একসময় হুগলী ছিল ভারতের অন্যতম বন্দর শহর। শুধু ইংরেজরাই নয়,এখানে ওলন্দাজ, পর্তুগীজদের মতো জাতি উপনিবেশ স্থাপন করে ছিল। আর এই হুগলী জেলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শহর ছিল চুঁচুড়া।আজও হুগলী জেলায় চুঁচুড়া একটি গুরুত্বপূর্ণ মহকুমা শহর। দীর্ঘ ইতিহাসের সাক্ষী এই শহরের বুকে আজও বিদ্যমান। গঙ্গা দিয়ে বহু জল গড়িয়ে গেলেও সেসব সাক্ষীকে একেবারেই ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারেনি। চুঁচুড়ার দীর্ঘ ইতিহাসের সবচেয়ে বড় সাক্ষী হয়ে থেকে এই শহরের প্রাণকেন্দ্র ঘড়ির মোড়ের ঘড়ি। ১০৬ বছর ধরে থাকা এই ঘড়িটি আজও জানান দেয় সঠিক সময়। জানান দেয় বাকি সমস্ত কিছু অতীত হয়ে গেলেও সে আজও বর্তমান, আজও প্রাসঙ্গিক সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে।একবারই মাত্র সে থেমে গিয়েছিল, সময়ের সঙ্গে দৌড়তে গিয়ে কিন্তু ওই একবারই,তারপর আর তার গতিরোধ হয়নি।আজ সেই ঘড়ির ইতিহাসেই একবার সফর করে নেওয়া যাক।চুঁচুড়া শহরের কেন্দ্রস্থলে চারমাথা মোড়ে রয়েছে “এডওয়ার্ডিয়ান ক্লক টাওয়ার” যার স্থানীয় নাম ঘড়ির মোড়।চুঁচুড়ার শতাব্দী প্রাচীন এই স্তম্ভঘড়ি টি ব্রিটিশরা ইংল্যান্ডের রাজা সপ্তম এডওয়ার্ডের স্মৃতিতে ইংল্যান্ড থেকে নিয়ে এসে চুঁচুড়ায় প্রতিষ্ঠা করেন।রাজা সপ্তম এডওয়ার্ড বা অ্যালবার্ট এডওয়ার্ড ছিলেন ব্রিটেনের রানী ভিক্টোরিয়ার জ্যেষ্ঠ পুত্র।১৯০১এ রানী ভিক্টোরিয়ার মৃত্যুর পর ভারতবর্ষের শাসনভার গ্রহণ করেছিলেন। ১৯১০ সালে নিউমোনিয়া আক্রান্ত হয়ে তাঁর মৃত্যু হয়৷ ১৯১৪ সালে এই সুসজ্জিত স্তম্ভঘড়িটি চুঁচুড়ার চার্চের সামনের চার মাথার মোড়ে প্রতিষ্ঠা করা হয় তাঁর স্মৃতিতে৷ স্তম্ভঘড়িটির চারদিকে রয়েছে চারটি ঘড়ি এবং উপরে রয়েছে একটি ধাতব ঘন্টা।এছাড়া স্তম্ভটির গায়ে একটু নীচে উত্তর মুখে রয়েছে রাজা সপ্তম এডওয়ার্ডের অবয়বের একটি ধাতব পার্শ্বমূর্তি এবং বাকি তিন দিকে রয়েছে তিনটি কারুকার্য খচিত স্মৃতিফলক।সেইসময় এই জায়গার নাম ছিল টাউন গার্ড রোড৷ এখনও খুঁজলে পুরোনো দোকানের ঠিকানা সেই চিহ্নবহন করে৷ ঘড়ির চারপাশের রাস্তা দিতে যাতায়াত করতে করতে কখন যেন নাম হয়ে যায় ঘড়ির মোড় চার মাথার মোড়ে ৩০ ফুট উঁচু এই ঘড়ি দণ্ডায়মান ১৬ স্কোয়ারফুট জায়গা নিয়ে৷ চারদিকে ঘড়ির চারটে ডায়াল। পিতল ও ইস্পাতের তৈরি যন্ত্রাংশ৷ ৩০ মিনিট পর পর ঘড়িতে ঢং ঢং করে ঘন্টা বাজে আর পথ চলতি মানুষ মিলিয়ে নেয় সময়৷ ব্রিটিশ আমলে ঘড়ি মেরামত করত কুক অ্যান্ড কেলভি নামক একটি সংস্থা৷ ১৯৫৪ থেকে কলকাতার বিবি দত্ত কোম্পানি ঘড়ির দেখ ভালের দায়িত্ব পালন করে ১৯৬৩ পর্যন্ত৷এরপর চুঁচুড়ার এম এস হোসেন অ্যান্ড কোম্পানি দায়িত্ব পায় ঘড়ির দেখ ভালের৷ প্রতি চার বছর অন্তর ঘড়ির সার্বিক মেরামতি হয়। আনুমানিক খরচ ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা।প্রাচীন এই ঘড়িতে চারদিন অন্তর দম দিতে হয়।ইতিহাস প্রাচীন এই ঘড়ি এতবছরে মাত্র একবার থেমে গিয়েছিল।২০০৯ সালে আয়লার সময় প্রকৃৃতির ধ্বংসলীলার সম্মুখে তাল রাখতে পারেনি এই ঘড়ি।ইতিহাসের সাক্ষ্য বজায় রেখে ঢং ঢং ঘন্টা বাজিয়ে আজও সময় জানান দেয় ঘড়ি৷।
রানা চক্রবর্তীঃ ‘আলী মর্দানের’ পরবর্তী শাসক ‘হিসামুদ্দীন ইওজ খিলজি’ লখনৌতির তখতে আরোহণ করে ‘গিয়াসুদ্দীন ইওজ শাহ’ নাম নিয়েছিলেন। ইতিপূর্বে ইওজ বরাবরই দিল্লীর প্রতি তাঁর বশ্যতার পরিচয় দিয়েছিলেন। দিল্লীর প্রতি বশ্যতার পরিচয় দিয়েই তিনি ‘মুহম্মদ শিরান খিলজি’র বিরুদ্ধে গিয়েছিলেন, এবং শিরানের বিরুদ্ধে প্রেরিত ‘কাএমাজ রুমী’কে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন। সেসবের জন্য পুরস্কার হিসেবে তাঁকে দিল্লীর অধীনে দেবকোটে লখনৌতি-রাজ্যের শাসনকর্তা নিযুক্ত করা হয়েছিল। এরপরে যখন আলী মর্দান দিল্লীর অনুমোদন পেয়ে বাংলায় ফিরে এসেছিলেন, তখন দিল্লীর প্রতি বশ্যতার কারণেই ইওজ নিজে থেকে এগিয়ে গিয়ে আলী মর্দানকে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন, এবং বিনা বাক্যে তাঁকে লখনৌতি রাজ্যের শাসনভার ছেড়ে দিয়েছিলেন। অথচ আলী মর্দানকে তিনি ভাল করেই চিনতেন, ওরকম দুর্দান্ত ব্যক্তি একটা আস্ত রাজ্যের শাসনভার পেলে কী করবেন, সেটা তিনি বুঝতে পেরেও তখন চুপ করে ছিলেন। ওইভাবে দিল্লীর বশংবদ ইওজের সমর্থনে আলী মর্দান কয়েক বছর ধরে লখনৌতি-রাজ্য শাসন করে সেখানে বিভীষিকার রাজত্ব কায়েম করেছিলেন। অবশেষে খিলজি আমীররা সমবেত হয়ে যখন আলী মর্দানকে হত্যা করে ইওজকে তখতে বসাবার জন্য আহ্বান জানিয়েছিলেন, তখন ইওজ বিনা দ্বিধায় একজন স্বাধীন সুলতান হিসাবে তখতে বসেছিলেন, দিল্লীর প্রতি বশ্যতার কথা তখন আর তাঁর মনে থাকেনি; শুধু সেটাই নয়, তখন থেকেই তিনি দিল্লীর বিরুদ্ধাচরণও করতে শুরু করে দিয়েছিলেন। এর থেকেই বোঝা যায় যে, সেই সময়ের অন্য পাঁচজন আমীরের মত ইওজও একজন উচ্চাভিলাষী ও সুযোগ-সন্ধানী ব্যক্তি ছিলেন, বারবার নিজের ভোল পাল্টাতে তিনি কখনো দ্বিধাবোধ করতেন না। তাঁর চরিত্রের অনেক সদগুণ থাকা সত্ত্বেও এই দিকটার কথা ভুলে গেলে চলবে না। তাঁর সম্বন্ধে ‘তবকৎ-ই-নাসিরী’ গ্রন্থে বলা হয়েছিল, “হুসামুদ্দীন ইওজ সৎ লোক ছিলেন। তিনি ঘোরী-দেশীয় গর্মশিরের খিলজি। কথিত আছে, তিনি একবার ঘোরী সীমান্তের ওয়ালিস্তান নামক জায়গা থেকে – যাকে উচ্চ ভূখণ্ডের দেশ বলা হয়, – সেই পোশ-তাহ-ই-আফরোস যাওয়ার পথে, ভারবাহী গাধা চালিয়ে একটি গ্রামের দিকে যাচ্ছিলেন। সেখানে ছিন্ন পোষাক পরিহিত দু’ জন দরবেশ তাঁর কাছে এসে প্রশ্ন করলেন, ‘তোমার কোন খাদ্য আছে কি?’ ইওজ খলজী জবাব দিলেন, ‘আছে’। তাঁর কাছে পথ-চলবার সময়ে খাওয়ার জন্য রুটি ছিল, সেগুলি তিনি গাধার পিছনে বাঁধা থলি থেকে নিয়ে দরবেশদের সামনে মেলে ধরলেন। তাঁদের ভোজন চলবার সময়ে গাধার পিঠে বাঁধা জল হাতে নিয়ে তাঁদের দেবার জন্য দাঁড়িয়ে রইলেন। দরবেশদের যখন এত তাড়াতাড়ি খাদ্য ও পানীয় দেওয়া হল, তখন তাঁরা নিজেদের মধ্যে বললেন, ‘এই ভাল লোকটি আমাদের সেবা করেছে, তাই সেবার প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়।’ তাঁরা ইওজ খলজীর দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, ‘সর্দার! তুমি হিন্দুস্তানের দিকে যাও। সে দেশে যতদূর ইসলাম বিস্তার লাভ করেছে, ততদূরের দেশ আমরা তোমাকে দিচ্ছি।’ দরবেশদের এই নির্দেশে তিনি সেখান থেকে ফিরে গেলেন এবং গাধার উপরে স্ত্রীকে বসিয়ে তিনি হিন্দুস্তানের পথ ধরলেন। তিনি মুহম্মদ বখতিয়ারের সঙ্গে যোগ দিলেন। তাঁর সৌভাগ্য এতদূর ফলপ্রসূ হযেছিল যে (তখতে আরোহণের পরে) সমগ্র লখনৌতি রাজ্যে তাঁর নামে খুৎবা পাঠ করা হয়, এবং মুদ্রায় তাঁর নাম অঙ্কিত করা হয়। তাঁকে ‘সুলতান গিযাসুদ্দীন’ উপাধি দেওয়া হয়। তিনি লখনৌতি নগরকে তাঁর শাসন পরিচালনার কেন্দ্র করলেন (দেবকোট থেকে রাজধানী সরিয়ে নিয়ে গিয়ে) এবং বসনকোট দুর্গ তৈরী করলেন। চারদিক থেকে জনসাধারণ তাঁর কাছে আসতে লাগল, কারণ তিনি ছিলেন ভাল স্বভাবের লোক, সচ্চরিত্র ও পরিচ্ছন্ন অভ্যাসের অধিকারী। তিনি মুক্তহস্ত, ন্যায়নিষ্ঠ ও দাতা ছিলেন। তাঁর রাজত্বকালে সৈন্যেরা ও জনসাধারণ, স্বস্তি ও আরামের সঙ্গে বাস করত। তাঁর অধীনস্থ সব আমীর তাঁর উপহার দানে খুবই কতার্থ হয়েছিলেন এবং প্রভূত ধন লাভ করেছিলেন। তিনি দেশের মধ্যে তাঁর সদাশয়তার অনেক স্মৃতিচিহ্ন রেখে গেছেন। তিনি বহু মসজিদ ও খানকাহও নির্মাণ করিয়েছেন। বিশিষ্ট আলিম এবং শেখ ও সৈয়দদের জন্য তিনি বৃত্তির বন্দোবস্ত করে দিতেন। অন্যান্য শ্রেণীর লোকদেরও তিনি ধন-সম্পত্তি দান করতেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, জামালুদ্দীন গজনবীর পুত্র – যিনি জলালুদ্দীন নামে অভিহিত হতেন – তিনি ছিলেন ফিরোজকোহর ইমামজাদা। তিনি ৬০৮ সনে (হিজরায়) অনুচরবর্গ সমেত হিন্দুস্তানে আসেন ও কয়েক বছর পরে তিনি প্রভূত ধন সমেত ফিরোজকোহতে ফেরেন। কীভাবে তিনি ঐ সম্পদ লাভ করলেন তা জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন যে, হিন্দুস্তানে পৌঁছে তিনি দিল্লী যাত্রা করেন এবং সেখান থেকে তিনি লখনৌতি যাত্রা করেন। সেখানে গিয়াসুদ্দীনের দরবাবে একটি ধর্মীয় উপদেশের উল্লেখ করা হয়। সেই সচ্চরিত্র সুলতান তাঁর কোষাগার থেকে স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রায় পূর্ণ একটি বড় পাত্র তাঁকে দান করেন, যার মূল্য দশ হাজার রৌপ্য তঙ্কার (টাকার) মত। তিনি তাঁর অধীনস্থ মালিক, আমীর ও দরবারের সম্ভ্রান্ত লোকদের কিছু দান করতে আদেশ দেন; তদনুসারে প্রত্যেকে তাঁকে কিছু দান করেন যার পরিমাণ তিন হাজার টাকার মত, তাঁর বিদায়ের সময়ে, আগে তিনি যা পেয়েছিলেন, তার সঙ্গে আরও পাঁচ হাজার টাকা যোগ করা হল; এর ফলে ইমামজাদা লখনৌতিক রাজা গিযাসুদ্দীন খিলজির দয়ায় আঠারো হাজার তঙ্কা পেলেন। … এই বইয়ের লেখক (মীনহাজুদ্দিন) যখন ৬৪১ হিজরায় লখনৌতিতে পৌঁছান, তখন লখনৌতি রাজ্যের চারদিকে এই রাজার সৎকার্য দেখেন। গঙ্গার দুই দিকে লখনৌতি রাজোর দু’টি অংশ আছে; পশ্চিম দিকের অংশটিকে ‘রাল’ (রাঢ়) বলা হয়, লখনোর নগর এই দিকে অবস্থিত, পূর্ব দিকটিকে ‘বরিন্দ’ (‘বরেন্দ্র’) বলা হয়, দেওকোট (দেবকোট/দেবীকোট) নগর ঐ দিকে অবস্থিত। লখনৌতি থেকে লখনোরের ফটক পর্যন্ত এবং অন্যান্য অঞ্চল থেকে দেওকোট নগর পর্যন্ত উঁচু বাস্তা বানানো হয়েছিল, এবং এগুলি দৈর্ঘ্যে দশ দিনের যাত্রাপথের মত করা হযেছিল। এর কারণ এই যে, বর্ষার সমযে সমগ্র দেশ প্লাবিত হত এবং যদি উঁচু রাস্তা না থাকত, তবে