দ্যা ক্রাইং বয়। অভিশপ্ত যে ছবির কারনে পুড়ে ছাই হয়েছিল একাধিক মানুষের বাড়ি

বর্তমান যুগের ছবি তোলা এবং পোস্ট করা একটা ফ্যাশনে দাঁড়িয়ে গেছে। তবে বহু আগে যখন ক্যামেরার প্রচলন ছিল না তখন হাতেই ছবি আঁকতো মানুষেরা। বিভিন্ন প্রাকৃতিক দৃশ্য হোক কিংবা পশু-পাখি বা কোন মানুষের ছবি অংকন করা হোক, চিত্রকারীরা তুলিতে এমন টান দিত যে প্রাকৃতিক জিনিস ক্যানভাসে ফুটে উঠতো জীবন্ত হয়ে। তবে এই প্রতিবেদনে এমন একটি ছবির কথা বলা হয়েছে যা সকলের কাছেই ছিল অভিশপ্ত। সেই ছবিটির নাম হল দ্য ক্রাইং বয়। এই চিত্রটি অংকন করেছিলেন ইতালীয় চিত্রশিল্পী জিওভান ব্রাগোলিন। চিত্রশিল্পীর আসল নাম ছিল ব্রুনো আমাডিও।

তখনকার দিনে অর্থাৎ বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ৭০ থেকে ৮০ দশক নাগাদ প্রত্যেকটি মানুষ তাদের ঘরের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য চিত্র টানিয়ে রাখত দেওয়াল গুলিতে।

অর্থাৎ বলতে গেলে তখনকার দিনের দেওয়ালে বিভিন্ন ধরনের চিত্র টানিয়ে রাখা ছিল এক ধরনের ফ্যাশন। চিত্রকর জিওভান ব্রাগোলিনের অংকন করা চিত্র ১৯৫০-৮০ দশকে বহুল জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। অধিকাংশ মানুষই এই চিত্র কিনে নিজের বাড়িতে শোভা বাড়ানোর জন্য রাখছিলেন। তবে ৮০-র দশকের পর থেকেই আচমকা বদলে যায় গোটা পরিস্থিতি। সেই সময় প্রায় ১৬ টি বাড়ির পুড়ে ছাইয়ে পরিণত হয়ে গেছিল। তবে প্রত্যেকটি ঘটনাতে দমকল কর্মীদের একটাই বক্তব্য ছিল যে বাড়িগুলির আসবাবপত্র সব পুড়ে গেলেও শুধুমাত্র এই ছবিটি পোড়েনি। এছাড়াও আরো তাজ্জবের বিষয় ছিল যে প্রত্যেকটি বাড়িতেই উপস্থিত ছিল তা ক্রাইং বয়ের পেইন্টিংটি। পরবর্তীতে এই ঘটনাগুলির পর থেকেই অভিশপ্ত হিসাবে পরিচিতি পায় পেইন্টিংটি।

পরবর্তীতে ১৯৮৫ সালের ৪ঠা সেপ্টেম্বর ঠিক একইভাবে আগুনে পুড়ে ছাই হয়েছিল রন এবং মে নামের দম্পতিদের বাড়ি। তাদের বাড়িতেও ছিল দ্যা ক্রাইং বয় পেইন্টিংটি। তবে এই দম্পতিরা এই পেইন্টিংকে দায়ী করেছিলেন বাড়িতে সর্বনাশ হওয়ার জন্য। যদিও পরবর্তীতে দম্পতিদের এই অভিযোগ একটি জার্নালে প্রকাশিত হয়েছিল।

এরপর থেকেই একের পর এক দুর্ঘটনা হওয়ার কারণে সকলের মনে একটাই প্রশ্ন জেগে ছিল পেইন্টিংয়ে থাকা এই ছেলেটি কে?

আরো পড়ুন- ভূতের সঙ্গে বিয়ে হত যে দেশে

একটি সংবাদপত্রের পক্ষ থেকে কলমের মাধ্যমে জানানো হয়েছিল যে স্প্যানিশের একটি অনাথ আশ্রমের দুঃখী শিশুদের ছবি আঁকতেন চিত্রকার জিওভানও। যদিও পরবর্তীতে শোনা গেছিল যে ওই অনাথ আশ্রমটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল।

আরো একটি গল্পের প্রচলন রয়েছে যে পরবর্তী সময় নাকি একজন স্কুল শিক্ষক জর্জ ম্যালরি চিত্রকর জিওভানওকে খুঁজে বের করে তার কাছে এই চিত্রের সম্পর্কে সকল তথ্য জানতে চেয়েছিলেন। তখন চিত্রশিল্পী জানিয়েছিলেন যে” চিত্রে আঁকা শিশুটির নাম ডন বনিলো। সে একজন স্প্যানিশের পথ শিশু। ১৯৬৯ সালে শিশুদের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল আমার। বিশ্বযুদ্ধ শেষের পর ইতালি থেকে পালিয়ে এসেছিল শিশুটি। তবে রহস্যজনক এক অগ্নিকাণ্ডে মৃত্যু হয়েছিল শিশুটির বাবা-মায়ের। সেই ঘটনার পর থেকেই শিশুকে সকলে এল ডায়াবলো নামে ডাকতে শুরু করেছিল। এই শব্দের অর্থ ছিল শয়তান। অর্থাৎ শিশুকে কেউ দত্তক নেওয়ার জন্য যেরকম রাজি ছিল না সেরকমই কেউ নিজের বাড়িতেও রাখতে চাইছিল না। কারণ সকলেরই ধারণা তৈরি হয়েছিল এই শিশু যেখানেই যাবে সেখানেই আগুন জ্বালিয়ে দেবে।”

এরপরই নাকি জিওভান শিশুটিকে এক পুরোহিতের অমতেই দত্তক নিয়েছিলেন। এরপরই শিশুটির চিত্র আঁকতে শুরু করেছিলেন। অর্থাৎ শিশুটিকে অপব্যবহার করে ধনী হতে থাকছিলেন চিত্রশিল্পী। তবে আচমকা একদিন তার স্টুডিও পুড়ে গেছিল আগুনে। সকলের মত তিনিও আগুন লাগার জন্য শিশুটিকেই দায়ী করেছিলেন। এই সকল ঘটনার কয়েক বছর পর বার্সেলোনায় এক গাড়ি বিস্ফোরণে আচমকা মৃত্যু হয়ে যায় ওই শিশুটির।

তবে শিশুর মৃত্যুর পরেও তার রহস্য ভেদ করতে উদগ্রীব ছিলেন একাধিক ব্যক্তি। এরপরই একজন সাংবাদিক ড: ডেভিড ক্লার্ক তিনি শিশুটির সম্পর্কে বহু গবেষণা করেছিলেন। কিন্তু সেই গবেষণার কোন তথ্য খুঁজে না পাওয়ার কারণে সাংবাদিকের মনে হয়েছিল যে জর্জ ম্যালরির, জিওভানির সঙ্গে কখনো দেখাই করেননি। হয়তো চিত্রশিল্পী সকল ঘটনা বানিয়ে বানিয়ে বলেছিলেন। এমনও হতে পারে যে ভেনিসে হয়তো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জিও কুড়ি ত্রিশ জন শিশুকে কান্নাকাটি করতে দেখেছিলেন আর তাদেরই চিত্র এঁকে দিয়েছিলেন। যেগুলি ১৯৭৯ এর দশকে ডিপার্টমেন্টাল স্টোরগুলিতে প্রচুর পরিমানে বিক্রি হয়েছিল।

পরবর্তীতে ১৯৮৫ সালের ৪ঠা সেপ্টেম্বর দ্য সান’ পত্রিকায় ক্রাইং বয় পেইন্টিং নিয়ে ‘ক্রাইং বয় জলন্ত অভিশাপ কি পাঠকদের মধ্যে ভিতীর সৃষ্টি করেছিল। যার কারণ হলো রন ও মে নামে দম্পতির বাড়ি পুড়ে যাওয়া। এরপর থেকে অনেকেই এটা মানতে শুরু করেছিল যে যারাই ছেলেটির ছবি কিনবে তাদের বাড়ি ছয় মাসের মধ্যে পুড়ে যাবে এবং অক্ষত থাকবে ওই পেইন্টিংটি। যেহেতু এই ঘটনাগুলি প্রথম দ্যা সান পত্রিকাটি প্রকাশ করেছিল তাই সকলের থেকে এই পত্রিকার জনপ্রিয়তা ছিল তুঙ্গে। এমনকি শুধুমাত্র সংবাদ প্রকাশিত নয় যাদের বাড়িতে এই ছবি ছিল তাদেরকে এই ছবি সরিয়ে দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছিল পত্রিকাটি। রীতিমতো সে পত্রিকার কথা শুনে প্রায় ২৫০০ টি পরিবারের পক্ষ থেকে ছবি পাঠানো হয়েছিল সংবাদপত্রের অফিসে। অফিসের একটি ঘরে উঁচু পর্বতের মতো স্তূপ জমে গেছিল। যদিও এই ঘটনার এক সপ্তাহ পরে পত্রিকাটি আরেকটি শিরোনাম দিয়ে একই গল্প প্রকাশিত করেছিল। ক্রয়িং-বয় কার্স স্ট্রাইকস এগেইন’ নামে একটি শিরোনাম দিয়ে সংবাদপত্রে লিখেছিল যে আরো এক দম্পতির বাড়ি একইভাবে পুড়ে গেছিল কিন্তু অক্ষত ছিল ওই পেইন্টিং।

পরবর্তীতে পত্রিকাটি তার সর্বশেষ নিউজ প্রকাশিত করেছিল ক্রাইং ফ্লেম নামক শিরোনাম দিয়ে। কারণ তারা উল্লেখ করেছিলেন যে টেমস নদীর ধারে তারা একটি বন ফায়ার করতে গিয়ে সকল ক্রাইং বয়ের পেইন্টিং পুড়িয়ে দিয়েছিলেন।

তবে সত্যিই কি শিশুটির ছবি থাকার জন্য সকলে বাড়িতে আগুন লাগতো ?

পরবর্তীতে এই বিষয়গুলিকে ভালো করে খতিয়ে দেখা হলে জানা গেছিল যে আগুন লাগার পেছনে মূল কারণ থাকতো সিগারেট, বা তারের অসংলগ্নতা বা কোন সময় অতিরিক্ত হট ফ্রাইং প্যান। যদিও পরবর্তীতে এসেক্সের অগ্নিনির্বাপক কর্মীরা ধ্বংসপ্রাপ্ত জায়গা গুলিতে অনুসন্ধান চালিয়ে ওই একটি ক্রাইং বইয়ের ছবি উদ্ধার করেছিলেন। তাই আগুন লাগার পেছনে ছবি দিকেই দায়ী করেছিল বাড়ির মালিকেরা।

বৈজ্ঞানিক ব্যখ্যা! পরবর্তীতে ছবিটিকে নিয়ে নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলে দেখা গেছিল যে ছবিটি তৈরি হয়েছিল অগ্নি প্রতিরোধক বার্নিশ তেল দিয়ে। এছাড়াও ছবিটির ক্যানভাস এতটাই খরচ হতো যে আগুনে পুড়ে যাওয়া থেকে সর্বদাই রক্ষা পেত।

চিত্রকর্মটি কি সত্যিই অভিশপ্ত ছিল?

বিজ্ঞানীদের আগুন ধরার ব্যাখ্যা দেওয়ার পরে প্রমাণিত হয়েছিল যে চিত্রটি অভিশপ্ত নয়। তবে প্রমাণ পাওয়ার পরেও অনেকের ধারণা ছিল যে চিত্রটি অভিশপ্ত এবং সেইগুলি বাড়িতে না রাখার। যদিও পরবর্তীতে ১৯৮১ সাল নাগাদ জিওভান ব্রাগোলিনের মৃত্যু হয়ে যাওয়ার সাথে সাথেই চিত্রটির রহস্যও চাপা পড়ে গেছিল। কিছু মানুষের ধারণা ছিল এই চিত্রটি অভিশপ্ত নয় তো কিছু মানুষের ধারণা ছিল এটি অভিশপ্ত। তবে চিত্রটিকে কেন্দ্র করে যেহেতু নানান মুখরোচক গল্প তৈরি হয়েছিল তাই চিত্রটি সম্বন্ধে মানুষের আগ্রহের শেষ ছিল না।

ভূতের সঙ্গে বিয়ে হত যে দেশে

দাম্পত্য জীবন হল যে কোন মানুষের ক্ষেত্রে একটা নতুন অধ্যায়। অনেকের আবার এই বিয়েকে ঘিরে নানান স্বপ্ন থাকে। আজকালকার দিনে তো অনেকে ডেস্টিনেশন ওয়েডিং করে। সম্প্রতি এক সমীক্ষায় দেখা গেছে অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ থেকে লাভ ম্যারেজই বেশি হচ্ছে। অর্থাৎ এক কথায় বলা যায় যে যে কোনও মানুষ নিজের বিয়ে এবং বিবাহিত জীবন নিয়ে যথেষ্ট আবেগপ্রবণ এবং স্বপ্ন বিলাসী। তবে পূর্বে কেনিয়ায় বিয়ের দেওয়া হয় ভূতের সঙ্গে। বিষয়টা আজকালকার দিনে বড়ই অদ্ভুত। তবে পূর্ব কেনিয়ার নিয়ম অনুসারে কোন ব্যক্তির বিশেষ করে মহিলাদের ক্ষেত্রে সম্মতি থাকুক কিংবা না থাকুক তাদের পরম্পরা অনুযায়ী ভূতের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হতো। তাহলে একবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক এই পৌরাণিক রীতি কেমন ছিল এবং কিভাবে পালন করা হতো।

আরো পড়ুন – এখনকার দিনে মানুষ ঘড়িতে অ্যালার্ম দেয়। ১৮ শতকের দিকে মানুষই ছিল অ্যালার্ম ঘড়ি

ইতিহাসের পাতা উল্টালে দেখা যাবে যে পূর্ব কেনিয়ায় কাম্বা সম্প্রদায়ের লোকজনেরা সদ্য মৃত্যু হওয়া পুরুষদের সঙ্গে তাদের গোষ্ঠীর নারীদের বিবাহ দিতেন। সেক্ষেত্রে অনেক সময় দেখা যেত মহিলাদের মধ্যে এই বিবাহ করার ইচ্ছা থাকত না। কিন্তু কাম্বা সম্প্রদায়ের বয়েস জ্যেষ্ঠদের এই ধারণা ছিল যে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা এই প্রথাকে মেনে চললে জীবনের শৃঙ্খলা বজায় থাকবে।

কেনিয়ার এই সম্প্রদায়ের বাসিন্দারা এতটাই জীবনের শৃঙ্খলা পরায়ন ছিল যে তারা যুগ যুগ ধরে এই প্রথা লালন করে আসছিলেন। তাদের ভাষায় এই প্রথার নাম ছিল কুঙ্গামিয়া ইসিতোয়া। অর্থাৎ মৃত ব্যক্তির নাম সংরক্ষণ করা। এই পদ্ধতিটা ছিল অনেকটা এরকম যেকোনো পরিবারের পুরুষ সদস্যের মৃত্যু হলে প্রথমে তার দেহটিকে কবরস্থ করা হতো। এরপর তার ফটো সাজিয়ে তাতে মালা পরিয়ে আয়োজন করা হতো বিয়ের। তাদের গোষ্ঠীর মধ্যে থেকেই কোন এক মহিলার সঙ্গে দেওয়া হতো বিয়ে। এই পদ্ধতির মাধ্যমেই গোষ্ঠীর সদস্যরা বিশেষ করে মৃত ব্যক্তির পরিবারের সদস্যরা মনে করত যে এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাদের মৃত ছেলের উত্তরাধিকারীকে রক্ষা করা হচ্ছে। এছাড়াও আত্মা হয়ে পরিবারের আশেপাশে বেঁচে আছে তাদের ছেলে।

ভূতের সঙ্গে বিয়ে হওয়া এই মেয়েদের জীবন ছিল অন্য ধরনের। কারণ এই সকল প্রথা বেশি প্রচলন ছিলো ধনী পরিবারগুলির মধ্যে। অর্থাৎ মোটা অর্থের বিনিময়ে গরিব পরিবারের মেয়েকে নিজের ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে ঘরে তুলতেন তারা। এরপর আর পাঁচটা সাধারণ নববধূর মত বিবাহিত মেয়েরাও বাপের বাড়ি ছেড়ে মৃত ব্যক্তির স্ত্রী হয়ে শ্বশুর বাড়িতে আসতো। সেখানেই কাটতো তার জীবন। তারা বিবাহিত হলেও নিজেদের স্বামীকে কোনদিন চোখে দেখতে পেতেন না কারণ আত্মার সঙ্গে বিয়ে হতো তাদের। এই সমস্ত মহিলাদের অন্য কোন পুরুষ বিয়ের প্রস্তাব ও দিতেন না কারণ সকলেই জানতো ওই মহিলা বিবাহিত। এছাড়া যখন বংশ বৃদ্ধির সময় আসত তখন বিবাহিত মহিলার শ্বশুর বাড়ির লোকজনই অর্থ দিয়ে পুরুষ লোক ভাড়া করতেন যাদের শুক্রাণুর সহায়তায় বৃদ্ধি পাবে তাদের বংশ।

অনেক ঐতিহাসিক বই ঘাটলে প্রমাণ পাওয়া যাবে যে পূর্বে রীতি অনুযায়ী এই প্রথার প্রচলন ছিল। তবে বর্তমান দিনে এই সকল প্রথার আর কোনো প্রচলন দেখা যায় না। এমন অনেক মহিলা ছিলেন যারা মৃত স্বামীকে বিয়ে করেছিলেন তাদের বলা হত ভূতের স্ত্রী। আর পাঁচ জন স্ত্রীর মতোই মৃত স্বামীর পরিবারের সদস্য হতো এবং তার সম্পত্তির ভাগীদারও হতো ওই সকল মহিলারা। যদিও এই বিষয়ে শ্বশুর বাড়ির লোক কোনদিনই আপত্তি জানাতো না। কারণ তারাও মনে করত যে তাদের ছেলের স্ত্রী হওয়ার জন্য তাদেরও এই বাড়িতে সমান অধিকার রয়েছে এবং তারা সেই অধিকার ঘরের বউকে দিত।

স্কুপার ওয়েবসাইটের একটি রিপোর্টের তথ্য মতেঃ- প্রথমে ধনী ব্যক্তিরা মোটা অর্থ যৌতুক হিসেবে প্রদান করত মহিলাদের পরিবারকে। এরপরে অর্থের বিনিময়ে তারা ভূতের সঙ্গে বিয়ে দিত নিজের মেয়ের। সমাজের সামনে পদ্ধতিটি সম্মানজনক হলেও পরবর্তীতে বংশপ্রতির জন্য গোপনে অর্থ দিয়ে নিয়ে আসা হতো এক পুরুষকে। তারপর যখন ওই মহিলা গর্ভবতী হয়ে যেতেন তখন তার শ্বশুর বাড়ির লোক এবং সমাজের লোকজন মনে করতেন মৃত ছেলেরই উত্তরাধিকার ওই সন্তান।

যদিও আজকের দিনে কেনিয়ার বহু মানুষ এই প্রথার উচ্চারণ করেন না। এছাড়াও অনেকের দাবিতে কোনদিন এরকম প্রথা ছিল না কাম্বা সম্প্রদায়ে। তবে আজও কিছু কিছু বিধবা মহিলা বলেন যে তাদের বিয়ে হয়েছে মৃত স্বামীর সঙ্গে।

এখনকার দিনে মানুষ ঘড়িতে অ্যালার্ম দেয়। ১৮ শতকের দিকে মানুষই ছিল অ্যালার্ম ঘড়ি

উন্নত প্রযুক্তির সমাজে সকালে সময় মতো ঘুম থেকে ওঠাটা খুবই সহজ ব্যাপার। ঘড়ি বা মোবাইলে নির্দিষ্ট সময়ে অ্যালার্ম সেট করলেই সব সমস্যা শেষ। এত গেল বর্তমান সময়ের কথা কিন্তু যদি আমরা আগেকার দিনের কথা যদি ভাবি তাহলে তাদের কি করে ঘুম ভাঙত ভোরবেলায়? কারন তখনকার দিনে তো এত উন্নত প্রযুক্তি ছিল না।

যদি এই প্রশ্নটা গ্রামাঞ্চলের মানুষদের করা হয় তাহলে তাদের উত্তর হবে মোরগ ডাকার শব্দ শুনে। কিন্তু শহরাঞ্চলের না ছিল মোরগ না ছিল এলার্মঘড়ি তাহলে সেখানকার মানুষদের কিভাবে সকালে ঘুম ভাঙত? কে তাদের সময় মতো জাগিয়ে তুলতো?

