শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস ঊনবিংশ শতকের একজন চিহ্নিত ব্যক্তিত্ব, আর বিংশ শতকের শেষ ধাপে তিনি সর্বজন শ্রদ্ধেয় বিশ্বের শেষ আশ্রয়। তিনি আদর্শ ও ঐতিহ্যের এক অনন্য মিশ্রণ। অতীতে ‘ডি. এস. শর্মা’ যেমন তাঁকে ‘Entire orbit of Hinduism’ বলেছিলেন (Hinduism through the Ages, D. S. Sarma, Bharatiya Vidya Bhavan, 1955, P. 125), অন্যদিকে ‘ক্রিস্টোফার ইশারউড’ তেমনি তাঁকে ‘phenomenon’ বলে (রামকৃষ্ণ ও তাঁর শিষ্যগণ, ক্রিস্টোফার ইশারউড, অনুবাদ: রবিশেখর সেনগুপ্ত, মণ্ডল বুক হাউস, কলকাতা, ১৩৮৮ বঙ্গাব্দ, পৃ: ১-২) চিহ্নিত করেছিলেন। শতবর্ষ অতিক্রম করে যন্ত্রসভ্যতার বিজয় বৈজয়ন্তীর দিনেও রামকৃষ্ণ-জনপ্রিয়তা এখনো যেমন ক্রমবর্ধমান, তেমনি শ্রীরামকৃষ্ণ অবমূল্যায়নের প্রবণতাও খুব একটা কম কিছু নয়। ‘সুনীতিরঞ্জন রায়চৌধুরী’র মত অনেকেই এখনো তাঁকে হিন্দু পুনরভ্যুত্থানবাদের একজন নায়ক হিসাবে চিত্রিত করতে চান। (ঊনিশ শতকে নব্য হিন্দু আন্দোলনের কয়েকজন নায়ক, সুনীতিবঞ্জন রায়চৌধুরী, জি.এ.ই. পাবলিশার্স, কলকাতা, ১৩৮৮ বঙ্গাব্দ, পৃ: ১-১৯) আবার কারো কারো কাছে তিনি ‘অলৌকিকতাবাদী’। (আনন্দবাজার পত্রিকা, ৭২ বর্ষ, ১২৮ সংখ্যা) বাক স্বাধীনতার জোর দেখিয়ে বর্তমানে কেউ কেউ এটাও বলেন যে – ‘মথুরামোহন বিশ্বাস’, ‘হৃদয়নাথ’ ও ‘ভৈরবী ব্রাহ্মণী’ মিলে শ্রীরামকৃষ্ণকে সামান্য পুরোহিত থেকে অবতার বানিয়েছিলেন। (উৎস মানুষ, জুন ও জুলাই সংখ্যা, ১৯৯১ সাল) ইতিহাস বলে যে, শ্রীরামকৃষ্ণ কলকাতায় এসেছিলেন ১৮৫৩ সালে। তারপরে দক্ষিণেশ্বর কালী মন্দিরে তাঁর পৌরোহিত্যের দায়িত্ব গ্রহণ, পরে সেই বৃত্তি থেকে নিষ্পত্তি লাভ, তারপরে গভীর সাধনায় একাগ্রচিত্তে নিজেকে নিয়োগ, এবং সেখান থেকে লোকশিক্ষার কাজে আমৃত্যু সংগ্রাম – সংক্ষেপে এটাই ছিল শ্রীরামকৃষ্ণ আন্দোলনের অক্ষ। সেই অক্ষের ভূমিতে আসীন ছিলেন বালক ‘গদাধর’, এবং শীর্ষে অধিষ্ঠান করেছিলেন প্রজ্ঞাময় শ্রীরামকৃষ্ণ। বস্তুতঃ শ্রীরামকৃষ্ণ একটি Phenomenon; তৎকালীন কলকাতার সমাজ যে তাঁকে সহজে স্বীকৃতি দেয়নি – সমকালীন ইতিহাসে সেটার প্রমাণ দেখতে পাওয়া যায়। সম্ভবতঃ সেই ইতিহাসের সঠিক পরিচিতির অভাবেই আজও তাঁকে নিয়ে নানা বিজাতীয় মন্তব্য দেখতে পাওয়া যায়। সেই ইতিহাস অজ্ঞাত থাকলে শ্রীরামকৃষ্ণ আন্দোলনের ‘dimension’ বোঝা যেমন কষ্টকর, তেমনি শ্রীরামকৃষ্ণের মূল্যায়নও অগভীর হতে বাধ্য।
আরো পড়ুন- সংস্কৃত এবং উর্দু ভাষার ইতিহাস
সময়টা ছিল খৃষ্টীয় ঊনিশ শতকের পাঁচের দশক। মাহিষ্য কুলোদ্ভবা ‘রাণী রাসমণিদেবী’ দক্ষিণেশ্বরে বহু অর্থ ব্যয় করে কালীর নবরত্নসহ সুবৃহৎ মন্দির, দ্বাদশ শিবমন্দির ও অন্যান্য দেবালয় প্রভৃতি উৎসর্গ করবার জন্য প্রস্তুত হয়েছিলেন, এবং ১৮৫৫ সালের ৩১শে মে তারিখে সেই মন্দির ও মূর্তি প্রতিষ্ঠার দিন ঠিক হয়েছিল। অসংখ্য বাধা-বিপত্তির মাঝে রাণীকে সে কাজ করতে হয়েছিল। যেহেতু তিনি শূদ্র জাতীয়া ছিলেন, সেই কারণে সমকালীন সমাজের ব্রাহ্মণেরা তাঁকে সে কাজ করবার অনুমতি দেন নি। সেই ঘটনার নিখুঁত বিবরণ দিতে গিয়ে ‘স্বামী সারদানন্দ’ লিখেছিলেন, “এখানেও (রাণী রাসমণি কর্তৃক মন্দির ও মূর্তি প্রতিষ্ঠার কার্যাদি) প্রচলিত সামাজিক প্রথা তাঁহার বিরুদ্ধে দণ্ডায়মান হইল। শূদ্র প্রতিষ্ঠিত দেবদেবীর পূজা করা দূরে যাউক, সদ্বংশজাত ব্রাহ্মণগণ ঐ কালে প্রণামপর্যন্ত করিয়া ঐ মূর্তির মর্যাদা রক্ষা করিতেন না। এবং রাণীর গুরু বংশীয়গণের ন্যায় ব্রহ্মবন্ধুদিগকে তাঁহারা শূদ্র মধ্যেই পরিগণিত করিতেন। সুতরাং যজন-যাজনক্ষম কোন ব্রাহ্মণই রাণীর দেবালয়ে পূজক পদে ব্রতী হইতে সহসা স্বীকৃত হইলেন না।” (শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ লীলাপ্রসঙ্গে, ১ম খণ্ড, সাধকভাব, স্বামী সারদানন্দ, উদ্বোধন