বাংলা সাহিত্যের বটগাছ নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী

শুধু অসাধারণ সাহিত্য সৃষ্টিই কি একজন সাহিত্যকারের মাপকাঠি। স্বয়ং ভাষার কাছেও তার দায় যে অপরিসীম। আসলে এমন বহু প্রিয় এবং বিশিষ্ট সাহিত্যকার আছেন যারা তাদের লিখনশৈলী এমন তারে বেঁধেছেন যা আমাদের মুগ্ধ করে রাখে যুগের পর যুগ ধরে। ভাষার ব্যবহারে এরা অনুনকরণীয়। আবার এমনও সাহিত্যকার আছেন যারা নিঃসাড়ে কাজ করে যান পাল্টে দেন ভাষার ব্যবহার, এক নতুন যুগ নিয়ে আসেন আড়ম্বর ছাড়াই। তাদের হাতের কলমই তাদের ছেনি হাঁতুড়ি। এই শেষ দলের এক পরম শ্রদ্ধেয় নাম নরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। তিনি একাধারে কবি, গদ্যকার, শিশুসাহিত্যিক, সম্পাদক, সাংবাদিক – লিস্ট অনেক লম্বা। নীরেন্দ্রনাথ, বলা ভাল ‘নীরেন দা’র সংস্পর্শে যারাই এসেছেন, সবারই কিছু না কিছু স্মৃতি রয়ে গেছে। এখন তো, সেই স্মৃতিগুলোকেই উস্কে নেওয়া।

পুব বাংলায় জন্মেছিলেন তিনি। সেখানকার প্রকৃতির স্পর্শেই কেটেছে শৈশব। নিজের ভেতর সবসময় নিয়ে চলতেন সেই মাঠ, ক্ষেত, রেল স্টেশন। বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে মানবপ্রকৃতিকে নিবিড়ভাবে দেখতেন। সেই নিয়েই একদিন কলকাতায় পা। ১৯৫৪। সিগনেট থেকে বের হল প্রথম কবিতার বই ‘নীলনির্জন’। তারপর কত বই, কত সম্মান পেয়েছেন তিনি। সে-বৃত্তান্ত এখন থাক। কবিতা, গল্প, সবেতেই যে তাঁর প্রধান নায়ক ছিল মানুষ, সে কথা বারবার দ্ব্যর্থহীন হয়ে বলেছেন তিনি।

নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী

নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী মনে করতেন, ‘‘কঠিন ভাষা যারা বলে, শোনে ও বোঝে, সহজ ভাষা বলে শোনে ও বোঝে তার চতুর্গুণ মানুষ। আর তাই আমার কবিতা যদি অনেক লোকের কাছে পৌঁছে দিতে হয় তো ভাষার স্তর নির্বাচনে কোনও ভুল করলে আমার চলবে না, সহজ বাংলার জনপথ ধরেই আমাকে হাঁটতে হবে।’’ কবি, লেখক, অনুবাদক, সম্পাদক, বাংলা ভাষার নীতি-নির্ধারক হিসেবে তিনি যা কিছু করেছেন তার মূল নীতিই ছিল লেখা ‘‘আরও অনেকের কাছে পৌঁছে দিতে চাই।’’

‘বাঙ্গালার পাঠক পড়ান ব্রত’ নামের অস্বাক্ষরিত লেখায় বঙ্গদর্শন পত্রে মন্তব্য করা হয়েছিল – ছাপাখানা আসার আগে কথকেরা পড়তে-না-জানা মানুষের কাছেও বলার গুণে তাঁদের বার্তা পৌঁছে দিতেন, এখন লেখক সম্পাদকের দায়িত্ব পড়তে-জানা-মানুষদের পাঠক হিসেবে গড়ে তোলা। আনন্দমেলা-র সম্পাদক নীরেন্দ্রনাথ এই পত্রিকার মাধ্যমে ভবিষ্যৎ পাঠকদের রুচি গড়ে তুললেন। এখন পঁয়ত্রিশ থেকে পঞ্চাশের মধ্যবর্তী যে বাঙালিরা বিশ্বের নানাখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন তাঁদের অনেকেই এই পত্রিকা পড়ে বাংলা ভাষায় মজেছেন। অনুবাদে বাংলা ভাষার সীমাকে যেমন তিনি সম্প্রসারিত করলেন তেমনি বাংলা ভাষার অল্পবয়স্ক পড়ুয়াদের ভাষাটির প্রতি মনোযোগী করে তোলার জন্য কাজে লাগালেন ভাষাবিদ পবিত্র সরকার ও কবি শঙ্খ ঘোষকে। স্কুলে স্কুলে তখনও ডাক্তারের প্রেসক্রিপশনের মতোই তেতো বাংলা ব্যাকরণ পড়ানো হত, আনন্দমেলার পাতায় কিন্তু প্রকাশিত হত ‘বাংলা বলো’। মুখের সজীব বাংলার রীতি-নীতি তাই ‘আমেরিকা ফেরত’ পবিত্র সরকারের লেখার বিষয়। শঙ্খ ঘোষ ‘কুন্তক’ ছদ্মনামে লিখতেন শব্দ নিয়ে খেলা। ‘বানানের শুদ্ধি-অশুদ্ধি বিচার’ নিয়ে এমন সহজ-গভীর বই বাংলায় দু’টি নেই।

‘কবিতার ক্লাস’ নেওয়া মাস্টারমশাই নীরেন্দ্রনাথ জনপ্রিয় হলেও, ওঁর আরেকটা কাজ ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ। ছিল কেন, আজও আছে। ‘বাংলা কী লিখবেন, কেন লিখবেন’। আনন্দবাজারের বানানবিধি, কাগজের প্রুফ দেখা, লেখার ধরন – সমস্ত কিছুকেই দুই মলাটে রেখেছিলেন তিনি। আজও, তরুণ সাংবাদিকদের কাছে এই বইটি সর্বক্ষণের সঙ্গী।

বাংলা ভাষার প্রমিত রূপ নির্মাণের যে চেষ্টা তাঁর সম্পাদনায় আনন্দমেলার পাতায় শুরু হয়েছিল, পরে তা সম্প্রসারিত রূপ পেল। বাংলা কী লিখবেন কেন লিখবেন নামের বিধিগ্রন্থ নীরেন্দ্রনাথ গড়ে তুলেছিলেন। ঢাকা বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত দু’খণ্ডের প্রমিত বাংলা ভাষার ব্যাকরণের অন্যতম উপদেষ্টা ছিলেন তিনি। চলিতের প্রতি, পথচলতি মানুষের প্রতি তাঁর বরাবর পক্ষপাত। তখন তিনি ‘ল কলেজের’ ছাত্র, আজ়াদ-হিন্দ ফৌজের বন্দি সেনাদের মুক্তির ছাত্র-আন্দোলনে পুলিশি হামলা। রাস্তার ওপর চাপ-চাপ রক্ত, ছেঁড়া বইখাতা, চপ্পলের পাটি, ভাঙা চশমা। নিহত হলেন তরুণ রামেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৯৪৫-এর নভেম্বর মাসের সেই ঘটনা নিয়ে লেখা কবিতা ‘শহিদ রামেশ্বর’। দেশ পত্রিকায় পাতা জুড়ে ছাপা হল। পথের মানুষদের সম্বন্ধে বিশ্বাস দৃঢ় ছিল বলেই এক সময় জীবনানন্দের কবিতায় তিনি দেখেছিলেন ‘আত্মঘাতী ক্লান্তি।’

১৯২৪ সালের ১৯ অক্টোবর অবিভক্ত ভারতের ফরিদপুরে তাঁর জন্ম। প্রাথমিক পড়াশোনা সেখানকার পাঠশালায়। পরে ১৯৩০-এ কলকাতায় চলে আসা। শহরের মিত্র ইনস্টিটিউশন, বঙ্গবাসী এবং সেন্ট পলস কলেজে পড়াশোনা। ১৯৫১ সালে আনন্দবাজার পত্রিকায় কাজে যোগ দেন। একটা দীর্ঘ সময় তিনি ‘আনন্দমেলা’ পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। কবির পাশাপাশি নীরেন্দ্রনাথ ছিলেন ছড়াকার, প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক, গদ্যকার, গোয়েন্দা-গল্পকার, শিশুসাহিত্যিক, ভ্রমণ-কাহিনির লেখক, সম্পাদক এবং বানান-বিশেষজ্ঞ।

ছোটবেলা থেকেই ছড়া লিখতেন নীরেন্দ্রনাথ। ১৯৫৪ সালে প্রকাশ পায় তাঁর প্রথম কবিতার বই ‘নীল নির্জন’। তখন কবির বয়স ৩০। তার পর একে একে প্রকাশ পায় ‘অন্ধকার বারান্দা’, ‘নিরক্ত করবী’, ‘নক্ষত্র জয়ের জন্য’, ‘আজ সকালে’… অজস্র কবিতার বই। পেয়েছেন আনন্দ পুরস্কার, সাহিত্য অকাদেমি। ১৯৯০-এ বিশ্ব কবি সম্মেলনে ভারতের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেন তিনি। একটা সময়ে ‘দেশ’ পত্রিকায় বেশ কিছু ছোটগল্প লিখেছেন। সেই লেখাও পাঠক মহলে সাড়া ফেলে দিয়েছিল। তাঁর লেখা কবিতা ‘অমলকান্তি রোদ্দুর হতে চেয়েছিল…’ বা ‘রাজা তোর কাপড় কোথায়…’ বাঙালির কাছে রীতিমতো প্রবাদে পরিণত হয়েছে।

মুখে স্বকীয়তা নিয়ে বেঁচে থাকার শিক্ষা আজও আমাদের পাথেয় এবং তাই থাকবে চিরটাকাল।

শুধু শিল্পী বা শিল্প নিয়েই নয়। নীরেন্দ্রনাথ ছিলেন একজন সমাজ সচেতন কবি, সমাজ এবং আগামীর প্রতি তাঁর দায়িত্ববোধ ছিলো অপরিসীম। সামাজিক বিভেদ, মসজিদ না মন্দির এই প্রসঙ্গে কবি নীরেন্দ্রনাথের মনে হয়েছে যে লেংটি পরা ক্ষুধার্ত, খেটে খাওয়া মানুষের কাছে এই প্রশ্ন নিতান্ত অবান্তর, তিনি মনে করতেন :-

“পিতলের থালায় এক চিমটি নুন ছিটিয়ে
ছাতু ঠাসতে-ঠাসতে
তবুও যে তারা হাসছে, তার কারণ, তাদের
একজনের নাম হতেই পারত সিকান্দর শাহ্‌ আর
অন্যজনের সেলুকাস”

শুধু কি বড়দের জন্যেই লিখেছেন তিনি! ছোটোদের জন্য তাঁর সেরা উপহার অনন্দমেলার অসাধারণ সম্পাদনা। একসময় আনন্দমেলা বছরে একটি বার প্রকাশিত হত। ক্রমে ক্ষুদে, কচি-কাঁচাদের হাতে আনন্দমেলা পৌঁছাতে লাগলো প্রতি মাসে। অসাধারণ প্রবন্ধ, গল্প, কবিতা, ধাঁধা, এবং বাংলা কমিকস সমৃদ্ধ এই কিশোর ম্যাগাজিন বহু ছেলে-মেয়ের বেড়ে ওঠার বছরগুলোর শ্রেষ্ঠ সহায় ছিলো। বহু বড়দের লেখকের কলম থেকে শিশু সাহিত্যের ফোয়ারা ছুটিয়েছেন এই নীরেন্দ্রনাথ। তাঁর বদান্যতায় আমরা পেয়েছি বাংলায় অনূদিত টিনটিন! স্নোয়ির বদলে কুট্টুসকে, জনসন-রনসনকে! নিজেই নীরেন্দ্রনাথ ছিলেন অনুবাদকের ভূমিকায়।

অতিক্রান্ত হবার আগেই তাঁর জন্ম; অথচ আশ্চর্য ব্যাপার, সেই শতকের প্রান্তরেখা সম্পূর্ণ পেরিয়ে গিয়ে যখন নূতন শতকে ঢুকছেন, তাঁর পদক্ষেপ তখনও সমান দুঃসাহসী, তখনও জরার জং ধরেনি তাঁর কবিকণ্ঠে। এই রুগ্ন সমাজের ব্যাখ্যাতা তিনি, এই দুঃসময়ের ভাষ্যকার। প্রেম, প্রতিবাদ, করুণা, কৌতুক, ব্যঙ্গ, বেদনা, শ্লেষ ও সহানুভূতির এক আশ্চর্য সংমিশ্রণ ঘটেছে তাঁর কবিতায়, যার দীপ্তি ও দ্যোতনা আমাদের গোটা জীবন জুড়ে ছড়িয়ে যায়।

লাল কাঁকড়ার জন্য ভিআইপি রাস্তা, যেখানে মানুষের চলাচল নিষিদ্ধ

৫ কোটি লাল কাঁকড়ার জন্য ভিআইপি রাস্তা, সেখানে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে নোটিশ বোর্ড। এই রাস্তায় আর মানুষ যেতে পারবে না। যান চলাচল একেবারেই নিষিদ্ধ। এমনকি মানুষের বাইরে বেরোনোর সময়সীমাও বেঁধে দেওয়া হয়েছে। সেই অনুযায়ী পরিবর্তন করা হয়েছে অফিস টাইম। ভাবছেন সামান্য কাঁকড়ার জন্য এত কিছু? হ্যাঁ এটাই সত্যি। পৃথিবীর এই জায়গায় মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার চেষ্টা করে। বছরের অন্যান্য দিনে যে রাস্তা দিয়ে মানুষ অত্যন্ত ব্যস্ত ভাবে গাড়ি চালিয়ে যান কিংবা হেঁটে যান সেই রাস্তা কয়েক মাসের জন্য বন্ধ থাকে। সেই রাস্তা দিয়ে চলাফেরা করে শুধু লাল কাঁকড়ার দল। দেখলে মনে হবে বৃষ্টি ভেজা পথে কেউ যেন প্রকৃতির লাল গালিচা বিছিয়ে দিয়েছে। অক্টোবর-নভেম্বর মাসে লাল চাদরে মুড়ে যায় অস্ট্রেলিয়ার এই জায়গা।

ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা থেকে ৩৫০ কিলোমিটার দক্ষিণে ক্রিসমাস দ্বীপ। অস্ট্রেলিয়ার অধীনে থাকা দ্বীপটির আয়তন ১৩৫ বর্গ কিলোমিটার। সেই দ্বীপের সৈকতের হলুদ বালি আর পাশের পিচ ঢালা রাস্তার রংও এখন লাল। কারণ সেখানে ভিড় করেছে কোটি কোটি কাঁকড়া। ভারত মহাসাগরের নীল জল এখন হয়ে গিয়েছে লাল!

ক্রিসমাস দ্বীপে হাজার দু’য়েক মানুষের পাশাপাশি সেখানে রয়েছে প্রায় ৫ কোটি কোটি লাল কাঁকড়া। তাদের জন্য দ্বীপের এক বিস্তীর্ণ বনাঞ্চল- ‘ক্রিসমাস আইল্যান্ড ন্যাশনাল পার্ক’ সংরক্ষিত রয়েছে।

ভারত মহাসাগরের ঐ দ্বীপে বর্ষার মৌসুম সাধারণত আসে অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে। আর সেই সময় থেকই উপকূলের জঙ্গলে গর্ত খুঁড়ে ডেরা বেঁধে থাকা লাল কাঁকড়ার দল সমুদ্রে পাড়ি দেয়! কারণ, এটি তাদের প্রজননের সময়। কাঁকড়াদের এ বার্ষিক পরিযান দেখতে সে সময় ক্রিসমাস দ্বীপে ভিড় জমান দেশ-বিদেশের পর্যটক আর প্রাণিবিজ্ঞানীরা।

সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে নির্দিষ্ট কিছু পথ ধরে সমুদ্রের তীরে পৌঁছায় কাঁকড়ার দল। তাৎপর্যপূর্ণভাবে প্রথম সারিতে থাকে পুরুষ কাঁকড়ারা। তারা গিয়ে সৈকতের বালি খুঁড়ে তৈরি করে বাসা। ততক্ষণে পৌঁছে যায় স্ত্রী কাঁকড়ারাও। প্রজননের পরে পুরুষ কাঁকড়ারা ফের জঙ্গলে ফিরে যায়। স্ত্রীরা থেকে যায় আরো কিছুদিন। সমুদ্রের অগভীর জলে ডিম পাড়ার পরে তাদের ছুটি।

তিন-চার সপ্তাহ পরে সেই ডিম ফুটে বের হয়ে ছানা কাঁকড়ারা। এরপর দল বেঁধে জঙ্গলে ফিরতে শুরু করে তারা। সবাই অবশ্য ফিরতে পারে না। পাখি বা সাপেদের খাদ্যে পরিণত হয়। যারা ফেরে তারা গর্ত খুঁড়ে জঙ্গলে বানাতে হয় ডেরা। এরপর শুরু হয় তিন বছরের প্রতীক্ষা। পরিণত হওয়ার পরে আবার এক অক্টোবরের শেষে সঙ্গী বা সঙ্গিনীর খোঁজে সাগরপারে পাড়ি দেয় কাঁকড়ার দল।

উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী ও কালাজ্বর

একজন বৈজ্ঞানিকের জীবনে যথেষ্ট অনিশ্চয়তা থাকে। অতীতে এমন অনেক বৈজ্ঞানিক ছিলেন বা এখনো আছেন, যাঁরা নিজেদের সারাজীবন ধরে গবেষণা করে গিয়েছিলেন বা এখনো গবেষণা করে চলেছেন, কিন্তু তেমন কিছু চমকপ্রদ আবিষ্কার করবার ভাগ্য তাঁদের হয় নি। আবার এমন অনেক বৈজ্ঞানিক ছিলেন বা এখনো আছেন, তাঁরা যা কিছুতেই হাত দিয়েছিলেন বা দিয়েছেন, তাতেই তাঁরা সফল হয়েছিলেন বা হয়েছেন। ডাঃ উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী এমনি একজন ভাগ্যবান বৈজ্ঞানিক ছিলেন। ১৮৭৩ সালের ১৯শে ডিসেম্বর তারিখে জামালপুরে উপেন্দ্রনাথের জন্ম হয়েছিল। সেখানে তাঁর পিতা ‘নীলমণি ব্রহ্মচারী’ রেলওয়ের ডাক্তার ছিলেন। স্কুল জীবন থেকেই উপেন্দ্রনাথের প্রতিভা ও তীক্ষ্ণ বুদ্ধির পরিচয় পাওয়া গিয়েছিল। তাঁর কলেজ জীবন কেটেছিল হুগলী কলেজে। সেখান থেকে তিনি বি. এ. পরীক্ষায় গণিতে অনার্সে প্রথমস্থান অধিকার করেছিলেন। এরপরে তিনি কলকাতায় রসায়ন নিয়ে এম. এ. ক্লাসে ভর্তি হয়েছিলেন। তাঁর পিতার ইচ্ছা ছিল যে, তাঁর প্রতিভাবান পুত্র যেন তাঁর মতোই চিকিৎসক হন। কিন্তু চিকিৎসা-বিদ্যায় উপেন্দ্রনাথের ঠিক ততটা উৎসাহ ছিল না, যতটা গণিত ও রসায়নের প্রতি ছিল। তবে তাঁর পিতার ইচ্ছাই শেষ পর্যন্ত পূর্ণ হয়েছিল। উপেন্দ্রনাথ কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে একথা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে যে, উপেন্দ্ৰনাথ যেদিন মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন, সেদিন দেশের জন্য এক শুভদিন সূচিত হয়েছিল, এবং সেজন্য উপেন্দ্রনাথেরও কোনোদিন অনুতাপ করবার কোনো কারণ ঘটেনি। একজন মানুষের জীবনে যা যা কাম্য থাকে – অর্থাৎ অর্থ, যশ, লোকের কৃতজ্ঞতা – সেসব কিছুই তিনি লাভ করেছিলেন। রসায়নশাস্ত্রে জ্ঞান ও চিকিৎসাবিদ্যার ব্যবহারিক নৈপুণ্য তাঁর গবেষণার ক্ষেত্রে বিশেষ সহায়ক হয়েছিল। মেডিক্যাল কলেজে পড়বার প্রথম বছরে তিনি এম. এ. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। সেই পরীক্ষাতেও তিনি প্রথম শ্রেণী লাভ করেছিলেন। ১৮৯৯ সালে ‘এম. বি.’ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। তাতে মেডিসিন ও সার্জারি – এই দুটি বিষয়েই তিনি প্রথম হয়েছিলেন। সেকালের কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের ইতিহাসে প্রধান দুটি বিষয়ে প্রথম হওয়ার কৃতিত্ব খুব অল্প লোকেরই ছিল। এরপরে ১৯০২ সালে তিনি ‘এম. ডি.’ ও ১৯০৪ সালে ‘পি. এইচ. ডি.’ ডিগ্রি লাভ করেছিলেন। ‘এম. বি.’ পাস করবার পরেই ডাঃ ব্রহ্মচারী ‘বেঙ্গল মেডিক্যাল সার্ভিসে’ যোগ দিয়েছিলেন। প্রথমে তিনি ঢাকার মেডিক্যাল স্কুলে ‘প্যাথলজি’ ও ‘মেটেরিয়ামেডিকা’র শিক্ষক হিসেবে কাজ শুরু করেছিলেন। ১৯০৫ সালে তিনি ‘ক্যাম্পবেল মেডিক্যাল স্কুলে’ বদলি হয়ে এসেছিলেন। তারপরে সেখানেই তাঁর কর্মবহুল জীবনের অনেকগুলি বছর অতিবাহিত হয়েছিল। ১৯২৩ সালে ডাঃ ব্রহ্মচারী কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে অতিরিক্ত চিকিৎসক হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন। তিনিই মেডিক্যাল কলেজের ইতিহাসের প্রথম ব্যক্তি ছিলেন, যিনি একজন ‘আই. এম এস.’ না হয়েও ওই পদে নিযুক্ত হয়েছিলেন। সেই একই সময়ে আরো দু’জন ভারতীয় চিকিৎসক মেডিক্যাল কলেজে অবৈতনিক চিকিৎসক হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন। তাঁরা ছিলেন ‘স্যার কৈলাসচন্দ্র বসু’ ও শস্ত্রচিকিৎসক ‘মেজর হাসান সুরাবর্দি’। ডাঃ ব্রহ্মচারী ১৯২৭ সালে সরকারী কাজ থেকে অবসর গ্রহণ করেছিলেন। তারপরে তিনি ‘কারমাইকেল মেডিক্যাল কলেজে’ কর্মরত ছিলেন। একই সাথে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ-রসায়নের অধ্যাপক পদেও নিযুক্ত হয়েছিলেন। ১৯৪৬ সালের ৬ই ফেব্রুয়ারি তারিখে ৭২ বছর বয়সে এই অনলস বৈজ্ঞানিকের জীবনাবসান ঘটেছিল।
ক্যাম্পবেল মেডিক্যাল স্কুলে কাজ করবার সময়ে, ১৯২০ সালে ডাঃ ব্রহ্মচারী ‘ইউরিয়া স্টিবেমাইন’ (Urea Stibamine) আবিষ্কার করেছিলেন। তাঁর সেই আবিষ্কারের ফলে লক্ষ্য লক্ষ্য মানুষের জীবন রক্ষা পেয়েছিল। সেই সময়ে ম্যালেরিয়ার মতো কালাজ্বরের কবলে পড়েও বাংলা ও আসামের হাজার হাজার মানুষ প্রতি বছর প্রাণ হারাতেন। কালাজ্বর তখন নিশ্চিত মৃত্যুর পরওয়ানা নিয়ে হাজির হত, কারণ, সেই রোগের তখন কোনো সুচিকিৎসাই ছিল না। অতীতের একটা সময়ে কালাজ্বরকে ম্যালেরিয়ারই অন্য রূপ বলে মনে করা হত। ১৯০০ সালে ‘লেইসমান’ (Leishman) প্রথম কালাজ্বরের জীবাণু আবিষ্কার করেছিলেন। তারপরে ১৯০৩ সালে ‘ডনোভেন’ও (Donovan) সেই জীবাণুর অস্তিত্ব প্রমাণ করেছিলেন। পরবর্তী সময়ের বৈজ্ঞানিকেরা প্রমাণ করেছিলেন যে ‘স্যাণ্ডফ্লাই’ (Sandfly) নামক এক ধরণের মাছি সেই রোগকে একজনের দেহ থেকে অন্যজনের দেহে ছড়িয়ে দেয়। ১৯১৫ সালে ‘রজার্স’ কালাজ্বরের চিকিৎসার জন্য প্রথম অ্যান্টিমনির (Antimony) ব্যবহার করেছিলেন। কিন্তু অধিক পরিমাণে সেই ওষুধ ব্যবহারে রোগীর দেহে বিষক্রিয়া দেখা দিত, আবার অল্প পরিমাণে ব্যবহার করলে কোন ফলই হত না। ডাঃ ব্রহ্মচারীর ‘ইউরিয়া স্টিবেমাইন’ যদিও অ্যান্টিমনি থেকেই তৈরি ছিল, তবুও সেই ওষুধ সব ধরণের দোষ থেকে মুক্ত ছিল। অতএব আবিষ্কারের অল্পদিনের মধ্যেই ইউরিয়া স্টিবেমাইনই ভারতে কালাজ্বরের একমাত্র ওষুধ হয়ে উঠেছিল। ইতিহাস বলে যে, ‘ক্রিস্টোফারস’ (S. R. Christophers), ‘শর্ট’ (H. E. Shortt), ‘ব্যারড’ (P. G. Barraud)-কে নিয়ে গঠিত ‘ভারতীয় কালাজ্বর কমিশন’ কেবলমাত্র ইউরিয়া স্টিবেমাইন ব্যবহার করেছিল। ওই ওষুধ আবিষ্কারের ফলে উপেন্দ্রনাথ চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছেন। ইউরিয়া স্টিবেমাইনের জন্য তিনি খ্যাতি ও সম্মান অজস্রভাবে লাভ করেছিলেন, প্রচুর অর্থও উপার্জন করেছিলেন। তবে একটু বললে সম্ভবতঃ কালাজ্বরের মত ভীষণ রোগের বিরুদ্ধে ডাঃ ব্রহ্মচারীর লড়াইকে অতি সরলীকরণ করা হয়ে যায়। সেজন্য ব্যাপারটা বিস্তারে আলোচনা করবার প্রয়োজন রয়েছে।
কল্পনা করুন ১৯২৩ সালের ১০ই সেপ্টেম্বর তারিখের সেই মর্মান্তিক দৃশ্য, যখন মারা যাচ্ছিলেন ‘সুকুমার রায়’। পরলোকের পথে পা বাড়িয়ে দেওয়া সেই পুত্রের পায়ের উপরে মুখ গুঁজে বসেছিলেন তাঁর বিধবা মা – ‘বিধুমুখী দেবী’। সুকুমারের স্ত্রী ‘সুপ্রভা দেবী’ তাঁর মাথার কাছে একটা ছোট টুলে বসেছিলেন, তাঁর মুখে কথা ছিল না, তাঁর বন্ধ চোখ থেকে বইছিল জলের ধারা। সুকুমারের মৃত্যু এসেছিল মাত্র পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে, বাংলা শিশু সাহিত্যে তাঁর অবিস্মরণীয় গ্রন্থ ‘আবোল তাবোল’ ছেপে বেরনোর ঠিক ন’দিন আগে। সুকুমার রায়ের রোগের নাম ছিল ‘কালাজ্বর’। ততদিনে কিন্তু কালাজ্বরের দিশি ওষুধ ইউরিয়া স্টিবামাইন বেরিয়ে গিয়েছিল। ১৯২২ সালের অক্টোবর মাসে, সুকুমারের মৃত্যুর প্রায় এক বছর আগেই, সেই ওষুধের অবিষ্কর্তা ডাঃ উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী ‘ইন্ডিয়ান জার্নাল অব মেডিক্যাল রিসার্চে’ সেই ওষুধের সফল প্রয়োগের কথা লিখেছিলেন। তা সত্ত্বেও সুকুমার কেন সেই ওষুধ পাননি? সম্ভবতঃ সেটার পিছনের একমাত্র কারণ ছিল যে, কলকাতার সাহেব ডাক্তাররা তখনও সেই ওষুধকে ছাড়পত্র দেননি। সুকুমারের চিকিৎসা করছিলেন তাঁরই ঘনিষ্ঠ আত্মীয়, মেয়ো হাসপাতালের অধ্যক্ষ, ‘দ্বিজেন্দ্রনাথ মৈত্র’। তিনি ক্যাম্বেল মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষক-চিকিৎসক উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারীর আবিষ্কারের কথা জানতেন কি না, কে জানে। তবে ‘লীলা মজুমদারের’ লেখা থেকে জানা যায় যে, “সেবাযত্ন, ওষুধপত্রের কোনও ত্রুটি হয়নি।” কিন্তু সেই ওষুধ কী ছিল, তা অবশ্য জানা যায় না। ঊনবিংশ আর বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে ব্রিটিশ অধ্যুষিত ভারতে মহামারি লেগেই থাকত। কখনো বন্যা, কখনো খরা, আবার কখনো বা ম্যালেরিয়া- কলেরা-কালাজ্বর। ‘স্যার রোনাল্ড রস’ এই ভারতেই গবেষণা করে ‘ম্যালেরিয়া’ যে মশাবাহিত রোগ সেটা আবিষ্কার করেছিলেন। তাঁর সেই আবিষ্কার ম্যালেরিয়ার কিছুটা প্রকোপ কমালেও কালাজ্বরের উপদ্রব থেকে ভারতবাসীর তখনও পর্যন্ত রেহাই ছিল না। বাংলা, বিহার আর আসামের গ্রামের পর গ্রাম জনপদ শূন্য হয়ে গিয়েছিল সেই রোগের কবলে পড়ে। জনগণের কথা ভেবে, ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল সার্ভিস তখন স্যার রোনাল্ড রসকে কালাজ্বরের ওষুধ আবিষ্কারের জন্য নিযুক্ত করেছিল। কিন্তু তিনি তখন ম্যলারিয়ার জীবাণু আবিষ্কার করবার পরে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। তাই সেই নতুন দায়ভার নেওয়ার মত মানসিক অবস্থা তখন তাঁর ছিল না। শেষ পর্যন্ত কালাজ্বরের ওষুধ আবিষ্কার করে ডাঃ ব্রহ্মচারী সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। আগেই বলা হয়েছে যে, উপেন্দ্রনাথ কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ থেকে ডাক্তারি পাশ করে ‘প্রভিন্সিয়াল মেডিক্যাল সার্ভিসে’ যোগদান করেছিলেন। কিন্তু তাঁর আসল কাজ শুরু হয়েছিল কলকাতার ক্যাম্পবেল মেডিক্যাল কলেজে যোগদান করবার পরে। সেই কলেজেই ডাঃ ব্রহ্মচারী ভারতের মত গ্রীষ্মপ্রধান দেশের বিভিন্ন দুরারোগ্য মারনব্যাধির নিরাময় সংক্রান্ত গবেষণায় নিমজ্জিত হয়েছিলেন। বলা বাহুল্য যে, রসায়ন শাস্ত্রে তাঁর অগাধ নৈপুণ্য তাঁকে সেই ব্যাপারে বেশ সাহায্য করেছিল। ওই মেডিক্যাল কলেজের এক অন্ধকার ল্যাবরেটরিতেই তিনি কালাজ্বরের ওষুধ আবিষ্কার করেছিলেন। ক্যাম্পবেল কলেজের সেই ল্যাবরটেরিতে কোন ন্যূনতম সুযোগ সুবিধা পর্যন্ত ছিল না। সেখানে না ছিল বুন্সেন বার্নার, আর না ছিল ইলেকট্রিক বাতি। লন্ঠনের অল্প আলোয় আলোকিত সেই ল্যাবে কাজ করেই একদিন রাত দশটা নাগাদ তিনি তাঁর বহু প্রত্যাশিত ফল পেয়েছিলেন। সেটা ছিল একটি রায়ায়নিক পদার্থ – যেটা কালাজ্বরের জীবাণুকে দহনে সক্ষম ছিল। গবেষণাগারের ঐসব প্রতিকূলতা ডাঃ ব্রহ্মচারীর মনোবলকে এতটুকু ক্ষুণ্ণ করতে পারে নি। সেই আবিষ্কারের অনেকদিন পরে তিনি মন্তব্য করেছিলেন, “ওই ল্যাবরেটরি আমার কাছে তীর্থস্থানের সমান।” কিন্তু কিভাবে তিনি সফল হয়েছিলেন কালাজ্বরের ওষুধ আবিষ্কারে? সে গল্প নিতান্তই অনুপ্রেরনাদায়ক।
ভারতে কালাজ্বর রোগটা প্রথমে ধরা পড়েছিল পশ্চিমী ডাক্তারদের হাতে, সম্ভবতঃ ১৮২৪ সালে বর্তমান বাংলাদেশের যশোর শহরে। কিন্তু প্রথমে তাঁরা সেই রোগকে ম্যালেরিয়া বলে ভুল করেছিলেন। ওই রোগের প্রধান লক্ষণগুলো ছিল – যকৃৎ ও প্লিহার বৃদ্ধি, গুমো জ্বর, রক্তাল্পতা আর ‘শরীরে কালো রঙের দাগ (যে কারণে ওই রোগের নাম দেওয়া হয়েছিল কালাজ্বর)। ১৯০৩ সালে ‘চার্লস ডোনোভেন’ কালাজ্বরের জীবাণু আবিষ্কারের পরে তাঁর ও উইলিয়াম লাইশম্যানের নামানুসারে সেই প্রোটোজোয়ার নাম দেওয়া হয়েছিল – ‘লাইশম্যান ডোনভানি’। যাই হোক, সেই সময়ে কালাজ্বরের উপশমের জন্য যে কয়টি ওষুধ জানা ছিল সেগুলোর কোনটাই খুব একটা কাজ করত না। যেমন – ‘টারটার এমেটিক’ (‘অ্যান্টিমনি টারটারেটের পটাসিয়াম লবণ’) কালাজ্বর আক্রান্তের শিরায় প্রয়োগ করা হত। কিন্তু বহুদিন ধরে সেই ওষুধ নিলে আক্রান্তের মধ্যে বেশ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যেত। তাছাড়া ওই ওষুধগুলো সব সময় টাটকা বানাতে হত, সেগুলো সংরক্ষণের বেশ অসুবিধা ছিল, আর বানাতেও বেশ কাঠখড় পোড়াতে হত। উপরন্তু, ঠিকমত সাবধানতা অবলম্বন না করলে শিরায় ইঞ্জেকশন দেওয়ার সময়ে তখন অন্য রোগের সংক্রমনের সম্ভাবনাও প্রবল ছিল। তাই ডাঃ ব্রহ্মচারী ঠিক করেছিলেন যে সেটার কিছু একটা বিহিত করতে হবে। তখন দরকার ছিল সহজলভ্য কার্যকরী কালাজ্বরের ওষুধ। সেই সময়ে বৈজ্ঞানিক মহলে অ্যান্টিমনির কিছু অজৈব রাসায়নিকের বিষক্রিয়ার কথা জানা ছিল। তাই ডাঃ ব্রহ্মচারী মনস্থির করেছিলেন যে, অ্যান্টিমনির সেই রাসায়নিকগুলো দিয়েই তিনি কালাজ্বরের জীবাণুদের নিধন করবেন। সেই মত কিছু কিছু কম্পাউন্ডও তৈরি করেছিলেন। সেগুলো প্রয়োগে কিন্তু আশানুরূপ কোন ফল হয় নি। তারপরে তিনি অজৈব এন্টিমনি পদার্থ থেকে জৈব পদার্থের দিকে নিজের চোখ ফিরিয়েছিলেন। সেই সময়ে তিনি ‘স্টিবানিলিক অ্যাসিডের’ নানান লবণ তৈরি করেছিলেন। একটার পর একটা পদার্থের বিষক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। কিন্তু সেখানেও তিনি অসফল হয়েছিলেন। সেই অসফলতা সত্ত্বেও কিন্তু তিনি ভেঙ্গে পড়েন নি। তিনি অন্য কোন রাস্তার কথা ভাবতে শুরু করেছিলেন। এরপরেই তাঁর মাথায় এসেছিল যে ‘ইউরিয়া’কে অন্য কোন ওষুধের সাথে প্রয়োগ করলে সেটা ব্যথা নিরাময়ের কাজ করে। তিনি ভেবেছিলেন যে, এন্টিমনির লবণগুলো আর ইউরিয়াকে মেশালে কেমন হয়! তারপরে তিনি সেই কাজ শুরু করেছিলেন। এরপরে একটা সময়ে তিনি ইউরিয়া আর স্টিবানিলিক অ্যাসিডকে একসাথে মিশিয়ে তাপপ্রয়োগ করেছিলেন। তাতেই সফলতা এসেছিল। তৈরি হয়েছিল ‘ইউরিয়া স্টিবামাইন’। ডাঃ ব্রহ্মচারী এবং ইন্ডিয়ান মেডিকেল সার্ভিসের শ্রট সাহেব দেখেছিলেন যে, সেই নতুন পদার্থ কালাজ্বরের জীবাণু মারতে দিব্যি সক্ষম। শুধু তাই নয়, সেটার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াও অনেক কম। এরপরে তাঁর সেই নতুন আবিষ্কারের কথা সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়েছিল। দিকে দিকে কালাজ্বরের নিরাময়ের জন্য সেই ওষুধ প্রয়োগ হতে শুরু হয়েছিল। ফলও এসেছিল হাতেনাতে। ধীরে ধীরে সেই রোগের প্রকোপে মৃত্যুর সংখ্যা কমতে শুরু হয়েছিল। এই প্রসঙ্গে আসামের তদানীন্তন গভর্নর, ‘স্যার জন কের’ তাঁর বিদায়কালীন সম্ভাষণে বলেছিলেন, “কালাজ্বর সংক্রান্ত ডাঃ ব্রহ্মচারীর গবেষণা নিঃসন্দেহে এক উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব। তাঁর এই কাজের জন্যই আসামে গত দশ বছরে অন্তত তিন লাখ লোক এই রোগের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে।” এরপর থেকেই চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসে কালাজ্বর আর উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী – দুটি অচ্ছেদ্য নাম হয়ে গিয়েছিল। উপেন্দ্রনাথকে তাঁর সফলতার জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘কোটস’ পদক, স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিনের ‘মিন্টো-পদক’, এশিয়াটিক সোসাইটির ‘স্যার উইলিয়ম জোন্‌স ও বার্কলে’ পদক, ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে ‘কাইজার-ই-হিন্দ’ পদক দেওয়া হয়েছিল। এছাড়াও ব্রিটিশ সরকার তাঁকে ‘রায় বাহাদুর’ ও ‘নাইটহুড’ উপাধি দিয়ে সম্মানিত করেছিল। তিনি ১৯৩৬ সালে অনুষ্ঠিত ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের সাধারণ সভাপতি হয়েছিলেন। ডাঃ ব্রহ্মচারী প্রথম বাঙালি ও ভারতীয় চিকিৎসক ছিলেন যিনি মূল কংগ্রেসের সভাপতি হতে পেরেছিলেন। তাঁর আগে অবশ্য একজন ভারতীয় চিকিৎসক মূল কংগ্রেসের সভাপতি হয়েছিলেন, তিনি ছিলেন অধ্যাপক ‘শিবরাম কাশ্যপ’। যদিও কাশ্যপ আগ্রা মেডিক্যাল স্কুল থেকে ডিপ্লোমা নিয়ে কিছুদিন চিকিৎসাবৃত্তি চালিয়েছিলেন, কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই তিনি একজন উদ্ভিদ বিজ্ঞানীরূপে যশস্বী হয়ে উঠেছিলেন, এবং লাহোর গভর্ণমেন্ট কলেজে উদ্ভিদবিদ্যার অধ্যাপক হয়েছিলেন। তাঁর জীবন উদ্ভিদবিদ্যার চর্চায় কেটেছিল, অতএব তাঁকে চিকিৎসক বলা চলে না। ডাঃ ব্রহ্মচারীর আগে কংগ্রেসের মূল সভাপতিদের মধ্যে তিনজন চিকিৎসক ছিলেন, আর সেই তিনজনই ছিলেন বিদেশী। ১৯২৯ সালে অনুষ্ঠিত ‘রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গলের’ একটি সভার সভাপতির ভাষণে ডাঃ ব্রহ্মচারী বলেছিলেন, “ক্যাম্পবেল হাসপাতালের সেই রাতটির কথা মনে হলে এখনো আনন্দ হয়। রাত দশটায়, কেরোসিনের ক্ষীণ আলোয় ধূমাচ্ছন্ন ঘরের ভিতর আমার গবেষণার প্রথম ফল প্রত্যক্ষ করলাম। তখনো জানতাম না, ঈশ্বর আমার হাতে এমন এক তামোঘ অস্ত্র দিয়েছেন যা দিয়ে আমার দেশের লক্ষ লক্ষ লোকের প্রাণ রক্ষা হবে। যে ঘরটিতে আমি দিনের পর দিন, মাসের পর মাস কাজ করেছি, সে ঘরে না ছিল বিজলি বাতি, না ছিল গ্যাস, জলের ট্যাপ। তবু সে ঘর আমার কাছে চিরদিন তীর্থস্থান হয়ে থাকবে।” বর্তমানে নিজেদের অক্ষমতা ঢাকার জন্য অধিকাংশ মানুষই সময় সুযোগ সুবিধার অভাবের দোহাই দিয়ে থাকেন। একথা অবশ্য ঠিক যে, জটিল বৈজ্ঞানিক গবেষণায় সূক্ষ্ম যন্ত্রপাতি একান্ত দরকার হয়। কিন্তু যে সব উপকরণ হাতে থাকে, সেগুলিকেও কি পুরোপুরি কাজে লাগানো সম্ভব নয়! উপেন্দ্রনাথ প্রমাণ করে দিয়েছিলেন যে প্রতিভা, সংকল্প ও সহিষ্ণুতা থাকলে নানা অসুবিধার মধ্যেও সার্থকভাবে কাজ করা যায়। কালাজ্বরের উপর উপেন্দ্রনাথ বেশ কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। ‘Kala- azar: Its treatment’ (১৯১৭), ‘A Treatise on Kala-azar’ (১৯২৮), ‘Gleanings from My Researches’ (১৯৪০) গ্রন্থগুলি আজও তাঁর গবেষণালব্ধ অভিজ্ঞতার সাক্ষ্য বহন করে চলছে।

