে যত রকমের কায়িক পরিশ্রমের কাজ করানো সম্ভব, সে সবই করিয়ে নিতেন। তৎকালীন নমঃশূদ্র সমাজ উচ্চ বর্ণের সেই বিদ্বেষ ও নীচুতাকে একটা সময়ে আর সহ্য করতে পারেনি। তাঁরা ভিতরে ভিতরে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিলেন। এরপরেই তাঁরা নিজেদের সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন গড়ে তুলতে বদ্ধ পরিকর হয়েছিলেন। তখন জাত বিচারের প্রশ্নে বাংলার নমঃশূদ্র জাতি অন্যান্য ‘নবশাখ’ সম্প্রদায়ের মতই নিজেদের জন্য অধিকতর সামাজিক মর্যাদার দাবি করেছিলেন। সেই সময়ে মনু সংহিতার প্রচলিত অনুশাসনকে নমঃশূদ্ররা আর মানতে রাজী হননি। ফলে উচ্চবর্ণের লোকেরা নমঃশূদ্র জাতির প্রতি দুর্ব্যবহার করতে আরম্ভ করেছিলেন। বিশেষতঃ সেই সময়ে পূর্ববঙ্গের কায়স্থরা অহেতুকই নমঃশূদ্রদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়াতে চাইলে নমঃশূদ্র জাতিও নিজেদের আত্মমর্যাদার লড়াইয়ে নামতে হতে বাধ্য হয়েছিলেন। এর ফলে ১৮৭৩ সালে স্ব-জাতির সম্মান ও আত্মরক্ষার্থে, এবং কায়স্থদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর জন্য তৎকালীন বাংলার নমঃশূদ্র অধ্যুষিত অঞ্চলে একটি গণ-আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল। সেই গণ-আন্দোলনের কার্যক্রম কেবলমাত্র সভা-সমিতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তদানীন্তন নমঃশূদ্র সমাজের অগ্রণী অংশ ন্যূনতম কর্মসূচীর ভিত্তিতে বাংলার জনগণকে সেই আন্দোলনের সামিল হতে উদ্বুদ্ধও করেছিলেন। এরপরে ১৮৭৩ সালে গোটা ফরিদপুর জেলায় নমঃশূদ্রদের পক্ষ থেকে একটি সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হলে, অন্যান্য সম্প্রদায়ের মধ্যেও সেটার মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলার জাতিভেদ বিষয়ে ওই ধরণের ধর্মঘট পালনের ডাক ভারত তথা বাংলার ধর্মঘটের ইতিহাসে সেই প্রথম এবং অভিনব ছিল। তখন জাত বিচারের প্রশ্নে বা বর্ণ বৈষম্যের বিরুদ্ধে নমঃশূদ্র জাতিরা ধর্মঘট পালনের ক্ষেত্রে নিজেদের কতগুলি দাবিকে প্রকাশ্যেই ঘোষণা করেছিলেন। তাঁদের প্রথম ও প্রধান দাবি ছিল যে, তাঁরা কিছুতেই অন্য কোন জাতির বা লোকের সেবা করবেন না। দ্বিতীয় দাবি ছিল যে, ব্রাহ্মণ ভিন্ন অন্য কোন জাতি বা সম্প্রদায়ের পাকান্ন তাঁরা গ্রহণ করবেন না। তখন মূলতঃ এই দুটি দাবিকে কেন্দ্র করেই একটা সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেওয়াটা সেকালের পক্ষে কম গৌরবের বিষয় ছিল না। আজও ভাবলে অবাক হতে হয় যে, তখন সামাজিক আত্মসম্মানের প্রশ্নে তাঁরা নিজেদের সমস্ত রকমের কাজকর্ম প্রায় বন্ধও করে দিয়েছিলেন। ওই সময়ে কিছু সংখ্যক নমঃশূদ্র তো নিজেদের জাতিগত বৃত্তি বর্জন করে, নৌকার মাঝি-মাল্লা হিসাবে জীবিকার্জনেরও চেষ্টা করেছিলেন।

দুর্ভাগ্যের বিষয় যে, নমঃশুদ্রদের সেই ধর্মঘট বেশী দিন স্থায়ী হয়নি, এবং তাঁদের সেই ধর্মঘট শেষ পর্যন্ত সফলও হয়নি। এমন কি ওই ধরঘটের ফলে তৎকালীন সমাজে তাঁদের বর্ণ বা জাতিগত মর্যাদাও কোন ভাবে বৃদ্ধি পায়নি। কিন্তু বাংলার শ্রমজীবী মানুষের কাছে তাঁদের সেই আন্দোলনের আবেদন একেবারে নিষ্ফল হয়ে যায়নি। ওই আন্দোলন তাঁদের কাছে একটি নতুন অর্থ ও শিক্ষা বহন করে এনেছিল। ঐসব শোষিত, নির্যাতিত মানুষের ঐক্যই সেই ধর্মঘটের প্রেরণা ও প্রাণ শক্তি ছিল, এবং তৎকালীন সমাজ থেকে বর্ণ-ব্যবস্থার উৎখাত ও সমান অধিকারের প্রশ্নটিও সেখানে মুখ্য হয়ে দেখা দিয়েছিল। ওই সময়ের সামন্ততান্ত্রিক শোষণের বিরুদ্ধেও নমঃশূদ্র জাতি সেই সামাজিক প্রতিষ্ঠা কামনার ভিতর দিয়েই একটি শোষণ মুক্ত সমাজ গড়ে তোলবার লক্ষ্যে পৌঁছতে চেয়েছিল। তাই শেষপর্যন্ত সাফল্য কিংবা ব্যর্থতা বড় কথা নয়, বঙ্গদেশে শূদ্র জাতির নবজাগরণের প্রাক-প্রস্তুতি হিসাবে ওই ধর্মঘট সেই সময়ের অন্যান্য শোষিত শ্রমজীবী মানুষকে মানবতাবাদে উজ্জীবিত করতে একটি সফল ভূমিকা নিয়েছিল। আর সেখানেই ছিল সেই আন্দোলনের মূল মর্মবস্তু ও সার্থকতার পরিচয়।

(তথ্যসূত্র:
১- প্রাচীন ভারতে শূদ্র, রামশরণ শর্মা।
২- বাঙ্গালী হিন্দুর বর্ণভেদ, নীহাররঞ্জন রায়।
৩- বাংলায় ধর্মঘট, অশোক ঘোষ।)

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও ভারতের ‘রাফায়েল’

মাত্র চোদ্দ দিন, আর তারমধ্যেই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ! নেপথ্যে জেনারেল মানেকশা’র রাফায়েল। অবাক হচ্ছেন? একাত্তরে ভারতের কাছে আবার ঐ বিমান কোথায়! একটু ভুল হলো, ইনি স্থলবাহিনীর রাফায়েল….. ইস্টার্ন কমান্ডের চীফ অফ স্টাফ(অপারেশন)।

পূর্ব রণাঙ্গনে যুদ্ধ শুরু হতেই এই সেনাধ্যক্ষ সেখানে
‘কনটেন অ্যান্ড বাইপাস’ পদ্ধতিতে আক্রমণ শানালেন। অন্যদিকে পাকিস্তানিদের যুদ্ধ পরিকল্পনা ছিল সীমান্তের অ্যাপ্রোচগুলোতে শক্তিশালী ‘ফোর্টস’ বা ‘স্ট্রং পয়েন্ট’ পদ্ধতিতে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। আর ঢাকা শহরকে ঘিরে ছিল পাঁচ স্তরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। এই পদ্ধতিতে সীমান্তের শক্তিশালী সেক্টর গুলোর পতন হলে সৈন্যেরা ঢাকার উদ্দেশে পশ্চাদপসরণ করে নির্দিষ্ট অবস্থানে এসে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলবে। ঢাকাকে কেন্দ্রে রেখে দীর্ঘ দিন ধরে যুদ্ধ চালিয়ে যাবে।

আর ভারতীয় সেনা কর্তা রাফায়েল কি করলেন ?
পাকবাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটের ঢাকায় আসার সব রাস্তা বন্ধ করে দিলেন। তার ওপরে সীমান্তের পাকিস্তানি শক্তিশালী প্রতিরক্ষা অবস্থানগুলোকে অবরুদ্ধ রেখে মূল বাহিনীকে ক্ষিপ্র গতিতে ঢাকা যেতে আদেশ দিলেন। মুক্তিবাহিনীর সাহায্য নিয়ে দুটো কাজই সফল ভাবে করতে পেরেছিল ভারতীয় সেনা। একমাসের লড়াই শেষ হয়ে যায় মাত্র তেরো দিনে!

১৫ই ডিসেম্বর সকাল থেকেই ভারতীয় বাহিনীর মাউন্টেন ব্রিগেড দুভাগে ভাগ হয়ে ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ার ও ব্রিগেডিয়ার সান্টা সিংহের নেতৃত্বে দ্রুত এগিয়ে আসছিল জামালপুর ময়মনসিংহ টাঙ্গাইল ধরে উত্তর দিক থেকে ঢাকার দিকে। সাভার এলাকার কাছাকাছি এদের সাথে যোগ দিলেন ১০১ কমিউনিকেশন কোরের জিওসি মেজর জেনারেল নাগরা। মুক্তিবাহিনী ততক্ষণে ঘিরে ফেলেছে রাজধানী ঢাকার চার পাশ। এই পরিস্থিতিতে যৌথবাহিনীর কমান্ডার স্যাম মানেকশ তার রাফায়েল কে বললেন, “যাও ওদের
আত্মসমর্পণে বাধ্য করো।’’ বাস্তবে সেটা ছিল এক দুঃসাহসী অভিযান। ঢাকা গ্যারিসনে তখন পাক সেনার সংখ্যা প্রায় ছাব্বিশ হাজার, অন্যদিকে ভারতীয় সেনা মাত্র তিন হাজার! যদিও পাক সামরিক গোয়েন্দারা এই সংখ্যাটা একদমই আন্দাজ করতে পারেনি। নিয়াজীর কাছে পাঠানো হলো আত্মসমর্পণের প্রস্তাব।

১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১, সকাল দশটায় হেলিকপ্টারে ঢাকা পৌঁছালেন রাফায়েল। আত্মসমর্পণের দলিল‌ নিয়ে সোজা হাজির হলেন ক্যান্টনমেন্টে পাক আর্মির সদর দফতরে। অনুগামী হয়েছিলেন বিবিসি’র কয়েকজন সাংবাদিক সহ মুক্তিযুদ্ধের নায়ক বাঘা সিদ্দিকী। সেখানে তাদের স্বাগত জানান স্বয়ং আব্দুল্লাহ খান নিয়াজি।

আত্মসমর্পণের দলিলের খসড়া যখন তিনি পড়ে শোনান তখন সেখানে পিনপতনের নিঃস্তব্ধতা। নিয়াজি কাঁদছিলেন। রাও ফরমান আলি ‘ভারত ও বাংলাদেশ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ’ কথাটিতে আপত্তি জানান। পাকিস্তানের আরও কয়েক জন অফিসার কিছু বিষয়ে আপত্তি জানান। ভারতীয় সেই সেনাধ্যক্ষ তাদের আশ্বস্ত করে বলেন, জেনেভা চুক্তি অনুযায়ী তাদের পূর্ণ নিরাপত্তা দেয়া হবে, তবে এই আত্মসমর্পণ হবে সেদিনই এবং প্রকাশ্য স্থানে।

পরের ইতিহাস তো সবায়ের জানা, কিন্তু রাফায়েল গেলেন কোথায় ? যেহেতু নিয়াজী ছিলেন পদ মর্যাদায় লেফটেন্যান্ট জেনারেল, তাই প্রটোকল অনুযায়ী সমমর্যাদার কোন অফিসারের কাছেই তার আত্মসমর্পণ করার কথা। তড়িঘড়ি উড়িয়ে আনা হলো ইস্টার্ন কমান্ডের জিওসি লে.জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা কে, আর তিনিই হয়ে গেলেন বিজয় দিবসের নায়ক। পাদপ্রদীপের পেছনে চলে গেলেন রাফায়েল!