কার্যালয়, ১৩৯৮ বঙ্গাব্দ, পৃ- ৭৩) সেই অবস্থায় শ্রীরামকৃষ্ণ দাদা ‘রামকুমার’, সমস্ত সামাজিক প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে রাণী রাসমণির মন্দির ও মূর্তি প্রতিষ্ঠার কাজ সম্পন্ন করেছিলেন। এর অনতিবিলম্বে দেখা গিয়েছিল যে, তিনিই সেই কালীমন্দিরে পূজকের কাজে ব্রতী হয়েছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ জীবনী পাঠকমাত্রেই অবগত রয়েছেন যে, রামকুমারের পরে গদাধর দক্ষিণেশ্বরের পূজকপদে ব্রতী হওয়ার পরেই বিবিধ দিব্যদর্শন পেতে শুরু করেছিলেন, এবং তখন থেকেই পূজার কাজ ব্যাহত হতে শুরু হয়েছিল। এরপরেই তাঁর দ্বাদশবর্ষকাল সাধনা এবং পূজা থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া শুরু হয়েছিল। তারপরে নিবিড় জনসংযোগ করে ক্রমশই তিনি তৎকালীন কলকাতার একজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছিলেন। গদাধর দেখতে দেখতে শ্রীরামকৃষ্ণ হয়েছিলেন। তাঁর সেই উত্তরণের পথ যে কী জটিল এবং ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়ার ঝঞ্ঝায় পরিপ্লুত ছিল, সেটা সমকালীন ইতিহাসের ভাষ্যে আজও উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ দেবতা ও মানুষের মধ্যে ব্যবধানটা ঘুচিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। তিনি দেবতাকে ‘প্রিয়’ জ্ঞানে তাঁর মধ্যে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। আর তিনি সেটা করতে চেয়েছিলেন বলেই ঠাকুরকে রামপ্রসাদী গান শোনাতেন, তাঁর কাছে কাঁদতেন, রাত্রে ঠাকুরের সঙ্গে কথোপকথন করতেন, কখনো কখনো তো ঠাকুরের পায়ে ফুল দেওয়ার আগে তিনি নিজের পায়েই ফুল রেখেছিলেন, এমনকি ঠাকুরকে নৈবেদ্য অর্পণের আগে তিনি নিজেই সেটাকে উচ্ছিষ্ট পর্যন্ত করেছিলেন। তাঁর সেই সমস্ত ক্রিয়াকলাপগুলিকে রানীর কর্মচারীরা কিন্তু ভাল চোখে দেখেন নি। প্রথম থেকেই তিনি রানীর কর্মচারীদের মনমত হতে পারেন নি। রানীর কর্মচারীদের ধারণা ছিল যে, “রাজপুরোহিত হবেন ধর্মীয় মোড়কে কূটনীতি, রাজকীয় চালে আড়ম্বরে পারিপাট্য”। (শ্রীরামকৃষ্ণ: নৈঃশব্দেব রূপ, ধনগোপাল মুখোপাধ্যায, সুবর্ণরেখা, কলকাতা, ১৯৮৩ সাল, পৃ- ১০) বিনিময়ে তাঁরা সেই রাজপুরোহিতকে পেয়েছিলেন – যিনি ছিলেন পৌরোহিত্য বিমুখ, লোভহীন, অনাড়ম্বর এবং প্রচলিত নিয়মের বিরুদ্ধাচারী। শেষে রানীর অনুগ্রহ লাভের প্রত্যাশায় একদিন তাঁরা জমায়েত হয়ে তাঁর বিরুদ্ধে ফাতোয়া জারি করেছিলেন। তাঁরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, “ছোট ভট্চাজ পাগল হয়েছে অথবা তাঁর মধ্যে উপদেবতা ভর করেছে, নতুবা পূজাকালে কেউই কি অমন শাস্ত্র বিরুদ্ধে কাজ করে?” (শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ লীলা প্রসঙ্গ, ১ম ভাগ, সাধকভাব, সপ্তম অধ্যায, পৃ: ১২২-২৩) ঠাকুরবাড়ির প্রধান কর্মচারী খাঞ্জাঞ্চী মহাশয় ও অন্যান্য নিম্নপদস্থ কর্মচারীরা রাণী রাসমণি ও মথুরামোহনকে জানিয়েছিলেন, “ছোট ভট্চাজ (রামকৃষ্ণ) সব মাটি করলে; মা-র পূজা, ভোগরাগ কিছুই হচ্ছে না, ওরূপ অনাচার করলে মা কি কখনো পূজা ভোগ গ্রহণ করেন ?” ঘটনার শেষ সেখানেই ঘটেনি। এরপরে একদিন রাণী রাসমণি শ্রীরামকৃষ্ণের কণ্ঠে গান শুনতে শুনতে অন্যমনস্ক হয়ে পড়লে, তিনি তাঁকে চপেটাঘাত করেছিলেন। সেই দৃশ্য দেখে মন্দিরে উপস্থিত কর্মচারীরা ও রাণীর পরিচারিকাবর্গ হই হই করে শ্রীরামকৃষ্ণকে প্রহারের উদ্দেশ্যে তেড়ে এসেছিলেন। কার্যতঃ শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর সাধনাকালে রানীর কর্মচারীদের কাছ থেকে কোন ধরণের সহযোগিতা তো পাননিই, বরঞ্চ প্রতিনিয়ত প্রতিহত, তিরস্কৃত ও অপবাদক্লিষ্ট হয়েছিলেন। তাঁরা তাঁকে নির্বোধ ও উন্মাদজ্ঞান করতেন। এমনকি রাণীর জমিদারীর খাজাঞ্চীকে শ্রীরামকৃষ্ণ ভয় করতেন। একবার