এখনকার দিনে যেমন মানুষ ঘড়িতে অ্যালার্ম দেয় আর সেই সময় মানুষই ছিল অ্যালার্ম ঘড়ি।

১৮ ও ১৯ শতকে সকালে মানুষদের ঘুম থেকে জাগানোর কাজে ব্রিটেন এবং আয়ারল্যান্ডে বিশেষ কর্মীরা নিযোগ ছিল। এই সমস্ত কর্মীদের বলা হত নকার-আপার।

নকার-আপার্স কারা ছিলেন?

১৮ শতকের মাঝামাঝি থেকে ১৯ শতকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত অর্থাৎ শিল্প বিপ্লবের সময় অ্যালার্ম ঘড়ি জনপ্রিয় ছিল না এবং সেগুলি সস্তা বা নির্ভরযোগ্যও ছিল না যার কারণে সেই সময় জন্ম নেয় এই নকার-আপার পেশাটি। এই পেশাটি জন্ম নেওয়ার পিছনে আসল কারণ ছিল ব্রিটেনের কারখানার কাজ করা শ্রমিকদের পক্ষে অ্যালার্ম ঘড়ি ক্রয় করা দুঃসাধ্য ব্যাপার ছিলো। এদিকে সেসময়টায় শিল্পায়ন ক্রমবর্ধমান ছিলো যার জন্য কল-কারখানাগুলির প্রয়োজন ছিল আরও বেশি শ্রমিক এবং আরও বেশি ওয়ার্কিং আওয়ারের। সেই সময় খুবই ন্যূনতম মজুরিতে শ্রমিকরা কাজ করত এবং কল-কারখানাগুলো কাজে যোগ দেয়ার সময়ের ব্যাপারে কঠিন ছিল। দেরির কারণে নয় চাকরি চলে যাওয়া তা নাহলে মাইনে থেকে বেতন কেটে নেয়ার ভয় ছিল। একে অল্প বেতনের চাকরি তার উপর যদি জরিমানা কেটে নেওয়া হয় তাহলে বেতনের থাকবেটা কি? এই কারণেই তারা খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠার জন্য নকার- আপারদের ভাড়া করা হত।

তাদের ঘুম ভাঙানোর পদ্ধতি কি ছিল?

মূলত বড় শহর বা ব্রিটেন এবং আয়ারল্যান্ডের উত্তরাঞ্চলে নকার-আপাররা কাজ করত। প্রথমে নক-আপাররা মানুষকে জাগানোর জন্য তাদের বাড়ির দরজায় ধাক্কা দিত। কিন্তু এই পদ্ধতিটি ছিল ভুল এবং অকার্যকর। কারণ দরজায় ধাক্কা দেওয়ার কারণে ওই পরিবারের বাকি সদস্যদেরও ঘুম ভেঙে যেতো। তবে শুধু বাড়ির সদস্যরাই নয় প্রতিবেশীরাও এই পদ্ধতিতে বিরক্ত হচ্ছিল। যার ফলে এ ব্যাপারে প্রতিবেশীরাও অভিযোগ করতে থাকে। কারণ তাদের কোনো প্রয়োজন ছাড়া ভোর ৫-৬ টার সময় ঘুম থেকে উঠতে হত।

এরপর তারা এই পদ্ধতিটি বদল করে নিয়ে আসে আরেকটি নতুন পদ্ধতি। এই পদ্ধতি অনুযায়ী, উপরের তলায় অবস্থিত বেডরুম থাকা শ্রমিকদের জাগানোর জন্য তারা একটি দীর্ঘ লাঠি ব্যবহার করত এবং সেই লাঠি দিয়ে শ্রমিকের জানালায় আঘাত করতো। কিছু কিছু নকার আপার দু-তিনবার জানালায় ধাক্কা দিয়ে চলে যেতো আবার কেউ কেউ জানালায় ততক্ষণ ধাক্কা দিত যতক্ষণ না সেই কর্মী জানালায় উঠে এসে জানালা খুলতো। প্রতিদিন কমপক্ষে ১০০ জনকে প্রতিটি নকার-আপার জাগিয়ে তুলতেন।

কয়েকজন নকার-আপারের নাম এবং তারা কত উপার্জন করতো?

চার্লস নেলসন: চার্লস নেলসন ইস্ট-লন্ডনের কর্মীদের যেমন ডাক্তার, বাজারের ব্যবসায়ী এবং ড্রাইভারদের জাগিয়ে তুলতেন। তিনি নকার-আপার হিসাবে দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে কাজ করেছেন।

ডরিস উইগ্যান্ড: ডরিস উইগ্যান্ড প্রথম যিনি ব্রিটিশ রেলওয়ের নকার-আপার ছিলেন। তিনি শ্রমিকদের শর্ট নোটিশে জানাতেন যাদের শিফটে জরুরি প্রয়োজন ছিল।

মেরি স্মিথ: মেরি স্মিথের জাগানোর পদ্ধতি ছিল একটু অন্যরকম। তিনি ইস্ট-লন্ডনে শ্রমিকদের জাগানোর জন্য শুকনো মটর ছুঁড়ে মারতেন তাদের জানালায়। সপ্তাহে তিনি ছয় পেন্স আয় করতেন।

বাকি সমস্ত নকার-আপাররা প্রতি সপ্তাহে উপার্জন করতো কয়েক পয়সা।

যারা প্রতিটি কর্মীকে সঠিক সময়ে ঘুম থেকে উঠাতে সাহায্য করলেও তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ ছিল না কর্মীরা এবং তাদেরকে কখনো তারা পাত্তা দিত না। এমনকি মাঝেমধ্যে কর্মীরা তাদের নিয়োগ করা নকার-আপারদেরকে উপর বালতি দিয়ে উপর থেকে জল নিক্ষেপ করত।

নক আপার কে জাগিয়ে তুলতো?

যাদের উপর ছিল অন্য মানুষদের জাগানোর দায়িত্ব তারা কিভাবে এতো ভোরে ঘুম থেকে উঠতো?

তাদের ঘুমানোর পদ্ধতিটি ছিল অনেকটা পেঁচার মতো অর্থাৎ নকার-আপাররা তাদের সকালের দায়িত্ব শেষ করার জন্য সারারাত জেগে থাকতো এবং শেষ হয়ে যাওয়ার দিনের বেলায় ঘুমাতো। ১৯৪০ ও ৫০ এর দশকে অ্যালার্ম ঘড়ি কেনা সহজলভ্য হয়ে যাওয়ার ফলে নকার আপাররা তাদের চাকরি হারায়।

কালের স্রোতে যাতে হারিয়ে না যায় এই পেশা সেই কারণে ১৯৭০এর দশক পর্যন্ত উত্তর ইংল্যান্ডের কিছু শহরে নিয়োগ করা হয়েছিল নকার-আপারদের।

১৮ ও ১৯ শতকের মানুষের কাছে নকার-আপাররা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ন কারন তারা সময় মতো মানুষকে জাগিয়ে দিত।

আফ্রিকা ও ইউরোপ কেন সংযুক্ত নয়? কেন কোন সেতু ও টানেল নেই দুই মহাদেশের মাঝে?

পৃথিবীতে সাতটি মহাদেশ আছে এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা, উত্তর আমেরিকা, দক্ষিন আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ও আন্টার্কটিকা। এদের মধ্যে এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপের সীমানা একসাথে ভূমির সাথে সংযুক্ত হয়ে একটি বড় মহাদেশ অ্যাফ্রোইউরেশিয়া গঠন করেছে। বিশ্বের মোট স্থলভাগের ৫৭ শতাংশ এবং বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৮৫ শতাংশ এখানেই রয়েছে। এদের মধ্যে অদ্ভুত ব্যাপার হল এশিয়া ভূমির দ্বারা ইউরোপ ও আফ্রিকার সাথে সংযুক্ত কিন্তু আফ্রিকা ও ইউরোপের মধ্যে সরাসরি ভূমি সংযোগ নেই। যেখানে ৭৪৬ মিলিয়ন জনসংখ্যা বিশিষ্ট ইউরোপ বিশ্ব অর্থনীতির ২৫ শতাংশের যোগান দেয় সেখানে ১.৩ বিলিয়ন জনসংখ্যা বিশিষ্ট আফ্রিকা বিশ্ব অর্থনীতির মাত্র ৩ শতাংশ যোগান দেয়। আফ্রিকা ও ইউরোপের সবচেয়ে কাছাকাছি অংশের দূরত্ব মাত্র ১৪ কিলোমিটার কিন্তু তাও আফ্রিকা ও ইউরোপের মধ্যে সরাসরি কোন যোগাযোগ নেই।

আরো পড়ুন- অপারেশন ঘোস্ট স্টোরিস। আমেরিকার ইতিহাসে রাশিয়ার সবচেয়ে বড় স্পাই নেটওয়ার্ক খুঁজে বের করে এফবিআই

একবিংশ শতাব্দীতে যেখানে মহাকাশ ভ্রমন পর্যন্ত শুরু হয়ে গেছে, মঙ্গলে বসতি স্থাপনের পরিকল্পনা চলছে, অসাধারন ইঞ্জিনিয়ারিং প্রযুক্তির মাধ্যমে পর্বতের চূড়া থেকে শুরু করে জলের নীচে পর্যন্ত স্থাপনা চলছে, এমনকী তুষরাবৃত আন্টার্কটিকাতে পর্যন্ত মানুষ পৌঁছে গেছে সেখানে মাত্র ১৪ কিলোমিটার দূরত্ব কেনো এখনও পর্যন্ত সংযোগ করা হয়নি! বিশ্বের সবচেয়ে লম্বা টানেল ১৬৪ কিলোমিটার লম্বা যা চীনের দানিয়াং ও কুনশাং প্রদেশকে সংযুক্ত করে। ইংলিশ চ্যানেলে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সকে সংযুক্ত করা জলের নীচে টানেলের দৈর্ঘ্যও ৫১ কিলোমিটার। তাহলে জিব্রাল্টার প্রনালীতে আফ্রিকা ও ইউরোপের মধ্যে ১৪ কিলোমিটার এই দূরত্বকে কেনো কোন সেতু বা জলের নীচে থাকা টানেলের মাধ্যমে সংযুক্ত করা হয়নি? অতীতে কী কোন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল এই দূরত্বকে সংযুক্ত করার!! এই ব্যাপারেই বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।
আফ্রিকা ও ইউরোপের মধ্যে এই ১৪ কিলোমিটার দূরত্বকে জিব্রাল্টার প্রনালী বলা হয়। প্রনালী মানে দুটি বড় স্থলভাগের মাঝে সংকীর্ন জলভাগ যা দুই স্থলভাগকে আলাদা করে। জিব্রাল্টার প্রনালী আফ্রিকার মরোক্ক ও ইউরোপের আইবেরিয়ান অঞ্চলকে আলাদা করে। ৫৫ কিলোমিটার লম্বা ও স্থান বিশেষে ১৪ থেকে ৪২ কিলোমিটার চওড়া এই জিব্রাল্টার প্রনালী আটলান্টিক মহাসাগর ও ভূমধ্যসাগরকে সংযুক্ত করে। ইউরোপের শেষ শহর তারিফা এবং মরোক্কর পয়েন্ট সাইরাসের মধ্যে দূরত্ব সবচেয়ে কম ১৪ কিলোমিটার। জিব্রাল্টার প্রনালী সবচেয়ে বেশী চওড়া পশ্চিমে ইউরোপের কেপ ট্রাফালগার থেকে আফ্রিকার কেপ স্পারটেল অবধি ৪২ কিলোমিটার। ইউরোপ থেকে পরিযায়ী পাখিরা এই ১৪ কিলোমিটার পথ দিয়েই আফ্রিকায় যায়। বিশ্বের অন্যতম ব্যাস্ত সমুদ্র বানিজ্য পথ এটি। এখান দিয়ে প্রতিদিন অন্তত ৩০০ জাহাজ যাতায়াত করে এবং প্রতি পাঁচ মিনিটে একটি জাহাজ যায় এখান দিয়ে। এই কারনে জিব্রাইলের প্রনালী বিশ্বের একটি গুরুত্বপূর্ন জায়গা। এই অঞ্চলে যদি কোন সেতু তৈরি করা যেত তাহলে তা বানিজ্য ও পর্যটনের জন্য খুবই ভালো হত। ভূমধ্যসাগরকে সংযুক্ত করার কারনে জিব্রাল্টার প্রনালীর স্ট্রাটেজিক গুরুত্ব অনেক বেশী। ২২ টি দেশ এবং তিনটি মহাদেশ এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ জুড়ে থাকা ভূমধ্যসাগর ২.৫ মিলিয়ন বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত, যা ব্রিটেনের মোট আয়তনের দশ গুন। ভূমধ্যসাগরের উপকূল ভাগের দৈর্ঘ্য ৪৬,০০০ কিলোমিটার। ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলগুলোর সংস্কৃতি বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন সংস্কৃতি গুলোর মধ্যে একটি। বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন সভ্যতা গুলোর মধ্যে একটি মিশরীয় সভ্যতার উত্থান এখানেই হয়েছিল। এছাড়া প্রাচীন গ্রীস ও রোমান সভ্যতার উত্থানও এখানেই হয়েছিল।

ধর্মীয় সংস্কৃতির দিক দিয়েও ইহুদী, খ্রীষ্টান ও ইসলাম ধর্মের উত্থান এখানেই হয়েছিল। ভূমধ্যসাগরের তীরেই বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যের সূচনা হয়েছিল। রোমানরা ভূমধ্যসাগরকে ম্যারে নোস্ট্রাম বলত যার অর্থ তাদের সমুদ্র। পর্তুগিজ ও স্পেনের সাম্রাজ্যের সূচনা এখান থেকেই হয়েছিল। ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলেই ক্যাটাল্যান ও জিনোয়িসরা সর্বপ্রথম ব্যাঙ্কিং সিস্টেমের সূচনা করেছিল। সুতরাং বহু আগে থেকেই ভূমধ্যসাগর ও জিব্রাল্টার প্রনালী বিশ্বের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন অংশ। ১৮৬৯ সুয়েজ ক্যানেল তৈরি হবার পর জিব্রাল্টার প্রনালীর গুরুত্ব আরও বেড়ে যায়। এর আগে ভারত মহাসাগর থেকে কোন জাহাজকে ভূমধ্যসাগরে পৌঁছাতে হলে ৫০০০ মাইলের সুদীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হত কিন্তু সুয়েজ খাল তৈরির ফলে এই দূরত্ব অনেক কমে যায়। যার কারনে জিব্রাল্টার প্রনালীতে বানিজ্যের পরিমান বেড়ে যায়।

অতীতে অনেকবার ইউরোপ ও আফ্রিকাকে সংযুকক্ত করবার চেষ্টা করা হয়েছিল। প্রথম চেষ্টা করা হয় বিংশ শতকের প্রথমের দিকে ১৯২০ সালে, জার্মানির স্থপতিবিদ হার্মান মিলার সরগেল অ্যাটলানট্রোপা প্রজেক্টের কথা বলেন যাতে ইউরোপ ও আফ্রিকাকে সংযুক্ত করা যায়। এর জন্য তিনি একটি ইলেকট্রিক পাওয়ার প্ল্যান্ট তৈরির প্রস্তাব দেন যাতে এই অঞ্চলে একটি ৮০ মাইল লম্বা ড্যাম তৈরি করা হবে। এই ড্যাম ৫০ গিগাওয়াট বিদ্যুৎ তৈরিতে সক্ষম হত যা স্থানীয় অঞ্চলে বিদ্যুৎ এর চাহিদা মেটাতে সক্ষম ছিল। কিন্তু এতে সমস্যা হত যে কয়েক দশকের মধ্যে ভূমধ্যসাগরের জলস্তর কিছুটা কমে যেত। জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাডলফ হিটলার এই প্রজেক্টের সম্মতি দেয়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সরগেল আবারও এই প্রজেক্ট শুরু করবার চেষ্টা করেন কিন্তু তিনি প্রয়জনীয় অর্থ জোগার করতে ব্যার্থ হন। এরপর ১৯৩০ সালে স্পেন এখানে জলের নীচে টানেলের প্রস্তাব দেয় কিন্তু জিব্রাল্টার প্রনালী প্রায় ৩০০০ ফুট গভীর, এত গভীরতায় কোন টানেল করা সম্ভব নয়।

১৯৭৯ সালে স্পেন ও মরোক্ক যৌথভাবে এখানে একটি সেতু নির্মানের চেষ্টা শুরু করে। কিন্ত একটি নতুন তথ্য সামনে আসে, এই অঞ্চলের নীচে রয়েছে আফ্রিকান-ইউরেশিয়ান প্লেট যা ভূমিকম্পের সৃষ্টি করে। তবুও দুই দেশ সেতু নির্মানের চেষ্টা করেছিল ৪০ বছর ধরে কিন্তু কোন লাভ হয়নি। ১৯৯০ সালে বিখ্যাত চাইনিজ আমেরিকান স্থপতি টুং ইয়েন লিন সানফ্রান্সিসকোর একটি বড় সংস্থার সাথে ১৪ কিলোমিটার লম্বা সেতু তৈরির প্রস্তাব রাখেন। এই প্রজেক্টে খরচ দেখা যায় ১৫ বিলিয়ন ডলার। শেষ পর্যন্ত এই প্রজেক্টও শুরু হয়নি। ২০০৪ সালে আমেরিকান স্থপতি ইওগিনি তাসুই এখানে একটি ভাসমান সেতু তৈরির প্রস্তাব দেন। তিনি বলেন দুই অঞ্চলের মাঝামাঝি একটি কৃত্রিম দ্বীপ তৈরি করা হবে এবং দ্বীপের দুই প্রান্ত সেতুর মাধ্যমে সংযুক্ত থাকবে কিন্তু এত বিশাল খরচের প্রজেক্টে কেউ আগ্রহ দেখায়নি। তবে ২০২১ সাল থেকে একটি একটি টানেল তৈরির কাজ শুরু হয়েছে মরোক্কর সবচেয়ে বড় বন্দর ট্যানগিয়ের পর্যন্ত, এই প্রজেক্টে ব্রিটেন যুক্ত আছে। তবে এখন সেই প্রজেক্ট সম্পর্কে তেমন কোন তথ্য নেই। ২০২২ এর বাজেটে স্পেন ৭,৫০,০০০ ইউরোর বাজেট দিয়েছে একটি গবেষনা সংস্থাকে নতুন টানেল তৈরির ব্যাপারে বিশ্লেষন করতে। ২০৩০ এ এখানে নতুন টানেল তৈরির কাজ শুরু হতে পারে। যা দিয়ে ২০৫০ এর মধ্যে জিব্রাল্টার প্রনালী দিয়ে ১৩ মিলিয়ন টন পন্য এবং ১২ মিলিয়ন যাত্রী যেতে পারবে। এতবছর ধরে চেষ্টা করেও এখানে কোন টানেল ও সেতু না তৈরি করতে পারার সবচেয়ে বড় কারন এই অঞ্চলের ভৌগোলিক গঠন। জিব্রাল্টার প্রনালী প্রায় ৩০০০ ফুটের বেশী গভীর, বিশ্বের সবচেয়ে বড় বিল্ডিং বুর্জ খলিফার উচ্চতা ২৭১৬ ফুট. সুতরাং এত লম্বা স্থাপত্য করা সত্যিই খুব সমস্যার। এখনও পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে লম্বা সেতু মন্টেনেগ্রোর মালা ভায়াডাক্ট যা ৮০৩ ফুট লম্বা। যার জন্য বিশ্বের বড় বড় স্থাপত্য সংস্থা এই প্রজেক্টকে অসম্ভব জানিয়েছে।

অপারেশন ঘোস্ট স্টোরিস। আমেরিকার ইতিহাসে রাশিয়ার সবচেয়ে বড় স্পাই নেটওয়ার্ক খুঁজে বের করে এফবিআই