পরিশেষে, আরেকবার চলে যাওয়া যাক ১৯২৯ সালে। জায়গাটা ছিল সুইডেনের ‘ক্যারলিন্সকা ইন্সটিটিউট’। বিশ্বের তাবড় তাবড় চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের মধ্য থেকে কে বা কারা চিকিৎসাশাস্ত্রে ‘নোবেল’ পুরস্কার পাবেন, সেটা তখন ওই প্রতিষ্ঠানের অধ্যাপকেরা ঠিক করতেন, আর আজও তাঁরাই ঠিক করেন। সেই বছর চিকিৎসাশাস্ত্রে নোবেলের মনোনয়ন ঘাঁটতে ঘাঁটতে সেখানকার অধ্যাপকদের হাতে এক ভারতীয় চিকিৎসকের নাম উঠে এসেছিল, যিনি কিনা কলকাতার ক্যাম্পবেল মেডিকেল কলেজে (এখনকার ‘এন. আর. এস. মেডিক্যাল কলেজ’) গবেষণা করে কালাজ্বরের ওষুধ – ইউরিয়া স্টিবেমাইন আবিষ্কার করেছিলেন। খোদ ব্রিটিশ সরকারের রিপোর্ট জানিয়েছিল যে, সেই ওষুধ লক্ষ লক্ষ কালাজ্বরে আক্রান্ত মানুষকে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে এনেছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে সেই বছরের চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল ‘ক্রিশ্চিয়ান আইজম্যান’ এবং ‘ফ্রেড্রিক হপকিন্স’ সাহেবদের – পুষ্টিপ্রদায়ক ভিটামিন আবিষ্কারের জন্য। ডাঃ উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী ১৯২৯ সালে বা তার পরবর্তী কোন বছরেই আর নোবেল পান নি। কিন্তু তিনি লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণ রক্ষা করতে পেরেছিলেন। সেই উপলব্ধি সম্ভবতঃ তাঁর কাছে হাজার নোবেল পুরস্কারের থেকেও অনেক বেশি দামি ছিল। তাঁর সেই কাজ গোটা বিশ্বের মানুষের কাছে আশীর্বাদ স্বরূপ হয়ে উঠেছিল।

পৃথিবীর সত্যিকারের পাতাল MariyanaTrench

বাংলাহান্ট ডিজিটালঃ হিমালয় পর্বতের মাউন্ট এভারেস্টের শৃঙ্গ পৃথিবীর সবথেকে উঁচু যায়গা আর এর উচ্চতা প্রায় ৯ কিলোমিটারের কাছাকাছি। কিন্তু আপনি কি জানেন পৃথিবীর গভীরতম স্থান কোনটি ?

এটা বোধহয় অনেকেই জানে না। সমুদ্রের গভীরতম একটি স্থানই হবে বিশ্বের গভীরতম যায়গা, এটাই স্বাভাবিক,তাই না?

আরো পড়ুন- ৩৬ বছর পর বিশ্বকাপ জিতল আর্জেন্তিনা, বিশ্বরেকর্ড করলেন মেসি

সমুদ্রের তলদেশের ‘ভি’ আকৃতির এই রকম গভীরতম স্থান গুলোকে পরিখা বা ট্রেঞ্চ বলা হয়ে থাকে। পৃথিবীর প্রতিটি সাগর মহাসাগরেই এরকম অসংখ্য ট্রেঞ্চ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।

পৃথিবীর সবথেকে গভীরতম ট্রেঞ্চ হোল মারিয়ানা ট্রেঞ্চ (MariyanaTrench)। পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরের তলদেশে মারিয়ানা দ্বীপপুঞ্জের পূবদিকে জাপানের কাছে এটি শুয়ে আছে ২৫৫০ কিলোমিটার লম্বা আর মাত্র ৬৯ কিলোমিটার প্রশস্ত জায়গা জুড়ে । এই পরিখার গভীরতা ১১.০৩ কিলোমিটার।

অর্থাৎ আস্ত একটি মাউন্ট এভারেস্ট এই ট্রেঞ্চে ঢুকে যাবে নির্দিধায় তারপরেও ২.১৯ কিলোমিটার অথৈ জল খেলা করবে এই শৃঙ্গের মাথার উপর দিয়ে।

এখানে জলের চাপ এতই বেশি যে একটা শক্তিশালী জাহাজ নামিয়ে দিলেও মুহূর্তেই ডিমের খোলসের মতোই ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাবে।

এই ট্রেঞ্চের তলদেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা হল ৩০০ ডিগ্রী সেলসিয়াস। এত গরম যা কল্পনাও করা যায় না। কিন্তু প্রতিনিয়ত আশেপাশের হিমশীতল জল এসে এতে মিলিত হবার কারণে এই গরমেও জল বাষ্পীভূত হয় না।

এবার নিশ্চয়ই সত্যিকার পাতাল বলতে আমরা মারিয়ানা ট্রেঞ্চকেই বোঝাতে পারি।

মারিয়ানা ট্রেঞ্চের অপেক্ষাকৃত উপর দিকে, ডাম্ব অক্টোপাস,হেচেট মাছ, বিভিন্ন জেলিফিশ সহ অনেক আশ্চর্যজনক মাছ ও জলজ প্রাণী বসবাস করে। ট্রেঞ্চের গভীরে গহীন আঁধারের কারনে এদের অনেকের দেহ থেকেই আলো বিচ্ছুরিত হয়।

‘Autophagy’ কি? অটোফেজি বা উপবাসের উপকারিতা কি

হিন্দু বা বৌদ্ধরা না খেয়ে থাকলে তাকে বলা হয় “উপবাস”। খ্রিস্টানরা না খেয়ে থাকলে তাকে বলা হয় ‘’ফাস্টিং”। মুসলিমরা রোজা রাখলে তাকে বলা হয় “সিয়াম”। বিপ্লবীরা না খেয়ে থাকলে তাকে বলা হয় ‘’অনশন”। আর, মেডিক্যাল সাইন্সে উপবাস করলে, তাকে বলা হয় “অটোফেজি” (Autophagy)।

২০১৬ সালে নোবেল কমিটি জাপানের ডাক্তার ‘ওশিনরি ওসুমি’-কে অটোফেজি আবিষ্কারের জন্যে পুরষ্কার দেন ।

আরো পড়ুন- বাঙালীর সমাজ ও জাতিবিন্যাসের বিবর্তন

যাই হোক, ‘Autophagy‘ কি ?

Autophagy শব্দটি একটি গ্রিক শব্দ ।
Auto অর্থ নিজে নিজে এবং Phagy অর্থ খাওয়া ।
সুতরাং, অটোফেজি মানে নিজে নিজেকে খাওয়া ।

মেডিক্যাল সাইন্স থেকে জানা যায়, শরীরের কোষগুলো বাইরে থেকে কোনো খাবার না পেয়ে, নিজেই যখন নিজের অসুস্থ কোষগুলো খেতে শুরু করে, তখন মেডিক্যাল সাইন্সের ভাষায় তাকেই অটোফেজি বলা হয়।

আরেকটু সহজভাবে বলি –

আমাদের ঘরে যেমন ডাস্টবিন থাকে, অথবা আমাদের কম্পিউটারে যেমন রিসাইকেল বিন থাকে, তেমনি আমাদের শরীরের প্রতিটি কোষের মাঝেও একটি করে ডাস্টবিন আছে ।

সারা বছর শরীরের কোষগুলো খুব ব্যস্ত থাকার কারণে, ডাস্টবিন পরিষ্কার করার সময় পায় না। ফলে, কোষগুলোতে অনেক আবর্জনা ও ময়লা জমে যায় ।

শরীরের কোষগুলো যদি নিয়মিত তাদের ডাস্টবিন পরিষ্কার করতে না পারে, তাহলে কোষগুলো একসময় নিষ্ক্রিয় হয়ে শরীরে বিভিন্ন প্রকারের রোগের উৎপন্ন করে। ক্যান্সার বা ডায়াবেটিসের মতো অনেক বড় বড় রোগের শুরু হয় এখান থেকেই। মানুষ যখন খালি পেটে থাকে, তখন শরীরের কোষগুলো অনেকটা বেকার হয়ে পড়ে। কিন্তু তারা তো আর অলস হয়ে বসে থাকে না, তাই প্রতিটি কোষ তার ভিতরের আবর্জনা ও ময়লাগুলো পরিষ্কার করতে শুরু করে দেয় ।

কোষগুলোর আমাদের মতো আবর্জনা ফেলার কোন জায়গা নেই বলে, তারা নিজের আবর্জনা নিজেই খেয়ে ফেলে। মেডিক্যাল সাইন্সে এই পদ্ধতিকে বলা হয় অটোফেজি।

শুধুমাত্র এই জিনিসটা আবিষ্কার করেই জাপানের, ওশিনরি ওসুমি ২০১৬ সালে নোবেল পুরস্কারটা পেয়ে গেলেন ।

তিনি আবিষ্কার করেন যে ১২-২৪ ঘন্টা উপবাস রাখলে মানুষের দেহে অটোফেজি চালু হয়।

তিনি প্রমান করেন যে, উপবাস থাকার মাধ্যমে মানুষের নিম্নলিখিত উপকার গুলো হয়-

১| দেহের সেল পরিস্কার হয়।
২| ক্যান্সার সেল ধ্বংস হয়।
৩| পাকস্থলীর প্রদাহ সেরে যায়।
৪| ব্রেইনের কার্যকরীতা বাড়ে।
৫| শরীর নিজে নিজেই সেরে যায়।
৬| ডায়াবেটিস ভালো হয়।
৭| বার্ধক্য রোধ করা যায়।
৮| স্থূলতা দূর হয়।
৯| দীর্ঘ জীবন লাভ করা যায়।