কলকাতার এক গির্জার দ্বারদেশে দাঁড়িয়ে তিনি খৃষ্ট ধর্মাবলম্বীদের যীশু উপাসনা দেখছিলেন, কিন্তু খাজাঞ্চির ভয়ে ভেতরে ঢোকেননি। পরে তিনি বলেছিলেন, “আমি খাজাঞ্চীর ভয়ে ভিতরে গিয়া বসি নাই – ভাবলাম কি জানি যদি কালী ঘরে যেতে না দেয়।” এসব তো ছিল রানীর কর্মচারীদের কথা। কিন্তু স্বয়ং রাণীমা ও তাঁর জামাতা মথুরামোহনও কি শ্রীরামকৃষ্ণ সম্পর্কে প্রথম থেকেই সম্পূর্ণভাবে সংশয়মুক্ত ছিলেন? দক্ষিণেশ্বর থেকে কর্মচারীদের অভিযোগ জানবাজারে রাণীমার কাছে পৌঁছানোর পরে তাঁরা সেই অভিযোগের তদন্ত করতে দক্ষিণেশ্বর এসেছিলেন। পরবর্তীকালে শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি তাঁরা শ্রদ্ধা ও সৌজন্য প্রদর্শন করলেও প্রথমপর্বে তাঁদের মানসিকতা কিন্তু সেই মার্গে কখনোই ছিল না। শ্রীরামকৃষ্ণের সংশ্লিষ্ট ক্রিয়া পরিপ্রেক্ষিতে মথুরামোহন শ্রীরামকৃষ্ণকে একবার জানিয়েছিলেন – “ঈশ্বরকেও আইন মেনে চলতে হয়।” সেই মথুরবাবুই কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণকে প্রলুব্ধ করবার জন্য মূল্যবান ভোগ্যবস্তু উপহার দিয়েছিলেন, ঠাকুরবাড়ির দেবোত্তর সম্পত্তিও তাঁর নামে লিখে দিতে চেয়েছিলেন, এবং অবশেষে তাঁর ব্রহ্মচর্য বিনষ্টির উদ্যোগে বারবণিতাদের নিয়োগ করেছিলেন।
সমকালীন ব্রাহ্মণ, পুরোহিত ও গুরুকুলের প্রতিনিধিরাও শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি কখনোই যথেষ্ট সম্ভ্রম দেখাননি। সেক্ষেত্রেও তাঁদের ভূমিকা বিরুদ্ধাত্মক ও বিরূপাত্মক ছিল। শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর সাধনা প্রত্যয় থেকে ঘোষণা করেছিলেন, “ঈশ্বর সবেতেই আছেন তবে মানুষে তাঁর অধিক প্রকাশ।” তাই মানুষকে অবমাননার পরিবর্তে তিনি শ্রদ্ধার শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যায় ব্রতী হয়েছিলেন। তিনি ব্রাহ্মণের বর্ণ চিহ্ন উপবীত ত্যাগ করেছিলেন; আচার, পবিত্রতা-অপবিত্রতার বিচার বর্জন করেছিলেন; কাঙালের এঁটো পাতা পরিষ্কার করেছিলেন; অব্রাহ্মণের গৃহে খাদ্যগ্রহণ করেছিলেন; ধর্ম পথের উদ্দেশ্য বোঝবার জন্য মুসলমান ও খ্রিস্টানদের ধর্ম সাধনা করেছিলেন এবং তাঁদের সঙ্গে মেলামেশা শুরু করেছিলেন। তাঁর সেই ক্রিয়া পারম্পর্য কিন্তু তৎকালীন রক্ষণশীল হিন্দুসমাজ কখনোই মেনে নেয়নি। এই প্রসঙ্গে স্বামী সারদানন্দ লিখেছিলেন, “কিছুদিন ঐরূপ পূজা করিতে না করিতে তিনি প্রথমে অনেকের বিদ্রূপভাজন হলেন।” সাধন মর্গে উন্নীত হওয়ার পরে তাঁর খাদ্যাখাদ্যের এবং ছোঁয়াছুঁয়ির বিচার ছিল না বলে তিনি নিজের স্বজনবর্গের কাছ থেকেও কম নিগ্রহ ভোগ করেন নি। এই প্রসঙ্গে তিনি নিজেই বলেছিলেন, “দেশে গেলুম, রামলালের বাপ (শ্রীরামকৃষ্ণের মধ্যম ভ্রাতা রামেশ্বর) ভয় পেয়ে ভাবলে, যাঁর তাঁর বাড়িতে খাবে। ভয় পেলে পাছে তাঁদের জাতে বের করে দেয়। আমি তাই বেশীদিন (দেশে) থাকতে পারলুম না; চলে এলুম।” শ্রীরামকৃষ্ণের ওপরে সমকালীন ব্রাহ্মণদের মানসিকতা কেমন ছিল, সেটা ‘মহেন্দ্ৰনাথ দত্তের’ লেখা থেকেও জানতে পারা যায়। তিনি লিখেছিলেন, “পরমহংসমশাই রামদাদার বাড়িতে এইরূপ বার কতক আসা যাওয়া করাতে, পাড়ার লোকের তাঁহার প্রতি আর বিদ্বেষভাব কিছু রহিল না, কেহ উপহাসও করিত না। … পাড়ার মহেন্দ্র গোঁসাই আসিলেন কিন্তু কোন ভট্টাচার্য ব্রাহ্মণ আসিতেন না; ইহা আমি বিশেষ করিয়া লক্ষ্য করিয়াছিলাম। পরমহংস মশাই ছিলেন মাড়েদের ঠাকুরবাড়ির পূজারী – মাহিষ্যদের পূজারী, তাহার উপর গলায় পইতা ছিল না। এইজন্য ভট্টাচার্য ব্রাহ্মণেরা তাঁহাকে প্রণাম করিতে রাজী ছিলেন না, আর এই কারণেই, ভট্টাচার্য ব্রাহ্মণেরাও পরমহংসমশাইকে সেরূপ শ্রদ্ধার চোখে দেখিতেন না।” শ্রীরামকৃষ্ণ আন্দোলনের সামাজিক বিন্যাস প্রসঙ্গে ‘স্বামী সোমেশ্বরানন্দ’ লিখেছিলেন, “ভাটপাড়া, দক্ষিণেশ্বর ও কলকাতার