চীন, ভারতবর্ষ রাশিয়ার সাথে নিজেদের মুদ্রাতে ব্যবসা করছে, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ নাকী পূর্ব বনাম পশ্চিম! কোন পথে বিশ্ব রাজনীতি?

১৫৫৫ সালে অর্থাৎ প্রায় চারশো বছর আগে ফ্রান্সের বিখ্যাত জ্যোতিষী নস্ত্রাদ্রামুস এমন কিছু ভবিষ্যত বানী করেছিলেন যা আজও মানুষকে অবাক করে দেয়। ওনার প্রায় অধিকাংশ ভবিষ্যত বানীই সত্য হয়েছিল যার মধ্যে রয়েছে ফরাসী বিপ্লব, হিটলারের উত্থান, পারমানবিক বোম্ব বিস্ফোরনের ঘটনা। এই জন্য নস্ত্রাদামুসকে অনেকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ জ্যোতিষী বলেন। এমনকী বর্তমানে হওয়া রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের ভবিষ্যতবানীও তিনি করেছিলেন। নস্ত্রাদামুস এটা বলেছিলেন এই সংঘর্ষকে কেন্দ্র করে শীঘ্রই বিশ্ব ভয়ানক যুদ্ধের সম্মুখীন হবে। বিশ্বের অন্যতম বিখ্যাত সামরিক বিশেষজ্ঞ মাইকেল ই ওহ্যানলোন ২০১৯ সালে তার বই দি সেনকাকু প্যারাডক্স : রাইজিং গ্রেট পাওয়ার ওয়ার ওভার স্মল স্টেকসে লিখেছেন বিশ্বের ছোট ছোট সংঘর্ষ বড় যুদ্ধের জন্ম দিতে পারে যার অর্থ তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ।

অ্যাটলান্টিক কাউন্সিলের প্রধান ম্যাথিউ ক্রোয়িং বলেছেন বিশ্ব জুড়ে ছোট ছোট সংঘর্ষ ভবিষ্যতের বড় যুদ্ধের দিকে ইশারা করছে। রাশিয়া ইউক্রেনের যু্দ্ধই হোক কিংবা উত্তর কোরিয়ার সাথে আমেরিকার বিরোধ এসব কিছুই ভবিষ্যতের জন্য অশুভ সংকেত। সামরিক বিশেষজ্ঞদের ধারনা আগামী বিশ্বে পূর্ব বনাম পশ্চিমের যুদ্ধ হবার সম্ভবনা বেশী যার কেন্দ্রবিন্দু হবে ইন্দো প্যাসিফিক অঞ্চল। এই অঞ্চলেই রয়েছে চীন, ভারত, দক্ষিন কোরিয়া, জাপানের মতন বড় সামরিক ক্ষমতা ও মজবুত অর্থনীতির দেশগুলো। যার কারনে ইন্দো প্যাসিফিক অঞ্চলকে ভবিষ্যতে বিশ্বরাজনীতির মূলকেন্দ্র বলা হচ্ছে। কিন্তু কী কারনে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এত বছর পর বিশ্বে আবারও একটি বড় যুদ্ধের সম্ভবনা তৈরি হয়েছে? সেবিষয়েই বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয় জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পরমানু বোম্ব ফেলার মাধ্যমে। যার জন্য বিশ্ব সাক্ষী হয়েছিল এক মর্মান্তিক ধ্বংসাত্মক অস্ত্রের ধ্বংসলীলার। এরপরই পরমানু অস্ত্র তৈরি ও ব্যবহারের উপর লাগাম লাগানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। প্রথমদিকে শুধু আমেরিকা ও রাশিয়ার কাছেই এই অস্ত্র ছিল কিন্তু পরে চীন, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, ভারত, ইসরায়েল ও পাকিস্তান এই পরমানু শক্তির অধিকারী হয়ে ওঠে। এই মহূর্তে বিশ্বের সবচেয়ে বেশী পরমানু হাতিয়ার রয়েছে রাশিয়ার কাছে। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমন করে, এরপরই রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিন হুমকী দেয় ইউক্রেনকে সাহায্য করলে রাশিয়া পরমানু অস্ত্র প্রয়োগে বাধ্য হবে। যার জন্য ছোট ছোট দেশ গুলোর নিরাপত্তার ব্যাপারেই প্রশ্ন উঠে যায়। শুধু রাশিয়া নয় পাকিস্তান, চীন, উত্তর কোরিয়ার মতন অস্থিতিশীল দেশ গুলোর কাছেও পরমানু অস্ত্র রয়েছে যা বিশ্বের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকী। উত্তর কোরিয়ার সবচেয়ে বড় শত্রু আমেরিকা। যার জন্য উত্তর কোরিয়া কিছুদিন আগেই ঘোষনা করেছে তাদের উপর আক্রমনের সম্ভবনা হলেই তারা পরমানু হামলা করবে যার কারনে আমেরিকার মত বিশ্বের সুপার পাওয়ার দেশও উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে আর্থিক নিষেধাজ্ঞার বাইরে কিছু করতে পারেনা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মত ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ বা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ যাতে না হয় তার জন্য জাতিসংঘের মতোন সংগঠন তৈরি হয়েছিল যার প্রধান কাজই ছিল বিশ্বজুড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা এবং মুক্তবানিজ্য নীতি। জাতিসংঘে মূলত আমেরিকার নেতৃত্বে পশ্চিমা দেশগুলোর প্রভাব রয়েছে। তবে বর্তমানে জাতিসংঘও দ্বিধাবিভক্ত কারন জাতিসংঘের পাঁচ স্থায়ী সদস্যের মধ্যে চীন ও আমেরিকার মধ্যে বানিজ্য যুদ্ধ শুরু হয়েছে প্রাক্তন আমেরিকার রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের সময় থেকে। আমেরিকার স্পীকার ন্যান্সি পেলোসির তাইওয়ান সফরের পর থেকে আরও জোড়ালো বিরোধীতা শুরু হয়েছে দুই দেশের মধ্যে। চীন তাইওয়ানের চারদিকে যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করেছে। বিশেষ করে রাশিয়া ও চীনের ভাল সম্পর্কের জেড়ে মনে করা হচ্ছে চীন হয়ত তাইওয়ানে আক্রমন করতে পারে তবে এমনটা হলেও জাতিসংঘের কিছু করবার থাকবেনা, কারন চীন পরমানু শক্তিধর দেশ। ঠিক এই ভাবেই ইউরোপে অস্থিতিশীলতা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সৃষ্টি করেছিল। সাধারনত বিশ্বে শান্তি বজায় তখনই থাকে যখন শক্তির ভারসাম্য বজায় থাকে এবং শক্তির ভারসাম্য তখনই সম্ভব যখন বিশ্ব ইউনিপোলার ও বাইপোলারে থাকবে। বাইপোলার মানে দুটি সুপার পাওয়ার থাকবে বিশ্বে যার কারনে বিশ্বে শান্তি থাকবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে বিশ্বে এরকমই দুটি সুপার পাওয়ার ছিল আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন। ইউনিপোলারের ক্ষেত্রে বিশ্বে একটিই সুপার পাওয়ার থাকে যার সমতুল্য কেউ হতে পারে না ফলে শান্তি বজায় থাকে। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাবার পর বিশ্বে একক সুপার পাওয়ার হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে আমেরিকা। কিন্তু বর্তমান বিশ্ব মাল্টিপোলার বা একসাথে অনেকগুলো শক্তিশালী দেশের উত্থান হয়েছে। শক্তিশালী সামরিক ও অর্থনৈতিক দেশ হিসাবে চীনের উত্থান হয়েছে, চীনকে কাউন্টার করার জন্য ভারত ও জাপান রয়েছে এশিয়ায়। রাশিয়া নতুন করে নিজেদের শক্তি বাড়িয়েছে। মধ্য প্রাচ্যে ইরানের মতো সামরিক শক্তিশালী দেশ রয়েছে। এখন পরিস্থিতি অনেকটা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মতন, তখনও পরিস্থিতি মাল্টিপোলার ছিল। মূলত অস্ট্রিয়া হাঙ্গেরি, জার্মানি, অটোমান সাম্রাজ্য, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও আমেরিকার শক্তি প্রদর্শনের জন্যই জন্যই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ হয়েছিল। তবে বর্তমান বিশ্বে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পাশাপাশি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মতন পরিস্থিতিও রয়েছে। অনেক সময় শক্তিশালী দেশ গুলো ক্ষমতা দখলের নেশায় এতটাই মত্ত হয়ে যায় যে তাদের পতন ডেকে আনে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলার ক্ষমতার নেশায় প্রায় গোটা ইউরোপ দখল করে নিয়ে রাশিয়া আক্রমন করেছিল যা তার পতনের সূত্রপাত করেছিল। অন্যদিকে জাপান এশিয়ায় তার প্রভাব বিস্তার করছিল। এখন রাশিয়াও সেই একই ভুল করে ইউক্রেন আক্রমন করেছে। তবে রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিন স্বপ্নেও ভাবেনি ইউক্রেন এতটা প্রতিরোধ করবে। অন্যদিকে সামরিক বিশেষজ্ঞদের ধারনা চীনও দক্ষিন চীন সাগর থেকে শুরু করে ভারত মহাসাগর ও হিমালিয়ান রেঞ্জে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করতে ব্যাস্ত যা ভবিষ্যতে একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের ইঙ্গিত দিচ্ছে। চীন ক্ষমতার নেশায় মত্ত হয়ে বেলট রোড ইনিশিয়েটিভের মতন বিপুল ব্যায়ের প্রকল্প শুরু করেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জার্মানি ও জাপান যেন আজকের রাশিয়া ও চীন। শুধু ক্ষমতার লড়াই নয় বরং পারস্পারিক বানিজ্যও বর্তমানে বিশ্বে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করছে। জাতিসংঘের একটি লক্ষ্য ছিল মুক্ত বানিজ্য নীতি কিন্তু বর্তমানে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় মুক্ত বানিজ্যনীতি প্রায় নেই বললেই চলে। যেমন রাশিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধের পর অ্যাপেল, কেএফসির মতন বড় বড় সংস্থা রাশিয়া ছেড়ে চলে আসে। আবার চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিনপিং ও বড় বড় চাইনিজ সংস্থাকে আমেরিকা থেকে সরিয়ে নিয়ে আসছে। আমেরিকার অ্যাপেলের মতন সংস্থা চীন থেকে ভারতে চলে আসছে। ইউরোপ রাশিয়া থেকে গ্যাস, তেল কেনার বদলে বিকল্প জায়গা থেকে কিনছে বেশী দামে হলেও। ইরান, ভেনিজুয়েলার উপর আমেরিকার নিষেধাজ্ঞার কারনে দেশ গুলো আমেরিকা বিরোধী জোট যেমন চীনের সাথে বানিজ্য করছে। চীন আমেরিকার বদলে এশিয়াও আফ্রিকার বাজার দখলে ব্যাস্ত হয়ে পড়েছে। এর সবচেয়ে ব্যাপক প্রভাব পড়েছে আমেরিকান ডলারে। বলা হয় আমেরিকান ডলার বিশ্বের সবচেয়ে মজবুত কারেন্সি কিন্তু বানিজ্য যুদ্ধের কারনে চীন তার কারেন্সি ইউয়ান, ভারত রুপি, রাশিয়া রুবেলে বানিজ্য করছে। আমেরিকার অন্যতম বন্ধু দেশ সৌদি আরবও তেল রপ্তানির জন্য চীনের সাথে ইউয়ানে বানিজ্য করছে। যার কারনে বিশ্বে ডলারের ৫৯ শতাংশ শেয়ার কমে গেছে। আমেরিকান ডলারের পতন বিশ্বে আর্থিক সংকট তৈরি করতে পারে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে যুদ্ধের ধরনে একটু পরিবর্তন হয়েছে। আগে যুদ্ধ হত দুই বা একাধিক দেশের মত। তবে ২০১৪ সালে ইসলামিক স্টেট, লেবাননের হিজবুল্লাহ এবং সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ প্রচলিত যুদ্ধের ধারনাকে বদলে দিয়ে নতুন ধারার প্রবর্তন করেছে তা হচ্ছে শক্তিশালী দেশের বিরুদ্ধে ছায়াযুদ্ধ যার সবচেয়ে বড় উদাহারন হচ্ছে আফগানিস্তানের তালিবান যারা আমেরিকাকে উচ্ছেদ করে দিয়ে আজ আফগানিস্তানের ক্ষমতায়। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, রোবটিক্স, হাইপারসনিক মিসাইল যুদ্ধের ধরনই পাল্টে দিয়েছে। রাশিয়া, চীন, ইরান, উত্তর কোরিয়া, পাকিস্তান, সিরিয়ার মতন পশ্চিমা বিরোধীদেশ গুলোর জোট যেন ক্রমশ বিশ্বকে পূর্ব বনাম পশ্চিমের গনবিধ্বংসী যুদ্ধের দিকে এগিয়ে দিচ্ছে।