বাঙালীর সমাজ ও জাতিবিন্যাসের বিবর্তন

রানা চক্রবর্তীঃ প্রাচীন যুগে আর্যসমাজ থেকে বাঙলার সমাজসংগঠন সম্পূর্ণ পৃথক ছিল। আর্যসমাজ প্রতিষ্ঠিত ছিল ‘ব্রাহ্মণ’, ‘ক্ষত্রিয়’, ‘বৈশ্য’ ও ‘শূদ্র’ – এই চতুর্বর্ণের ওপরে। সুতরাং ‘বিদেহ’র পূর্বে অবস্থিত ‘প্রাচ্য’ দেশে চতুর্বর্ণ সমাজের অনুপ্রবেশ ঘটেনি। সেখানে যে সমাজ প্রতিষ্ঠিত ছিল, সেটা ছিল ‘কৌমসমাজ’ – বিভিন্ন বৃত্তিধারী জাতিগোষ্ঠীর সমাজ। সে সমাজের মধ্যে ছিলেন নানাবৃত্তিধারী মানুষ। কিন্তু তাঁদের মধ্যে চতুর্বর্ণের বিভেদ না থাকার দরুনই আর্যরা প্রাচ্যদেশের লোকদের ঘৃণার চোখে দেখতেন৷ তবে প্রাক্-আর্যদের প্রতি বৈদিক আর্যদের বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব খুব বেশি দিন টেকেনি। ‘পঞ্চনদের উপত্যকা’ থেকে আর্যরা যতই পূর্বদিকে অগ্রসর হয়েছিল, প্রাক্‌-আর্যজাতিসমূহের সঙ্গে তাঁদের ততই সংমিশ্রণ ঘটেছিল। সেই সংমিশ্রণ মূলতঃ বিবাহের মাধ্যমে ঘটেছিল। ক্রমশঃ আর্যরা প্রাক-আর্যজাতিসমূহের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় রীতিনীতি ও আচার-ব্যবহার অনেক গ্রহণ করতে শুরু করেছিলেন৷ ‘সুত্র’ যুগেই সেই সংমিশ্রণ ও সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান পূর্ণ মাত্রায় ঘটেছিল। প্রাচ্যদেশের লোকদের প্রতি তাঁদের একটা উদার মনোভাব সেই যুগেই সঞ্চারিত হয়েছিল এবং তাঁরা বিধান দিয়েছিলেন যে, যদি কেউ তীর্থ যাত্রা বা অন্য কোনও কারণে প্রাচ্যদেশে যায়, তবে তাঁদের সে দোষ স্খলিত হবে ‘পুনোষ্টম’ বা ‘সর্বপৃষ্টা’ নামক যজ্ঞদ্বারা। কিন্তু পরে এই ‘শুদ্ধিকরণ-বিধানের’ও ক্রমশঃ অবলুপ্তি ঘটেছিল। আগেই বলা হয়েছে যে প্রাচীন বাঙলার সামাজিক সংগঠন ‘কৌমভিত্তিক’ ছিল। বাঙলার জনপদগুলি সেই সকল ‘কৌমজাতি’র নামেই অভিহিত হত। সেই সকল ‘কৌমজাতি’র মধ্যে অন্যতম ছিল – ‘পূন্ড্র’, ‘বঙ্গ’, ‘কর্বট’ প্রভৃতি। গবেষকদের মতে, সেই ‘পূন্ড্র’দের বংশধররাই হচ্ছেন বর্তমানের ‘পোদ’ জাতি। অনুরূপভাবে এটাও অনুমেয় যে, বর্তমান ‘কৈবর্ত’জাতি ‘কর্বট’-কৌমের বংশধর। এইসব জাতি ছাড়া প্রাচীন বাঙলায় আর এক জাতি ছিল। তাঁরা হচ্ছেন ‘বাগ্‌দি’ জাতি। এছাড়া আরও ছিলেন – ‘হাড়ি’, ‘ডোম’, ‘বাউড়ি’ প্রভৃতি জাতির পূর্বপুরুষরা। প্রাচীন গ্রীক লেখকদের রচনাবলী থেকে জানতে পারা যায় যে, ‘মৌর্যদের’ সময় পর্যন্ত ‘বাগ্‌দি’রাই ‘রাঢ়দেশের’ সংখ্যা গরিষ্ঠ জাতি ছিলেন। ‘কৈবর্ত’দের উল্লেখ ‘মনু’র ‘মানবধর্মশাস্ত্র’-এ পাওয়া যায়। ‘মনু’ তাঁদের ‘বর্ণ-সঙ্কর’ বলে অভিহিত করেছিলেন। ‘বিষ্ণুপুরাণ’-এ তাঁদের ‘অব্রাহ্মণ্য’ বলা হয়েছে। গবেষকরা মনে করেন যে, ‘মনু’ অপেক্ষা ‘বিষ্ণুপুরাণ’-এর উক্তিই ঠিক। কারণ বঙ্গদেশের অতি প্রাচীন অধিবাসী হিসাবে ‘কৈবর্ত’দের সংস্কৃতি যে আর্যদের ‘ব্রাহ্মণ্যধর্মবিহিত সংস্কৃতি’ থেকে ভিন্ন ছিল, সে বিষয়ে গবেষকদের কোন সন্দেহ নেই। পরবর্তী কালে ‘পালরাজা’দের সময় ‘কৈবর্ত’-জাতির শক্তির প্রবল অভ্যুত্থান ঘটেছিল। ‘পালরাজা’দের অধীনস্থ এক ‘কৈবর্ত সামন্তরাজ’ ‘দিব্যোক’ তাঁর প্রভুর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে ‘পাল রাজ’ ‘দ্বিতীয় মহীপাল’কে (১০৭০-৭১ খ্রীস্টাব্দ) নিহত করে ‘বরেন্দ্রভূম’ অধিকার করেছিলেন এবং সেখানে কিছুকাল রাজত্বও করেছিলেন। ‘দিব্যোকের’ উত্তরাধিকারী হিসাবে আরও দু’জন ‘কৈবর্তরাজা’ ‘বরেন্দ্রদেশ’ শাসন করেছিলেন। তাঁরা হচ্ছেন ‘রুদোক’ ও ‘ভীম’। সেই সময় কৈবর্তরা খুব শক্তিশালী হয়ে উঠেছিলেন ও সমাজে তাঁরা বেশ গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করতেন। তখন তাঁরা আর ‘অব্রাহ্মণ্য’ বা ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির বাইরে ছিলেন না। বস্তুতঃ তাঁদের মধ্যে অনেকেই তখন ‘ব্রাহ্মণ্যধর্ম ও সংস্কৃতি’ গ্রহণ করেছিলেন এবং সংস্কৃত ভাষায় পারদর্শিতা লাভ করে কবিতা রচনা করতে শুরু করে দিয়েছিলেন। জনৈক ‘কৈবর্ত কবি’ ‘পপিপ’-কর্তৃক রচিত একটি ‘গঙ্গাস্তোত্র’ ‘সদুক্তিকৰ্ণায়ত’ গ্রন্থে উদ্ধৃত হয়েছিল। আর এক জাতি যাঁরা সেই সময় প্রাধান্য লাভ করেছিল, তাঁরা হচ্ছেন বর্তমান ‘সদগোপ’ জাতির পূর্বপুরুষেরা। ‘তাম্রাশ্মযুগ’ থেকেই গ্রামের কৃষিভিত্তিক অর্থনীতিতে তাঁদের গুরুত্বপূর্ণ স্থান ছিল। গবেষকরা মনে করেন যে, ‘দক্ষিণরাঢ়ে’ ‘কৈবর্তদের’ যেমন আধিপত্য ছিল, ‘উত্তররাঢ়ে’ তেমনই ‘সদগোপ’দের প্রাধান্য ছিল। বর্তমানকালে এই দুই জাতির পারস্পরিক অবস্থান থেকে গবেষকদের সেটাই মনে হয়। অবশ্য গবেষকদের এরূপ অনুমান করবার সপক্ষে যথেষ্ট কারণ আছে যে, ‘পাল’ ও ‘শূরবংশীয়’ রাজারা ‘সদগোপ’ ছিলেন। গবেষকরা আরও মনে করেন যে, বাঙলায় ‘তন্ত্রধর্মের’ ব্যাপক প্রচার তাঁদের চেষ্টাতেই হয়েছিল। বস্তুতঃ তাঁরা ‘শিব’ ও ‘শক্তি’র উপাসক ছিলেন। ‘বর্ধমান’ ও ‘বীরভূমের’ অংশবিশেষ নিয়েই ছিল সদগোপদের বাসস্থান – যেটাকে ‘গোপভূম’ বলা হত। সদগোপদের বিভিন্ন শাখা ‘ভালকী’, ‘অমরাগড়’, ‘কাঁকশা’, ‘দিগ্‌নগর’, ‘ঢেক্করী’, ‘মঙ্গলকোট’, ‘নীলপুর’ প্রভৃতি জায়গায় বহু ‘সদগোপ’ রাজ্য স্থাপন করেছিলেন। ‘পালরাজা’দের আধিপত্যের সময় তাঁরা পালরাজাদেরই ‘সামন্তরাজা’ হিসাবে রাজত্ব করতেন। সেই সব ‘সদেগাপরাজা’দের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ‘ইছাই ঘোষ’ বা ‘ঈশ্বর ঘোষ’। খ্রীস্টীয় একাদশ শতাব্দীতে তাঁর আবির্ভাব ঘটেছিল। তিনি ‘পালরাজ’ ‘মহীপালের’ (৯৭৭-১০২৭ খ্রীস্টাব্দ) সমসাময়িক ছিলেন। ‘রামগঞ্জের তাম্রশাসনে’ ‘ইছাই ঘোষের বংশ তালিকা’ পাওয়া যায়। তা থেকে জানতে পারা যায় যে, ‘মহামাণ্ডলিক’ ইছাই (ঈশ্বর) ঘোষের পিতা ছিলেন ‘ধবলঘোষ’ (‘ধর্মমঙ্গলকাব্য’ অনুযায়ী ‘সোমঘোষ’), তাঁর পিতামহ ছিলেন ‘বলঘোষ’ ও প্রপিতামহ ছিলেন ‘ধূর্তঘোষ’। এ থেকে গবেষকদের মনে হয় যে, ‘ধূর্তঘোষ’ খুব সম্ভবতঃ ‘পালরাজ রাজ্যপাল’ বা ‘দ্বিতীয় গোপালের’ সমসাময়িক ছিলেন। ‘অমরাগড়ে’ ইছাই ঘোষের সমসাময়িক ‘সগোপরাজা’ ছিলেন ‘হরিশ্চন্দ্র’। ইছাই ঘোষ ছিলেন ‘ধর্মঠাকুরের উপাসক’ আর ‘হরিশ্চন্দ্র’ ছিলেন ‘ভবানীর উপাসক’। এখানে একথা উল্লেখযোগ্য যে, ‘রামগঞ্জের তাম্রশাসনে’ ইছাই ঘোষের নামের সঙ্গে যে-সকল উপাধিসূচক বিশেষণ প্রয়োগ করা হয়েছিল, সেগুলো পালরাজগণ কর্তৃক ব্যবহৃত উপাধিসমূহকেও হার মানিয়ে দেয়। ‘উত্তররাঢ়ে’ যেমন ‘সদগোপ’দের প্রাধান্য ছিল, তেমনই ‘বাঁকুড়া’ জেলায় ছিল ‘মল্ল’দের প্রাধান্য। তাঁরা প্রাচীন ‘জৈনধর্মাবলম্বী’দের উত্তরপুরুষ ছিলেন কিনা সেটা বিবেচ্য। কেননা, ‘মহাবীর’ ‘মলভার’ বহন করতেন এবং অনেক জৈন অতি গৌরবের সঙ্গে ‘মলধারী’ উপাধি ধারণ করতেন। পরবর্তীকালে অবশ্য ‘মল্ল’ শব্দটি ‘বীর’ শব্দের সমবাচক শব্দ হিসাবেই গণ্য হত। সে যাই হোক, পরবর্তীকালে ‘আদিমল্ল’, ‘জয়মল্ল’, ‘কালুমল্ল’ ও ‘বীর হাম্বীর’ প্রভৃতি মল্লরাজগণের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। যদিও ‘বাঁকুড়া’র ‘বিষ্ণুপুরে’ তাঁদের রাজধানী অবস্থিত ছিল, তথাপি তাঁদের রাজশক্তি উত্তরে ‘সাঁওতাল পরগনা’র ‘দামিন-ই-কো’ থেকে দক্ষিণে ‘মেদিনীপুর’ জেলা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। ‘বর্ধমানের’ অংশবিশেষ ও পশ্চিমে ‘পঞ্চকোট’, ‘মানভূম’ ও ‘ছোটনাগপুরের’ অংশবিশেষও তাঁদের রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এখানে উল্লেখনীয় যে ‘বৃহদ্ধর্মপুরাণ’-এ ‘মল্ল’দের ‘অন্ত্যজ জাতি’ বলে অভিহিত করা হয়েছে।
যদিও খ্রীস্টপূর্ব যুগ থেকেই বঙ্গদেশে ‘ব্রাহ্মণ্যধর্মের’ অনুপ্রবেশ ঘটেছিল, তবুও ‘গুপ্তযুগের’ আগে ব্রাহ্মণ্যধর্ম বঙ্গদেশে বিশেষ প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারেনি। বস্তুতঃ গুপ্তযুগেই ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ব্রাহ্মণরা এসে বঙ্গদেশে বসবাস করতে শুরু করেছিলেন। সমসাময়িক ‘তাম্রপট্ট’সমূহ থেকে জানতে পারা যায় যে, সেই সময় বাঙলায় চিরস্থায়ী বসবাসের জন্য বহু ব্রাহ্মণকে ভূমি দান করা হয়েছিল এবং মন্দির নির্মাণ করাও হয়েছিল। সেই সব লিপি থেকে আরও জানতে পারা যায় যে, সেই সব ব্রাহ্মণ ‘বেদের’ বিভিন্ন শাখার অন্তর্ভুক্ত ছিলেন এবং ‘বৈদিক যজ্ঞ ও ক্রিয়াকলাপাদি’ সম্পন্ন করা সম্বন্ধে তাঁদের বিশেষ পারদর্শিতা ছিল। সাধারণতঃ সেই সকল ব্রাহ্মণ ‘শর্মা’ ও ‘স্বামিন’ উপাধি ধারণ করতেন। ব্রাহ্মণদের মধ্যে ‘গাঞি’ প্রথারও প্রচলন ছিল। ‘গাঞি’ বলতে সেই গ্রামকে বোঝাত যে গ্রামে এসে তাঁরা প্রথম বসবাস শুরু করেছিলেন। সেই সকল ‘গাঞি’ এর নাম (যেমন ‘ভট্ট’, ‘চট্ট’, ‘বন্দ্যো’ ইত্যাদি) পরবর্তীকালে উপাধি হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছিল৷ সেই সব ‘তাম্রপট্টলিপি’ থেকে ‘ব্রাহ্মণেতর জাতিসমূহের’ যেসব উপাধি পাওয়া যায় সেগুলি হচ্ছে ‘দত্ত’, ‘পাল’, ‘মিত্র’, ‘বর্মণ’, ‘দাস’, ‘ভদ্র’, ‘সেন’, ‘দেব’, ‘ঘোষ’, ‘কুণ্ড’, ‘পালিত’, ‘নাগ’, ‘চন্দ্র’, ‘দাম’, ‘ভূতি’, ‘বিষ্ণু’, ‘যশ’, ‘শিব’, ‘রুদ্র’ ইত্যাদি। এই সব উপাধি বর্তমানকালে ‘কায়স্থ’ ও অন্যান্য জাতিসমূহ নিজেদের পদবী হিসাবে ব্যবহার করেন। কিন্তু এখানে যে যুগের কথা বলা হচ্ছে, সে যুগে স্বতন্ত্র জাতি হিসাবে ‘কায়স্থ’ জাতির উদ্ভব হয়নি। পরবর্তী কালের ‘তাম্রপট্ট’সমূহে অবশ্য এক শ্রেণীর ‘রাজকীয় কর্মচারী’র উল্লেখ পাওয়া যায়, যাঁদের নামের সঙ্গে ‘প্রথম-কায়স্থ’, ‘জ্যেষ্ঠকায়স্থ’, ইত্যাদি বিশেষণ ব্যবহার করা হয়েছিল। কিন্তু তাঁরা সাধারণতঃ ‘সচিবালয়ে’ লেখকের কাজ করতেন। সেই সময়ে ‘সমার্থবোধক’ শব্দহিসাবে ‘করণ’ শব্দও ব্যবহৃত হতে দেখতে পাওয়া গিয়েছিল। প্রাচীন গ্রন্থসমূহ থেকেও জানতে পারা যায় যে, প্রথমে ‘কায়স্থ’ এক বিশেষ বৃত্তিধারী গোষ্ঠীর নাম ছিল, সেটা কোনও বিশেষ জাতির নাম ছিল না৷ ‘বৃহদ্ধর্মপুরাণ’-এর জাতির তালিকার মধ্যে ‘কায়স্থ’ শব্দের পরিবর্তে ‘সমার্থবোধক’ ‘করণ’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। ‘চান্দেল্লরাজ’ ‘ভোজবর্মণের’ ‘অজয়গড়-লিপি’তেও সেটাই করা হয়েছিল। ‘গাহডবালরাজ’ ‘গোবিন্দচন্দ্রের’ লপিসমূহেও সেটা দেখা যায়। সবচেয়ে বিচিত্র ব্যাপার হল, যদিও ওই সময়ের লিপিসমূহে ব্রাহ্মণ ব্যতীত অন্যান্য অনেকেরই নামের পাওয়া যায়, কিন্তু তাঁরা কেউই নিজেদের ‘ক্ষত্রিয়’ বা ‘বৈশ্য’ বলে দাবি করেনি। বিশেষ করে গবেষকরা প্রচুর পরিমাণে ‘নগরশ্রেষ্ঠী’, ‘সার্থবাহ’, ‘ব্যাপারী’ প্রভৃতি শব্দের উল্লেখ পেয়েছেন। কিন্তু তাঁদের কাউকেই নিজেদের ‘বৈশ্য’ বলে দাবি করতে দেখা যায়নি। এ থেকে গবেষকরা অনুমান করেন যে, ‘উত্তরভারতের’ ন্যায় ‘বর্ণবাচক জাতি’ হিসাবে ‘ক্ষত্রিয়’ ও ‘বৈশ্য’ জাতি কোনও দিনই বঙ্গদেশে ছিল না, যদিও বর্তমানে অনেক জাতির ক্ষেত্রে নিজেদের ‘ক্ষত্রিয়ত্ব’ দাবি করা একটা নেশায় পরিণত হয়েছে। এখানে যে সমাজের চিত্র দেওয়া হল, সেটা হচ্ছে ‘গুপ্তযুগের’ সমাজের চিত্র। আগেই বলা হয়েছে যে, সেই যুগেই ‘উত্তরভারত’ থেকে ব্রাহ্মণরা দলে দলে বঙ্গদেশে এসে বসবাস শুরু করেছিলেন ও সমাজে প্রতিষ্ঠালাভ করেছিলেন। পরবর্তী কালে তাঁরাই ‘সপ্তশতী’ বা ‘সাতশতী’ ব্রাহ্মণ নামে অভিহিত হয়েছিলেন। ‘রাঢ়দেশে’ তাঁরা ‘সাতটি গোত্রভুক্ত’ ছিলেন ও ‘বরেন্দ্রদেশে’ ‘পাঁচটি গোত্রভুক্ত’ ছিলেন। ‘কুলশাস্ত্র’সমূহে তাঁদের বিরুদ্ধে ‘নিষ্ঠাহীনতা ও অজ্ঞতা’র যে অভিযোগ করা হয়েছিল, সেটা গবেষকদের কাছে ‘অভিসন্ধিমূলক কু-প্রচার’ বলেই মনে হয়। এটা পালযুগের ভূমিদান সংক্রান্ত ‘তাম্রপট্টলিপি’সমূহ থেকে প্রমাণিত হয়। কেননা, ‘গুপ্তযুগে’ সাধারণ ব্যক্তিরাই ব্রাহ্মণদের ভূমিদান করতেন। কিন্তু ‘পালযুগে’ রাজারাজড়ারাও ব্রাহ্মণদের ভূমিদান করতে শুরু করেছিলেন। সেই সব ‘তাম্রপট্টলিপি’সমূহে ব্রাহ্মণদের ‘শাস্ত্রজ্ঞ ও যাগযজ্ঞাদিকর্মে বিশেষ পারদর্শী’ বলে বর্ণনা করা হয়েছিল। সেই সব ব্রাহ্মণ যে ‘সপ্তশতী’ সমাজভুক্ত ছিলেন, সে বিষয়ে গবেষকদের কোন সন্দেহ নেই। সেই সকল লিপি থেকে আরও জানতে পারা যায় যে, বঙ্গদেশে ‘ব্রাহ্মণ’ ব্যতীত চতুর্বর্ণের অন্তর্ভুক্ত ‘ক্ষত্রিয়’ ও ‘বৈশ্য’ বলে আলাদা কোন বর্ণের কোন অস্তিত্ব ছিল না। তার মানে ‘গুপ্তযুগের’ ন্যায় ‘পালযুগে’ও অনুরূপ সমাজব্যবস্থাই চালু ছিল। মোট কথা, ওই যুগের ব্রাহ্মণেতর সমাজে পরবর্তী কালের ন্যায় কোনরূপ জাতিভেদ ছিল না। ‘কায়স্থ’রা ‘পেশাদারী শ্রেণী’ হিসাবেই গণ্য হতেন এবং তাঁরা রাজাদের মন্ত্রী ও এমন কি ‘ভিষক্’ হিসাবেও নিযুক্ত হতেন। এরূপ একজন ‘ভিষক্-কায়স্থ’ ‘শব্দপ্রদীপ’ নামে একখানি ‘ভেষজ-সম্পর্কিত গ্রন্থ’ রচনা করেছিলেন। বস্তুতঃ নবম ও দশম শতাব্দী থেকেই ‘কায়স্থ’রা নিজেদের স্বতন্ত্র জাতি হিসাবে গণ্য করতে শুরু করেছিলেন। এবং তখনই বোধ হয় অন্যান্য জাতিসমূহের অভ্যুত্থান ঘটেছিল। স্বতন্ত্র জাতি হিসাবে ‘কৈবর্ত’দের তো অভ্যুত্থান ঘটেই ছিল, কারণ তা ‘দিব্যোকের’ বিদ্রোহ থেকেই প্রকাশ পায়। কিন্তু অন্য কোনও ব্রাহ্মণেতর জাতির উল্লেখ ‘পালযুগের অনুশাসনসমূহে’ বড় একটা পাওয়া যায় না। সেই সকল ‘অনুশাসনে’ প্রধান ও অপ্রধান রাজকর্মচারীদের নামের তালিকার পরে যাঁদের উল্লেখ পাওয়া যায়, তাঁরা ছিলেন ‘প্রতিবেশী’, ‘ক্ষেত্রকার’ (বা ‘ভূমিকৰ্ষক’) এবং ‘কুটুম্ব’ বা প্রধান প্রধান গৃহস্থ। সুতরাং বঙ্গদেশে বর্তমানে যে জাতিবিন্যাস দেখতে পাওয়া যায়, পাল যুগে সেটার সম্পূর্ণ অভাব পরিলক্ষিত হয়। সমাজের নিম্নকোটির অন্তর্ভুক্ত যাঁদের নাম সেই সব ‘অনুশাসন’ থেকে পাওয়া যায়, তাঁদের অন্যতম হচ্ছেন ‘মেদ’, ‘অনধ্র’ ও ‘চণ্ডাল’। কিন্তু ‘চর্যাসাহিত্যে’ যে সব জাতির উল্লেখ পাওয়া যায় তাঁরা হচ্ছেন ‘ডোম’, ‘চণ্ডাল’, ‘শবর’ ও ‘কাপালিক’। তাঁরা সকলেই নিম্নস্তরের লোক ছিলেন৷ ‘ডোমেরা’ গ্রাম বা নগরের বাইরে বাস করতেন ও ব্রাহ্মণগণ কর্তৃক ‘অস্পৃশ্য’রূপে গণ্য হতেন। বৃত্তি হিসাবে তাঁরা ঝুড়ি-চুপড়ি ইত্যাদি তৈরি করতেন এবং নাচ-গানে তাঁরা বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। সকলের নীচে স্থান ছিল ‘কাপালিক’দের। তাঁরা ‘নর-কঙ্কালের মালা’ পরে সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় ঘুরে বেড়াতেন। ‘শবর’রা পর্বতে ও অরণ্যে বাস করতেন। তাঁরা ‘ময়ূরপুচ্ছের পরিচ্ছদ’ পরতেন এবং গলায় ‘গুঞ্জাবীজের মালা’ ও কানে ‘বজ্রকুণ্ডল’ ধারণ করতেন। তাঁরা সঙ্গীতেও পারদর্শী ছিলেন এবং তাঁদের দ্বারা ‘শবরী’ রাগের প্রবর্তন হয়েছিল।
এবারে দেখা যাক যে, বাঙলার সমাজবিন্যাসের ইতিহাসে ‘সেনযুগে’ কি ঘটেছিল। ‘পালরাজা’রা ‘বৌদ্ধ’ ছিলেন, কিন্তু ‘সেনরাজা’রা ছিলেন ব্রাহ্মণ্যধর্মের স্তম্ভস্বরূপ। ব্রাহ্মণ্যধর্মের পুনঃপ্রতিষ্ঠায় তাঁরা যথেষ্ট প্রয়াসী হয়েছিলেন। ব্রাহ্মণ্যধর্মের অন্তর্ভুক্ত পূজা-অর্চনাদি ও যাগযজ্ঞ সম্পাদনে তাঁরা ব্রতী হয়েছিলেন। সেই সময়ের সমাজ ব্যবস্থায় ব্রাহ্মণদের প্রাধান্য পুনরায় ঘটেছিল। তাঁরা ‘স্মৃতিশাস্ত্র’ সমূহের অনুশাসন অনুযায়ী বিধান দিতে থাকেন এবং এই সকল বিধান সমাজকে ক্রমশঃ গ্রাস করতে শুরু করেছিল। সেই যুগেই ‘রাঢ়ী’ ও ‘বারেন্দ্র’ ছাড়া, ‘বৈদিক’, ‘শাকদ্বীপি’ প্রভৃতি ব্রাহ্মণদের সঙ্গে বাঙালির প্রথম সাক্ষাৎ ঘটেছিল। নানা শ্রেণীর ব্রাহ্মণের ছড়াছড়ি ঘটায় সেই যুগে নূতন করে ‘ব্রাহ্মণসমাজ’ সংগঠিত হয়েছিল এবং কিংবদন্তী অনুযায়ী ‘সেনরাজা’ ‘বল্লালসেন’ ‘কৌলীন্য-প্রথা’ প্রবর্তন করেছিলেন। ব্রাহ্মণদের মধ্যে ‘গাঞ’-এর প্রাধান্য সেই যুগে পরিলক্ষিত হয়েছিল এবং ‘বন্দ্যো’, ‘চট্ট’, ‘মুখটী’, ‘ঘোষাল’, ‘পুতিতুন্ড’, ‘গাঙ্গুলী’, ‘কাঞ্জীলাল’ ও ‘কুন্দলাল’ – এঁরা প্রধান বা ‘মুখ্যকুলীন’ হিসাবে পরিগণিত হয়েছিলেন। আর ‘রারী’, ‘গুড়’, ‘মাহিন্ত’, ‘কুলভী’, ‘চৌতখণ্ডি’, ‘পিপ্পলাই’, ‘গড়গড়ি’, ‘ঘণ্টাসরী’, ‘কেশরকোনা’, ‘দিমসাই’, ‘পরিহল’, ‘হাড়’, ‘পিতমুণ্ডী’ ও ‘দীর্ঘতি’ – এঁরা হয়েছিলেন ‘গৌণ কুলীন’৷ বাকী ব্রাহ্মণরা ‘শ্রোত্রিয়’ শ্রেণীভুক্ত হয়েছিলেন। সেই সময় ‘রাঢ়ীয়দের’ ছিল ৬টি ‘গাঞ’ (কারুর মতে ৫২ বা ৫৯), আর ‘বারেন্দ্রদের’ ছিল ১০০টি ‘গাঞ’। কিন্তু কিংবদন্তী অনুযায়ী ‘বল্লালসেন’ কর্তৃক মাত্র পাঁচটি ‘বারেন্দ্র গাঞ’, যথা – ‘লাহিড়ী’, ‘বাগচী’, ‘মৈত্র’ ও ‘ভাদুড়ী’ – ‘কুলীন’ বলে স্বীকৃত হয়েছিল। ‘শ্রোত্রিয় ব্রাহ্মণ’রা তিন শ্রেণীতে বিভক্ত হয়েছিলেন, যথা – ‘সিদ্ধশ্রোত্রীয়’, ‘সাধ্য-শ্রোত্রীয়’ ও ‘কাষ্ঠশ্রোত্রীয়’। এখানে পরবর্তী কালে রচিত ‘কুলপঞ্জিকা’সমূহে উল্লেখিত এক কাহিনীর উল্লেখ করা যেতে পারে৷ সেই কাহিনী অনুযায়ী ‘গৌড়ের রাজা’ ‘আদিশূর’ একটি যজ্ঞ সম্পাদন করবার সংকল্প করে ‘কান্যকুব্জ’ থেকে ‘পাঁচজন বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ’কে নিয়ে এসেছিলেন। বলা হয় যে, বঙ্গদেশে ‘সাতশতী’, ‘বৈদিক’ প্রভৃতি শ্রেণী ছাড়া আর যত ব্রাহ্মণ বর্তমানে আছেন তাঁরা সকলেই সেই ‘পঞ্চব্রাহ্মণের বংশধর’। সেই ‘পঞ্চব্রাহ্মণের’ সঙ্গে যে পাঁচজন ভৃত্য এসেছিলেন, বর্তমান বাঙলার ‘কুলীন কায়স্থগণ’ নাকি তাঁদের মধ্যে চারজনের বংশধর। কুলগ্রন্থসমূহে ‘আদিশূর’কে ‘বল্লালসেনের মাতামহ’ বলা হয়েছিল। কিন্তু পণ্ডিতমহলে ‘আদিশূর’-কর্তৃক সেই ‘পঞ্চব্রাহ্মণ’ আনয়নের কাহিনী ‘ঐতিহাসিক সত্য’ বলে গ্রহণ করা হয়নি। তবে ‘আদিশূর’ নামে প্রাচীন বঙ্গদেশে যে কোনও রাজা ছিলেন না, বা তিনি কোনও যজ্ঞ সম্পাদন করেননি বা তা অলীক বলে মনে করবার সপক্ষেও কোন প্রমাণ নেই। কিন্তু ‘কুলপঞ্জিকা’সমূহে ‘আদিশূরের বংশাবলী ও রাজত্বকাল’ সম্বন্ধে বিভিন্ন গ্রন্থে বিভিন্ন ও পরস্পরবিরোধী মতও দেখতে পাওয়া যায়। তিনি যে যজ্ঞ সম্পাদন করেছিলেন বিভিন্ন ‘কুলপঞ্জিকায়’ সেটার বিভিন্ন নাম এবং তিনি যে ‘পঞ্চব্রাহ্মণ’ এনেছিলেন বিভিন্ন গ্রন্থে তাঁদের বিভিন্ন নাম দেখে ওই কাহিনীর যথার্থতা সম্বন্ধে সন্দেহ অবশ্যই জাগে। তবে এটা ঠিক যে ‘সেনরাজা’ ‘বল্লালসেন’ কর্তৃক নতুন করে সামাজিক সংগঠনের একটা চেষ্টা হয়েছিল, যদিও সেটার ধারা, প্রকৃতি ও পদ্ধতি সম্বন্ধে ঐতিহাসিক ও গবেষকদের আজও সঠিক কিছু জানা নেই। ‘মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী’ বলেছিলেন যে, সেনযুগে ব্রাহ্মণ্যধর্মের পুনঃপ্রতিষ্ঠার সঙ্গে বহু ‘বৌদ্ধধর্মাবলম্বী’ হিন্দু ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন এবং সামাজিক সংগঠনের মধ্যে তাঁদের স্থান নির্ণয় করবার প্রয়োজনীয়তা ‘সেনযুগে’ই অনুভূত হয়েছিল। এর ফলে, বঙ্গদেশে নানা জাতি ও উপজাতির সৃষ্টি হয়েছিল। ‘সেনরাজত্বের’ অব্যবহিত পরেই ‘বৃহদ্ধর্মপুরাণ’ ‘রাঢ়দেশে’ রচিত হয়েছিল। ‘বৃহদ্ধর্মপুরাণ’-এ নানা জাতি ও উপজাতির উল্লেখ পাওয়া যায়। সুতরাং ধরে নেওয়া যেতে পারে যে, ‘বৃহদ্ধর্মপুরাণ’-এ বর্ণিত জাতি ও উপজাতিসমূহ ‘সেনরাজত্বকালে’ও বর্তমান ছিল। ‘বৃহদ্ধর্মপুরাণ’-এ যে সকল জাতি ও উপজাতির তালিকা দেওয়া আছে, সেটা হচ্ছে –
(১) ‘উত্তম সঙ্কর’ (‘শ্রোত্রীয় ব্রাহ্মণ’রা যাঁদের পুরোহিতের কাজ করেন) – (ক) করণ, (খ) অম্বষ্ঠ, (গ) উগ্র, (ঘ) মগধ, (ঙ) গন্ধবণিক, (চ) কাংস্যবণিক, (ছ) শঙ্খবণিক, (জ) কুম্ভকার, (ঝ) তন্তুবায়, (ঞ) কর্মকার, (ট) সদগোপ, (ঠ) দাস, (ড) রাজপুত, (ঢ) নাপিত, (ণ) মোদক, (ত) বারুজীবী, (থ) সুত, (দ) মালাকার, (ধ) তাম্বুলি ও (ন) তৈলক।
(২) ‘মধ্যম সঙ্কর’ – (ক) তক্ষ, (খ) রজক, (গ) স্বর্ণকার, (ঘ) সুবর্ণবণিক, (ঙ) আভীর, (চ) তৈলক, (ছ) ধীবর, (জ) শৌণ্ডিক, (ঝ) নট, (ঞ) শবক ও (ট) জালিক।
(৩) ‘অন্ত্যজ’ – (ক) গৃহি, (খ) কুড়ব, (গ) চণ্ডাল, (ঘ) বাদুর, (ঙ) চর্মকার (চ) ঘট্টজীবী, (ছ) দোলবাহী ও (জ) মল্ল।
এ ছাড়া ‘বৃহদ্ধর্মপুরাণ’-এ আরও যেসব জাতির উল্লেখ আছে, তাঁদের অন্যতম হচ্ছেন ‘শাকদ্বীপী ব্রাহ্মণ’ (‘দেবল’, ‘গণক’ ইত্যাদি) ও ‘ম্লেচ্ছজাতি’সমূহ, যথা – ‘পুলিন্দ’, ‘কক্কস’, ‘যবন’, ‘খস’, ‘সৌম্য’, ‘কম্বোজ’, ‘শবর’ ও ‘খর’। লক্ষ্যণীয় যে, ‘বাগদি’, ‘ডোম’, ‘কৈবর্ত’ প্রভৃতি যেসব জাতির একসময় বাঙলার জাতিবিন্যাসে প্রাধান্য ছিল, তাঁদের নাম এই তালিকায় নেই। উপরে প্রদত্ত তালিকা থেকে বেশ বোঝা যায় যে তৎকালীন জাতিসমূহের উৎপত্তি তিনভাবে ঘটেছিল – (ক) ‘বৃত্তিগত’, (খ) ‘কর্মগত’, ও (গ) ‘নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীগত’। তবে ‘সুবর্ণবণিক’দের ‘মধ্যমসঙ্কর’রূপে গণ্য করবার কারণ সম্বন্ধে বলা হয় যে, ‘বল্লভানন্দ’ নামে সেই সময়ের প্রসিদ্ধ এক ‘সুবর্ণবণিক’ ‘রাজা বল্লালসেন’কে অর্থ সরবরাহ করতে অসম্মত হওয়ায় ‘বল্লালসেন’ তাঁদের অবনমিত করেছিলেন। যদিও এই ঘটনার সত্যতা সম্পর্কে ঐতিহাসিকেরা সন্দেহ করে থাকেন।