দিনটা ২৬ জুন, ২০১০, অন্যান্য দিনের মতোই কর্মব্যাস্ত নিউইয়র্ক শহরের এক রেস্তোরাঁয় কালো চশমা পড়ে লাল চুলের এক মেয়ে প্রবেশ করে। সেখানে অনেকক্ষন ধরেই তার জন্য অপেক্ষা করছিল কালো জামা পড়া এক ব্যাক্তি। তবে মেয়েটি রেস্তোরাঁয় প্রবেশ করার অনেক আগে থেকেই চারপাশ খুব ভালো ভাবে লক্ষ্য করছিল। মেয়টির নাম অ্যানা চ্যাপমান যে একজন রাশিয়ান গুপ্তচর। কালো জামা পড়া ওই ব্যাক্তিটির নাম রোমান যে একজন রাশিয়ান কর্মকর্তা। অ্যানা তার ব্যাগ থেকে একটি ল্যাপটপ বের করে রোমানের হাতে দেয়। আসলে রোমান নামে যে ব্যাক্তিটিকে অ্যানা রাশিয়ান কর্মকর্তা ভাবছিল বাস্তবে সে আমেরিকার ইনটেলিজেন্স সংস্থা এফবিআই এর এজেন্ট। তাদের এই পুরো ঘটনা একটি গোপন ক্যামেরায় রেকর্ড হচ্ছিল।

এফবিআই এই পুরো মিশনের পরিকল্পনা বহুদিন ধরেই করছিল। এফবিআই এর এই মিশনের নাম অপারেশন ঘোস্ট স্টোরিস। বহুদিন ধরেই আমেরিকার বিভিন্ন শহরে বেশ কয়েকজন রাশিয়ান এজেন্ট গোপনে কাজ করছিল। তারা আমেরিকান পরিচয় নিয়ে সাধারন আমেরিকানদের ছদ্মবেশে আমেরিকায় বসবাস করে পরিবারও তৈরি করেছিল। তাদের পরিবার তাদের এই গোপন জীবন সম্পর্কে জানত না। কিন্তু এফবিআই বহুদিন ধরেই তাদের ধরবার পরিকল্পনা করছিল। এক অসাধারন অপারেশনের মাধ্যমে এফবিআই একই দিনে সব রাশিয়ান এজেন্টদের গ্রেফতারের পরিকল্পনা তৈরি করে ফেলে।

অ্যানা চ্যাপমান নামের এই রাশিয়ান মহিলা দীর্ঘদিন ধরে আমেরিকা ও ব্রিটেনে রাশিয়ান এজেন্ট হিসাবে কাজ করছিল। লন্ডনে রাশিয়ার একটি মিশনে কাজ করার সময় অ্যানার সাথে পরিচত হয় আলেকজান্ডার চ্যাপমান নামে এক ধনী যুবকের, এবং উভয়ে খুব তাড়াতাড়ি বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হয়। কিন্তু চার বছর পর উভয়ের মধ্যে বিচ্ছেদ হয়ে যায়। অ্যানা তখন লন্ডন থেকে ম্যানহ্যাটেন চলে আসে ২০০৯ সালে। পরে সেখান থেকে পরে নিউইয়র্ক আসে, কিন্তু তখনও সে তার প্রাক্তন সাথীর চাপম্যান টাইটেল ব্যবহার করছিল। নিউইয়র্কে এসে অ্যানা রাশিয়ান ইনটেলিজেন্স সংস্থা কেজিবির কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ শুরু করে নিউইয়র্কে তার কাজ শুরু করে। লাল চুলের সুন্দরী অ্যানা খুব দ্রুত রাজনৈতিক মহলে তার বন্ধু তৈরি করতে শুরু করে এবং সে সফলও হয় তার কাজে। সেখান থেকে তথ্য সংগ্রহ করে বিভিন্ন কফিশপে, মলে, রেস্তোরাঁয় গোপন ভাবে কেজিবি এজেন্টদের সাথে দেখা করত অ্যানা। কিন্তু অ্যানা জানতো না এফবিআই তাকে নজর রাখা শুরু করেছে, আসলে বহু দিন থেকেই এই অপারেশন ঘোস্টস্টোরিস শুরু করেছিল এফবিআই। ২০০০ সালের শুরু থেকেই এফবিআই এই অপারেশন শুরু করে। প্রায় দশ বছর ধরে চলা এই অপারেশনে রাশিয়ান এজেন্টদের উপর এফবিআই বহু ধরে নজর রেখেছিল। কয়েক হাজার ঘন্টা ধরে তাদের সমস্ত বক্তব্য বিশ্লেষন করতে হয় এফবিআই এজেন্টদের।

অ্যানা সহ আমেরিকায় থাকা রাশিয়ান এজেন্টরা প্রাইভেট ওয়াইফাই নেটওয়ার্কে যোগাযোগ করত যার লিংক ও গোপনীয় ছিল। এইসব এজেন্টরা রেডিওগ্রাম ও স্টেগানোগ্রাফি ব্যাবহার করত যোগাযোগের জন্য। স্টেগানোগ্রাফি এমন একটি পদ্ধতি যেখানে একটি কম্পিউটারে রঙিন ছবির মধ্যে একটি বিশেষ সফটওয়্যারে কিছু ডিজিট্যাল সাংকেতিক মেসেজ ইনস্টল করা থাকত। সবাই দেখে সেটা সাধারন ছবি ভাবত, কিন্তু এই ছবির মধ্যে থাকা সফটওয়্যার ওপেন করতে হলে একটি বিশেষ কোডের দরকার হতো। প্রথমে কম্পিউটারে কন্ট্রোল, অল্ট ই টিপে তারপর ২৭ সংখ্যার একটি পাসওয়ার্ড দিতে হত তবে সেই মেসেজ দেখা যেত। এফবিআই এই প্রাইভেট নেটওয়ার্ক খুঁজে বের করে এবং অ্যানার কম্পিউটার হ্যাক করে তাতে নিজেদের সফটওয়্যার ইনস্টল করে দেয়। এভাবে অ্যানা সহ আমেরিকায় গোটা কেজিবি নেটওয়ার্ককে ট্র্যাক করে ফেলে এফবিআই। অ্যানা যেখানে যেত, যাদের সাথে গোপনে দেখা করতো সব তথ্যই এফবিআই পেতে থাকে। এফবিআই বহুদিন ধরেই সন্দেহ করছিল বেশ কিছু সংখ্যায় রাশিয়ান আমেরিকায় ছদ্মবেশে বসবাস করছে। এইসব এজেন্টদের দেখে কেউ সন্দেহও করবে না, এরা এমনই পরিচয় তৈরি করেছিল। এদের মধ্যে কেউ নিজের নাম বদলে ফেলেছিল, কেউ মরে যাওয়া ব্যাক্তির নাম ব্যবহার করেছিল। সাধারন স্বামী স্ত্রীর মতোই প্রতিবেশীদের সাথে শান্তিপূর্ন বসবাস করতো এরা, সন্তান ছিল, কাজ করত, কেউ কেউ কলেজেও পড়তো অর্থাৎ পুরো একদম সাধারন জীবন যাপন, সন্দেহর কোন জায়গায় ছিলনা।

রাশিয়া এভাবে আমেরিকায় পুরো তাদের কেজিবির একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করে ফেলেছিল। এফবিআই এই অপারেশনের নাম ঘোস্ট স্টোরিস দেয় কারন এফবিআই প্রাথমিক ভাবে দশজনকে রাশিয়ান এজেন্ট হিসাবে সন্দেহ করেছিল তাদের মধ্যে ছয়জনই মরে যাওয়া আমরিকান নাগরিকদের পরিচয় ব্যাবহার করতো। আমেরিকায় কেজিবির এই নেটওয়ার্ক পুরো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ব্রিটেনে সোভিয়েত ইউনিয়নের কেমব্রিজ ফাইভ নেটওয়ার্কের মতো ছিল যা ১৯৫০ সাল পর্যন্ত ছিল। যদিও ব্রিটেনের ইনটেলিজেন্স সংস্থা এমআই ৬ এবং এমআই ৫ সফল ভাবে এই নেটওয়ার্ক ধ্বংস করে দিয়েছিল। কেমব্রিজ ৫ এর সবচেয়ে ধুরন্ধর এজেন্ট ছিল কিম ফিলবি যে এমআই ৬ এর সোভিয়েত ইউনিয়ন বিভাগের প্রধান হিসাবেও নিযুক্ত হয়েছিল। এফবিআই প্রায় একবছর ধরে অ্যানার উপর নজর রাখে। অ্যানা অন্তত ছয়টি জায়গা থেকে সাংকেতিক ভাবে মেসেজ পাঠাতো ও পেতো। সব কটি মেসেজই এফবিআই বুঝতে পারতো। এফবিআই রোমানকে রাশিয়ান কর্মকর্তা সাজিয়ে অ্যানার সাথে দেখা করতে পাঠায়। রোমানের সাথে দেখা করতে রাজিও হয়ে যায় অ্যানা। রোমান অ্যানাকে একটি নকল আমেরিকান পাসপোর্ট দিয়ে তা একজন এজেন্টকে দিয়ে আসতে বলে। কিন্তু অ্যানার রোমানের উপর সন্দেহ দেখা দেয় সেজন্য রেস্তোরাঁ থেকে বেড়িয়েই সে প্রথমেই তার ফোন নষ্ট করে ফেলে। একটি নতুন ফোন ও সিম কার্ড কেনে। কিন্তু এফবিআই অ্যনার গতিবিধির উপর নজর রাখছিল। পরের দিন অর্থাৎ ২৭ জুন অ্যানাকে গ্রেফতার করে এফবিআই। তবে ২৭ জুন শুধু অ্যানা একা গ্রেফতার হয়নি তার সাথে বোস্টন, উত্তর ভার্জিনিয়া, মন্টক্লেয়ার এবং ইয়াঙ্কাীসে অভিয়ান চালিয়ে আরও নয়জন রাশিয়ান এজেন্টকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। ৮ জুলাই দশজন এজেন্টকে রাশিয়া ফেরত পাঠানো হয়, বদলে রাশিয়াও গুপ্তচর সন্দেহে গ্রেফতার হওয়া চারজন ইউরোপীয়ান ব্যাক্তিকে ছেড়ে দেয়। তবে আরও তিনজন রাশিয়ান এজেন্ট গ্রেফতারের আগেই আমেরিকা ছেড়ে পালিয়ে যায়। এই সমস্ত এজেন্ট রাশিয়ার এসভিআর ইনটেলিজেন্স অ্যাকডেমি থেকে প্রশিক্ষিত ছিল। এফবিআই এর ইতিহাসে এরকম অপারেশন প্রথমবারের মতোন হয় যেখানে একই দিনে দশজন রাশিয়ান এজেন্টকে গ্রেফতার করা হয়। এই দশ এজেন্টকে রাশিয়া আমেরিকায় পাঠিয়েছিল যাতে তারা সাধারন আমেরিকান হিসাবে বসবাস করে আমেরিকার রাজনৈতিক জগতে প্রভাব খাটিয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে পারে। গ্রেফতার হওয়া দশজন রাশিয়ান এজেন্টদের মধ্যে আটজন স্বামী স্ত্রী এবং দুজন একা ছিল।

** ভিকি পেলায়েজ এবং জুয়ান লাজারো:–

ভিকি পেলায়েজের আসল নাম ছিল মিখাইল অ্যান্টোলিভিচ ভাসেনকভ। পেরুতে জন্মানো এই ব্যাক্তি আমেরিকায় ল্যাটিন ও আমেরিকান ও ক্যারিবিয়ান রাজনীতির অধ্যাপক হিসাবে কাজ করতো। তার স্ত্রী জুয়ান লাজারো নামটাও ছদ্মনাম ছিল। আসল জুয়ান লাজারো একজন আমেরিকান বাচ্চা ছিল যে ১৯৪৭ সালে উরুগুয়েতেই মারা গিয়েছিল। জুয়ান লাজারো এল ডিয়ারিও নামে একটি আমেরিকান স্প্যানিশ সংবাদমাধ্যমে কাজ করতো।

** ডোনাল্ড হেতফিল্ড এবং ট্রাসি লি অ্যান ফলি:– এদের আসল নাম ছিল অ্যান্দ্রে বেজ্রোকোভ এবং ইয়েলিনা ভ্যাভিলোভা। এরা ম্যাসাচুসেটসে থাকত। ডোনাল্ড হেতফিল্ড নামটা একজন কানাডিয়ান মৃত ব্যাক্তির। ট্রাসি রিয়েল এস্টেট এজেন্ট এবং ডোনাল্ড ভবিষ্যত প্রযুক্তির উপরে কাজ করত, সাথে সেলসম্যান হিসাবেও কাজ করতো।

** রিচার্ড এবং সিন্থিয়া মার্ফি:— এদের আসল নাম ভ্লাদিমির গুরিয়েভ এবং লিদিয়া গুরিয়েভা। এরা নিউ জার্সির মন্টকেয়ারে থাকতো। সিন্থিয়া বিভিন্ন অর্থনৈতিক প্রজেক্টে কাজ করতো নিউইয়র্কে।

** মিখাইল জটোলি এবং প্যাটরিসিয়া মিলস:– এদের আসল নাম ছিল মিখাইল কুটসিক এবং নাটালিয়া পেরেভারজেভা। প্রথমে এরা ওয়াশিংটনে থাকতো পরে ভার্জিনিয়ায় চলে আসে। এরা ২০০১ ও ২০০৩ সালে আমেরিকায় আসে। জটোলি নিজেকে ইটালিয়ান ব্যাঙ্কার হিসাবে পরিচয় দিয়েছিল এবং মিলসের পরিচয় ছিল একজন কানাডিয়ান ছাত্র।

** অ্যানা চ্যাপম্যান :– আসল নাম অ্যানা কুশচেঙ্কো। লন্ডন থেকে নিউইয়র্কে এসে রিয়েল এস্টেট এজেন্ট হিসাবে কাজ করতো।

** মিখাইল সেমেঙ্কো :– এই ব্যক্তি তার নিজের নামেই আমেরিকার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে। রাশিয়ান, ইংরেজি, স্প্যানিশ ও চাইনিজ ভাষায় পারদর্শী মিখাইল ট্রাভেল অল রাশিয়া নামে একটি ভ্রমন সংস্থায় কাজ করতো। তার মালিক সালাভা শিরোকোভ একজন বিশ্বরাজনীতির বিশ্লেষক ছিল যার থেকে অনেক গোপন তথ্য পেত মিখাইল।

পরে সাইপ্রাসে ক্রিস্টোফার মেসটস নামে আর একজন ব্যাক্তিকে গ্রেফতার করে এফবিআই যে আমেরিকা থেকে পালিয়ে গিয়েছিল। মেসটস আমেরিকায় রাশিয়ান এজেন্টদের পয়সা দেবার দায়িত্বে ছিল। মেসটস নিজেকে কানাডিয়ান দাবি করলেও তার আসল পরিচয় এফবিআই খুঁজে বের করে। তার আসল নাম পাভেল কাপুস্টিন যে একজন ধুরন্ধর রাশিয়ান এজেন্ট।

শ্রীরামকৃষ্ণ এবং হিন্দু পুনরুত্থানবাদ বিতর্ক

রানা চক্রবর্তীঃ বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঊনিশ শতকের ভারতের ইতিহাসে হিন্দু পুনরভ্যুত্থান আন্দোলনের প্রসঙ্গটি বিভিন্ন ভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। সেই উদ্যোগ যেমন ঔপনিবেশিকতা-বিরোধী জাতীয়তাবাদী মনোভাব বিস্তারে সহায়ক হয়েছিল, তেমনি সেটার সঙ্গে বহু প্রতিক্রিয়াশীল চেতনার আমদানিও ঘটেছিল, যেগুলোর খেসারত বর্তমানেও সমাজকে দিতে হচ্ছে। ঊনিশ শতকের হিন্দু-পুনরভ্যুত্থান আন্দোলনের মূল্যায়ন করাটা এই প্রবন্ধের প্রতিপাদ্য বিষয় নয়, হিন্দু পুনরভ্যুত্থান আন্দোলন নেতৃত্বে রামকৃষ্ণকে সংশ্লিষ্ট করবার যৌক্তিকতা বিচার করে এই প্রবন্ধের মূল আলোচ্য বিষয়। যেহেতু হিন্দু পুনরুভ্যুত্থান আন্দোলনকালেই রামকৃষ্ণের আবির্ভাব ঘটেছিল, যেহেতু হিন্দু ধর্মপীঠস্থানেই তাঁর অবস্থান ছিল, আর যেহেতু তাঁর কণ্ঠে প্রায়শঃই ‘মা’ ‘মা’ ডাক শোনা গিয়েছিল, সেই কারণেই সিংহভাগ ঐতিহাসিকেরা তাঁকে হিন্দু পুনরভ্যুত্থানবাদদের সগোত্র করেছেন। যদিও অনেক ঐতিহাসিকই রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ প্রসঙ্গে ‘নব্যহিন্দু আন্দোলন’ বিশেষণটি প্রয়োগ করবারও পক্ষপাতী। বস্তুতঃ হিন্দু-পুনরভ্যুত্থানবাদীদের সঙ্গে রামকৃষ্ণকে সংশ্লিষ্ট করবার অর্থ, তাঁর চরিত্রের খণ্ডিত মূর্তির ওপরে সিদ্ধান্ত টানা ছাড়া অন্য কিছুই নয়। এই সিদ্ধানে, রামকৃষ্ণ জীবনের বৃহত্তর ও মূল্যবান অংশকে উপেক্ষা করা হয়েছে, যা অবশিষ্ট বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রাক্কালে অতীব জরুরি। রামকৃষ্ণ চরিত্রের বিশ্লেষণী তথ্য সামনে বাখলে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিতর্ক থাকবেই। সেই প্রসঙ্গে আলোকপাত করে এই নিবন্ধের উদ্দেশ্য।