প্রতাপগড়ের যুদ্ধঃ যেখানে ছত্রপতি শিবাজী মহারাজের অসাধারন রননীতির কাছে পরাস্ত হয়েছিল আফজল খানের বিশাল সেনা

ভারতবর্ষের ইতিহাসে মহান মারাঠা সম্রাট ছত্রপতি শিবাজী মহারাজের নাম স্বর্নাক্ষরে লেখা রয়েছে। ছত্রপতি শিবাজী মহারাজের অসাধারন বীরত্বের কাহিনী সম্পর্কে জানে না এমন খুব কম ব্যাক্তিই আছে। ভারতবর্ষের ইতিহাসে এমন অনেক মহান সম্রাট শাসন করেছে যারা তাদের অসাধারন বীরত্বের জন্য স্মরনীয় হয়ে আছে। কিন্তু ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ এমনই একজন রাজা ছিলেন যার দক্ষ স্থল সেনার পাশাপাশি একটি শক্তিশালী নৌবাহিনীও ছিল যার কারনে তাঁকে ভারতীয় নৌবাহিনীর জনক বলা হয়। ছত্রপতি শিবাজী মহারাজের জীবনের অসংখ্য যুদ্ধের মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ন যুদ্ধ হচ্ছে প্রতাপগড়ের যুদ্ধ। ১৬৫৯ সালের ১০ নভেম্বর ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ ও বিজাপুরের শাসক আদিল শাহের সেনাপতি আফজল খানের মধ্যে এই যুদ্ধ হয়েছিল যাতে ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ জয়ী হয়েছিলেন।

এই যুদ্ধের পরই মারঠা সাম্রাজ্যের বিস্তার শুরু হয়। ভারতবর্ষের রাজনীতিতে এক সিংহ হৃদয় পুরুষের আবির্ভাব হয় যিনি মুঘল সাম্রাজ্যের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিলেন। একদিকে মুঘল, অন্যদিকে আদিল শাহ উভয় পক্ষকেই শক্ত হাতে দমন করেছিলেন তিনি। মারাঠা সাম্রাজ্যের গঠন তার সময়েই শুরু হয়। যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী হওয়ার পাশাপাশি দক্ষ শাসকও ছিলেন ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ।

১৫৩০ সালের পর থেকে শুরু থেকেই ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ইতিহাসে রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরু হয়। একদিকে উত্তর ভারতে মুঘল সাম্রাজ্য বিস্তার লাভ করে। আকবর সাম্রাজ্য বিস্তার শুরু করে। অন্যদিকে দক্ষিন ভারতে ক্ষমতার দখল নিয়ে রাজনৈতিক সংকট দেখা যায়। দক্ষিন ভারতে সেসময় একটি শক্তিশালী সাম্রাজ্য বিজয়নগর সাম্রাজ্যের রাজত্ব ছিল। ১৫৬৫ সালে পাঁচটি ডেকান প্রদেশ আহমেদনগর, বিজাপুর, গোলকোন্ডা, বিদার ও বেরার যৌথভাবে বিজয়নগর আক্রমন করে। ইতিহাসে এই যুদ্ধ তালিকোটার যুদ্ধ নামে পরিচিত, এই যুদ্ধের পরই বিজয়নগর সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। এই পাঁচটি ডেকান প্রদেশ এর আগে একত্রে বাহমানি সাম্রাজ্য নামে পরিচিত ছিল। ১৩৪৭ সালে আলাউদ্দিন বাহমান শাহ এর প্রতিষ্ঠা করেছিল। ১৪৯০ থেকে ১৫১৮ এর মধ্যে এই সাম্রাজ্য পাঁচ ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। এদের একত্রে ডেকান সাম্রাজ্যও বলা হত। বিজয়নগর সাম্রাজ্যের কৃষ্ণদেব রায় এই বাহমানি সাম্রাজ্যকে পরাজিত করে যার কারনে এই সাম্রাজ্য ভেঙে যায় পাঁচ ভাগে। যার কারনে ১৫৬৫ সালে এই পাঁচটি প্রদেশ একত্রে বিজয়নগর আক্রমন করেছিল। পাঁচটি ডেকান প্রদেশের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ছিল বিজাপুর যার শাসক ছিল আদিলশাহি বংশ। এই আদিল শাহি রাজত্বের প্রতিষ্ঠাতা ছিল ইউসুফ আদিল শাহ। এই আদিল শাহি বংশেরই সেনাপতি ছিল আফজল খান।

