রানা চক্রবর্তীঃ শিল্প ও সঙ্গীতের ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে রাজা মানসিং ও মৃগনয়নার প্রেমোপাখ্যান। ঘটনার ঘনঘটায় মানবিক সম্পর্ক ইতিহাসের গভীরে দাগ না কাটলেও, গোয়ালিয়রের ইতিহাসের দিকে তাকালে সেটা অন্ততঃ মনে হয় না। তাই ওই ঘটনার পরে বহু যুগ পেরিয়ে এসেও গোয়ালিয়র আজও মানসিং ও মৃগনয়নার যুগল প্রেমের পরিচয় বহন করে চলেছে। সেখানকার প্রাসাদ, মন্দির, মহলের পর মহল, চিত্রশালা, সঙ্গীতভবন সর্বত্র শুধু উক্ত যুগলের উপস্থিতি দেখতে পাওয়া যায়, তাঁদের ঘিরে আজও সেখানে অজস্র কিংবদন্তী প্রচলিত রয়েছে। যদিও সেই কিংবদন্তী কিন্তু বলে, মৃগনয়না কে? তাঁর আসল নাম তো ‘নিন্নি’।
মানসিং তোমরের সঙ্গে নিন্নির প্রথম দেখা হওয়ার ঘটনাটা গল্পের মতোই। মানসিং যখন গোয়ালিয়রের রাজা ছিলেন, তখনও পানিপথের প্রথম যুদ্ধ হয়নি। এই ‘তোমর’ বংশীয় রাজপুত বীর যতদিন গোয়ালিয়রের সিংহাসনে আসীন ছিলেন, ততদিন কোন বিদেশি আক্রমণের আঁচ তাঁর গায়ে লাগেনি। ‘বাহলোল লোদী’ পাঁচবার গোয়ালিয়র আক্রমণ করেও মানসিংয়ের রাজ্য থেকে একফালি মাটিও কখনো কেড়ে নিতে পারেননি। প্রত্যেকবার হয় সম্মুখ যুদ্ধে, আর না হয় কূটকৌশলে মানসিং প্রতিবারই তাঁকে পরাজিত করেছিলেন। বাহলোলের পরে দিল্লীর তখতে বসেছিলেন ‘সিকন্দর লোদী’, তিনি মানসিংকে জব্দ করবার জন্য একটি নতুন নগরের পত্তন করেছিলেন (১৫০৫ খৃষ্টাব্দে)। সেই নগরটি হল আগ্রা। যদিও মানসিংয়ের তাতে কোন ক্ষতি হয়নি। তিনি ১৪৮৬ খৃষ্টাব্দ থেকে ১৫১৭ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত স্বমহিমায় স্বগৌরবে রাজত্ব করেছিলেন। ওই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে সিকন্দর শুধুমাত্র নরবরের দুর্গটি ধ্বংস করতে পেরেছিলেন। নরবর আসলে কাছোরার বংশীয় রাজসিংহের দুর্গ ছিল। কোন একসময়ে মানসিং সেটা দখল করে নিয়েছিলেন। আর সম্ভবতঃ সেই সময়েই এই সদা সতর্ক যোদ্ধা রাজার সঙ্গে একদিন নিন্নির দেখা হয়ে গিয়েছিল। তখন সাক নদীর তীরে ছোট্ট রাই গ্রামে গুর্জরীরা বাস করতেন। প্রধানতঃ শিকারজীবী সেই খেটে খাওয়া মানুষগুলোর ঘরের মেয়ে ছিলেন নিন্নি। অতীতে একসময়ে ভারতের বাইরে থেকে এলেও কয়েক পুরুষ ধরে গুর্জররা আর্যদের সংস্কৃতির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ভারতীয়দের সঙ্গে মিলেমিশে এক হয়ে গিয়েছিলেন। একই সঙ্গে তাঁদের নিজস্ব একটি সাধনা ও সমাজধারাও ছিল। বিশেষ করে শিল্প ও সঙ্গীতে তাঁদের অসামান্য উত্তরাধিকার ছিল। নিজেদের দৈনন্দিন জীবনকে তাঁরা হাস্যে, লাস্যে, নৃত্যে, সঙ্গীতে ভরিয়ে রাখতেন। ভারতীয় সংগীতের ‘গুর্জরীরাগ’ আসলে সেই গুর্জরীদেরই জাতীয় সুরের শুদ্ধিকৃত রূপ। ঐতিহাসিকদের মতে সম্ভবতঃ মধ্য এশিয়া থেকে আসবার সময়ে সেই সুর যাযাবর গুর্জরদের কণ্ঠে ভর দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেছিল। পরে ভারতীয় সঙ্গীতভাণ্ডারের সেটি মিশে গিয়ে একটি নতুন রূপ লাভ করেছিল। সে সব অবশ্য অনেক পরের কথা। সাক নদীর ধারের বনজঙ্গল থেকে যে নিন্নি কাঠ কুড়িয়ে আনতেন, তীর ধনুক দিয়ে শিকার করে আনতেন, তিনি কিন্তু রাগ-রাগিণীর রূপতত্ত্ব সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। শুধু তাঁর কণ্ঠে সাতটি সুর সাতটি পোষা পাখির মতই খেলা করত। প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা সেই মেয়েটিকে ওই ছোট্ট গ্রামের সবাই ভালোবাসতেন। তিনি যোগ না দিলে সব উৎসবই সেখানে ম্লান হয়ে যেত। মধ্যভারতের বীরগাথা ‘রাসো’তে অবশ্য নিন্নির সখী ‘লাখি’র কথাও পাওয়া যায়। সেই দুই সখী নিজেদের মধ্যে গলাগলি করে নির্ভয়ে ঘুরে বেড়াতেন। লাখি নিজের মন দিয়েছিলেন নিন্নির দাদা ‘অটল সিং’কে। রূপসী নিন্নির মন অবশ্য তখনও কোথাও বাঁধা পড়েনি। তারপরেই কোন একদিন ঘটে গিয়েছিল সেই ঘটনাটি।