ঊনিশ শতকের হিন্দু-পুনর্জাগরণের প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোচনার শুরু করা যাক। এই প্রসঙ্গে ‘সুনীতিরঞ্জন রায় চৌধুরী’ জানিয়েছিলেন যে, উক্ত শতকের হিন্দু-পুনরভ্যুত্থানবাদীরা প্রাচীন ভারতের ঐতিহ্যকে পুনঃপ্রবর্তিত করবার পক্ষপাতী ছিলেন। অতীতের কোন কোন যুগকে তাঁরা প্রত্যাবর্তন করাতে চেয়েছিলেন, সেটাও খুব স্পষ্ট। মনে হয় যে, বৈদিক যুগ, মহাভারতের যুগ, অশোক ও চন্দ্রগুপ্তের যুগই তাঁদের লক্ষ্য ছিল। এই প্রসঙ্গে সংস্কারবাদী ও হিন্দু-পুনরভ্যুত্থানবাদীদের পার্থক্যটিও অবশ্য উল্লেখ্য। উক্ত সময়ের সংস্কারবাদীরা বর্তমান সমাজব্যবস্থার কথাই চিন্তা করতেন, এবং বাস্তব পরিপ্রেক্ষিতে সেই সমস্যার সমাধানের কথা ভাবতেন। অন্যদিকে পুনরভ্যুত্থানবাদীরা গ্রীক দেবতা জেনাসের মতো অতীতের স্বর্ণযুগ কল্পনার সঙ্গে সঙ্গে সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের কথাও চিন্তা করেছিলেন। ইউরোপীয় সমাজ-চিন্তার অভিজ্ঞতা ও যুক্তিবাদ যেখানে সংস্কারবাদীদের আদর্শ ছিল, সেখানে পুনরভ্যুত্থানবাদীদের আদর্শ ছিল হিন্দু শাস্ত্র এবং ভারতের অতীত ইতিহাস। এই প্রসঙ্গে ‘লালা রাজপত রাই’ লিখেছিলেন, “The former are bent on relying more upon reason and the experience of European society while the latter are disposed to primarily look at the shastras and the past history and the traditions of their people and the ancient institutions of the land which were in vogue when nation was in the zenith of its glory.” সেই সময়ের ইংরেজি শিক্ষিত সম্প্রদায়ের হিন্দুধর্মের প্রতি অনাস্থা ও অবজ্ঞার প্রতিক্রিয়া স্বরূপই হিন্দু পুনরভ্যুত্থান আন্দোলন অনেকটা দানা বেঁধেছিল। তার সঙ্গে এদেশে খ্রিস্টধর্ম প্রচারকদের নির্বিচার ধর্মান্তরকরণ ও হিন্দু-বিদ্বেষ যুক্ত হয়েছিল। এর ফলে তখনকার একশ্রেণীর হিন্দুদের মনে ত্রাসের সৃষ্টি হয়েছিল, এবং তাঁরা হিন্দুধর্মের মাহাত্ম্য পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য সর্বতোভাবে উদ্যোগী হয়েছিলেন। ঊনিশ শতকের হিন্দু পুনরভ্যুত্থানবাদের মূলে সেই প্রচেষ্টায় ছিল। ‘শিবনাথ শাস্ত্রী’ ১৮৭০-৭৯ কালপর্বকে ‘ব্রাহ্মসমাজের প্রভাব হ্রাস ও হিন্দুধর্মের পুনরুত্থানের সূচনা কাল’ বলে উল্লেখ করেছিলেন। ‘প্রচার’ (প্রথম প্রকাশ ১৮৮৪), এবং ‘নবজীবন’ (১৮৮৪) পত্রিকার আত্মপ্রকাশ ও হিন্দুধর্মের নব ব্যাখ্যাদান সেই সময়ের উল্লেখযোগ্য ঘটনা। তাছাড়া ওই একই সময়ে ‘কৃষ্ণপ্রসন্ন সেন’ (১৮৪৯-১৯০২) ও ‘পণ্ডিত শশধর তর্ক চূড়ামণি’র (১৮৫১-১৯২৮) হিন্দুধর্মের ব্যাখ্যা ও নব্য হিন্দুধর্ম প্রচার হিন্দু পুনরভ্যুত্থান আন্দোলনকে তীব্র গতিদান করেছিল। ঊনিশ শতকের গবেষকেরা ধারণা করেন যে, উক্ত শতকের শেষপর্বে যে হিন্দু পুনরভ্যুত্থানের জোয়ার এসেছিল, সেটার অঙ্কুর ওই শতকের শুরুতেই বিভিন্ন ধর্মের পারস্পরিক প্রতিস্পর্ধী প্রবণতার মধ্য দিয়েই মাথা তুলেছিল। ঊনিশ শতকের প্রথমার্ধে খ্রিস্টধর্মই হিন্দুধর্মের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল। রামমোহন রায় খ্রিস্টীয় ‘ত্রিত্ববাদ’ খণ্ডন করে খ্রিস্টান পাদ্রীদের সঙ্গে যেমন তর্ক যুদ্ধে প্রবৃত্ত হয়েছিলেন, তেমনি আবার রামমোহনের পৌত্তলিকতা বিরোধী বেদান্ত প্রতিপাদ্য ধর্ম ও ব্রহ্মসভার (১৮৩০) বিরোধিতা করে রক্ষণশীল হিন্দুসমাজ ‘ধর্মসভা’ও (১৮৩০) প্রতিষ্ঠা করেছিল। রামমোহন খ্রিস্টধর্ম প্রবাহ রোধের উদ্যোগে যে ধর্ম ও ধর্মসভার সূচনা করেছিলেন, পরবর্তীকালে ‘মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের’ হাতে সেটাই ‘ব্রাহ্মসমাজ’ হয়েছিল। মহর্ষি ব্রাহ্মধর্মকে হিন্দুধর্মের সমুন্নত রূপ বলে মনে করতেন। মিশনারী ‘আলেকজাণ্ডার ডাফ’ (১৮০৬-৭৮) প্রবর্তিত ‘জেনারেল অ্যাসেমব্লি’ এই দেশীয় কিশোর ও যুবকদের খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করবার কেন্দ্র হয়ে উঠলে, তিনি সেকাজের প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠেছিলেন, এবং রক্ষণশীল হিন্দু ‘রাধাকান্তদেব’কে সাহায্য করবার জন্য এগিয়ে গিয়েছিলেন। অতঃপর ‘হিন্দু হিতার্থী বিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। অনুরূপ উদ্যোগেই ‘হিন্দু কলেজে’র খ্রিস্টান ব্যক্তিবর্গের অপ্রতিহত গতায়াতের প্রতিবাদেই রক্ষণশীল হিন্দু গোষ্ঠী ‘হিন্দুমেট্রোপলিটন কলেজ’ গড়ে তুলেছিল। পরবর্তীসময়ে দেবেন্দ্রনাথের ব্রাহ্মসমাজে ‘কেশবচন্দ্র সেন’ খ্রিস্টভাবনার অনুপ্রবেশ ঘটালে, এবং ‘ব্রাহ্মবিবাহ’ প্রসঙ্গে ‘ব্রাহ্মরা হিন্দু নয়’ বলে মন্তব্য করলে, প্রতিপক্ষ হিন্দুসমাজ তাঁদের হিন্দু পুনরভ্যুত্থান আন্দোলনকে আর জোরদার করেছিলেন। তাই হিন্দু পুনরভ্যুত্থান আন্দোলনের কারণ হিসাবে গবেষকরা মূলতঃ দুটি শর্তের কথা উল্লেখ করেন। সেগুলোর মধ্যে প্রথমটি হল, মূলগত (basic), এবং দ্বিতীয়টি হল তাৎক্ষণিক (immediate)। মূলগত কারণটি ছিল – হিন্দু সমাজ কর্তৃক প্রাচীন হিন্দু রীতিনীতিকে শ্রেষ্ঠত্ব জ্ঞান করে সেটার পুনঃপ্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা, আর তাৎক্ষণিক কারণের নেপথ্যে ছিল সমকালীন বিক্ষিপ্ত ঘটনার প্রবাহ; যথা – কেশবচন্দ্রের খ্রিস্টপ্রীতি, ব্রাহ্মবিবাহ বিধি প্রবর্তন (১৮৭২), ব্রাহ্ম স্ত্রী স্বাধীনতা, ইলবার্ট বিল (১৮৮২) ও সহবাস সম্মতি বিধি (১৮৯১)। ঊনিশ শতকের রক্ষণশীল হিন্দুসমাজ প্রায় বরাবরই ব্রাহ্মসমাজের বিরোধিতা করে গিয়েছিলেন। তাঁরা কেশবচন্দ্রের খ্রিস্টপ্রীতিকে যেমন ভালো চোখে দেখেন নি; তেমনি ব্রাহ্ম স্ত্রী স্বাধীনতা রক্ষণশীল হিন্দু চেতনার পরিপন্থী, ব্রাহ্মবিবাহ বিধি হিন্দু সমাজের বাল্যবিবাহ ও কৌলিন্য প্রথার প্রতিবাদস্বরূপ, এবং পরিশেষ সহবাস সম্মতি বিধির মাধ্যমে হিন্দুকন্যার বিবাহের সময়কাল (অর্থাৎ দৈহিক পরিণতির পর বিবাহ ব্যবস্থার) নির্ধারিত হলে হিন্দুসমাজ প্রমাদ গুণেছিল। তাঁরাই তখন বিদ্রোহী হয়ে পুনরভ্যুত্থানকে কামনা করেছিলেন। ইলবার্ট বিল সংক্রান্ত আন্দোলন সেই আন্দোলনে ঘৃতাহুতি দিয়েছিল। ওই বিলে এই দেশীয় বিচারকদের দ্বারা ইউরোপীয়দের বিচারের অধিকার দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ইউরোপীয়রা সেটা মানতে রাজি হননি। তাঁরা আন্দোলন করবার পরে সরকার সেই উদ্যোগকে পরিবর্তন করেছিলেন। ওই অবমাননা এই দেশে হিন্দু পুনরভ্যুত্থানকে অনেকাংশে প্রভাবিত করেছিল।

আরো পড়ুন- নাচতে নাচতে স্ট্রোক হয়ে যাচ্ছে, তবুও নাচ থামছে না! ডান্সিং প্লেগের ঘটনা কতখানি সত্যি?

শ্রীরামকৃষ্ণকে হিন্দু পুনরভ্যুত্থান আন্দোলনের নায়ক হিসাবে চিহ্নিত করবার প্রবণতা, এবং সেই চিন্তার পৃষ্ঠপোষকের সংখ্যা যথেষ্টই বলে দেখতে পাওয়া যায়। অনেকে যেমন স্রেফ ভাবাবেশে এই সিদ্ধান্তকে মেনে নেন, অনেকে তেমনি জোর করে যুক্তি খাড়া করে এই সিদ্ধান্ত অন্যকে মানাতে চান। এই প্রসঙ্গে তিনটি তত্ত্বকে উল্লেখ করা যেতে পারে। প্রথম তত্ত্বটি হল ‘প্রাতিষ্ঠানিক গুণাবলীভিত্তিক’ বা ‘Institutional concept’, দ্বিতীয় তত্ত্বটি হল ‘আচরণিক ভিত্তি’ বা ‘Behavioural concept’, এবং তৃতীয় তত্ত্বটি হল ‘উদ্ধৃতিভিত্তিক তত্ত্ব’ বা ‘Quotational concept’। যাঁরা শ্রীরামকৃষ্ণকে তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক বৈশিষ্ট্য গুণে হিন্দু পুনরভ্যুত্থানবাদী বলে চিহ্নিত করতে চান, তাঁদের বক্তব্য হল যে, কৈবর্ত রমণী রানী রাসমণি জাতিতে শূদ্র বংশীয়া ছিলেন। তিনি জাত্যকৌলীন্যে উন্নীত হওয়ার জন্যই দক্ষিণেশ্বরে ভবতারিণী মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, এবং সেখানে দরিদ্র ব্রাহ্মণ গদাধরকে পুরোহিত থেকে অবতার পদে ঢক্কানিনাদের জোরে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। যেহেতু হিন্দু আরাধ্যা দেবী কালীর কাছে পৌরোহিত্য জোরে তিনি অবতার হয়েছেন, সেই কারণে সমকালীন হিন্দু পুনরভ্যুত্থান আন্দোলনে তিনি সহজেই অংশীদার। আচরণীয় বৈশিষ্ট্যে যাঁরা রামকৃষ্ণকে ঐ পর্যায়ভুক্ত করবার পক্ষপাতী তাঁদের মতে, হিন্দুধর্ম পুনরভ্যুত্থান প্রচেষ্টায় রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের সর্বাপেক্ষা তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তিনি তাঁর কথায় ও কাজে হিন্দুধর্মকে নিম্নস্তর থেকে তুলে এনে উচ্চতম আসনে অধিষ্ঠিত করে গিয়েছেন। হিন্দু পুনরভ্যুত্থানের বড় বৈশিষ্ট্য হল যুক্তি বিরোধী ভক্তি চর্চা। রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব শুধু ভক্তি রসের প্রতিষ্ঠা করে ক্ষান্ত থাকেন নি, তিনি পাণ্ডিত্যকেও চরম আঘাত করেছিলেন। ভক্তিবাদভিত্তিক হিন্দু-জাগরণের দিক থেকে সেটার প্রয়োজনীয়তা হয়ত তিনি উপলব্ধি করেছিলেন। পাণ্ডিত্যাভিমানীদের সঙ্গে শকুনদের তুলনা করে তিনি বলতেন যে, শকুনি যত উপরেই উড়ুক না কেন, তার নজর যেমন সব সময় ভাগাড়ের দিকে থাকে, তেমনি পণ্ডিতেরাও কখনো কামিনী-কাঞ্চনের আসক্তি থেকে মুক্ত হতে পারে না। তিনি মনে করতেন যে, বেশি পড়াশুনা করবার কোন প্রয়োজন নেই – স্রেফ ভক্তি থাকলেই হল। গীতা পড়লে কি হয়? দশবার ‘গীতা’ ‘গীতা’ বললে যা হয়। ‘গীতা’ ‘গীতা’ বললে ‘ত্যাগী’ হয়ে যায়। সংসারে কামিনী কাঞ্চনে যাঁর আসক্তি ত্যাগ হয়ে গেছে, সে ঈশ্বরেতে ষোল আনা ভক্তি দিতে পেরেছে, সেই গীতার মর্ম বুঝেছে। এছাড়া তিনি আরো বলেছিলেন যে, পাণ্ডিত্যে কি আছে? ব্যাকুল হয়ে ডাকলে তাঁকে পাওয়া যায়। নানা বিষয়ে জানবার দরকার নেই। এই পাণ্ডিত্যবিরোধী মনোভাবের জন্য তিনি ‘শশধর তর্ক চূড়ামণি’ ও ‘ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের’ প্রতি কিছুটা কটাক্ষ করেছিলেন। যাঁরা উদ্ধৃতিমূলক তথ্য দিয়ে রামকৃষ্ণকে হিন্দু পুনরভ্যুত্থানবাদী প্রমাণের নমুনা হিসেবে উপস্থিত করতে চান, তাঁরা বলেন যে, ঐ যুগের সর্বাপেক্ষা রহস্যবাদী ও আধ্যাত্মিক শিক্ষার ক্ষেত্রে শ্রীরামকৃষ্ণ সর্বোচ্চ স্থানের অধিকারী ছিলেন। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর বা কেশবচন্দ্র সেন – এই দুই আধ্যাত্মিক পুরুষের যেমন একটা পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রেক্ষাপট ছিল, রামকৃষ্ণ ঠিক তার বিপরীতে ছিলেন। বাংলায় গ্রাম্যজীবন ও শিক্ষা-দীক্ষা-পূজা-অর্চনা ইত্যাদির প্রেক্ষাপটেই রামকৃষ্ণ তাঁর আধ্যাত্মিক পরিণতির দিকে অগ্রসর হয়েছিলেন। অতি সহজ সরল গ্রাম্য ভাষায় তিনি তাঁর ভক্তদেরকে আধ্যাত্মিক শিক্ষা দিয়েছিলেন। দেবেন্দ্রনাথ ও কেশবচন্দ্ৰ যেমন তাঁদের ব্রাহ্ম সমাজে আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে ভারতীয় আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে পাশ্চাত্য শিক্ষাদীক্ষার একটা সমন্বয় ঘটিয়েছিলেন, রামকৃষ্ণের ক্ষেত্রে সেটা সম্পূর্ণতঃই ভারতীয় ঐতিহ্যগত ছিল, এবং পরিণামে হিন্দু পুনরুত্থানবাদী হয়ে উঠেছিল। রামকৃষ্ণের শ্রেষ্ঠতম শিষ্য ‘স্বামী বিবেকানন্দের’ ভাষায় – “আর্য জাতির প্রকৃত ধর্ম কি, এবং সতত বিবাদমান আপাত-প্রতীয়মান বহুধা বিভক্ত সর্বথা-প্রতিযোগী, আচার সঙ্কুল সম্প্রদায়ে সমাচ্ছন্ন, স্বদেশীয় ভ্রান্তিস্থান ও বিদেশীয় ঘৃণাস্পদ হিন্দুধর্ম নামক যুগ যুগান্তরব্যাপী বিখণ্ডিত ও দেশ-কালযোগে ইতঃস্ততঃ বিক্ষিপ্ত ধর্মখণ্ড সমষ্টির মধ্যে যথার্থ একতা কোথায় – এবং কালবেশে নষ্ট এই সনাতন ধর্মের সার্বলৌকিক, সার্বকালিক ও সার্বদেশিক স্বরূপ স্বীয় জীবনে নিহিত করিয়া, লোকসমক্ষে সনাতন ধর্মের জীবন্ত উদাহরণ স্বরূপ আপনাকে প্রদর্শন করিতে লোকহিতের জন্য শ্রীভগবান রামকৃষ্ণ অবতীর্ণ হইয়াছেন। … নবযুগ ধর্ম সমগ্র জগতের বিশেষতঃ ভারতবর্ষের কল্যাণের বিচার এবং হে নবযুগ ধর্ম প্রবর্তক শ্রীভগবান পূর্বগ শ্রীযুগধর্ম প্রবর্তকদিগের পুনঃ সংস্কৃত প্রকাশ। হে মানব, ইহা বিশ্বাস কর ও ধারণ কর।” তৃতীয় তত্ত্বের প্রবক্তারা বলে যে, শ্রীরামকৃষ্ণ সম্পর্কে স্বামী বিবেকানন্দের উক্ত বক্তব্যের পরে আর কোন ব্যাখ্যার প্রয়োজনীয়তা থাকতে পারে না। নিঃসন্দেহেই রামকৃষ্ণের আবির্ভাবকে তিনি হিন্দু পুনরুভ্যুত্থানবাদী দৃষ্টিতেই দেখেছিলেন, এবং সেই ভাবেই তাঁর ভক্তি শ্রদ্ধা প্লাবিত হয়েছিল। ঐ দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেকানন্দের উক্ত বিশ্লেষণ সম্পূর্ণ সঠিক ছিল। রামকৃষ্ণের সমগ্র জীবন ও উপদেশাবলী খুব সাধারণ, সরল এবং গ্রাম্য পদ্ধতিতে হিন্দু পুনরুভ্যুত্থানবাদের লক্ষ্যেই পরিচালিত হয়েছিল।

গবেষক সুনীতিরঞ্জন রায়চৌধুরী তাঁর গ্রন্থে বহু তথ্যের সমাবেশে ঊনিশ শতকের হিন্দু পুনরভ্যুত্থান আন্দোলনের নায়কদের কর্মপ্রয়াসকে লিপিবদ্ধ করেছিলেন। ওই আন্দোলনের বিশেষ নেতৃত্ব প্রসঙ্গে তিনি ‘শশধর তর্কচূড়ামণি’ (১৮৫১-১৯২৮), ‘কৃষ্ণপ্রসন্ন সেন’ (১৮৮৯-১৯০২), ‘চন্দ্ৰনাথ বসু’ (১৮৪৪-১৯১০), ‘অক্ষয় চন্দ্র সরকার’ (১৮৪০-১৯১৭), ‘ইন্দ্ৰনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়’ (১৮৪৯-১৯১১) ও ‘যোগেশ চন্দ্র বসু’র (১৮৫৪-১৯০৫) নামোল্লেখ, এবং তাঁদের কর্মধারার বিস্তৃত বিবরণ উপস্থাপন করেছিলেন। তাঁর গবেষণার বিস্তৃত বিশ্লেষণী ধারা থেকে হিন্দু পুনরভ্যুত্থানবাদীদের তিনটি মুখ্য বৈশিষ্ট্যকে শনাক্ত করা যেতে পারে। প্রথমতঃ, অহিন্দুদের প্রতি তাঁদের বিরূপ মনোভাব (শশধর তর্কচূড়ামণি খ্রিস্টান বিরোধী এবং অক্ষয়চন্দ্র সরকার ব্রাহ্ম প্রতিরোধী ছিলেন); দ্বিতীয়তঃ, প্রাচীন আচার ও কুসংস্কারকে আদর্শ হিসাবে গ্রহণের প্রবণতা (কৃষ্ণপ্রসন্ন সেন ও শশধর তর্কচূড়ামণি কর্তৃক হিন্দু আচার সর্বস্বতার ভ্রান্ত বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেওয়ার প্রবণতা), এবং তৃতীয়তঃ, প্রগতিবাদী চিন্তা চেতনার বিরোধিতা (কৃষ্ণপ্রসন্ন সেন কর্তৃক সহবাস সম্মতি আইনের বিরোধিতা, চন্দ্রনাথ বসু কর্তৃক খাদ্যাখাদ্যের বিচার, জাতিভেদ ও বর্ণভেদের সমর্থন, ইন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় কর্তৃক নারী স্বাধীনতার ব্যঙ্গ করা; এবং যোগেশ চন্দ্র বসুর বিধবা বিবাহের বিরুদ্ধাচারণ)।