১৯২৩ সালে কলকাতার এক সম্ভ্রান্ত ব্যবসায়ী পরিবারে জন্ম রাফায়েলের। বাবা ইলিয়াস ইমানুয়েল বাগদাদ থেকে এসেছিলেন এখানে। কার্শিয়াঙ মিশনারী স্কুল থেকে বেরিয়ে ১৯৪২ সালে তিনি যোগ দেন বৃটিশ ইন্ডিয়ান আর্মিতে। কমিশনড্ পান ইনফ্যানট্রি ডিভিশনে। ছত্রিশ বছর বিভিন্ন দায়িত্ব পালনের পর ১৯৭৮ সালে লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। বাহিনীতে অবদান রাখার জন্য পেয়েছেন PVSM ও COM পুরস্কার। বাংলাদেশ সরকার দিয়েছেন ‘মুক্তিযুদ্ধ’ সম্মাননা।
সামলেছেন গোয়া এবং পাঞ্জাবের রাজ্যপালের দায়িত্ব। একাত্তরের ঘটনাবলী নিয়ে বই লিখেছেন ..
সারেন্ডার ইন ঢাকা, বার্থ অব এ নেশন ।

চিনতে পারলেন এই সেনাকর্তাকে ?
জে. এফ. আর.জ্যাকব ওরফে জ্যাকব ফারজ রাফায়েল জ্যাকব, ভারতীয় সেনাবাহিনীর একমাত্র ইহুদী সেনানায়ক! ২০১৬ সালে নয়াদিল্লির সেনা হাসপাতালে দুনিয়া থেকে বিদায় নিলেন একাত্তরের যুদ্ধের এই উপেক্ষিত নায়ক!

মধুসূদন-প্রতিভার স্বরূপ সন্ধানে

রানা চক্রবর্তীঃ মাইকেল মধুসূদন দত্তের গোটা জীবনটাই একটা নাটক ছিল। বাঙালির জাতীয় জীবনের সঙ্কট-কালে তিনি দেখা দিয়েছিলেন বলে তাঁর জীবনেতিহাসেও একটা সঙ্কট দেখতে পাওয়া যায়, সেটা হল তাঁর মানসিক সঙ্কট। ওই সময়ে বাইরে দেশকালের মধ্যে ভাবধারার যে জটিলতা ও বিক্ষুব্ধি ছিল, কবির মনোভূমিতে সেটার প্রভাব সুস্পষ্টভাবে দেখতে পাওয়া যায়। ১৮২৪ সালের ২৫শে জানুয়ারি তারিখে, কপোতাক্ষ তীরে সাগরদাঁড়ি গ্রামে যে ছোট কপোতটি জন্ম নিয়েছিলেন, তাঁর মধ্যে আর কিছু না থাক, আত্মবিশ্বাসীর দুরন্তপনা অবশ্যই ছিল। নিজের গোটা জীবনে তিনি কখনও শান্তি চাননি, স্বস্তি চাননি, স্বাচ্ছন্দ্যও চাননি; তিনি শুধু আত্মপ্রত্যয়ের জোরে আমরণ ভেসে চলতে চেয়েছিলেন। তাইতো তাঁর অস্থির জীবনের কল্লোল থেকে থেকে শোনা গিয়েছিল। নিজের অশান্ত মনোধর্মের তাড়না নিয়ে তিনি নয় বছর বয়সে কলকাতায় পদার্পন করেছিলেন, কিন্তু সেখানে গিয়েও তাঁর মন স্থিব হয়নি। এরপরে হিন্দু কলেজ ও বিশপস কলেজ তাঁর মনের ওপরে ছায়া ফেলতে শুরু করেছিল, ফলে এক অস্থিব আবেগ তাঁর মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছিল। সাগর পাড়ের শ্বেতদ্বীপ তাঁকে বারবার হাতছানি দিয়ে ডেকেছিল। তাই পিতামাতার স্নেহের নিশ্চিন্ত আশ্রয় ভেঙে দিয়ে, অজানা পথের শঙ্কা বরণ করে নিয়ে তিনি খৃষ্টান হয়েছিলেন – যিশুর প্রতি ভক্তিবশতঃ নয় – এক নতুন জীবনের-সুধা আকণ্ঠ পান করবে বলে, একজন ‘মানুষের মত মানুষ’ হবেন বলে, বিলেত গিয়ে একজন বড়ো কবি হওয়ার সুযোগ পাবেন বলে তিনি ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন। বিজাতীয় ধর্মাবলম্বী হওয়ার পরে ইংল্যাণ্ডই তাঁর স্বপ্নের দেশ হয়ে উঠেছিল।