সেদিন মানসিং গোয়ালিয়র থেকে কোন একটা কাজে বের হয়েছিলেন। মাত্র আঠারো মাইল পথ তাঁর শিক্ষিত ঘোড়া সহজেই পেরিয়ে গিয়েছিল। সাক নদীর ধারে, বনের মধ্যে পৌঁছেই রাজা চমকে উঠেছিলেন, তাঁর ঘোড়া সেখানেই থমকে দাঁড়িয়েছিল। নিন্নি তখন বনের মধ্যে তীর ধনুক নিয়ে বিদ্যুৎগতিতে একটি শিকারকে ধাওয়া করে এগিয়ে চলেছিলেন। মানসিংহ চুপ করে দাঁড়িয়ে সেই দৃশ্য দেখতে শুরু করেছিলেন। তারপরে নিন্নি যখন সুকৌশলে নিজের শিকারকে পরাস্ত করে ঘুরে দাঁড়িয়েছিলেন, মানসিংহের মুগ্ধ চোখে তখন ছিল শুধুই বিস্ময়। কে এই রূপসী? তন্বী, শ্যামা, সুকেশী, সুস্তনী যেন মুর্তিমতী গুর্জরী রাগিণী। তাঁর রাজঅন্তঃপুরে দু’শো জন রানী ছিলেন, তাঁদের মধ্যে প্রধানা রানী ছিলেন আটজন, তাঁদের সকলেই ছিলেন সদ্বংশজাতা ও অতিব সুন্দরী। কিন্তু অমন মেয়ে তো তিনি আগে কখনও দেখেননি। মেয়েটির পোশাক ছিল অতি সাধারণ রঙচঙে একটা ঘাঘরা ও কাঁচুলি, হাতে পায়ে ছিল সামান্য রুপোর গয়না। কালভুজঙ্গিনীর মতো তাঁর দীর্ঘ বেণীটির রুক্ষ, চূর্ণ কুম্ভলগুলি ঘামে ভিজে কপালে, গালে, পিঠে লেপটে গিয়েছিল। একটা ছোট্ট টিপ ছাড়া তাঁর মুখে প্রসাধনের অন্যকোন চিহ্নমাত্র ছিল না, কিন্তু তবুও মানসিং সেই অনন্ত যৌবনা মেয়েটিকে দেখে নিজের চোখের পলক ফেলতে পারেন নি। কিন্তু তিনি রাজা, তাই পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে তিনি বলে উঠেছিলেন, ‘শাবাশ, তোমার হাতের টিপ অসাধারণ।’ তাঁর প্রশংসা শুনে নিন্নির ভ্রুদুটো ধনুকের মতো বেঁকে উঠেছিল, চোখের পলকে সন্দেহ ফুটে উঠেছিল। কে এই সুদর্শন পুরুষ? যে-ই হোন না কেন, নিন্নি অত সহজে কাউকে ভয় পাওয়ার মত নারী ছিলেন না। কিন্তু তিনি কিছু বলবার আগেই শুনেছিলেন যে সেই রূপবান মানুষটি গভীর স্বরে তাঁকে বলছেন, ‘তোমাকে দেখেই আহত হয়েছি গুর্জরী, দৃষ্টি বাণে আর আমায় বিঁধো না। রাজহত্যার পাপ হবে যে!” যিনি রাজা! নিন্নি চমকে উঠেছিলেন। তারপরে তড়িঘড়ি নিজের হাতের শিকারটা মাটিতে নামিয়ে রেখে খাটো ওড়নাটা একটু টেনেটুনে চেহারায় সভ্য ভব্য ভাব আনবার একটা চেষ্টা করেছিলেন। বন্য হরিণীর টানা টানা চোখে তখন লজ্জার মায়াকাজল নেমেছিল। রাজার মনে হয়েছিল যে, তাঁর রাওলায় যে সৌন্দর্য বন্দী হয়ে নেই, সেই সৌন্দর্যই এই গুর্জরী মেয়েটির সর্বাঙ্গ দিয়ে উপচে পড়ছে। মেয়েটি প্রচলিত ধারার রূপসী হয়ত নয়, কিন্তু তাঁর ঘন অরণ্যের মতো নিবিড় চুল আর হরিণীর মতো কাজলটানা দুটি কালো গহিন চোখ ইতিপূর্বে রাজা কোথাও দেখেছেন বলে মনে করতে পারেন নি। এক অনাস্বাদিত পুলকে তাঁর মন ভরে উঠেছিল। তাঁর পরিচয় পেয়ে মেয়েটি ততক্ষণে মাথা নিচু করে তাঁকে বিনয়ের সঙ্গে জানিয়েছিল, ‘আমার নাম নিন্নি। এই নদীর ধারে রাই গ্রামেই আমার বাড়ি।’ … ‘বাড়িতে তোমার কে কে আছেন?’ … ‘আমার বাবা-মা নেই। পুরোহিতজী আমাদের মানুষ করেছেন।’ … ‘তোমাদের মানে?’ … ‘আমাকে আর আমার দাদা অটল সিংহকে।’ সেকথা শুনে মানসিংহ যেন হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিলেন। নিন্নি যদি অন্য কারোর হত, তাঁর হয়ত সেখানে তাঁর বুক ফেটে যেত। সেই আশঙ্কা দূর হওয়ার পরে তিনি সেখানেই নিজের মনের কথা বলে ফেলেছিলেন, ‘তোমাকে দেখেই আমি নিজেকে হারিয়েছি। নিন্নি তুমি কি আমাকে বিয়ে করবে?’ নিন্নি তাঁর প্রশ্নের কোন উত্তর দিতে পারেন নি। এমনিতেই তো কাউকে তাঁর মনে ধরত না। তবে সেদিন এক যাযাবরী তাঁর হাত দেখে বলেছিল বটে যে, নিন্নি একদিন রানী হবেন। কিন্তু সত্যিকারের কোন রাজা, বিশেষ করে অত রূপবান এক যুবক রাজা যে তাঁকে বিয়ে করতে চাইবেন, নিন্নি সেটা স্বপ্নেও ভাবেননি। তাই নিজের মনের খুশি মনে চেপে রেখেই, মুখে ছদ্ম রাগ ফুটিয়ে শিকারটি হাতে তুলে নিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি কি বলব? পুরোহিতজী আছেন … দাদা আছেন।’ মানসিংহ সেই ইঙ্গিত বুঝতে পেরে হেসে বলেছিলেন, ‘ঠিক আছে, আমি যাবো তোমাদের গ্রামে পুরোহিতজীর সঙ্গে দেখা করতে।’ তারপরে নিজের গ্রামের দিকে ফিরে যেতে যেতে নিন্নি বারবার পিছনে ফিরে তাকিয়েছিলেন। যতদূর গিয়েই তাঁকান না কেন, প্রত্যেকবার দেখতে পেয়েছিলেন যে, রাজা একইভাবে ঘোড়ার পিঠে বসে তাঁর দিকে তাকিয়ে ছিলেন। তাঁর নিজের মনটিও তখন যেন আর তাঁর নিজের কাছে ছিল না। সেই মুহূর্তে নিন্ন রাজাকে ভালোবেসে ফেলেছিলেন। তাঁর প্রিয় সখী লাখি শুধু জানতে পেরেছিলেন যে, তাঁর সখী বনে শিকার করতে গিয়ে সেখানেই নিজের মন হারিয়ে এসেছেন। যদিও নিন্নি একই সাথে আশঙ্কাতেও ছিলেন যে, রাজা শেষকালে তাঁকে ভুলে যাবেন না তো? তবে অতবড় ঘটনার পরেও তিনি আগের মতোই থেকে গিয়েছিলেন। কখনও বল্লম নিয়ে ঘোড়ার পিঠে চেপে বরাহ শিকার করতে ছুটতেন, তো কখনও আবার দুরন্ত উল্লাসে সাক নদীর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়তেন।
ঘটনার কয়েকদিন পরেই মানসিং রাই গ্রামে উপস্থিত হয়েছিলেন। সেদিন রাজা আসছেন খবর পেয়ে গ্রামের সবাই মন্দিরের সামনে জড়ো হয়েছিলেন। সেখানেই রাজা ঘোড়া থেকে নেমেছিলেন। তাঁকে দেখে গ্রামের মানুষের আনন্দ আর ধরছিল না। কিন্তু অত মানুষের মধ্যে রাজার ব্যাকুল চোখ দুটি যেন অবাধ্য হয়েই নিন্নিকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল। পুরোহিতজী যেন সেকথা বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, তাঁর শকুন্তলার জন্যই দুষ্মন্ত রাই গ্রামে এসেছেন। তাই নিজের পালিতা কন্যাকে তিনি মন্দিরে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। রাজার সঙ্গে নতুন করে তাঁর পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘নিন্নি হচ্ছে এই গ্রামের সেরা মেয়ে। ওর হাতে তীর ধনুক থাকলে শিকার হার মানবেই।’ মানসিং সেকথা জানতেন। শুধু হাতের তীর ধনুক দিয়ে নয়, নিন্নি তো নিজের নয়ন বাণেও তাঁকে বধ করে ফেলেছিলেন। আর সেজন্যই তো তিনি সেখানে গিয়েছিলেন। কিন্তু তখন সেকথা না বলে তিনি বলেছিলেন, ‘তাই নাকি? তা আমি সেই শিকার দেখবার সুযোগ পাব কি?’ তাঁর কথা শুনে গ্রামবাসীরা হৈহৈ করে উঠে বলেছিলেন, ‘নিশ্চই পাবেন। নিন্নি তো প্রতিদিনই শিকারে যায়।’ এরপরে নিন্নি একটি তীর আর ধনুক নিয়ে শিকারে বের হয়েছিলেন। অনেক খোঁজাখুঁজির পরে তিনি পড়েছিলেন একটি বুনো মোষের সামনে। কিন্তু হয় সেদিন তাঁর কপাল মন্দ ছিল, কিংবা মন চঞ্চল থাকবার জন্য তাঁর ছোঁড়া তীর লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছিল। ফলে বুনো মহিষটি সোজা তাঁর দিকেই তেড়ে এসেছিল। মুহূর্তের মধ্যেই নিন্নির চোখের সামনে মৃত্যুর ভীষণ ছায়া উঁকি দিয়ে গিয়েছিল। তারপরই তিনি নিজের দিকে ধেয়ে আসা সেই মহিষের শিং ধরে বনবিড়ালীর মতো ঝুলে পড়েছিলেন। উভয়ের মধ্যে সেই মরণপণ যুদ্ধ শেষ হয়েছিল মানসিংয়ের হস্তক্ষেপে। তিনিই নিন্নিকে সেদিন প্রাণে বাঁচিয়েছিলেন। একই সাথে সেদিন তিনি গ্রাম্য ভারতীয় নারীর এক নতুন রূপ দেখতে পেয়েছিলেন। ওই বীর্যবতী নারীর জন্য প্রমোদক্লান্ত পুরুষের মন ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল। তাই নিজের গলা থেকে মোতির মালা খুলে নিয়ে তিনি সবার সামনে নিন্নির হাতে তুলে দিয়ে বলেছিলেন, ‘আশা করি পুরোহিতজী একদিন এই মালা পরিয়ে দেওয়ার অনুমতি আমাকে দেবেন।’ তাঁর সেকথা শুনে রাই গ্রামের মানুষেরা সেদিন খুব খুশি হয়েছিলেন। অত বড় একজন রাজা যদি তাঁদের গ্রামের মেয়েকে জোর করে তুলে নিয়ে যেতেন, তাহলে তাঁরা কীই বা করতে পারতেন? পুরোহিতজী নিন্নির মাথায় হাত রেখে সস্নেহে বলেছিলেন, ‘বল নিন্নি তোর মনের কথা? মহারাজের প্রস্তাবে সম্মতি আছে তোর?’ তখন গুর্জরী সমাজে মেয়েরা স্বাধীন ছিলেন, নিজের পছন্দ অপছন্দের কথা তাঁরা নিজেরাই সবার সামনে বলতেন। সেই সময়ের রাজপুতানী কিংবা অন্যান্য উচ্চবর্ণের কন্যাদের মতো অভিভাবকদের পছন্দকে তাঁরা নীরবে স্বীকার করে নিতেন না। নিন্নি তো সেই প্রথম দেখার দিনটিতেই মানসিংকে নিজের মন দিয়েছিলেন, কিন্তু সে কথা তিনি গ্রামের সবার সামনে স্বীকার করতেন কী ভাবে? তাই পুরোহিতজীর কথার উত্তরে নিন্নি বলেছিলেন, ‘মহারাজ যদি আমার শর্তে রাজি হন তবেই আমি এই বিয়েতে সম্মতি দেবো।’ শঙ্কিত পুরোহিতজী প্রশ্ন করেছিলেন, ‘কি শর্ত?’ রাজার মনেও সেই একই প্রশ্ন ছিল। এই গ্রাম্য কিশোরী কি মৎস্যগন্ধার মতোই তাঁকে দিয়ে কোন কঠিন প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিতে চান? কিংবা তাঁর পাটরানির আসনটি অধিকার করতে চান? নিন্নি কিন্তু সে সবের ধার দিয়েও যাননি, তিনি বলেছিলেন, ‘আমার বিয়ে এই রাই গ্রামেই হবে। মহারাজকে বর সেজে আসতে হবে।’ তাঁর কথা শুনে দরিদ্র রাই গ্রামের অধিবাসীরা প্রমাদ গুনেছিলেন। নিন্নি কি জানেন না যে, রাজপুত রাজাদের বিয়েতে কনেই বরের বাড়িতে যায়। ওটাই সেদেশের নিয়ম। মানসিংহ অবশ্য নিন্নির কথা শুনে হেসে উঠে বলেছিলেন, ‘এই কথা। বেশ তাই হবে। আসব আমি বরের বেশে। এখন থেকেই বিয়ে করে নিয়ে যাবো রাই গ্রামের মেয়েকে।’ প্রজারা খুশিতে ধন্য ধন্য করে উঠেছিলেন। তাঁদের আদরের মেয়েটি গ্রামের নাম রেখেছে। রাজা যদি জোর করে নিন্নিকে সেদিনই নিজের সঙ্গে নিয়ে যেতে চাইতেন, তাঁকে বাধা দেওয়ার সাধ্য কি তাঁদের ছিল? এরপরে মানসিং গোয়ালিয়রে ফিরে নিজের মন্ত্রী, পাত্র-মিত্রদের ডেকে বলেছিলেন, ‘গোয়ালিয়র থেকে রাজধানী তুলে নিয়ে যেতে হবে রাই গ্রামে। আপনারা সেই ব্যবস্থা করুন।’ তাঁর কথা শুনে সবাই অবাক হয়েছিলেন। মন্ত্রী বলেছিলেন, ‘সে কি মহারাজ? সুরক্ষিত রাজধানী ছেড়ে সীমান্তের একটি গ্রামে …’ তিনি নিজের কথা শেষ করবার আগেই মানসিংহ হেসে বলেছিলেন, ‘মাত্র সাতদিনের জন্য।’ রাজার সেই হাসি দেখে মন্ত্রী কিছুটা হলেও ব্যাপারটা আন্দাজ করতে পেরেছিলেন। তাই তিনিও হেসে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘কেন মহারাজ?’ রাজা আরো রহস্যময় হাসি হেসে তাঁকে বলেছিলেন, ‘রাই গ্রামের রাজকন্যের হুকুম।’ মানসিং অন্য কারোর হুকুম মানবার পাত্র ছিলেন না। কিন্তু প্রেম অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারে। তাই সামান্য এক গ্রাম্য নারীর সামান্য ইচ্ছাপূরণের জন্য তিনি তাঁর গোটা রাজধানী রাই গ্রামে তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেই সঙ্গেই তিনি ইতিহাসের পাতায় ওই অখ্যাত গ্রামটিকে চিরকালের মতো বিখ্যাত করে দিয়েছিলেন।
আরো পড়ুন- বিশ্বের সবথেকে সুন্দর আর রঙীন গাছ
বিবাহের দিন নিন্নিকে তাঁর সখীরা গান গেয়ে গেয়ে সাজিয়ে দিয়েছিলেন। গান তো গুর্জরীদের জীবনের একটা অঙ্গ। রাই গ্রামে সেদিন আনন্দের ঢেউ উঠেছিল। পুরোহিতজী নিন্নির কপোতির মতো কোমল হাতটি মানসিংহের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। তখন থেকেই নিন্নি আর দুরন্ত গ্রাম্য কিশোরী থাকেন নি, তিনি হয়ে গিয়েছিলেন গোয়ালিয়রের রাজবধূ। এরপরে তাঁর নতুন নামকরণ হয়েছিল। হয়ত তাঁর রূপের সঙ্গে মিলিয়ে রাজাই সেই নাম রেখেছিলেন – ‘মৃগনয়না’ মতান্তরে ‘মৃগনয়ন’। আর সেই নামের আড়ালেই তখন থেকে চিরকালের মত হারিয়ে গিয়েছিল তাঁর নিজের আসল নামটি। রাজা মানসিং পেয়েছিলেন তাঁর প্রিয়তমাকে, আর মৃগনয়না পেয়েছিলেন তাঁর প্রেমাস্পদকে। তাঁদের দু’জনেরই মনে হয়েছিল যে, সেই পরম প্রাপ্তির পরে তাঁদের আর কিছুই চাওয়ার নেই। বিবাহের পরে তাঁরা প্রতিদিন প্রেমকে নতুন নতুন রূপে আবিষ্কার করেছিলেন। অবশেষে সাতদিন পরে মানসিং নববধূকে নিয়ে গোয়ালিয়রে ফিরে গিয়েছিলেন। হয়ত রাই গ্রাম ছাড়বার সময়েই তিনি অটল সিংয়ের হাতে নরবর দুর্গের ভার তুলে দিয়েছিলেন। বিদায়ের আগে গ্রামের সবাই চোখের জল মুছে তাঁদের সৌভাগ্যবতী মেয়েকে বলেছিলেন, ‘আমাদের ভুলে যেও না।’ প্রকৃতির কোলে বড় হওয়া মৃগনয়না শেষে রাজপুত রাওলায় গিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন। বনের পাখি খাঁচার পাখি হয়ে গোয়ালিয়রে এসেছিলেন। গোয়ালিয়রের রাজ অন্তঃপুরে তখন কড়া পর্দাপ্রথা থাকলেও রাজা জানতেন যে, মৃগনয়না সেই চার দেওয়ালের গণ্ডির মধ্যে বদ্ধ থাকতে পারবেন না। তাই তিনি তাঁকে বলে দিয়েছিলেন, ‘এখানকার রাওলার নিয়ম তোমায় মেনে চলতে হবে না। তোমার যেমন খুশি তেমনই থেকো।’ … ‘তাহলে কথা দাও, আমার কোন আচরণে অসন্তুষ্ট হলে সঙ্গে সঙ্গে আমাকে জানাবে। আমাদের মনে কোন আড়াল থাকবে না।’ মানসিংহ তাঁর কথায় চমৎকৃত হয়ে বলেছিলেন, ‘আর কেউ তো এমন কথা আমায় বলেনি। কেমন কথা তুমি কোথা থেকে শিখলে?’ … ‘মনের কথা মুখে বলছি। এ তো শেখানো বুলি নয় মহারাজ।’ … ‘ঠিক। তুমি শিক্ষা পেয়েছো প্রকৃতির কাছে। জীবনের কাছে। তোমার সঙ্গে কার তুলনা।’