১৬৩০ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারী শিবনেরী দুর্গে জন্ম হয় ছত্রপতি শিবাজী মহারাজের। তার বাবা শাহাজী ভোঁসলে এবং মা জিজাবাই। ছোটবেলা থেকের তার মা তাকে রামায়ান মহাভারত শোনাতো। শাহাজি ভোঁসলে সেসময় পুনের জায়গিরদার ছিল যা বিজাপুরের সুলতান আদিল শাহের অধীনে ছিল। খুব অল্প বয়স থেকেই মারাঠা সাম্রাজ্যের স্বপ্ন দেখতেন শিবাজী মহারাজ যার কারনে ১৬৪৬ সালে মাত্র ১৬ বছর বয়সেই শিবাজি মহারাজ তোর্না দুর্গ বিজয় করেন। এর পরবর্তী দুই বছরের মধ্যে তিনি পুনের কাছে আরও বেশ কিছু দুর্গ জয় করেন, যার মধ্যে পুরন্দর, কোন্ধানা এবং চাকান দুর্গ উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও পূর্ব পুনের সুপা, বারামতি, ইন্দপুর এলাকা নিজের অধীনস্ত করেন। এরপর তিনি পশ্চিম কোঙ্কন উপকূলের দিকে কল্যান নামক গুরুত্বপূর্ন শহর জয় করেন। বিজাপুরের সুলতান এই খবর জানতে পেরে শিবাজী মহারাজের বাবা শাহাজি ভোঁসলেকে ১৬৪৮ সালের ২৫ জুলাই গ্রেফতার করেন। তবে একবছর পর তাকে ছেড়েও দেওয়া হয়। ১৬৪৯ থেকে ১৬৫৫ অবধি শিবাজী মহারাজ তার সাম্রাজ্য বিস্তার বন্ধ রাখেন। ১৬৫৬ সালে জাভেলি উপত্যকা বিজয়ের মাধ্যমে পুনরায় সাম্রাজ্য বিস্তার শুরু করেন তিনি। বর্তমান মহাবালেশ্বরের কাছেই অবস্থিত এই জাভেলি উপত্যকা। জাভেলি বিজয়ের পরই শিবাজী মহারাজ দক্ষিন এবং দক্ষিন পশ্চিম মহারাষ্ট্র বিজয় শুরু করেন। শিবাজী মহারাজের সাম্রাজ্য বিস্তারে ভীত হয়ে পড়ে বিজাপুরের আদিল শাহি রাজত্ব। ততদিনে আদিল শাহের মৃত্যু হয়েছে। বিজাপুরের শাসনভারের দায়িত্বে রয়েছে আদিল শাহের স্ত্রী বারি সাহেবা। তিনি সেনাপতি আফজল খানকে পাঠান শিবাজী মহারাজকে জীবিত অথবা মৃত যেকোনও অবস্থায় ধরে আনতে। আফজল খানের বিশ্বাস ছিল সে শিবাজী মহারাজকে বন্দী করতে পারবে কারন ৩৫,০০০ সেনার বিশাল সৈন্য বহর ছিল তার। আফজল খান খুবই শক্তিশালী ছিল, প্রায় সাড়ে ছয়ফুট উচ্চতার আফজল খান বিজাপুরের হয়ে অনেক যুদ্ধ জয় করেছিল। আফজল খানের সেনা প্রথমেই তুলজা ভবানী মন্দির এবং পান্ডাহারপুরের বিঠোবা মন্দির ধ্বংস করেন। এর মাধ্যমে আফজল খান শিবাজী মহারাজকে সামনে আনার চেষ্টা করছিলেন। শিবাজী মহারাজ গোরিলা যুদ্ধে পারদর্শী ছিলেন। তিনি জানতেন ৩৫,০০০ সেনার বিশাল সেনার সাথে তার ৭০০০ এর মারাঠা সেনার সমতলে লড়াই করা সম্ভব নয়। তাই তিনি প্রতাপগড় দুর্গে চলে যান। তিনি ঠিক করেন যুদ্ধ প্রতাপগড়েই হবে। প্রতাপগড় দুর্গ এমন ভাবে তৈরি এবং তার আশেপাশের উপত্যকার কারনে সেখানে সরাসরি সেনা অভিযান করা খুবই সমস্যার। আফজল খান প্রথমে ভেবেছিল শিবাজী মহারাজ হয়তো পুনেতে আছেন কিন্তু সেখানে গিয়ে তিনি জানতে পারেন শিবাজী মহারাজ প্রতাপগড় দুর্গে আছেন। আফজল খান নিজেও জানতেন প্রতাপগড় দুর্গে সরাসরি সেনা অভিযান প্রায় অসম্ভব। আফজল খানের কাছে বিশাল অশ্বারোহী সেনা ছিল কিন্তু প্রতাপগড় দুর্গ ঘেরাবন্দী করবার জন্য তা যথেষ্ট ছিলনা। দুই মাস ধরে অপেক্ষা করার পর আফজল খান কৃষ্ণাজী ভাস্কর নামে এক ব্রাহ্মন সহ কিছু লোককে চিঠি দিয়ে শিবাজী মহারাজের কাছে দূত হিসাবে পাঠায়। চিঠিতে আফজল খান জানায় শিবাজী মহারাজ যে সব দুর্গ জয় করেছে সেগুলো তার অধীনেই থাকবে শুধু তাকে বিজাপুরের অধীনে থাকতে হবে। এছাড়াও আফজল খান শিবাজী মহারাজের সাথে দুর্গের বাইরে আলাদা করে সাক্ষাৎ এর আর্জি জানায়। শিবাজী মহারাজ কৃষ্ণাজী ভাস্করকে দারুন অভ্যত্থনা জানান এবং যথেষ্ট সেবা যত্ন করেন। তবে শিবাজী মহারাজ সন্দেহ করেছিলেন আফজল খান হয়ত তাকে হত্যা বা গ্রেফতার করতে পারে কারন এর আগেও আফজল খান এধরনের কাজ করেছিলেন, ১৬৩৯ সালে এক রাজার সাথে আলোচনার সময়ে তার এই হাল করেছিল। ১০ নভেম্বর, ১৬৫৯ সালে প্রতাপগড় পাহাড়ের নীচে উভয়ে সাক্ষাৎ করেন। দেখা করবার নিয়ম ছিল উভয়ে মাত্র একজন লোককে নিয়ে আসবে সাথে করে এবং একটি মাত্র তরোয়াল থাকবে প্রত্যেকের কাছে। তবে শিবাজী মহারাজ পুরো প্রস্তত হয়ে গিয়েছিলেন, তিনি জামার ভিতর কবজ পরেছিলেন, বাম হাতে বাঘ নখ এবং ডান হাতে ছোরা নিয়ে গিয়েছিলেন। প্রতাপগড় পাহাড়ের নীচে বিশেষ তাঁবু তৈরি করা হয়েছিল উভয়ের সাক্ষাৎ এর জন্য। আফজল খানের কাছে হীরের তরোয়াল ছিল যা তাকে উপহার দিয়েছিল আদিল শাহ। আফজল খান সুযোগ বুঝে শিবাজী মহারাজের উপর ছুরিকাঘাত করে কিন্তু শিবাজী মহারাজের কবজ থাকায় ছুরির আঘাত লাগেনি। সাথে সাথে শিবাজী মহারাজ বাঘনখ বসিয়ে দেয় আফজল খানের পেটে। আফজল খানের দেহরক্ষী বাডা সৈয়দ শিবাজী মহারাজের উপর আক্রমন করতে আসে তরোয়াল দিয়ে কিন্তু শিবাজী মহারাজের দেহরক্ষী জিভা মহালা তাকে হত্যা করে। আহত অবস্থাতেও আফজল খান কোনও রকমে তাঁবুর বাইরে বেড়িয়ে পালকিতে বসে পড়ে। কিন্তু শিবাজী মহারাজের বিশ্বস্ত সেনাপতি সম্ভাজি কভজি কোন্ডালকর পীছু পীছু ধাওয়া করে আফজল খানের শিরচ্ছেদ করে। পরে কাটা মাথাটি মহারাজ শিবাজীর মা জিজাবাইকে দেখানোর জন্য রায়গড়ে পাঠানো হয়েছিল। তিনি দীর্ঘদিন ধরে আফজাল খানের বন্দী থাকাকালীন তার স্বামী শাহাজি রাজে ভোঁসলের সাথে দুর্ব্যবহার এবং তার বড় ছেলে সম্ভাজি শাহাজি রাজে ভোসলের মৃত্যুতে খানের ভূমিকার জন্য প্রতিশোধ চেয়েছিলেন। এরপরে শিবাজী মহারাজ একটি তোপ চালিয়ে তার লুকিয়ে থাকা সেনাকে আদেশ দেয় বিজাপুরী সেনার উপর আক্রমন করতে। প্রতাপগড়ের এই যুদ্ধে বিজাপুরের ৫০০০ এর বেশী সেনা নিহত হয়, যেখানে ১৭৩৪ মারাঠা সেনা বীরগতি প্রাপ্ত হন। এই যুদ্ধে শিবাজি মহারাজ বিজয়ী হন। এই যুদ্ধে প্রায় ৩০০০ বিজাপুরী সেনাকে বন্দী করা হয়, সাথে আফজল খানের দুই ছেলেকেও বন্দী করা হয়। এই যুদ্ধের পর শিবাজী মহারাজের নাম সমগ্র ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়ে। শিবাজী মহারাজ এতটাই মানবিক ছিলেন তিনি যুদ্ধ বন্দীদের উপর কোন অত্যাচার করেননি। কিছুদিন পর তাদের নিজ গৃহে ফেরত পাঠিয়ে দেন। শিবাজী মহারাজের মহানুভবতায় প্রভাবিত হয়ে সিদ্দি হিলাল এর মতোন আফজল খানের অনেক জেনারেল সহ সেনা শিবাজী মহারাজের হয়ে আনুগত্য স্বীকার করেন। প্রতাপগড় যুদ্ধের পর শিবাজী মহারাজের বিজয়রথ চলতেই থাকে যা ওনাকে ছত্রপতি হিসাবে বিখ্যাত করে দেয়।

আজকের মেক্সিকো অতীতে অ্যাজটেক সভ্যতা! মাত্র দুইবছরে এই সাম্রাজ্য ধ্বংস করে দিয়েছিল স্প্যানিশরা

সিন্ধু সভ্যতার ও মায়া সভ্যতার মতই এক বিশাল উন্নত সাম্রাজ্য ছিল অ্যাজটেক সভ্যতা। ইতিহাসে কোন সাম্রাজ্য এত তাড়াতাড়ি ভাঙেনি যত তাড়াতাড়ি অ্যাজটেক সাম্রাজ্য ভেঙে গেছিল। স্প্যানিশরা মাত্র দুইবছরে এই সাম্রাজ্য ধ্বংস করে দিয়েছিল। আজকের মেক্সিকো অতীতে অ্যাজটেক সভ্যতা ছিল। একটা সময় গোটা আমেরিকা ইউরোপীয়দের অধীনে ছিল, ইউরোপীয়ানরা আমেরিকার আদি জনগনদের পুরো ধ্বংস করে দিয়েছিল। আমেরিকার আসল অধিবাসী রেড ইন্ডিয়ান সহ অনেক ট্রাইবের মানুষ তাদের উৎখাত করে ইউরোপীয়ানরা। ১৩৪৫ সালে এই সাম্রাজ্য তৈরি হয় এবং ১৫১৯ সালে স্পেন এখানে আক্রমন করে। ১৫২১ সালের মধ্যে এই সাম্রাজ্য ধ্বংস করে দেয় স্পেন। হয়ত স্পেনের সাথে যুদ্ধে বেঁচেও যেত এই সাম্রাজ্য কিন্তু ইউরোপীয়ানরা তাদের সাথে যে ভয়ানক রোগ নিয়ে এসেছিল তার জন্য এই সাম্রাজ্যের অর্ধেক জনসংখ্যা ধ্বংস হয়ে যায়।