“And oh! I sigh for Albion’s strand
As if she were my native land!”
অতএব মধুসূদন মাতৃভূমি থেকে ছিন্নমূল হয়েছিলেন, নতুন জন্মের জন্মভূমির অঙ্গীকার নিয়েছিলেন। সবাই বুঝেছিলেন যে, তিনি জীবনে একটা কিছু চান। সেটার জন্য নিজের সর্বস্ব পণ করতেও তাঁর কোন দ্বিধা ছিল না। নিজের ব্যবহারিক জীবনে তিনি ইয়ং বেঙ্গলের একজন হয়ে স্পষ্টতঃই উচ্ছৃঙ্খল হয়ে পড়েছিলেন, বিজাতীয় সমস্ত কিছুর প্রতিই ভক্তির প্রাবল্যে তিনি স্নবের পরিচয় দিতে ইতস্ততঃ করেন নি। কিন্তু তাঁর বাইরের জীবনের সেই সর্বগ্রাসী উচ্ছৃঙ্খলতার মধ্যে, বিমূঢ়তার মধ্যে একটা অন্তর্জীবনও ছিল। তাঁর সেই জীবনে বিদ্যাদায়িনী ও কাব্যলক্ষ্মীর আসন সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল, তাই বাইরেব ঝড়-ঝাপটার মধ্যেও তাঁর অন্তরের দেবীর পূজায় কোন ব্যাঘাত ঘটেনি। বড়ো কবি হওয়ার স্বপ্নটানে তিনি তখন পাশ্চাত্য ভাষা ও সাহিত্যের সমুদ্র মন্থন করেছিলেন। হিন্দু কলেজে ইংরেজী ও পারসী, এবং বিশপস কলেজ গ্রীক ও ল্যাটিন শিখেছিলেন। মধুসূদনের মাদ্রাজ প্রবাস নিয়ে কোথাও তেমন আলোচনা পাওয়া যায় না, অথচ তাঁর জীবনে মাদ্রাজ প্রবাসের গুরুত্ব অনেক। যে বিপুল আশা নিয়ে তিনি খৃষ্টান হয়েছিলেন তার মধ্যে ধীরে, অতি ধীরে ভাঙন ধরেছিল; খৃষ্টান হলেই জীবনের যা কিছু কাম্য তা পাওয়া যায় না, এই উপলব্ধি তাঁর মধ্যে জাগতে শুরু করেছিল। মাদ্রাজে মধুসূদনের জীবন নিরবচ্ছিন্ন সুখের ছিল না, সেখানে বহু আয়াস ও পরিশ্রমে তাঁকে অন্নসংস্থান করতে হয়েছিল। এক কথায়, মাদ্রাজে থাকবার সময় থেকেই স্নব মধুসূদনের স্বপ্নের জগৎ একটু একটু করে ভাঙতে আরম্ভ করেছিল। ওই সময়ে তাঁর যৌবনের স্বপ্ন-বঙীন দিনে কবির চোখে যে প্রিয়া – “oh! beautiful as Inspiration when she fills the poet’s breast” – মধুসূদনের জীবনে তিনি প্রথমে এসেছিলেন কিনা সঙ্কীর্ণমনা ‘রেবেকা’ বেশে! পুরুষ, কবিপুরুষ নারীর কাছে প্রাণ-পিপাসায় যে সুধা চায়, রেবেকার কাছে সাফোর-ভক্ত মধুসূদন তা পাননি। এরপরেও কি তাঁর স্বপ্ন না আর ভেঙে পারত? দ্বিতীয়তঃ, ওই সময়ে তিনি ইংরেজী কাব্য লিখেছিলেন, ভালোই লিখেছিল – অথচ রসজ্ঞ ইংরেজ মনীষী ‘বেথুন’ সাহেব তাঁকে উপদেশ দিয়েছিলেন যে, বিদেশী ভাষায় কাব্য লিখলে তাঁর কোন উপকার হবে না, বরং মাতৃভাষায় কাব্য লিখলে তাঁর প্রতিষ্ঠা অনিবার্য। অর্থাৎ, খৃষ্টান হওয়ার সময়ে মধুসূদনের যে দুটি স্বপ্ন ছিল – তিনি একজন অভিজাত, সম্ভ্রান্ত ও উচ্চস্তরের ব্যক্তি হবেন, আর ইংরেজী ভাষার একজন কবি হবেন – সেই দুই স্বপ্নেই মাদ্রাজ প্রবাস কালে আঘাত এসেছিল, তারপরে আঘাতে আঘাতে বাস্তবের সাক্ষাতে তাঁর চোখ খুলতে শুরু করেছিল। আবার সেই সময়েই বিধাতার আশীর্বাদের মতো তিনি তাঁর সতী-সাধ্বী দ্বিতীয়া স্ত্রী ‘আঁরিয়েৎ’ বা ‘হেনরিয়েটা’কে লাভ করেছিলেন। তাঁর অশান্ত বিক্ষুব্ধ জীবনে সেই নারী স্নিগ্ধ প্রলেপ হয়ে দেখা দিয়েছিলেন, হয়তো জীবনের অন্তর্নিহিত মাধুর্যের আস্বাদ ও তাৎপর্যের সন্ধানও ওই সময়েই তিনি পেয়েছিলেন। সত্যি কথা বলতে কি, মধুসূদনের মাদ্রাজ প্রবাস-কাল তাঁর স্বপ্নভাঙার কাল ছিল, অন্ততঃ কিছু পরিমাণে আত্মস্থ ও স্থিতধী হওয়ার কাল ছিল। যদিও কোন কোন সমালোচক অন্য কথাও বলে থাকেন। কলকাতা থাকতেই মধুসূদন দিশি ভাষা ও সাহিত্যকে নিঃশেষে ত্যাগ করে ইংরেজী ও পাশ্চাত্য বিভিন্ন ক্লাসিক্যাল ভাষা ও সাহিত্যেব রাজ্যে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ওই সময়ে তিনি নাকি প্রকাশ্যে মাতৃভাষার নিন্দা করে বেড়াতেন। মাদ্রাজে প্রথমাবস্থায় সেটারই অনুবৃত্তি চলেছিল; সেই সময়ে তাঁর লেখা একটি চিঠি থেকে হিব্রু, গ্রীক, তেলেগু, সংস্কৃত, ল্যাটিন এবং ইংরেজী পাঠে তাঁর নিত্যকার অধ্যবসায়ের কথা জানতে পারা যায়। ওই সময়ে সীতাকে নিজের একটি রচনায় তিনি ‘অসতী’ (faithless) বলতেও ইতস্ততঃ করেন নি, ‘ক্যাপটিভ লেডি’র পাদটীকায় রামায়ণ ও পুরাণ সম্পর্কে তাঁর অজ্ঞতার প্রমাণ পাওয়া যায়। মাদ্রাজে থাকবার সময়েই তিনি আরেকটি চিঠিতে বাঙলা দ্রুত ভুলে যাচ্ছেন বলে ‘গৌরদাস বসাক’কে জানিয়েছিলেন। অর্থাৎ মাদ্রাজ প্রবাস মধুসূদনের পক্ষে দেশ, দেশের সাহিত্য ও দেশেব সংস্কৃতিকে অস্বীকারের কাল ছিল। কিন্তু অনেকেই আবার এই মতের পরিপোষক নন। মাদ্রাজে দেশীয় খৃষ্টান সমাজ ছাড়া তিনি আর কিছুই পাননি, এবং মধুসূদনের জীবনী যাঁরা অধ্যয়ন করেছেন তাঁরা নিশ্চই বিশ্বাস করবেন যে, এই দূরাভিলাষী ব্যক্তিটির স্বপ্ন তাতে অটুট থাকতে পারেনি। দ্বিতীয়তঃ, তখন পাশ্চাত্য বিভিন্ন ভাষার সঙ্গে তিনি সংস্কৃত ও তেলেগুও পড়ছিলেন – সেটি দেশের ভাষা ও সাহিত্যের দিকে তাঁর দৃষ্টি থাকবার উদাহরণ। তৃতীয়তঃ, গৌরদাস বসাকের কাছে মধুসূদন কাশীদাসী মহাভারত পড়বার আগ্রহ প্রকাশ করে সেটা মাদ্রাজে চেয়ে পাঠিয়েছিলেন। চতুর্থতঃ, গৌরদাসকে লেখা চিঠিতে নিজের ভাষা শিক্ষার তালিকা উল্লেখের শেষে তিনি মন্তব্য করেছিলেন – “Am I not preparing for the great object of embellishing the tongue of my fathers?” সবচেয়ে বড় কথা হল যে, মাদ্রাজ প্রবাস-কাল মধুসূদনের স্বপ্নভাঙার কাল না হলে তিনি তারপরে কলকাতায় ফিরে এসে সার্থক সাহিত্যের সোনার ফসল ফলাতে পারতেন না। সীতা সম্পর্কে তাঁর মন্তব্য ও ‘ক্যাপটিভ লেডি’র পাদটীকা আসলে স্নব ও উচ্চাভিলাষী মধুসূদন কর্তৃক বিদেশী পাঠক-পাঠিকাকে খুশি করবার একটা চেষ্টা মাত্র ছিল। ওই ধরনের ধাপ্পা বা স্নবারিব উদাহরণ মধুসূদনের জীবনেতিহাসে আরো অনেক পাওয়া যায়। তারপরে তিনি মাদ্রাজ থেকে পিতার মৃত্যু-সংবাদ পেয়ে তাঁর সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়ে ফিরে এসেছিলেন। কিন্তু সেই প্রাচুর্যের কুফল ফলবার আগেই তিনি তাঁর মাদ্রাজ জীবনের অভিজ্ঞতার সঞ্চয় নিয়ে, নিজের মাথায় বিদ্যের বোঝা নিয়ে – ভেতরের কবি-পুরুষের তাগিদে কয়েকটি শ্রেষ্ঠ সাহিত্য রচনা করে ফেলেছিলেন। বস্তুতঃ, সেটাই ছিল মধুসূদনের জীবন-নাট্যের প্রকৃষ্ট সময়। কারণ, ব্যবহারিক জীবনে যে দুঃখবেদনা, দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, এক কথায় যে ট্র্যাজেডি মাদ্রাজে তাঁকে সুখী হতে দেয়নি – পৈতৃক সম্পত্তির উদ্ভবাধিকার, পুলিশ কোর্টের চাকরি, আর্থিক সচ্ছলতা ও মানসিক শান্তি সেসবের অবসান ঘটাতে পেরেছিল। তার কবিজীবনের সঙ্গে ব্যবহারিক জীবনের সামঞ্জস্য আসবার ফলে তাঁর অস্থির জীবনের পুনর্বাসন ঘটেছিল। যে কোন সৃষ্টির জন্যই যে স্থিতি ও শান্তি অত্যাবশ্যক, মধুসূদনের মন তখন সেটার নাগাল পেয়েছিল। কবি তখন আত্মস্থ হয়েছিলেন। আর বাঙলার সমাজের মাহেন্দ্রক্ষণও সেই সময়েই এসেছিল (১৮৬০ খৃষ্টাব্দের আগে অথবা পরে)। বিধবা-বিবাহের আন্দোলনে, নীলকর-বিরোধী আলোড়নে, দেশীয় নাট্যশালা প্রতিষ্ঠায়, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনায়, নববিধান ব্রাহ্মসমাজেব অভ্যুত্থানে – তৎকালীন বাংলায় একটা সামাজিক পরিবর্তনের আভাস পাওয়া গিয়েছিল। এমনি এক শুভদিনে, বাঙালির সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উজ্জীবনের দিনে মধুসূদনের বাঙলা সাহিত্য-ক্ষেত্রে আবির্ভাব ঘটেছিল, সেটাকে বিস্ময়কর আবির্ভাব বললেও ভুল কিছু বলা হবে না। কিন্তু কবির সেই সৃষ্টিশীলতাও দীর্ঘস্থায়ী হয়নি, পৈতৃক সম্পত্তির সংস্পর্শে ও সামাজিক প্রতিষ্ঠার আস্বাদনে তাঁর ভেতরকার স্নব মানুষটি আবার জেগে উঠেছিল। অপব্যয়ে ও অমিতব্যয়ে তিনি নিজের জীবন কাটতে শুরু করেছিলেন, বিদেশে যাবাব স্বপ্নে তিনি আবার অস্থির অশান্ত হয়ে উঠেছিলেন। অর্থ-চিন্তা তাঁর ভেতরকার কবি মানুষটিকে ধ্বংস করেছিল; সাহিত্যেব পবিত্র পূজায় তাঁর অবহেলা মানসিক তপশ্চর্যা ঘটিয়েছিল। এরপরে ব্যারিস্টার হওযার জন্য তিনি বিলেত যাত্রা করেছিলেন। আর সেই যাত্রার ফল বিভীষিকাময় হয়েছিল। অনিদ্রায় অনাহারে বিদেশে তাঁকে নিজের দিন কাটাতে হয়েছিল, সেখানে শক্ত করে ধরবার জন্য কোন খুঁটিই তিনি খুঁজে পাননি। এর আগেও তাঁর জীবনে দুঃখ এসেছিল, অভাব এসেছিল – কিন্তু তখনও তিনি অমন ভাবে ভেঙে পড়েন নি; তখন সংসারের টানা-পেড়েনের হাত থেকে আপন শক্তিবলেই তিনি আপনাকে মুক্ত করেছিলেন। কিন্তু বিদেশে যখন দুঃখের আঘাতে আঘাতে তিনি রক্তাক্ত হয়েছিলেন, তখন বিদ্যাসাগরের দিকে আকুল দৃষ্টিতে তাকিয়ে, এবং সমস্ত সম্ভাব্য সাহায্য সত্ত্বেও শান্তির আশ্রয় ও স্বস্তির কোন অবলম্বন পাননি। ততদিনে তিনি প্রায় সব খুইয়ে বসে ছিলেন, নিজের মনের দিক থেকে তিনি তখন দ্রুত দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছিলেন, কাব্যলক্ষ্মীর ঝাঁপি ভরিয়ে তোলবার শক্তি-সামর্থ্যটুকুও তিনি তখন হারিয়ে ফেলেছিলেন। মধুসূদন তখন বাইরের দিক থেকে যেমন, ভেতরের দিক থেকেও তেমনি নিঃস্ব রিক্ত সর্বহারা হওয়ার পথে এগিয়ে গিয়েছিলেন। যদিও মাঝে মাঝেই তিনি জানাচ্ছিলেন বটে – আমি অবিশ্রান্ত পড়ে যাচ্ছি, শিখে যাচ্ছি – কিন্তু তখনকাব সমস্ত জীবনের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর সেই উক্তিগুলিকে আত্ম-ছলনার চেষ্টা ছাড়া আর কিছু বলে মনে হয় না। সেটা যেন নিজেকে ভুলিয়ে রাখবার জন্য তাঁর নিজের একটা অসামান্য প্রয়াস ছিল। এমনি দিনে মধুসূদনের বারে বারে তাঁর মাতৃভূমির কথা মনে পড়েছিল – যে মাতৃভূমি শুধু মৃন্ময় নয়, চিন্ময়ও বটে। সেই কপোতাক্ষ নদ, অন্নপূর্ণার ঝাঁপি, নদীতীরের দ্বাদশ শিবের মন্দির, কৃত্তিবাস, কাশীরাম দাস, জয়দেব, ইত্যাদি স্বপ্নে জাগরণে তাঁকে হনন করতে শুরু করেছিল। কিন্তু, হায়! বিমূঢ়তায় তিনি যে তখন অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছিলেন; সেখান থেকে ফেরবার পথ আর ছিল কোথায়? তাই চতুর্দশপদীতে শেষবারের মতো মধুসূদনের কবিকণ্ঠ আর্তনাদ করে উঠেছিল – মাতৃভূমিকে তিনি তাঁর রক্তাক্ত হৃদয়ের সর্বশেষ নমস্কার, সর্বশ্রেষ্ঠ নমস্কার জানিয়েছিলেন। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, মধুসূদনের মধ্যে এক অশান্ত হৃদয়াবেগ ও অতৃপ্ত আকাঙ্ক্ষা ছিল। সাগরদাঁড়ি থেকে কলকাতা, কলকাতা থেকে বিলেত, বিলেত থেকে ভারতবর্ষকে তিনি পেতে চেয়েছিলেন; একটিকে তিনি যখনই পেয়েছিলেন, তখনই আরেকটির জন্য তাঁর মনে আকুলতা জেগে উঠেছিল। তাঁর মন যে কোথাও স্থির হয়ে দাঁড়াতে চায়নি, দাঁড়াতে পারেনি – সেটার কারণ ছিল যুগ-পরিবেশ। সমাজে তখন নতুন জোয়ার-জল এসেছিল, সেই জোয়ারে মধুসূদন আত্মরক্ষা করতে পাবেন নি, অবশ্য তিনি আত্মরক্ষা করতেও চাননি; কারণ, তাঁর ব্যক্তিপুরুষেরও অস্থির ধর্ম ছিল। তখন কালের বুকে নিশ্চই আবর্ত জেগেছিল, আর সেই আবর্ত মধুসূদনের জীবনের তটেই ভেঙে পড়েছিল। আজও সম্বাদ-প্রভাকরের পৃষ্ঠা ঘাঁটলে সেকালের পিতার আর্তনাদ শুনতে পাওয়া যায় – “ওরে আমি কি ঝকুমারি করো তোরে হিন্দু কলেজে দিয়েছিলাম যে তোর জন্য আমার জাতিকুলমান সমুদয় গেল!” কিন্তু তখন হিন্দু কলেজে পড়লেই ছেলেরা উচ্ছঙ্খল হতেন, একথাই বা বলা যায় কি করে? মধুসূদনের হিন্দু কলেজের সহপাঠী ছিলেন ‘রাজনারায়ণ বসু’ ও ‘ভূদেব মুখোপাধ্যায়’। তাঁদের মধ্যে একজন গিয়েছিলেন রিফরমেসনের পথে, অন্যজন ঝুঁকেছিলেন রক্ষণশীলতার দিকে। আসল কথা হল, সমাজে তখন যে নতুন বন্যা এসেছিল, মধুসূদন সেটা থেকে নিজেকে বাঁচাতে চাননি; কারণ, তাঁর মন কখনো নোঙর করতে শেখেনি। দ্বিতীয়তঃ, তাঁর আত্মমহিমা বা ব্যক্তিত্ববোধ খুব প্রখর ছিল, তাই ইয়ং বেঙ্গলের স্রোতে গা ভাসিয়ে দিতে তিনি কোন কুন্ঠাবোধ করেন নি। কারণ, ইয়ং বেঙ্গল, গভীরতর দৃষ্টিতে, ব্যক্তিতন্ত্রের উপাসক ছিল না কি? এবং তাতে উচ্ছ্বাস ও স্বেচ্ছাচারিতা, অতিসাহস ও স্পর্ধা থাকাটাই স্বাভাবিক ছিল। মধুসুদন আপন ব্যক্তিত্ববোধের তাগিদে রাজনারায়ণ-জাহ্নবীর স্নেহের ফাটল দিয়ে যুগের ঝড়ো হাওয়ার দিকে এগিয়ে গিয়েছিলেন। তাছাড়া অতি অল্প বয়সে, ‘গ্যেটের’ চেয়েও কম বয়সে, তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, তিনি কবিত্ব-প্রতিভা নিয়েই জন্মেছেন, অসাধারণ একটা কিছু করবার জন্যই রাজনারায়ণের ছেলের আবির্ভাব ঘটেছে। সেই উপলব্ধিটাও তাঁকে ঘর ছেড়ে বাইরে ছুটে যেতে প্রেরণা দিয়েছিল। ফলে মনে তাঁর শান্তি ছিল না, স্থৈর্য ছিলো] না, দৃঢ়তা ছিল না – তাঁর মানসিক ভারসাম্য কখনোই অটুট থাকে নি। একটা গভীর প্রত্যয় ছাড়া কারো জীবন কখনো দাঁড়াতে পারে না, একটি বিশ্বাসের শক্ত জমির ওপরে অন্তর্জীবন দাঁড় করাতে না পাবলে মানুষের চলে না। মধুসূদন নিজের গোটা জীবন ধরে সেই অপরিহার্য শক্ত জমি হারিয়ে ফেলে শুধুই অবিশ্রান্ত উড়ে বেড়িয়েছিলেন। বহু সংগ্রামেব শেষে সেই জীবন-পাখি যখন মাটি খুঁজে পেয়েছিল তখন বড় দেরি হয়ে গিয়েছিল। তাই মধুসূদনের বিদেশ থেকে প্রত্যাবর্তনের পরের দিনগুলি ছিল শুধুই অপচয়ের দিন, মৃত্যুর দিকে তাঁর ক্ষয় হয়ে যাওয়ার দিন। অতি বেদনাদায়ক সে ইতিহাস।