কিন্তু রাজা যতই অনুমতি দিন না কেন, অন্তঃপুরের রানীরা কিন্তু মৃগনয়নাকে অত সহজে মেনে নিতে পারেন নি। যদিও রাজার রাওলায় থাকতেন দু’শো রানী, তাঁদের মধ্যে আটজন ছিলেন তাঁর প্রধান মহিষী। তাই নতুন আরেকজন রানীকে নিয়ে তাঁদের অত ভাবনা-চিন্তা করবার কোন দরকার ছিল না। কিন্তু তবুও মৃগনয়নাকে নিয়ে তাঁদের সকলেই মুখর হয়ে উঠেছিলেন। আসলে রাজার ঐসব রানীরা সকলেই কোন না কোন রাজপরিবার থেকে এসেছিলেন। তাঁরা সামান্যা একজন গ্রাম্য গুর্জরী নারীকে নিজের সমপর্যায়ভুক্ত করতে নারাজ ছিলেন। তাই মৃগনয়নার জন্য তাঁদের সকলেরই চোখেই ছিল অবজ্ঞা, মুখে ছিল ছিঃ ছিঃ। রানীদের মধ্যে মৃগনয়নার সাথে সবচেয়ে নিষ্ঠুর ব্যবহার করেছিলেন মানসিংহের তৃতীয় রানী। তিনি রূপসী এবং মানসিংহের প্রিয় স্ত্রী বলেই বোধহয় সেই নতুন রানীকে প্রতি পদে অপমান করবার একটা তীব্র আকাঙ্ক্ষা তাঁকে পেয়ে বসেছিল। মৃগনয়না অবশ্য কারোর সঙ্গেই খারাপ ব্যবহার করেন নি, তাঁদের দুর্ব্যবহারে তিনি দমেও যাননি। মেয়েমহলের ষড়যন্ত্রে কানও দেন নি। তিনি শুধু রাজার ভালোবাসায় নিজেকে শুধু উজাড় করে দেননি, তিনি মহারাজার শিল্পরুচির সঙ্গে তাঁর নিজস্ব কল্পনাকেও মিশিয়ে দিয়েছিলেন। গোয়ালিয়র রাজপ্রাসাদে আসবার সময়ে মৃগনয়না তাঁর নিজের সঙ্গে করে গুর্জরী রাগিণীর ঐশ্বর্য নিয়ে এসেছিলেন। সঙ্গীতরসিক রাজা তাঁর সেই গান শুনে মুগ্ধ হয়ে বলেছিলেন, ‘আমার সভাগায়ক বৈজনাথ নায়েককে তোমার গান শোনাবো। তিনি মস্ত বড় সুরসাধক।’ মৃগনয়না বলেছিলেন, ‘আমার গান শুধু তোমার জন্য। আমি তো ওঁদের মতো সঙ্গীতসাধনা করিনি।’ মানসিং তাঁর আপত্তি নাকচ করে দিয়ে বলেছিলেন, ‘তোমার গান তাঁকে হয়ত নতুন রাগ-রাগিণীর সন্ধান দেবে।’ তাঁর অনুমানই সত্যি হয়েছিল। মৃগনয়নার কণ্ঠ, মৃগনয়নার গান বৈজনাথকে প্রেরণা জুগিয়েছিল। ভারতের ইতিহাস তাঁকে ‘বৈজু বাওরা’ নামে চেনে। মৃগনয়নার মধ্যে বৈজনাথ মূর্তিমতী সঙ্গীতকে দেখতে পেয়েছিলেন। তাঁর কণ্ঠে টোরি গুর্জরী টোরি রাগিণীর মধ্যে নতুন রূপ পরিগ্রহ করেছিল। গুর্জরী রাগে শৃঙ্গার রসের প্রাধান্য দেখতে পাওয়া যায়। বৈজনাথ মঙ্গল ও কৌশিকী কানাড়াকেও মৃগনয়নার নামে বেঁধেছিলেন। ওদিকে গোয়ালিয়রের অন্দরমহলে সেসব নিয়ে কানাকানি ও ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছিল। রটে গিয়েছিল, মানসিংয়ের গুর্জরী রানী স্বেচ্ছাচারিণী। তিনি পরদা মানেন না। রাজার প্রেয়সী আবার কখনো গায়কের প্রেরণদাত্রী হতে পারে না কি? ও সবই ছলাকলা। গুর্জরীরা যাযাবর। তাঁরা বশীকরণ বিদ্যা জানে। সেই বিদ্যা দিয়েই মৃগনয়না রাজাকে বশ করে তাঁর সভা গায়কের সঙ্গে অবাধে মেলামেশার সুযোগ নিচ্ছেন। মৃগনয়না সব শুনতেন, কিন্তু তাতে কান দিতেন না। কখনও রাজার সভাগায়কের কণ্ঠে নতুন তিনি সাগ্রহে নতুন সুর শুনতেন, তো কখনও আবার তাঁকে তাঁদের পুরুষানুক্রমিকভাবে পাওয়া গুর্জরী রাগিণীর অপ্রচলিত কোন রূপ গেয়ে শোনাতেন। বৈজনাথ আবার সেই সুর ভেঙে গড়ে কোন নতুন রাগ সৃষ্টি করতেন। মধ্যভারতের রাগাশ্রয়ী সঙ্গীতে মৃগনয়নী নামের একটি স্বতন্ত্র রাগের খোঁজ পাওয়া যায়, মারবা ঠাটের অন্তর্গত সেই রাগ রাত্রির চতুর্থ প্রহরের বক্রগতির মিশ্ররাগ। কিন্তু শুধুই কি বৈজনাথ? ভারতীয় রাগপ্রধান সঙ্গীতের আশ্চর্য বালক ‘তানসেনের’ মধ্যে থাকা সুপ্ত প্রতিভার আবিষ্কর্ত্রীও তো মৃগনয়নাই ছিলেন। জনশ্রুতি রয়েছে যে, মাত্র দশ বছর বয়সে তানসেন গোয়ালিয়রে গিয়েছিলেন। তাঁর সঠিক জন্মসাল জানা যায় না, তবে প্রচলিত মত অনুসারে তিনি নাকি ১৫০৬ সালে জন্মেছিলেন। মানসিংয়ের রাজত্বকালের একেবারে শেষের দিকে তিনি গোয়ালিয়রে গিয়েছিলেন। গোয়ালিয়র