ইংরেজ সাহেব। কেমব্রিজে পড়াশোনা শেষ করে ইংল্যান্ড থেকে এসেছিলেন ভারতবর্ষে। গিয়েছিলেন বীরভূমের রবীন্দ্র তীর্থে। কিন্তু শান্তিনিকেতনে মন টিকল না। তুসা বিভাগে অধ্যাপনার কাজ নিয়ে তিনি চলে এসেছিলেন যাদবপুরে। থাকতেন কলকাতার মেসবাড়িতে। সাইকেল চালিয়ে আশা-যাওয়া। পথের লোকেরা তাঁকে ডাকত সাইকেল সাহেব নামে। হঠাৎই তাঁকে এক নেশায় পেয়ে বসল। বাংলার স্থাপত্য ঐতিহ্যের অসামান্য স্মারকের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অবশিষ্ট কিছু স্মৃতিচিহ্নের অনুসন্ধান। বাংলার টেরাকোটা মন্দির। আর এই টেরাকোটা অনুসন্ধানীটি হলেন ডেভিড ম্যাককাচন/ম্যাকাচ্চিয়ন/ম্যাকাচ্চন।
ষাটের দশকে পশ্চিমবঙ্গের নানা জেলায় গ্রাম গঞ্জে দূর দূরান্তে রোগা পাতলা শীর্ণ চেহারার এক সাহেবকে ঘুরে বেড়াতে দেখা যেত। কখনো সাইকেলে, কখনো বাসে-ট্রেনে আবার কখনোবা মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে তিনি টেরাকোটা মন্দিরের খোঁজে অনুসন্ধান চালাতেন। বাঁকুড়া, বীরভূম, বর্ধমান, পুরুলিয়া, মেদিনীপুর, মুর্শিদাবাদ, মালদা, চব্বিশ পরগনা, হাওড়া, হুগলি তাঁর পদচারণায় মুখর ছিল। টেরাকোটা স্থাপত্যের সন্ধান পেলে তার ছবি তুলতেন, তথ্য সংগ্রহ করতেন, আশপাশের ঝোপঝাড় পরিষ্কার করতেন, অসীম ধৈর্যের সাথে স্থানীয় লোকজনদের ডেকে বোঝাতেন টেরাকোটা স্থাপত্য সম্পদের গুরুত্বের কথা, কি করে একে রক্ষণাবক্ষেণ করা যায় তা যথাসাধ্য বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করতেন। লোকেরা পোড়ামাটির মন্দির নিয়ে বিলেতি সাহেবের উৎসাহ ও আগ্রহ দেখে অবাক হতো, ভাবত, হাসত। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো সাহেবটিকে পাগল বলে ভেবে বসতো। তাঁর ভাঙা ভাঙা বাংলায় বলা কথাগুলোয় বিশেষ আমল প্রায় কেউই দিতে চাইত না। তবুও এ ব্যাপারে সাহেব ছিলেন অসীম ধৈর্যশীল, কঠোর পরিশ্রমী আর নিরলস প্রয়াসী। এই সাহেবটি হলেন ডেভিড জে. ম্যাককাচন।
আরো পড়ুন- ‘মানসিং তোমর ও মৃগনয়না’
আজকের বাংলাদেশ তখন পূর্ব পাকিস্তান। পশ্চিমবাংলা থেকে এক সাহেব এসে পূর্ববাংলার বিভিন্ন জেলায় ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। উদ্দেশ্য সেই একই। বাংলার মন্দির মসজিদ টেরাকোটা। যশোর, ফরিদপুর, খুলনা, রাজশাহী, দিনাজপুর, রংপুরে সাহেব বহু ঝুঁকি নিয়ে বহু কষ্ট স্বীকার করে পোড়ামাটির স্থাপত্য নিদর্শনের খোঁজে ঘুরে বেড়ালেন। প্রচুর ছবি ও তথ্য সংগ্রহ করে এ নিয়ে মূল্যবান প্রবন্ধ লিখলেন। স্বাধীন বাংলাদেশে যাওয়ার সুযোগ তিনি পাননি। তবে সে অঞ্চলের প্রত্যন্ত প্রান্তে ঘুরে ফিরে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন এক নতুন দেশের জন্ম লগ্ন আসন্ন। আজ বাংলাদেশের মন্দির টেরাকোটার চর্চায় সাহেবের সেদিনের সেই পরিশ্রমের জুড়ি নেই। সেই সাহেবটি হলেন ডেভিড ম্যাককাচন।
ফেলুদা কাহিনীর শেষ উপন্যাস “রবার্টসনের রুবির” কথা মনে পড়ে? নিশ্চয়ই অনেকেই পড়েছেন। এতে জটায়ুর উদ্দেশ্যে ফেলুদার জবানিতে টেরাকোটা সাহেবকে নিয়ে বলা কথায় বাংলা চলচ্চিত্র ও বাংলা সাহিত্যের বিরাট ব্যক্তিত্ব সত্যজিৎ রায় তাঁর প্রিয় বন্ধুর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধার্ঘ্য রেখে গেছেন। ভুলো মন বাঙালীদের হয়তো এভাবেই রায়সাহেব তাঁর অসাধারণ বন্ধুটির বিষয়ে জানিয়ে দিয়ে গেছেন। মানিকবাবুর সেই বন্ধুটি হলেন ডেভিড ম্যাককাচন।