মধুসূদন আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ক্রান্তিলগ্নের প্রতীকী-কবি। তাঁর কাব্যমূল্য মোটামটি চূড়ান্তভাবে নির্ধারিত হলেও তাঁর ঐতিহাসিক তাৎপর্য সম্বন্ধে পাঠক-পাঠিকার কৌতূহল এখনও অতৃপ্তই রয়ে গিয়েছে। তাঁর সম্বন্ধে জিজ্ঞাসার উৎস নিঃশেষিত না হয়ে চির-প্রবহমাণ। তাঁর এই ঐতিহাসিক ভূমিকাই তাঁর সম্বন্ধে বিচিত্র ও বহুমুখী ধারাকে উন্মুক্ত রেখেছে। বিদেশীয় সাহিত্য ও দেশী সংস্কৃতির অপূর্ব সমন্বয় রহস্যের সূত্রটি তাঁর হাতেই বিধৃত। প্রায় দেড়শো-বছরের আধুনিক বাংলা সাহিত্যধারা যে পথে প্রবাহিত হয়েছে তাঁর রচনাই সেটার গতিপথ নির্ণায়ক। মধুসূদনকে সম্যক না বুঝলে, যে মানসচেতনা ও কল্পনাসমৃদ্ধির মাধ্যমে পাশ্চাত্য সাহিত্যের প্রাণরস ভারতীয় কবি-চিত্তের অন্তঃপ্রকৃতির অঙ্গীভূত হয়েছে, তার রহস্য অবিদিতই থাকবে। নতুন ও পুরাতনের এই অন্তরঙ্গ মিলন মধুসূদনের কবিপ্রতিভারই স্বীকরণশক্তির পরিচয় ও তাঁর পরবর্তীদের সাহিত্যকৃতির আদিম প্রেরণা। রামমোহনকে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “Inaugurator of Modern Age in India” – “ভারতে আধুনিক যুগের প্রবর্তক”। তেমনই মাইকেল মধুসূদন ছিলেন ভারতীয় সাহিত্যে আধুনিক যুগের প্রবর্তক। আধুনিক বাংলা সাহিত্য যে গরিমায় আজ বিশ্ব সাহিত্যে সুপ্রতিষ্ঠিত, মাইকেল মধুসূদনই সেটার সূচনা করেছিলেন। পাশ্চাত্য সাহিত্যের ভাবসম্পদ ও আঙ্গিককে বাংলা সাহিত্যের ভাণ্ডারে গ্রহণের পথ সর্বপ্রথম তিনিই দেখিয়েছিলেন। বিশ্ব সাহিত্যের মহাসমুদ্রকে মন্থন ক’রে অমৃত সংগ্রহের জন্যে প্রয়োজনীয় দৈবী ও দানবিক দুই শক্তিরই অধিকারী ছিলেন তিনি। তাঁর শক্তি ছিল দৈবী, কারণ, তাতে ছিল অতুলনীয় নিষ্ঠা, সাধনা ও আত্মপ্রত্যয়; তাঁর শক্তি ছিল দানবিক, কারণ, তাতে ছিল শক্তির অতুলনীয় দম্ভ এবং গগনস্পর্শী উচ্চাশা। তিনি কেবল ইংরেজী, গ্রীক, লাতিন, ইতালীয়, ফরাসী, জার্মান ও সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের সমুদ্রকে মন্থন করেন নি, ঐসব সাহিত্যের মহাকবিদের সমকক্ষ হওয়ার উচ্চাশা ও অহংকারও তিনি পোষণ করতেন। তিনি হোমার, ভার্জিল, দান্তে, মিল্টন, ব্যাস ও বাল্মীকির রচনাকে কেবল আকণ্ঠ পান করেন নি; তিনি হোমার, ভার্জিল, দান্তে, মিল্টন, ব্যাস ও বাল্মীকির সমকক্ষ হয়ে তাঁদের সমান আসনে আপনাকে প্রতিষ্ঠিত করবার উচ্চাশা ও অহংকার পোষণ করতেন। তাই তিনি বাল্যকালেই তাঁর প্রিয় বন্ধুকে বলতে দ্বিধা করেন নি – “Oh! how should I like to see you write my ‘Life’, if I happen to be a great poet, which I am almost sure I shall be …” নিজের কবিত্ব শক্তি সম্পর্কে দম্ভ ও তাঁর উচ্চাশা তিনি কৈশোরেই উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন। মধুসুদনের মধ্যে যে দৈবী ও দানবিক শক্তির মিলন ঘটেছিল, সেটাই তাঁকে একদিকে যেমন কবিত্বের উত্তঙ্গ গরিমায় প্রতিষ্ঠিত করেছিল, অন্যদিকে তেমনি তাঁকে একদা দুঃখের অতল গহবরেও নিক্ষেপ করেছিল। তাঁর জীবনে যেমন ঐশ্বর্য ও ভোগবিলাসের রাজসিকতা, দৈন্য-দুঃখের চরম অবস্থা দেখতে পাওয়া যায়, তেমনই দেখতে পাওয়া যায় দেবোপম বন্ধুপ্রীতি, পত্নীপ্রেম, সন্তান বাৎসল্য, ক্ষুরধার বুদ্ধি, জ্ঞান ও পাণ্ডিত্য – আবার এগুলোর সাথে দেখতে পাওয়া যায় চরম হৃদয় হীনতা, হঠকারিতা, ঔদাসীন্য, অবহেলা, নির্বুদ্ধিতা, অবিবেচনা, এমনকি স্বার্থপরতা। যে স্বর্গ ও নরকের মিলন ঘটেছে মর্ত্যলোকের সীমানায়, সেই স্বর্গ ও নরকের দুই কোটিকেই প্রত্যক্ষ করা যায় তাঁর জীবনে। তাই তাঁর জীবন আমাদের যেমন উল্লসিত করে, তেমনই পীড়াও দেয়৷ মধুসূদনের জীবন-আলেখ্য আলোকে, অন্ধকারে, ঔজ্জ্বল্যে, কালিমায় এমন পরিপূর্ণ যে, তাঁকে বৈপরীত্যের সমাবেশও বলা চলে।
হিন্দু কলেজের ছাত্র থাকবার সময়ে মধুসূদন রোমান কবি ওভিড-এর লেখা ‘এপিস্তুলাই হেরোইদুম’ বা ‘হেরোইদেস’ পড়েছিলেন; যেখানে গ্রিক পুরাণের নারীরা আবেগে-আশ্লেষে তাঁদের প্রেমিকদের চিঠি লিখেছিলেন। অমন কাব্য তখন বাংলায় ছিল না। তাই মধুসূদনের মনে হয়েছিল যে, ওভিড-এর অনুকরণে নতুন এক কাব্য লিখলে কেমন? সেখানে ভারতীয় পুরাণের নারীরা ‘প্রশ্ন-অভিযোগ-আহ্বান’ জানিয়ে চিঠি লিখবেন তাঁদের স্বামী অথবা প্রেমিককে। চিঠির আদল হবে ‘পৌরাণিক’, কিন্তু অন্তরে থাকবে ‘সমকালের স্বর’। নিজের মাথায় ঘুরতে থাকা সেই পরিকল্পনা তিনি তাঁর প্রিয় বন্ধু গৌরদাস বসাককে তখনই জানিয়েছিলেন। এর বেশ কয়েক বছর পরে মধুসূদন লিখেছিলেন ‘বাংলা সাহিত্যের প্রথম পত্রকাব্য’ – ‘বীরাঙ্গনা কাব্য’। তত দিনে জীবনের পরিচিত ছন্দ থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন তিনি। ‘তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য’ ও ‘মেঘনাদবধ কাব্য’-এর পরে, ১৮৬২ সালে প্রকাশিত হয়েছিল মধুসূদনের ‘বীরাঙ্গনা কাব্য’। ‘শকুন্তলা’, ‘তারা’, ‘রুক্মিণী’, ‘কৈকেয়ী’, ‘শূর্পণখা’, ‘ভানুমতী’, ‘দ্রৌপদী’, ‘দুঃশলা’, ‘জাহ্নবী’, ‘ঊর্বশী’, ‘জনা’ – এগারো জন পৌরাণিক নারী চরিত্র ‘বীরাঙ্গনা কাব্য’-এ তাঁদের প্রেমিক অথবা স্বামীকে চিঠি লিখেছিলেন। সে চিঠির সুর ছিল কখনও অনুনয়ের, কোথাও বা প্রশ্ন আর অভিযোগে তীক্ষ্ণ। পুরাণের প্রচলিত ছাঁদ, চেনা গল্পকে সম্পূর্ণ দুমড়ে তাকে নতুন খাতে বইয়ে দিয়েছিলেন মাইকেল। যে প্রবণতা ‘মেঘনাদবধ’ কাব্যে আছে। সংস্কৃত সাহিত্য, পুরাণ, দান্তের ‘ডিভাইন কমেডি’ বা ভার্জিলের ‘দ্য ইনিড’ পড়া মুক্তমনা মাইকেল এমন এক সমাজের ছবি দেখতে চেয়েছিলেন, যেখানে নারী প্রশ্ন তুলবে, বুঝে নিতে চাইবে নিজের ‘অধিকার’। যা সে সময় ছিল ‘আকাশকুসুম চিন্তা’। তাই দেখা যায়, ‘বীরাঙ্গনা কাব্য’-এ কথা দিয়ে কথা না রাখা স্বামীর বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলেছেন কৈকেয়ী; আবার দেখা যায় যে রুক্মিণী স্বেচ্ছায় অপহৃতা হতে চেয়ে পত্র পাঠিয়েছেন দ্বারকানাথ শ্রীকৃষ্ণের কাছে। মাইকেলের ‘বীরাঙ্গনা’রা কুণ্ঠা কাটিয়ে জগৎকে জানাতে চান নিজের ইচ্ছের কথা, নিছক সংস্কারবশে মেনে নেন না স্বামী বা প্রেমিকের প্রবঞ্চনা। কিন্তু প্রথম থেকেই ‘বীরাঙ্গনা কাব্য’-এর সবচেয়ে বিতর্কিত পত্র হয়ে দাঁড়ায় ‘সোমের প্রতি তারা’। প্রত্যেক নায়িকার চিঠির শুরুতেই মধুসূদন কাহিনীসূত্র দিয়েছিলেন। সেখানে বলা আছে, কোন পরিস্থিতিতে সেই নায়িকা অমুককে ওই চিঠিটি লিখেছেন। তারার চিঠির মুখবন্ধ থেকে জানতে পারা যায়, ‘দেবগুরু বৃহস্পতি’র আশ্রমে বিদ্যালাভের জন্য এসেছিলেন যুবক ‘সোমদেব’। রূপবান এই তরুণের রূপে মুগ্ধ হয়েছিলেন ‘বৃহস্পতির স্ত্রী তারা’। শিক্ষাশেষে ছাত্র ফিরে যাওয়ার উদ্যোগ নিলে গুরুপত্নী চিঠি লেখেন সোমদেবকে। যেখানে মেলে ধরেন তাঁর অনুক্ত কামনা। মধুসূদন লিখেছিলেন – “সোমদেব যে এতাদৃশী পত্রিকাপাঠে কি করিয়াছিলেন, এ স্থলে তাহার পরিচয় দিবার কোন প্রয়োজন নাই। পুরাণজ্ঞ ব্যক্তিমাত্রেই তাহা অবগত আছেন।” আর গোলমাল বাধে এখানেই। আসলে কী করেছিলেন সোমদেব? পুরাণে আছে, সিক্তবসনা তারাকে দেখে সোমদেব উত্তেজিত হয়ে পড়েন। এমনই সে উত্তেজনা যে সব কিছু ভুলে তিনি অপহরণ করেন তারাকে। তারা যথাসাধ্য বাধা দেন। বারবার মনে করিয়ে দিতে থাকেন কে তিনি। পতিব্রতা গুরুপত্নীকে জোরপূর্বক সঙ্গম করলে যে সহস্র ব্রহ্মহত্যার সমান পাপ হয়, সে কথাও জানাতে ভোলেন না। কিন্তু কামোন্মত্ত সোমদেব জল-স্থল-পাতালের নানা জায়গায় তারাকে নিয়ে যান, আর মেতে থাকেন উদ্দাম সঙ্গমে। অবশেষে ‘প্রজাপিতা ব্রহ্মা ও মহাদেবের মধ্যস্থতায়’ বৃহস্পতি ফিরে পান তাঁর স্ত্রীকে। তারা তখন গর্ভবতী, ক্রমে সোমদেবের ঔরসে জন্ম হয় ‘বুধের’। ‘ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের’ এই কাহিনী সম্পূর্ণ উল্টে যায় মাইকেলের লেখায়। সেখানে দেখা যায় দেবী তারাই কামনা করছেন ‘চন্দ্র’কে। তারা চন্দ্রের উদ্দেশে লিখছেন –
“তুষেছ গুরুর মন: সুদক্ষিণাদানে,
গুরুপত্নী চাহে ভিক্ষা, দেহ ভিক্ষা তারে।”
এক অদম্য শরীরী আহ্বান, যেখানে স্পষ্ট এক নারীর যৌন স্বাধিকারের কথা। কিন্তু মাইকেল ‘পুরাণের বদল’ ঘটিয়েছিলেন কেন? উত্তর খুঁজতে আর এক পৌরাণিক প্রসঙ্গের গিঁট খুলতে হয়। মহামতি ‘অঙ্গিরার পুত্র উতথ্য’ ছিলেন বৃহস্পতির বৈমাত্রেয় দাদা। ‘উতথ্যর স্ত্রী মমতা’ যখন গর্ভবতী, এক দিন বৃহস্পতি মমতার অসম্মতি সত্ত্বেও তাঁর সঙ্গে রমণে উদ্যত হন। মমতা বাধা দেন। এমনকি তাঁর গর্ভস্থ সন্তানটিও মায়ের জরায়ুপথ আটকানোর চেষ্টা করে। ‘সম্ভোগ’ ব্যাহত হওয়ায় ক্রুদ্ধ ‘দেবগুরু’ সেই সন্তানকে ‘অন্ধত্বের অভিশাপ’ দেন। মমতাও পাল্টা অভিশাপ দিয়ে বসেন বৃহস্পতিকে – এক দিন তাঁর স্ত্রী তারা-ও পরপুরুষের ভোগ্যা হবেন। তাই তারার নারীত্বের অবমাননা বুঝি একপ্রকার ‘অনিবার্য’ই ছিল। এক বিকৃতকাম পুরুষের লালসার ফলশ্রুতিতে অন্য এক পুরুষের কামনার শিকার হয়েছিলেন আর এক নারী। মধুসূদন এই ‘পৌরাণিক অশালীনতার প্রায়শ্চিত্ত’ করতে চেয়েছিলেন সদর্পে। পুরাণকথার অভিমুখটাই তিনি ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন। মূল পুরাণে উল্লেখিত সোমদেবের লাম্পট্যের গল্পের পরিবর্তে সেখানে চালিকার আসনে বসিয়েছিলেন তারাকে। মাইকেল ছন্দ ভাঙলেও সেই সময় সমাজ তো ছন্দ ভাঙতে শেখেনি। পুরাণের গল্প পাল্টে গিয়েছিল – নারী তাঁর অধিকার নিয়ে সোজাসুজি প্রশ্ন করছে, সেক্ষেত্রে সমালোচনার ঝড় ওঠার কথা। কিন্তু এই কাব্য তার বিষয় আর আঙ্গিকের অভিনবত্বে সেই সময় এতই আলোড়ন ফেলেছিল যে, বীরাঙ্গনাদের চিঠির উত্তর লেখার একটা প্রবণতা চোখে পড়ে পরের পঞ্চাশ বছর জুড়ে। ওই কাব্য প্রকাশকালের বছর দশেক পরেই অসমের বরাক উপত্যকার ‘রামকুমার নন্দী মজুমদার’ লিখেফেলেছিলেন ‘বীরাঙ্গনা পত্রোত্তর কাব্য’। যেখানে ‘চন্দ্র’ বলছেন –
“কলঙ্কী শশাঙ্ক কেহ বলে নাই সতি!
এত দিন, কিন্তু তব ভবিষ্যত-কথা
দৈববাণী সম এবে ফলিবে দাসেরে;
ধরিবে কলঙ্ক এ কিঙ্কর তব নামে –
শোভিবে সোমের অঙ্কে সে কলঙ্করেখা,
ভৃগুপদচিহ্ন যথা মাধবের হৃদে।
তারানাথ নাম মম তেয়াগিয়া আজি,
হইব তারার দাস জনমের মত!”
ঔপনিবেশিক বাস্তবতায় উত্তরসূরিরা কিভাবে মধুসূদনকে আঁকড়ে ধরেছিলেন, তারই আভাস পাওয়া যায় ওই ‘উত্তর-বীরাঙ্গনা পত্রকাব্য’ পড়লে।