রাজসভায় উপস্থিত হয়ে তিনি ধ্রুপদী আঙ্গিকে মৃগনয়নার বন্দনাগান রচনা করে শুনিয়ে সেখানে উপস্থিত সকলের প্রশংসালাভ করেছিলেন। মানসিং সঙ্গীতের সঙ্গে স্থাপত্যেও নিজের অসাধারণ আগ্রহের পরিচয় দিয়েছিলেন। যদিও স্থানীয় মানুষেরা বলেন যে, মহারাজ আসলে খুব বড় যোদ্ধা ছিলেন, মৃগনয়নাই তাঁকে শিল্পী করে তুলেছিলেন। আসলে মানসিং ভেবে পাচ্ছিলেন না যে, কিভাবে তিনি মৃগনয়নাকে সুখী করবেন। সেজন্য তিনি গোয়ালিয়রকে প্রাসাদ, মন্দির, উদ্যান দিয়ে স্বর্গের মত সাজিয়ে তুলেছিলেন। নতুন নতুন উপহার দিয়ে তিনি মৃগনয়নাকে সুখী করতে চেয়েছিলেন। তাঁর উপহারে খুশি হয়ে মৃগনয়না রাজাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন যে, কিভাবে পাথরে প্রাণের উষ্ণ স্পর্শ ফুটে উঠবে। কিভাবে ভাস্কর্য হয়ে উঠবে কবিতা। এরপরেই গোয়ালিয়র প্রাসাদে রানী মৃগনয়নার জন্য তৈরী করা হয়েছিল একটি অপরূপ মহল। সেটির নাম দেওয়া হয়েছিল – ‘গুর্জরীমহল’। মৃগনয়না পাথর ভালোবাসেন মৃগনয়না, তাই সেই মহলের সর্বত্র ছিল পাথরের কারুকাজ। ওই মহলটি সম্পূর্ণ হওয়ার পরে রাজা সেই মহলের সামনে তাঁর প্রিয়তমা রানীকে নিয়ে গিয়ে বলেছিলেন, ‘আজ থেকে এই মহল তোমার।’ … ‘আমার?’ … ‘হ্যাঁ। এই মহল আমি তোমার জন্য তৈরি করেছি। তোমার পছন্দ হয়েছে কি?’ … ‘অনবদ্য। কিন্তু আমার জন্য এত কেন? আমি তো আমার নিজের জন্য কখনো কিছু চাইনি মহারাজ।’ … ‘তুমি চাও না বলেই তো আমি বুঝতে পারি না যে তুমি কি চাও।’ … ‘আমার তো কিছু চাইবার নেই মহারাজ। তোমায় পেয়ে আমি সব কিছু পেয়েছি।’ হেসে হেসে বলেছিলেন মৃগনয়না। তারপরে গুর্জরীমহলের চারপাশ খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে বলেছিলেন, ‘ইস, এখানে যদি সাক নদী বইত তাহলে কি ভালোই না হত। আমি সেই জলে স্নান করতে পারতাম।’ মানসিং বলেছিলেন, ‘তাই হবে।’ মৃগনয়নার অন্ততঃ একটা সাধের কথা জানতে পেরে তিনি শান্তি পেয়েছিলেন। এরপরে দীর্ঘ আঠারো মাইল পাথুরে পথ কেটে রাই গ্রামের পাশ থেকে সাক নদীকে রাজা গোয়ালিয়রে নিয়ে এসেছিলেন, একেবারে গুর্জরীমহলের পাশে। তারপরে মৃগনয়নাকে গুর্জরীমহলে তুলে নিয়ে এসে তিনি নিশ্চিন্ত হতে চেয়েছিলেন। ইতিমধ্যে মৃগনয়না রাজাকে দুটি পুত্র উপহার দিয়েছিলেন। তাঁদের একজনের নাম ছিল ‘রাজসিং’, অপরজনের নাম ছিল ‘বলসিং’। আর তাতেই রাজার বড়রানীর মনের শান্তি আর রাতের ঘুম ঘুচে গিয়েছিল। তিনি মৃগনয়নাকে খুব ভয় পেয়েছিলেন। রাজা তাঁর কথায় উঠতেন বসতেন। মৃগনয়না নিশ্চই নিজের ছেলেদের জন্যই গোয়ালিয়রের সিংহাসনটি দাবি করবেন। তাহলে বড় রানীর ছেলে ‘বিক্রমাদিত্য’ কি পিতার সিংহাসনে আর কখনো বসতে পারবেন? কাজেই তিনি মৃগনয়নার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে শুরু করেছিলেন। প্রথমে রাজার কাছে মৃগনয়নাকে অবিশ্বাসিনী প্রমাণ করবার চেষ্টা করেছিলেন, সেই চেষ্টায় ব্যর্থ হওয়ার পরে তিনি মৃগনয়নাকে একেবারে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিলেন। রাজা সেই ষড়যন্ত্রে আভাস পেয়েই মৃগনয়নাকে ওই নতুন মহলে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। মৃগনয়না তাঁকে বলেছিলেন, ‘মহারাজ, মন্দির না হলে নগর মানায় না। কয়েকটা মন্দির তৈরি করতে হবে।’ … ‘তুমি যেমনটি বলবে তেমনই হবে।’ তারপরে একে একে তৈরি হয়েছিল ‘সহস্রবাহুর মন্দির’, ‘ত্রৈলোক্য মন্দির’ এবং আরো অনেক অপূর্ব সুন্দর। গোয়ালিয়রের প্রতিটি ঐতিহাসিক স্থাপত্যে আজও যেন মৃগনয়নার কোমল স্পর্শ লেগে রয়েছে। ইতিহাসও স্বীকার করে যে, মানসিং তাঁর প্রিয়তমা রানী মৃগনয়নাকে পাশে নিয়েই রাজধানী গোয়ালিয়রকে নতুন এক রূপ দিয়েছিলেন। দেখতে দেখতে গোয়ালিয়রে তৈরি হয়েছিল মানমন্দির, চিত্রশালা, সঙ্গীতমহল। আজও সেখানে কোথাও একা রাজা বা রানীর অস্তিত্ব নেই, সর্বত্র তাঁরা দু’জনে একত্রে, একসঙ্গে রয়েছেন। গোয়ালিয়র সেই যুগল প্রেমের স্রোতে ভেসে গিয়েছিল।