তিনি অধ্যাপনা করতেন। অকৃতদার ছিলেন। একজনের পক্ষে ভালো ভাবে চলার জন্য রোজগার মন্দ ছিল না। কিন্তু অতি সাধারণ ভাবে জীবন যাপন করা সাহেবটি ছেঁড়া গেঞ্জিতে সন্তুষ্ট ছিলেন। অতি সাধারণ খাবার খেতেন। বাস ভাড়া বাঁচাতে যথা সম্ভব সাইকেল ব্যবহার করতেন। দৈনন্দিন খরচ চালিয়ে অবশিষ্ট টাকা তিনি জমিয়ে রাখতেন। টেরাকোটা মন্দির অভিযানের জন্য খরচ হিসেবে। দূর দূরান্তে যাতায়াত, ছবি ক্যামেরা, মন্দিরের আশেপাশের আগাছা পরিষ্কারে কীটনাশক ইত্যাদিতে খরচ হতো মিতব্যয়ী সাহেবটির জমানো টাকা। এই অদ্ভুত সাহেবটি হলেন ডেভিড ম্যাককাচন।
টেরাকোটা মন্দির স্থাপত্য চর্চায় পথিকৃত ছিলেন তিনি। নিজের গবেষণাকে চূড়ান্ত রূপ দিয়ে যাওয়ার সময় তিনি পাননি। জীবন তাঁকে সেই আয়ু দেয়নি। তবে প্রচুর ছবি আর বিপুল তথ্য ভাণ্ডার রেখে গেছেন পরবর্তী গবেষকদের জন্য পাথেয় করে। তাঁর অসমাপ্ত কাজ শেষ করার চেষ্টা করেছেন সুহৃদকুমার ভৌমিক, হিতেশরঞ্জন সান্যাল, তারাপদ সাঁতরা, অমিয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, মানিকলাল সিংহ প্রমুখেরা। এ কাজ এখনো অব্যাহত। ক্ষেত্রসমীক্ষক ডেভিডের পথ ধরে এখনো অনেকেই বাংলার টেরাকোটা মন্দিরের ইতিহাস অনুসন্ধান করে চলেছেন। এই মাটির প্রতি সুগভীর মমত্ববোধ ছিল তাঁর। এই দেশের পুরাকীর্তি রক্ষায় আমৃত্যু সোচ্চার ছিলেন তিনি। টেরাকোটা স্থাপত্যের পাশাপাশি বাংলার পটচিত্র নিয়ে উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে তাঁর।
অতর্কিত পোলিও রোগে আক্রান্ত হয়ে মাত্র ৪১ বছর বয়সে ১৯৭২ সালের ১২ই জানুয়ারি হঠাৎই তিনি গেছেন না ফেরার দেশে। প্রিয় শহর কলকাতার বুকে ভবানীপুর সিমেট্রিতে তাঁকে চির নিদ্রায় সমাহিত করা হয়। পরবর্তীতে বন্ধুরা তাঁর সমাধিস্থলটিকে টেরাকোটায় মুড়ে দেয়।
আত্মবিস্মৃত জাতি বাঙালীরা তাঁদের এই মহান বন্ধুটিকে সেভাবে মনে রাখেনি। প্রায় নীরবে নিভৃতে প্রয়াণের অর্ধশতক পেরিয়ে গেছেন তিনি। আজ ৫১তম প্রয়াণ দিবসে তাঁকে সশ্রদ্ধ প্রণাম জানাই।
তথ্যসূত্র:
* ডেভিড ম্যাককাচন চর্চা সম্পাদক: সুরঞ্জন মিদ্দে,
* বাংলাদেশের মন্দির – ডেভিড ম্যাককাচন।
ভাঙন পদ্ম শিবিরে, মালদায় তৃণমূলে যোগদান শতাধিক কর্মী সমর্থকের
গঙ্গায় স্নান করতে গিয়ে জলে ডুবে মৃত্যু হল এক নাবালিকার
Dilip Ghosh: আজ বিয়ের পিড়িতে দিলীপ ঘোষ! কিভাবে ফুটল বিয়ের ফুল?
‘Bangladesh Should Be Broken Apart,’ Says Tripura’s ‘King’ in Response to Yunus’ Comments
পাকিস্তানি অভিনেতা ফাওয়াদ খানের বলিউড প্রত্যাবর্তন ঘিরে উত্তাল মহারাষ্ট্র!
Taslima Nasrin: ‘Islam is not my religion…’—A Definitive Statement on Eid
Heatwave Alert: West Bengal, 16 Other States Brace for Extended Heatwave Days from April to June
Former Pakistani Prime Minister Imran Khan Nominated for the Nobel Peace Prize
কল্যাণীতে দুঃসাহসিক ছিনতাই! কাঁচরাপাড়ার ব্যবসায়ীকে মারধর করে টাকা লুঠ
Durga Puja 2024: অভিনব উদ্যোগ! মহালয়ার দিন অঙ্কন প্রতিযোগিতা করল কাঁচরাপাড়া আমরা সবাই ক্লাব