এব্যাপারেই বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।

মেক্সিকোতে তৈরি এই অ্যাজাটেক সাম্রাজ্য সম্পর্কে বলা হয় এখানকার অধিবাসীরা নোমাডিক বা যাযাবর প্রকৃতির। এইসব লোকেরা বিশ্বাস করত তারা অ্যাজটান ল্যান্ড থেকে এসেছে। কিন্তু ঐতিহাসিকদের মতে ১৩ শতকে মেসোপটেমিয়া থেকে এসে এরা এই সাম্রাজ্য তৈরি করে। এরকমই একটি যাযাবর সম্প্রদায় হচ্ছে মঙ্গোল সাম্রাজ্য। সাধারনত এই ধরনের সম্প্রদায়ের মানুষরা অত্যন্ত নৃশংস হয়। এরা যেখানে যায় সেখানকার অধিবাসীদের পুরো শেষ করে দেয়। তবে বলা হয় অ্যাজটেকরা যে শহর নির্মান করেছিল তা অত্যন্ত সুন্দর ছিল, দূর দূরান্ত থেকে লোক এখানে ব্যবসার জন্য আসত। অ্যাজটেক সাম্রাজ্যে তাদের উপাস্য ভগবানের জন্য অনেক সুন্দর সুন্দর মন্দির ছিল।

অ্যাজটেকরা পলিথিয়েস্টিক ছিল। যার অর্থ অনেক দেবদেবী ছিল তাদের। ধর্ম সাধারনত দুই ধরনের হয় পলিথিয়েস্টিক ও মনোথিয়েস্টিক। পলিথিয়েস্টিক মানে বহু দেব দেবীর উপসনা যেমন সনাতন ধর্ম, রোমান ও গ্রীক ধর্মে রয়েছে। মনোথিয়েস্টিক মানে একই পরাশক্তির ভক্ত যেমন ইসলাম, খ্রিষ্টান, ইহুদী ধর্ম। অ্যাজটেকদের প্রায় ২০০ উপাস্য দেব দেবী ছিল। তারা ভগবানকে টিওটেল নামে সম্বোধন করত। তাদের প্রধান দেবতার নাম ছিল ওমিশিহুয়াটাল যিনি দুজন মহিলা দেবী ছিলেন এবং ওমিশিসুঠিল যিনি দুজন পুরুষ দেবতা ছিলেন। তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী এরাই ছিলেন জগৎ এর সৃষ্টিকর্তা। তাদের দেবদেবীকে তিন ধরনের শ্রেনীতে বিভক্ত করা হয়। প্রথমত সূর্যের ও সমস্ত জীবিত প্রানীর দেবতা, দ্বিতীয়ত বিষ্টি ও কৃষিকাজের দেবতা, তৃতীয়ত যুদ্ধ ও ত্যাগের দেবতা।

অ্যাজটেকদের বিশ্বাস অনুযায়ী তারা এই জায়গায় এসে বসতি স্থাপন করেছে তাদের দেবতার নির্দেশ অনুযায়ী। তাদের সূর্যের দেবতা নির্দেশ দিয়েছিল এমন কোনো জায়গায় বসতি স্থাপন করতে যেখানে একটি বাজপাখির মুখে কোন প্রানী থাকবে এবং পাখিটি ক্যাকটাসের উপর বসে থাকবে। তারা সেই অনুযায়ী অনেক জায়গা খুঁজে এই জায়গাটা খুঁজে পায়। অ্যাজটেকরা বিশ্বাস করত তারা পঞ্চম সূর্যে বাস করছে। মানে আমাদের হিন্দু ধর্মে সময়কে চার যুগে ভাগ করা হয়েছে সত্য যুগ, ত্রেতা যুগ, দ্বাপর যুগ ও কলি যুগ। এখন কলি যুগ চলছে। তেমনি অ্যাজটেকদের বিশ্বাস অনুযায়ী এখন আকাশে পঞ্চম সূর্য রয়েছে। মানে এর আগে চারবার সূর্য সৃষ্টি হয়ে ধ্বংস হয়ে গেছে এটা পঞ্চম বার। তারা সেজন্য সূর্যকে খুশি করতে নরবলি দিত যাতে মানুষের রক্ত ও হৃদয় তাদের উপাস্য দেবতার উদ্দেশ্যে দেওয়া হত। ১৪৮৭ সালে অ্যাজটেক সাম্রাজ্যে গ্রেট পিরামিডে চারদিনের অনুষ্ঠানে প্রায় ১০,০০০-৮০,০০০ লোকের বলি দেওয়া হয়েছিল এতটাই নৃশংস ছিল এরা। তাদের প্রধান পাঁচ ধর্মগুরু যাকে বলি দেওয়া হবে তাকে কোনো উঁচু জায়গায় পাথরের টেবিলের উপর শুইয়ে জীবিত অবস্থায় তার হৃদপিন্ড কেটে বার করে নিত। তবে তার আগে যাকে বলি দেওয়া হবে তাকে ভাল খাওয়ানো হতো।

আরো পড়ুন- আজকের মেক্সিকো অতীতে অ্যাজটেক সভ্যতা! মাত্র দুইবছরে এই সাম্রাজ্য ধ্বংস করে দিয়েছিল স্প্যানিশরা- দ্বিতীয় খণ্ড

তাদের বিশ্বাস মতে সমগ্র জগৎ তিনভাগে বিভক্ত ট্যামোঅ্যানচ্যান বা পৃথিবী লোক যেখানে সবাই বাস করে, মিক্টল্যান যেখানে মৃত লোকেরা বাস করে যার নয়টি স্তর আছে এবং আকাশ লোক যার ১৩ টি স্তর আছে, একদম সর্বোচ্চ স্তরকে ওমিয়াকোন বলা হয়। আমরা যেমন জানি পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে ঘুরছে সেজন্য আবর্তন অনুযায়ী দিন রাত হয়। কিন্তু অ্যাজটেকদের মতে সূর্য অস্ত যাবার সময় মিক্টল্যানে চলে যায়। অ্যাজটেকদের সবচেয়ে বড় ও পবিত্র উৎসব ছিল জিওহোমলোপিলি যা ৫২ বছর অন্তর একবার হত। এখানকার ধ্বংসাবশেষ থেকে জানা গেছে এদের সবচেয়ে বড় উপাস্যালয়ের নাম ছিল টেম্পো মেয়োর।

আজকের মেক্সিকো অতীতে অ্যাজটেক সভ্যতা! মাত্র দুইবছরে এই সাম্রাজ্য ধ্বংস করে দিয়েছিল স্প্যানিশরা- দ্বিতীয় খণ্ড

অ্যাজাটেকদের রাজধানী ছিল তেনোচটেটল্যান, সেখান থেকে তারা গোটা মধ্য মোক্সিকো সহ বিস্তীর্ণ এলাকায় উন্নয়ন ও শাসন করত। অ্যাজাটেকরা নাহুটাল ভাষায় কথা বলত। এজন্য তাদের নাহুয়াও বলা হত। তবে অ্যাজটেক নাম দেওয়া হয়েছে উনবিংশ শতকে। এই সাম্রাজ্যের লোকেরা নিজেদের মেক্সিকা বলত, এরই উপর নির্ভর করে আজকের মেক্সিকো নাম এসেছে। অ্যাজাটেক মায়া সভ্যতার মানুষদের মতোই অ্যাজাটেকরা জ্যোর্তোবিজ্ঞানে অত্যন্ত পারদর্শী ছিল। তারা সূর্যের অবস্থান দেখে বলে দিতে পারত ভবিষ্যতে কী হবে, কোন সাম্রাজ্যের কখন পতন হবে।

আরো পড়ুন- আজকের মেক্সিকো অতীতে অ্যাজটেক সভ্যতা! মাত্র দুইবছরে এই সাম্রাজ্য ধ্বংস করে দিয়েছিল স্প্যানিশরা

এরকমই উদাহারন হচ্ছে মায়া সভ্যতা। মায়াদের ক্যালেন্ডার এতটা উন্নত ছিল যে ২০১২ পর্যন্ত ক্যালেন্ডার তারা তৈরি করে গেছিল। যার জন্য এটা নিয়ে অনেক আলোচনা হয়, সিনেমা তৈরি হয়৷ যেহেতু ২০১২ এর পর মায়া ক্যালেন্ডার পাওয়া যায়নি আর সেজন্য ধরে নেওয়া হয়েছিল এরপর পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। আসলে মায়ারা ২০১২ অবধিই ক্যালেন্ডার তৈরি করেছিল। অ্যাজটেকদের ক্যালেন্ডারও এমন উন্নত ছিল। সেখানে লেখা হয়েছিল ১৫২১ সালে এই সাম্রাজ্য ধ্বংস হয়ে যাবে এবং সেটাই হয়েছিল। অ্যাজটেক ক্যালেন্ডারে ১৮ মাস রয়েছে মানে এক মাসে ওদের হিসাবে ২০ দিন করে ছিল। তবে আরও একটি কথা অ্যাজটেকদের ক্যালেন্ডারে লেখা ছিল যে যখন সব কীছু শেষ হয়ে যাবে তখন ভগবান আসবে যার দাড়ি থাকবে যিনি অ্যাজটেকদের সমস্ত বিপদ থেকে উদ্ধার করবে।