মানুষদের বিভিন্ন অঞ্চলে ও স্থানে নৌকায় করে যেতে হত। তাঁর রাজত্বকালে এই রাস্তাগুলির দরুন সব লোকের চলাচলের উপায হয়। … এও বলা হয় যে, মালিক নাসিরুদ্দীন মাহমুদের মৃত্যুর পরে যখন সুলতান সৈয়দ শামসুদ্দীন (ইলতুৎমিশ) ইখতিয়ারুদ্দীনের বিদ্রোহ দমন করতে লখনৌতিতে আসেন, তখন তিনি গিয়াসুদ্দীনের সংকার্যসমূহ দেখেছিলেন। পরে যখনই তিনি গিয়াসুদ্দীনের নাম উচ্চারণ করতেন তখনই তাঁকে তিনি ‘সুলতান গিয়াসুদ্দীন ইওজ শাহ’ বলতেন, এবং এই কথা বলেছিলেন যে এত কল্যাণসাধক ব্যক্তিকে ‘সুলতান’ উপাধিতে বিভূষিত করতে কোন ব্যক্তির দ্বিধা হওয়া উচিত নয। প্রকৃতপক্ষে, তিনি ছিলেন কল্যাণকামী, দাতা, ন্যায়নিষ্ঠ এবং সৎ লোক। … লখনৌতির পার্শ্ববর্তী সমস্ত রাজ্য, যথা জাজনগর, বঙ্গ (পূর্ববঙ্গ) প্রদেশ, কামরূদ (কামরূপ) ও ত্রিহুত তাঁর কাছে উপঢৌকন পাঠাতো। (বলে রাখা দরকার যে, এই কথার যাথার্থে সংশয়ের অবকাশ রয়েছে। কারণ, জাজনগর প্রভৃতি দেশ তখন মুসলমানদের অধীন ছিল না, পক্ষান্তরে ওই সব দেশের সঙ্গে ইওজ শাহের শত্রুতার সম্পর্ক ছিল। তিনি জাজনগর রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন এবং বঙ্গ ও কামরূপ রাজ্য জয় করাব জন্য ব্যর্থ চেষ্টা করেছিলেন। উড়িষ্যার রাজা অনঙ্গভীমের (১২১১-১২৩৮ খৃষ্টাব্দ) একটি শিলালিপিতে বলা হয়েছিল যে, অনঙ্গভীমের মন্ত্রী ও সেনাপতি বিষ্ণু ‘যবনাবনীন্দু’র সঙ্গে যুদ্ধে অবর্ণনীয় বীরত্বের প্রদর্শন করেছিলেন। সেই ‘যবনাবনীন্দু’ নিঃসন্দেহে গিয়াসুদ্দীন ইওজ শাহ ছিলেন, যিনি লখনোর জয় করেছিলেন।) লখনোর জেলা সম্পূর্ণভাবে তাঁর অধিকারভুক্ত হয়েছিল। (এখান থেকে) প্রভূত পরিমাণে হাতী, রাজস্ব ও ধনসম্পদ তাঁর হস্তগত হয় এবং এখানে তিনি তাঁর আমীরদের অধিষ্ঠিত করেছিলেন। … সুলতান শামসুদ্দীন (ইলতুৎমিশ) কয়েকবার দিল্লী থেকে লখনৌতিতে সৈন্যবাহিনী পাঠান এবং বিহার জয় করে সেখানে তাঁর আমীরদের নিযুক্ত রাখেন। ৬২২ হিজরায় তিনি লখনৌতি আক্রমণ করলেন। তখন গিয়াসুদ্দীন তাঁর নৌকাগুলি উঠিয়ে নিলেন (এর থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, গিয়াসুদ্দীন তাঁর একটি নিজস্ব এক নৌবহর গঠন করেছিলেন) এবং তাঁদের মধ্যে শাস্তি স্থাপিত হল। তিনি ইলতুৎমিশকে আটত্রিশটি হাতী এবং ৮০ লাখ তঙ্কা মূল্যের ধনবত্ব প্রদান করেন। তিনি সুলতানের নামে খুৎবা পাঠের প্রচলন করেন। (এই উক্তির সত্যতা সম্বন্ধে আরও প্রমাণ হল যে, ঐতিহাসিকেরা ৬২২ হিজরায় উৎকীর্ণ কিছু মুদ্রা পেয়েছিলেন, যেগুলোতে শামসুদ্দীন ইলতুৎমিশ ও গিয়াসুদ্দীন ইওজ – দু’জনেবই নাম ছিল (JNSI, 1979, p: 42-62)। বিদায়ের সময়ে সুলতান মালিক আলাউদ্দীন জানীকে বিহার দেন। গিয়াসুদ্দীন ইওজ লখনৌতি থেকে বিহারে এসে তা অধিকার করলেন এবং অন্যায় কাজ করতে লাগলেন। (বোঝা যায় যে, গিয়াসুদ্দীন ইওজও অন্যায় কাজ করতে জানতেন।) … ৬২৪ হিজরায় সুলতান শামসুদ্দীনের পুত্র মালিক শহীদ নাসিরুদ্দীন এক হিন্দুস্তানী সৈন্যবাহিনী সংগ্রহ কবে মালিক জানীকে সঙ্গে নিয়ে, অযোধ্যা থেকে লখনৌতির দিকে অগ্রসর হলেন। সেই সময়ে গিযাসুদ্দীন ইওজ হোসেন খিলজি বঙ্গ (নৌবহর গঠন করার ফলেই তাঁর পূর্ববঙ্গ অভিযানে যাওয়া সম্ভব হয়েছিল) ও কামরূদ (কামরূপ) অভিযানে গিয়েছিলেন এবং লখনৌতি রক্ষক-বর্জিত অবস্থায় রেখেছিলেন। (এর থেকে মনে হয় গিয়াসুদ্দীন ইওজের বাস্তব বুদ্ধির অভাব ছিল; কারণ, তাঁর পিছনে ইলতুৎমিশের মত প্রবল একজন শত্রু থাকা সত্ত্বেও রাজধানী লখনৌতি অরক্ষিত অবস্থায় রেখে যাওয়াটা তাঁর কখনোই উচিত হয় নি)। মালিক নাসিরুদ্দীন লখনৌতি অধিকার করলেন। এই বিপদের ফলে গিয়াসুদ্দীন ফিরে এসে মালিক নাসিরুদ্দীন মাহমুদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হলেন। কিন্তু, তাঁকে ও তাঁর সমস্ত আমীরকে বন্দী করা হল। বারো বছর রাজত্বের পরে তিনি নিহত হলেন।”
বাংলার প্রথম জনহিতৈষী সুলতান
উপরোক্ত বিবরণ থেকে গিয়াসুদ্দীন ইওজ শাহের স্বভাব এবং রাজত্বের ঘটনাবলী সম্বন্ধে পরিষ্কার কিছু তথ্য পাওয়া যায়। মীনহাজ অন্যত্র লিখেছিলেন, “গিয়াসুদ্দীন তাঁর সমস্ত আত্মীয়স্বজন, খলজী আমীর, সমস্ত অর্থভাণ্ডার ও হাতীর পাল সমেত তাঁর (নাসিরুদ্দীনের) হাতে ধরা পড়েন। গিয়াসুদ্দীনকে তিনি হত্যা করলেন এবং তাঁর ধনসম্পদ বাজেয়াপ্ত করলেন।” ঐতিহাসিকেরা গিয়াসুদ্দীন ইওজ শাহের অনেক মুদ্রা পেয়েছিলেন। তবে সেই মুদ্রাগুলিতে টাঁকশালের কোন নাম ছিল না, কিন্তু সেগুলোর মধ্যে – ৬১৬, ৬১৭, ৬১৯, ৬২০, ৬২১ – প্রভৃতি হিজরার বছর, এবং ‘১৯শে সফর ৬১৬, রবি-উস-সানী ৬১৭, ৬১৯, ৬২০; ২০শে রবি-উস-সানী ও জমাদি-উস-সানী ৬২১’ প্রভৃতি তারিখের উল্লেখ পাওয়া গিয়েছিল। ওই মুদ্রাগুলিতে দেখা গিয়েছিল যে, গিয়াসুদ্দীন সেগুলিতে নিজের অনেক উপাধি উৎকীর্ণ করিয়েছিলেন। সেই উপাধিগুলি তাঁর রাজকীয় মর্যাদার পরিচায়ক ছিল। সেগুলোর মধ্যে দু’টি উপাধি ঐতিহাসিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ – ‘নাসির আমীর উল-মোমেনীন’ ও ‘কসীম আমীর-উল-মোমেনীন’। এই দুই উপাধি দ্বারা গিয়াসুদ্দীন নিজেকে ‘আব্বাসী খলিফা’র সাহায্যকারী বলে ঘোষণা করেছিলেন। এর থেকে ‘এডওয়ার্ড টমাস’ প্রভৃতি পাশ্চাত্য গবেষকেরা সিদ্ধান্ত করেছিলেন যে, ইওজ শাহ আব্বাসী খলিফা ‘আল-নাসিরের’ কাছ থেকে সনদ পেয়েছিলেন। কিন্তু গবেষক ‘ডঃ আহমদ হাসান দানী’ এবং তাঁর অনুবর্তী গবেষক ‘ডঃ আবদুল করিম’ পরবর্তীকালে দেখিয়ে দিয়েছিলেন যে, ইওজ শাহ আদৌ সেরকম কোন সনদ কখনো পান নি। (বাংলার ইতিহাসে সুলতানি আমল, ডঃ আবদুল করিম, পৃ: ১০০-১০২) এই প্রসঙ্গে ডঃ করিম লিখেছিলেন, “এই বিষয়ে ডঃ আই. এইচ. কোরেণীর মত প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন যে, মুসলিম সাম্রাজ্য চারিদিকে বিস্তৃতি লাভ করিবার পর অনেক এলাকার স্বাধীন মুসলমান শাসক নিজেদের শাসন আইনানুগ করার উদ্দেশ্যে আব্বাসী খলিফার অনুমতি ছাড়াই তাঁহাদের নাম ব্যবহার করিতেন।” তাই মনে হয় যে, গিয়াসুদ্দীন ইওজ খিলজিও সেটাই করেছিলেন; এমনকি ইলতুৎমিশও প্রথম দিকে সেটাই করেছিলেন, যদিও পরবর্তী সময়ে তিনি সত্যিই খলিফার সনদ আনিয়েছিলেন। গিয়াসুদ্দীন ইওজ শাহের মুদ্রা সম্পর্কে ডঃ আবদুল করিম আরো লিখেছিলেন, “কোন কোন মুদ্রায় তিনি ওলী আহাদ বা যুবরাজ আলা-উল-হক্ক-ওয়াদ-দীন (সংক্ষেপে অ লা-উদ-দীন) এর নামও উল্লেখ করিয়াছেন।” (বাংলার ইতিহাসে সুলতানি আমল, ডঃ আবদুল করিম, পৃ- ১০০) গিয়াসুদ্দীনের কোন কোন মুদ্রায় জনৈক ‘মুইজ-উদ-দুনিয়া ওয়াদ-দীন আবুল মুজাফ্ফর’-এর উল্লেখ পাওয়া যায়; টমাস ভুলভাবে সেইসব মুদ্রার পাঠোদ্ধার করেছিলেন, এবং সেগুলোর থেকে সিদ্ধান্ত করেছিলেন যে, আব্বাসী খলিফা ইওজ শাহকে প্রত্যক্ষভাবে হস্তক্ষেপ করে সুলতান পদে নিযুক্ত করেছিলেন। কিন্তু সে সম্বন্ধে ডঃ আবদুল করিম লিখেছিলেন, “উপরোক্ত অর্থ করিলে মুদ্রার সম্পূর্ণ বাক্যটির কোন অর্থই হয় না। হোয়ের্নল এবং রাইটের পাঠ মানিয়া লইলে সম্পূর্ণ বাক্যটির অর্থ হয়। অর্থ নিম্নরূপ – ‘গিয়াস-উদ-দুনিয়া ওয়াদ দীন যিনি কদীম আমীর-উল মোমেনীন, সুলতান- উস-সলাতীন এবং নাসির আমীর-উল-মোমেনীন ছিলেন, তিনি মুঈজ-উদ-দুনিয়া ওয়াদ-দীন আবুল মুজফ্ফরকে নিযুক্ত করেন।’ … অন্য কোন সূত্রে মুইজ-উদ-দীনের নামও পাওয়া যায় না। হয়ত যুববাজ আলা-উল-হক্কের অকাল মৃত্যু হয় এবং সেই জন্য পরবর্তী মুদ্রায় ইওজ খলজী অন্য একজন যুবরাজ মুইজ-উদ-দীনের নাম অঙ্কিত করিয়াছেন।” (বাংলার ইতিহাসে সুলতানি আমল, ডঃ আবদুল করিম, পৃ- ১০৫) কিন্তু ডঃ করিমের ব্যাখ্যাও সম্পূর্ণ সঠিক নয়; কারণ, মুদ্রাটিতে ‘আলায়দ’ শব্দটি রয়েছে ধরে নিয়ে সেটির বঙ্গানুবাদ – “নিযুক্ত করেন” – করা হয়েছিল। কিন্তু ‘ডঃ জেড. এইচ. দেশাই দেখিয়ে দিয়েছিলেন যে, ‘আলায়দ’ আসলে ভ্রান্ত পাঠ, প্রকৃত পাঠ হওয়া উচিত ছিল ‘আলী শের’। (Epigraphia Indica, Arabic & Persian Supplement, 1975, p- II) যাই হোক, ‘মুইজুদ্দীন’ যে গিয়াসুদ্দীন ইওজ শাহের পুত্র ছিলেন, সেটা পরবর্তীকালে আবিষ্কৃত হয়েছিল। অতীতে ঐতিহাসিকেরা বীরভূম জেলার ‘সিয়ান’ গ্রামে (বোলপুর থেকে ৪ মাইল দূরে অবস্থিত) ‘মখদুম শাহের দরগা’ নামে পরিচিত একটি দরগায় একটি খণ্ডিত শিলালিপি পেয়েছিলেন। অতীতে অনেকেরই ধারণা ছিল যে, উক্ত মখদুম শাহ ছিলেন ‘শেখ জলালুদ্দীন তব্রিজী’। কিন্তু তাঁদের সেই মতের স্বপক্ষে সামান্যতম কোন প্রমাণ পাওয়া যায় নি। উক্ত শিলালিপিটি পাল রাজাদের (নয়পাল বা তৃতীয় বিগ্রহপালের রাজত্বকালের) আমলের একটি শিলালিপির উল্টোপিঠে উৎকীর্ণ করা হয়েছিল। (ডঃ দীনেশচন্দ্র সরকার সেই শিলালিপিটির পাঠোদ্ধার করেছিলেন, এবং নানা জায়গায় সে সম্বন্ধে আলোচনা করেছিলেন।) ‘ডঃ জেড. এইচ. দেশাই সেটির যে পাঠোদ্ধার করেছিলেন (Epigraphia Indica, Arabic & Persian Supplement, 1975, p: 7-8) তা নিম্নরূপ –
“(1) In the name of Allah, the Beneficent, the Merciful (In houses which Allah has permitted to be exalted and that) His name may be remembered in them; there glorify Him therein in the mornings and evenings,
(2) men whom neither merchandise nor selling diverts from the remembrance (of Allah and the keeping up of prayer and the giving of poor-rate, they fear a day in which shall turn about,
(3) ‘the hearts and the eyes’ (Saying quoted) from the Messenger of Allah, may Allah’s (peace and salutations be upon him in) the sahlh ‘Men are in their prayer-houses (mosques) and Allah is (looking) after their needs.’