আগেই বলা হয়েছে যে, ঊনিশ শতকের হিন্দু পুনরভ্যুত্থানবাদীদের চরিত্রের অন্যতম লক্ষণ ছিল অহিন্দু অসহনীয়তা। অথচ রামকৃষ্ণ ছিলেন ঐ চেতনার পরিপন্থী ছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ জীবনী পাঠক-পাঠিকা মাত্রেই অবগত আছেন যে, তিনি একাধিক ধর্মের অনুশীলনে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন, এবং বিভিন্ন ধর্মসম্প্রদায়ের ব্যক্তিদের সঙ্গে তাঁর নিবিড় সখ্যও অব্যাহত ছিল। ১৮৬৭ সালে তিনি ইসলাম ধর্ম সাধনা করবার জন্য ‘ওয়াজেদ আলি খাঁ’র কাছ থেকে দীক্ষা নিয়েছিলেন। ওই সময়ে তিনি, দক্ষিণেশ্বরের গাজিপীরের তলায় ত্রিসন্ধ্যা নামাজ পাঠ করেছিলেন। তখন তিনি প্রায়ই মোল্লাপাড়ার (দক্ষিণেশ্বর) মসজিদে নামাজ পাঠের সময়ে উপস্থিত থাকতেন। এছাড়া ‘ফকির ওস্তাগরের’ কাছে তিনি দীর্ঘদিন ধরে কোরান পাঠ নিয়েছিলেন। তাঁর কাছে যেমন ‘ডাঃ ওয়াজিজের’ মত শিক্ষিত মুসলমানও আসতেন, তেমনি একাধিক ব্যবসায়ী ও শ্রমজীবী মুসলমানও (শেখ আবদুল শোভান, যোছন মোল্লা, খাতির মিস্ত্রি প্রমুখ) তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিলেন। কেবলমাত্র ইসলাম প্রতিনিধিরাই নন, একাধিক শিখ প্রতিনিধির সঙ্গেও রামকৃষ্ণের নিবিড় সংযোগ তাঁর বিভিন্ন জীবনীগ্রন্থে বিবৃত করা হয়েছে। সমকালে দক্ষিণেশ্বরের সরকারি বারুদগোলার পাহারায় শিখ সৈন্যদের যে পল্টন ছিল, সেই শিখ ব্যক্তিদের সঙ্গে রামকৃষ্ণের প্রত্যহ সংযোগ ছিল; এবং সেই সূত্র ধরেই ব্যারাকপুর ও দমদম ক্যান্টনমেন্টের ব্যারাকের শিখ সৈন্যরা তাঁদের কাজের অবসরে রামকৃষ্ণের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিলেন। হাবিলদার ‘কুঁয়োর সিং’-এর সঙ্গে রামকৃষ্ণের যোগাযোগের বিস্তৃত সংবাদ পাওয়া যায়। তাঁদের কাছেই রামকৃষ্ণ ‘গ্রন্থ সাহেবের’ পাঠ নিয়েছিলেন। রামকৃষ্ণ জীবনীগ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ১৮৬৪ সালে তিনি শিখ ধর্মেও দীক্ষা নিয়েছিলেন। বৌদ্ধধর্মের প্রতিও তাঁর যথেষ্ট অনুরাগ ছিল। এমনকি খ্রিস্টানদের প্রতিও তাঁর স্বভাবজাত প্রীতি ছিল। তিনি সেই ধর্মানুশীলনও করেছিলেন। শিবনাথ শাস্ত্রীর সঙ্গে ‘পাদ্রী যোশেফ কুক’ তাঁর সন্দর্শনে এলে তিনি তাঁকে সসম্ভ্রমে প্রণাম জানিয়েছিলেন। তদানীন্তন প্রেসিডেন্সী কলেজের অধ্যক্ষ ‘এইচ. সি. টনি’ও নিজের লেখায় রামকৃষ্ণ প্রসঙ্গে গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেছিলেন। এই সমস্ত ঘটনা নিঃসন্দেহে প্রমাণ করে দেয় যে, রামকৃষ্ণের সঙ্গে সকল ধর্ম সম্প্রদায়েরই গভীর সম্প্রীতি ছিল। মুসলমানরা রামকৃষ্ণকে তাঁদের ‘পীর’ বলে ভাবতেন। শিখরা সকলের সামনেই তাঁকে ‘তুমিই নানক’ বলে সম্বোধন করতেন। সমকালীন ব্রাহ্ম সমাজের স্তম্ভ দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কেশবচন্দ্র সেন ও শিবনাথ শাস্ত্রী প্রমুখ সকলের সঙ্গেই রামকৃষ্ণের আত্মিক সম্পর্ক ছিল। এই পটভূমিকায় প্রশ্ন তোলা যেতে পারে যে, শ্রীরামকৃষ্ণ যদি সত্যিই হিন্দু পুনরভ্যুত্থান আন্দোলনের নায়ক ছিলেন, তাহলে অহিন্দু ব্যক্তিবর্গ কিভাবে তাঁর কাছে নৈকট্য ও নিরপত্তা পেয়েছিলেন? হিন্দু পুনরভ্যুত্থানবাদীদের দ্বিতীয় প্রকৃতি, যা কুসংস্কারকে আঁকড়ে ধরে রাখতে চেয়েছিল, শ্রীরামকৃষ্ণ সেখানেও প্রতিবাদী ছিলেন। ব্রাহ্মণ বংশে জন্মগ্রহণ করে জীবনের প্রথম পর্বে দেবীপূজায় লিপ্ত থেকেও তিনি ব্রাহ্মণের বর্ণচিহ্ন উপবীত বর্জন করেছিলেন। লোকাচার, জাতিভেদ, খাদ্যাখাদ্যের বিচার করেননি; মেথরকে আলিঙ্গন করেছিলেন। আচার-সর্বস্ব ভক্তকে বলেছিলেন, “শুচিবাই ছেড়ে দাও। যাঁদের শুচিবাই, তাঁদের জ্ঞান হয় না।” হিন্দু পুনরভ্যুত্থানবাদীরা যখন আচারতন্ত্রকে জোরালো ভাষায় সমর্থন ঘোষণা করেছিলেন, রামকৃষ্ণ তখন বলেছিলেন যে, শাস্ত্রজ্ঞান, আচার-অনুষ্ঠান, যাগযজ্ঞ, কৃচ্ছ্রসাধন, জপতপ কোনটাই অপরিহার্য নয়। মনই আসল – মানুষ মনেতেই মুক্ত, মনেতেই বদ্ধ। প্রসঙ্গতঃ নিজের জনৈক একজন ভক্তকে তিনি বলেছিলেন, “কোশাকুশি ফেলে দাও।” শশধর তর্কচূড়ামণি যখন সবকিছু কুসংস্কারের পিছনে ‘বেদে আছে’ বলে বিশেষণ যোগ করেছিলেন, তখন রামকৃষ্ণ তাঁকে বলেছিলেন, “কলিতে বেদ মত চলে না।” তিনি যেমন প্রতিক্রিয়াশীলতার প্রতিরোধ করেছিলেন, তেমনি প্রগতিবাদী চেতনার পৃষ্ঠপোষকতাও করেছিলেন, এবং সেই চেতনায় তাঁর পার্ষদবর্গকে উদ্বুদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। তাঁর বক্তব্যে ভক্তিরসের প্রাধান্য থাকলেও যুক্তিনিষ্ঠা কিন্তু কোন অংশেই কম কিছু ছিল না। তিনি বলতেন, “ভক্ত হবি তো বোকা হবি কেন?” তিনি আরো বলেছিলেন, “শুধু মেনে লওয়া কপটতা!” তাঁর বিশেষ শিক্ষা নির্দেশ ছিল – “ভদ্রতার নামে কাপুরুষ হবে না। সর্বভূতে ঈশ্বর দর্শন করলেও নপুংসক হবে না। কাম সম্পর্কে শুচিবাইগ্রস্ত হবে না।” তিনি যে নারী স্বাধীনতার পূর্ণ সমর্থক ছিলেন, সেটা তাঁর জীবনী পাঠক-পাঠিকা মাত্রেই অবগত রয়েছেন। তিনি যেমন তাঁর স্ত্রী ‘সারদাদেবী’কে ভক্তদের ঘরে যাতায়াতের নির্দেশ দিয়েছিলেন, তেমনি ভক্তা ‘গৌরীদাসী’কে মহিলাদের শিক্ষা দেওয়ার জন্য একটি বিদ্যালয় খোলবার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনি চাইতেন যে, তাঁর পার্ষদেরা ইংরাজীতে কথাবার্তা বলুন। সমকালীন বিজ্ঞান আন্দোলনের পথিকৃৎ ‘মহেন্দ্রলাল সরকারের’ ‘বিজ্ঞান সভা’ (Science Association) সম্পর্কে তাঁর বিশেষ কৌতূহল ছিল। নিজের বিশাল ভক্তমণ্ডলীর মধ্যে তিনি তাঁর পার্ষদ হিসাবে যাঁদের চিহ্নিত করেছিলেন, তাঁরা প্রায় সকলেই কিন্তু পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন। সর্বোপরি তাঁর আচার-আচরণে বিজ্ঞানমনস্কতার লক্ষণ প্রতি পদে পদে প্ৰকাশ পেয়েছিল। এরকম বহু নমুনাই তাঁর প্রগতিবাদী চেতনার দ্যোতক হিসেবে উপস্থাপন করা যেতে পারে। অতঃপর রামকৃষ্ণের ‘কালী সাধনা ও হিন্দু জাগরণ’ সরলীকরণ প্রবণতা প্রসঙ্গে নজর দেওয়া যাক। রামকৃষ্ণ ধর্মীয় পুরুষ ছিলেন। ধর্মকে তিনি একটা সামাজিক শর্ত হিসাবেই দেখেছিলেন। তিনি নিজে একাধিক ধর্ম অনুশীলন করেছিলেন, এবং সকল ধর্মের প্রকৃত উদ্দেশ্য যে একই, সেই প্রত্যয় দ্বিধাহীন কণ্ঠে সবাইকে জানিয়েছিলেন। কিন্তু তবুও বহুল প্রচারে তিনি একজন কালীপূজক রূপেই চিহ্নিত হয়ে রয়েছেন। এটাকে ইতিহাসের অপব্যাখ্যা ছাড়া অন্য কিছু বলা যায় না। সকলেই জানেন যে, – “যত মত তত পথ” – রামকৃষ্ণেরই সারস্বত বাণী। কিন্তু তবুও তাঁকে একক ধর্মের নিগঢ়ে আটকে রাখবার দূরভিসন্ধির কারণ বুঝতে পারা যায় না। রামকৃষ্ণ ১৮৫৩ সালে কলকাতায় এসেছিলেন। ১৮৫৫ সাল থেকে ১৮৮৬ সাল পর্যন্ত তিনি দক্ষিণেশ্বরে অবস্থান করেছিলেন। দক্ষিণেশ্বর তথা কলকাতায় তাঁর ৩১ বছর ধরে অবস্থানের মধ্যে মাত্র তিন বছর (১৮৫৬-৫৮ সাল) তিনি কালীপূজক পদে ব্রতী ছিলেন। তারপর তাঁকে আর পূজকরূপে দেখা যায় নি। সেই জায়গায় পর্যায়ক্রমে তাঁর ভাই ‘রামতারক’, তাঁর ভাইপো ‘রামঅক্ষয়’ ও ‘রামলাল’ হাজির হয়েছিলেন। এর পরবর্তী কালপর্বে তিনি বিভিন্ন ধর্মসাধনায় ও বিবিধ লোকশিক্ষার কাজে ব্যাপৃত ছিলেন। এহেন কর্মবিন্যাসে যুক্ত রামকৃষ্ণকে কিভাবে শুধু একজন কালীপূজক রূপে চিহ্নিত করা সঙ্গত? এটা যেমন সত্যের অপলাপ, তেমনি ইতিহাস বিকৃতিও বটে। এই প্রসঙ্গে রামকৃষ্ণের অন্যতম সমালোচক, বৈদিক রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ডাইরেক্টর ‘শৈলেন্দ্রনারায়ণ ঘোষাল’ গভীর প্রত্যয়ের সঙ্গে জানিয়েছিলেন, “রামকৃষ্ণ কালীকিঙ্কর ছিলেন না। রামকৃষ্ণের সিদ্ধিলাভ প্রস্তরময়ী কালীমূর্তি পূজা করে নয়। তা এসেছিল তাঁর আকুতি, সত্যনিষ্ঠা ও ধ্যান তন্ময়তায়।” রামকৃষ্ণ কণ্ঠে প্রায় উচ্চারিত ‘মা’ শব্দটি কোন মূর্তির আঙ্গিক ছিল না, সেটা ‘উন্নত চেতনার’ প্রতীক ছিল। অতীতে রামকৃষ্ণ মিশনের একাধিক সন্ন্যাসীও এই একই অভিমত প্রকাশ করেছিলেন। রামকৃষ্ণ বলতেন, ব্রহ্ম ও শক্তি অভেদ। যেই ‘মা’ – সেই-ই ‘ব্ৰহ্ম’। গবেষক-সন্ন্যাসী ‘স্বামী সোমেশ্বরানন্দ’ রামকৃষ্ণের ‘ঈশ্বর’ ও ‘মা কালী’ প্রসঙ্গে বিশেষ বিশ্লেষণী ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছিলেন, “এ বিশ্বে সবচেয়ে মহান সম্পদ মানুষের চেতনা। বিশ্বের সবচেয়ে প্রগতিশীল শক্তিও এটিই। বিভিন্ন দেশ-কালে এই মানবচেতনা বিভিন্ন রূপে আত্মপ্রকাশ করছে নানান ক্রিয়াকাণ্ডে। … পূর্ণতা প্রাপ্তির আকুতিতেই মানবচেতনার শুরু। চেতনার পূর্ণবিকাশে এই পূর্ণতাকেই শ্রীরামকৃষ্ণ ‘ঈশ্বর’ বলে অভিহিত করেছেন। … ধর্মের মাধ্যমে মানুষের যে মৌল আকুতি সুপ্রাচীন যুগে দেখা দিয়েছিল তার প্রকাশ ঘটেছিল পিতৃ-উপাসনা ও প্রকৃতি উপাসনার মধ্যে দিয়ে। পরবর্তীযুগে কখনো পুরোহিত কখনও রাজা ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসাবে গণ্য হলেন। ভারত-মিশর-গ্রীস-ব্যাবিলনের ইতিহাস আমাদের এই তথ্যই দেয়। এর পরের যুগে ভারতীয় লোক-চেতনায় নতুন চিন্তা দেখা যায়। তখন মানুষ আর ঈশ্বর প্রতিনিধি নয়, ঈশ্বরের সমতুল্য হতে চাইছে। … আবার কখনো মানুষ ঈশ্বরকে অস্বীকার করে নিজেই ঈশ্বর হতে চাইল, ঈশ্বরের স্থানে বসার প্রয়াস করল। নীৎসের অতিমানব এই মতেরই প্রবক্তা। কমিউনিস্ট সম্প্রদায়ে মার্কস, লেনিন, মাও সে তুং, হো-চি-মিনও একই পথের পথিক। গত দুই শতকের ভারতে দেখা দিল নতুন চিন্তা। বহু মনীষী ও সমাজনেতা আবির্ভূত হয়ে জাতিকে পথ দেখাবার চেষ্টা করলেন। এঁদের অনেকে যেমন সরাসরি ঈশ্বর-বিশ্বাসকে পাথেয় করে এগোতে চাইলেন, অনেকে আবার ঈশ্বরের স্থানে বসাতে চাইলেন অন্য কিছুকে। ‘ঈশ্বরের স্থানে’ অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ স্থানে, সার্ত্রের ভাষায় যা ‘পরম’ তার স্থানে। অক্ষয়কুমার দত্ত বসালেন বিজ্ঞানকে, ডিরোজিও যুক্তিকে, কবি ঈশ্বর গুপ্ত মাতৃভাষাকে, রাজেন্দ্রলাল মিত্র স্বজাতির ইতিহাসকে। পাশ্চাত্যেও দেখি একই ধারা। ঈশ্বরের স্থানে দস্তয়েভস্কি বসাতে চাইলেন ন্যায়কে, রুশো জনসাধারণের ইচ্ছাকে, হেগেল রাষ্ট্রকে, আর মার্কস সর্বহারা শ্রেণীকে। পৃথিবীর ইতিহাসে মানুষের যে বিভিন্ন চিন্তাধারা দেখা গেছে তা এভাবেই মূলত ঈশ্বরকেন্দ্রিক। মানুষ কখনো ঈশ্বরের সমতুল্য হতে চেয়েছে, কখনো ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী, কখনো বা নিজেই ঈশ্বর হতে চেয়েছে, কখনো আবার ন্যায়-রাষ্ট্র-শ্রেণী-ভাষা-স্বদেশ-বিজ্ঞান ইত্যাদির কোন একটিকে ঈশ্বরের স্থানে বসিয়েছে। মানুষ এটা করতে চাইছে কারণ এটাই তাঁর মৌল প্রবৃত্তি যাকে আমরা মানবচেতনা বলে আগে উল্লেখ করেছি, সার্ত্রে যাকে বলেছেন ‘পরম’। … শ্রীরামকৃষ্ণের পূজা পদ্ধতির মধ্যেও এই সত্যের প্রমাণ পাই। সাধক অবস্থায কালী প্রতিমার পায়ে ফুল দিতে গিয়ে বারবার ফুল দিয়েছেন নিজের মাথায়। সমস্ত সাধনার শেষে ষোড়শী পুজোয় সাধনার ফল আর জপের মালা অর্পণ করলেন মানুষেরই পায়ে। আবার পৃথিবীর মঞ্চ থেকে বিদায় নেবার আগে কাশীপুরের শেষ শয্যায় যে ফটোতে তিনি শেষবারের মত ফুল দিলেন সেই ফটোটিও ছিল মানুষের। এই তিনটি ঘটনা তাৎপর্যময়। দেবতার ফুল বারবার গিয়ে পড়েছে মানুষের কাছে। সাধক অবস্থায় যে শ্রীরামকৃষ্ণ ঈশ্বরের কাছে কেঁদে কেঁদে বলেছিলেন – ‘মা, আরেকটা দিন চলে গেল, দেখা দিলি না!’ সাধনার শেষে তিনিই কেঁদেছেন মানুষের জন্য – ‘ওরে, তোরা কে কোথায আছিস, আয়।’ শ্রীরামকৃষ্ণ ঈশ্বরকে মানুষের মধ্যেই খুঁজে পেয়েছিলেন।”
উপরের আলোচনা থেকে দেখা গেল যে, হিন্দু পুনরভ্যুত্থানবাদীদের ক্রিয়াকলাপের সঙ্গে রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের ক্রিয়া পারম্পর্য সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল। তাই ঊনিশ শতকের ইতিহাসে ধর্ম সাংস্কৃতিক আন্দোলনের চিহ্নিত ব্যক্তিত্ব রামকৃষ্ণকে বিশ্লেষণের জন্য স্বতন্ত্র শিরোনামের প্রয়োজন রয়েছে। বস্তুতঃ ঊনিশ শতকের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের দুটি ধারার পরিবর্তে তিনটি ধারা দেখতে পাওয়া যায়। সেগুলির মধ্যে একটি ধারা পাশ্চাত্য অনুসারী (মুখ্যতঃ ইয়ং বেঙ্গল গোষ্ঠী), দ্বিতীয় ধারাটি প্রাচ্য অনুসারী (মুখ্যতঃ হিন্দু পুনরভ্যুত্থানবাদীরা), এবং তৃতীয় ধারাটি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সম্মিলনকামী, অর্থাৎ শ্রীরামকৃষ্ণের প্রক্রিয়াটি যেমন আধুনিক তেমনি ভারতীয়। সেই কারণে রামকৃষ্ণকে তৃতীয় ধারার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করাই বিধেয়। রামকৃষ্ণ চরিত্রের স্বাতন্ত্র্য সকল ঐতিহাসিকই একবাক্যে স্বীকার করে নিয়েছেন। ঊনিশ শতকের ইতিহাসে হিন্দু পুনরভ্যুত্থানের প্রগতিবাদী চেতনাসমূহ ‘নব্য হিন্দু আন্দোলন’ শিরোনামে উপস্থিত হওয়ার নেপথ্য কারণ রামকৃষ্ণই। রামকৃষ্ণের ধর্ম ও আধুনিকতার যৌথচর্চার জন্য গবেষকদেরকে ঐ জাতীয় শিরোনাম ব্যবহার করতে হয়েছে। ঊনিশ শতকের ধর্ম সংস্কৃতির আন্দোলনকে দ্বিমুখী ধারায় ব্যাখ্যা করতে অনেক ঐতিহাসিকই দ্বিধাগ্রস্ত। এই প্রসঙ্গে প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ‘নরহরি কবিরাজের’ মন্তব্যটি উপস্থাপন করলে সিদ্ধান্তে আসা সহজতর হবে। তিনি বলেছিলেন, “বাংলার জাগরণের প্রথম পর্বটি পাশ্চাত্যকরণের যুগ, এবং দ্বিতীয় পর্বটি প্রাচ্যকরণের যুগ – এভাবে দেখা উচিত নয়। প্রথম পর্বে বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল পাশ্চাত্য সভ্যতার সুফলগুলিকে আয়ত্ত করার – আধুনিকতাকে গ্রহণ করার সুতীব্র আগ্রহ। প্রথম পর্বে কেউ কেউ (বিশেষ করে ইয়ং বেঙ্গল) ইংরেজিয়ানা ও আধুনিকতা – এই দুটিকে সম-অর্থবাচক বলে মনে করতেন। তবে সেই পর্বের শ্রেষ্ঠ প্রতিনিধিরা – যেমন, রামমোহন, বিদ্যাসাগর, অক্ষয়কুমার পাশ্চাত্যকরণ ও আধুনিকতা – এই দুইয়ের পার্থক্য সম্পর্কে বিশেষ সজাগ ছিলেন, এবং তাঁরা দেশকে পাশ্চাত্যকরণের দিকে নয়, আধুনিকতার দিকে নিয়ে যেতে বিশেষ সচেষ্ট হন। … আবার যাঁরা মনে করেন – ভারতীয় ঐতিহ্যের মধ্যেই সৃজনশীলতার মূল উপাদানগুলি লুক্কায়িত ছিল, এবং বাইরে থেকে আনা এক-আধটু সংশোধনই যথেষ্ট ছিল, তাঁরা ভারতীয় সামন্ততান্ত্রিক অচলায়তনটি জীবনের স্রোতধারাকে যে সম্পূর্ণরূপে রুদ্ধ করে দিয়েছিল – এটি বিস্মৃত হন। তাঁরা ভারতীয় ঐতিহ্যকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে যুগধর্মের গুরুত্বটি খুবই ছোট করে দেখেন। মনে রাখতে হবে বঙ্কিম-বিবেকানন্দ দেশের ঐতিহ্য সন্ধানে বিশেষ আগ্রহ দেখিয়েছেন, কিন্তু আধুনিকতাকে বাদ দিয়ে নয়। … আধুনিকতা ও ঐতিহ্যের সম্পর্কটি কি – এই প্রশ্ন অবশ্যই উঠতে পারে। কি রামমোহন, কি ইয়ং বেঙ্গল, কি বিদ্যাসাগর, কি বঙ্কিমচন্দ্র, কি বিবেকানন্দ, কি রবীন্দ্রনাথ – সকলের কাছেই প্রশ্নটি উত্থাপিত হয়েছিল। এইভাবে – আধুনিকীকরণের সঙ্গে পরিচয় ছাড়া দেশবাসীর পক্ষে ইউরোপীয়দের সমকক্ষ হওয়া ও দেশের জাগরণের পথ প্রশস্ত করার আর কোন উপায় নেই। আবার দেশের ঐতিহ্যের সঙ্গে আধুনিকীকরণের প্রক্রিয়াটিকে সংযুক্ত করতে না পারলে, এই প্রক্রিয়াটি দেশবাসীর চেতনার প্রবেশ করবে না, এবং এটি বন্ধ্যা হয়ে রইবে। রামমোহন ব্রাহ্ম আন্দোলনের মাধ্যমে এই কাজটি সুসম্পন্ন করতে চাইলেন। এমনকি ইয়ং বেঙ্গল – যাঁদের চোখে পাশ্চাত্যকরণ ও আধুনিকীকরণ – এই দুটি প্রক্রিয়া প্রায় একাকার হয়ে গিয়েছিল – তাঁরা বলতে বাধ্য হলেন যে ইউরোপীয় চিন্তা আমাদের গ্রহণ করতে হবে, তবে তাকে প্রকাশ করতে হবে ভারতীয় ভঙ্গীতে। বিদ্যাসাগর চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল তাঁর আধুনিকতা, যদিও জাতীয় ঐতিহ্যের বলিষ্ঠ দিকটির প্রতি দৃঢ়মূল থেকেই তিনি যুগধর্মকে গ্রহণ করতে চেয়েছিলেন। … বঙ্কিম-বিবেকানন্দ হিন্দু ঐতিহ্যের পুনরুজ্জীবনের পক্ষপাতী হলেও সাধারণভাবে আধুনিকতার বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করেননি। এঁদের চিন্তায় সমকালীন ইউরোপের প্রগতিশীল চিন্তাধারার চূড়ান্ত প্রভাব লক্ষ্য করার বিষয়। … আধুনিকীকরণ ও ঐতিহ্য সন্ধান পরস্পর সংযুক্ত। আধুনিকীকরণ যদি দেশের মাটির সঙ্গে সম্পর্ক শূন্য হয় তাহলে তা নকলনবীশীর নামান্তর হয়ে উঠতে বাধ্য। কাজেই ঐতিহ্য যাচাই করে নেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। রামমোহন, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র রবীন্দ্রনাথ – এঁরা সকলেই নিজের মত করে এই যাচাই করার কাজে হাত দেন। অবশ্য, কার চেষ্টা কতটা সার্থক হয়ে উঠেছে কালের বিচারে তার চূড়ান্ত হিসাব মিলবে। যুগধর্মের আলোকে ঐতিহ্য সন্ধানের কাজে লেনিনের যে লেখাগুলি মার্কসবাদীদের কাছে দিক নির্দেশক হতে পারে তা হলো ‘The Heritage of Renounce’, ‘In Memory of Herzen, Tolstoy’, ‘The Mirror of Revolution’, ‘The National Pride of the Great Russians’ প্রভৃতি। …” শ্রীরামকৃষ্ণ ধর্মীয় পরিভাষায় কথা বললেও, ভারতীয় ঐতিহ্যের সারস্বত বাণীকেই প্রচার ও প্রসার ঘটাতে প্রয়াসী হয়েছিলেন। রামকৃষ্ণের ধর্মচেতনার স্বাতন্ত্র্য আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। ধর্মকে তিনি ‘সোশ্যাল কমিটমেন্টের’ সামিল করতে চেয়েছিলেন। ধর্মের ভ্রান্তি দূর করে তিনি সেটাকে সামাজিকীকরণের বিশেষ শর্ত হিসাবে চিহ্নিত করতে চেয়েছিলেন। ধর্মের ফোরামে দাঁড়িয়েই তিনি ধর্মতন্ত্রকে চূড়ান্ত আঘাত হেনেছিলেন। তাই তাঁর শিক্ষাকে জনগণ সহৃদয়তা দিয়ে গ্রহণ করেছিল। শ্রীরামকৃষ্ণের ধর্মীয় সার্বভৌমিকতার কথা কিন্তু স্বামী বিবেকানন্দ সোচ্চার কণ্ঠে প্রতিনিয়তই ঘোষণা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “শ্রীরামকৃষ্ণ যা শিখিয়ে গেছেন তা-ই হচ্ছে ঠিক ঠিক ধর্ম। তাকে হিন্দুরা হিন্দুধর্ম বলে। অন্যেরা তাঁদের রুচিমত নাম দেয়।” শ্রীরামকৃষ্ণের ধর্মচেতনা যে ওই সময়ের মৌলবাদী ধর্ম চেতনা থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ছিল, ঐতিহাসিক গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের লেখনীতেও সেটা স্পষ্টভাবে ধরা দে। তিনি বলেছিলেন, “যে ধর্মসংস্কারে রামকৃষ্ণ পরমহংসে ব্রতী হন সেখানে ধনী-নির্ধন, উচ্চ-নীচ, সবাই সমান; সবাই মায়ের সন্তান। তখনকার সমাজের হাওয়ার সঙ্গে এই ধর্মীয় সাম্যবাদ সহজেই সঙ্গতি খুঁজে পেল। জাতপাতের ঊর্ধ্বে উঠে সমস্ত মানুষকে এক মায়ের আহ্বানে সামিল করে, রামকৃষ্ণ তখনকার সমাজে এক আলোড়ন সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন। এই ঐক্যবোধ সেদিনকার জাতীয় আন্দোলনের ছিল, এক পরম সম্পদ।” এহেন রামকৃষ্ণকে হিন্দু পুনবভ্যুত্থানবাদী হিসাবে চিহ্নিত করা অত্যন্ত অন্যায় বলেই মনে হয়। শ্রীরামকৃষ্ণ যেমন অন্ধ পাশ্চাত্য অনুসারী ছিলেন না, তেমনি অন্ধপ্রাচ্য অনুগামীও ছিলেন না; তিনি মধ্যপন্থা অবলম্বী – আধুনিক ও ভারতীয় ছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ চরিত্রের এই উজ্জ্বল বৈশিষ্ট্যটি কেউ বিস্মৃত না হলেই সমাজ ও ইতিহাসের মঙ্গল হবে।