আজ ১৭ ডিসেম্বর, ইতিহাসের আজকের এই দিনে যা ঘটেছিল

আজ ১৭ ডিসেম্বর। একটি দিন ২৪ ঘণ্টা। ১৪৪০ মিনিট। ৮৬ হাজার ৪০০ সেকেন্ড। সময়ের হিসেবে অতি অল্প মনে হলেও একটি ঘটনার জন্য তা যথেষ্ট। ইতিহাস ঘেটে দেখা যায় বছরের প্রতিটি দিনে ঘটেছে অনেক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। ইতিহাসের কৌতুহল উদ্দীপক ও উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলো জেনে নেবো। আসুন আজকের দিনে ঘটে যাওয়া উল্লেখযোগ্য কিছু বিষয়-একনজরে দেখে নিই। ইতিহাসের আজকের এই দিনে কী কী ঘটেছিল, কে কে জন্ম নিয়েছিলেন ও মৃত্যুবরণ করেছিলেন——-

ঘটনাবলী—-

১৩৯৯ – পানিপথের যুদ্ধে তৈমুর লঙ দিল্লির সুলতান মুহম্মদ তুঘলককে পরাস্ত করেন।

১৮৭৩ – বুদাপেস্ট নগরীর পত্তন হয়।

১৯০৩ – রাইট ভ্রাতৃদ্বয় প্রথম উড়োজাহাজে উড্ডয়ন করেন।

দিনটি আমেরিকায় রাইট ব্রাদার্স দিবস।

১৯৩১ – প্রশান্ত চন্দ্র মহলানবীশ কলকাতায় ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেন।

১৯৪২ – বিপ্লবী সতীশচন্দ্র সামন্ত তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার গঠন করেন।

১৯৯৬ – পেরুর জিম্মি সংকট শুরু।

জন্ম—

১৭৭০- জার্মান সুরকার ও পিয়ানো বাদক লুডউইগ ভ্যান বেইটোভেন।
১৮৯২- ভারতীয় বাঙালি সাংবাদিক বঙ্কিমচন্দ্র সেন।
১৯০২- ভারতীয় রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী মালতী ঘোষাল।
১৯২০- টুরিং পুরস্কার বিজয়ী কম্পিউটার বিজ্ঞানী কেনেথ আইভার্সন।
১৯৩৬- বাঙালি কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক দেবেশ রায়। ব্রিটিশ ভারতের অবিভক্ত বাংলায়, অধুনা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের পাবনা জেলার বাগমারা গ্রামে তার জন্ম। তিস্তা পারের বৃত্তান্ত উপন্যাসটির জন্য তিনি ১৯৯০ সালে ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সাহিত্য সম্মান সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কারে সম্মানিত হন। বাংলা সাহিত্যে তিনি একজন ছকভাঙা আধুনিক ঔপন্যাসিক হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
১৯৭৯- বাংলাদেশি চলচ্চিত্র অভিনেত্রী শাবনূর।

১৯০০- ব্রিটিশ গণিতবিদ মেরি কার্টরাইট।

১৯২০ – কেনেথ আইভার্সন, টুরিং পুরস্কার বিজয়ী কম্পিউটার বিজ্ঞানী।

মৃত্যু—–

১৯৩৮- প্রখ্যাত বাঙালি লেখক, সম্পাদক ও অনুবাদক চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৮৭৭ সালের ১১ অক্টোবর অবিভক্ত বাংলার মালদহের চাঁচলে জন্ম গ্রহণ করেন তিনি। তাদের আদি বাসস্থান ছিল বর্তমান বাংলাদেশের যশোরে। চারুচন্দ্রের সাহিত্য জীবনের শুরু ‘মেঘদূত’,’মাঘ’ প্রভৃতি পত্রিকায় সংস্কৃত সাহিত্যের সমালোচক হিসেবে।

১৯৬১ – শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক গোলাম মাকসুদ হিলালী।

২০০২ – আইদেউ সন্দিকৈ, অসমীয়া চলচ্চিত্রের প্রথম মহিলা অভিনেত্রী।

২০১১ – কিম জং-ইল, গণতান্ত্রিক গণপ্রজাতন্ত্রী কোরিয়া বা উত্তর কোরিয়ার শাসক ও প্রধান ব্যক্তিত্ব।

মানুষ ইতিহাস আশ্রিত। অতীত হাতড়েই মানুষ এগোয় ভবিষ্যৎ পানে। ইতিহাস আমাদের আধেয়। জীবনের পথপরিক্রমার অর্জন-বিসর্জন, জয়-পরাজয়, আবিষ্কার-উদ্ভাবন, রাজনীতি-অর্থনীতি-সমাজনীতি একসময় রূপ নেয় ইতিহাসে। সেই ইতিহাসের উল্লেখযোগ্য ঘটনা স্মরণ করাতেই বিশেষ আয়োজন আজকের এই দিনে।

।।তথ্য : সংগৃহীত ইন্টারনেট।।

গল্প নয় সত্যি! বিশ্ব এমন কিছু শহর রয়েছে যেখানে নেই কোনও গাড়ি

ভাবুন তো কেমন হবে? সত্যি সত্যি, যদি কোথাও গাড়িশূন্য নগরী খুঁজে পাওয়া যায়। যেখানে চলে না কোনও গাড়ি। মানুষের প্রতিদিনের ব্যস্ততা কাটে পায়ে হেঁটে। না, এটা গল্পের রূপকথা নয়। সভ্যতার বিবর্তনে বিশ্ব এগিয়ে গেলেও কিছু শহর রয়েছে যেখানে নেই কোনও গাড়ি।

আরো পড়ুন- সমকালীন প্রতিক্রিয়ায় ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ

সভ্যতার উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে জীবনযাত্রায় যোগ হয়েছে গাড়ি। বেড়েছে গাড়ির চাহিদা। ভাবুন তো, গাড়ি ছাড়া যদি কোনও নগরী কি চিন্তা করা যায়। সেই নগরী কি অভিজাত্যের তালিকায় উঠে আসবে? অবশ্যই উঠে এসেছে। এমনকি সেই নগরীর জীবনযাত্রা মান হয়েছে আরও উন্নত। সেসব নগরীতে যোগাযোগ ব্যবস্থার কোনও উন্নয়ন না করেও সভ্যতা টিকিয়ে রেখেছে এবং তা মানুষের কাছে আরও গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। বিশ্বের বুকে গাড়ীহীন সেসব নগরী বা শহরের কথা চলুন জেনে নেই।

অসলো
********
নরওয়ের রাজধানী অসলো। ঐতিহ্যবাহী পুরাতন নগরী এটি। ৭ লাখের একটু বেশি অধিবাসীর এ শহর। এই শহরের সড়ক কর্তৃপক্ষ অবাক করা এক নিয়ম চালু করেছেন। নগরীর সবাইকে রাস্তা ব্যবহারে মানতে হয় কিছু নিয়ম। ২০১৫ সালে স্থানীয় সড়ক কর্তৃপক্ষ পরিবেশকে দূষণহীন রাখার জন্য শহরকে গাড়িমুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়। ২০১৯ সালে রাস্তায় গাড়ী পার্কিং করা নিষিদ্ধ করা হয়। নগরের বাসিন্দারা পায়ে হেটেই গন্তব্যে ছুটেন। বড় জোড় একটি সাইকেল ব্যবহারের অনুমতি পাওয়া যায় এখানে। প্রথমে একটু অসুবিধায় হয়েছে বটে। কিন্তু কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তের সুফল দেখে নগরীর সবাই মেনে চলছেন এই নিয়ম। এই নগরীতে দর্শনীয় স্থানেরও কমতি নেই। প্রতিবছর এখানে আসে অসংখ্য পর্যটক। পর্যটন থেকে শহর কর্তৃপক্ষও প্রচুর রাজস্ব আয় করে। পর্যটকদেরও এই নিয়ম মেনেই ঘুরে বেড়াতে হয় এই শহরে।

লামু
*****
পূর্ব আফ্রিকার দেশ কেনিয়ার লামু। এই শহরেও কিন্তু চলাচলের জন্য কোনও গাড়ীর ব্যবস্থা নেই। যোগাযোগের একমাত্র উপায় পায়ে হাটা। সাইকেলও রয়েছে অন্য মাধ্যম হিসেবে। এখন কথা হলো যদি হাটাহাটি অথবা সাইকেল চালানোর অভ্যাস না থাকে তাহলে। দুশ্চিন্তার কোনও কারণ নেই। এখানে অধিবাসীরা আদিকাল থেকেই গাঁধার পিঠে চলতে অভ্যস্ত। প্রায় সবার কাছেই আছে এই প্রাচীন বাহন। কাজেই প্রয়োজনে চেপে বসুন ভাড়া করা গাঁধার পিঠে। আর ঘুরে বেড়ান ইউনেস্কো ওয়াল্ড হেরিটেজের অন্তর্ভুক্ত অপূর্ব সুন্দর এই প্রাচীন নগরীতে।

বিথন
*******
নেদারল্যান্ডের একটি গ্রাম বিথন। এখানে পায়ে হাঁটা বা সাইকেল তো দূরের কথা, কোনও রাস্তাই পাওয়া যাবে না। অবাক হচ্ছেন? ভাবছেন গ্রামের অধিবাসীদের যোগাযোগের মাধ্যম কী? এখানকার অধিবাসীদের যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম নৌকা। নৌকায় চড়েই এক জায়গা থেকে অন্যত্র ছুটের নগরীর মানুষেরা। গ্রামের বুক চিরে বয়ে গেছে অসংখ্য খাল। যার মোট দৈর্ঘ প্রায় সাড়ে ৭ কিলোমিটার। সম্পূর্ণ গ্রামটি নৈসর্গিক সৌন্দর্য দিয়ে পরিপূর্ণ। পরিষ্কার বাতাস, পাখ-পাখালির কলতান আর ফুলের সুবাস সহজেই পর্যটকদের মন কেড়ে নিবে। এজন্যই প্রতি বছর এই গ্রামটি দেখতে ছুটে যান সৌন্দর্য পিপাসু হাজার হাজার পর্যটক। তবে নৌকা চালালেই হবে না। এতেও রয়েছে কঠোর নিয়ম। মনে রাখতে হবে নৌকা চালোনার সময় কোনও শব্দ করা যাবে না। নিশব্দে নৌকা চালিয়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে হয় নগরীর অধিবাসীদের।

জারম্যাট
**********
সুইজারল্যান্ডের জারম্যাট। ম্যাটারহর্নের গোড়ায় অবস্থিত এই শহরটি। শহরটি সম্পূর্ণ গাড়িমুক্ত। পায়ে হেটে জারমাট থেকে প্রায় ৫ কিলোমিটার দূরে গিয়ে ট্রেনে চড়ে সেখানকার মানুষ। এই শহরের সবাই ঘোড়ার গাড়ি বা পায়ে চলাচলেই অভ্যস্ত।