(4) this Khanqah was (built and donated by the humble creature (al-Faqir), the sinful, the one who l opes (for the mercy of his Nourisher,) son of Muhammad al-Marāghi., (i.e by origin, of Maragha), for the benchers (Ahl-i Suffa i. e. ascetics, sufis) who all the while abide in the presence.
(5) of the Exalted Allah and occupy themselves in the remembrance of the Exalted Allah in the (time of the government? of the Shelter?) of Islam and the Muslims, Chief among the monarchs and the Sultāns one who is specially favoured.
(6) by the lordship of the Time in the Worlds, ‘Ali Shir son of ‘Iwad, Burhanu Amiri’l-Mu’minin lit. Proof of the Commander of the Faithful), on the seventh day of (the month of Jumādā II, year (A. H.) eighteen and six hundred (7 Jumādā II 618-29 July 1221).”
ঐতিহাসিকদের কাছে উক্ত শিলালিপিটি আজও বিশেষ মূল্যবান। কারণ, প্রথমতঃ, বাংলার মুসলমান আমলের এটিই প্রথম শিলালিপি – ১২২১ খৃষ্টাব্দে অর্থাৎ বখতিয়ারের নদীয়া জয়ের মাত্র ১৭ বছর পরে এই শিলালিপি উৎকীর্ণ করা হয়েছিল। দ্বিতীয়তঃ, অত আগে বীরভূমের অভ্যন্তর প্রদেশে অজয় নদের অনতিদূরে মুসলিম রাজত্ব যে বিস্তৃত হয়েছিল, সেটাও একটা চমকপ্রদ খবর; কিন্তু ওরকম হওয়া খুবই স্বাভাবিক ছিল, কারণ ‘সিয়ান’ নদীয়া ও লখনোরের প্রায় মাঝখানে অবস্থিত ছিল। তৃতীয়তঃ, শিলালিপিটিতে একটি খানকাহ, বা সুফী দরবেশদের ধর্মশালা প্রতিষ্ঠার উল্লেখ পাওয়া যায়; খানকাহ, প্রতিষ্ঠা সংক্রান্ত শিলালিপি ভারত উপমহাদেশে ঐতিহাসিকেরা খুব কমই পেয়েছেন; মীনহাজের ‘তাকাৎ-ই-নাসিরী’তে বখতিয়ারের খানকাহ স্থাপনের উল্লেখ রয়েছে, ইওজ শাহের রাজত্বকালেও যে সেই প্রথা চলেছিল, সেটার পাথুরে প্রমাণ ওই শিলালিপি থেকে পাওয়া যায়। চতুর্থতঃ, ইওজ শাহের পূর্বোক্ত মুদ্রায় (৬২১ হিজরায়) যে মুইজুদ্দীনের উল্লেখ পাওয়া যায়, তিনি এবং উক্ত শিলালিপিতে উল্লিখিত আলী শের অভিন্ন লোক ছিলেন। এই প্রসঙ্গে ডঃ জেড. এইচ. দেশাই লিখেছিলেন, “… the coin stated to have been minted in A. H. 621 and published by Hoernle, is assigned to him. But the legend on the reverse has (1) Ghiyathu, d-Dunya wa’d-Din (2) Abu’l- Fath ‘Iwad bin Husain (3) Qasimu Amiri ‘l-Mu’minin Sultan (4) u’s-Salātin Mu’izzu’d-Dunya wa’d-Din (5) Abul-Muzaffar ‘Ali Shir Iwad (6) Burhānu (?) Amiri I – Muminin.” ডঃ দেশাইও লিখেছিলেন, “Ali Shir mentioned in our record (শিলালিপি) as the son of ‘Iwad is identical with him (মুইজুদ্দীন) and the ‘Iwad of the record is none other than Ghiyath’ud-D.n ‘Iwad.” ডঃ দেশাই-এর মতে উক্ত মুইজুদ্দীন আলী শের ১২২১ খৃষ্টাব্দে স্বাধীনভাবে রাজত্ব করছিলেন; তাঁর যুক্তি ছিল যে, শিলালিপিটিতে আলী শেরের সে সব উপাধি দেখা যায়, সেগুলি “are used in inscriptions, coins and historical works only for monarchs and rulers.” আধুনিক সময়ের ঐতিহাসিকেরা তাঁর মতের সঙ্গে সহমত হতে পারেন নি। কারণ, ১২২১ খৃষ্টাব্দের কয়েক দশক পরে শামসুদ্দীন ফিরোজ শাহের ছেলেরা, তাঁদের পিতার অধীনস্থ শাসনকর্তা হিসাবেই পূর্ণ রাজকীয় উপাধি নিয়ে মুদ্রা জারী করেছিলেন। এক্ষেত্রেও অনুরূপ ব্যাপার হয়েছিল বলে ডঃ দেশাই এ কথাও বিশ্বাস করতে রাজী ছিলেন যে, গিয়াসুদ্দীন ইওজ শাহের রাজত্ব ৬১৭ হিজরায় শেষ হয়েছিল, কারণ পরবর্তী কালে লেখা একটি সূত্রে সেই তারিখই উল্লেখ করা হয়েছিল। কিন্তু ‘তবকাৎ ই-নাসিরী’র সব পুঁথিতেই দেখা যায় যে, ৬২৪ হিজরায় ইওজ শাহ নাসিরুদ্দীন মাহমুদ শাহের হাতে পরাজিত ও নিহত হয়েছিলেন; এরপরে নাসিরুদ্দীন দেড় বছর ধরে লখনৌতি-রাজ্য শাসন করেছিলেন, এবং ৬২৬ হিজরার জমাদী অল-আউয়ল মাসে ইলতুৎমিশের কাছে তাঁর মৃত্যু-সংবাদ পৌঁছেছিল; ৬১৭ হিজরায় ইওজ নাসিরুদ্দীনের হাতে নিহত হয়েছিলেন বললে ‘তবকাত-ই-নাসিরী’র আভ্যন্তরীণ সাক্ষ্যের সঙ্গেই বিরোধ দেখা দেয়। ডঃ দেশাই মনে করতেন, “the statements of the later authorities which must have been based on good copies of the earlier authorities including the Tabaqāt-i-Nasiri cannot be brushed aside easily or summarily.” কিন্তু সে রকম কোন ‘good copy’ না দেখা পর্যন্ত ‘তবকাৎ-ই-নাসিরী’র বর্তমান পুঁথিগুলির সাক্ষ্যকে উপেক্ষা করা যেতে পারে না। মোটের উপরে এক্ষেত্রে সেই ‘Later authority’-র সাক্ষ্য একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। গিয়াসুদ্দীন ইওজ শাহের ৬১৭ হিজরার পরবর্তী তারিখের অনেক মুদ্রাও ঐতিহাসিকেরা পেয়েছিলেন। সুতরাং মুইজুদ্দীন বা আলী শের ১২২১ খৃষ্টাব্দে তাঁর পিতা গিয়াসুদ্দীন ইওজ শাহের অধীনস্থ শাসনকর্তা হিসাবে সিয়ান ও তার আশপাশের অঞ্চলগুলি শাসন করতেন বলে সিদ্ধান্ত করা যেতে পারে। কারণ, ৬২১ হিজরায় উৎকীর্ণ গিয়াসুদ্দীন ইওজ শাহের যে মুদ্রাটিতে ডঃ দেশাই আলী শেরের নাম লেখা আছে বলে দেখিয়েছিলেন, সেটিতে ইজ শাহ ও আলী শের – দু’জনেরই নাম রাজকীয় উপাধি সমেত উল্লেখ করা হয়েছিল। অথচ কেবল গিয়াসুদ্দীনকেই ‘সুলতান’ বলা হয়েছিল। অতএব পিতার জীবদ্দশাতেই যে আলী শের রাজকীয় উপাধি ব্যবহারের অধিকার পেয়েছিলেন, সেটা প্রমাণিত হয়। ১২২১ খৃষ্টাব্দে বীরভূম অঞ্চলের শাসনকর্তা হিসাবে আলী শেরকে পাওয়া যায়; সম্ভবতঃ তাঁর কর্মকেন্দ্র লখনোরে ছিল।
মীনহাজ-ই-সিরাজের লেখা থেকে বোঝা যায় যে, মুহম্মদ শিরান বখতিয়ার কর্তৃক লখনোর জয়ের জন্য প্রেরিত হয়েছিলেন, কিন্তু বখতিয়ারের মৃত্যুর জন্য সেই জয় তিনি করতে পারেন নি। ইওজ শাহ প্রথমে লখনোর অধিকার করেছিলেন; সেই অধিকারের পরেই সম্ভবতঃ নিজের পুত্র আলী শেরের উপরে তিনি লখনোরের শাসনভার দিয়েছিলেন, এবং তাঁকে পূর্ণ রাজকীয় মর্যাদার অনুরূপ উপাধি ব্যবহারেরও অনুমতি দিয়েছিলেন। গিয়াসুদ্দীন ইওজ শাহ যে একজন যোগ্য শাসক ছিলেন, সে বিষয়ে ঐতিহাসিকদের কোন সন্দেহ নেই। অবশ্য তাঁর চরিত্রে দোষও ছিল। আগেই বলা হয়েছে যে, গোড়ার দিকে তিনি নির্লজ্জ সুবিধাবাদের পরিচয় দিয়েছিলেন, এবং শেষ দিকে তিনি উপযুক্ত বুদ্ধির পরিচয় দিতে পারেন নি। কিন্তু তাঁব নাম এই কারণে ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে যে, তিনিই বাংলার ‘প্রথম জনহিতৈষী মুসলমান সুলতান’ ছিলেন। ইতিপূর্বে বখতিয়ার খলজী তাঁর নিজের সম্প্রদাযের লোকেদের জন্য কিছু কিছু হিতকর কাজ করেছিলেন, কিন্তু অসাম্প্রদাযিক জনহিতকর কাজ বোধ হয় ইওজ শাহই প্রথম করেছিলেন। দেবকোট থেকে লখনোর অবধি বাস্তা তৈরী করা তাঁর অক্ষয় কীর্তি।
(তথ্যসূত্র:
১- Tabakat-i-Nasiri, Minhaj-us-Siraj, English translation by H.M. Elliot.
২- Tabaqat-i-Nasiri, Minhaj-us Siraj, Raverty’s Translation.
৩- বাংলার ইতিহাসে সুলতানি আমল, ডঃ আবদুল করিম।
৪- Journal of the Numismatic Society of India, ১৯৭৩।
৫- Social History of the Muslims of India, D. Abdul Karim.
৬- Epigraphia Indica, Arabic & Persian Supplement, 1975.)