তবে নিজের কাব্যে অলংকার ও উপমা প্রয়োগে মধুসূদন প্রথাজীর্ণ ঐতিহ্যকে সম্পূর্ণভাবে পরিহার করতে পারেন নি। তাঁর কাব্যে ব্যবহৃত বহু অলংকারই ভারতকাব্যের চিরন্তন সঞ্চয় থেকে গৃহীত, পুরাণ-চেতনার দ্বারা অনুবিদ্ধ। কোথাও কোথাও তাঁর মৌলিকতা আশ্চর্যভাবে প্রকাশ পেলেও মোটের উপরে তিনি পাঠক-পাঠিকার চিরাভ্যস্ত প্রত্যাশাকে নিদারণভাবে ক্ষুন্ন করেন নি, দেবলোক ও স্বর্গ-নরকের পরিকল্পনাতে তিনি পাশ্চাত্য চিন্তা প্রভাবিত হলেও, যথাসম্ভব পৌরাণিক আদর্শের প্রতি বিশ্বস্তই থেকেছেন, উৎকটভাবে প্রচলিত সংস্কারের উল্লম্বন করেন নি। সচেতন সৃষ্টি প্রয়াসে তিনি বিদেশের মুখাপেক্ষী হলেও অবচেতনের গভীরে তিনি জাতীয় সংস্কৃতির টানে সাড়া দিয়েছেন। তাঁর সরস্বতীর স্তব, বাল্মীকি বন্দনা ও এই ভক্তিবিহ্বলতা প্রকাশের ভাষা ও ভঙ্গী সবই সংপ্রাচীন ভারতীয় কাব্যসাধনার শিষ্টরীতির অনুগামী। এই অস্থিমজ্জাগত ভাবচেতনার মুলে তাঁর মনোভূমিতে কোথায় প্রচ্ছন্ন ছিল, তাঁর জীবন কাহিনী সে সম্বন্ধে নীরব। এর হেতু খুঁজতে গিয়ে অন্য পর্যাপ্ত কারণের অভাবে সেটাকে মধুসূদনের জাতিস্মরতার অলৌকিক নিদর্শন রূপে নেওয়া সম্ভব নয়। যিনি নিজের সমস্ত জীবন দিয়ে পাশ্চাত্য আদর্শের সাধনা করেছিলেন, শেষপর্যন্ত দেখা গিয়েছিল যে, দেশের সঙ্গে তাঁর আত্মিক সম্পর্ক চেতনার মূল পর্যন্ত প্রসারিত ও অবিস্মরণীয়। মধুসূদনের জীবন ও কাব্যের অসমাহিত দুটি সমস্যা দুটির হল – (১) তাঁর কবি-জীবনের ভূমিকা সম্বন্ধীয়, ও (২) তাঁর মনে প্রাচ্যভাবের বদ্ধমূলতা বিষয়ক। কেমন করে তিনি মহাকবি হলেন ও কেমন করে পাশ্চাত্য ও প্রাচ্য সংস্কৃতির অপূর্ব সমন্বয়কারী জীবনচেতনার প্রতীক রূপে তিনি আত্মপ্রকাশ করলেন – এই দুই প্রশ্নের সমাধান শেষ পর্যন্ত প্রতিভারহস্যের স্বরূপ-উপলদ্ধির সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য ভাবে জড়িত। আধুনিক যুগের অন্য দুই প্রতিভাধর প্রবর্তক – বঙ্কিমচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে সাহিত্য সমালোচকদের সেই সংশয়িত মনোভাব নেই। কেবল এই ভাবগঙ্গার আদি ভগীরথ এককালে মাইকেল, এখন শ্রীমধুসূদন সম্বন্ধে এখন মানুষ যত বেশি জানেন, তার চেয়ে অনেক বেশী জানেন না – এই ধারণাই অখণ্ডিত থেকে গিয়েছে।