ভেনিস
*******
ইতালির বিখ্যাত শহর ভেনিসও গাড়িশূন্য। জলে ভাসমান এই শহরেও গাড়ি চলে না। সবাই নৌকায় যাতায়াত করে। স্থানীয়রা নৌকায় চড়ে বা পায়ে হেঁটে ভেনিসে ঘুরে বেড়ান বা গন্তব্যে যান। ভেনিসে ১৭৭টি খাল রয়েছে। আরও রয়েছে ৪১৬টি সেতু। বিশ্বজুড়ে পর্যটকদের প্রধান আকর্ষণ এই শহরটি।

গিথোর্ন
********
হল্যান্ডের উত্তর-পূর্ব দিকে অবস্থিত গির্থোন শহর। এখানেও গাড়িমুক্ত রেখেছে কর্তৃপক্ষ। নৌকা ছাড়া এই শহরে চলার কোনও উপায় নেই। তবে চাইলে সাইকেলে চড়ে গন্তব্যে যেতে পারেন। ছবির মতো সুন্দর এই শহরেও পর্যটকদের ভিড় হয় প্রতিবছর।

সমকালীন প্রতিক্রিয়ায় ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ

শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস ঊনবিংশ শতকের একজন চিহ্নিত ব্যক্তিত্ব, আর বিংশ শতকের শেষ ধাপে তিনি সর্বজন শ্রদ্ধেয় বিশ্বের শেষ আশ্রয়। তিনি আদর্শ ও ঐতিহ্যের এক অনন্য মিশ্রণ। অতীতে ‘ডি. এস. শর্মা’ যেমন তাঁকে ‘Entire orbit of Hinduism’ বলেছিলেন (Hinduism through the Ages, D. S. Sarma, Bharatiya Vidya Bhavan, 1955, P. 125), অন্যদিকে ‘ক্রিস্টোফার ইশারউড’ তেমনি তাঁকে ‘phenomenon’ বলে (রামকৃষ্ণ ও তাঁর শিষ্যগণ, ক্রিস্টোফার ইশারউড, অনুবাদ: রবিশেখর সেনগুপ্ত, মণ্ডল বুক হাউস, কলকাতা, ১৩৮৮ বঙ্গাব্দ, পৃ: ১-২) চিহ্নিত করেছিলেন। শতবর্ষ অতিক্রম করে যন্ত্রসভ্যতার বিজয় বৈজয়ন্তীর দিনেও রামকৃষ্ণ-জনপ্রিয়তা এখনো যেমন ক্রমবর্ধমান, তেমনি শ্রীরামকৃষ্ণ অবমূল্যায়নের প্রবণতাও খুব একটা কম কিছু নয়। ‘সুনীতিরঞ্জন রায়চৌধুরী’র মত অনেকেই এখনো তাঁকে হিন্দু পুনরভ্যুত্থানবাদের একজন নায়ক হিসাবে চিত্রিত করতে চান। (ঊনিশ শতকে নব্য হিন্দু আন্দোলনের কয়েকজন নায়ক, সুনীতিবঞ্জন রায়চৌধুরী, জি.এ.ই. পাবলিশার্স, কলকাতা, ১৩৮৮ বঙ্গাব্দ, পৃ: ১-১৯) আবার কারো কারো কাছে তিনি ‘অলৌকিকতাবাদী’। (আনন্দবাজার পত্রিকা, ৭২ বর্ষ, ১২৮ সংখ্যা) বাক স্বাধীনতার জোর দেখিয়ে বর্তমানে কেউ কেউ এটাও বলেন যে – ‘মথুরামোহন বিশ্বাস’, ‘হৃদয়নাথ’ ও ‘ভৈরবী ব্রাহ্মণী’ মিলে শ্রীরামকৃষ্ণকে সামান্য পুরোহিত থেকে অবতার বানিয়েছিলেন। (উৎস মানুষ, জুন ও জুলাই সংখ্যা, ১৯৯১ সাল) ইতিহাস বলে যে, শ্রীরামকৃষ্ণ কলকাতায় এসেছিলেন ১৮৫৩ সালে। তারপরে দক্ষিণেশ্বর কালী মন্দিরে তাঁর পৌরোহিত্যের দায়িত্ব গ্রহণ, পরে সেই বৃত্তি থেকে নিষ্পত্তি লাভ, তারপরে গভীর সাধনায় একাগ্রচিত্তে নিজেকে নিয়োগ, এবং সেখান থেকে লোকশিক্ষার কাজে আমৃত্যু সংগ্রাম – সংক্ষেপে এটাই ছিল শ্রীরামকৃষ্ণ আন্দোলনের অক্ষ। সেই অক্ষের ভূমিতে আসীন ছিলেন বালক ‘গদাধর’, এবং শীর্ষে অধিষ্ঠান করেছিলেন প্রজ্ঞাময় শ্রীরামকৃষ্ণ। বস্তুতঃ শ্রীরামকৃষ্ণ একটি Phenomenon; তৎকালীন কলকাতার সমাজ যে তাঁকে সহজে স্বীকৃতি দেয়নি – সমকালীন ইতিহাসে সেটার প্রমাণ দেখতে পাওয়া যায়। সম্ভবতঃ সেই ইতিহাসের সঠিক পরিচিতির অভাবেই আজও তাঁকে নিয়ে নানা বিজাতীয় মন্তব্য দেখতে পাওয়া যায়। সেই ইতিহাস অজ্ঞাত থাকলে শ্রীরামকৃষ্ণ আন্দোলনের ‘dimension’ বোঝা যেমন কষ্টকর, তেমনি শ্রীরামকৃষ্ণের মূল্যায়নও অগভীর হতে বাধ্য।

আরো পড়ুন- সংস্কৃত এবং উর্দু ভাষার ইতিহাস

সময়টা ছিল খৃষ্টীয় ঊনিশ শতকের পাঁচের দশক। মাহিষ্য কুলোদ্ভবা ‘রাণী রাসমণিদেবী’ দক্ষিণেশ্বরে বহু অর্থ ব্যয় করে কালীর নবরত্নসহ সুবৃহৎ মন্দির, দ্বাদশ শিবমন্দির ও অন্যান্য দেবালয় প্রভৃতি উৎসর্গ করবার জন্য প্রস্তুত হয়েছিলেন, এবং ১৮৫৫ সালের ৩১শে মে তারিখে সেই মন্দির ও মূর্তি প্রতিষ্ঠার দিন ঠিক হয়েছিল। অসংখ্য বাধা-বিপত্তির মাঝে রাণীকে সে কাজ করতে হয়েছিল। যেহেতু তিনি শূদ্র জাতীয়া ছিলেন, সেই কারণে সমকালীন সমাজের ব্রাহ্মণেরা তাঁকে সে কাজ করবার অনুমতি দেন নি। সেই ঘটনার নিখুঁত বিবরণ দিতে গিয়ে ‘স্বামী সারদানন্দ’ লিখেছিলেন, “এখানেও (রাণী রাসমণি কর্তৃক মন্দির ও মূর্তি প্রতিষ্ঠার কার্যাদি) প্রচলিত সামাজিক প্রথা তাঁহার বিরুদ্ধে দণ্ডায়মান হইল। শূদ্র প্রতিষ্ঠিত দেবদেবীর পূজা করা দূরে যাউক, সদ্বংশজাত ব্রাহ্মণগণ ঐ কালে প্রণামপর্যন্ত করিয়া ঐ মূর্তির মর্যাদা রক্ষা করিতেন না। এবং রাণীর গুরু বংশীয়গণের ন্যায় ব্রহ্মবন্ধুদিগকে তাঁহারা শূদ্র মধ্যেই পরিগণিত করিতেন। সুতরাং যজন-যাজনক্ষম কোন ব্রাহ্মণই রাণীর দেবালয়ে পূজক পদে ব্রতী হইতে সহসা স্বীকৃত হইলেন না।” (শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ লীলাপ্রসঙ্গে, ১ম খণ্ড, সাধকভাব, স্বামী সারদানন্দ, উদ্বোধন কার্যালয়, ১৩৯৮ বঙ্গাব্দ, পৃ- ৭৩) সেই অবস্থায় শ্রীরামকৃষ্ণ দাদা ‘রামকুমার’, সমস্ত সামাজিক প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে রাণী রাসমণির মন্দির ও মূর্তি প্রতিষ্ঠার কাজ সম্পন্ন করেছিলেন। এর অনতিবিলম্বে দেখা গিয়েছিল যে, তিনিই সেই কালীমন্দিরে পূজকের কাজে ব্রতী হয়েছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ জীবনী পাঠকমাত্রেই অবগত রয়েছেন যে, রামকুমারের পরে গদাধর দক্ষিণেশ্বরের পূজকপদে ব্রতী হওয়ার পরেই বিবিধ দিব্যদর্শন পেতে শুরু করেছিলেন, এবং তখন থেকেই পূজার কাজ ব্যাহত হতে শুরু হয়েছিল। এরপরেই তাঁর দ্বাদশবর্ষকাল সাধনা এবং পূজা থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া শুরু হয়েছিল। তারপরে নিবিড় জনসংযোগ করে ক্রমশই তিনি তৎকালীন কলকাতার একজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছিলেন। গদাধর দেখতে দেখতে শ্রীরামকৃষ্ণ হয়েছিলেন। তাঁর সেই উত্তরণের পথ যে কী জটিল এবং ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়ার ঝঞ্ঝায় পরিপ্লুত ছিল, সেটা সমকালীন ইতিহাসের ভাষ্যে আজও উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ দেবতা ও মানুষের মধ্যে ব্যবধানটা ঘুচিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। তিনি দেবতাকে ‘প্রিয়’ জ্ঞানে তাঁর মধ্যে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। আর তিনি সেটা করতে চেয়েছিলেন বলেই ঠাকুরকে রামপ্রসাদী গান শোনাতেন, তাঁর কাছে কাঁদতেন, রাত্রে ঠাকুরের সঙ্গে কথোপকথন করতেন, কখনো কখনো তো ঠাকুরের পায়ে ফুল দেওয়ার আগে তিনি নিজের পায়েই ফুল রেখেছিলেন, এমনকি ঠাকুরকে নৈবেদ্য অর্পণের আগে তিনি নিজেই সেটাকে উচ্ছিষ্ট পর্যন্ত করেছিলেন। তাঁর সেই সমস্ত ক্রিয়াকলাপগুলিকে রানীর কর্মচারীরা কিন্তু ভাল চোখে দেখেন নি। প্রথম থেকেই তিনি রানীর কর্মচারীদের মনমত হতে পারেন নি। রানীর কর্মচারীদের ধারণা ছিল যে, “রাজপুরোহিত হবেন ধর্মীয় মোড়কে কূটনীতি, রাজকীয় চালে আড়ম্বরে পারিপাট্য”। (শ্রীরামকৃষ্ণ: নৈঃশব্দেব রূপ, ধনগোপাল মুখোপাধ্যায, সুবর্ণরেখা, কলকাতা, ১৯৮৩ সাল, পৃ- ১০) বিনিময়ে তাঁরা সেই রাজপুরোহিতকে পেয়েছিলেন – যিনি ছিলেন পৌরোহিত্য বিমুখ, লোভহীন, অনাড়ম্বর এবং প্রচলিত নিয়মের বিরুদ্ধাচারী। শেষে রানীর অনুগ্রহ লাভের প্রত্যাশায় একদিন তাঁরা জমায়েত হয়ে তাঁর বিরুদ্ধে ফাতোয়া জারি করেছিলেন। তাঁরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, “ছোট ভট্চাজ পাগল হয়েছে অথবা তাঁর মধ্যে উপদেবতা ভর করেছে, নতুবা পূজাকালে কেউই কি অমন শাস্ত্র বিরুদ্ধে কাজ করে?” (শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ লীলা প্রসঙ্গ, ১ম ভাগ, সাধকভাব, সপ্তম অধ্যায, পৃ: ১২২-২৩) ঠাকুরবাড়ির প্রধান কর্মচারী খাঞ্জাঞ্চী মহাশয় ও অন্যান্য নিম্নপদস্থ কর্মচারীরা রাণী রাসমণি ও মথুরামোহনকে জানিয়েছিলেন, “ছোট ভট্চাজ (রামকৃষ্ণ) সব মাটি করলে; মা-র পূজা, ভোগরাগ কিছুই হচ্ছে না, ওরূপ অনাচার করলে মা কি কখনো পূজা ভোগ গ্রহণ করেন ?” ঘটনার শেষ সেখানেই ঘটেনি। এরপরে একদিন রাণী রাসমণি শ্রীরামকৃষ্ণের কণ্ঠে গান শুনতে শুনতে অন্যমনস্ক হয়ে পড়লে, তিনি তাঁকে চপেটাঘাত করেছিলেন। সেই দৃশ্য দেখে মন্দিরে উপস্থিত কর্মচারীরা ও রাণীর পরিচারিকাবর্গ হই হই করে শ্রীরামকৃষ্ণকে প্রহারের উদ্দেশ্যে তেড়ে এসেছিলেন। কার্যতঃ শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর সাধনাকালে রানীর কর্মচারীদের কাছ থেকে কোন ধরণের সহযোগিতা তো পাননিই, বরঞ্চ প্রতিনিয়ত প্রতিহত, তিরস্কৃত ও অপবাদক্লিষ্ট হয়েছিলেন। তাঁরা তাঁকে নির্বোধ ও উন্মাদজ্ঞান করতেন। এমনকি রাণীর জমিদারীর খাজাঞ্চীকে শ্রীরামকৃষ্ণ ভয় করতেন। একবার কলকাতার এক গির্জার দ্বারদেশে দাঁড়িয়ে তিনি খৃষ্ট ধর্মাবলম্বীদের যীশু উপাসনা দেখছিলেন, কিন্তু খাজাঞ্চির ভয়ে ভেতরে ঢোকেননি। পরে তিনি বলেছিলেন, “আমি খাজাঞ্চীর ভয়ে ভিতরে গিয়া বসি নাই – ভাবলাম কি জানি যদি কালী ঘরে যেতে না দেয়।” এসব তো ছিল রানীর কর্মচারীদের কথা। কিন্তু স্বয়ং রাণীমা ও তাঁর জামাতা মথুরামোহনও কি শ্রীরামকৃষ্ণ সম্পর্কে প্রথম থেকেই সম্পূর্ণভাবে সংশয়মুক্ত ছিলেন? দক্ষিণেশ্বর থেকে কর্মচারীদের অভিযোগ জানবাজারে রাণীমার কাছে পৌঁছানোর পরে তাঁরা সেই অভিযোগের তদন্ত করতে দক্ষিণেশ্বর এসেছিলেন। পরবর্তীকালে শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি তাঁরা শ্রদ্ধা ও সৌজন্য প্রদর্শন করলেও প্রথমপর্বে তাঁদের মানসিকতা কিন্তু সেই মার্গে কখনোই ছিল না। শ্রীরামকৃষ্ণের সংশ্লিষ্ট ক্রিয়া পরিপ্রেক্ষিতে মথুরামোহন শ্রীরামকৃষ্ণকে একবার জানিয়েছিলেন – “ঈশ্বরকেও আইন মেনে চলতে হয়।” সেই মথুরবাবুই কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণকে প্রলুব্ধ করবার জন্য মূল্যবান ভোগ্যবস্তু উপহার দিয়েছিলেন, ঠাকুরবাড়ির দেবোত্তর সম্পত্তিও তাঁর নামে লিখে দিতে চেয়েছিলেন, এবং অবশেষে তাঁর ব্রহ্মচর্য বিনষ্টির উদ্যোগে বারবণিতাদের নিয়োগ করেছিলেন।
সমকালীন ব্রাহ্মণ, পুরোহিত ও গুরুকুলের প্রতিনিধিরাও শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি কখনোই যথেষ্ট সম্ভ্রম দেখাননি। সেক্ষেত্রেও তাঁদের ভূমিকা বিরুদ্ধাত্মক ও বিরূপাত্মক ছিল। শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর সাধনা প্রত্যয় থেকে ঘোষণা করেছিলেন, “ঈশ্বর সবেতেই আছেন তবে মানুষে তাঁর অধিক প্রকাশ।” তাই মানুষকে অবমাননার পরিবর্তে তিনি শ্রদ্ধার শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যায় ব্রতী হয়েছিলেন। তিনি ব্রাহ্মণের বর্ণ চিহ্ন উপবীত ত্যাগ করেছিলেন; আচার, পবিত্রতা-অপবিত্রতার বিচার বর্জন করেছিলেন; কাঙালের এঁটো পাতা পরিষ্কার করেছিলেন; অব্রাহ্মণের গৃহে খাদ্যগ্রহণ করেছিলেন; ধর্ম পথের উদ্দেশ্য বোঝবার জন্য মুসলমান ও খ্রিস্টানদের ধর্ম সাধনা করেছিলেন এবং তাঁদের সঙ্গে মেলামেশা শুরু করেছিলেন। তাঁর সেই ক্রিয়া পারম্পর্য কিন্তু তৎকালীন রক্ষণশীল হিন্দুসমাজ কখনোই মেনে নেয়নি। এই প্রসঙ্গে স্বামী সারদানন্দ লিখেছিলেন, “কিছুদিন ঐরূপ পূজা করিতে না করিতে তিনি প্রথমে অনেকের বিদ্রূপভাজন হলেন।” সাধন মর্গে উন্নীত হওয়ার পরে তাঁর খাদ্যাখাদ্যের এবং ছোঁয়াছুঁয়ির বিচার ছিল না বলে তিনি নিজের স্বজনবর্গের কাছ থেকেও কম নিগ্রহ ভোগ করেন নি। এই প্রসঙ্গে তিনি নিজেই বলেছিলেন, “দেশে গেলুম, রামলালের বাপ (শ্রীরামকৃষ্ণের মধ্যম ভ্রাতা রামেশ্বর) ভয় পেয়ে ভাবলে, যাঁর তাঁর বাড়িতে খাবে। ভয় পেলে পাছে তাঁদের জাতে বের করে দেয়। আমি তাই বেশীদিন (দেশে) থাকতে পারলুম না; চলে এলুম।” শ্রীরামকৃষ্ণের ওপরে সমকালীন ব্রাহ্মণদের মানসিকতা কেমন ছিল, সেটা ‘মহেন্দ্ৰনাথ দত্তের’ লেখা থেকেও জানতে পারা যায়। তিনি লিখেছিলেন, “পরমহংসমশাই রামদাদার বাড়িতে এইরূপ বার কতক আসা যাওয়া করাতে, পাড়ার লোকের তাঁহার প্রতি আর বিদ্বেষভাব কিছু রহিল না, কেহ উপহাসও করিত না। … পাড়ার মহেন্দ্র গোঁসাই আসিলেন কিন্তু কোন ভট্টাচার্য ব্রাহ্মণ আসিতেন না; ইহা আমি বিশেষ করিয়া লক্ষ্য করিয়াছিলাম। পরমহংস মশাই ছিলেন মাড়েদের ঠাকুরবাড়ির পূজারী – মাহিষ্যদের পূজারী, তাহার উপর গলায় পইতা ছিল না। এইজন্য ভট্টাচার্য ব্রাহ্মণেরা তাঁহাকে প্রণাম করিতে রাজী ছিলেন না, আর এই কারণেই, ভট্টাচার্য ব্রাহ্মণেরাও পরমহংসমশাইকে সেরূপ শ্রদ্ধার চোখে দেখিতেন না।” শ্রীরামকৃষ্ণ আন্দোলনের সামাজিক বিন্যাস প্রসঙ্গে ‘স্বামী সোমেশ্বরানন্দ’ লিখেছিলেন, “ভাটপাড়া, দক্ষিণেশ্বর ও কলকাতার হিন্দু ব্রাহ্মণেরা তাঁর কাছে বিশেষ যেতেন না, কারণ শূদ্রাণীর (রাণী রাসমণির) চাকরি করায় শ্রীরামকৃষ্ণ জাত হারিয়েছিলেন।” মথুরবাবুর কালীঘাটের পুরোহিত ‘চন্দ্রহালদারের’ ব্যবহারের মধ্যেও রামকৃষ্ণের প্রতি সমকালীন ব্রাহ্মণদের মানসিকতার একটি নজির দেখতে পাওয়া যায়। “মথুরবাবু ক্রমশঃ শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি অনুরক্ত হওয়া কালে এক সময় রামকৃষ্ণ মথুরবাবুর জানবাজারের গৃহে হাজির হন। এবং সেখানে তিনি সমাধিস্থ হন। সে সময় তাঁর কাছে কেউ ছিল না। মথুরবাবুর পুরোহিত চন্দ্রহালদার সেখানে হাজির ছিল। তাঁর ধারণা ছিল, শ্রীরামকৃষ্ণ মথুরবাবুকে কোন গুণটুন করেছে। ঠাকুরের সমাধিস্থ অবস্থাতেই চন্দ্রহালদার বলতে শুরু করল, ‘অ বামুন, বল্ না বাবুটাকে কি করে হাত করলি?’ ঠাকুর সমাধিস্থ ও নিরুত্তর। হালদার পুরোহিত তখন ক্রুদ্ধ হয়ে ‘যা শালা বল্লিনা’ বলে তাঁকে লাথি মেরে চলে গেল।”