বাংলাহান্ট ডিজিটালঃ মোট ২১টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে তাঁর লেখা বই, যার মধ্যে রয়েছে ১৩টি বিদেশি ভাষা। ফ্রান্স, জার্মানি এবং জাপানে রয়েছেন তাঁর বইয়ের পাঠক-পাঠিকা। সারা দেশে বিভিন্ন সাহিত্য উৎসবে তিনি আমন্ত্রিত হন তাঁর লেখা পাঠের জন্য।
এক দুঃস্বপ্নময় শৈশব কেটেছে তাঁর। কাজ করেছেন পরিচারিকা হিসেবে। সত্যি বলতে কী, এখনও পেশাগত পরিচয়ে তিনি একজন পরিচারিকাই। কিন্তু এটাই তাঁর একমাত্র পরিচয় নয়। তিনি একজন স্বনামধন্য লেখিকা। নিজের বই নিয়ে তিনি হাজির হয়েছেন প্যারিস, ফ্রাঙ্কফুর্ট বা হংকং-এর মতো শহরে। মোট ২১টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে তাঁর লেখা বই, যার মধ্যে রয়েছে ১৩টি বিদেশি ভাষা। ফ্রান্স, জার্মানি এবং জাপানে রয়েছেন তাঁর বইয়ের পাঠক-পাঠিকা। সারা দেশে বিভিন্ন সাহিত্য উৎসবে তিনি আমন্ত্রিত হন তাঁর লেখা পাঠের জন্য। তিনি বেবি হালদার।
বর্তমানে ৪১ বছর বয়সি বেবির জন্ম হয় কাশ্মীরে। বাবা পেশায় ছিলেন গাড়ি চালক, মদের নেশায় চুর হয়ে থাকা ছিল তাঁর স্বভাব। এই মদ্যপানের অভ্যাসের কারণেই বেবির মা স্বামী ও সন্তানকে ছেড়ে চলে যান। বেবির বয়স তখন মাত্র ৪ বছর। দ্বিতীয় বিয়ে করেন বেবির বাবা। বেবিকে নিয়ে তাঁরা চলে আসেন মুর্শিদাবাদে, তারপর বসত গড়েন দুর্গাপুরে। মদ্যপ বাবা ও সৎ মায়ের হাতে ছোটবেলায় অনেক নির্যাতন সয়েছেন বেবি। মেয়ের বয়স যখন ১২, তখনই এক ২৬ বছর বয়সি পুরুষের সঙ্গে বেবির বিয়ে দিয়ে দেন বেবির বাবা। বিয়ের রাত্রেই স্বামীর হাতে ধর্ষিতা হন কিশোরী বেবি। ১৩ বছর বয়সে বেবির প্রথম সন্তানের জন্ম হয়। পরবর্তী কয়েক বছরের মধ্যে আরও দু’টি সন্তানের জন্ম দেন বেবি।
স্বামীগৃহে নিয়মিত মারধর ও যৌন নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে ২৫ বছর বয়সে তিন সন্তানকে নিয়ে বেবি চড়ে বসেন দিল্লির ট্রেনে। কিন্তু দিল্লিতে নিজের পেট চালানো সহজ ছিল না। বাধ্য হয়ে পরিচারিকার কাজ নেন তিনি। কিন্তু সেখানেও জোটে অসম্মান। যাঁর বাড়িতে কাজ করতেন তাঁর কাছ থেকে আসতে থাকে অশালীন প্রস্তাব। কাজ ছেড়ে দেন বেবি। নতুন কাজ নেন গুরগাঁও নিবাসী প্রবোধ কুমারের বাড়িতে। এর পরেই নতুন বাঁক নেয় বেবির জীবন।
প্রবোধ কুমার শুধু প্রখ্যাত হিন্দি সাহিত্যিক মুন্সি প্রেমচাঁদের নাতি নন, তিনি নিজেও একজন সাহিত্যরসজ্ঞ। তিনি লক্ষ্য করেছিলেন, মাঝেমধ্যেই নিজের কাজ থামিয়ে কৌতূহলী দৃষ্টিতে বেবি তাকিয়ে থাকেন প্রবোধের বইয়ের আলমারিগুলির দিকে। প্রবোধ বুঝতে পারেন, বইয়ের প্রতি টান রয়েছে বেবির। প্রবোধের আলমারিতে বাংলা বইয়ের সংখ্যাও নেহাৎ কম ছিল না। প্রবোধ সেই বইগুলি একটি একটি করে তুলে দিতে থাকেন বেবির হাতে। বেবি আগ্রহভরে পড়ে ফেলতে শুরু করেন প্রতিটি বই। স্কুলে ক্লাস সেভেন পর্যন্ত পড়াশোনা করা বেবিকে আরও ভাল করে লেখাপড়াও শেখান প্রবোধ।
কিন্তু প্রবোধের মনে হয়েছিল, বেবির মধ্যে সুপ্ত রয়েছে এক লেখিকা সত্তা। সেই সত্তাকে উদ্বোধিত করতে চেয়েই একদিন বেবির হাতে খাতা-কলম তুলে দেন প্রবোধ। বলেন, নিজের কাহিনি লিপিবদ্ধ করতে। লেখার কথায় প্রথমটা একটু ঘাবড়েই গিয়েছিলেন বেবি। কিন্তু তারপর তসলিমা নাসরিন, আনা ফ্রাঙ্ক, ঝুম্পা লাহিড়ির লেখার ভক্ত বেবির মনে হয়, তাঁর লেখাই হয়ে উঠতে পারে তাঁর ভিতরে জমে থাকা যন্ত্রণা প্রকাশের মাধ্যম। ২০০২ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর আত্মজীবনীর প্রথম খণ্ড ‘আলো আঁধারি’। ২০০৬ সালে প্রবোধের উদ্যোগে সেই বইয়ের ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ পায় ‘আ লাইফ লেস অর্ডিনারি: আ মেমোয়ার’ নামে। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে সাড়া ফেলে দেয় বইটি। কয়েক বছর পরে প্রকাশিত হয় বেবির আত্মকাহিনির পরবর্তী খণ্ড— ‘ঈষৎ রূপান্তর’। বই দু’টি লেখিকা হিসেবে প্রতিষ্ঠা দেয় বেবিকে।
আজ বেবি স্বনামধন্য লেখিকা। তাঁর আত্মকাহিনি প্রশংসা কুড়িয়েছে বহু পাঠক ও সমালোচকের। কিন্তু এখনও প্রবোধের বাড়িতে পরিচারিকার কাজই করেন বেবি। তাঁর বক্তব্য, ‘প্রবোধবাবু আমার নিজের বাবার মতোই। তাঁর বাড়িতে কাজ করতে আমার ভালো লাগে। তাঁকে ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা আমি ভাবতেই পারি না।’ শুধু তাই নয়, বেবিকে কেউ ‘লেখিকা’ বললে তিনি বরং বিব্রতই বোধ করেন। বেবি বলেন, ‘আমি সামান্য পরিচারিকা মাত্র’।
সে তিনি যা-ই বলুন, পাঠক তাঁকে চেনে এক অসামান্য আত্মকাহিনির লেখিকা হিসেবেই। নিজের প্রথম জীবনে অজস্র যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছে তাঁকে। কিন্তু এখন পাঠক আর সমালোচকদের ভালবাসা আর শ্রদ্ধায় পরিপূর্ণ তাঁর বেঁচে থাকা। নিজের জীবনকে কীভাবে সৎ প্রচেষ্টার মাধ্যমে দুর্ভাগ্যের অন্ধকার থেকে আলোর দিকে নিয়ে যাওয়া যায়, তারই এক জীবন্ত দৃষ্টান্ত বেবি হালদার। সেই সঙ্গে বহু মানুষের অনুপ্রেরণাও তিনি। কুর্নিশ তাঁকে।
পলাশীর প্রান্তরে পলাশী যুদ্ধ ১৭৫৭ সালের ২৩ শে জুন নবাব সিরাজউদ্দৌলা ও ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানির মধ্যে সংঘটিত হয়েছিল। এই যুদ্ধ আট ঘন্টার মতো স্থায়ী ছিল এবং প্রধান সেনাপতি মীরজাফর আলী খানের বিশ্বাসঘাতকতার দরুন নবাব সিরাজউদ্দৌলা কোম্পানী কর্তৃক পরাজিত হন। এরপরে বাংলায় ব্রিটিশ শাসনের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৭৫৭ সালের ১২ জুন কলকাতার ইংরেজ সৈন্যরা চন্দননগরের সেনাবাহিনীর সঙ্গে মিলিত হয়। সেখানে দুর্গ রক্ষার জন্য অল্প কিছু সৈন্য রেখে তারা ১৩ জন অবশিষ্ট সৈন্য নিয়ে যুদ্ধযাত্রা শুরু করে। কলকাতা থেকে মুর্শিদাবাদের পথে হুগলী, কাটোয়ার দুর্গ, অগ্রদ্বীপ ও পলাশীতে নবাবের সৈন্য থাকা সত্ত্বেও তারা কেউ ইংরেজদের পথ রোধ করে নি। ফলে নবাব সিরাজউদ্দৌলা বুঝতে পারেন, তার সেনাপতিরাও এই ষড়যন্ত্রে শামিল।
বিদ্রোহের আভাস পেয়ে সিরাজ মীর জাফরকে বন্দি করার চিন্তা পরিত্যাগ করেন। তিনি মীর জাফরকে ক্ষমা করে তাকে শপথ নিতে বলেন। মীর জাফর পবিত্র কুরআন স্পর্শ করে অঙ্গীকার করেন যে, তিনি শরীরের একবিন্দু রক্ত থাকতেও বাংলার স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ন হতে দেবেন না। গৃহবিবাদের মীমাংসা করে নবাব রায় দুর্লভ, ইয়ার লুৎফ খান, মীর জাফর, মীর মদন, মোহন লাল ও ফরাসি সেনাপতি সিনফ্রেঁকে সৈন্য চালানোর দায়িত্ব দিয়ে তাদের সঙ্গে যুদ্ধযাত্রা করেন।
Battle of Plassey
২৩ জুন সকাল থেকেই পলাশীর প্রান্তরে ইংরেজরা মুখোমুখি যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়। ১৭৫৭ সালের ২২ জুন মধ্যরাতে রবার্ট ক্লাইভ কলকাতা থেকে তার বাহিনী নিয়ে পলাশী মৌজার লক্ষবাগ নামে আম্রকাননে এসে তাঁবু গাড়েন। বাগানটির উত্তর-পশ্চিম দিকে গঙ্গা নদী। এর উত্তর-পূর্ব দিকে দুই বর্গমাইলব্যাপী আম্রকানন[৪]। বেলা আটটার সময় হঠাৎ করেই মীর মদন ইংরেজ বাহিনীকে আক্রমণ করেন। তার প্রবল আক্রমণে টিকতে না পেরে ক্লাইভ তার সেনাবাহিনী নিয়ে আমবাগানে আশ্রয় নেন। ক্লাইভ কিছুটা বিচলিত হয়ে পড়েন। মীর মদন ধীরে ধীরে অগ্রসর হচ্ছিলেন। কিন্তু মীর জাফর, ইয়ার লুৎফ খান ও রায় দুর্লভ যেখানে সৈন্য সমাবেশ করেছিলেন সেখানেই নিস্পৃহভাবে দাঁড়িয়ে রইলেন। তাদের সামান্য সহায়তা পেলেও হয়ত মীর মদন ইংরেজদের পরাজয় বরণ করতে বাধ্য করতে পারতেন। দুপুরের দিকে হঠাৎ বৃষ্টি নামলে সিরাজউদ্দৌলার গোলাবারুদ ভিজে যায়। তবুও সাহসী মীর মদন এবং অপর সেনাপতি মোহন লাল ইংরেজদের সাথে লড়াই চালিয়ে যেতে লাগলেন। কিন্তু হঠাৎ করেই গোলার আঘাতে মীর মদন মারাত্মকভাবে আহত হন ও মারা যান। নবে সিং হাজারী ও বাহাদুর খান প্রমুখ গোলন্দাজ বাহিনীর প্রধানও একইসাথে মৃত্যুবরণ করেন।
গোলন্দাজ বাহিনীর প্রধান নিহত হওয়ার পর সিরাজউদ্দৌলা মীর জাফর ও রায় দুর্লভকে তাদের অশ্বারোহী বাহিনী নিয়ে তীব্র বেগে অগ্রসর হতে নির্দেশ দেন। কিন্তু উভয় সেনাপতি তার নির্দেশ অমান্য করেন। তাদের যুক্তি ছিল গোলন্দাজ বাহিনীর সহযোগিতা ছাড়া অগ্রসর হওয়া আত্মঘাতী ব্যাপার। কিন্তু কোম্পানি ও নবাবের বাহিনীর মধ্যে তখন দূরত্ব মাত্র কয়েকশত গজ। বিশ্বস্ত সেনাপতি মোহন লাল নবাবকে পরামর্শ দেন যুদ্ধবিরতি ঘটলে বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী কিন্তু সিরাজ মীর জাফর প্রমুখের পরামর্শে পশ্চাৎপসরণের সিদ্ধান্ত নেন। বিকেল পাঁচটায় সিরাজউদ্দৌলার বাহিনী নির্দেশনার অভাবে এবং ইংরেজ বাহিনীর গোলন্দাজি অগ্রসরতার মুখে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে অর্থাৎ পরাজয় স্বীকার করে। নবাবের ছাউনি ইংরেজদের অধিকারে আসে। ইংরেজদের পক্ষে ৭ জন ইউরোপীয় এবং ১৬ জন দেশীয় সৈন্য নিহত হয়। তখন কোনো উপায় না দেখে সিরাজউদ্দৌলা রাজধানী রক্ষা করার জন্য ২,০০০ সৈন্য নিয়ে মুর্শিদাবাদের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। কিন্তু রাজধানী রক্ষা করার জন্যেও কেউ তাকে সাহায্য করেনি। সিরাজউদ্দৌলা তার সহধর্মিণী লুৎফুন্নেসা ও ভৃত্য গোলাম হোসেনকে নিয়ে রাজধানী থেকে বের হয়ে স্থলপথে ভগবানগোলায় পৌঁছে যান এবং সেখান থেকে নৌকাযোগে পদ্মা ও মহানন্দার মধ্য দিয়ে উত্তর দিক অভিমুখে যাত্রা করেন। তার আশা ছিল পশ্চিমাঞ্চলে পৌঁছাতে পারলে ফরাসি সেনাপতি মসিয়ে নাস-এর সহায়তায় পাটনা পর্যন্ত গিয়ে রাজা রামনারায়ণের কাছ থেকে সৈন্য সংগ্রহ করে ফরাসি বাহিনীর সহায়তায় বাংলাকে রক্ষা করবেন। কিন্তু তার সে আশা পূর্ণ হয়নি। সিরাজ পথিমধ্যে বন্দি হন ও মিরনের হাতে বন্দি অবস্থায় তার মৃত্যু ঘটে।
রানা চক্রবর্তীঃ শ্রীরামকৃষ্ণ সারদা দেবীকে বলেছিলেন, “কলকাতার লোকগুলো যেন অন্ধকারে পোকার মতো কিল বিল করছে। তুমি তাদের দেখো!” তারপরে তিনি নিজেকে দেখিয়ে বলেছিলেন, “এ আর কি করেছে? তোমাকে এর অনেক বেশী করতে হবে।” নিজের মর্তলীলাবসানের আগে তখন তিনি ভবিষ্যৎকর্মের গুরুদায়িত্ব যোগ্য পাত্রে সমর্পণের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন। নিজের অন্তরঙ্গ পার্ষদদের তখন তিনি ভাবী কালের সঙ্ঘজননীকে চিনিয়ে দিচ্ছিলেন, যেন বলতে চাইছিলেন – আমার কাজ অর্ধেক করা হয়েছে, জগতের কল্যাণের জন্য বাকি কাজ ও করবে। কিন্তু সারদা দেবী একজন নারী হিসেবে নিজের সীমাবদ্ধতার কথা তাঁকে মনে করিয়ে দিলে তিনি তাঁকে বলেছিলেন, “শুধু কি আমারই দায়? তোমারও দায়।” কিন্তু সেই দায় কিসের ছিল, কিসের দায়িত্ব তিনি সারদা দেবীর হাতে তুলে দিয়েছিলেন?
ঊনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণের কেন্দ্র ছিল কলকাতা। গ্রাম তখন শহরের রূপ নিচ্ছিল। আভিজাত্য আর বর্ণশ্রেষ্ঠদের হাত ধরে ছিল না। বিদ্যা নয়, বিত্তই তখন গরিমার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। হিন্দুসমাজ তখন কোণঠাসা ব্যক্তিদের আপনগড়া হৃদয়হীন স্বার্থপর বিধি-নিষেধের পাঁকে জড়িয়ে পড়ে খাবি খাচ্ছিল। সাধারণ মানুষ তখন সহজ, সরল ও সুস্থ জীবনযাপনের স্বাদ ভুলে যেতে বসেছিলেন। নতুন শহরে বিদেশিরাও তখন বিভিন্ন উদ্দেশ্য ও আদর্শ নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন। তাঁদের সঙ্গেই পশ্চিম দিগন্তের একটুখানি আলো এসে পূর্বের আকাশে পড়েছিল। বাঙালির চিত্তলোকে সেই আলো প্রবল আলোড়ন তুলেছিল। প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের সেই ভাবসংঘর্ষ ও সমন্বয়কেই ইতিহাসে নবজাগরণ নাম দেওয়া হয়েছে। ইতিহাস বলে যে এই সময়েই যুগপুরুষদের আবির্ভাব ঘটে। সেবারেও সেটাই হয়েছিল। একে একে উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো মনীষীরা এসেছিলেন। তাঁরা অনুভব করেছিলেন যে, সেই জাগরণ শুধু ভাবের আদান-প্রদান নয়, সার্বিক অর্থে মুক্তির আকাশে বিচরণও বটে। একই সঙ্গে তাঁরা বুঝতে পেরেছিলেন যে, তাঁরা কতটা অসহায়। মুক্তিপ্রয়াস যতই আন্তরিক হোক না কেন, এক পক্ষে পক্ষীর উত্থান কখনোই সম্ভব নয়; এদেশের নারী খাঁচায়-বন্দি পাখির মতোই তখন নিরুপায় ছিল। সেজন্য ঊনিশ শতকের মনীষীদের যাবতীয় ভাবনাচিন্তাতেই নারীর মঙ্গলকামনা ছিল। বাস্তবিকই হিন্দু সমাজপতিদের দাপট এবং কুলগৌরব তখন যত খর্ব হচ্ছিল, ততই তাঁরা নারীদের প্রতি রুষ্ট হচ্ছিলেন। কঠোর নিয়মানুবর্তিতার মধ্যে নারীর দেহ ও মনকে শৃঙ্খলিত করে তাঁরা এক ধরনের বিকৃত আনন্দ লাভ করতেন। পশমের আসনের উলটো পিঠের মতো কুশ্রী জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে নারীরা নিজেদের স্বাভাবিক জীবনের ছন্দ ভুলতে বসেছিলেন। যাঁদের ব্যবস্থাপনায় নারীরা তখন বন্দীজীবন কাটাতে বাধ্য হয়েছিলেন, তাঁরা এবং পরনির্ভর, শিক্ষাবঞ্চিত সেকালের কলকাতার নারী – অন্ধকারে থাকা সেই নরনারীকেই কী শ্রীরামকৃষ্ণ কীটের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন? ঊনিশ শতকের মনীষীরাও সমাজ-সংস্কারের কাজে হাত দিয়েই নারীদের অসহায় অবস্থাটি লক্ষ্য করেছিলেন। কিন্তু তাঁদের জন্য বা তাঁদের অবস্থার প্রকৃত উন্নতির জন্য কী করা উচিত, সেটা তাঁরা নির্ণয় করতে পারেন নি। হিন্দুসমাজকে বদলানোর মত ক্ষমতা তাঁদের ছিল না। বিচ্ছিন্নভাবে রাজা রামমোহন রায় সতীদাহ বন্ধ করতে চেষ্টা করেছিলেন, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বাল্যবিধবার পুনর্বিবাহ দিতে চেষ্টা করেছিলেন। তখন বহুবিবাহ ও বাল্যবিবাহ বন্ধ করবার প্রয়াস অসফল হলেও মানুষের মনে সচেতনতা নিয়ে এসেছিল। সেই সময়ের শিক্ষিত মানুষেরা পশ্চিমের নারীদের জীবন লক্ষ্য করছিলেন। তাঁরা দেখেছিলেন যে, ইউরোপে নারীরা শিক্ষিত এবং গৃহবন্দী নন। সেই বিদেশিনীদের আদর্শেই এদেশের নারীকে শিক্ষা দেওয়ার আগ্রহও অনেকের মধ্যে ছিল। তাঁরা সুগৃহিণী হওয়ার উপযুক্ত শিক্ষা দিয়ে নারীদের এবং নিজেদের জীবনেও সুখ-সমৃদ্ধি নিয়ে আসতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বাইরে থেকে হিন্দুসমাজে পরিবর্তন আনা সম্ভব ছিল না। অতিরিক্ত রক্ষণশীল হয়ে সমাজপতিরা নব্যশিক্ষিতদের দূরে সরিয়ে দিতে শুরু করেছিলেন। বহু যুবক ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন। ব্রাহ্ম ধর্মের আশ্রয় নিয়ে আবার অনেকে রক্ষাও পেয়েছিলেন। কিন্তু মূল স্রোতের মানসিক মানচিত্র তখন কারো পক্ষেই বদলানো সম্ভব হয়নি। রিক্ত, ক্লান্ত, অবসন্ন, অপমানিত নারীরাও পশ্চিমী শিক্ষার আলোয় নিজেদের মনের অন্ধকার দূর করতে পারেন নি। তাহলে কি মনীষীদের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল? না, তা হয়নি। বরং যুগপুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণের জীবন ও সাধনাকে আশ্রয় করে তাঁদের আন্তরিক প্রয়াস সার্থক হয়েছিল। অনেকটা দৈবনির্দিষ্ট ঘটনার মতোই ঠাকুর তৎকালীন কলকাতা শহরের এক ভক্তিমতী নারীর প্রতিষ্ঠিত দেবালয়ের মৃন্ময়ী দেবীকে মাতৃভাবে সাধনা করে চিন্ময়ী ভবতারিণীরূপে প্রত্যক্ষ করেছিলেন। নিজের গুরুরূপে তিনি ‘ভৈরবী যোগেশ্বরী’কে গ্রহণ করেছিলেন। নিজের সাধনার শেষপর্বে তিনি সহধর্মিণী সারদা দেবীকে দেবীজ্ঞানে ষোড়শোপচারে পুজো করেছিলেন, মন্দিরের অধিষ্ঠাত্রী দেবী ভবতারিণীর সঙ্গে তাঁকে এক করে দেখেছিলেন, এবং পরম স্নেহ ও সমাদরে স্ত্রীরূপে গ্রহণ করে দেহ-সম্পর্কহীন অপূর্ব দাম্পত্য জীবন অতিবাহিত করেছিলেন। অপমানের অন্ধকার থেকে নারীকে সসম্মানে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করবার জন্য সেই উদাহরণের প্রয়োজন ছিল। ইতিপূর্বে অপর কোনও সাধক ওভাবে মানুষের অন্তরে নারী সম্পর্কিত শ্রদ্ধার বীজ বপন করবার চেষ্টা করেননি। পশ্চিমী আদর্শে নারীর শিক্ষা ও স্বাধীনতার কথা থাকলেও তাঁকে শ্রদ্ধা ও সম্মানের জগতে প্রতিষ্ঠা করা হয়নি। আত্মপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য সেখানেও নারীকে সংগ্রাম করতে হয়েছিল। কিন্তু এদেশে সূচনাপর্বে নারীকে মানসিক শক্তি অর্জন করবার জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছিল। ঊনিশ শতকের মনীষীরা নারীর অন্তঃকরণে জ্ঞানের বীজ রোপণে আগ্রহ প্রকাশ করলেও ভেবেছিলেন, “এখন তাঁহাদিগকে স্বাধীনতা প্রদান করিলে অবশ্যই তাহাতে বিষময় ফল ফলিবে।” যাঁদের নিজেদের মধ্যেই সংশয় ও পরিচালনাশক্তির অভাব ছিল, তাঁরা কীভাবে নেতৃত্ব দেবেন সেটাই ভেবে পাননি। সেই সময়ে রামকৃষ্ণ এবং সারদাদেবী তাঁদের সামনে নিজেদের অলৌকিক জীবনচর্যার চিত্র অত্যন্ত বিশ্বাসযোগ্যভাবে উপস্থিত করেছিলেন।
প্রকাশ্য উদাহরণ হিসেবে সকলে রামকৃষ্ণের কথাই জানেন, কিন্তু সারদা দেবীর কথা ভুলে গেলে চলবে না।
ঊনিশ শতকের সত্তরের দশকে তিনি প্রথম কলকাতা শহরে এসেছিলেন। তখন অবশ্য দক্ষিণেশ্বর কলকাতা-সংলগ্ন একটা গ্রাম ছিল। কলকাতা শহরে তখন নারীজাগরণের প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল। নানা ঐতিহাসিক কারণে সেই দশকটি আধুনিক সময়ের নারীদের কাছে স্মরণীয়, কেননা সেই সময়েই ‘চন্দ্রমুখী-কাদম্বিনী’ প্রবেশিকা স্তরে উন্নীত হয়েছিলেন। ‘রাসসুন্দরী-স্বর্ণকুমারী-ফয়জুন্নেসা’র গ্রন্থ প্রকাশিত হচ্ছিল। ‘নীলকমল মিত্র’ দৌহিত্রী ‘বিরাজমোহিনী’কে চিকিৎসাবিদ্যা শেখাতে চাইছিলেন। নারীর আত্মবিকাশের সেই পর্বে সারদা দেবী দক্ষিণেশ্বরে উপস্থিত হওয়ার পরে শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন, “তুমি কি আমায় সংসারপথে টেনে নিতে এসেছ?” সারদা দেবী সেদিন তাঁকে নির্দ্বিধায় উত্তর দিয়েছিলেন, “আমি তোমাকে সংসার পথে কেন টানতে যাব? তোমার ইষ্টপথেই সাহায্য করতে এসেছি।” এখানেই তিনি আপন বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। শ্রীরামকৃষ্ণগতপ্রাণা কিন্তু আত্মসচেতন। প্রথম থেকেই তিনি “স্বেচ্ছায় স্বামীর ব্রতসাধনের ক্ষেত্রে নিজেকেও পূর্ণভাবে অংশীদার করে সন্ন্যাসিনীর জীবনকে বরণ করে নিয়েছিলেন।” এই নারী অপমানের অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া নারীদের একজন ছিলেন না, বরং তাঁদের উদ্ধারকারিণী দলের নেত্রী ছিলেন। শুধু অপমানিত, লাঞ্ছিত নারীদের নয়, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ধনী- দরিদ্র, সুখী-দুঃখী সব নারীকেই তিনি নিজের আসক্তিবিহীন জীবনাচরণের অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত দিয়ে কূপমণ্ডূকের জীবন থেকে মুক্তি পাওয়ার শিক্ষা দিয়েছিলেন। ঠাকুর সেকথা ভালোভাবেই জানতেন বলে যাবতীয় গুরুদায়িত্ব অর্থাৎ শুধু নারীদের ভার নয়, যাবতীয় পুত্র-কন্যা-গৃহী-সন্ন্যাসী-মুমুক্ষু-দিগ্ভ্রান্ত মানবসন্তানের দায়দায়িত্ব তাঁর হাতেই সমর্পণ করেছিলেন। সারদা দেবীও সেই দায়িত্ব এড়াতে পারেন নি। তিনি নিজে ভক্তদের অপূর্ব আশ্বাসবাণী শুনিয়েছিলেন – “ঠাকুরের জগতের প্রত্যেকের উপর মাতৃভাব ছিল। সেই মাতৃভাব জগতে বিকাশের জন্য আমাকে এবার রেখে গেছেন।” সন্তানদের জন্যও তাঁর অভয়বাণী ছিল – “তাঁদের ভবিষ্যৎ আমি দেখব।” অবশ্য না দেখে তাঁর উপায়ই বা কী ছিল – “আমার ছেলে যদি ধুলোকাদা মাখে, আমাকেই তো ধুলো ঝেড়ে কোলে নিতে হবে।” ঠাকুরের লীলাবসানের পরে সারদাদেবীকে দুটি দায়িত্ব নিতে হয়েছিল। ঠাকুর যে ভাবান্দোলনের সূচনা করেছিলেন, সেটাকে বাঁচিয়ে রাখা; এবং তাঁর ভাব সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে যে সন্ন্যাসীবৃন্দ পৌঁছে দিচ্ছিলেন, তাঁদের মাতৃস্নেহ দিয়ে একসুরে বেঁধে রাখা। তখনও তাঁরা গৈরিকধারী সন্ন্যাসী ছিলেন না, তখনও রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের সুষ্পষ্ট সূচনা হয়নি, ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা স্থির হয়নি, অর্থের সংস্থান ছিল না, ঠাকুরের গৃহী ভক্তদের সঙ্গে তাঁদের আদর্শগত বিরোধ ছিল – কিন্তু সেই সঙ্কটপর্বে শ্রীমা নিঃশব্দে তাঁর সন্ন্যাসী সন্তানদের পাশে ছিলেন। সারদাদেবীর সেই নীরব সমর্থন মন্ত্রের মতো কাজ করেছিল। স্বামীজী পরে তাঁর এক বক্তৃতায় সেই চরম দুঃসময়ের কথা স্মরণ করে বলেছিলেন, “একজন ছাড়া কেহই সহানুভূতি জানাইল না। সেই একজনের সহানুভূতিই আশা ও আশীর্বাদ বহন করিয়া আনিল। তিনি এক নারী।” অথচ সেই শতকেই নারীর নিরুপায় স্নানমুখ প্রত্যক্ষ করা গিয়েছিল। দয়ার পাত্রী যে কোন মুহূর্তে প্রেরণাদাত্রী হয়ে উঠেছিলেন, সেটা কেউ তা বুঝতে পারেন নি। রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের পুষ্টিসাধনে সারদাদেবীর ভালোবাসাই ছিল প্রধান শক্তি। স্বামীজী বলেছিলেন, “আমাদের সকলের তাঁহার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা। তিনি কখনও আমাদের উপর হুকুম চালান না।” যদিও সারদাদেবীর ইচ্ছা এবং নির্দেশই ছিল রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের শেষ কথা। একবার বেলুড় মঠে দুর্গাপুজোয় স্বামীজী চেয়েছিলেন ‘বলি’ হবে। সেকথা শুনে শ্রীমা তাঁকে বলেছিলেন, “মঠে দুর্গাপুজো করে শক্তির আরাধনা করবে বইকি। শক্তির আরাধনা না করলে জগতে কোনও কাজ কি সিদ্ধ হয়? তবে বাবা, বলি দিয়ো না, প্রাণিহত্যা কোরো না। তোমরা হলে সন্ন্যাসী, সর্বভূতে অভয়দানই তোমাদের ব্রত।” স্বামীজী নির্দ্বিধায় তাঁর সেই আদেশ মেনে নিয়েছিলেন। একসময়ে প্লেগ যখন কলকাতায় মহামারীর রূপ নিয়েছিল, তখন সেবাকর্মে অর্থের অভাব দেখা দিলে স্বামীজী বেলুড় মঠ পর্যন্ত বিক্রি করে দিতে চেয়েছিলেন। সেবাকর্মে অকুণ্ঠ সমর্থন থাকা সত্ত্বেও শ্রীমা কিন্তু স্বামীজীর সেই প্রস্তাবে সম্মত হননি। তিনি বলেছিলেন, “মঠ-স্থাপনায় আমার নামে সংকল্প করেছ, তোমার ওসব বিক্রির অধিকারই বা কোথায়? বেলুড় মঠ কি একটা সেবাকাজেই নিঃশেষ হয়ে যাবে?” সেদিন সঙ্ঘজননীর কথায় স্বামীজী তাঁর নিজের ভুল বুঝতে পেরেছিলেন। পরবর্তী কালেও শ্রীমাকে বহু জটিল সমস্যার সমাধান করতে হয়েছিল। মায়াবতী অদ্বৈত আশ্রমে স্বামীজীর ইচ্ছানুসারে বিশুদ্ধ অদ্বৈতের সাধনা করা হত, কিন্তু তাঁর দু’-একজন সন্ন্যাসী-শিষ্য একটি ঘরে শ্রীরামকৃষ্ণের পটপূজা করতেন। স্বামীজী সেকথা শুনে তাঁদের উপরে অত্যন্ত বিরক্ত হয়েছিলেন। তাঁর সম্মানে সেই পুজো বন্ধ করে দেওয়া হলেও সন্তানদের মনে সংশয়ের অবসান ঘটেনি। তাঁরা শ্রীমাকে সেই বিষয়ে একটি পত্র লিখলে তিনি তাঁদের উত্তর দিয়েছিলেন, “আমাদের গুরু যিনি তিনি তো অদ্বৈত। তোমরা সেই গুরুর শিষ্য তখন তোমরাও অদ্বৈতবাদী। আমি জোর করিয়া বলিতে পারি তোমরা অদ্বৈতবাদী।” সঙ্ঘজননী হিসেবে সারদাদেবীর দৃঢ়তা এবং গুরুত্ব সেই পত্রটির প্রতি ছত্রে লুকিয়ে ছিল। নিজের দৈনন্দিন জীবনে তাঁকে দ্বৈতবাদিরূপেই দেখতে পাওয়া যেত। পটপূজা, ভোগরাগ, আরতি সবেতেই তাঁর প্রগাঢ় নিষ্ঠা দেখা গেলেও অতি সহজে তিনি পারিপার্শ্বিক থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে প্রকৃত সত্য ব্যক্ত করেছিলেন। প্রশ্ন উঠতে পারে যে, তাহলে শ্রীমা তাঁর দৈনন্দিন আচরণে কিংবা বলা যায় ব্যবহারিক জীবনে কেন অদ্বৈতবাদকে প্রাধান্য দেননি?