হিন্দু ব্রাহ্মণেরা তাঁর কাছে বিশেষ যেতেন না, কারণ শূদ্রাণীর (রাণী রাসমণির) চাকরি করায় শ্রীরামকৃষ্ণ জাত হারিয়েছিলেন।” মথুরবাবুর কালীঘাটের পুরোহিত ‘চন্দ্রহালদারের’ ব্যবহারের মধ্যেও রামকৃষ্ণের প্রতি সমকালীন ব্রাহ্মণদের মানসিকতার একটি নজির দেখতে পাওয়া যায়। “মথুরবাবু ক্রমশঃ শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি অনুরক্ত হওয়া কালে এক সময় রামকৃষ্ণ মথুরবাবুর জানবাজারের গৃহে হাজির হন। এবং সেখানে তিনি সমাধিস্থ হন। সে সময় তাঁর কাছে কেউ ছিল না। মথুরবাবুর পুরোহিত চন্দ্রহালদার সেখানে হাজির ছিল। তাঁর ধারণা ছিল, শ্রীরামকৃষ্ণ মথুরবাবুকে কোন গুণটুন করেছে। ঠাকুরের সমাধিস্থ অবস্থাতেই চন্দ্রহালদার বলতে শুরু করল, ‘অ বামুন, বল্ না বাবুটাকে কি করে হাত করলি?’ ঠাকুর সমাধিস্থ ও নিরুত্তর। হালদার পুরোহিত তখন ক্রুদ্ধ হয়ে ‘যা শালা বল্লিনা’ বলে তাঁকে লাথি মেরে চলে গেল।”
ঊনিশ শতকের সাতের ও আটের দশক ছিল শ্রীরামকৃষ্ণ চেতনার সামাজিকীকরণের অধ্যায়। তখন গোটা দেশ হিন্দু পুনরভ্যুত্থানের জোয়ারে উত্তাল হয়ে উঠেছিল। অবশ্যই সেই জোয়ার প্রাচীনকে অনুসরণ করতে উদ্যত ছিল। সেই হিন্দু আন্দোলনের অন্যতম নায়ক ছিলেন ‘শশধর তর্কচূড়ামণি’। তিনি বৈদিক ধর্মের কোন কথা না বলে কেবলমাত্র ভক্তিমূলক পৌরাণিক ও আনুষ্ঠানিক ধর্মকেই তাঁর বক্তৃতায় তুলে ধরতেন। তিনি প্রাচীন প্রথা ও আচারগুলি প্রচার করতেন। হাঁচি, টিকটিকি ইত্যাদি নিয়মের ওপরে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা করতেন। টিকির চৌম্বক শক্তির আকর্ষণ-বিকর্ষণ, হাই তুলে তুড়ি মারবার মধ্যে অক্সিজেনের সম্পর্ক আবিষ্কার করে ব্যক্তিদের বিভ্রান্ত করতেন। এমনকি অনেক সময়েই তিনি শাস্ত্রকে বিকৃত করে বা শাস্ত্রের অংশ বিশেষ বর্জন করে তাতে বিজ্ঞানের রঙ লাগিয়ে সেই আচার-তত্ত্বকে ধর্ম বলে চালিয়ে দিতেন। যাই হোক, ‘কথামৃত’ ও ‘লীলাপ্রসঙ্গে’ শ্রীরামকৃষ্ণ ও শশধর তর্কচূড়ামণির সাক্ষাতের উল্লেখ পাওয়া যায়। শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে তিনি ভক্তিনম্রচিত্তেই নিবেদন করেছিলেন, “মহাশয়, দর্শনশাস্ত্র পড়িয়া আমার হৃদয় শুষ্ক হইয়া গিয়াছে, তাই আপনার নিকটে আসিয়াছি ভক্তিরস পাইব বলিয়া, অতএব আমি শুনি, আপনি কিছু বলুন।” শ্রীরামকৃষ্ণও তাঁর কাছে অত্যন্ত সৌজন্য দেখিয়েই বলেছিলেন, “ওগো তুমি পণ্ডিত, তুমি কিছু বল।” সেই আলোচনা শ্রীরামকৃষ্ণ ও শশধরের পারস্পরিক সৌহার্দ্য সম্পর্কের ওপরেও আলোকপাত করে। কিন্তু ইতিহাস থেকে এটাও জেনে বিস্মিত হতে হয় যে, শ্রীরামকৃষ্ণ দেহরক্ষা করবার পরে, সেই চূড়ামণি মহাশয়েরই শিষ্য ‘পদ্মনাথ দেবশর্মা’, ১৩২৭ বঙ্গাব্দের ‘সাহিত্য’ পত্রিকায় চূড়ামণি মহাশয়ের লেখা একটি চিঠিকে ভিত্তি করে শ্রীরামকৃষ্ণের ওপরে তীব্র কটাক্ষ হেনেছিলেন। সেই চিঠির বক্তব্যে তিনি জানিয়েছিলেন, “রামকৃষ্ণ, ‘পরমহংস’ উপাধি কাহার নিকট পাইয়াছিলেন, তাহা জানিনা। খুব সম্ভব ইহা সাধারণ লোকের নিকট পাইয়াছিলেন। যদি তাঁহার গুরুই ঐ উপাধি দিয়া থাকেন, তবে তাহাও ভ্রান্তিমূলক বুঝিতে হইবে। … তাঁহাকে ‘অবধূত আশ্রমী’ বলিলে নিতান্ত অসঙ্গত হয় না। আমি কোন ধর্মতত্ত্ব শিক্ষা বা উপদেশ পাওয়ার নিমিত্ত তাঁহার নিকট যাই নাই, কারণ তিনি কোন প্রকার শাস্ত্রই জানিতেন না।” ওই একই লেখায় তিনি শ্রীরামকৃষ্ণের সমাধিভাব প্রসঙ্গে জানিয়েছিলেন, “সমাধির যে অসংখ্য স্তর আছে এবং যেগুলি করিতে পারিলে নির্বিকল্প সমাধি সম্ভবপর হয়, শ্রীরামকৃষ্ণের তাহা জানা ছিল না। কারণ, লেখাপড়া তিনি আদৌ জানিতেন না।” ওই দীর্ঘপত্রে চূড়ামণি শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি আগাগোড়া কটাক্ষ হেনেছিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ জীবনে খ্রিস্টান মিশনারিদের