(তথ্যসূত্র:
১- ভারতের মুক্তি সংগ্রামে চরমপন্থী পর্ব, অমলেশ ত্রিপাঠী।
২- Bengal Renaissance and other Essays, Sushovan Sarker.
৩- বাংলা প্রগতি সাহিত্যের আত্মসমালোচনা, মার্কসবাদী, রবীন্দ্র গুপ্ত।
৪- ঊনিশ শতকে নব্য হিন্দু আন্দোলনের কয়েকজন নায়ক, সুনীতিরঞ্জন রায়চৌধুরী।
৫- লোকজীবনে শ্রীরামকৃষ্ণ, স্বামী সোমেশ্বরানন্দ।
৬- স্বাধীনতার সংগ্রামে বাঙলা, নরহরি কবিরাজ।
৭- রুশ বিপ্লব ও বাংলার মুক্তি আন্দোলন, গৌতম চট্টোপাধ্যায়।
৮- Hinduism through the Ages, D. S. Sarma.
৯- সমসাময়িক দৃষ্টিতে শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস, ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও সজনীকান্ত দাস।
১০- শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ লীলাপ্রসঙ্গে, স্বামী সারদানন্দ।
১১- শ্রীরামকৃষ্ণ: নৈঃশব্দেব রূপ, ধনগোপাল মুখোপাধ্যায়।
১২- উদ্বোধন, শ্রীরামকৃষ্ণ শতবার্ষিকী সংখ্যা।
১৩- রামকৃষ্ণ জীবনী ও প্রসঙ্গ, স্বামী তেজসানন্দ।
১৪- রামকৃষ্ণ ভক্তিমালিকা, স্বামী গম্ভীরানন্দ।
১৫- আত্মচরিত, শিবনাথ শাস্ত্রী।
১৬- শ্রীরামকৃষ্ণ ও যুগধর্ম, স্বামী ভুতেশানন্দ।
১৭- রামকৃষ্ণ ও সমকালীন কামারপুকুর, তড়িৎ কুমার বন্দোপাধ্যায়।
১৮- শ্রীরামকৃষ্ণ দেব, শশীভূষণ ঘোষ।)

নাচতে নাচতে স্ট্রোক হয়ে যাচ্ছে, তবুও নাচ থামছে না! ডান্সিং প্লেগের ঘটনা কতখানি সত্যি?

প্লেগের নাম তো আমরা সবাই শুনেছি কিন্তু আপনারা কি ডান্সিং প্লেগের নাম শুনেছে? নামটি শুনতে অদ্ভুত লাগলেও সত্য ছিল এটি। এই রোগটি দেখা দিয়েছিল ১৫১৮ সালে স্ট্রাসবার্গ নামের একটি ছোট্ট শহরে। এই রোগের কারণে সেই সময় মৃত্যু হয়েছিল ৪০০ জনেরও বেশি মানুষের। কিন্তু কিভাবে উদ্ভব হয়েছিল এই রোগের? আর কি কি ছিল এই রোগের লক্ষণ?

প্রথম কার মধ্যে ডান্সিং প্লেগের উপশম দেখা দিয়েছিল?

১৫১৮ সালের জুলাই মাসে স্ট্রাসবার্গের (তখন পবিত্র রোমান সাম্রাজ্য, আজকের আধুনিক ফ্রান্স) একটি ব্যস্ত রাস্তায় হঠাৎ এক মহিলা উম্মাদের মতো নাচতে শুরু করেন। এই মহিলাটির নাম ছিল লেডি ট্রফিয়া (বা ফ্রাউ ট্রফিয়া)। যথারীতি এই মহিলাটির নাচ দেখে সেখানে ভিড় জমে যায় এবং দর্শকরা তার এই নাচ দেখে প্রশংসাসূচক হিসেবে হাত তালি দিয়েছিলেন।

সেই সময় কারোর পক্ষে এই নাচের পিছনে আসল কারণটা জানা সম্ভব ছিল না।

প্রথমে ব্যাপারটা স্বাভাবিক মনে হলেও পরে ব্যাপারটা স্বাভাবিক লাগেনি। কারণ লেডি ট্রফিয়ার এই নৃত্য ক্ষণিকের জন্য ছিলো না। টানা ৬ দিনের মতো উম্মাদের মতো নেচেছিলেন এই মহিলাটি। তিনি সন্ধ্যায় নাচ থামাতো আবার সকাল হলেই শুরু করতো তার উম্মাদ নৃত্য। এই এক সপ্তাহের মধ্যে তার সাথে এই নৃত্যে যোগ দিয়েছিলেন আরো চৌত্রিশ জন স্থানীয় লোক।

আরো পড়ুন- কলেজ ড্রপআউট ছিলেন। গ্যালিলিও গ্যালিলির অজানা কিছু তথ্য

সেই সময় এই বিষয়টি সম্পর্কে চিকিৎসকদেরও কোনোরকম কোনো ধারণা ছিল না। যার ফলে চিকিৎসকরা উল্টো পরামর্শ দিয়েছিল যে মানুষদের শরীরের জ্বর এসেছে এবং রক্ত গরম হয়ে গেছে, তাই তাদের আরো নাচলে এই অসুখ নিরাময় হবে।

চিকিৎসকদের দেওয়ায় এই পরামর্শটি সেই শহরের সিটি কাউন্সিল গ্রহণ করেছিল। এমনকি নৃত্যের জন্য একটি মঞ্চ তৈরি করা, নাচার জন্য মিউজিক হিসেবে ব্যান্ড পার্টির ও ব্যবস্থা করা এবং সঠিকভাবে নাচতে শেখার জন্য নৃত্য প্রশিক্ষক নিযোগ করার মতো ব্যবস্থা করা হয়েছিল।

আগস্টের শেষের দিকে, একটি আধুনিক দিনের কোনো কনসার্টের মতোই অবস্থা হয়ে গিয়েছিল রাস্তাটি। যেখানে অসংখ্য মানুষ নাচছে এবং সেই নাচ দেখে হাসছে হাজার হাজার মানুষ। এরপর নাচ দেখতে থাকা ওই মানুষজনও দলে দলে যোগ দিচ্ছে এই নাচে। সময় বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে মানুষজন অতিরিক্ত ক্লান্ত হয়ে পড়ছে যার ফলে স্ট্রোকে মৃত্যু বরণ করতে শুরু করে এই মানুষজনগুলি। কিছু কিছু স্থানে উল্লেখ রয়েছে যেখানে নাচতে নাচতে প্রতিদিন ১৫ জনের মৃত্যু হত। ১৫১৮ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অব্যাহত ছিল এই নৃত্যের ধারা।

ডান্সিং প্লেগের ঘটনা কতখানি সত্যি?

Time to Dance, A Time to Die: The Extraordinary Story of the Dancing Plague of 1518 (2008) ইতিহাসবিদ ‘জন ওয়ালার’ লেখা এই বইটিতে ব্যাখ্যা করেছেন এর কারণ। ঐতিহাসিক রেকর্ডগুলিতে (ভুক্তভোগীরা) নাচের বিষয়টিতে দ্ব্যর্থহীন। এই মানুষজনরা কেবল কাঁপছিল তবে সেটি খিঁচুনি ছিল না। তারা নৃত্য করেছিল তবে এমনভাবে তারা হাত ও পা নড়াচড়া করছিল তাতে মনে হচ্ছিল যেন তারা উদ্দেশ্যমূলকভাবে নাচছে।

সেই সময়কার রাস্তা, গলি এবং পাবলিক মার্কেটে মানুষদের নাচের বর্ণনা দিয়েছিলেন একজন জার্মান প্রত্যক্ষদর্শী ও পুরাতত্ত্ববিদ জোহান শিল্টার। তাদের বর্ণনা অনুযায়ী, ওই সমস্ত মানুষজন দিনরাত কিছু না খেয়ে নেচে যাচ্ছিল। এদের মধ্যে কেউ অজ্ঞান হয়ে হচ্ছে আবার কেউ মারা যাচ্ছে। এটি যেন এক মৃত্যুনৃত্য।

নাচের প্লেগ যে বাস্তব ছিল সেই নিয়ে কোনো সংশয় নেই।

কেনো এমন উন্মাদ নৃত্যের সৃষ্টি হয়েছিল?

বর্তমান দিনের বিশেষজ্ঞরা অনুমান করে যে এটি Ergot বিষক্রিয়া: Ergot হল একটি ছত্রাক যা রাই এবং সংশ্লিষ্ট গাছে জন্মায়। এতে থাকে সাইকোঅ্যাকটিভ নামক রাসায়নিক পদার্থ যা মারাত্মক হ্যালুসিনেশন এবং খিঁচুনি সৃষ্টি করতে পারে।

ওই সময় একটি সাধারণ খাদ্য আইটেম ছিল রাই রুটি। ১৫৫৮ সালে আবির্ভূত হওয়া প্লেগ নৃত্য রোগটি Ergot বিষক্রিয়ার কারণ সৃষ্টি হতে পারে। তবে জন ওয়ালার একটি বিজ্ঞান জার্নালে এই নিয়ে যুক্তি দেওয়ার পরে বাতিল করা দেওয়া হয়েছিল এই তত্ত্বটি। “এই তত্ত্বটি গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয় না, কারণ এটি সম্ভব নয় যে যারা এরগট দ্বারা বিষক্রিয়া করেছিল তাদের হতে পারে”।

গণ হিস্টিরিয়া: অনেক বিশেষজ্ঞদের মতে, নৃত্য প্লেগকে গণ হিস্টিরিয়ার ক্ষেত্রে যুক্তি দেন। গণ হিস্টিরিয়ার অর্থ হল জনসংখ্যার সংগ্রহ যা একই আচরণ প্রদর্শন করে, প্রায়শই উদ্ভট, অজানা বা ব্যাখ্যাতীত কারণে।

এই তত্ত্বকে সমর্থন করেন এডিনবার্গ ইউনিভার্সিটির সায়েন্স স্টাডিজ ইউনিটের লেকচারার ইভান ক্রোজিয়া। তিনি মনে করেন যে লেডি ট্রফিয়া (প্রথম নর্তকী) ইর্গট বিষের শিকার হয়েছিলেন। তার নাচের উন্মত্ততা প্রভাব ফেলেছিল গণ হিস্টিরিয়ার উপর। এরপর এতে যোগ দান করেছিল বাকিরা। উচ্চ মাত্রায় মানসিক চাপের পাশাপাশি প্রচুর জনসংখ্যার মধ্যে গণ হিস্টিরিয়া প্রাদুর্ভাব ঘটে।

জন ওয়ালারের তত্ত্ব অনুযায়ী, অনাহার, রোগ এবং স্ট্রাসবার্গের মানুষের কুসংস্কারপূর্ণ বিশ্বাস স্ট্রেস-সম্পর্কিত সাইকোসিসকে প্ররোচিত করতে পারে যা ১৫১৮ সালের ডান্সিং প্লেগের রূপ নিয়েছিল।

কলেজ ড্রপআউট ছিলেন। গ্যালিলিও গ্যালিলির অজানা কিছু তথ্য

বিজ্ঞান জগতে গ্যালিলিও গ্যালিলির নাম কে না জানা। তিনি ইতালির দার্শনিক তথা জ্যোতির্বিজ্ঞানী এবং গণিতবিদ হিসেবে খ্যাত। বিশেষ করে জ্যোতির্বিদ্যা এবং গতিবিজ্ঞানে অনস্বীকার্য অবদান রেখেছিলেন গ্যালিলিও গ্যালিলি। তবে অনেকেই এই বিজ্ঞানীর ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে অজানা। সেক্ষেত্রে এই প্রতিবেদনে আলোচনা করা হয়েছে বিজ্ঞানী গ্যালিলিও গ্যালিলির ১০টি অজানা তথ্য।

বিজ্ঞানীর জীবন সম্পর্কে শুরু করতে গেলে তার জন্ম সাল থেকে শুরু করাই ভালো। ১৫৬৪ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি ইতালির পিসায় শহরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন গ্যালিলিও গ্যালিলি। এরপরই শৈশব ও কিশোর বয়সে তিনি মেডিসিনের বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করেছিলেন। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার পর গণিত এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানের দিকে আকৃষ্ট হয়েছিলেন এই বিজ্ঞানী।