ঊনিশ শতকের সাতের ও আটের দশক ছিল শ্রীরামকৃষ্ণ চেতনার সামাজিকীকরণের অধ্যায়। তখন গোটা দেশ হিন্দু পুনরভ্যুত্থানের জোয়ারে উত্তাল হয়ে উঠেছিল। অবশ্যই সেই জোয়ার প্রাচীনকে অনুসরণ করতে উদ্যত ছিল। সেই হিন্দু আন্দোলনের অন্যতম নায়ক ছিলেন ‘শশধর তর্কচূড়ামণি’। তিনি বৈদিক ধর্মের কোন কথা না বলে কেবলমাত্র ভক্তিমূলক পৌরাণিক ও আনুষ্ঠানিক ধর্মকেই তাঁর বক্তৃতায় তুলে ধরতেন। তিনি প্রাচীন প্রথা ও আচারগুলি প্রচার করতেন। হাঁচি, টিকটিকি ইত্যাদি নিয়মের ওপরে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা করতেন। টিকির চৌম্বক শক্তির আকর্ষণ-বিকর্ষণ, হাই তুলে তুড়ি মারবার মধ্যে অক্সিজেনের সম্পর্ক আবিষ্কার করে ব্যক্তিদের বিভ্রান্ত করতেন। এমনকি অনেক সময়েই তিনি শাস্ত্রকে বিকৃত করে বা শাস্ত্রের অংশ বিশেষ বর্জন করে তাতে বিজ্ঞানের রঙ লাগিয়ে সেই আচার-তত্ত্বকে ধর্ম বলে চালিয়ে দিতেন। যাই হোক, ‘কথামৃত’ ও ‘লীলাপ্রসঙ্গে’ শ্রীরামকৃষ্ণ ও শশধর তর্কচূড়ামণির সাক্ষাতের উল্লেখ পাওয়া যায়। শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে তিনি ভক্তিনম্রচিত্তেই নিবেদন করেছিলেন, “মহাশয়, দর্শনশাস্ত্র পড়িয়া আমার হৃদয় শুষ্ক হইয়া গিয়াছে, তাই আপনার নিকটে আসিয়াছি ভক্তিরস পাইব বলিয়া, অতএব আমি শুনি, আপনি কিছু বলুন।” শ্রীরামকৃষ্ণও তাঁর কাছে অত্যন্ত সৌজন্য দেখিয়েই বলেছিলেন, “ওগো তুমি পণ্ডিত, তুমি কিছু বল।” সেই আলোচনা শ্রীরামকৃষ্ণ ও শশধরের পারস্পরিক সৌহার্দ্য সম্পর্কের ওপরেও আলোকপাত করে। কিন্তু ইতিহাস থেকে এটাও জেনে বিস্মিত হতে হয় যে, শ্রীরামকৃষ্ণ দেহরক্ষা করবার পরে, সেই চূড়ামণি মহাশয়েরই শিষ্য ‘পদ্মনাথ দেবশর্মা’, ১৩২৭ বঙ্গাব্দের ‘সাহিত্য’ পত্রিকায় চূড়ামণি মহাশয়ের লেখা একটি চিঠিকে ভিত্তি করে শ্রীরামকৃষ্ণের ওপরে তীব্র কটাক্ষ হেনেছিলেন। সেই চিঠির বক্তব্যে তিনি জানিয়েছিলেন, “রামকৃষ্ণ, ‘পরমহংস’ উপাধি কাহার নিকট পাইয়াছিলেন, তাহা জানিনা। খুব সম্ভব ইহা সাধারণ লোকের নিকট পাইয়াছিলেন। যদি তাঁহার গুরুই ঐ উপাধি দিয়া থাকেন, তবে তাহাও ভ্রান্তিমূলক বুঝিতে হইবে। … তাঁহাকে ‘অবধূত আশ্রমী’ বলিলে নিতান্ত অসঙ্গত হয় না। আমি কোন ধর্মতত্ত্ব শিক্ষা বা উপদেশ পাওয়ার নিমিত্ত তাঁহার নিকট যাই নাই, কারণ তিনি কোন প্রকার শাস্ত্রই জানিতেন না।” ওই একই লেখায় তিনি শ্রীরামকৃষ্ণের সমাধিভাব প্রসঙ্গে জানিয়েছিলেন, “সমাধির যে অসংখ্য স্তর আছে এবং যেগুলি করিতে পারিলে নির্বিকল্প সমাধি সম্ভবপর হয়, শ্রীরামকৃষ্ণের তাহা জানা ছিল না। কারণ, লেখাপড়া তিনি আদৌ জানিতেন না।” ওই দীর্ঘপত্রে চূড়ামণি শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি আগাগোড়া কটাক্ষ হেনেছিলেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ

শ্রীরামকৃষ্ণ জীবনে খ্রিস্টান মিশনারিদের প্রতিক্রিয়াও অনুল্লেখের নয়। শ্রীরামকৃষ্ণ জীবনী পাঠক-পাঠিকা মাত্রেই ‘রেভারেণ্ড কুক’ ও ‘হোস্ট’ সাহেবের নামের সঙ্গে পরিচিত রয়েছেন। ঘটনার বিবরণে তাঁদের শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি সৌজন্য প্রদর্শনের বিষয় উল্লিখিত থাকলেও প্রকৃত অর্থে তাঁদের ধর্মান্ধ মানসিকতায় শ্রীরামকৃষ্ণ কখনোই ঔজ্জ্বল্যের সঙ্গে গৃহীত হননি। অতীতে ‘শঙ্করীপ্রসাদ বসু’ সমেত একাধিক গবেষকই এই বিষয়ে সহমত ছিলেন। খ্রিস্টান ব্যক্তিবর্গের সেই নমুনার কথা কথামৃত গ্রন্থেও বিবৃত করা হয়েছে। শ্রীরামকৃষ্ণ ও রামচন্দ্র দত্তের কথোপকথনেও সেটার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। সমকালীন খ্রিস্টান পত্রিকা ‘Indian Empire’ তখন বিশেষ দাপটের সঙ্গেই চালু ছিল। ওই পত্রিকার সম্পাদকের সঙ্গে রামচন্দ্র দত্তের বিশেষ আলাপ ছিল। রামচন্দ্র দত্ত সেদিন শ্রীরামকৃষ্ণকে জানিয়েছিলেন, “একজন খবরের কাগজের (Indian Empire) সম্পাদক আপনার নিন্দা করছিল।” প্রত্যুত্তরে শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁকে বলেছিলেন, “তা করলেই বা।” পরবর্তীকালে ‘ম্যাক্সমূলার’ লিখিত ‘রামকৃষ্ণ’ গ্রন্থ প্রকাশিত হওয়ার পরে দেশব্যাপী যে প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছিল, তাতে মিশনারি পত্রিকাগুলিও যোগ দিয়েছিল। তখন ‘অ্যার্থীনিয়াম’ পত্রিকা শ্রীরামকৃষ্ণ প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছিল, “তিনি (রামকৃষ্ণ) বেদান্ত দর্শনের অনুগামী কিন্তু পণ্ডিত নন, সংস্কৃত বা ইংরাজী জানতেন না। বস্তুতঃপক্ষে তিনি নিছক এক গরিব ভিখারি, যিনি বাড়াবাড়ি কৃচ্ছ্রসাধন করে নিজের শরীর নষ্ট করেছিলেন।” ওই সময়ে ‘হার্ভেস্ট ফিল্ড পত্রিকা’য় ‘ই. ডবলিউ. টি.’ রামকৃষ্ণ প্রসঙ্গে লিখেছিলেন, “রামকৃষ্ণের প্রেম, মনস্বিতা এবং বিবেকের দিক দিয়ে অভাবগ্রস্ত। তার ফলে তা বেহিসেবি এবং উন্মত্ত।” ‘রেভারেণ্ড মার্ডক’ যিনি অর্ধ শতাব্দিকাল ধরে ভারতবর্ষে অবস্থান করেছিলেন, এবং ‘খৃষ্টান লিটারেচার সোসাইটি’র কর্ণধার হয়ে একাধিক পুস্তক রচনা করেছিলেন, যাঁর জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্যই ছিল হিন্দুধর্মকে কদর্যরূপে প্রকাশ করা – সেই মার্ডক শ্রীরামকৃষ্ণ সম্বন্ধে জানিয়েছিলেন, “বিবেকানন্দের গুরু শাস্ত্র-টাস্ত্র কিছু জানিতেন না – বিবেকানন্দ গুরুর উপরে মিথ্যা গুণারোপ করেছেন।”
ঊনিশ শতকের বঙ্গসমাজে ‘ব্রাহ্মসমাজের’ প্রভাব অপরিসীম ছিল। ১৮২৮ সালে ‘রাজা রামমোহন রায়’ ‘ব্রহ্মসভা’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। রামমোহনের দেহত্যাগের পরে ১৮৪৩ সালে ‘দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের’ হাতে সেটা ‘ব্রাহ্মসমাজ’-এ পরিণত হয়েছিল। ১৮৫৮ সালে ‘কেশবচন্দ্ৰ সেন’ ব্রাহ্মসমাজে যোগ দিয়েছিলেন এবং সেই সমাজে সংস্কার আন্দোলনকে জোরদার করেছিলেন। এর ফলে ব্রাহ্মসমাজের প্রাচীনপন্থী ও নতুন পন্থীদের মধ্যে সংঘর্ষ বেঁধেছিল। তার ফলে ১৮৬৬ সালে ব্রাহ্মসমাজ, ‘আদি ব্রাহ্মসমাজ’ ও ‘ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজে’ বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল। দেবেন্দ্রনাথ আদি সমাজের কর্ণধার থেকে গিয়েছিলেন, এবং কেশবচন্দ্র ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজের কর্ণধার হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে পুনরায় নব্য ও প্রাচীনদের মধ্যে সংঘর্ষ দেখা দিলে ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ ‘সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ’ ও ‘নববিধান ব্রাহ্মসমাজে’ বিভক্ত হয়েছিল (১৮৭৮ সালে)। সেই বিভাগে সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের নেতৃত্বে ছিলেন ‘শিবনাথ শাস্ত্রী’ এবং নববিধান ব্রাহ্মসমাজের দায়িত্বে ছিলেন কেশবচন্দ্র। ব্রাহ্মসমাজের সেই ধারাবাহিক বিবর্তনের পথে দেবেন্দ্রনাথ, কেশবচন্দ্র ও শিবনাথ শাস্ত্রী প্রমুখ ব্যক্তিত্বের নেতৃত্বও স্মরণীয়। ঐ সব নমস্য ব্যক্তিদের সঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণের বিশেষ পরিচিতি ও প্রভাবের কথা ইতিহাসে বহুল বিবৃত। শ্রীরামকৃষ্ণ নিজস্ব আগ্রহেই ব্রাহ্মসমাজে হাজির হয়েছিলেন, তাঁদের নেতৃত্বের অধিকারী ব্যক্তিদের সঙ্গে সাক্ষাৎও করেছিলেন। তাঁদের প্রার্থনা সভাতেও তিনি হাজির থেকেছিলেন। কিন্তু সেসব সত্ত্বেও তাঁকে নিয়ে ব্রাহ্মদের বিসংবাদ রহিত হয়নি। অনেকেই হয়ত জানেন যে, নিজের সাধক জীবনের প্রথম পর্বে মথুরবাবুর সঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণ মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিলেন। মহর্ষিকে তিনি ‘কলিরজনক’ রূপে আখ্যাতও করেছিলেন। কিন্তু তাঁর পোষাক কৌলিন্য না থাকবার জন্য, ব্রাহ্মউৎসবে যোগদানে আগ্রহী হওয়া সত্ত্বেও তিনি তাতে যোগ দিতে পারেননি। কারণ মহর্ষি মথুরবাবুকে জানিয়েছিলেন, “শ্রীরামকৃষ্ণ যেন উৎসবে যোগদান না করেন, কারণ গায়ে উড়ানি থাকবে না, অসভ্যতা হবে।” এরপরে ১৮৭৫ সালে শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে কেশবচন্দ্রের সাক্ষাৎ ঘটবার পরে তাঁদের মধ্যেকার পারস্পরিক সৌহার্দ নিবিড় হয়েছিল। কিন্তু তাঁদের সেই নৈকট্যকে ব্রাহ্মসমাজ যে খুব একটা আনন্দের সঙ্গে যে গ্রহণ করেনি, লীলাপ্রসঙ্গ গ্রন্থে সেটার বিস্তৃত উল্লেখ পাওয়া যায়। মহেন্দ্রনাথ দত্তের লেখনীতেও সেই ধরণের ঘটনার বর্ণনা পাওয়া যায়, “গঙ্গার ঘাটে কেশববাবুর বক্তৃতা; পরমহংস মশাইও বক্তৃতা শুনিতেছিলেন, কিন্তু খানিকক্ষণ পরেই তিনি বিরক্ত হ‍ইয়া নিজের ঘরে চলিয়া যাইলেন। পরমহংস মশাইকে চলিয়া যাইতে দেখিয়া কেশববাবু ভাবিলেন যে তাহা হইলে বোধহয় বক্তৃতায় কোন ত্রুটি হইয়াছে। কিন্তু অন্যান্য শ্রোতারা বলিতে লাগিলেন, ‘লোকটা অশিক্ষিত, মুখ্যু, কোনো কিছু বোঝে না, তাই চলে গেল’।” ব্রাহ্মনেতা ‘প্রতাপচন্দ্র মজুমদার’ তো শ্রীরামকৃষ্ণ প্রসঙ্গে এটাও বলেছিলেন যে, “তাঁর ভাষা জঘন্য ধরনের নোংরা, তিনি কুত্রাপি বৈদান্তিক নন ও তিনি স্ত্রীর প্রতি বর্বরোচিত ব্যবহার করেছিলেন।” পরবর্তীকালে সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ ও নববিধান ব্রাহ্মসমাজ গঠিত হওয়ার পরে শিবনাথ শাস্ত্রী শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে গমনাগমন বন্ধ করেছিলেন। সেটার কারণ হিসেবে তিনি বলেছিলেন যে, তিনি যদি ঘনঘন দক্ষিণেশ্বর গমন করেন তাহলে তাঁর দেখাদেখি অন্য সকলেও ওই রকম করবেন এবং তাতে দল ভেঙে যাবে। এছাড়া শ্রীরামকৃষ্ণের সমাধিভাব প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন যে, সেটা রামকৃষ্ণের ‘স্নায়বিক দৌর্বল্য’ (hysteria or epileptic fits)। ব্রাহ্মসমাজের উপাসনাকক্ষে শ্রীরামকৃষ্ণের চরম নিগ্রহের বিবরণও অনেকের জানা রয়েছে। নরেন্দ্রনাথের সন্ধান মানসে একদা তিনি সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ প্রার্থনাকক্ষে হাজির হয়েছিলেন এবং সেখানেই সমাধিস্থ হয়েছিলেন। তাঁর সেই রূপ দর্শন অভিলাষে জনতা হুড়োহুড়ি করতে আরম্ভ করবার পরে ব্রাহ্মসমাজ কর্তৃপক্ষ কক্ষের গ্যাসবাতিগুলি নিভিয়ে দিয়েছিলেন। তার ফলে কক্ষের মধ্যে হুড়োহুড়ি ভয়ঙ্কর আকার নিয়েছিল। নরেন্দ্রনাথ সেখানে শ্রীরামকৃষ্ণের উপস্থিতি লক্ষ্য করেছিলেন এবং তাঁর কাছেই হাজির ছিলেন। তাঁর সমাধি ভাঙবার পরে তিনি তৎক্ষণাৎ সমাজগৃহের পিছনের দরজা দিয়ে তাঁকে বাইরে বের করে এনেছিলেন। ঐ দিনের ঘটনায় তিনি আরো লক্ষ্য করেছিলেন যে, ঐ সমাজের আচার্য বা সমাজস্থ কোন বিশিষ্ট ব্যক্তি ঠাকুরকে সাদর আহ্বান করা তো দূরের কথা, তাঁর প্রতি শিষ্টাচারও প্রদর্শন করেন নি।