প্রতিক্রিয়াও অনুল্লেখের নয়। শ্রীরামকৃষ্ণ জীবনী পাঠক-পাঠিকা মাত্রেই ‘রেভারেণ্ড কুক’ ও ‘হোস্ট’ সাহেবের নামের সঙ্গে পরিচিত রয়েছেন। ঘটনার বিবরণে তাঁদের শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি সৌজন্য প্রদর্শনের বিষয় উল্লিখিত থাকলেও প্রকৃত অর্থে তাঁদের ধর্মান্ধ মানসিকতায় শ্রীরামকৃষ্ণ কখনোই ঔজ্জ্বল্যের সঙ্গে গৃহীত হননি। অতীতে ‘শঙ্করীপ্রসাদ বসু’ সমেত একাধিক গবেষকই এই বিষয়ে সহমত ছিলেন। খ্রিস্টান ব্যক্তিবর্গের সেই নমুনার কথা কথামৃত গ্রন্থেও বিবৃত করা হয়েছে। শ্রীরামকৃষ্ণ ও রামচন্দ্র দত্তের কথোপকথনেও সেটার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। সমকালীন খ্রিস্টান পত্রিকা ‘Indian Empire’ তখন বিশেষ দাপটের সঙ্গেই চালু ছিল। ওই পত্রিকার সম্পাদকের সঙ্গে রামচন্দ্র দত্তের বিশেষ আলাপ ছিল। রামচন্দ্র দত্ত সেদিন শ্রীরামকৃষ্ণকে জানিয়েছিলেন, “একজন খবরের কাগজের (Indian Empire) সম্পাদক আপনার নিন্দা করছিল।” প্রত্যুত্তরে শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁকে বলেছিলেন, “তা করলেই বা।” পরবর্তীকালে ‘ম্যাক্সমূলার’ লিখিত ‘রামকৃষ্ণ’ গ্রন্থ প্রকাশিত হওয়ার পরে দেশব্যাপী যে প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছিল, তাতে মিশনারি পত্রিকাগুলিও যোগ দিয়েছিল। তখন ‘অ্যার্থীনিয়াম’ পত্রিকা শ্রীরামকৃষ্ণ প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছিল, “তিনি (রামকৃষ্ণ) বেদান্ত দর্শনের অনুগামী কিন্তু পণ্ডিত নন, সংস্কৃত বা ইংরাজী জানতেন না। বস্তুতঃপক্ষে তিনি নিছক এক গরিব ভিখারি, যিনি বাড়াবাড়ি কৃচ্ছ্রসাধন করে নিজের শরীর নষ্ট করেছিলেন।” ওই সময়ে ‘হার্ভেস্ট ফিল্ড পত্রিকা’য় ‘ই. ডবলিউ. টি.’ রামকৃষ্ণ প্রসঙ্গে লিখেছিলেন, “রামকৃষ্ণের প্রেম, মনস্বিতা এবং বিবেকের দিক দিয়ে অভাবগ্রস্ত। তার ফলে তা বেহিসেবি এবং উন্মত্ত।” ‘রেভারেণ্ড মার্ডক’ যিনি অর্ধ শতাব্দিকাল ধরে ভারতবর্ষে অবস্থান করেছিলেন, এবং ‘খৃষ্টান লিটারেচার সোসাইটি’র কর্ণধার হয়ে একাধিক পুস্তক রচনা করেছিলেন, যাঁর জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্যই ছিল হিন্দুধর্মকে কদর্যরূপে প্রকাশ করা – সেই মার্ডক শ্রীরামকৃষ্ণ সম্বন্ধে জানিয়েছিলেন, “বিবেকানন্দের গুরু শাস্ত্র-টাস্ত্র কিছু জানিতেন না – বিবেকানন্দ গুরুর উপরে মিথ্যা গুণারোপ করেছেন।”
ঊনিশ শতকের বঙ্গসমাজে ‘ব্রাহ্মসমাজের’ প্রভাব অপরিসীম ছিল। ১৮২৮ সালে ‘রাজা রামমোহন রায়’ ‘ব্রহ্মসভা’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। রামমোহনের দেহত্যাগের পরে ১৮৪৩ সালে ‘দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের’ হাতে সেটা ‘ব্রাহ্মসমাজ’-এ পরিণত হয়েছিল। ১৮৫৮ সালে ‘কেশবচন্দ্ৰ সেন’ ব্রাহ্মসমাজে যোগ দিয়েছিলেন এবং সেই সমাজে সংস্কার আন্দোলনকে জোরদার করেছিলেন। এর ফলে ব্রাহ্মসমাজের প্রাচীনপন্থী ও নতুন পন্থীদের মধ্যে সংঘর্ষ বেঁধেছিল। তার ফলে ১৮৬৬ সালে ব্রাহ্মসমাজ, ‘আদি ব্রাহ্মসমাজ’ ও ‘ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজে’ বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল। দেবেন্দ্রনাথ আদি সমাজের কর্ণধার থেকে গিয়েছিলেন, এবং কেশবচন্দ্র ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজের কর্ণধার হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে পুনরায় নব্য ও প্রাচীনদের মধ্যে সংঘর্ষ দেখা দিলে ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ ‘সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ’ ও ‘নববিধান ব্রাহ্মসমাজে’ বিভক্ত হয়েছিল (১৮৭৮ সালে)। সেই বিভাগে সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের নেতৃত্বে ছিলেন ‘শিবনাথ শাস্ত্রী’ এবং