স্পেন থেকে হেরনান করট্রেস বা হেরনান্দ করট্রেস যখন অ্যাজাটেক আক্রমন করতে আসে তখন সেখানকার লোক ভেবেছিল এই বোধহয় সেই ভগবান কিন্তু বাস্তবে হেরনান করট্রেস সবকীছু ধ্বংস করে দিয়েছিল। প্রধানত উত্তর মেক্সিকোয় অবস্থিত এই অ্যাজাটেক সাম্রাজ্যের একদিকে ছিল উত্তর আমেরিকা, কানাডা, অন্যদিকে ছিল দক্ষিন আমেরিকা। উত্তর আমেরিকার কিছু দেশ, কানাডা এবং ব্রাজিল বাদে প্রায় গোটা এলাকা স্পেন দখল করে নিয়েছিল। নির্মম ভাবে এখানকার অধিবাসীদের হত্যা করে স্পেন এবং তাদের সংস্কৃতিকে নষ্ট করে। ইউরোপীয়ানদের মধ্যে সবচেয়ে নৃশংস ছিল স্পেন ও ইংরেজরা। অ্যাজাটেককে ট্রিপল অ্যালায়েন্স বলা হত বা তিনটি শহরের মিলনস্থল। তেনোচটেটল্যান, ট্যাক্সোপেরোন ও টেক্সকোকো, যার মধ্যে তেনোচট্যাটলান সবচেয়ে বড় শহর ছিল এবং অ্যাজটেকদের রাজধানীও এটি। ১৪২৮ সালে এই শহর তৈরি হয়। যেমন আগে বলা হয়েছে যাযাবররা নৃশংস ছিল ঠিক তেমনি অ্যাজাটেকরা তাদের উপাস্যালয়ে নরবলি দিত। যদি খরা হত কিংবা বন্যা হত এরকম বিভিন্ন কারনে তারা আশেপাশের জঙ্গল থেকে ছোট ছোট সম্প্রদায়ের লোকেদের ধরে এনে বলি দিত। তবে একটা দুটো নয় বরং একসাথে কয়েকশো মানুষের বলি দেওয়া হত। ২০০৬ সালে মেল গিবসনে অ্যাপোক্লিপটো নামে একটি সিনেমা তৈরি করে যাতে অ্যাজাটেকদের ইতিহাস, নরবলি সবকিছু খুব ভালোভাবে দেখানো হয়েছে। এইসময় ইউরোপে শুরু হয় এজ অফ এক্সপ্লোরেশন যার অর্থ ইউরোপীয়ানরা বিভিন্ন দিকে জাহজ নিয়ে বেরিয়ে পড়ত যেখানে পৌঁছাত সেই দেশ দখলের চেষ্টা করত। যেমন ভাস্কো ডা গামা ভারত এসেছিল, ঠিক তেমনি ক্রিস্টোফার কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কার করে তারপরেই স্পেনকে অ্যাজাটেকদের ব্যপারে জানানো হয়। স্পেন আমেরিকা দখলের জন্য প্রথমে কিউবা দখল করে। কারন কিউবা আমেরিকার পাশেই অবস্থিত এবং এটি একটি বন্দর দেশ তাই এখান থেকে সহজে আমেরিকা আক্রমন করা যাবে জাহজে করে। ১৫০৩ সালে অ্যাজটেক সাম্রাজ্যের নতুন রাজা হয় মকতেজুমা যিনি ১৫০৯ অবধি রাজা ছিলেন, এইসময় তিনি অনেক শহর জিতে নেন।

১৫০৪ সালে হেরনান্দ করট্রেস ক্যারিবিয়ান দ্বীপে আসে। তখন হেরনান্দ স্পেনের একজন সাধারন সেনা ছিল তখনও কোন বড় পদ পায়নি। ১৫১১ সালে দিয়েগো ভেলাসকুইজকে কিউবার ভাইসরয় নিযুক্ত করা হয় এবং তাকে নির্দেশ দেওয়া হয় আমেরিকা দখল করতে। কিন্তু দিয়েগো ভেলাসকুইজ বহুদিন পর্যন্ত আক্রমনে যায়নি কারন তার কাছে আমেরিকা সম্পর্কে কোন তথ্যই ছিলনা। ফ্রান্সিসকো হেরনান্দেজ প্রথম কোন ইউরোপীয়ান ব্যাক্তি যে মেক্সিকোতে যায় প্রথম। ১৫১৭ সালে তিনটি জাহাজে করে ১০০ জন লোক নিয়ে সে মেক্সিকো যায়। ১৫১১ সালে দিয়েগো ভেলাসকুইজকে আদেশ দেওয়া সত্বেও সে আমেরিকা আক্রমন করছিলনা। সেজন্য হেরনান করট্রেস দিয়েগো ভেলাসকুইজকে না জানিয়েই কিছু সেনা নিয়ে মেক্সিকো চলে যায়। হেরনান করট্রেসের কাছে খুবই সেনা ছিল, সেই তুলনায় অ্যাজাটেকদের কাছে অনেক বেশী সেনা ছিল। অ্যাজাটেক সাম্রাজ্যে সবচেয়ে নীচু স্তরের লোকদের সার্ফ বলা হত। বিভিন্ন ট্রাইবের লোকদের জোর করে ধরে এনে অ্যাজাটেকরা তাদের দাস বানাতো, প্রয়োজনে বলি দিত, এদেরই সার্ফ বলা হত। এই সার্ফরা চাইত এই সাম্রাজ্য ধ্বংস হয়ে যাক, সেজন্য তারা হেরনান করট্রেসকে সাহায্য করে। ১৫১৯ সালে হেরনান করট্রেস অ্যাজটেক সাম্রাজ্যের টাবাসকো পৌঁছায়। সেখানে সে জানতে পারে অ্যাজটেক সাম্রাজ্যের রাজা তখন মকতেজুমা ২. হেরনান করট্রেস ও তার ৪০০ সেনা এরপর মেক্সিকোর আরও ভেতরে অ্যাজটেকদের রাজধানী তেনোচটেটল্যান অভিমুখে যাত্রা শুরু করে। যাবার পথে ছোট ছোট এলাকা জিততে শুরু করে তার সেনা। এদিকে মকতেজুমা ২ হেরনান করট্রেস সম্পর্কে খবর পেয়েছিলো কিন্তু সে ভেবেছিল বোধহয় ভগবান এসেছে তাদের জন্য সেইজন্য তার লোকের হেরনান করট্রেসকে স্বাগত জানানোর জন্য তৈরি ছিল। লা মালিনচি নামে এক মহিলা হেরনান করট্রেসের সেনার ট্রান্সলেটর হিসাবে কাজ করে। ওদিকে কিউবা থেকে দিয়েগো ভেলাসকুইজ সেনা পাঠায় করট্রেসের বিরুদ্ধে কারন না অনুমতি নিয়ে আক্রমন করার জন্য। সেজন্য অ্যাজটেক সাম্রাজ্য জেতবার জন্য করট্রেস ব্যাস্ত হয়ে পড়ে। তেনোচটেটল্যানে হেরনান করট্রেসকে অভ্যত্থনা জানানো হয়। কিন্তু সেখানকার স্থানীয় মানুষরা রাজার এই কাজকে একদম সমর্থন করেনি তারা বিদ্রোহ শুরু করে। বিদ্রোহের কারনে কীছুদিনের মধ্যেই মকতেজুমা ২ কে স্থানীয়রাই হত্যা করে। এরপর মকতেজুমা ২ এর ভাইপো কুয়াওটেমক সাম্রাজ্যের দায়িত্ব গ্রহন করে। কুয়াওটেমক রাজা হয়েই স্প্যানিশদের তার সাম্রাজ্য থেকে বের করে দেয়। কিন্তু স্প্যানিশদের শরীরে স্মল পক্সের মতো রোগ ছিল যা মহামারীর মতোন তেনোচট্যাটল্যানো ছড়িয়ে যার কারনে প্রায় ৪০ শতাংশ লোক বা ২,৪০,০০০ লোকোর মৃত্যু হয়।

রাজা কুয়াওটেমকও এই রোগে আক্রান্ত হয়। এই সুযোগে হেরনান করট্রেস তেনোচট্যাটল্যানে আক্রমন করে। ওদিকে কিউবা থেকে আসা সেনা ও স্থানীয় মানুষরাও করট্রেসের সাথে যোগ দেয়। ১৫১৯ সালে অ্যাজটেকদের সাথে স্প্যানিশদের যুদ্ধ শুরু হয় এবং ১৫২১ সালের ১৩ আগস্ট পুরো অ্যাজটেক সাম্রাজ্য হেরনান করট্রেস জিতে নেয়, নারকীয় ধ্বংসলীলা চালানো হয়েছিল। স্পেন যখন এই খবর পায় তখন করট্রেসকে বিশেষ সম্মান দেওয়া হয় এবং মেক্সিকোর ভাইসরয় হিসাবে নিযুক্ত করা হয়। আমেরিকাতে স্পেনের কলোনাইজেশনের এটাই ছিল প্রথম পদক্ষেপ। এর পরবর্তী ২০০ সালের মধ্যে ইউরোপীয়ানরা আমেরিকাতে তাদের কলোনী তৈরি করে। ১৫৪৭ সালে মৃত্যু হয় হেরনান করট্রেসের।

ধর্ষণ করে খুন! ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে প্রথম শনাক্ত করা হয়েছিল যে অপরাধীকে

গোটা পৃথিবীতে বিভিন্ন ধরনের অপরাধ হয়ে থাকে। সেই সকল অপরাধের শাস্তিও হয় ভিন্ন ধরনের। বিভিন্ন তদন্ত ও এভিডেন্সের উপর ভিত্তি করে একজন তদন্তকারী অপরাধীকে শনাক্ত করে। তবে Colin Pitchfork’ছিল প্রথম ব্রিটিশ আসামী যাকে শনাক্ত করা হয়েছিল সর্বপ্রথম ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে। এই দাগী আসামিকে টেস্ট করার পর থেকেই ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে আসামিদের ধরার বিষয়টা প্রচলিত হয়েছিল। তাহলে একটু খোলসা করে বলা যাক এই দাগি আসামীর বিষয়ে। কে ছিল এই Colin Pitchfork’ এবং কি ছিল তার অপরাধ?