সমকালে অন্যান্য ধর্মান্দোলনের সঙ্গে বৈষ্ণব সমাজেও ধর্মান্দোলনের জোয়ার এসেছিল। সমকালীন বৈষ্ণব চূড়ামণি, ‘ভগবান দাস বাবাজী’ ও ‘বৈষ্ণব চরণের’ বৈষ্ণব সমাজে বিশেষ প্রতিপত্তি ছিল। সেই আন্দোলনের উপাদান হিসাবে দেশের ইতঃস্ততঃ তখন হরিসভা, ভাগবত পাঠ, নাম সংকীর্তন, নৃত্য প্রভৃতি অনুষ্ঠান সাড়ম্বরে পালিত হত। লীলাপ্রসঙ্গ গ্রন্থ থেকে সেই ধরণের এক হরিসভা ও শ্রীরামকৃষ্ণ নিগ্রহের সংবাদ সম্পর্কে জ্ঞাত হওয়া যায়। তখন কলুটোলার হরিসভার সভ্যরা নিজেদের শ্রীচৈতন্যের একান্ত পদাশ্রিত বলে মনে করতেন; এবং সেকথা অনুক্ষণ স্মরণ রাখার উদ্দেশ্যে হরিসভার আসরে তাঁরা একটি আসন ফুল ও মালা দিয়ে শোভিত রাখতেন। উদ্দেশ্য ছিল, সেটিকে ‘শ্রীচৈতন্যের আসন’ হিসাবে চিহ্নিত করা; ভক্তিভরে ভাবা যে, ঐ আসনে শ্রীচৈতন্য সমাসীন এবং ভক্তরা তাঁরই সম্মুখে ভাগবত কথকতা স্মরণ করছেন। একবার সেই আসরে বৈষ্ণব চরণ শ্রীমদ্ভাগবত পাঠে ব্রতী ছিলেন। এমতাবস্থায় শ্রীরামকৃষ্ণ সেখানে হাজির হয়েছিলেন এবং ভাবাবেগে শ্রীচৈতন্যাসনে দণ্ডায়মান হয়ে সমাধিস্থ হয়েছিলেন। সমাধি ভাঙবার পরে তিনি সেই কীর্তন আসরে যোগদান করে সকলকে আনন্দাপ্লুত করেছিলেন। পরবর্তীকালে শ্রীরামকৃষ্ণের ঐ আচরণ বৈষ্ণব সমাজে বিশেষ বিতর্কের সৃষ্টি করেছিল। বিশেষ বৈষ্ণব ভক্তরা ভেবেছিলেন যে, নামযশঃ প্রার্থী ধূর্ত ভণ্ডেরা স্বার্থসিদ্ধির জন্য ভবিষ্যতে আর কখনো যাতে আসন অধিকার না করতে পারেন, সেই ব্যাপারে তাঁদের ব্যবস্থা নিতে হবে। তাই তাঁরা বৈষ্ণব সমাজে শ্রীরামকৃষ্ণের ঐ ক্রিয়াকাণ্ডের সংবাদ পাঠিয়েছিলেন। এমন কি তখন কালনায় অবস্থানরত বৈষ্ণবচূড়ামণি ভগবানদাস বাবাজীকেও সেই সংবাদ জানানো হয়েছিল, এবং সকলেই তাঁর কাছে ত্রুটি সংশোধনের পথ জানতে ব্যগ্র হয়ে উঠেছিলেন। শ্রীচৈতন্য পদাশ্রিত সিদ্ধবাবাজী রামকৃষ্ণের ঐ ঘটনা সম্পর্কে অবগত হয়ে তাঁর উপরে বিশেষ ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন। ক্রোধান্ধ হয়ে তিনি শ্রীরামকৃষ্ণের উদ্দেশ্য কটুবাক্য প্রয়োগ তো করেছিলেনই, সেই সঙ্গে তাঁকে ভণ্ড বলতেও কুণ্ঠিত হননি। যদিও পরবর্তীকালে ঐ ভগবানদাস বাবাজী শ্রীরামকৃষ্ণ দর্শনে কৃতার্থ হয়েছিলেন এবং তাঁর উপদেশ বাণীতেই নিজেকে চিনতে পেরেছিলেন।
সমকালে সাধারণের মানসিকতাও শ্রীরামকৃষ্ণ সম্পর্কে খুব একটা উচ্চাঙ্গের ছিল না। ধনগোপাল মুখোপাধ্যায় সাধনকালে তাঁর ভাবান্তর এবং প্রতিবেশী প্রতিক্রিয়ার বিবরণ দিতে গিয়ে লিখেছিলেন, “… অবশেষে তাঁর প্রার্থনা ও তাঁর ক্রন্দন এমন উচ্চকণ্ঠ হলো যে পাড়ার সম্ভ্রান্ত ভদ্রলোকেরা বিরক্তবোধ করলেন। তাঁরা নিজেদের মধ্যে রাগে গজগজ করতে লাগলেন। তাঁরা বললেন, ‘এ তো স্রেফ অত্যাচার। ঘুমোবার একটা সময় আছে। প্রার্থনার সময় নির্দিষ্ট। দেবীর বিশ্রামের সময় তাঁকে শয়ন না দিয়ে তাঁর সঙ্গে অনর্থক বকবক করা – এসব দুষ্কর্ম কোন সাম্মানিক পুরোহিত করে না। কিন্তু এসব কী!’ …” এমনকি শ্রীরামকৃষ্ণ-পার্ষদ ‘যোগানন্দের’ সামনেও জনৈক নৌকাযাত্রী শ্রীরামকৃষ্ণ সম্পর্কে কটু বাক্য বলেছিলেন। একদা যোগানন্দ দক্ষিণেশ্বর অভিমুখে গহনার নৌকায় আসছিলেন। সেই সংবাদ অবগত হয়ে জনৈক যাত্রী তাঁকে বলেছিলেন, “ঐ এক ঢং আর কি; ভাল খাচ্চেন, গদিতে শুচ্চেন, আর ধর্মের ভান করে যত সব স্কুলের ছেলের মাথা খাচ্ছেন।” শ্রীরামকৃষ্ণপার্ষদ ‘নিরঞ্জনের’ সামনেও সেই নৌকাযাত্রীরা ওই জাতীয় উক্তি করেছিলেন। এরপরে রামকৃষ্ণের প্রতি সমকালীন ব্যক্তি মানসিকতা বোঝানোর উদ্যোগে স্বামীজী ভ্রাতা মহেন্দ্ৰনাথ দত্তের লেখনী থেকে কিছুটা তুলে ধরা অসঙ্গত হবে না – “সাধারণ লোকের ধারণা ছিল যে, দক্ষিণেশ্বরে পরমহংস নামে কে একজন লোক থাকে, তাহার মিরগি হয়, কিন্তু হাত-পা খেঁচা খেঁচি করে না, আপনা-আপনি ভাল হয়, ডাক্তার দেখাইতে হয় না। … আবার শুনা গেল যে, সে লোকটি রাসমণিদের পূজারী, কালীপূজা করিয়া থাকে। লোকটার নাম আবার ‘পরমহংস’, এ আবার কি কথা! লোকেরা অমনি ব্যঙ্গচ্ছলে পরমহংসকে ‘গ্রেটগূস’ (Great goose) বলিতে লাগিল। পরমহংস মশাই-এর প্রতি তখনকার লোকের প্রথমে এরূপ কিঞ্চিৎ অবজ্ঞা বা অশ্রদ্ধার ভাব ছিল।” মহেন্দ্র দত্তের বিবরণী থেকে আরো জানা যায় যে, একদিন শ্রীরামকৃষ্ণ সিমলায় ‘সুরেশমিত্তির’-এর বাড়িতে গেলে তাঁর জনৈক আত্মীয় যিনি তখন সরকারী উচ্চপদে বহাল ছিলেন, তিনি শ্রীরামকৃষ্ণের সামনেই মন্তব্য করেছিলেন – “পরমহংস মশাই ছোট ছেলেগুলিকে বখাচ্ছেন, নষ্ট করছেন” প্রভৃতি।

উপরোক্ত আলোচনায় শ্রীরামকৃষ্ণ ও তাঁর সমকালীন পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির চালচিত্র হাজির করা হয়েছে। ওই সব ঘটনা যেমন শ্রীরামকৃষ্ণ ও পরিবেশ প্রতিক্রিয়াকে ব্যক্ত করে, তেমনি শ্রীরামকৃষ্ণ শ্রেষ্ঠত্ব প্রচারে কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর দাবীকেও নস্যাৎ করে দেয়। বিবৃত ঘটনার সমাহারে পাঠক-পাঠিকারা নিশ্চিত অবগত হতে পেরেছেন যে, রাণী রাসমণির ‘কালী সাধনা’ শ্রীরামকৃষ্ণকে অপরাজেয় করেনি। নিতান্ত সাধারণ মানুষের মত পদে পদে হোঁচট খেয়ে তবেই তিনি জীবনের প্রত্যন্ত প্রদেশে পৌঁছাতে পেরেছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণের জীবন, সংগ্রামে পরিপূর্ন ছিল; কোন মতেই কোন কিছুর সঙ্গেই তিনি কখনো আপস করেননি। আঘাত অপমান নিগ্রহ কটুবাক্য সব কিছুই তিনি নীরবে হজম করেছিলেন। সেসবের উত্তরে তিনি কেবলই হেসেছিলেন। বিস্ময়ের ব্যাপার হল যে, রানীর কর্মচারীরা, ব্রাহ্মণ, ব্রাহ্মসমাজী, খ্রিস্টান মিশনারি, বৈষ্ণব সমাজী, সাধারণ মানুষ সকলের ঐ প্রতিক্রিয়া পরাভূত হয়ে ক্রমাগত জনতার স্রোত তাঁকে আবর্তন করে ফিরত। সেই প্রতিক্রিয়ার সংবাদ আপাত অপ্রীতিকর ঠেকলেও সেটার মধ্যে বিরাট এক সত্য নিহিত রয়েছে। সেই তীব্র প্রতিক্রিয়া সত্ত্বেও শ্রীরামকৃষ্ণ ঊনিশ শতকে ও তার পরেও সর্বজনপূজ্য একজন ব্যক্তিত্ব হয়ে রয়েছেন। কারণ তিনি কলকাতাকে জয় করেছিলেন। ঐ প্রতিক্রিয়াই তাঁকে বিজয়ী করেছে। এখানে অন্য শর্ত গৌণ। কার্যতঃ শ্রীরামকৃষ্ণের শ্রেষ্ঠত্ব ও সর্বজনগ্রাহ্যতা কোন ধর্মের নিগড়ে কখনোই বাঁধা ছিল না। তিনি শ্রেষ্ঠ ছিলেন তাঁর প্রজ্ঞায় – জ্ঞানে – চেতনায় – সমাজমনস্কতায়। তাই তাঁর জীবন যতখানি দেবত্বে – ততখানিই মানবত্বে মহিমান্বিত ছিল। তাই সবশেষে অধ্যাপক ‘রিবাকভের’ ভাষায় বলতে পারা যায় – “সবার উপরে রামকৃষ্ণ ছিলেন কবি। … আকাশে মেঘ দেখলে তাঁর ভাবোদয় হচ্ছে, প্রকৃতির শোভা দেখে তিনি আত্মহারা হচ্ছেন। … তিনি সাধারণ মানুষের, আবার সাধারণ হয়েও অসাধারণ। তিনি ধুলো কাদা মাখা এই পৃথিবীরই মানুষ। লোকোত্তর হয়েও তিনি সকলের লোক।”

সংস্কৃত এবং উর্দু ভাষার ইতিহাস -১

আশিফুল ইসলাম জিন্নাহঃ মানব সভ্যতা বিস্তারের সাথে ভাষার বিস্তরণের ইতিহাস ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মধ্য এশিয়া থেকে আর্যদের একটি শাখা ইউরোপে প্রবেশ করে। এদের ভাষাকে বলা হয় ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা। ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার উপশাখা হলো ইন্দো-ইরানীয় ভাষা। আর্যভাষা ইন্দো-ইরানীয় ভাষার একটি শাখা। ধর্মগ্রন্থ বেদের ভাষা বলে একে বৈদিক আর্যভাষাও বলা হয়। ভারতবর্ষের আর্যায়ন প্রক্রিয়ায় স্থানীয় আনার্য ভাষাগুলো ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যায়। অনার্য ভাষাগুলোর কিছু শব্দ শুধু টিকে থাকে। কালের পরিক্রমায় আর্য ভাষায় বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। বিখ্যাত ব্যাকরণবিদ পাণিনি ও ভাষ্যকার পতঞ্জলি এর সংস্কার করেন। তাই এর নাম হয় সংস্কৃত। সংস্কৃত প্রাচীন পৃথিবীর সেরা ভাষাগুলোর একটি। সংস্কৃত ভাষায় রচিত হয়েছে রামায়ণ ও মহাভারতের মত মহাকাব্য। কবি কালিদাস, বিজ্ঞানী আর্যভট্ট এবং বরাহ মিহিরের রচনার ভাষা ছিল সংস্কৃত।

আরো পড়ুন- পৃথিবীর এমন একটি জায়গা, যেটি ৬ মাস এক দেশে, ৬ মাস অন্য দেশে! বদলে যায় আইনও

সংস্কৃত ভাষার যে রূপটি ছিল সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা, তা এক সময় শিথিল ও সরল হয়ে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন আঞ্চলিক রূপ ধারণ করে। কালক্রমে এগুলোকেই বলা হয় প্রাকৃত ভাষা। এ ভাষাগুলোর প্রকৃতি বা মূল সংস্কৃত, তাই এদের বলা হয় প্রাকৃত ভাষা। অথবা প্রকৃতি অর্থ সাধারণ জনগণ অর্থাৎ প্রাকৃত অর্থ প্রাকৃতজনের ভাষা। প্রাকৃতভাষার শেষ স্তর হচ্ছে অপভ্রংশ। এরকম একটি অপভ্রংশ হচ্ছে শৌরসেনী অপভ্রংশ। মুসলিমরা ভারতে আসার সময় দিল্লি ও তার আশেপাশে যে ভাষা প্রচলিত ছিল তার নাম খাড়িবুলি, যেটি ছিল শৌরসেনী অপভ্রংশের স্থানীয় রূপ।

প্রাচীন ভারতে দুটি লিপির ইতিহাস পাওয়া যায়। একটি ব্রাহ্মী লিপি, অন্যাটি খরোষ্ঠী লিপি। ব্রাহ্মী লেখা হতো বাম থেকে ডানদিকে আর খরোষ্ঠী ডান থেকে বামে। ব্রাহ্মী লিপি থেকেই ভারতের অধিকাংশ লিপি বিকাশিত হয়। এরকম একটি লিপি দেবনাগরি লিপি(উৎপত্তি আনুমানিক একাদশ শতক)। হিন্দি ভাষা লেখা হয় দেবনাগরি লিপিতে। তবে হিন্দি ঠিক কবে থেকে দেবনিাগরি লিপিতে লেখা শুরু হয় তা গবেষণার দাবি রাখে। হিন্দি কবি মালিক মুহম্মাদ জয়সী তাঁর ‘পদুমাবৎ’ কাব্য (যার উপর ভিত্তি করে আলোচিত হিন্দি ছবি পদ্মাবতী নির্মিত হয়েছে) লিখেছিলেন ফারসি হরফে (ব্রিটানিকা)। তবে ফারসি প্রভাবিত আরবি হরফে লিখিত হিন্দুস্তানি সরকারি ভাষা হলেও সাধারণ মাসুষের মধ্যে দেবনাগরি লিপিতে লিখিত হিন্দি অধিক জনপ্রিয় ছিল বলে ধারণা করা হয়।

পৃথিবীর এমন একটি জায়গা, যেটি ৬ মাস এক দেশে, ৬ মাস অন্য দেশে! বদলে যায় আইনও

এত বৃহৎ পৃথিবীতে রহস্য রোমাঞ্চের শেষ নেই। কোনো জায়গায় ছোট্ট একখানা জমির জন্য লড়াই চলে, তো কখনো একটা গোটা দেশকেই গ্রাস করে নেয় আগ্রাসী শক্তি। তবে আজ আমরা এমন এক জায়গার কথা বলবো যেখানে ৬-৬ মাস করে সরকার চালায় দুই দেশ!

আরো পড়ুন- দীর্ঘ ইতিহাস বুকে চেপে আজোও সময় জানান দেয় ঘড়ির মোড়ের ঘড়ি

হ্যাঁ, এমনও জায়গা রয়েছে বিশ্বে। ইউরোপে অবস্থিত এই বিশেষ জায়গাটি অবস্থিত ফ্রান্স ও স্পেনের সীমান্তে। সেখানে দুই দেশই ৬-৬ মাস করে নিজেদের সরকার চালায়। মজার ব্যাপার হলো দুই দেশেরই সম্মতি রয়েছে এ ব্যাপারে।

কোনো রক্তক্ষয়ী, প্রাণনাশি যুদ্ধ ছাড়াই একে অপরের সাথে মিলেমিশে ফ্রান্স এবং স্পেন দুজনে মিলে সরকার চলায় ফিজান্ট নামের একটি দ্বীপে। বছরের ১লা ফেব্রুয়ারি থেকে ৩১শে জুলাই অবধি দ্বীপটির মালিকানা থাকে থাকে স্পেনের কাছে। এরপর ১লা আগস্ট থেকে ৩১ শে জানুয়ারি অবধি ফ্রান্স নিয়ন্ত্রণ করে এই দ্বীপটি।

বিগত ৩৫০ বছর ধরে উভয় দেশ এই রীতি মেনে চলেছে। দুই দেশের সীমান্তের মাঝে বয়ে চলেছে বিদাসোয়া নামের একটি নদী। নদীর ওপর রয়েছে এই বিশেষ দ্বীপ। ফিজান্ট নামের এই দ্বীপে কেও বসবাস করেন না। দ্বীপে ফরাসি এবং স্প্যানিশ, উভয় বাহিনীর জওয়ানরাই অবস্থান করছে সেখানে।

আরো পড়ুন- আলাস্কান উড ফ্রগ, এক আশ্চর্য ক্ষমতার অধিকারী এই ব্যাঙ

দ্বীপের ওপর একটি ঐতিহাসিক ভবনও নির্মিত হয়েছে। এই দ্বীপের মালিকানা নিয়ে দুই দেশের মধ্যে চুক্তি হয় ১৬৫৯ সালে। আরো অবাক করা বিষয় এই যে, এক রাজকীয় বিয়ের মাধ্যমে এই চুক্তি সম্পন্ন হয়। স্পেনের রাজা চতুর্থ ফিলিপ বিয়ে করেন ফরাসি রাজা লুই চতুর্দশের কন্যাকে। তখন এই দ্বীপ নিয়ে দুদেশের বিরোধীতার শেষ হয়। প্রসঙ্গত একই দ্বীপে উভয় দেশের শাসনকে বলা হয় কনডমিনিয়াম।

দ্বীপটি অবশ্য আকার আয়তনে খুবই ছোট। ২০০ মিটার লম্বা এবং ৪০ মিটার চওড়া দ্বীপ নিয়ে উদ্বিগ্ন দুই দেশের স্থানীয় জনগণ। নদী বক্ষে ডুবতে বসেছে দ্বীপটি। যদিও দুদেশের সরকার এক টাকাও খরচ করতে রাজি নয় দ্বীপটিকে বাঁচিয়ে রাখতে।

আলাস্কান উড ফ্রগ, এক আশ্চর্য ক্ষমতার অধিকারী এই ব্যাঙ

আলাস্কান উড ফ্রগ। এক আশ্চর্য ক্ষমতার অধিকারী ” সাত মাস ‘নিষ্প্রাণ’ দেহ, বরফে জমাট বেঁধেও দিব্যি জীবত থাকে এই ব্যাঙের মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে অদ্ভুত এক ক্ষমতা। বা বলা ভালো, চরম প্রকৃতির সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতেই বিবর্তনের এই আশ্চর্য পথে হেঁটেছে এই প্রাণীটি।

আর্কটিক সার্কেল মধ্যে অবস্থিত হওয়ায়, চিরকালই শীতের দাপট থাকা আলাস্কায়। বছরের বেশিরভাগ সময়েই সেখানকার তাপমাত্রা থাকে হিমাঙ্কের নিচে। স্তন্যপায়ী প্রাণীরা এই তাপমাত্রা সয়ে গেলেও, শীতলরক্তের প্রাণীদের ক্ষেত্রে এই পরিবেশে বেঁচে থাকা এক-কথায় অসম্ভব। তবে এই প্রতিকূলতার সঙ্গেও নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে আলাস্কান উড ফ্রগ।

আরো পড়ুন- ভারতের এই খনি থেকে মিলবে ১৭ হাজার কোটি টাকার সোনা! উত্তোলনের বড় পদক্ষেপ কেন্দ্রের

আলাস্কান উড ফ্রগ

সাধারণত এই ব্যাঙের দেহের দুই-তৃতীয়াংশই নির্মিত জল দিয়ে। শীতকালে তা সম্পূর্ণভাবে জমাট বেঁধে পরিণত হয় বরফে। জমাট বাঁধে রক্তও। বন্ধ হয়ে যায় হৃদপিণ্ড। তবে গোটা দেহ পাথরের মতো শক্ত হয়ে গেলেও প্রাণ যায় না এই প্রাণীটির। শীতের পর বসন্তের আগমনে যখন একটু একটু করে পারদ চড়ে আলাস্কায়, তখন ফের সজীব হয়ে ওঠে উড ফ্রগরা। ফের শুরু হয় রক্তপ্রবাহ। তবে একদিন দুদিন নয়, টানা মাস সাতেক এভাবেই জমাট বেঁধে থাকতে পারে এই ব্যাঙ। কাজেই শীতঘুম না বলে, এ-হেন ঘটনাকে ধ্যানমগ্নতা বলাই যায় অনায়াসে! কিন্তু কীভাবে সম্ভব হয় এমনটা?

আলাস্কান উড ফ্রগ

এই আশ্চর্য ক্ষমতার পিছনে দায়ী ব্যাঙের দেহে সঞ্চিত গ্লাইকোজেন। গ্রীষ্ম কিংবা বসন্তে দেহের সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গেই প্রচুর পরিমাণ গ্লাইকোজেন সংগ্রহ করে রাখে উডফ্রগ। ফলে রক্ত জমাট বাঁধলেও, কোষে কোষে খাদ্য সরবরাহের সমস্যা থাকে না কোনো। এই গ্লাইকোজেনকেই গ্লুকোজে পরিণত করে প্রতিটি অঙ্গে শক্তি সরবরাহ করে আলাস্কান উড ফ্রগ। শীতের শেষে তাপমাত্রা বাড়তে শুরু করলে আরও বেশি মাত্রায় তৈরি হয় গ্লুকোজ। শিথিল হয় শরীরের পেশি। কাজেই ফের চলচ্ছক্তি ফিরে পায় তারা। তবে মজার বিষয় হল, চরম প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করার ক্ষমতা আয়ত্ত করলেও, অনেক সময় জমাট বাঁধা অবস্থাতেও খাদকদের শিকার হয়ে থাকে এই ব্যাঙ।