ওদিকে মৃগনয়নার বিরুদ্ধে অন্তঃপুরের ষড়যন্ত্র কিন্তু অব্যাহত ছিল। মানমন্দির প্রতিষ্ঠার দিন পানের মধ্যে সেঁকো বিষ দিয়ে মৃগনয়নাকে হত্যা করবার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু মৃগনয়না সে খবর আগেই পেয়েছিলেন, তাই ওই পান মুখে দিতে গিয়ে তিনি ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন। সেই খবরটা মানসিংয়ের কানে পৌঁছেছিল। তিনি বিস্মিত হয়ে দেখেছিলেন যে, মৃগনয়না একবারও তাঁর কাছে কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ জানান নি। কেন? তাহলে তিনি কি রাজাকেও সন্দেহ করেন? মানসিং সোজা গুর্জরীমহলে গিয়ে তাঁকে বলেছিলেন, ‘আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছি মৃগনয়না, সকলের হয়ে।’ … ‘কেন মহারাজ?’ তারপরে দুটি উদাস চোখ তুলে তাঁর দিকে তাকিয়ে গুর্জরী রানী বলেছিলেন ‘আমি তো আপনার কাছে কোন অভিযোগ জানাইনি।’ … ‘সে তোমার মহত্ত্ব। আমি জেনেছি অন্তঃপুরের ষড়যন্ত্রে তোমার প্রাণসংশয় হয়েছিল। মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেয়েছ। ক্ষমা করো তুমি ওদের।’ মৃগনয়না শুধু হেসেছিলেন। কোন উত্তর দেননি, অভিযোগও করেন নি। এমনকি কোন কৌতূহলও প্রকাশ করেন নি। মানসিং বিভ্রান্ত হয়ে সেখান থেকে ফিরে গিয়েছিলেন। এরপরেও কিন্তু ষড়যন্ত্র চলেছিল। তবে সেবার বড় রানী বিষ আর প্রয়োগ করে মৃগনয়নাকে হত্যা করবার কথা ভাবেন নি, তিনি সোজাসুজি মহারাজকে আর্জি জানিয়েছিলেন, ‘আপনি নিজের উত্তরাধিকারীর নাম ঘোষণা করুন।’ সেকথা শুনে রাজা ভ্রু কুঁচকে গম্ভীর স্বরে তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘কি বলতে চাও তুমি?’ … ‘সব মানুষই বয়স হলে নিজের উত্তরাধিকারীর কথা ভাবে। ঈশ্বর আপনাকে দীর্ঘজীবী করুন, কিন্তু আপনার পরে যে আপনার রাজ্য শাসন করতে পারবে, তাঁর নাম ঘোষণা করতে ক্ষতি কি?’ বিরক্ত হয়ে রাজা মানসিং তাঁকে বলেছিলেন, ‘আমার রাজ্য শুধু মৃগনয়নাই শাসন করতে পারে।’ তাঁর উত্তরটা এতটাই প্রাঞ্জল ছিল যে, বড়রানী আর কোন কথা বলতে পারেন নি। ওই খবরটা মৃগনয়নার কাছেও পৌঁছেছিল। তিনি রাজাকে নিজের মহলে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। রাজা সেখানে যাওয়ার পরে তিনি হাসতে হাসতে তাঁকে বলেছিলেন, ‘রাজ্যশুদ্ধু লোক কত কি বলছে। সত্যিই কি এসব তোমার নিজের কথা।’ … ‘সব কথাই সত্যি। যা শুনেছ, আমি তা-ই বলেছি।’ … ‘কি বলছো তুমি? আমি শুধু তোমার কল্পনার রূপকার মহারাজ। রাজ্যশাসনের আমি কি জানি? তোমার স্বপ্নই গোয়ালিয়র রাজ্যকে সুন্দর করেছে।’ … ‘সবই হয়েছে তোমার জন্য।’ মানসিং হেসে বলেছিলেন, ‘আমাকে স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছ তুমি। আমার স্বপ্নকে সাকার করেছ তুমি।’ … ‘তুমি বীর।’ … ‘আমি যোদ্ধা। পাথরের বুকে কবিতা লেখা আমার পক্ষে কোনদিনই সম্ভব হত না, যদি তুমি আমার পাশে না থাকতে।’ … ‘শুধু এটুকুই চাই মহারাজ।’ … ‘আরো অনেক বেশি যোগ্যতা তোমার আছে।’ তারপরেই হঠাৎ ভুলে যাওয়া একটা কথা মনে পড়ে যাওয়ার মতো মৃগনয়না বলে উঠেছিলেন, ‘যার জন্য তোমাকে নিমন্ত্রণ করেছি, সে কথাটাই বলতে ভুলে গিয়েছি। মহারাজ, চলো আমার চিত্রশালায়।’ … ‘নিশ্চই যাবো। তুমি যখন চিত্রশালায় নিয়ে যেতে চাইছ তখন নিশ্চই কোন দুর্লভ চিত্র সেখানে দেখতে পাবো।’ … ‘সেটা আগে বলব না।’ এরপরে রাজাকে নিয়ে মৃগনয়না গুর্জরীমহল সংলগ্ন চিত্রশালায় পৌঁছেছিলেন। সেখানে ছবি দেখতে দেখতে রাজার অনেকটা সময় কেটে গিয়েছিল। মানসিংহ মুখে যাই বলুন না কেন, তিনিও প্রকৃত শিল্পরসিক ছিলেন। তারপরে একটা সময়ে গুর্জরী রানী রাজার হাতে একটি তুলট কাগজের চিঠি তুলে দিয়েছিলেন। গোল করে পাকানো চিঠি। রাজা প্রথমে সেটাকে নতুন কোন ছবি ভেবেছিলেন, কিন্তু তারপরেই সেটাকে খুলে তিনি চমকে উঠেছিলেন। ওই চিঠির লেখা পড়ে তিনি নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছিলেন না, তাই আবার চিঠিটি পড়েছিলেন। তাঁর গুর্জরী রানী মৃগনয়না নিজের হাতে সেই চিঠিটি লিখেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, ‘চিরকালের প্রথা আমার জন্য বদলাতে পারে না। গোয়ালিয়রের মহারাজার অভিলাষ যাই হোক, আমার সিদ্ধান্ত যে, আমার পুত্র রাজসিং বা বলসিং কোনদিনই গোয়ালিয়র রাজ্যের সিংহাসনে বসবার অধিকারী হবে না। সেই অধিকার একমাত্র মহারাজা মানসিংয়ের জ্যেষ্ঠা মহিষীর জ্যেষ্ঠপুত্র বিক্রমাদিত্যের।’ মানসিং চিঠিটি আরো কয়েকবার পড়ে মৃগনয়নার দিকে তাকিয়েছিলেন। তাঁর সেই দৃষ্টিতে শুধু বিস্ময় আর প্রেম নয়, প্রগাঢ় শ্রদ্ধাও মিশে ছিল। এই আশ্চর্য নারী কি করে জানল যে ভিতরে ভিতরে তিনি ভাবনা ও চিন্তায় ক্ষয়ে যাচ্ছিলেন! একদিকে চিরকালের নিয়মের অপমান করা, আর অন্যদিকে বড়-রানীর ষড়যন্ত্র; নিরপরাধ বিক্রমকে পিতার সিংহাসন থেকে বঞ্চিত করতে তাঁর নিজের মনও সায় দেয়নি, অথচ তিনি মৃগনয়নাকেও সুখী করতে চেয়েছিলেন। যদিও মৃগনয়না তাঁর নিজের ছেলেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনদিন কোন কথাই তাঁকে বলেননি। তিনি প্রশ্ন করেছিলেন, ‘সত্যই কি এই তোমার মনের কথা?’ মৃগনয়না বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ। এর প্রতিলিপি এতক্ষণে বড়রানীও পেয়ে গিয়েছেন।’… ‘কিন্তু কেন? তোমার সাজানো রাজ্যপাটে নিজের ছেলেকে তুমি কেন বসাতে চাও না?’ … ‘আমি যা কিছু করেছি মহারাজ, তোমাকে ভালোবেসেই করেছি। তোমার কল্পনাকে আমি নিজের সাধ্যমত রূপ দিয়েছি। সেটা আমার ছেলেদের ভবিষ্যৎ গড়বার জন্য নয়।’ … ‘আমিও তো তোমায় ভালোবেসেই …’ … ‘মহারাজ, আমি তোমাকে সবরকমের চিন্তা, পারিবারিক ষড়যন্ত্র, এবং সব ধরনের অন্যায় কর্ম থেকেও মুক্ত রাখতে চাই। তাই আমি এই সিদ্ধান্ত স্বেচ্ছায় এবং সানন্দে নিলাম।’ আর কোন কথা বলতে না পেরে মানসিং দু’হাতে মৃগনয়নাকে নিজের বুকের মধ্যে টেনে নিয়েছিলেন।
কেউ কেউ বলেন যে, মৃগনয়না নাকি তাঁর ছেলেদের নিজের সমাজে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। তারপরে নিজেও একদিন রাজ্যসমেত সকলকে কাঁদিয়ে বিদায় নিয়েছিলেন। তবে তাঁর সেই স্বেচ্ছানির্বাসন নিশ্চই মানসিংহের মৃত্যুর আগে ঘটেনি। পার্থিব জীবনে কেউ কোনদিন তাঁদের বিচ্ছেদ ঘটাতে পারেন নি। মধ্যভারতের কবিরা কখনোই সেসব দিনের কথা ভুলতে পারেন নি। তাই ইতিহাস তেমনভাবে মনে না রাখলেও, তাঁরা কিন্তু সেই আশ্চর্য রানীকে মনে রেখেছিলেন। আজও শুধু সাক নদী নয় ঐতিহাসিক গোয়ালিয়র দুর্গও রাজা মানসিং ও মৃগনয়নার প্রেমের গল্প শোনায়। নিঃস্বার্থ প্রেম আত্মত্যাগ করতে শেখায়।
(তথ্যসূত্র:
১- The Glory of Gwalior, CHOB SINGH VERMA.
২- History of the Fortress of Gwalior, Balwant Row Bhaiyasaheb.
৩- Gwalior, Scindias & Their Sardār Oligarchs, A. R. Rajwade.
৪- Tomar Architecture of Gwalior (1486-1526 A.D): Potential Precursor to Mughal Architecture, Prof. R. Nath.
৫- Dhrupad: tradition and performance in Indian music, Ritwik Sanyal & Richard Widdess.
৬- Gwalior Fort: Art, Culture, and History; Kalyan Kumar Chakravarty.)
ভাঙন পদ্ম শিবিরে, মালদায় তৃণমূলে যোগদান শতাধিক কর্মী সমর্থকের
গঙ্গায় স্নান করতে গিয়ে জলে ডুবে মৃত্যু হল এক নাবালিকার
Dilip Ghosh: আজ বিয়ের পিড়িতে দিলীপ ঘোষ! কিভাবে ফুটল বিয়ের ফুল?
‘Bangladesh Should Be Broken Apart,’ Says Tripura’s ‘King’ in Response to Yunus’ Comments
পাকিস্তানি অভিনেতা ফাওয়াদ খানের বলিউড প্রত্যাবর্তন ঘিরে উত্তাল মহারাষ্ট্র!
Taslima Nasrin: ‘Islam is not my religion…’—A Definitive Statement on Eid
Heatwave Alert: West Bengal, 16 Other States Brace for Extended Heatwave Days from April to June
Former Pakistani Prime Minister Imran Khan Nominated for the Nobel Peace Prize
কল্যাণীতে দুঃসাহসিক ছিনতাই! কাঁচরাপাড়ার ব্যবসায়ীকে মারধর করে টাকা লুঠ
Durga Puja 2024: অভিনব উদ্যোগ! মহালয়ার দিন অঙ্কন প্রতিযোগিতা করল কাঁচরাপাড়া আমরা সবাই ক্লাব