জানা চায় ১৯৮৩ সালের এক নভেম্বর মাসে ১৫ বছরের নাবালিকা Lynda Mann-র মৃত অবস্থায় জঙ্গলের ভেতর থেকে উদ্ধার করে এলাকাবাসী। এরপরই পুলিশ গোটা ঘটনা তদন্ত করেও এর অপরাধীকে ধরতে সক্ষম হয়নি।

মূলত নাবালিকাকে ধর্ষণ করেই খুন করা হয়েছিল। এরপরই ধর্ষণকারীর সিমেন স্যাম্পেল সংগ্রহ করলেও আসল অপরাধীকে ধরতে পারেনি পুলিশ।

আরো পড়ুন- মাত্র ১৭ মিনিটের পুরো অপারেশন সম্পন্ন! বিশ্বের প্রথম দশ এলিট ফোর্সের মধ্যে অন্যতম স্যাসের অপারেশন নিমরোড

পরবর্তীতে একইভাবে জঙ্গলের মধ্যে থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল আরো এক ১৫ বছরের নাবালিকা Dawn Ashworth-র মৃতদেহ। সেই নাবালিকার ময়না তদন্ত করেও প্রকাশ্যে এসেছিল তাকেও ধর্ষণ করে খুন করা হয়েছে। এই ঘটনাটা আগের ঘটনার থেকে তিন বছর পর অর্থাৎ ১৯৮৬ সালের জুলাই মাসে ঘটেছিল। একইভাবে দুজন কিশোরীর ধর্ষণ করে খুন করার ঘটনায় নড়েচড়ে বসেছিল ব্রিটিশ পুলিশ।

পরবর্তীতে পুলিশ তদন্ত নেমে মৃতদেহ উদ্ধারে ঘটনা সংলগ্ন এলাকায় মাইকিং করে প্রচার করেছিল যে সকল পুরুষ তাদের লালা রস এবং রক্তের স্যাম্পেল থানায় জমা করুক। তবে আশ্চর্যের বিষয় ছিল যে শহরের প্রত্যেকটা মানুষ সেই স্যাম্পেল থানায় জমা করলেও মূল অপরাধের সঙ্গে কোনোভাবেই ম্যাচ খাচ্ছিল না। রীতিমত ধোঁয়াশায় পরে গিয়েছিল গোটা শহরের পুলিশ।

এরপর আনুমানিক প্রায় ১৯৮৭ সালের সেপ্টেম্বর মাস নাগাদ Ian Kelly’ নামের এক ব্যক্তি থানায় এসে রিপোর্ট করেছিল যে একটি বারে একজন মধ্যম যুবককে তিনি বলতে শুনেছিলেন তার এক বন্ধু তাকে ২০০ পাউন্ড দিয়েছিল তার লালারস এবং রক্ত স্যাম্পেল থানায় জমা করার জন্য। পরবর্তীতে ওই ব্যক্তির তথ্যের উপর ভিত্তি করেই আসল অপরাধীকে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ। অভিযুক্তকে জেরা করেও যখন সে সত্য স্বীকার করছিল না তার রক্তের স্যাম্পেল নিয়ে টেস্ট করতেই মিলে গেছিল। এরপরই ১৯৮৮ সালের ২২শে জানুয়ারি দুই নাবালিকাকে ধর্ষণ করা অপরাধে অভিযুক্তকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের নির্দেশ দিয়েছিল আদালত। তবে দীর্ঘ ৩০ বছর সাজা ভোগ করার পর Colin Pitchfork, কোর্টের অনুমতি নিয়ে ২০১৭ সাল নাগাদ ৬ ঘন্টা জন্য বাইরে বেরোনোর সুযোগ পেয়েছিলেন। যদিও এরপরে তিনি বাইরের প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে পেয়েছিলেন কিনা সেই নিয়েও রয়েছে যথেষ্ট ধোঁয়াশা।

মাত্র ১৭ মিনিটের পুরো অপারেশন সম্পন্ন! বিশ্বের প্রথম দশ এলিট ফোর্সের মধ্যে অন্যতম স্যাসের অপারেশন নিমরোড

সালটা ১৯৭৮, ইরানে শাহ মহম্মদ রেজার শাসন। এই সময় ইরান প্রাশ্চাত্য সংস্কৃতির দিকে ঝুঁকে পড়ছিল কিন্তু সাথে সাথে দেশে ঘটে চলা একের পর এক দূর্নীতির বিরুদ্ধেও সরব হতে শুরু করেছিল। শাহ মহম্মদ রেজার এই পশ্চিমী প্রীতি মেনে নিতে পারছিলনা ইরানেরই বেশ কিছু মানুষ। ফলে শাহ মহম্মদ রেজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের হার বাড়তে শুরু করে। কয়েকলাখ মানুষ বিদ্রোহ শুরু করে এবং ক্রমশ হিংসা বাড়তে শুরু করে এই বিদ্রোহ। প্রায় ষাট হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছিল এই বিদ্রোহে। এই বিদ্রোহের নাম ইরানিয়ান রেভোলিউশন যার নেতা ছিল রাহোল্লাহ খোমেনী। এই বিদ্রোহ ইরানের পহলভী বংশের শাসক শাহ মহম্মদ রেজাকে ফেব্রুয়ারী ১৯৭৯ তে ক্ষমতাচ্যুত করে থামে এবং ইরানের নতুন শাসক হয় রাহোল্লাহ খোমেনী যে ইরান থেকে পশ্চিমা সংস্কৃতিকে সরিয়ে দেয়।

আরো পড়ুন- আগামী দশকে মঙ্গলে বসতি স্থাপনে কী কী সমস্যা রয়েছে?

ইরানের হওয়া এই বিদ্রোহের প্রভাব সুদূর লন্ডনেও ছড়িয়ে পড়ে। ৩০ এপ্রিল, ১৯৮০ লন্ডনের দক্ষিন ক্যানিংস্টনে প্রতিদিনের মতোই ব্যাস্ত ইরানের দূতাবাস। আচমকা ছয়জন লোক বন্দুক হাতে দূতাবাসে ঢুকে পড়ে, খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তারা দূতাবাসের থাকা ২৬ জনকে বন্দী করে ফেলে, তবে তিনজন লোক কোনও রকমে পালিয়ে যায়। এই ছয়জন ব্যাক্তি ডেমোক্রেটিক রেভোলিউশোনারি ফ্রন্ট ফর দি লিবারেশন অফ আর্বিস্তানের সদস্য ছিল। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে শুরু হয় অপারেশন নিমরোড। কি করে ব্রিটিশ সরকার এই ২৬ জন বন্দীকে বাঁচালো? এবং অপারেশন নিমরোড সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।

৩১ মার্চ, ১৯৮০ ওয়েন আলি মহম্মদ নামে এক ব্যাক্তি ইরাকি পাসপোর্ট নিয়ে লন্ডনে আসে। লন্ডনে পৌঁছেই পশ্চিম লন্ডনে একটি বাড়ি ভাড়া নেয় সে। ওয়েন আলি মহম্মদ এর বয়স ২৭ বছর, ইরানের কুজিস্তানের বাসিন্দা ছিল। তার সাথে আরও তিনজন লোক এসেছিল। ওয়েন আলি মহম্মদ ইরানের তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে রাজনীতিতে যোগ দেয়। ওয়েন আলি ইরানের ৩১ টি প্রদেশের মধ্যে একটি কুজিস্তানের স্বাধীনতার পক্ষে রাজনীতি শুরু করেছিল যার জন্য ইরানের পুলিশ তাকে ও তার সঙ্গী সাথীদের গ্রেফতার করে এবং তাদের উপর প্রচুর অত্যাচার করা হয়, যার কারন ওয়েন আলি ইরানের উপর ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল। কুজিস্তান প্রদেশে স্বল্প সংখ্যায় আরবী মানুষরা বাস করত, এরাই আলাদা দেশ চাইছিল। এই এলাকায় প্রচুর তেল পাওয়া যায়, যার জন্য এই এলাকা ইরানের জিডিপির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন। ওয়েন আলিকে গ্রেফতার করেছিল সাবাক নামে এক গোপন পুলিশ সংস্থা ইরানের, যারা শাহ মহম্মদ রেজার হয়ে কাজ করতো। একমাস ধরে লন্ডনে সমস্ত পরিকল্পনা করে ৩০ এপ্রিল সকাল সাড়ে নটার সময় ওয়েন আলি বাড়ির মালিককে চাবি ফেরত দিয়ে বলে তারা এক সপ্তাহের জন্য ব্রিস্টল যাচ্ছে সেখান থেকে তারা ইরাক ফিরে যাবে। এর দুই ঘন্টা পর ওয়ান আলি ও তার পাঁচজন সদস্য ইরানের দূতাবাসে পৌঁছে সবাইকে বন্দী করে ফেলে। বন্দী সবাইকে দূতাবাসের দ্বিতীয় তলায় রেখে পুরো বাড়িকে তাদের নিয়ন্ত্রনে নিয়ে আসে তারা। কিছুক্ষনের মধ্যেই ব্রিটশ পুলিশ পুরো এলাকাকে ঘিরে ফেলে। একজন সন্ত্রাসী দূতাবাসের জানালা দিয়ে পুলিশের দিকে গুলি চালায় ফলে পুলিশ বাধ্য হয় পিছিয়ে আসতে। ওয়েন আলি ও তার সঙ্গীরা পুলিশকে তাদের দাবী জানায়, তাদের বক্তব্য ছিল কুজিস্তানকে ইরান থেকে আলাদা করতে হবে সেখানে কুজিস্তান সরকারের শাসন হবে এবং সেখানকার জেলে বন্দি থাকা তাদের ৯১ জন সাথীকে মুক্তি দিতে হবে। সন্ত্রাসীরা এটাও জানায় তাদের ইংল্যান্ড থেকে নিরাপদে বেরোনোর পথ করে দিতে হবে। এর জন্য তারা ব্রিটিশ সরকারকে ১ মে দুপুর অবধি সময় দেয় এর মধ্যে তাদের দাবী পূরোন না হলে তারা গোটা বাড়ি বোম্ব দিয়ে উড়িয়ে দেবে সাথে সব বন্দীকে মেরে ফেলবে এটাও জানায়। এদিকে ইরানের সরকার এই ঘটনার পুরো দায় ব্রিটিশ ও আমেরিকান সরকারের উপর চাপিয়ে দেয় এবং তারা ব্রিটেনের সাথে কোনওরকম সহযোগিতায় রাজি হয়না। সন্ত্রাসীরা বিকেল সাড়ে চারটে নাগাদ ফ্রেডা নামে এক প্রেগন্যান্ট মহিলাকে ছেড়ে দেয়। ওয়েন আলি ও তার সঙ্গী সাথীদের প্রশিক্ষন দিয়েছিল ইরাক, ইরানের বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য কারন সেবছরই ইরাক ইরান যুদ্ধ শুরু হয়েছিল।