(তথ্যসূত্র:
১- মধুসূদন রচনাবলী।
২- যুগন্ধর মধুসূদন, শীতাংশু মৈত্র।
৩- সনেটের আলোকে মধুসূদন ও রবীন্দ্রনাথ, জগদীশ ভট্টাচার্য।
৪- মধুসূদন দত্ত, ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়।
৫- কাব্যসাহিত্যে মাইকেল মধুসূদন, কনক বন্দোপাধ্যায়।
৬- মধুসূদনের কবি-আত্মা ও কাব্যশিল্প, ক্ষেত্র গুপ্ত।)
©️রানা চক্রবর্তী©️

কুমারী পূজা কি? কেন করা হয়? শাস্ত্র ও পুরান মতে কুমারী পূজার ব্যাখ্যা

ঠাকুর শ্রী রামকৃষ্ণ বলেছেন,- “ দিব্যচক্ষু চাই। মন শুদ্ধ হলেই সেই চক্ষু হয়। দেখনা কুমারীপূজা। হাগা-মোতা -মেয়ে, তাকে ঠিক দেখলুম সাক্ষাৎ ভগবতী।” তিনি আরও বলেছেন,- “সারদা মা কে কুমারীর ভিতর দেখতে পাই বলে কুমারীপূজা করি।”

কুমারী হল শুদ্ধ আধার। কুমারী পূজা হলো তন্ত্রশাস্ত্রমতে অনধিক ষোলো বছরের অরজঃস্বলা কুমারী মেয়ের পূজা। বিশেষত দুর্গাপূজার অঙ্গরূপে এই পূজা অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়াও কালীপূজা, জগদ্ধাত্রীপূজা এবং অন্নপূর্ণা পূজা উপলক্ষে এবং কামাখ্যাদি শক্তিক্ষেত্রেও কুমারী পূজার প্রচলন রয়েছে।

প্রতিবছর দুর্গাপূজার মহাষ্টমী পূজার শেষে কুমারী পূজা অনুষ্ঠিত হয় তবে মতান্তরে নবমী পূজার দিনও এ পূজা অনুষ্ঠিত হতে পারে।
সূদূর অতীত থেকেই কুমারী পূজার প্রচলন ছিলো এবং তার প্রমাণ পাওয়া যায় “কুমারীপূজাপ্রয়োগ” গ্রন্থের পুথি থেকে।

● বর্ণনা: যোগিনীতন্ত্র, কুলার্ণবতন্ত্র, দেবীপুরাণ, স্তোত্র, কবচ, সহস্রনাম, তন্ত্রসার, প্রাণতোষিণী, পুরোহিতদর্পণ প্রভৃতি ধর্মীয় গ্রন্থে কুমারী পূজার পদ্ধতি এবং মাহাত্ম্য বিশদভাবে বর্ণিত হযে়ছে। বর্ণনানুসারে কুমারী পূজায় কোন জাতি, ধর্ম বা বর্ণভেদ নেই। দেবীজ্ঞানে যে-কোন কুমারীই পূজনীয়, এমনকি বেশ্যাকুলজাত কুমারীও। তবে সাধারণত ব্রাহ্মণ কুমারী কন্যার পূজাই সর্বত্র প্রচলিত। এক্ষেত্রে এক থেকে ষোলো বছর বয়সী যে কোনো কুমারী মেযে়র পূজা করা যায়। বয়সের ক্রমানুসারে পূজাকালে এই সকল কুমারীদের বিভিন্ন নামে অভিহিত করা হয়।

কুমারী পূজা

১) এক বছরের কন্যা — সন্ধ্যা।
২) দুই বছরের কন্যা — সরস্বতী।
৩) তিন বছরের কন্যা — ত্রিধামূর্তি।
৪) চার বছরের কন্যা — কালিকা।
৫) পাঁচ বছরের কন্যা — সুভগা।
৬) ছয় বছরের কন্যা — উমা।
৭) সাত বছরের কন্যা — মালিনী।
৮) আট বছরের কন্যা — কুষ্ঠিকা।
৯) নয় বছরের কন্যা — কালসন্দর্ভা।
১০) দশ বছরের কন্যা — অপরাজিতা।
১১) এগারো বছরের কন্যা — রূদ্রাণী।
১২) বারো বছরের কন্যা — ভৈরবী।
১৩) তেরো বছরের কন্যা — মহালপ্তী।
১৪) চৌদ্দ বছরের কন্যা — পীঠনাযি়কা।
১৫) পনেরো বছরের কন্যা — ক্ষেত্রজ্ঞা।
১৬) ষোলো বছরের কন্যা — অন্নদা বা অম্বিকা।

● কুমারী পূজা বিষয়ে বিভিন্ন শাস্ত্রীয় ও পৌরাণিক ধারনা: বৃহদ্ধর্মপুরাণের বর্ণনা অনুযায়ী দেবতাদের স্তবে প্রসন্ন হয়ে দেবী চণ্ডিকা কুমারী কন্যারূপে দেবতাদের সামনে দেখা দিয়েছিলেন। দেবীপুরাণে বিস্তারিত এ বিষয় উল্লেখ আছে। তবে অনেকে মনে করেন যে, দুর্গা পূজায় কুমারী পূজা সংযুক্ত হয়েছে তান্ত্রিক সাধনামতে। এক সময় শক্তিপীঠ সমূহে কুমারী পূজার রীতি প্রচলিত ছিল। শ্বেতাশ্বতর উপনিষদেও কুমারীর কথা উল্লেখ আছে। আর এ থেকে অনুমান করা কঠিন নয় যে, দেবীর কুমারী নাম অনেক পুরনো। দেবীর কুমারী নাম যেমন পুরনো, তার আরাধনা ও পূজার রীতিনীতিও তেমনি প্রাচীন এবং ব্যাপক।
যোগিনীতন্ত্রে কুমারী পূজা সম্পর্কে উল্লেখ আছে ব্রহ্মাশাপবশে মহাতেজা বিষ্ণুর দেহে পাপ সঞ্চার হলে সেই পাপ থেকে মুক্ত হতে হিমাচলে মহাকালীর তপস্যা শুরু করেন। বিষ্ণুর তপস্যায় মহাকালী খুশি হন।দেবীর সন্তোষ মাত্রেই বিষ্ণুর পদ্ম হতে সহসা ‘কোলা’ নামক মহাসুরের আবির্ভাব হয়। সেই কোলাসুর ইন্দ্রাদি দেবগণকে পরাজিত করে অখিল ভূমণ্ডল, বিষ্ণুর বৈকুণ্ঠ এবং ব্রহ্মার কমলাসন প্রভৃতি দখল করে নেয়।তখন পরাজিত বিষ্ণু ও দেবগণ ‘রক্ষ’ ‘রক্ষ’ বাক্যে ভক্তিবিনম্রচিত্তে দেবীর স্তব শুরু করেন। বিষ্ণু ও আদি দেবগণের স্তবে সন্তুষ্টা হয়ে দেবী বলেন“হে বিষ্ণু! আমি কুমারীরূপ ধারণ করে কোলানগরী গমন করে কোলাসুরকে সবান্ধবে হত্যা করিব।” অতঃপর তিনি কোলাসুরকে বধ করলে-সেই থেকে দেব-গন্ধর্ব, কিন্নর-কিন্নরী, দেবদেবী গণ সকলে সমবেত হয়ে কুসুম-চন্দন-ভারে কুমারীর অর্চনা করে আসছেন।