তাঁর আবিষ্কৃত একাধিক জিনিসের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল টেলিস্কোপ দিয়ে আবিষ্কার করা বস্তুটি। মূলত কোপারনিকাস সূর্যকেন্দ্রিক সিস্টেমের ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতার দিকে পরিচালিত করেছিল তার আবিষ্কার। সেই কারণে বিজ্ঞানীর মৃত্যুর পরেও তার অনস্বীকার্য আবিষ্কার প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের অনবদ্য ভূমিকা রেখেছিল এবং সে কারণেই তার নাম জগত শ্রেষ্ঠ হয়েছিল।

আরো পড়ুন- কলেজ ড্রপআউট ছিলেন। গ্যালিলিও গ্যালিলির অজানা কিছু তথ্য

I)নামের প্রথম ও শেষ নাম একই রকম:- ১৫ শতকের মাঝামাঝি সময় নাগাদ ইতালিতে নামের পাশে পদবি ব্যবহার করা ঐচ্ছিক ছিল। এমনকি অনেকে নিজের নাম পরিবর্তন করতেও পারতেন। বিশেষ করে আইনত সম্মতি ছিল। তাই গ্যালিও এবং গ্যালিলিও এই দুটি ছিল বিজ্ঞানের পরিবারের পদবি। তিনি পরবর্তীকালে এই দুটি পদবিকে যোগ করেই নিজের নাম রেখেছিলেন।

II)গ্যালিলিও একজন কলেজ ড্রপআউট ছিলেন:- সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলে ছিলেন গ্যালিলিও। পরিবারের সকলের শিক্ষিত হলেও আর্থিক দিক থেকে ছিলেন অসচ্ছল। তাই গ্যালিলিওর পিতা তার মাত্র ১৬ বছর বয়সে পিসা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করে দিয়েছিলেন চিকিৎসা বিদ্যায় পড়াশোনার জন্য। কিন্তু আর্থিক অবস্থার অবনতির কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঠিকমতো বেতন না দেওয়ার জন্য ১৫৮৫ সালে গ্যালিলিওকে বের করে দেওয়া হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্পর্ক ছিন্ন হলেও নিজের গণিতের প্রতি আকর্ষণকে কখনোই নষ্ট হতে দেননি গ্যালিলিও। টানা চার বছর নিজে থেকেই গণিতের চর্চা করে গিয়েছিলেন তিনি। পরবর্তীতে গণিত সম্পর্কে তার অগাধ জ্ঞান লোকসমাজে প্রচারিত হতেই পিসা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্যালিলিওকে ডাকা হয়েছিল শিক্ষকতা করার জন্য।

III)গ্যালিলিওর বিবাহ ছাড়াই ৩ জন সন্তান ছিল:- নিজের কৌশর বয়সে গ্যালিলিও মারিনা গাম্বা নামে এক মহিলার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পরেছিলেন। তাদের প্রেমের পরিণতি ছিল দুই কন্যা এবং এক পুত্র সন্তান। তবে সেই সময় গ্যালিলিও ছিল পণ্ডিত আর তখনকার দিনে মানা হতো পণ্ডিতরা বিবাহ সম্পর্ক থেকে দূরে থাকেন। এমনকি গ্যালিলিও মনে করতেন যে তিনি মারিনা গাম্বাকে বিয়ে করলে সেটা সমাজবিরোধী কাজ হবে। সেই কারণে আর্থিক দিক থেকে নিজের সন্তান এবং প্রেমিকার সমস্ত ভরণপোষণ সামলেও কোনদিন বিবাহ করেননি তিনি। যেহেতু মারিনাকে গ্যালিলিও বিবাহ করেনি তাই কন্যাদের বিবাহের সময় খুব সমস্যা হয়েছিল। সেই কারণে আর্সেট্রির সান ম্যাটিওতে একটি মঠ তৈরি জন্য নিজের কন্যাদের আলাদা করে জায়গা কিনে দিয়েছিলেন তিনি। আর গ্যালিলিওর কন্যারা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ না হয়ে সন্ন্যাসিনী হয়ে গিয়েছিল।

IV)তার কাজ চার্চের বিপরীতে ছিল:- গ্যালিলিও নিজের পড়াশোনাকে কাজে লাগিয়ে এটি উদ্ভাবন করেছিলেন যে পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে ঘোরে। তবে সেই যুগের ক্যাথলিক চার্চ গুলো এই বিষয়টাকে মানতে চাননি। সেই কারণে চার্চ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পড়েছিলেন গ্যালিলিও। চার্চ অনুযায়ী পৃথিবীর সৌরজগতের কেন্দ্র ছিল এমনটাই নাকি গ্রন্থে লেখা রয়েছে। সেক্ষেত্রে চার্চের বিরোধিতা করা মানে ধর্মের বিরোধিতা করা। ১৬১৬ সালে প্রথমবার গ্যালিলিওকে চার্চের পক্ষ থেকে সতর্ক করা হয়েছিল। এমনকি ১৬৩৩ সালে দ্বিতীয়বারের জন্য তাকে সতর্ক করা হয়েছিল। তবে নিজের সিদ্ধান্তেই অটল ছিলেন গ্যালিলিও। যার কারণে একবার গ্যালিলিওকে চার্চের সভা কক্ষে ডেকে কারারুদ্ধ করার শাস্তি দেওয়া হয়েছিল। তবে গ্যালিলিও নিজের কিছু প্রভাবশালী বন্ধুদের জন্য কারারুদ্ধ এবং দন্ড পাওয়া থেকে নিস্তার পেয়েছিলেন। তবে পরবর্তীতে গ্যালিলিওর বাণী সত্য প্রমাণিত হলে পরবর্তীকালে চার্চের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে গ্যালিলিওর কাছে ক্ষমা চাওয়া হয়েছিল। তবে গ্যালিলিও নিজের শেষ জীবনে চার্চের নির্দেশে ঘর বন্দি ভাবেই কাটিয়েছিলেন।

মহাদেবের মাথায় কিভাবে স্থান পেলো অর্ধচন্দ্র?

দেবাদিদেব মহাদেব যাকে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সংহারকর্তা বলা হয়। তাঁর পরনে থাকে বাঘের ছাল, হাতে থাকে ত্রিশূল ও ত্রিশূলে জড়ানো ডুমুর, ত্রিনয়ন, ও রুদ্রাক্ষ এবং মাথায় থাকে গঙ্গা ও অর্ধচন্দ্র। এইরকম বেশ ধারণ করার পিছনে কিছু পৌরাণিক কাহিনী প্রচলিত রয়েছে। আর এই সমস্ত পৌরাণিক কাহিনীগুলি মধ্যে অন্যতম একটি হল মহাদেবের মাথায় অর্ধচন্দ্রকে স্থান দেওয়া কাহিনী। মহাদেবের মাথায় কিভাবে স্থান পেলো অর্ধচন্দ্র? অর্থ বহন করে অর্ধচন্দ্র?

মহাদেবের মাথায় কিভাবে স্থান পেল অর্ধচন্দ্র? এই নিয়ে বিভিন্ন পুরাণে বিভিন্ন মতামত প্রচলিত রয়েছে।

পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে, ব্রহ্মাপুত্র প্রজাপতি দক্ষের ২৭ টি কন্যা নক্ষত্র ছিল।

তিনি এই ২৭ জন কন্যার সাথে বিবাহ দিয়েছিল চন্দ্রদেবের। চন্দ্রদেব ২৭ জন কন্যকে বিবাহ করলেও তাঁদের মধ্যে তার কাছে সবচেয়ে প্রিয় ছিল রোহিণী। যার ফলে রোহিনীকে ব্রহ্মাপুত্র প্রজাপতি দক্ষের বাকি কন্যারা ঈর্ষা করতে শুরু করেন। একদিন তাঁরা একত্রিত হয়ে দুঃখ প্রকাশ করেন তার পিতা দক্ষের কাছে। তাঁরা বলেন যে তাঁদের সাথে চন্দ্রদেব ভাল ব্যবহার করেন না। দক্ষ তাঁর কন্যাদের কথা শুনে চন্দ্রদেবের উপর ক্রোধিত হয়ে যান। যার ফলে তিনি চন্দ্রদেবকে অভিশাপ দেন যে তাঁর ধীরে ধীরে ঔজ্জ্বল্য কমে যাবে। দক্ষের দেওয়া অভিশাপ কি আর বিফলে যায়! যার ফলে চন্দ্রদেব ভীষণভাবে ভেঙে পড়েন। এদিকে এই বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন অন্যান্য দেবতারাও। যখন চন্দ্রদেবের মাত্র একফালি অংশই উজ্বল ছিল, তখন চন্দ্রদেব এবং অন্যান্য দেবতারা একত্রিত হয়ে যান মহাদেবের কাছে। মহাদেব দেবতাগনেদের থেকে সমস্ত বিষয় শোনার পর, মহাদেব নিজের জটায় চন্দ্রকে স্থান দেন। সাথে বর প্রদান করেন যে চন্দ্রদেবের ১৫ দিন উজ্বলতা হ্রাস পাবে এবং ১৫ দিন আবার তার উজ্বলতা ফিরে পাবে। পৌরাণিক মত অনুযায়ী, এই কারণেই প্রত্যেক মাসে হ্রাস-বৃদ্ধি হয় চাঁদের আলো।

আরো পড়ুন- মিড ডে মিলের খিচুড়িতে পাওয়া গেল আস্ত সাপ! চাঞ্চল্য নদিয়ায়

তবে শিব পুরাণে এই বিষয়ে অন্য ব্যাখ্যা রয়েছে। শিব পুরাণ অনুযায়ী, সতী তাঁর পিতা দক্ষের মুখ থেকে তাঁর স্বামী মহাদেবের অপমান সহ্য করতে না পেরে নিজের প্রাণ তিনি বিসর্জন দিয়েছিলেন যজ্ঞের অগ্নিকুন্ডে। এই কথাটি মহাদেব জানতে পারায় তিনি অত্যন্ত ক্রোধিত হয়ে যান এবং সেই সময় তিনি তাঁর জটা ছিঁড়ে ফেলেন। এরপর সেই যজ্ঞস্থলে মহাদেব তাঁর অনুচরদের সঙ্গে নিয়ে যায়। সেখানে গিয়ে সমস্ত কিছু লণ্ডভণ্ড করে দেন এবং প্রজাপতি দক্ষের মুণ্ডপাত করেন। তারপর মহাদেব সতীর মৃতদেহ কাঁধে তুলে নিয়ে শুরু করেন তান্ডব নৃত্য। মহাদেবের এই প্রলয় নৃত্য না থামাতে পারলে সমস্ত সৃষ্টি ধ্বংস হয়ে যেত। যার কারনে ভগবান বিষ্ণু তাঁর সুদর্শন চক্র দিয়ে সতীর দেহ ৫১টি অংশে খণ্ডিত করে দেন। এর ফলে শিব অনেকাংশে শান্ত হলেও তাঁর সেই রুদ্রতেজ কমে ছিল না। তাঁর এই প্রবল তেজের প্রভাবে মুমূর্ষু হয়ে গিয়েছিলেন সূর্যও। তখন দেবতারা তাঁর তেজ কমানোর উপায় খুঁজতে ব্রহ্মার কাছে যান। ব্রহ্মা তখন এই সমস্যা সমাধানের উপায় হিসাবে বলেন অমৃতের কলস এবং ষোলকলাময় চন্দ্র এর কথা।

সেই উপায় অনুযায়ী, ষোলকলায় সেজে চন্দ্র অমৃতের কলস সাথে নিয়ে এলেন। চন্দ্রকে ব্রহ্মা বললেন যে, তিনি রাতের আকাশে যে তৃপ্তিময় শীতলতা এবং প্রশান্তি নিয়ে অবস্থান করেন, এটি ওই অমৃতের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে। ব্রক্ষ্মার অনুরোধে অমৃতের কলসে প্রবেশ করেন চন্দ্রদেব এবং দেবতারা ওই অমৃত কলস নিয়ে যায় শিবের কাছে। এরপর ওই অমৃত পান করার জন্য মহাদেবকে অনুরোধ করে দেবতারা। অমৃত দেখে মহাদেবও প্রসন্ন হন। এরপর তিনি ওই কলসে আঙুল ডুবিয়ে অমৃত তোলা মাত্রই, তাঁর নখের আঘাতে কলসে থাকা দ্বিখণ্ডিত হয়ে যান চন্দ্রদেব! এটি দেখে মহাদেব উপলব্ধি করেন যে স্বাভাবিক ছন্দে তাঁকে ফিরিয়ে আনার জন্যই চন্দ্রদেব এই আত্মত্যাগ করেছেন। তখন তিনি অত্যন্ত প্রশন্ন হয়ে চন্দ্রদেব বর দেন ষোলকলা ফিরে পাওয়ার। সাথে খণ্ডিত হওয়া অষ্টকলাকে মহীয়ান করতে, মহাদেব নিজের মাথায় তা ধারণ করলেন। এরপর মহাদেবের শরীর থেকে মুক্ত হয়ে রুদ্রতেজ এবং ভরে ওঠে প্রশান্তিতে। এর পর থেকেই মহাদেবের মাথায় স্থান পান অর্ধচন্দ্র।

এছাড়াও বহু প্রাচীন গ্রন্থে এই নিয়ে প্রচলিত রয়েছে অন্য আরেকটি কাহিনী, যখন সমুদ্র মন্থন হয়েছিল সেই সময় অমৃতের সাথে উঠে এসেছিল বিষ। আর বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে বাঁচানোর জন্য সেই বিষ মহাদেব নিজের কণ্ঠে ধারণ করেছিলেন। নিজের কণ্ঠে নীল বিষ ধারণ করেছিলেন বলেই তিনি অপর একটি নাম হল নীলকণ্ঠ। এই তীব্র বিষ প্রভাবে মহাদেবের শরীরের তাপমাত্রা ভীষণভাবে বেড়ে যায়। সেই সময় তাপ হ্রাস করতেই মহাদেব তাঁর মাথায় ধারণ করেছিলেন চন্দ্রকে।

মহাদেবের মাথায় থাকা অর্ধচন্দ্র কিসের প্রতীক?

এই অর্ধচন্দ্র হল চিরন্তন সময়ের ইঙ্গিতের বাহক অর্থাত্‍ প্রাচীন, বর্তমান এবং ভবিষ্যত এই সবেরই প্রতীক হিসাবে ধরা হয়।

মেয়েদের প্রচণ্ড শপিং করার প্রবনতা এক ধরনের মানসিক রোগ! অজানা মানসিক রোগের গল্প অবাক করবে সাধারণ মানুষকে

শরীর থাকলেই অসুখ হবে। তবে সব মানুষের যে একই রকম অসুখ হবে তার কোন মানে নেই। সেরকমই বেশ কয়েকটি অদ্ভুত মানসির রোগের কথা এই প্রতিবেদনা আলোচনা করা হয়েছে। যা শুনলে অবাক হবে যে কোন মানুষ। তবে অনেকেই মানসিক রোগকে রোগ হিসাবে মানতে চান না। কিন্তু চিকিৎসকদের মতে মানসিক রোগ হচ্ছে সবচেয়ে ভয়ংকর ও গুরুতর একটি অসুখ।

1) প্যারিস সিন্ড্রোম:- যারা মূলত বিদেশে ঘুরতে যেতে বেশি পছন্দ করেন তাদের ক্ষেত্রে এই রোগটি বেশি দেখা যায়। বিশেষ করে জাপানিদের মধ্যে বেশি লক্ষণ করা যায়। কারণ জাপানিরা স্বভাব চরিত্রের দিক থেকে খুবই ভদ্র এবং নম্র প্রকৃতির। তাই তারা নিজেদের দেশ থেকে যখন প্যারিসে ঘুরতে যায় তখন প্যারিসের সৌন্দর্যকে দেখে তাদের খুব দ্রুত মেন্টাল ব্রেক ডাউন হয়ে যায়।

তাই জাপানিরা বেশিদিন প্যারিসে থাকতে পারে না। সেই দিক থেকে বিচার করতে গেলে ফরাসিরা খুব কঠোর এবং রুঢ় স্বভাবের হয়। তাদের খুব একটা মেন্টাল ব্রেক ডাউন হয় না। তবে আচমকা বিদেশে ঘুরতে গিয়ে এভাবে মানসিক স্থিতির পরিবর্তনকে এককথায় কালচার শকড বলে। যেহেতু প্যারিসে গেলেই মানুষের মধ্যে এই ধরনের রোগ বেশি দেখা যায় তাই এই রোগের নামকরণ করা হয়েছে প্যারিসের নাম দিয়ে।

2) স্টেন্ডহাল সিন্ড্রোম:- পৃথিবীতে এমন কিছু মানুষ রয়েছে যারা আর্ট বা কোন ভাস্কর্যরকে খুবই ভালোবাসে। তবে কিছু কিছু মানুষ এমনও রয়েছে যারা খুব সুন্দর আর্ট কিংবা ভাস্কর্য দেখলে সহ্য করতে পারে না তারা অসুস্থ হয়ে যায়। তাদের মাথা ঝিমঝিম করে আবার অনেক ক্ষেত্রে হার্টবিট বেড়ে যায় এবং হ্যালোসিনেশন পর্যন্ত হয়ে থাকে। এই ধরনের রোগকে স্টেন্ডহাল সিন্ড্রোম বলে।

3) ডায়োজেনেস সিন্ড্রোম:- কিছু মানুষ মনে করেন যে পৃথিবীতে যা কিছু রয়েছে সবই মূল্যহীন। সেই মানুষটা একপর্যায়ে এমন পরিস্থিতিতে পৌঁছে যায় যে নিজের অস্তিত্বকেও মূল্যহীন মনে হতে থাকে। অনেক সময় বয়স্কদের ক্ষেত্রে এই রোগের লক্ষণ দেখা যায়। কিন্তু গ্রিক দার্শনিক ডায়োজেনেসের ক্ষেত্রে যৌবনকালীন সময়ে এই রোগটি দেখা গিয়েছিল। তিনি একটি ব্যারেল বা পিপার ভেতরে বসবাস করতেন। এবং মনে করতেন যে পৃথিবীতে অস্তিত্বহীন হয়ে রয়েছেন তিনি। যেহেতু খুব অল্প বয়সে গ্রীক দার্শনিকের এই রোগ ধরা পরেছিল তাই তার নামানুসারে রোগের নাম করা হয়েছিল ডায়োজেনেস সিন্ড্রোম।

4) অটোফ্যাজিয়া সিন্ড্রোম:- কোন মানুষ খুবই বিষন্ন হয়ে গেলে এবং তার সিজোফ্রেনিয়া দেখা দিলে তার অটোফ্যাজিয়া সিনড্রোম হওয়ার চান্স বেশি। তবে যদি কোন মানুষ এই মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়ে যায় সে ক্ষেত্রে তারা উদ্ভট আচরণ করতে থাকে। এমনকি তারা এতটাই বিকারগ্রস্ত হয়ে যায় যে অনেক সময় নিজেরাই নিজেদের শরীরের কোন অংশ কামড়ে ধরে আবার কোন অংশ খেয়েও ফেলে। এক কথায় যাদের এই মানসিক সমস্যাটি রয়েছে তারা ক্রমাগত নিজের শরীরকে ব্যথা দিতে থাকে।

5) জেরুজালেম সিন্ড্রোম:- এই মানুষের রোগ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ধার্মিক মানুষের মধ্যে দেখা যায়। এই রোগে আক্রান্ত হলে যে কোন ব্যক্তি দেখতে পায় যে যীশু তার ঘরে উপস্থিত রয়েছেন এবং তাকে জেরুজালেমে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দিচ্ছেন। অনেকেরই জেরুজালেমের যাওয়ার এই অদম্য ইচ্ছাই পরবর্তীতে মানসিক রোগে পরিণত হয়েছে।

6) অনিওম্যানিয়া সিন্ড্রোম:- প্রত্যেকটি মানুষের ভিন্ন ধরনের ইচ্ছা থাকতেই পারে। কিন্তু কোন ইচ্ছাকেই এতটা গুরুত্ব দেওয়া উচিত না যে সেটা মানুষের উপর ভারী হয়ে যায়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে অনেক মহিলারাই কেনাকাটা করতে পছন্দ করেন। কিন্তু কিছু কিছু মহিলার ক্ষেত্রে এমনও দেখা গেছে যে তারা এতটাই কেনাকাটা করতে পছন্দ করেন যে যতক্ষণ না টাকা সম্পূর্ণরূপে শেষ হচ্ছেন ততক্ষণ শপিং করা থামান না। এটাও এক ধরনের মানসিক রোগ যাকে বৈজ্ঞানিক ভাষায় অনিওম্যানিয়া সিন্ড্রোম বলে।

আরো পড়ুন- ভারতের এক গরীব কৃষকের ঘরে দুই মাথা নিয়ে জন্মে ছিল এক শিশু। রিসার্চ করতে ইংরেজরা চুরি করেছিল তার মৃতদেহ

7) কটার্ড’স সিনড্রোম:- এটি এক ধরনের মানসিক তথা স্নায়বিক রোগ। এই রোগে আক্রান্ত মানুষ নিজেকে মৃত আবার কখনো অমর বলে মনে করেন।

8) ক্যাপগ্রাস ডেলুশন:- এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা সব সময় মনে করেন যে তাদের পরিবারের সদস্যরা কোন এক কারণ বসত একই রকম দেখতে হয়ে গেছে। বিশেষ করে সে তার স্ত্রীকে বেশি সন্দেহ করে। কারণ ওই ব্যক্তির মনে হয় অন্য কোন মানুষ তার স্ত্রীর রূপ ধরে এসে তার সঙ্গে সহবাসের চেষ্টা করছে। এই ভেবে নেওয়া রোগটাকেই ক্যাপগ্রাস ডেলুশন বলে।

9) অ্যামপিউটি আইডেন্টিটি ডিজঅর্ডার:- এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি অনেক সময় মনে করেন যে তার নিজের শরীরের কোন একটি অঙ্গ ছাড়া তারা ভালোভাবেই জীবন যাপন করতে পারবেন। সে কারণে এরা নিজেরাই নিজেদের অঙ্গ ছেদ করার চেষ্টা করেন।

আজীবন ব্রহ্মচর্য পালন করার পরও হনুমানের একজন পুত্র সন্তান ছিল!