কারণ সঙ্ঘজননী হওয়া ছাড়াও তাঁর আরও কিছু দায় ছিল। তিনি বহু সন্তানের জননী ছিলেন। মুষ্টিমেয় কয়েকজন দৃঢ়চেতা ত্যাগী সন্ন্যাসী সন্তানকে নিয়ে তাঁর সংসার ছিল না, তাঁর সংসার আরও বড়ো ছিল। সেখানে কামনাবাসনাতাড়িত, আকণ্ঠ সংসারপঙ্কে নিমজ্জিত অসংখ্য ধূলিধূসরিত মানুষ ছিলেন। ধুলো ঝেড়ে তাঁদের কোলে নিতে হবে, তাঁদের বোঝাতে হবে যে ঈশ্বরলাভই জীবনের শেষ কথা – এটাই ছিল তাঁর সংকল্প। সব সন্তানই তাঁর শিশু মাতৃক্রোড়েই সেরা শিক্ষা পায়। মা তাঁকে স্নেহে-শাসনে, আদরে, ভালোবাসায়, ভুলিয়ে, বুঝিয়ে নানাভাবে শিক্ষা দেন। শ্রীমাও তাঁর সন্তানদের মধ্যে জ্ঞান-ভক্তি সঞ্চারের চেষ্টা শুরু করেছিলেন। প্রথমদিকে তিনি পুরুষভক্তদের সামনে বাইরে বেরোতেন না, বা তাঁদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলতেন না; তবে প্রয়োজনে দীক্ষা অবশ্যই দিতেন, তাঁদের মনে কোনও সংশয় বা প্রশ্ন থাকলেও সেসবের উত্তর দিতেন। তবে মায়ের সঙ্গে নারী ভক্তদের যোগ সব সময়েই ছিল।
দক্ষিণেশ্বরে থাকতেই সারদাদেবী দুই কলকাতাবাসিনীর সান্নিধ্য পেয়েছিলেন, তাঁরা ছিলেন – ‘যোগীন-মা’ ও ‘গোলাপ-মা’। নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনে আরও অগণিত কলকাতাবাসিনীর মতোই তাঁদের দুঃখের জীবন ছিল। ‘যোগীন্দ্রমোহিনী’র স্বামী ‘অম্বিকাচরণ বিশ্বাস’ অমিতব্যয়ী, অসংযত ও উচ্ছৃঙ্খল ছিল। কোন উপায়ান্তর না থাকবার জন্য তিনি শ্বশুরালয় থেকে বাধ্য হয়ে উত্তর কলকাতায় পিত্রালয়ে ফিরে এসেছিলেন। পরে শ্রীরামকৃষ্ণের চরণপ্রান্তে পৌঁছে তিনি শান্তির আশ্রয় পেয়েছিলেন। তাঁর নির্দেশেই তিনি শ্রীমায়ের সেবিকা ও সঙ্গিনী হয়েছিলেন। গোলাপ-মা প্রথমে বাগবাজারে বাস করতেন। তাঁর স্বামী ‘কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়’ অকালেই মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছিলেন। এরপরে নিজের এক পুত্র ও কন্যাকে নিয়ে সেই দরিদ্র ব্রাহ্মণীর জীবন যাপন শুরু হয়েছিল। পুত্রটিও শৈশবে মারা গিয়েছিল। একমাত্র কন্যাকে গোলাপসুন্দরী যক্ষের ধনের মতো আগলে রেখেছিলেন। নিজের আর্থিক অনটনেও সেকালের কৌলীন্যপ্রথাকে অগ্রাহ্য করে তিনি তাঁর কন্যা ‘চণ্ডীকুমারী’কে পাথুরিয়াঘাটার ‘সৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুরের’ সঙ্গে বিবাহ দিয়েছিলেন। কিন্তু দুটি শিশুপুত্র রেখে চণ্ডীকুমারী অকালে মারা যাওয়ার পরে গোলাপসুন্দরী শোকে-দুঃখে উদ্ভ্রান্ত হয়ে উঠেছিলেন। তখন তাঁর পূর্বপরিচিতা যোগেন্দ্রমোহিনী তাঁকে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের চরণাশ্রয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। দক্ষিণেশ্বরের নহবতে তিনিও মায়ের সঙ্গিনীরূপে গৃহীত হয়েছিলেন। পরবর্তী জীবনে শ্রীমায়ের সর্বকালের সঙ্গিনীরূপে তাঁদের উওভয়কে দেখতে পাওয়া গিয়েছিল। শ্রীমা তাঁদের বলতেন ‘জয়া-বিজয়া’। যাই হোক, ঊনিশ শতকের কলকাতার সঙ্গে শ্রীমায়ের যোগ তাঁরাই ঘটিয়েছিলেন। সারদাদেবী স্বেচ্ছায় সেই শতকের অধঃপতিত নারীদের আলোয় ফিরিয়ে আনার কাজ গ্ৰহণ করেছিলেন। ঠাকুর ও শ্রীমায়ের প্রকৃত স্বরূপ জানা সত্ত্বেও গোলাপ-মা তৎকালীন সংস্কারবশত মাঝে মাঝেই বলে ফেলতেন, “… উনি অত বড়ো ত্যাগী, আর মা এত মাকড়ি-টাকড়ি এত গয়না পরেন, এ ভালো দেখায় কি?” বুদ্ধিমতী মা তৎক্ষণাৎ বুঝতে পেরেছিলেন যে, সেকথা শুধু মনোমোহনের মায়ের নয় গোলাপ – মায়েরও। তাই তিনি শুধু সোনার বালাটা হাতে রেখে বাকি সব গয়না খুলে ফেলেছিলেন। কারণটা তাঁর মুখেই অন্য এক প্রসঙ্গে এক সেবক শুনতে পেয়েছিলেন, “গোলাপ কি কম গা? দক্ষিণেশ্বরে আমি ঠাকুরের কাছে যেতুম বলে ওর হিংসে হত। একদিন বলেই ফেললে, তুমি ঠাকুরের কাছে যাও কেন? আমি কারুর কথা সইতে পারিনে। কথা শোনবার মতো কাজ তো করিই না, তবে শুনব কেন? আমি যাওয়া বন্ধ করে দিলুম।” অথচ মা ভালো করেই জানতেন যে, তাঁর গয়না পরা বা ঠাকুরের জন্য খাবার নিয়ে যাওয়া কোনওটাই দোষের নয়; কিন্তু তবুও ভক্তদের চোখে ঠাকুরের ত্যাগের আদর্শ নিয়ে কোনও প্রশ্ন তোলার অবকাশ তিনি রাখতে চাননি। তাঁর অপরূপ সংলাপটিও ঊনিশ শতকের নারীকে অন্য একটি শক্তি দিয়েছিল, সেটা ছিল – কথা শোনার মতো কাজ না করবার শক্তি। একেবারে নিরাভরণভাবেই তিনি নিজের পবিত্র জীবনটিকেই শুধু যে তুলে ধরেছিলেন – তা নয়, অন্য নারীদেরও বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে, পবিত্র ও গ্লানিহীন জীবনযাপনের মর্যাদা কতখানি। বস্তুতঃ, যে সময়ের কথা এখানে বলা হচ্ছে, সেই সময়ের কলকাতা শহরের অধিকাংশ অন্দরমহলে সীতা-সাবিত্রীর পাতিব্রত্য, বীরজননীর আত্মত্যাগ, দ্রৌপদীর মর্যাদাবোধ নিতান্ত গল্পকথায় পর্যবসিত হয়েছিল। গার্গী-মৈত্রেয়ী স্মৃতিতেও ছিলেন না। অবশ্য সহস্র বন্ধনের মধ্যেও তখনও দু’-চারজন নারী যে মুক্তির কথা ভাবেননি তা নয়। মানুষমাত্রেই একটা শান্তির আশ্রয় খোঁজে, ঊনিশ শতকে কিংবা তার আগেও নারী ধর্মের কাছে, ঠাকুরঘরে সেই আশ্রয় খুঁজেছিল। দু’-চারজন সংসারবন্ধন কেটে মুক্তির সন্ধানে বেরিয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু সারদাদেবীই সকলের জন্য শান্তির সন্ধান দিতে পেরেছিলেন। একই সঙ্গে তিনি সকলকে যুগোপযোগী এগিয়ে যাওয়ার পথও দেখিয়ে দিয়েছিলেন।
প্রথমেই তিনি নারীকে অতিরিক্ত আসক্তির হাত থেকে মুক্তি পেতে শিখিয়েছিলেন। তিনি জানতেন যে, অধিকাংশ নারীই নিজেদের তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয়ে আবদ্ধ করে রাখেন। বিড়ম্বিত দাম্পত্যজীবনে কোনওরকম সম্মান না পেলেও ভোগের মোহিনী-মায়া তাঁদের আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। ঠাকুর এবং শ্রীমার বিবাহের আদর্শটি সেজন্যই এত মূল্যবান। তাঁরা নতুন করে ভারতীয় আদর্শের পুরানো কথা শিখিয়েছিলেন যে, বিবাহ শুধু ইন্দ্রিয় পরিতৃপ্তির জন্য নয়, শুধু সন্তানের জন্ম দেওয়াই নারীজীবনের শেষ কথা নয়। গৃহী ভক্তদের জন্য সেই শিক্ষার প্রয়োজন তখন ছিল। তবে মায়ের দায়িত্ব ছিল আরেকটু বেশি। বাৎসল্য নারীর স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য, কিন্তু সে কি কেবল তাঁর নাড়ী-ছেঁড়া ধনের সঙ্গেই রক্ত মাংসের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে থাকবে? শ্রীমা তাঁদের সামনে বিশুদ্ধ মাতৃত্বের আদর্শ তুলে ধরেছিলেন। তিনি গর্ভধারিণী ছিলেন না, কিন্তু ‘সত্যজননী’ ছিলেন। সাধারণ মানুষকে শিক্ষা দেওয়া বড়ো শক্ত। শুধু উপদেশে কোনও কাজ হয় না। লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, শ্রীমা কাউকে এমন কোনও উপদেশ দেননি, যা তিনি নিজের আচরণের দ্বারা প্রমাণ করে দেখাননি। সর্বত্র অতি সাধারণ পল্লীবধূর মতো বাস করেছিলেন। তাঁকে যাঁরা ঘিরে থাকতেন, আপাতদৃষ্টিতে তাঁরাও অতি সাধারণ মানুষ ছিলেন। শ্রীমায়ের সংস্পর্শে এসে কি তাঁদের মন বদলাত না? বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। ‘স্বামী গম্ভীরানন্দ’ লিখেছিলেন, “ভ্রাতাদের স্বার্থবুদ্ধি, ভ্রাতুষ্পুত্রীদের পরস্পর হিংসা, নলিনীদিদির শুচিবায়ু, রাখুর বাতুলসদৃশ আবদার এবং ছোটোমামীর পাগলামী – এই সকল মিলিয়া যে অবর্ণনীয় আবহাওয়ার সৃষ্টি হইত তাহাতে একমাত্র ধৈর্যময়ী শ্রীমায়ের পক্ষেই সংসারের কাজ করা সম্ভব ছিল।” আসলে তাঁরা সকলেই মায়ের লীলাসঙ্গী ছিলেন। লোকলোচনের সামনে সেটি তাঁর ‘পঞ্চতপা’র সাধনা ছিল। বিড়ম্বিত নারীদের তিনি অশান্তির নিত্যদহনের মধ্য দিয়ে সাধনা করতে শিখিয়েছিলেন।
আপনার প্রচুর সামর্থ্য থাকলেও
আপনার সন্তানকে “অভাব” শেখান…
যা চাইবে তাই যদি হাজির করেন,
আপনার বাচ্চার “মানুষ” হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।
ক্ষুধা নিবারন করার জন্য মানুষকে যে পরিমাণ ব্রেইন ব্যবহার করতে হয়,তাতেই একজন মানুষ যা অর্জন করে এটা দিয়ে সে জীবন পার করে দিতে পারবে।
সন্তানকে এমনভাবে প্রস্তুত করেন
যে আপনি না থাকলে সে কিভাবে চলবে তার ট্রেইনিংটা সে পায়।
তাকে কোন কিছু করতে না দিয়ে ঢেকি বানালে,
সে আপনার অবর্তমানে কষ্টতো পাবেই,
আপনাকেই সবচেয়ে বেশি দোষারোপ করবে।
অনেকেই একটা আলাপ করেন পরে এমনিতেই সব শিখে যাবে।
একটা মানুষ হঠাৎ করেই মানুষ হয় না,আস্তে আস্তে মানুষ হয়!