নববিধান ব্রাহ্মসমাজের দায়িত্বে ছিলেন কেশবচন্দ্র। ব্রাহ্মসমাজের সেই ধারাবাহিক বিবর্তনের পথে দেবেন্দ্রনাথ, কেশবচন্দ্র ও শিবনাথ শাস্ত্রী প্রমুখ ব্যক্তিত্বের নেতৃত্বও স্মরণীয়। ঐ সব নমস্য ব্যক্তিদের সঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণের বিশেষ পরিচিতি ও প্রভাবের কথা ইতিহাসে বহুল বিবৃত। শ্রীরামকৃষ্ণ নিজস্ব আগ্রহেই ব্রাহ্মসমাজে হাজির হয়েছিলেন, তাঁদের নেতৃত্বের অধিকারী ব্যক্তিদের সঙ্গে সাক্ষাৎও করেছিলেন। তাঁদের প্রার্থনা সভাতেও তিনি হাজির থেকেছিলেন। কিন্তু সেসব সত্ত্বেও তাঁকে নিয়ে ব্রাহ্মদের বিসংবাদ রহিত হয়নি। অনেকেই হয়ত জানেন যে, নিজের সাধক জীবনের প্রথম পর্বে মথুরবাবুর সঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণ মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিলেন। মহর্ষিকে তিনি ‘কলিরজনক’ রূপে আখ্যাতও করেছিলেন। কিন্তু তাঁর পোষাক কৌলিন্য না থাকবার জন্য, ব্রাহ্মউৎসবে যোগদানে আগ্রহী হওয়া সত্ত্বেও তিনি তাতে যোগ দিতে পারেননি। কারণ মহর্ষি মথুরবাবুকে জানিয়েছিলেন, “শ্রীরামকৃষ্ণ যেন উৎসবে যোগদান না করেন, কারণ গায়ে উড়ানি থাকবে না, অসভ্যতা হবে।” এরপরে ১৮৭৫ সালে শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে কেশবচন্দ্রের সাক্ষাৎ ঘটবার পরে তাঁদের মধ্যেকার পারস্পরিক সৌহার্দ নিবিড় হয়েছিল। কিন্তু তাঁদের সেই নৈকট্যকে ব্রাহ্মসমাজ যে খুব একটা আনন্দের সঙ্গে যে গ্রহণ করেনি, লীলাপ্রসঙ্গ গ্রন্থে সেটার বিস্তৃত উল্লেখ পাওয়া যায়। মহেন্দ্রনাথ দত্তের লেখনীতেও সেই ধরণের ঘটনার বর্ণনা পাওয়া যায়, “গঙ্গার ঘাটে কেশববাবুর বক্তৃতা; পরমহংস মশাইও বক্তৃতা শুনিতেছিলেন, কিন্তু খানিকক্ষণ পরেই তিনি বিরক্ত হইয়া নিজের ঘরে চলিয়া যাইলেন। পরমহংস মশাইকে চলিয়া যাইতে দেখিয়া কেশববাবু ভাবিলেন যে তাহা হইলে বোধহয় বক্তৃতায় কোন ত্রুটি হইয়াছে। কিন্তু অন্যান্য শ্রোতারা বলিতে লাগিলেন, ‘লোকটা অশিক্ষিত, মুখ্যু, কোনো কিছু বোঝে না, তাই চলে গেল’।” ব্রাহ্মনেতা ‘প্রতাপচন্দ্র মজুমদার’ তো শ্রীরামকৃষ্ণ প্রসঙ্গে এটাও বলেছিলেন যে, “তাঁর ভাষা জঘন্য ধরনের নোংরা, তিনি কুত্রাপি বৈদান্তিক নন ও তিনি স্ত্রীর প্রতি বর্বরোচিত ব্যবহার করেছিলেন।” পরবর্তীকালে সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ ও নববিধান ব্রাহ্মসমাজ গঠিত হওয়ার পরে শিবনাথ শাস্ত্রী শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে গমনাগমন বন্ধ করেছিলেন। সেটার কারণ হিসেবে তিনি বলেছিলেন যে, তিনি যদি ঘনঘন দক্ষিণেশ্বর গমন করেন তাহলে তাঁর দেখাদেখি অন্য সকলেও ওই রকম করবেন এবং তাতে দল ভেঙে যাবে। এছাড়া শ্রীরামকৃষ্ণের সমাধিভাব প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন যে, সেটা রামকৃষ্ণের ‘স্নায়বিক দৌর্বল্য’ (hysteria or epileptic fits)। ব্রাহ্মসমাজের উপাসনাকক্ষে শ্রীরামকৃষ্ণের চরম নিগ্রহের বিবরণও অনেকের জানা রয়েছে। নরেন্দ্রনাথের সন্ধান মানসে একদা তিনি সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ প্রার্থনাকক্ষে হাজির হয়েছিলেন এবং সেখানেই সমাধিস্থ হয়েছিলেন। তাঁর সেই রূপ দর্শন অভিলাষে জনতা হুড়োহুড়ি করতে আরম্ভ করবার পরে ব্রাহ্মসমাজ কর্তৃপক্ষ কক্ষের গ্যাসবাতিগুলি নিভিয়ে দিয়েছিলেন। তার ফলে কক্ষের মধ্যে হুড়োহুড়ি ভয়ঙ্কর আকার নিয়েছিল। নরেন্দ্রনাথ সেখানে শ্রীরামকৃষ্ণের উপস্থিতি লক্ষ্য করেছিলেন এবং তাঁর কাছেই হাজির ছিলেন। তাঁর সমাধি ভাঙবার পরে তিনি তৎক্ষণাৎ সমাজগৃহের পিছনের দরজা দিয়ে তাঁকে বাইরে বের করে এনেছিলেন। ঐ দিনের ঘটনায় তিনি আরো লক্ষ্য করেছিলেন যে, ঐ সমাজের আচার্য বা সমাজস্থ কোন বিশিষ্ট ব্যক্তি ঠাকুরকে সাদর আহ্বান করা তো দূরের কথা, তাঁর প্রতি শিষ্টাচারও প্রদর্শন করেন নি।