ব্রিটিশ ক্যাবিনেট বৈঠকে এই সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অভিযানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, এর দায়িত্ব দেওয়া হয় স্যাসের হাতে। স্যাস বা স্পেশাল এয়ার সার্ভিস ব্রিটিশ সেনাবাহিনীরই একটি ভাগ, যারা ব্রিটেনের স্পেশাল ফোর্সের অন্তর্গত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই বাহিনী তৈরি করা হয়েছিল। ৩০ এপ্রিল গভীর রাতেই স্যাসের দুটি দল হেলিকপ্টারে করে ইরানিয়ান দূতাবাসের কাছে একটি বাড়িতে আসে এবং সম্ভাব্য অপারেশনের পরিকল্পনা করতে থাকে। ১ মে সকালে ওয়েন আলি বিবিসির সাথে যোগাযোগ করে আশ্বাস দেয় তাদের ইরানিয়ান ব্যাতীত কোন ব্যাক্তির সাথে শত্রুতা নেই, সেই দিনই বেলা সাড়ে এগারোটা নাগাদ ক্রিস নামে এক ব্যাক্তিকে ছেড়ে দেওয়া হয় সে বিবিসিরই লোক ছিল কিন্তু শারীরিক অসুস্থতার জন্য তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। এদিকে সেইদিন রাতে ইরানিয়ান দূতাবাসের পাশের দেওয়ালেই ইথিওপিয়ান দূতাবাসের দেয়ালে ছিদ্র করে ব্রিটিশ পুলিশ যাতে সারভিল্যান্স ডিভাইস ইনস্টল করা যায় ইরানিয়ান দূতাবাসের ভিতরে। ২ এপ্রিল ওয়েন আলি ব্রিটিশ পুলিশকে নির্দেশ দেয় কিছু আরবিক দেশের সাথে কথা বলতে যাতে তারা নিরাপদে সেখানে যেতে পারে। ব্রিটিশ সরকার লেবানন, জর্ডন, সিরিয়া, কাতার, কুয়েতের দূতাবাসের সাথে যোগাযোগ করে। এদিকে স্যাস ততক্ষনে গোটা দূতাবাসের পুরো নকশা খুঁটিয়ে দেখে দূতাবাসের সামনের দরজা স্টিলের এবং নীচের তলার জানলা গুলো বুলেটপ্রুফ। এই দিক দিয়েই দূতাবাসে ঢোকার পরিকল্পনা করে তারা। ৩ মে, ওয়েন আলি আবারও ব্রিটিশ পুলিশের সাথে যোগাযোগ করে যত দ্রুত সম্ভব তাদের দাবী পূরন করার কথা বলে, বিবিসি ওয়েনের দাবী আবারও সম্প্রচার করে। ৪ মে, ব্রিটিশ সরকারের সাথে আরব দেশ গুলোর প্রতিনিধিদের সাথে জরুরী বৈঠক হয় যাতে আরব প্রতিনিধিরা জানায় তারা ওয়েন ও তার সাথীদের নিরাপদে অন্য জায়গায় পৌঁছে দিতে প্রস্তত কিন্তু ব্রিটিশ সরকার জানায় তারা কোনওমতেই কোন সন্ত্রাসীকে ফিরতে দেবেনা। এদিকে স্যাস তাদের অপারেশনের পূর্নাঙ্গ পরিকল্পনা করে ফেলেছিল ততক্ষনে। যতদিন যেতে থাকে ওয়েন ও সাথী দের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙতে থাকে। ৫ মে সকালে ওয়েন আলি পুলিশকে জানায় আগামী ৪৫ মিনিটের মধ্যে তার দাবী পূরন করা না হলে সে একজন কে হত্যা করবে। ঠিক দূপুর ১ঃ৪৫ নাগাদ আব্বাস নামে এক বন্দীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এই ঘটনার পরই স্যাসকে অপারেশন শুরু করার নির্দেশ দেয় ব্রিটিশ সরকার। সন্ধ্যা ৭ঃ২৩ এ স্যাসের দুটি দল অপারেশন নিমরোড শুরু করে। স্যাসের সমস্ত কম্যান্ডো দল দুটি ভাগে ভাগ হয়ে যায় রেড টিম ও ব্লু টিম। রেড টিমের কম্যান্ডোরা ছাদ থেকে দড়ি দিয়ে দ্বিতীয় তলার জানলার কাছে এসে জানলা ভেঙে বাড়িতে ঢোকে, অন্যদিকে ব্লুটিম নীচের তলার জানলা গ্রেনেড দিয়ে উড়িয়ে বাড়িতে ঢোকে। স্যাস কম্যান্ডোরা প্রথমেই ওয়েন আলিকে হত্যা করে। এরপর একে একে পাঁচজন সন্ত্রাসীকে হত্যা করে স্যাস। একজন সন্ত্রাসী বন্দীদের সাথে বাইরে যাবার পরিকল্পনা করেছিল, স্যাস তাকেও হত্যা করে। তবে একজন সন্ত্রাসীকে তারা গ্রেফতার করে এবং আজীবন কারাবাসের শাস্তি হয় তার, ২৮ বছর জেলে থাকার পর ২০০৮ সালে এই ব্যাক্তি মুক্তি পায়। অপারেশন নিমরোড ইতিহাসের সবচেয়ে সফল অপারেশন গুলোর মধ্যে একটি। মাত্র ১৭ মিনিটের মধ্যে স্যাস পুরো অপারেশন সম্পন্ন করেছিল। মোট ৩৫ জন কম্যান্ডো অংশ নিয়েছিল এতে। বিশ্বের প্রথম দশ এলিট ফোর্সের একটি হল ব্রিটিশ স্পেশাল ফোর্সের অন্তর্গত স্যাস।

আফ্রোদিতি : সৌন্দর্য ও ভালবাসার দেবী। গ্রীক মাইথোলজি ইলিয়াড কি বলছে?

গ্রীক পুরাণ অনুযায়ী ভালোবাসা সৌন্দর্য এবং চিরযৌবনের দেবী ছিলেন আফ্রোদিতি। যার জন্ম কাহিনী নিয়ে রয়েছে বহু মতামত। হেসিয়ডের ‘THEOGONY’অনুযায়ী তাঁর জন্ম হয়েছিল সাইপ্রাস দ্বীপের পেফোসের জলের ফেনা থেকে এবং তাঁর পিতা ছিলেন ইউরেনাস। আবার, হোমারের ‘ইলিয়াড’ অনুযায়ী জিউস এবং ডিয়নের কন্যা ছিলেন আফ্রোদিতি৷ আফ্রোদিতি ছিলেন অপূর্ব সুন্দরী। যার রূপে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে নিয়ে দেবতাগন নিজেদের মধ্যে বিবাদে জড়িয়ে পড়তেন৷ এইজন্য জিউস আফ্রোদিতির সাথে হেপাইসটাসের বিবাহ দিয়েছিলেন। কারন হেপাইসটাস ছিলেন অসুন্দর মুখাবয়ব ও বিকলাঙ্গ যার জন্য তার কোন প্রতিদ্বন্দী ছিলো না। তবে আফ্রোদিতিদের বিবাহ হেপাইসটাস সঙ্গে হলেও তাঁর প্রচুর প্রেমিক ছিলো৷ যেমন যুদ্ধের দেবতা এরেস৷ তবে শুধুমাত্র দেবতারাই নয় মানুষও সেই তালিকার মধ্যে ছিল।

আরো পড়ুন- আগামী দশকে মঙ্গলে বসতি স্থাপনে কী কী সমস্যা রয়েছে?