পুরাণে আছে, ব্রহ্মার নির্দেশানুসারে শ্রীরামচন্দ্র দেবীপূজার আয়োজন করলেন। কিন্তু দেবী কি তখন জাগ্রত না নিদ্রিত? দেবী কি এখন আবির্ভূত হতে প্রস্তুত। তাই ধ্যানে খোঁজ নিলেন যে দেবী এখন কোথায় আছেন? ধ্যানমানসে উদ্ভাসিত হলেন দেবী এবং জানতে পারলেন যে, দেবী তখন কুমারীরূপে শায়িত আছেন বিল্বশাখায়। স্রষ্টা ব্রহ্মার নির্দেশ অনু্যায়ী শ্রীরামচন্দ্র শুক্লা ষষ্ঠীর সকালে কল্পারম্ভ এবং সন্ধ্যায় বিল্ব বৃক্ষমূলে শুরু করলেন দেবীর বোধন। ষষ্ঠীতে বোধিত হলেন দেবী। সপ্তমীতে ষোড়শোপচারে দেবীকে পূজা করলেন শ্রীরামচন্দ্র; কিন্তু তখন পর্যন্ত দেবীর কোন সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। তখন অষ্টমী তিথিতে সকল যোগিনীদের ডেকে আবার সমস্ত পূজা-অর্চনা করে আরাধনা করা হল দেবীকে। দেবী তখনও কোন সাড়া দিলেন না। আগত যোগিনীদের হৈ-চৈ-তে দেবী তখন কেবল একটু নড়ে চড়ে পাশ ফিরে শয়ন করলেন। কিন্তু জাগ্রত হলেন না। তখন অষ্টমীর শেষ এবং নবমীর শুরুতে মহা সন্ধিক্ষণে করলেন দেবীর আবার বিশেষ পূজা। যাকে বলা হয় সন্ধিপূজা। অষ্টমীর ২৪ মিনিট এবং নবমীর ২৪ মিনিট নিয়ে মোট ৪৮ মিনিটের পূজা হল সন্ধিপূজা। সন্ধিপূজা হল দেবী চামুন্ডার বিশেষ পূজা। শ্রীরামচন্দ্র তখন চামুন্ডা দেবীকে আবাহন করে বললেন-যেভাবেই হোক দেবী দুর্গাকে জাগাতে হবে। চামুন্ডার সহযোগীতায় দেবী তখন জেগে উঠলেন নবমী তিথিতে। শ্রীরামচন্দ্র দেবীকে যোগিনীদের সঙ্গে বিশেষ পূজা করলেন। এবং দেবীকে দর্শন করলেন কুমারীরূপে। সেই থেকে কুমারীরূপী দেবীপূজা শুরু। শ্রীরামচন্দ্র দেবী দুর্গাকে একসঙ্গে একশ আটটি নীলপদ্ম অঞ্জলি দিলেন এবং দেবী নবমীর দিন কুমারীরূপে পূজিতা হলেন।
মহাভারত অনুসারে, বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণের নির্দেশে তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুন কুমারী পূজা করেন। শ্বেতাশ্বর উপনিষদেও কুমারী পূজার উল্লেখ পাওয়া যায়। এছাড়া প্রাচীন শাস্ত্র ও গ্রন্থ থেকে নেপাল, ভুটান ও সিকিমেও কুমারী পূজার উল্লেখ পাওয়া যায়।

● স্বামী বিবেকানন্দের কুমারী পূজার ইতিহাস: স্বামী বিবেকানন্দ প্রথম কুমারী পূজা করেন ১৮৯৮ সালে, তাঁর কাশ্মীর ভ্ৰমনকালে। তিনি যখন ১৮৯৮ সালে কাশ্মীর ভ্রমণে গেছিলেন, তখন তিনি এক মুসলমান মেয়েকে কুমারীপূজা করেছিলেন। শাস্ত্ররীতিতে ব্রাহ্মণ কন্যাকেই কুমারীপূজার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু তিনি সমস্ত রীতির উর্ধ্বে গিয়ে পূজা করেছেন মুসলমান -কন্যাকে। তিনি জাতপাতের উর্ধ্বে দেবী দর্শন করেন। দেবীত্ব কেবল ব্রাহ্মণত্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় বা দেবীত্ব ও মাতৃ্ত্ব কারোর একচেটিয়া সম্পদ নয়। মাতৃত্ব ও দেবীত্ব প্রতিটি নারীর আজন্ম সম্পদ। স্বামীজির ধ্যানে ও দর্শনে তা প্রমাণিত। তাই তিনি মুসলমান -কন্যার মধ্যে দেবীত্বের সন্ধান পেয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন দর্শকদের, যেদিকে তাকাচ্ছি দেখছি কেবল মা’র মূর্তি। অবাক হয়ে গিয়েছিলেন দর্শকরা স্বামীজির ভাবমূর্তি দেখে।
১৮৯৯ সালে তিনি কন্যাকুমারী শহরে ডেপুটি একাউণ্ট্যাণ্ট জেনারেল মন্মথ ভট্টাচার্যের কন্যাকে কুমারী রূপে পূজা করেছিলেন।

১৯০১ সালে স্বামী বিবেকানন্দ, বেলুড় মঠে দুর্গা পূজা ও কুমারী পূজা শুরু করেন। ১৯০১ সালে বেলুড় মঠের প্রথম কুমারী পুজায় স্বামী বিবেকানন্দ নয় জন কুমারী কে পূজা করেন। এখন বেলুড়মঠে একজনকেই করা হয়ে থাকে। এটাই নাকি শাস্ত্রীয় রীতি। স্বামীজির দিব্যদৃষ্টিতে সকল কুমারীই দেবীর এক-একটি রূপ। সেই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তিনি পূজা করেছিলেন ৯ জন কুমারীকে। স্বামীজি প্রতিটি কন্যাকে ভক্তিভরে পূজা করেছিলেন। ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম করেছিলেন শ্রদ্ধাভরে। এই নয়জন কন্যার মধ্যে একজন ছিলেন গৌরীমার পালিতা কন্যা দুর্গামা। যাঁর কপালে টিপ পরাতে গিয়ে স্বামীজি ভাবাবিষ্ট হয়ে গিয়েছিলেন। চন্দনের টিপ পরানোর সময় তিনি ভাবে শিহরিত হয়েছিলেন। আবেগভরে তিনি বলেছিলেন- “ আঃ! দেবীর বোধ হয় তৃ্তীয় নয়নে আঘাত লেগে গেল।” তাঁর দৃষ্টি ঠিকই। আমাদের দুটো চোখ থাকলেও, তৃ্তীয় চোখ থাকে দেবী দুর্গার। তিনি সেই কুমারীর মধ্যে তৃ্তীয় নয়ন প্রত্যক্ষ করেছিলেন। তাঁর দৃষ্টিতে তিনি যেমন ‘সেদিন দুর্গারূপে প্রতিষ্ঠিতা’- পরবর্তীকালেও সেই কন্যা দুর্গামা নামে পরিচিতা হয়েছিলেন। স্বামীজির স্নেহধন্যা ছিলেন এই কন্যা। স্বামীজির কুমারীপূজায় যেন সত্যিই সত্যি ঠিক ঠিক দুর্গামারূপে তিনি পরিগণিতা হয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, ‘দুর্গামা’ অধ্যক্ষারূপে প্রতিষ্ঠিতা হয়েছিলেন সারদেশ্বরী আশ্রমে। স্বামীজির অন্তর্দৃষ্টি যেন বাস্তবায়িত হয়েছিল এই কুমারীপূজার মধ্য দিয়ে। অবশ্য এই নয়জন কুমারীর মধ্যে দুর্গামা যেমন ছিলেন, তেমনি শ্রীরামকৃষ্ণের ভাইপো রামলালদাদার কনিষ্ঠা কন্যা রাধারানীও ছিলেন। স্বামীজি এই পূজার দ্বারা যেন একটা নূতন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন। সমস্ত নীতির উর্ধ্বে গিয়ে তিনি সৃষ্টি করেছিলেন এক নূতন নীতি। তিনি নারীজাতির প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা নিদর্শন করেছেন এই কুমারীপূজার মধ্য দিয়ে। শুধু তাই নয়, ইদানীং যে দুর্গাপূজার সময় জীবন্ত কন্যাকে কুমারীপূজা করার প্রচলন তা স্বামীজিরই আবিষ্কার বা তিনিই এর প্রচারক।

অন্য একটি ঘটনার মধ্যে আমরা পাই তাঁকে দিব্যভাবের পূজক হিসাবে। তিনি তখন উত্তর প্রদেশের গাজীপুরে (খুব সম্ভবত ১৯০০ সাল)। সেখানে এক প্রবাসী বাঙালির কুমারী মেয়েকে কুমারীপূজা করেছিলেন। সেই মেয়েটির নাম ছিল মণিকা। পরবর্তীকালে এই মণিকাদেবী হয়ে উঠেছিলেন যশস্বিনী সন্ন্যাসিনী। এ যেন স্বামীজির ঐ দিব্য বীজের বপন, যেন অনাঘ্রাত কুসুমকে দেবসেবায় উৎসর্গ করা। যথার্থ তাঁর দেবী দর্শন। কুমারীপূজায় উৎসর্গীকৃ্তা মণিকা যেন দেবীমূর্তিতে প্রতিষ্ঠিতা। এই মণিকাদেবী শেষজীবনে সন্ন্যাসিনী হয়ে যশোদা-মাঈ নামে পরিচিতা হয়েছিলেন জগতে। এও স্বামীজির এক অন্য আবিষ্কার।

● দার্শনিক তত্ত্ব: কুমারী পূজার দার্শনিক তত্ত্ব হলো নারীতে পরমার্থ দর্শন ও পরমার্থ অর্জন। বিশব ব্রহ্মাণ্ডে যে ত্রিশক্তির বলে প্রতিনিয়ত সৃষ্টি, স্থিতি ও লয় ক্রিয়া সাধিত হচ্ছে, সেই ত্রিবিধ শক্তিই বীজাকারে কুমারীতে নিহিত। কুমারী প্রকৃতি বা নারী জাতির প্রতীক ও বীজাবস্থা। তাই কুমারী বা নারীতে দেবীভাব আরোপ করে তার সাধনা করা হয়। এ সাধনপদ্ধতিতে সাধকের নিকট বিশ্বজননী কুমারী নারীমূর্তির রূপ ধারণ করে; তাই তার নিকট নারী ভোগ্যা নয়, পূজ্যা। পৌরাণিক কল্পকাহিনিতে বর্ণিত আছে, এ ভাবনায় ভাবিত হওয়ার মাধ্যমে রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব নিজের স্ত্রীকে ষোড়শীজ্ঞানে পূজা করেছিলেন।

শাস্ত্রমতে মকর সংক্রান্তির মাহাত্ম্য কী? কী বলে জ্যোতিষ শাস্ত্র

পৃথিবীর সাপেক্ষে সূর্য প্রত্যেক রাশিতে এক মাস (৩০ দিন) অবস্থান করে। প্রত্যেক ৩০ ডিগ্রি অন্তর রাশি পরিবর্তনকালকে বিভিন্ন সংক্রান্তি হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। জ্যোতিষ শাস্ত্র মতে রাশিচক্রে ১২টি রাশির অবস্থান। প্রত্যেক রাশি ৩০ ডিগ্রি। বাংলার প্রথম মাস বৈশাখে সূর্যের অবস্থান মেষ রাশিতে, জ্যৈষ্ঠ মাসে বৃষ রাশিতে। এইরূপে ধনু রাশিতে ৩০ দিনের অবস্থানের পর মকর রাশিতে গমনকাল ‘মকর সংক্রান্তি’ নামে পরিচিত। এই তিথি ‘উত্তরায়ণ সংক্রান্তি’ নামেও পরিচিত। এই তিথি প্রাকৃতিক এবং জ্যোতিষ শাস্ত্র মতে যেমন গুরুত্বপূর্ণ, ঠিক তেমনই গুরুত্বপূর্ণ পৌরাণিক কারণেও।

প্রাকৃতিক কারণ হিসাবে বলা যায়, এই তিথি থেকেই একটি ঋতুর পরিবর্তন হয়। জ্যোতিষ শাস্ত্র মতে মকর এবং কুম্ভ রাশির অধিপতি গ্রহ শনিদেব। শাস্ত্রমতে, রবি এবং শনির পিতা-পুত্রের সম্পর্ক। এই হিসাবে রবির মকরে প্রবেশ পিতার পুত্রগৃহে গমন। যদিও জ্যোতিষ শাস্ত্র মতে পিতা-পুত্রের সম্পর্ক মধুর নয়

পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে রাজা সগরের ষাট হাজার মৃত পুত্রের প্রাণ দানের কারণে গঙ্গাদেবীর মর্তে তথা কপিল মুনির আশ্রমে আগমনের তিথি এই মকর সংক্রান্তি তিথি।

আরো পড়ুন- মকর সংক্রান্তিতে ৬ রাশির জাতকরা পাবেন সূর্যদেবের আশীর্বাদ, ভাগ্য হয়ে উঠবে অতি উজ্জ্বল

মকর সংক্রান্তি এবার ১৫ জানুয়ারি পালিত হবে। মকর সংক্রান্তি ১৪ জানুয়ারি রাত ৮টা বেজে ৪৩ মিনিটে শুরু হবে। মকর সংক্রান্তির শুভ সময় ১৫ জানুয়ারি সকাল ৬টা বেজে ৪৭ মিনিটে শুরু হবে এবং শুভ সময় শেষ হবে বিকেল ৫টা ৪০ মিনিটে। একই সময়ে, মহাপুণ্য কাল সকাল ৭টা ১৫ মিনিট থেকে ৯টা ৬. মিনিট পর্যন্ত হবে। মকর সংক্রান্তির দিনে পুণ্য ও মহৎ পুণ্যময় সময়ে স্নান ও দান করা উচিত।

মকর সংক্রান্তির দিন এই বিশেষ ব্যবস্থাগুলি করুন

মকর সংক্রান্তির দিন স্নানের জলে কালো তিল রাখুন। তিলের জল দিয়ে স্নান করা খুবই শুভ বলে মনে করা হয়৷ রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়৷

মকর সংক্রান্তির দিন স্নানের পর সূর্যদেবকে জল অর্পণ করুন এবং সূর্যদেবকে নিবেদন করা জলে তিল দিন। এটা জীবনে সুখ-সমৃদ্ধি নিয়ে আসে। এটা করলে পিতৃপুরুষের আত্মা শান্তি পায়।

আর্থিক সমস্যা থাকলে এই দিনে ঘরে সূর্য যন্ত্র স্থাপন করুন এবং সূর্য মন্ত্র ৫০১ বার জপ করুন। রাশিফলের যে কোনও উপায়ে সূর্যের দোষ কমাতে প্রবাহিত জলে একটি তামার মুদ্রা বা একটি বর্গাকার তামার টুকরো ফেলে দিন।

টেরাকোটা সাহেবে’র কথা

ইংরেজ সাহেব। কেমব্রিজে পড়াশোনা শেষ করে ইংল্যান্ড থেকে এসেছিলেন ভারতবর্ষে। গিয়েছিলেন বীরভূমের রবীন্দ্র তীর্থে। কিন্তু শান্তিনিকেতনে মন টিকল না। তুসা বিভাগে অধ্যাপনার কাজ নিয়ে তিনি চলে এসেছিলেন যাদবপুরে। থাকতেন কলকাতার মেসবাড়িতে। সাইকেল চালিয়ে আশা-যাওয়া। পথের লোকেরা তাঁকে ডাকত সাইকেল সাহেব নামে। হঠাৎই তাঁকে এক নেশায় পেয়ে বসল। বাংলার স্থাপত্য ঐতিহ্যের অসামান্য স্মারকের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অবশিষ্ট কিছু স্মৃতিচিহ্নের অনুসন্ধান। বাংলার টেরাকোটা মন্দির। আর এই টেরাকোটা অনুসন্ধানীটি হলেন ডেভিড ম্যাককাচন/ম্যাকাচ্চিয়ন/ম্যাকাচ্চন।

ষাটের দশকে পশ্চিমবঙ্গের নানা জেলায় গ্রাম গঞ্জে দূর দূরান্তে রোগা পাতলা শীর্ণ চেহারার এক সাহেবকে ঘুরে বেড়াতে দেখা যেত। কখনো সাইকেলে, কখনো বাসে-ট্রেনে আবার কখনোবা মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে তিনি টেরাকোটা মন্দিরের খোঁজে অনুসন্ধান চালাতেন। বাঁকুড়া, বীরভূম, বর্ধমান, পুরুলিয়া, মেদিনীপুর, মুর্শিদাবাদ, মালদা, চব্বিশ পরগনা, হাওড়া, হুগলি তাঁর পদচারণায় মুখর ছিল। টেরাকোটা স্থাপত্যের সন্ধান পেলে তার ছবি তুলতেন, তথ্য সংগ্রহ করতেন, আশপাশের ঝোপঝাড় পরিষ্কার করতেন, অসীম ধৈর্যের সাথে স্থানীয় লোকজনদের ডেকে বোঝাতেন টেরাকোটা স্থাপত্য সম্পদের গুরুত্বের কথা, কি করে একে রক্ষণাবক্ষেণ করা যায় তা যথাসাধ্য বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করতেন। লোকেরা পোড়ামাটির মন্দির নিয়ে বিলেতি সাহেবের উৎসাহ ও আগ্রহ দেখে অবাক হতো, ভাবত, হাসত। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো সাহেবটিকে পাগল বলে ভেবে বসতো। তাঁর ভাঙা ভাঙা বাংলায় বলা কথাগুলোয় বিশেষ আমল প্রায় কেউই দিতে চাইত না। তবুও এ ব্যাপারে সাহেব ছিলেন অসীম ধৈর্যশীল, কঠোর পরিশ্রমী আর নিরলস প্রয়াসী। এই সাহেবটি হলেন ডেভিড জে. ম্যাককাচন।

আরো পড়ুন- ‘মানসিং তোমর ও মৃগনয়না’

আজকের বাংলাদেশ তখন পূর্ব পাকিস্তান। পশ্চিমবাংলা থেকে এক সাহেব এসে পূর্ববাংলার বিভিন্ন জেলায় ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। উদ্দেশ্য সেই একই। বাংলার মন্দির মসজিদ টেরাকোটা। যশোর, ফরিদপুর, খুলনা, রাজশাহী, দিনাজপুর, রংপুরে সাহেব বহু ঝুঁকি নিয়ে বহু কষ্ট স্বীকার করে পোড়ামাটির স্থাপত্য নিদর্শনের খোঁজে ঘুরে বেড়ালেন। প্রচুর ছবি ও তথ্য সংগ্রহ করে এ নিয়ে মূল্যবান প্রবন্ধ লিখলেন। স্বাধীন বাংলাদেশে যাওয়ার সুযোগ তিনি পাননি। তবে সে অঞ্চলের প্রত্যন্ত প্রান্তে ঘুরে ফিরে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন এক নতুন দেশের জন্ম লগ্ন আসন্ন। আজ বাংলাদেশের মন্দির টেরাকোটার চর্চায় সাহেবের সেদিনের সেই পরিশ্রমের জুড়ি নেই। সেই সাহেবটি হলেন ডেভিড ম্যাককাচন।

ফেলুদা কাহিনীর শেষ উপন্যাস “রবার্টসনের রুবির” কথা মনে পড়ে? নিশ্চয়ই অনেকেই পড়েছেন। এতে জটায়ুর উদ্দেশ্যে ফেলুদার জবানিতে টেরাকোটা সাহেবকে নিয়ে বলা কথায় বাংলা চলচ্চিত্র ও বাংলা সাহিত্যের বিরাট ব্যক্তিত্ব সত্যজিৎ রায় তাঁর প্রিয় বন্ধুর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধার্ঘ্য রেখে গেছেন। ভুলো মন বাঙালীদের হয়তো এভাবেই রায়সাহেব তাঁর অসাধারণ বন্ধুটির বিষয়ে জানিয়ে দিয়ে গেছেন। মানিকবাবুর সেই বন্ধুটি হলেন ডেভিড ম্যাককাচন।

তিনি অধ্যাপনা করতেন। অকৃতদার ছিলেন। একজনের পক্ষে ভালো ভাবে চলার জন্য রোজগার মন্দ ছিল না। কিন্তু অতি সাধারণ ভাবে জীবন যাপন করা সাহেবটি ছেঁড়া গেঞ্জিতে সন্তুষ্ট ছিলেন। অতি সাধারণ খাবার খেতেন। বাস ভাড়া বাঁচাতে যথা সম্ভব সাইকেল ব্যবহার করতেন। দৈনন্দিন খরচ চালিয়ে অবশিষ্ট টাকা তিনি জমিয়ে রাখতেন। টেরাকোটা মন্দির অভিযানের জন্য খরচ হিসেবে। দূর দূরান্তে যাতায়াত, ছবি ক্যামেরা, মন্দিরের আশেপাশের আগাছা পরিষ্কারে কীটনাশক ইত্যাদিতে খরচ হতো মিতব্যয়ী সাহেবটির জমানো টাকা। এই অদ্ভুত সাহেবটি হলেন ডেভিড ম্যাককাচন।

টেরাকোটা মন্দির স্থাপত্য চর্চায় পথিকৃত ছিলেন তিনি। নিজের গবেষণাকে চূড়ান্ত রূপ দিয়ে যাওয়ার সময় তিনি পাননি। জীবন তাঁকে সেই আয়ু দেয়নি। তবে প্রচুর ছবি আর বিপুল তথ্য ভাণ্ডার রেখে গেছেন পরবর্তী গবেষকদের জন্য পাথেয় করে। তাঁর অসমাপ্ত কাজ শেষ করার চেষ্টা করেছেন সুহৃদকুমার ভৌমিক, হিতেশরঞ্জন সান্যাল, তারাপদ সাঁতরা, অমিয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, মানিকলাল সিংহ প্রমুখেরা। এ কাজ এখনো অব্যাহত। ক্ষেত্রসমীক্ষক ডেভিডের পথ ধরে এখনো অনেকেই বাংলার টেরাকোটা মন্দিরের ইতিহাস অনুসন্ধান করে চলেছেন। এই মাটির প্রতি সুগভীর মমত্ববোধ ছিল তাঁর। এই দেশের পুরাকীর্তি রক্ষায় আমৃত্যু সোচ্চার ছিলেন তিনি। টেরাকোটা স্থাপত্যের পাশাপাশি বাংলার পটচিত্র নিয়ে উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে তাঁর।

অতর্কিত পোলিও রোগে আক্রান্ত হয়ে মাত্র ৪১ বছর বয়সে ১৯৭২ সালের ১২ই জানুয়ারি হঠাৎই তিনি গেছেন না ফেরার দেশে। প্রিয় শহর কলকাতার বুকে ভবানীপুর সিমেট্রিতে তাঁকে চির নিদ্রায় সমাহিত করা হয়। পরবর্তীতে বন্ধুরা তাঁর সমাধিস্থলটিকে টেরাকোটায় মুড়ে দেয়।

আত্মবিস্মৃত জাতি বাঙালীরা তাঁদের এই মহান বন্ধুটিকে সেভাবে মনে রাখেনি। প্রায় নীরবে নিভৃতে প্রয়াণের অর্ধশতক পেরিয়ে গেছেন তিনি। আজ ৫১তম প্রয়াণ দিবসে তাঁকে সশ্রদ্ধ প্রণাম জানাই।

তথ্যসূত্র:
* ডেভিড ম্যাককাচন চর্চা সম্পাদক: সুরঞ্জন মিদ্দে,
* বাংলাদেশের মন্দির – ডেভিড ম্যাককাচন।