সমকালে অন্যান্য ধর্মান্দোলনের সঙ্গে বৈষ্ণব সমাজেও ধর্মান্দোলনের জোয়ার এসেছিল। সমকালীন বৈষ্ণব চূড়ামণি, ‘ভগবান দাস বাবাজী’ ও ‘বৈষ্ণব চরণের’ বৈষ্ণব সমাজে বিশেষ প্রতিপত্তি ছিল। সেই আন্দোলনের উপাদান হিসাবে দেশের ইতঃস্ততঃ তখন হরিসভা, ভাগবত পাঠ, নাম সংকীর্তন, নৃত্য প্রভৃতি অনুষ্ঠান সাড়ম্বরে পালিত হত। লীলাপ্রসঙ্গ গ্রন্থ থেকে সেই ধরণের এক হরিসভা ও শ্রীরামকৃষ্ণ নিগ্রহের সংবাদ সম্পর্কে জ্ঞাত হওয়া যায়। তখন কলুটোলার হরিসভার সভ্যরা নিজেদের শ্রীচৈতন্যের একান্ত পদাশ্রিত বলে মনে করতেন; এবং সেকথা অনুক্ষণ স্মরণ রাখার উদ্দেশ্যে হরিসভার আসরে তাঁরা একটি আসন ফুল ও মালা দিয়ে শোভিত রাখতেন। উদ্দেশ্য ছিল, সেটিকে ‘শ্রীচৈতন্যের আসন’ হিসাবে চিহ্নিত করা; ভক্তিভরে ভাবা যে, ঐ আসনে শ্রীচৈতন্য সমাসীন এবং ভক্তরা তাঁরই সম্মুখে ভাগবত কথকতা স্মরণ করছেন। একবার সেই আসরে বৈষ্ণব চরণ শ্রীমদ্ভাগবত পাঠে ব্রতী ছিলেন। এমতাবস্থায় শ্রীরামকৃষ্ণ সেখানে হাজির হয়েছিলেন এবং ভাবাবেগে শ্রীচৈতন্যাসনে দণ্ডায়মান হয়ে সমাধিস্থ হয়েছিলেন। সমাধি ভাঙবার পরে তিনি সেই কীর্তন আসরে যোগদান করে সকলকে আনন্দাপ্লুত করেছিলেন। পরবর্তীকালে শ্রীরামকৃষ্ণের ঐ আচরণ বৈষ্ণব সমাজে বিশেষ বিতর্কের সৃষ্টি করেছিল। বিশেষ বৈষ্ণব ভক্তরা ভেবেছিলেন যে, নামযশঃ প্রার্থী ধূর্ত ভণ্ডেরা স্বার্থসিদ্ধির জন্য ভবিষ্যতে আর কখনো যাতে আসন অধিকার না করতে পারেন, সেই ব্যাপারে তাঁদের ব্যবস্থা নিতে হবে। তাই তাঁরা বৈষ্ণব সমাজে শ্রীরামকৃষ্ণের ঐ ক্রিয়াকাণ্ডের সংবাদ পাঠিয়েছিলেন। এমন কি তখন কালনায় অবস্থানরত বৈষ্ণবচূড়ামণি ভগবানদাস বাবাজীকেও সেই সংবাদ জানানো হয়েছিল, এবং সকলেই তাঁর কাছে ত্রুটি সংশোধনের পথ জানতে ব্যগ্র হয়ে উঠেছিলেন। শ্রীচৈতন্য পদাশ্রিত সিদ্ধবাবাজী রামকৃষ্ণের ঐ ঘটনা সম্পর্কে অবগত হয়ে তাঁর উপরে বিশেষ ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন। ক্রোধান্ধ হয়ে তিনি শ্রীরামকৃষ্ণের উদ্দেশ্য কটুবাক্য প্রয়োগ তো করেছিলেনই, সেই সঙ্গে তাঁকে ভণ্ড বলতেও কুণ্ঠিত হননি। যদিও পরবর্তীকালে ঐ ভগবানদাস বাবাজী শ্রীরামকৃষ্ণ দর্শনে কৃতার্থ হয়েছিলেন এবং তাঁর উপদেশ বাণীতেই নিজেকে চিনতে পেরেছিলেন।
সমকালে সাধারণের মানসিকতাও শ্রীরামকৃষ্ণ সম্পর্কে খুব একটা উচ্চাঙ্গের ছিল না। ধনগোপাল মুখোপাধ্যায় সাধনকালে তাঁর ভাবান্তর এবং প্রতিবেশী প্রতিক্রিয়ার বিবরণ দিতে গিয়ে লিখেছিলেন, “… অবশেষে তাঁর প্রার্থনা ও তাঁর ক্রন্দন এমন উচ্চকণ্ঠ হলো যে পাড়ার সম্ভ্রান্ত ভদ্রলোকেরা বিরক্তবোধ করলেন। তাঁরা নিজেদের মধ্যে রাগে গজগজ করতে লাগলেন। তাঁরা বললেন, ‘এ তো স্রেফ অত্যাচার। ঘুমোবার একটা সময় আছে। প্রার্থনার সময় নির্দিষ্ট। দেবীর বিশ্রামের সময় তাঁকে শয়ন না দিয়ে তাঁর সঙ্গে অনর্থক বকবক করা – এসব দুষ্কর্ম কোন সাম্মানিক পুরোহিত করে না। কিন্তু এসব কী!’ …” এমনকি শ্রীরামকৃষ্ণ-পার্ষদ ‘যোগানন্দের’ সামনেও জনৈক নৌকাযাত্রী শ্রীরামকৃষ্ণ সম্পর্কে কটু বাক্য বলেছিলেন। একদা যোগানন্দ দক্ষিণেশ্বর অভিমুখে গহনার নৌকায় আসছিলেন। সেই সংবাদ অবগত হয়ে জনৈক যাত্রী তাঁকে বলেছিলেন, “ঐ এক ঢং আর কি; ভাল খাচ্চেন, গদিতে শুচ্চেন, আর ধর্মের ভান করে যত সব স্কুলের ছেলের মাথা খাচ্ছেন।” শ্রীরামকৃষ্ণপার্ষদ ‘নিরঞ্জনের’ সামনেও সেই নৌকাযাত্রীরা ওই জাতীয় উক্তি করেছিলেন। এরপরে রামকৃষ্ণের প্রতি সমকালীন ব্যক্তি মানসিকতা বোঝানোর উদ্যোগে স্বামীজী ভ্রাতা মহেন্দ্ৰনাথ দত্তের লেখনী থেকে কিছুটা তুলে ধরা অসঙ্গত হবে না – “সাধারণ লোকের ধারণা ছিল যে, দক্ষিণেশ্বরে পরমহংস নামে কে একজন লোক থাকে, তাহার মিরগি হয়, কিন্তু হাত-পা খেঁচা খেঁচি করে না, আপনা-আপনি ভাল হয়, ডাক্তার দেখাইতে হয় না। … আবার