কারন আপনি যখন থাকবেন না
দুনিয়ার কঠিন পথ তাকে একা চলতে হবে।
সেই একা চলার ট্রেইনিংটা তাকে শক্ত করবে,আপনিও দেখবেন হাল্কা ফিল করবেন! আপনার সন্তানকে শেখান চাইলেই সব কিছু পাওয়া যায় না।
সব কিছু পাওয়ার দরকারও নাই…
কষ্টের মাধ্যমে অর্জিত জিনিসের মূল্য বোঝান…
তাকে বোঝান সবকিছু ছাড়াও জীবন চলে ,দৌড়ায় ,উড়ে।
গত ২০ই জুন তিনি ৬৫ বছরে পা দিলেন। জন্ম ওড়িশার ময়ূর্ভঞ্জ জেলার এক প্রত্যন্ত গ্রামের দরিদ্র সাঁওতাল পরিবারে।সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত গ্রামের স্কুলেই পড়াশোনা। ওই বয়সেই সবসময় মাথায় ঘুরত,এগোতে হবে,অনেকদূর এগোতে হবে। পড়াশোনা করে বড় হয়ে চাকরি করে সংসারের হাল ধরতে হবে।
একদিন ওই অঞ্চলে এক মিটিং এ রাজ্যের এক মন্ত্রী এলেন। সদ্য ৭ম শ্রেণীতে ওঠা মেয়েটি সেসময়ের ম্যাট্রিক পাশ ঠাকুমার অনুপ্রেরণায় এবং বাবার পরামর্শে নিজের সমস্ত সার্টিফিকেট নিয়ে ছুটে গেল মন্ত্রীর কাছে।মিটিং এর মাঝেই দৌড়ে হলে প্রবেশ করে মন্ত্রীর হাতে সার্টিফিকেটগুলো জমা করে কাতর স্বরে বলল, আমি আরও পড়তে চাই।শহরের ভাল স্কুলে পড়াশোনা করতে চাই।মন্ত্রীর উদ্যোগে মেয়েটি প্রথমবার দেখল শহর,ভর্তি হলো শহরের স্কুলে। কলেজের গণ্ডিও পার করলেন।পড়াশোনা শেষ করে ‘সাঁওতাল পরিবারের মেয়ে চাকরি করবে’ সুলভ অজস্র কটুবাক্য নীরবে মাথায় নিয়ে যোগ দিলেন চাকরিতে।
ইতিমধ্যে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হয়েছেন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের আধিকারিক শ্যামচরণ মূর্মুর সাথে। প্রত্যাশিতভাবেই,বাড়ির বউ চাকরি করবে,এতে শ্বশুরবাড়ির ছিল ঘোর আপত্তি।তাই ছেড়ে দিলেন চাকরি। ঠিক এসময় কোল আলো করে আসে পরপর দু’টি পুত্র এবং একটি কন্যাসন্তান। ছেলেমেয়েরা একটু বড় হতে আর পাঁচজন ভারতীয় মহিলার মতোই পরিবারের সাথে একটু ‘মানিয়ে গুছিয়ে’ নিয়ে আবার যোগ দিলেন একটি স্কুলের চাকরিতে,তবে এবার বিনা বেতনে। অনারারি সার্ভিস।পড়ানোর দক্ষতা এবং সবার সাথে মিশে যাওয়ার অপরিসীম ক্ষমতার সৌজন্যে স্বল্প সময়েই জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন স্কুলের ছাত্রছাত্রী এবং তাদের অভিভাবকদের মধ্যে।করতে থাকেন সমাজসেবামূলক কাজ।
এসময় সেই মন্ত্রীর এক বন্ধু রাজনীতিকের নজরে পড়ে দ্রৌপদীর কাজকর্ম। তিনি ক্রমাগত দ্রৌপদীকে অনুরোধ করতে থাকেন রাজনীতিতে যোগ দিতে যাতে তাঁর জনপ্রিয়তার ওপর ভর করে ভোট বৈতরণী পার হওয়া যায়।দ্রৌপদী নাছোড়বান্দা। রাজনীতির বাইরে থেকেই সমাজের জন্য কাজ করতে চান।ক্রমাগত অনুরোধ উপোরধ শেষে আর নাকচ করতে না পেরে স্বামীর পরামর্শে ১৯৯৭ সালে ময়ূর্ভঞ্জের নোটিফায়েড এরিয়া কাউন্সিলের কাউন্সিলর পদে নির্বাচনের জন্য মনোনয়ন জমা দেন ভারতীয় জনতা পার্টির হয়ে এবং বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন। প্রথমবার কাউন্সিলর হয়েই ওই বোর্ডের ভাইস চেয়ারম্যান পদে মনোনীত হন।
কাউন্সিলর পদের মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগেই ২০০০ সালে দলের অনুরোধে বিজেপি-বিজেডি জোটের হয়ে মনোনয়ন জমা দেন বিধানসভা নির্বাচনে।মানুষের মধ্যে বিপুল জনপ্রিয়তা থাকায় জিতেও যান।প্রথমবার বিধায়ক হয়েই মনোনীত হন পরিবহন দফতরের রাষ্ট্রমন্ত্রী।
এবার এল আসল চ্যালেঞ্জ। এক সাঁওতাল মহিলা মন্ত্রীত্ব সামলাবেন!তাবড় আইএএস অফিসার, দফতরের কর্মীদের ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে দিনরাত পড়াশোনা করে কিছুদিনের মধ্যেই কাজের গতিপ্রকৃতি বুঝে নিলেন। চার বছরে চারটি দফতরের মন্ত্রীত্ব সামলালেন।
২০০৪ এর বিধানসভা নির্বাচনে জোট ভেঙে গেল। বিজেপির ভরাডুবি হল নবীন পত্তনায়কের বিজেডির কাছে।এই কঠিন সময়েও দ্রৌপদী মুর্মু বিজেপির টিকিটেই আবার বিধায়ক হলেন।কিন্তু হেরে গেলেন ২০০৯ এর বিধানসভায়।শহরে পাঠরত দুই ছেলেকে বললেন,তোমরা ভুবনেশ্বরে থেকেই পড়াশোনা করো,আমি আবার গ্রামে ফিরে গিয়ে তৃণমূল স্তরে মানুষের জন্য কাজ করতে চাই আগের মতো।
পুরনো গ্রামে ফিরে আবার ডুবে গেলেন সমাজসেবার কাজে।
কিছুদিনের মধ্যেই এক সকালে খবর পেলেন বড় ছেলে আর নেই। ভেঙে পড়লেন শোকে।সামলে ওঠার জন্য ডুবে গেলেন কাজের মধ্যে আরও বেশি করে।
২০১৪ র এক অভিশপ্ত রাতে ছোট ছেলেটিও একটি পথ দুর্ঘটনায় চলে গেল কোল খালি করে। স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই তীব্র মানসিক অবসাদে ডুবে গেলেন। স্ত্রীর স্নায়বিক শক্তি অসীম হলেও পুত্রশোক নিতে পারেননি স্বামী।কিছুদিনের মধ্যেই তিনিও পরলোকগমন করলেন। তার কয়েকদিনের মধ্যেই দ্রৌপদীর মা ও দাদা। এক বছরে এতগুলো মৃত্যু মেনে নিতে পারলেন না তিনি। শেষ অবলম্বন হিসাবে জড়িয়ে ধরলেন যোগ এবং আধ্যাত্বিকতাকে,সাথে আরো বেশি করে নিজেকে নিয়োজিত করলেন সমাজের কাজে। স্বামী-সন্তানহারা এক মা ছাতা হয়ে উঠতে চাইলেন অনেক অনেক আদিবাসী সন্তানের।
এরমধ্যেই ২০১৫ সালে কেন্দ্রীয় সরকার ঝাড়খণ্ডের রাজ্যপাল হিসাবে দ্রৌপদীকে মনোনীত করলেন।আদিবাসী অধ্যুষিত ঝাড়খণ্ডের প্রথম মহিলা রাজ্যপাল এবং ওড়িশা থেকে উঠে আসা প্রথম আদিবাসী রাজ্যপাল হিসাবে যোগ দিলেন কাজে।সসম্মানে দায়িত্ব সম্পূর্ণ করে ২০২১ এ অবসর নেন।ফিরে আসেন ওড়িশায়।
আর কিছুদিনের মধ্যেই চিরাচরিত রাজনৈতিক কলিমাহীন এহেন শক্তিশালী এক ভারতীয় নারীর মুকুটে যুক্ত হতে চলেছে চূড়ান্ত পালকটি। তিনিই হতে চলেছেন ভারতবর্ষের প্রথম মূলনিবাসী এবং দ্বিতীয় মহিলা রাষ্ট্রপতি। সাথে তিনিই হতে চলেছেন প্রথম রাষ্ট্রপতি যাঁর জন্ম স্বাধীনতার পরে।
একদা সন্তান শোকে বিহ্বল এক মা হতে চলেছেন একশ’ ত্রিশ কোটি ভারতবাসীর অভিভাবক!এটাই ভারতবর্ষ। এঁরাই ভারতবর্ষ।
‘আদিবাসী অধ্যুষিত রাজ্যের আগত বিধানসভা ভোটের জন্য খুড়োর কল’,’আদিবাসী কার্ড’, ‘কোটার রাষ্ট্রপতি’ ইত্যাদি সমালোচনা তো চলতেই থাকবে এবং এই আলোচনা যত চলবে,গণতান্ত্রিক পরিসর তত প্রশস্ত হবে। তবে এইসব কচকচানির বাইরে গিয়ে আশা রাখা যায় একাধারে আরও অনেক প্রিভিলেজড এবং প্রান্তিক,অসংরক্ষিত এবং জনজাতিভুক্ত রমণীর অনুপ্রেরণা হয়ে ধরা দেবেন এই আটপৌরে শুভ্রবস্ত্র আদিবাসী মা, দ্রৌপদী মুর্মু (Draupadi Murmu)।
হিন্দু শাস্ত্র অনুসারে, বছরের পঞ্চম মাস হল দেবতাদের প্রিয় মাস, অর্থাত্ শ্রাবণ মাস। এই বছর ১৪ জুলাই শুরু হচ্ছে শ্রাবণ মাস (Sawan Month 2022)। পুরো মাসটি মহাদেবের পুজোর উদ্দেশ্যে পালন করা হয়। এই মাস জুড়ে শিব শম্ভুর বিশেষ পূজা করা হয়, তবে শ্রাবণ মাসের প্রতিটি সোমবারের আলাদা গুরুত্ব রয়েছে।
এই মাসে পূর্ণিমাতে শ্রবণ নক্ষত্রটি চাঁদের সহচার্য্যে থাকে বলে এই মাসের নাম শ্রাবণ। শিব (Lord Shiva) হিন্দুধর্মের অন্যতম প্রধান দেবতা। ঈশ্বরের সৃজন, পালন ও সংহার এই ত্রিশক্তি যথাক্রমে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিব এই তিন দেবতারূপে পরিচিত। ব্রহ্মা সৃষ্টি করেন, বিষ্ণু পালন করেন আর শিব ধ্বংস করেন। শিবপুরাণ, লিঙ্গপুরাণ প্রভৃতি গ্রন্থে শিব স্বয়ং ঈশ্বররূপে বন্দিত হয়েছেন।
শ্রাবণের সোমবার শিবের অত্যন্ত প্রিয়। মনে করা হয় সোমবারের উপবাস করলে সমস্ত মনস্কামনা পূরণ হয়। শ্রাবণের সোমবার বিশেষ কিছু উপায় করলে শিবের কাছ থেকে পছন্দমতো আশীর্বাদ পেতে পারেন। পুরাণ মতে, শ্রাবণ মাস হিন্দুদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র একটি মাস, যা জ্যোতিষচর্চা, আধ্যাত্মিক সব দিক থেকেই সমান মাহাত্ম্য রয়েছে। এই মাসে বেশ কিছু নিয়ম আচার রয়েছে, হিন্দুদের বিশ্বাস অনুযায়ী তা করলে যাবতীয় মনস্কামনা পূরণ হয়। হিন্দু মতে, এই মাসটি শিবকে উত্সর্গ করা হয়। শ্রাবণ মাসের প্রতি সোমবার শিবের পুজো করা জন্য অধীর আগ্রহ করে থাকেন। এই মাসে শিবের মন্দিরগুলিতে দলবদ্ধ হয় বা বাড়িতেই শিবের পুজো করে পুণ্য লাভ করার জন্য অপেক্ষা করেন ভক্তরা।
শ্রাবণ মাসের গুরুত্ব
এই পবিত্র মাসে শিবের উপাসনা করা হয়। মনে করা হয় যে, শাওয়ান মাসে শিব-পার্বতী , উভয়েই মর্ত্যে নেমে এসে পৃথিবী ভ্রমণ করেন ও ভক্তদের প্রার্থনায় সাড়া দিয়ে আর্শীবাদ করেন। প্রতি সোমবার শিবভক্তরা উপবাস রাখেন ও বিশ্বাস করেন, জীবনের যাবতীয় সমস্যার কাণ্ডারি ও সুখ-সমৃদ্ধি অর্জনে সহায়তা করবেন মহাদেব। বিবাহতি জীবনে সমস্যায় জেরবার ভক্তরাও সোমবার উপবাস করে শিবের পুজো করে সমাধানের আশায় অপেক্ষা করেন।
শ্রাবণ ব্রতের নিয়ম
সোমবার একটি ব্রত পালন করুন। আপনি মঙ্গলবারও উপবাস করতে পারেন।
তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠুন (ব্রহ্ম মুহুর্তের সময় – সূর্যোদয়ের ঠিক দুই ঘন্টা আগে)।
স্নান করে পরিষ্কার কাপড় পরুন।
পুজোর ঘরে বা নিরিবিলি জায়গায় ধ্যান করুন। এর পরে সংকল্প করুন।
অটল বিশ্বাসে ভগবান শিবের পূজা করুন।
আপনি যখন উপবাস করবেন তখন ব্রহ্মচর্য বজায় রাখুন।
শ্রাবণ সোমবার ব্রত পালন করলে অ্যালকোহল এবং তামাক সেবন কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।
গম, চাল, ডাল এড়িয়ে চলুন। কিন্তু যারা সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত উপবাস রাখবেন, তাঁরা রাতে সম্পূর্ণ খাবার খেতে পারেন। তবুও, খাদ্যশস্য এড়িয়ে চললে সবচেয়ে ভাল হবে।
বাড়িতে বা মন্দিরে শিব পূজা এবং রুদ্রাভিষেক করুন, ভগবান শিবের কাছে মন্ত্র উচ্চারণ করুন এবং কোনও কিছু দান করুন।
অভিষেক করার সময়, হলুদ এবং সিঁদুর ব্যবহার করবেন না। পরিবর্তে, চন্দন ব্যবহার করুন।
পূজার জন্য গঙ্গাজল বা জল, বিল্বপত্র, ধাতুরা ফল ও ফুল, কাঁচা দুধ, অক্ষত, চন্দন, বিভূতি নিবেদন করুন।
দেবী পার্বতী এবং নন্দী পূজা করুন।
শ্রাবণ সোমবার ব্রত কথা পড়ুন।
শিব আরতি করে ব্রত শেষ করুন।
শ্রাবণ মাসে ভুলেও করবেন না এই কাজগুলি