আমরা জানি যে পবনপুত্র হনুমান আজীবন ব্রহ্মচর্য পালন করেছেন। কিন্তু অবাক করা বিষয় হল যে তিনি একজন ব্রহ্মচারী হওয়া সত্ত্বেও তার নাকি পুত্র ছিল! এমন কথাই প্রচলিত রয়েছে প্রাচীন ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অঞ্চলগুলোতে প্রচলিত রামায়ণের সংস্করণে। তবে এই তথ্য নিয়ে মতভেদ রয়েছে। কারন বাল্মিকী রামায়ণে হনুমানের কোন পুত্র ছিল বলে সেই রকম কোন তথ্য পাওয়া যায় না।

কৃত্তিবাসের রচিত রামায়ণ অনুযায়ী, হনুমানের পুত্র ছিল আর তার নাম ছিল মকরধ্বজ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রচলিত রামের কাহিনী অনুযায়ী, এখানে হনুমানের পুত্র থাকার কথা উল্লেখ রয়েছে তবে তার নাম নিয়ে দ্বিমত রয়েছে। এই মত অনুযায়ী তার নাম ছিল মৎসানু।

কিভাবে জন্ম হয়েছিল পবনপুত্র হনুমানের পুত্রের?

লঙ্কাকাণ্ডের কথা তোমরা সবাই জানি যে কিভাবে হনুমান তার লেজে আগুন লাগিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছিল রাবণের স্বর্ণের লঙ্কা। এরপর সে আগুন নেভাতে অনুমান সমুদ্রে যান। সেই সময় প্রচন্ড গরমের কারণে তার শরীর থেকে ঝরে পড়া ঘাম গিয়ে পড়ে সামুদ্রিক প্রাণী মকরের মুখে। এভাবেই মকরের গর্ভে আসে একটি শিশু। এই মকর ধরা পড়ে যায় পাতাল লোকের অধীশ্বর রাবণের পুত্র অহিরাবণের সেনাদের হাতে। এরপর মকরের পেট চিরে ফেলে তারা যার ফলে সেই সময় জন্ম হয় তার গর্ভে থাকা শিশুটির। সেই সময় তার নাম দেওয়া হয় মকরধ্বজ। যখন মকরধ্বজ প্রাপ্তবয়স্ক হয় তখন অহিরাবণ তার সাহস এবং শক্তির প্রমাণ পেয়ে তাকে নিযুক্ত করেন পাতাল লোকের প্রবেশপথের রক্ষক হিসেবে।

পরবর্তীকালে রাবণের স্বর্ণের লঙ্কায় রামচন্দ্র আক্রমণ করলে অহিরাবণ রাম ও লক্ষ্মণকে অপহরণ করেন এবং সিদ্ধান্ত নেয় যে তাদের দুজনকে দেবী মহামায়ার সামনে বলি দেবেন। অন্যদিকে হনুমান রাম ও লক্ষণকে খুঁজতে আসেন পাতাল লোকে। সেই সময় তার সাথে পাতাল লোকের দ্বারে দেখা হয় অর্ধেক বানর অর্ধেক সরীসৃপ মকরধ্বজ -এর। তখন তাকে তার পরিচয় জিজ্ঞাসা করলে তিনি উত্তর দেয় যে সে হনুমানের পুত্র মকরধ্বজ। এই কথাটি শুনে হনুমান চমকে ওঠে এবং পরে তিনি ধ্যান করে জানতে পারেন সমস্ত সত্যিটা।

তবে মকরধ্বজ হনুমানকে পাতাল লোকে যেতে বাধা দেন। কারণ মকরধ্বজের শিক্ষক ছিলেন অহিরাবণ, তাই তার দেওয়া দায়িত্ব তিনি পালন করে যাবেন। যার ফলে হনুমান মকরধ্বজকে পরাজিত করে বেঁধে ফেলেন। এরপর সেখান থেকে তিনি রাম এবং লক্ষ্মণকে উদ্ধার করে নিয়ে আসেন। ফেরার সময় রাম দেখতে পান মকরধ্বজকে। এরপর রাম হনুমানের কাছ থেকে সমস্ত কিছু জেনে মুক্ত করে দেন তাকে। তার সাথে পাতাললোকের রাজা হিসেবে অভিষিক্ত করেন মকরধ্বজকে।

ক্ষত্রিয় বর্ণের জেঠওয়া ( বা জেথওয়া) বংশের মানুষেরা দাবী করে যে, মকরধ্বজের বংশধর তারা। হনুমানকে তারা তাদের ইষ্টদেবতা” হিসেবে পূজা করে। মকরধ্বজের মন্দির ভারতের গুজরাট এলাকায় আছে।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতেও ছড়িয়ে রয়েছে রামায়ণের কাহিনী। থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়াতেও রামায়ণের আলাদা সংস্করণ রয়েছে। এই সংস্করণ অনুযায়ী, হনুমানের পুত্রের নাম ছিল মাচ্ছানু (Macchanu) বা মৎসানু (Matchanu) – এমনটিই উল্লেখ্য পাওয়া যায়।

আরো পড়ুন- ছত্রপতি শিবাজী খুব বিচক্ষণ রাজা ছিলেন। কিন্তু তাঁর দুই ছেলে এই গুণ পাননি

রামায়ণের এই সংস্করণের কাহিনী অনুযায়ী, যখন হনুমান বানর সেনা নিয়ে সীতাকে উদ্ধার করার জন্য পাথর দিয়ে সেতু বানাচ্ছিলেন সেই সময় তাদের সেই পাথর যেন কে বা কারা সরিয়ে ফেলছে। এই খবরটি জানার পর হনুমান সমুদ্রে ঝাপ দেন এবং দেখতে পান যে এই পাথরগুলো মৎস্যকন্যারা সরিয়ে দিচ্ছে। খোঁজ নেওয়ার পর তিনি জানতে পারেন যে এই মৎস্য কন্যাদের প্রধান হচ্ছে সুবর্ণমৎস যিনি আসলে রাবণের কন্যা। থাইল্যান্ডের সংস্করণ অনুযায়ী, রাবণের নাম থোতসাকান (Thotsakan), যা সংস্কৃত শব্দ “দশকণ্ঠ” থেকে অনুপ্রাণিত। সুবর্ণমৎসকে যতবার হনুমান ধরার চেষ্টা করছে ততবারই সে পালিয়ে যাচ্ছে, তাকে কিছুতেই ধরতে পারছে না হনুমান। বানর বাহিনী যতবার সেতু বানানোর চেষ্টা করছে ততবারই তিনি তার দলবল নিয়ে সব নষ্ট করে আবার পালিয়ে যায়।

হনুমান সুবর্ণমৎস এর সাথে এমন লুকোচুরি খেলতে খেলতে ধীরে ধীরে তার প্রতি ভালোবাসা অনুভব করতে শুরু করেন। এরপর সুবর্ণমৎসকে তিনি তার এই ভালো লাগার কথা প্রকাশ করেন। তখন সুবর্ণমৎস বলেন যে, তার পিতা রাজ্য রক্ষার্থে সে বার বার নষ্ট করে দিচ্ছে সমুদ্র পথে সেতু বানানোর চেষ্টাকে।

তখন হনুমান সুবর্ণমৎসকে বলেন সীতাহরণ থেকে শুরু করে সমস্ত গল্প। সমস্ত কিছু শোনার পর সুবর্ণমৎস সিদ্ধান্ত নেয় যে সেতু বানানোতে তিনি আর বাধা দিবেন না। আর ততক্ষণে সেও হনুমানকে ভালোবেসে ফেলেছে। পরবর্তীতে একটি ছেলে সন্তান হয় তাদের যার নাম ছিল মাচ্ছানু বা মৎসানু।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতেও প্রচলিত রয়েছে অহিরাবণ, রাম ও লক্ষ্মণ অপহরণ করা এবং তাদেরকে সেখান থেকে হনুমানের উদ্ধার করার কাহিনী। তবে এই কাহিনীটিতে একটু ভিন্নতা রয়েছে। হনুমান রাম-লক্ষ্মণকে খুঁজতে গিয়ে একটি সরোবর পান। সেই সরোবরের রক্ষক ছিল মৎসানু। এরপর হনুমান এবং মৎসানুর সাথে লড়াই করবার এক পর্যায়ে দৈববাণী হয় যে, মৎসানু হল হনুমানের পুত্র। সেই সময় মৎসানু জানায় যে, অহিরাবণের কাছে সুবর্ণমৎস রেখে চলে যায়। তাই তিনি হল তার পালক পিতা। এই কৃতজ্ঞতাবোধ থেকে সে অহিরাবণের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে রাজি নয়। তবে তখন হনুমানকে মৎসানু একটি ধাঁধাঁ বলে, সেই ধাঁধাঁ সমাধান করতে গিয়ে হনুমান বুঝতে পারে যে, এই সরোবরে থাকা পদ্মফুলের মধ্য দিয়ে যেতে হয় পাতাললোক।

একাধিক তথ্য ভিত্তিক লেখা, এই নিয়ে প্রচুর মতামত রয়েছে।

ভারতের এক গরীব কৃষকের ঘরে দুই মাথা নিয়ে জন্মে ছিল এক শিশু। রিসার্চ করতে ইংরেজরা চুরি করেছিল তার মৃতদেহ

চিকিৎসা বিজ্ঞানে এমন অনেক ঘটনাই থাকে যেটা গোটা পৃথিবীকে অবাক করে দেয়। নতুন করে চিন্তায় ফেলে দেয় চিকিৎসা বিজ্ঞানীদেরকেও। সেরকম একটি ঘটনা ঘটেছিল ১৭৮৩ সাল নাগাদ। দুই মাথা নিয়ে জন্মেছিল একটি শিশু। তাজ্জব হয়েছিল গোটা চিকিৎসাবিজ্ঞান। জানা যায় যে এখনো পর্যন্ত নাকি সেই জটিল ঘটনা বিশ্লেষণ করে উঠতে পারেনি বিজ্ঞানীরা।

ঘটনাটি শুরু হয়েছিল ১৭৮৩ সাল নাগাদ। সেই বছরের মে মাস নাগাদ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনস্থ ভারতের এক গরীব কৃষকের ঘরে জন্মগ্রহণ করেছিল এক পুত্র সন্তান। পুত্র সন্তান জন্মের আনন্দ ছিল পরিবারের কিন্তু তার দুটো মাথা হওয়ায় অবাক হয়েছিলেন তারা। সেইসময় অধিকাংশ শিশু বাড়িতেই জন্মাতো।

সেরকমই একজন দাইমা এই শিশুটিকে প্রসব করানোর সময় তার রূপ দেখে আঁতকে উঠেছিলেন। এবং ভয়ে সেই কক্ষে থাকা আগুনের উপর ফেলে দিয়েছিলেন। তবে সৌভাগ্যক্রমে শিশুটির শরীরের অল্প কয়েকটি জায়গা পুড়ে গেলেও প্রাণে বেঁচে গিয়েছিল সে। সেই শিশুটির নাম সম্বন্ধে রয়েছে যথেষ্ট জটিলতা। তাই শিশুটির নাম অজানাই থেকে গেছে।

পরবর্তীতে শিশুটিকে সুস্থ করিয়ে তার বাবা-মা নিজেদের ভিটে ছেড়ে কলকাতায় চলে এসেছিলেন। সেখানেই এরকম আজব ঘটনার জন্য নিজের শিশুকে পয়সা ইনকামের একটি মাধ্যম করে তুলেছিলেন। অর্থাৎ নিজের সদ্যজাত আত্মজকে প্রদর্শনীতে বসেছিলেন। যে সকল মানুষেরা শিশুটির গল্প শুনতেন এবং তাকে দেখতে চাইতো তাদের সকলকেই পয়সা দিয়ে দেখতে হতো। শুধুমাত্র প্রদর্শনী নয় কোন ধনী ও স্বনামধন্য ব্যক্তির পরিবার শিশুটিকে দেখতে চাইলে তারা ভাড়া করে নিয়ে যেত। তার জন্য অবশ্য শিশুটির পরিবারকে মোটা টাকা দেওয়া হতো। পরবর্তীতে এই শিশুর কথায় ছড়িয়ে পড়েছিল গোটা দেশে। এরপর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মকর্তারা শিশুটির বিষয় জানতে পেরে তাকে বিজ্ঞানের দোহাই দিয়ে একদিন চুরি করে নিয়ে গিয়েছিলেন। তবে শিশুটি সকলের সামনে প্রদর্শনী হলেও চিকিৎসা বিজ্ঞানের মতে পঞ্চাশ লক্ষ শিশু জন্মের মধ্যে মাত্র দুজন শিশুর মধ্যে এই ধরনের ব্যতিক্রম লক্ষ্য করা যায়। যদিও এই ধরনের শিশুরা বেশি দিন জীবিত থাকে না।

** ছেলেটি দেখতে ছিল – শিশুটির অন্যান্য শিশুর মতই দুই হাত, দুই পা এবং শারীরিক গঠন ছিল। তবে শিশুটির মাথা ছিল একটু বড় এবং সেই মাথার উপর দিয়ে আরেকটা মাথা তৈরি হয়েছিল। যেটাকে দেখলে অনেকটা মনে হতো মাথার উপর কোন একটা ভারী স্তুপ রেখে দেওয়া হয়েছে। তবে প্রথম মাথাটির তুলনায় দ্বিতীয় মাথাটি ছিল ছোট এবং সেই দ্বিতীয় মাথার চোখ কান নাক সঠিকভাবে তৈরি ছিল না। এমনকি জিহ্বা ও চোয়াল ছিল কিছুটা বিকৃত। এছাড়াও তার প্রথম মাথাটি ছিল অন্যান্য শিশুর মাথার তুলনায় অত্যাধিক বড়। যদিও দেখা গেছিল যে শিশুটির দ্বিতীয় মাথাটা কম সক্রিয় ছিল। কারণ শিশুটি যখন হাসতো কিংবা কাঁদবো তখন দ্বিতীয় মাথায় কোনরকম প্রতিক্রিয়া হত না। অর্থাৎ অনেকটা এরকম মনে হতো যে তার দ্বিতীয় মাথাটা তার শরীরে অংশই নয় আলাদা একটা সত্তা। মাঝে মাঝে ওই দ্বিতীয় মাথাটি স্বাধীনভাবে কাজ করতো।

যখন শিশুটি ঘুমাতো তখন তার দ্বিতীয় মাথাটির চোখ খোলা থাকতো এবং চারিদিক ঘোরাতে। অর্থাৎ এটা প্রমাণ করতে চাই তো যে সে ঘুমন্ত অবস্থায় সজাগ রয়েছে এবং চতুর্দিক পর্যবেক্ষণ করছে। আবার যখন শিশুটিকে প্রথম মাথার মুখ দিয়ে খাওয়ানো হতো তখন তার দ্বিতীয় মাথার মুখের জিহ্বা দিয়ে লালা ঝরতো। আবার অনেক প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন যে এই শিশুটির দ্বিতীয় মাথা দিয়ে স্বাভাবিকভাবে স্তন্যপান করতো।

** চিকিৎসা বিজ্ঞানে এই ঘটনার বিবরণ – চিকিৎসকদের মতেই মায়ের গর্ভে যখন জমজ বাচ্চার জন্ম হবে তখন যদি ভ্রুণ বিচ্ছিন্ন না হয় সেক্ষেত্রে ক্রেনিওপ্যাগাস প্যারাসিটিকাস কন্ডিশন দেখা দেয়। যার ফলে একটা শিশু এই ভাবে জন্মগ্রহণ করে। চিকিৎসা বিজ্ঞানে এই রোগের নিরাময়ের পদ্ধতি নেই সেটা বললে ভুল হবে। এই ধরনের কেসের জন্য এক ধরনের চিকিৎসা রয়েছে যাকে বলে ‘the removal of the parasitic twin’। অর্থাৎ শিশুদের প্রথম মাথা থেকে দ্বিতীয় মাথাটি অস্ত্রপাচারের মাধ্যমে আলাদা করতে হবে। কিন্তু সে ক্ষেত্রে বিষয়টা খুবই প্রাণঘাতি হয়ে দাঁড়ায়। কারণ দুটি মাথার মধ্যে শিরা গুলি এমনভাবে যুক্ত থাকে যে সেগুলো ছিন্ন করা মানে প্রাণ হারানো।

তবে ২০০৩ সাল নাগাদ ক্র্যানিওপ্যাগাস প্যারাসিটিকাসের একটি মেয়ের উপর অস্ত্রপাচার করা হয়েছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত অস্ত্র চালানোর পর মাত্র ১১ ঘণ্টার মধ্যেই তার মৃত্যু হয়েছিল। পরবর্তী ২০০৫ সালে মিশরের এক ছেলের উপর একই পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছিল তবে সেও মস্তিষ্ক সংক্রান্ত কিছু রোগের কারণে মারা গিয়েছিল।

তবে এই দুই মাথাওয়ালা শিশুটির অন্যান্য কোন শারীরিক উপশম ছিল না। তবে শিশুটির চার বছর বয়সে একটা কোবরা সাপের কামড়ে মৃত্যু হয়েছিল।

** মৃত্যুর পরেও চুরি হয়েছিল শিশুটির মৃতদেহ – দুর্ভাগ্যের বিষয় ছিল যে শিশুটি মারা যাওয়ার পর তাকে কবরস্থ করা হলেও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একজন এজেন্ট সেই কবর লুট করেছিল। এরপর শিশুটির মাথা নিয়ে পর্যবেক্ষণ করে জানতে পেরেছিল যে পুষ্টি গ্রহণের মাধ্যমে শিশুটির দুটি মস্তিষ্কই পুষ্ট ছিল। পরবর্তীতে অবশ্য ইংরেজদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষ হওয়ার আগেই শিশুটির শরীর শুকিয়ে গিয়েছিল। যার কারণে একজন ইংরেজ সার্জন এভারার্ড হোম নামে এক ব্যক্তিকে মাথার খুলি উপহার দিয়েছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আধিকারিকেরা। বর্তমানে সৃষ্টিকর্তার এই অদ্ভুত সৃষ্টিটি লন্ডনের রয়্যাল কলেজ অফ সার্জনস-এর হান্টেরিয়ান মিউজিয়ামে প্রদর্শনী হিসেবে যত্ন সহকারে রাখা রয়েছে।