শুনা গেল যে, সে লোকটি রাসমণিদের পূজারী, কালীপূজা করিয়া থাকে। লোকটার নাম আবার ‘পরমহংস’, এ আবার কি কথা! লোকেরা অমনি ব্যঙ্গচ্ছলে পরমহংসকে ‘গ্রেটগূস’ (Great goose) বলিতে লাগিল। পরমহংস মশাই-এর প্রতি তখনকার লোকের প্রথমে এরূপ কিঞ্চিৎ অবজ্ঞা বা অশ্রদ্ধার ভাব ছিল।” মহেন্দ্র দত্তের বিবরণী থেকে আরো জানা যায় যে, একদিন শ্রীরামকৃষ্ণ সিমলায় ‘সুরেশমিত্তির’-এর বাড়িতে গেলে তাঁর জনৈক আত্মীয় যিনি তখন সরকারী উচ্চপদে বহাল ছিলেন, তিনি শ্রীরামকৃষ্ণের সামনেই মন্তব্য করেছিলেন – “পরমহংস মশাই ছোট ছেলেগুলিকে বখাচ্ছেন, নষ্ট করছেন” প্রভৃতি।
উপরোক্ত আলোচনায় শ্রীরামকৃষ্ণ ও তাঁর সমকালীন পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির চালচিত্র হাজির করা হয়েছে। ওই সব ঘটনা যেমন শ্রীরামকৃষ্ণ ও পরিবেশ প্রতিক্রিয়াকে ব্যক্ত করে, তেমনি শ্রীরামকৃষ্ণ শ্রেষ্ঠত্ব প্রচারে কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর দাবীকেও নস্যাৎ করে দেয়। বিবৃত ঘটনার সমাহারে পাঠক-পাঠিকারা নিশ্চিত অবগত হতে পেরেছেন যে, রাণী রাসমণির ‘কালী সাধনা’ শ্রীরামকৃষ্ণকে অপরাজেয় করেনি। নিতান্ত সাধারণ মানুষের মত পদে পদে হোঁচট খেয়ে তবেই তিনি জীবনের প্রত্যন্ত প্রদেশে পৌঁছাতে পেরেছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণের জীবন, সংগ্রামে পরিপূর্ন ছিল; কোন মতেই কোন কিছুর সঙ্গেই তিনি কখনো আপস করেননি। আঘাত অপমান নিগ্রহ কটুবাক্য সব কিছুই তিনি নীরবে হজম করেছিলেন। সেসবের উত্তরে তিনি কেবলই হেসেছিলেন। বিস্ময়ের ব্যাপার হল যে, রানীর কর্মচারীরা, ব্রাহ্মণ, ব্রাহ্মসমাজী, খ্রিস্টান মিশনারি, বৈষ্ণব সমাজী, সাধারণ মানুষ সকলের ঐ প্রতিক্রিয়া পরাভূত হয়ে ক্রমাগত জনতার স্রোত তাঁকে আবর্তন করে ফিরত। সেই প্রতিক্রিয়ার সংবাদ আপাত অপ্রীতিকর ঠেকলেও সেটার মধ্যে বিরাট এক সত্য নিহিত রয়েছে। সেই তীব্র প্রতিক্রিয়া সত্ত্বেও শ্রীরামকৃষ্ণ ঊনিশ শতকে ও তার পরেও সর্বজনপূজ্য একজন ব্যক্তিত্ব হয়ে রয়েছেন। কারণ তিনি কলকাতাকে জয় করেছিলেন। ঐ প্রতিক্রিয়াই তাঁকে বিজয়ী করেছে। এখানে অন্য শর্ত গৌণ। কার্যতঃ শ্রীরামকৃষ্ণের শ্রেষ্ঠত্ব ও সর্বজনগ্রাহ্যতা কোন ধর্মের নিগড়ে কখনোই বাঁধা ছিল না। তিনি শ্রেষ্ঠ ছিলেন তাঁর প্রজ্ঞায় – জ্ঞানে – চেতনায় – সমাজমনস্কতায়। তাই তাঁর জীবন যতখানি দেবত্বে – ততখানিই মানবত্বে মহিমান্বিত ছিল। তাই সবশেষে অধ্যাপক ‘রিবাকভের’ ভাষায় বলতে পারা যায় – “সবার উপরে রামকৃষ্ণ ছিলেন কবি। … আকাশে মেঘ দেখলে তাঁর ভাবোদয় হচ্ছে, প্রকৃতির শোভা দেখে তিনি আত্মহারা হচ্ছেন। … তিনি সাধারণ মানুষের, আবার সাধারণ হয়েও অসাধারণ। তিনি ধুলো কাদা মাখা এই পৃথিবীরই মানুষ। লোকোত্তর হয়েও তিনি সকলের লোক।”
কল্যাণীতে দুঃসাহসিক ছিনতাই! কাঁচরাপাড়ার ব্যবসায়ীকে মারধর করে টাকা লুঠ
Durga Puja 2024: অভিনব উদ্যোগ! মহালয়ার দিন অঙ্কন প্রতিযোগিতা করল কাঁচরাপাড়া আমরা সবাই ক্লাব
কাঁচরাপাড়ায় ব্যবসায়ীর বাড়ি থেকে ২৫ লক্ষ টাকার মাল চুরি, মুল পান্ডা সুমন রায় গ্রেফতার
Durga Puja 2024: খুঁটি পুজো দিয়ে শুরু হল কাঁচরাপাড়া আমরা সবাই ক্লাবের এ বছরের পুজো
ইটালিতে জি৭ বৈঠকে জেলেনস্কি-মোদী বৈঠক, যুদ্ধ বন্ধের জন্য কী বললেন?
নিয়োগ মামলার তদন্তে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের আরও জমি বাজেয়াপ্ত করল ইডি
রাজ্যের ৪ বিধানসভা উপনির্বাচনে প্রার্থীর নাম ঘোষনা তৃণমূলের
চন্দবাবুর শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে কেনো এলেন না নীতিশ? খোঁচা বিরোধীদের, নীতিশকে ঘিরে জল্পনা
উত্তরের চা বলয়ে বিজেপির ভোট ব্যাঙ্কে ধস! রাশ ধরুক আরএসএস, জোর চর্চা দলের অন্দরে
একী কাণ্ড? বাংলায় ৩ বিজেপি সাংসদ যোগাযোগ করছেন তৃণমূলের সঙ্গে!