শ্রাবণ মাসে যাঁরা উপবাস রাখবেন তাঁরা তামসিক ভোজন গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকুন। শ্রাবণ মাসে পেঁয়াজ-রসুন এড়িয়ে যাওয়াই ভালো।
এই মাসে উপবাস করার কথা চিন্তা করলে প্রতিটি সোমবারই উপবাস করুন।
শ্রাবণ মাসে মাছ, মাংস খাওয়া ও মদ্যপান করা উচিত নয়।
শ্রাবণ মাসে করুন এই উপায়গুলি
পরিবারে বহুদিন ধরে আর্থিক সংকট চলতে থাকলে শ্রাবণ মাসের যে কোনও সোমবার বেদানার রস দিয়ে শিবলিঙ্গের অভিষেক করুন। এর ফলে আর্থিক অনটন থেকে মুক্তি পাবেন।
আপনার পরিবারে প্রায়ই কেউ অসুস্থ থাকলে এই উপায়টি করে দেখতে পারেন। এ ক্ষেত্রে জলের মধ্যে কালো তিল মিশিয়ে প্রতিদিন শিবলিঙ্গের অভিষেক করুন।
জীবনে সমস্যার আনাগোনা লেগে থাকলে নিজের স্ত্রীর সঙ্গে মিলে শিব ও পার্বতীর পুজো করুন। তার পর পায়েসের ভোগ অর্পণ করবেন।
আবার স্ত্রী ও পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে বিবাদ চলতে থাকলে পঞ্চামৃত দিয়ে শিবলিঙ্গের অভিষেক করুন। এর প্রভাবে জীবনে আনন্দের সমাগম ঘটে। দাম্পত্য জীবনও সুখ কাটে।
হিন্দি বিনোদন জগতের বিখ্যাত একজন কমেডিয়ান হলেন জনি লিভার (Johnny Lever)। মুম্বাই ইন্ডাস্ট্রিতে তাঁর মত বড় মাপের অভিনেতা অনেক কমই দেখা যায়। অন্ধ্রপ্রদেশের এক হিসাই পরিবারে জন্মগ্রহণ করা এই অভিনেতা ৮০-৯০ এর দশকে খ্যাতনামা একজন কমেডিয়ান ছিলেন। বতর্মান সময়ে তাঁর মত অভিনেতা খুঁজে পাওয়া দুস্কর।
১৯৫৭ সালে জন্মগ্রহণকারী এই অভিনেতা নিজের বাবা মাকে খুব ভালোবাসেন। সেই কারণেই তিনি আজও গোটা পরিবারের মধ্যমণি হয়ে রয়েছেন। একসময় বাবার হাত ধরেই মুম্বাই মায়ানগরীতে পা দিয়েছিলেন জনি লিভার। সেই সময় কোন সিনেমার প্রয়োজনে না এলেও হিন্দুস্তান লিভার কোম্পানিতে কাজের সুযোগ পেয়েছিলেন জনি লিভার (Johnny Lever)।
এই স্থানে কাজের মাঝে তিনি বিভিন্ন মানুষের নকল করতেন। আর তা খুবই পছন্দ করতেন বাকি কর্মচারীরা। এখানেই থেমে যাননি জনি লিভার। এইভাবে ধীরে ধীরে স্টেজ পারফরম্যান্স শুরু করেন তিনি। তাঁর কাজের ধরণ দেখে তাঁকে সিনেমায় অভিনয় করার কথাও বলেন অনেকে। সাহস করে বুক বাঁধা স্বপ্ন নিয়ে সিনেমায় অভিনয় করলেন জনি লিভার। তাঁর অভিনয় মন ছুঁয়ে গেল প্রতিটি দর্শকের। সকলের মুখ থেকেই প্রশংসা পেলেন এই অভিনেতা। পাশাপাশি হিন্দুস্তান লিভারে কাজ করার সুবাদে তাঁর নাম বদলে হয়ে গেল জনি লিভার।
পরিবারের আর্থিক অবস্থা খারাপ থাকার কারণে সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশুনার পর একটা সময় কাজের অভাবে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে ঘুরে কলম বিক্রি করতেন তিনি। সেইসঙ্গে নামী দামী শিল্পীদের নকল করে কিছু পয়সা উপার্জন করতেন। এইসময় মানুষ তাঁর কমেডি বেশি পছন্দ করায় দৈনিক ৫ টাকা করে উপার্জন করতেন তিনি। সেইসময় ৫ টাকা অনেক ছিল তাঁদের পরিবারের কাছে।
জানিয়ে রাখি, একসময় জনি লিভারের একটি শো চলাকালীন সেখানে উপস্থিত ছিলেন সুনীল দত্ত। আর সেখানে জনি লিভারের অনুষ্ঠান দেখে তাঁকে ভীষণই খুশি হন তিনি। এমনকি তাঁকে একটি ছবির অফারও দিয়ে দেন। এইভাবে চলচ্চিত্র জগতে প্রথম ছবি ‘দর্দ কা রিশতা’তে অভিনয় করে অনেক ভালোবাসা পান জনি লিভার।
বলিউডে প্রায় ৩৫০ টি সিনেমায় অভিনয় করে ফেলেছেন এই অভিনেতা। সেইসঙ্গে প্রায় ১৪ বার ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ডও পেয়েছেন তিনি। আজকের দিনে সকলের ভালোবাসার পাত্রে পরিণত হয়েছেন জনি লিভার (Johnny Lever)।
গরমের দাবদাহে মানুষ নাজেহাল। তাপমাত্রার পারদ ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখী। এই পরিস্থিতিতে বেশিরভাগ বাড়িতে এখন কুলার ই প্রধান ভরসা। কিন্তু এই কুলার ব্যবহারের বড় সমস্যা হল মাসের শেষে মোটা অংকের ইলেকট্রিক বিল। তবে আজ আমরা এই প্রতিবেদনের মাধ্যমে আপনাদের এই গরম থেকে রেহাই পাওয়ার এমন একটি উপায় বলবো যাতে পরিবেশেও থাকবে সবুজ এবং লাগবেনা কোন ইলেকট্রিক বিল।
এমন অনেক গাছপালা রয়েছে যেগুলো শুধু অক্সিজেন ও সবুজায়নই প্রদান করে না উপরন্তু শীতল অনুভূতিও প্রদান করে। তাই আপনারা যদি এই গাছগুলি আপনার বারান্দায় লাগান তাহলে শীতল অনুভূতি পাবেন। আসুন সেই সমস্ত গাছগুলি সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক।
• ঘৃতকুমারী (Aloe vera)।
ঘৃতকুমারী তে রয়েছে প্রচুর ঔষধি গুন। বিভিন্ন ওষুধ তৈরিতে কাজে লাগে এই গাছ। ঘৃতকুমারী বা এলোভেরা চুল ও ত্বকের জন্য বিশেষ উপকারী। এটি ব্যবহারে কোন পার্শপ্রতিক্রিয়া থাকেনা। এছাড়াও এর বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো যদি এই গাছকে আপনি আপনার বারান্দায় লাগান তাহলে বারান্দার চারপাশের পরিবেশ ঠান্ডা করতে বিশেষ সহায়তা করে।
• স্নেক প্ল্যান্ট (Snake Plant)।
আপনি যদি এই গাছ বাড়ির বারান্দায় লাগান তাহলে অক্সিজেন সরবরাহ বৃদ্ধি করে এছাড়াও বাড়ির আবহাওয়া ঠান্ডা করতে বিশেষ সহায়তা করে।
• আরিকা পাম (Areca Palm)।
প্রাকৃতিক আদ্রতা ধরে রাখার বিশেষ ক্ষমতা রয়েছে এই গাছের। গ্রীষ্মে আপনার বাড়িতে যদি এই গাছ লাগান তাহলে বাড়ির আবহাওয়া অনেক ঠান্ডা করবে।
• ডাইফেনবাচিয়া (Dieffenbachia)।
এই গাছটি অক্সিজেন সরবরাহ করতে বিশেষ উপযোগী। এছাড়াও গাছটি চারপাশে শীতল আবহাওয়া বিশেষভাবে তৈরি করে।
• ড্রাকেনা ফ্রাগান্স (Dracaena Fragrans)।
এই গাছটি আর্দ্রতা ধরে রাখতে বিশেষ ভাবে সক্ষম। এছাড়াও এটি শীতলতা প্রদানের পাশাপাশি সুগন্ধিও প্রদান করে থাকে।
• বেবি রবার (Baby Rubber)।
এই গাছটি যদি বাড়ির বারান্দা তে লাগান তাহলে শীতল অনুভূতি এর পাশাপাশি সতেজতাও প্রদান করবে। কাদের জন্য আপনাকে কুলার ও ব্যবহার করতে হবে না।
যসকলেই চান তার সন্তান যেন সুস্থ ও বুদ্ধিমান হয়। কিন্ত, একটি শিশুর ‘ইনটেলিজেন্ট’ হওয়া বা না-হওয়া অনেকটাই নির্ভর করে তার জিন-এর উপর। স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞের কথা অনুসারে— একটি শিশু যে জিন নিয়ে জন্মায়, সেটাই তার বুদ্ধিমত্তা ও চারিত্রিক বৈশিষ্ঠ্যের মূল কারণ হয়। কিন্তু, নতুন গবেষণায় একটি শিশুর ‘আইকিউ লেভেল’ মাত্র ৫০% নির্ভর করে তার জিনের উপর। বাকিটার জন্য দায়ী থাকে তার পারিপার্শ্বিক অবস্থা।
কি করলে এবং কোন কারণে আপনার শিশুটি বুদ্ধিমান হয়ে জন্মাবে, গবেষণায় উঠে আসা সেই কারণগুলি আজ দেওয়া হলো:
পুষ্টিকর খাবার: শিশুর ‘ব্রেইন ডেভলপমেন্ট’-এর জন্য ওমেগা ৩ ফ্যাটি অ্যাসিড খুবই জরুরি। তাই গর্ভবতি অবস্থায় মাছ, সোয়াবিন, পালং শাক খাওয়া খুবই প্রয়োজন। অন্যান্য শাক যাতে আয়রন রয়েছে, এমন শাকও শিশুর ব্রেইনে অক্সিজেন সাপ্লাই করতে সাহায্য করে। আমন্ড ও ওয়ালনাটও এ সময় কার্যকরী।
ফিট ও অ্যাক্টিভ :এক্সারসাইজ করলে শরীরে রক্তের প্রবাহ ভালো হয়, যা শিশুর বেড়ে ওঠায় সাহায্য করে। রিসার্চ বলছে, মা শারীরিক কসরত করলে, গর্ভের সন্তানের ব্রেইনে নিউরনের মাত্রা বেড়ে যায় প্রায় ৪০%। এটি মানুষের মনে রাখার শক্তি বহন করে।
কথা বলুন গর্ভস্থ সন্তানের সঙ্গে : গর্ভবতি অবস্থায় একই গান বা কোনো ভালো কবিতা যদি বারবার শোনা যায়, রিসার্চ বলছে, জন্মের পরে সেই গান বা কবিতা শুনলে শিশুটি চিনতে পারে। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, গর্ভস্থ সন্তানের সঙ্গে সুন্দর কিছু কথা বলতে।
গল্প সেশন: গর্ভবতি হওয়ার তিন মাস পর থেকেই গর্ভের সন্তানটির আওয়াজ বা শব্দ মনে রাখার ক্ষমতা বৃদ্ধি পেতে শুরু করে, জানাচ্ছেন প্যারেন্টিং এক্সপার্ট পলি সেনগুপ্ত। তার মতে, মা বা বাবা যদি লাগাতার ছোটদের কোনো গল্প জোরে জোরে পড়ে, সে ক্ষেত্রে শিশুটির ব্রেইন সেই শব্দগুলি মনে রাখে।
হাল্কা ম্যাসাজ: রিসার্চ বলছে, গর্ভবতি হওয়ার ২০ সপ্তাহ থেকেই মায়ের পেটের উপর হাত রাখলে, শিশুটি তা বুঝতে পারে। রিসার্চে এমনও তথ্য বলা হয়েছে যে, শিশুটি বাবা-মায়ের স্পর্শও বুঝতে পারে। তাই পেটের উপর তেলের ম্যাসাজ খুবই উপকারি।
আপনি হয়তো প্রায়ই অনলাইনে এবং নানান ওয়েবসাইটে জিনিস বিক্রি করে কোটিপতি হতে দেখেছেন অনেককেই। এখনকার পুরনো হয়ে যাওয়া সামগ্রীগুলো এন্টিক বিভাগের মধ্যে পড়ে। এইসব সামগ্রীগুলির চাহিদা খুবই বেশী আন্তর্জাতিক বাজারে। এইরকমই সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে আজকাল ই-কমার্স ওয়েবসাইটে। যেখান থেকে আপনি দেব-দেবীর ছবির খোদাই করা পুরনো কয়েন রেখে দিয়ে আয় করতে পারেন ১০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত।
এমন এক ব্যক্তির নাম প্রকাশিত হয়েছে খবরের দ্বারা কিছুদিন আগেই। একটি প্রতিবেদনের দ্বারা সেই ব্যক্তিটি জানিয়েছেন যে তিনি উপার্জন করেছেন লক্ষ লক্ষ টাকা একটি ১০০ টাকার পুরনো নোট বিক্রি করে। পুরনো জিনিসপত্রের যদি আপনি অনুরাগী হয়ে থাকেন তাহলে আপনিও রাতারাতি কোটিপতি হয়ে যেতে পারেন খুব সহজেই। আপনার সেই সখটিই আপনাকে অনেক টাকার মালিক করে তুলতে পারে।
আগের পাঁচ টাকার যেই মুদ্রাগুলি দেখা যেত যেগুলোর মধ্যে বৈষ্ণোদেবীর মূর্তি খোদাই করা থাকত সেই মুদ্রাগুলি যাদের কাছে রয়েছে এখনও, তারা সেটি রাখতে পারেন বিড করার জন্য। দুর্দান্ত ট্রেন্ডে রয়েছে আজকাল এই মুদ্রাটি। আজকাল এটির খুব সন্ধান করছেন পুরনো জিনিসের সন্ধানকারী লোকেরা। এই মুদ্রা জারি করেছিলেন সরকার ২০০২ সালে। ৫ এবং ১০ টাকারও হতো ওই মুদ্রাগুলি।
এই মুদ্রা টিকে খুবই শুভ বলে মনে করা হয় কারণ এতে বৈষ্ণোদেবীর ছবি রয়েছে। প্রত্যেকেই এটিকে রাখতে চাই এই কারণেই। এখন অনেকেই কয়েক লক্ষ টাকাও দিয়ে দিতে রাজি এই জাতীয় কয়েনটি পাওয়ার জন্য । এছাড়াও খুব চাহিদা রয়েছে সিরিজের নোটগুলিরও। সৌভাগ্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয় এই নোটগুলি। মিডিয়ার রিপোর্ট অনুসারে জানা যাচ্ছে যে পুরনো কয়েন এবং নোট নিলামের সুবিধা দেওয়া হয়েছে ইন্ডিয়ামার্ট,OLX এবং আরও নানান ওয়েবসাইট থেকে।