আফ্রোদিতি তার পুত্র ঈরোস এবং সাইকির প্রমকাহিনীতে একটি বড় ভূমিকা ছিল।

আফ্রোদিতি সম্পর্কে কিছু তথ্য:

১. ভালবাসা, সৌন্দর্য ও জননের দেবী হিসাবে পরিচিত ছিলেন আফ্রোদিতি ৷

২.তার জন্ম নিয়ে প্রচলিত রয়েছে দুইটি কাহিনী ৷ একটি হল হেসিয়ডের ‘THEOGONY’ অনুযায়ী তাঁর জন্ম হয়েছিল সাইপ্রাস দ্বীপের পেফোসের জলের ফেনা থেকে এবং তাঁর পিতা ছিলেন ইউরেনাস। এবং অপরটি হল, হোমারের ‘ইলিয়াড’ অনুযায়ী জিউস এবং ডিয়নের কন্যা ছিলেন আফ্রোদিতি৷

৩. আফ্রোদিতির বিবাহ হেপাইসটাসের সাথে হওয়া সত্ত্বেও হেপাইসটাসের সংকল্পের সাথে কখন তাঁর মনের ইচ্ছের মিল হয়নি।

৪. হারমোনিয়া নামের এক সন্তানের জন্ম দিয়েছিল আফ্রোদিতি এবং এরেস। যে হেরেডোটাসকে বিয়ে করেছিল ৷

৫. হারমাফ্রোদিতাসেরও মা ছিলেন আফ্রোদিতি, তবে হেরমেস ছিলেন তার এই সন্তানের পিতা।

৬. জিউসের ইউরোপা নামক এক মানুষের প্রেমে পড়ার পিছনে হাত ছিল আফ্রোদিতি এবং তাঁর পুত্র ঈরেসের।

৭. আফ্রোদিতি ছিলেন এডোনিসের সৎ মা। তবে এডোনিসের জন্মের পর আফ্রোদিতির মনে মনে বাসনা ছিল এডোনিসকে পাওয়ার। এরপর এডোনিসকে ভালবেসে ফেলেন সে৷ সে এডোনিসের দেখভালের দ্বায়িত্ব দিয়েছিলো পারসিফোনিকে। তবে এডোনিসের প্রেমে পারসিফোনি নিজেও পড়ে গিয়েছিলো, এবং তাকে ফেরত দিতে চাইছিলো না৷ এই অবস্থায় জিউস আসেন তাদের মধ্যে মধ্যস্থতায় করার জন্য। তিনি আদেশ দেন যে দুই জনের সাথেই থাকবে এডোনিস। এক বছরে অর্ধেক সময় অতিবাহিত করতে হবে আফ্রোদিতির সাথে বাকি অর্ধেক অতিবাহিত করতে হবে পারসিফোনির সাথে৷

৮. তার চিত্রে তার বাহন হিসেবে দেখা যায় এক ধরনের রাজহাঁস। যেটি হাওয়ায় ভেসে চলত৷

৯. ট্রোজান যুদ্ধের কথা আমরা সবাই জানি। জানা যায় যে এই যুদ্ধের পিছনে দায়ী ছিল প্যারিসের বিচারকার্যের ফলাফল। কারন একসময় আফ্রোদিতি, হেরা, এথেনা এই তিন জনের মধ্যে একটি প্রতিযোগী ছিল কে সবচেয়ে সুন্দরী? সে পাবে একটি স্বর্ণের আপেল। জিউসকে এই প্রতিযোগীতার বিচারকার্য পরিচালনা করা দায়িত্ব নেন না। তখন এই প্রতিযোগিতার বিচারকের দায়িত্ব নেন ট্রয় নগরের রাজার পুত্র প্যারিস। এই প্রতিযোগিতায় প্যারিস আফ্রোদিতির পক্ষে রায় দিয়েছিলেন৷

১০. প্যারিসের পক্ষে থেকে আফ্রোদিতি লড়াই করেছিলেন ট্রোজান যুদ্ধের সময়।

আগামী দশকে মঙ্গলে বসতি স্থাপনে কী কী সমস্যা রয়েছে?

সভ্যতার আদিকাল থেকেই মহাকাশ মানুষের কাছে চির রহস্যময়। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে মহাকাশ অভিযানের চিন্তাভাবনা শুরু হয়। আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নই ছিল এইসব অভিযানের নেতৃত্বে। মানব ইতিহাসে বিগত পঞ্চাশ বছরে বিজ্ঞানের সর্বাধিক উন্নতি হয়েছে, সাথে পাল্লা দিয়ে শক্তিশালী দেশ গুলোর মহাকাশ অভিযানের আগ্রহ আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। আমেরিকা, রাশিয়া, ভারত, চীন, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, ইসরায়েল সহ বিশ্বের প্রথম সারির একাধিক দেশ আজ ভিন্ন ভিন্ন মহাকাশ মিশন করছে। এখনও পর্যন্ত মহাকাশ অভিযানে পৃথিবীর সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ সংস্থা হচ্ছে আমেরিকার নাসা। ভারতের মহাকাশ গবেষনা সংস্থা ইসরোর নামেও মহাকাশ অভিযানের ক্ষেত্রে একাধিক কৃতিত্ব আছে।

তবে আজ মহাকাশের ইতিহাস কিংবা কোন দেশের মহাকাশ গবেষনা সংস্থা নিয়ে কথা বলা হবেনা বরং মহাকাশে হিউম্যান স্পেশ মিশনের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করা হবে।

আমেরিকার নাসা এর আগে মঙ্গলের মাটিতে রোভার পাঠিয়েছে। ইসরোও মঙ্গল অভিযান মিশন করেছে এর আগে কিন্ত মঙ্গল গ্রহে আজ পর্যন্ত কোন মহাকাশচারী যেতে পারেনি। মঙ্গলে মহাকাশচারী পাঠানোর প্রথম ধাপ হিসাবে নাসা আর্টেমিস মিশন করছে, ইসরো চাঁদে চন্দ্রযান ৩, চীন ছ্যাঙ্গ এবং রাশিয়া লুনা ২৫ মিশন পাঠাবে। তবে বাকী সবের থেকে নাসার আর্টেমিস প্রজেক্ট অনেকটা আলাদা। এই প্রজেক্টে নাসা চাঁদে মহাকাশচারী পাঠাবে সাথে সাথে নাসা এই প্রজেক্টের মাধ্যমে মঙ্গলে মানুষ পাঠানোর গেটওয়ে তৈরি করতে চাইছে। মঙ্গল গ্রহে মানুষের কলোনী তৈরি করবার কথা ইতিমধ্যেই জানিয়েছে আমেরিকার স্পেশএক্স সংস্থার মালিক ইলন মাস্ক। ইতিমধ্যেই মহাকাশ গবেষনার ক্ষেত্রে একটি খুব গুরুত্বপূর্ন ধাপ শুরু হয়েছে তা হচ্ছে মহাকাশ ভ্রমন। শুধু চাঁদ, মঙ্গলই নয় অন্যান্য গ্রহে মানুষের বসতি স্থাপনের উপযুক্ত পরিবেশের খোঁজ চলছে প্রতিনিয়ত। তবে এসব মিশন প্রযুক্তিগত ভাবে অত্যন্ত জটিল এবং প্রচুর ব্যায়বহুল। আগামী এক দশকের মধ্যে অন্য কোন গ্রহে মানুষ পাঠানো হয়ত সম্ভব হবে কিংবা মঙ্গলে মানুষের বসতি স্থাপনও অদূর ভবিষ্যতে করা হয়ত সম্ভব হবে কিন্ত বর্তমানে বেশ কিছু সমস্যা আছে মহাকাশ অভিযানে। এই বিষয়েই বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।

মহাকাশ অভিযানের ক্ষেত্রে বেশ কিছু সমস্যা আছে। প্রথমত মহাকাশ মিশনের ক্ষেত্রে খরচ একটি বড় সমস্যা। বিশ্বজুড়ে বেশকিছু দেশের মহাকাশ গবেষনায় বাজেট ২০২২-২৩ এ একটু কম হয়েছে কারন ২০১৯ থেকে চলা কোভিড -১৯ এবং সম্প্রতি হওয়া রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধে বিশ্বের আর্থিক ব্যাবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তেলের দাম বেড়েছে এবং মুদ্রাস্ফীতি হয়েছে যার প্রভাব দেখা গেছে মহাকাশ গবেষনার বাজেটে। তবে আমেরিকা ও চীনের ক্ষেত্রেই ততটা প্রভাব না পড়লেও, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, জার্মানির মহাকাশ গবেষনায় বাজেট কিছুটা হলেও কমেছে। তবে ইসরোর বাজেট মোটামুটি একই আছে। আমেরিকান কংগ্রেসে সম্ভবত নাসার বাজেট একটু কমাবে। স্পেশ স্টেশন আরও একটি প্রধান সমস্যা। এতদিন পর্যন্ত মহাকাশ অভিযানের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রাখত আন্তর্জাতিক স্পেশ স্টেশন। আইএসএস বা আন্তর্জাতিক স্পেশ স্টেশন নিম্ন পৃথিবী কক্ষপথে অবস্থিত একটি বড় স্যাটেলাইটের মতো। এটি আয়তনে একটি ফুটবল মাঠের মতোন। বিশ্বের পাঁচটি দেশের মহাকাশ সংস্থা আমেরিকার নাসা, রাশিয়ার রসকসমস, জাপানের জাক্সা, ইউরোপের ইএসএ এবং কানাডার সিএসএ যৌথভাবে এটি তৈরি করেছে। এই পাঁচটি দেশ ছাড়াও আরও পনেরোটি দেশ যুক্ত আছে এতে। তবে চীনকে এখানে যুক্ত করা হয়নি। মহাকাশ অভিযানে যাওয়া মহাকাশচারীদের ঘর এটা। এখানে পদার্থবিদ্যা, মহাকাশ বিজ্ঞান, মেট্রোলজি নিয়ে গবেষনা করার সাথে সাথে ভবিষ্যতে চন্দ্র অভিযান ও মঙ্গল অভিযানের মহাকাশযানের বিভিন্ন প্রযুক্তি পরীক্ষার কাজ করা হয়।

২০৩১ সালে নাসা আইএসএসকে অবসরে পাঠাবে। প্রশান্ত মহাসাগরের পয়েন্ট নিমো অঞ্চলে এই আইএসএস এর ধ্বংসাবশেষ পড়বে। চীনকে আইএসএস থেকে দূরে রাখার জন্য চীন নিজেই নিজের জন্য স্পেশ স্টেশন তৈরি করেছে। চীনের এই স্পেশ স্টেশনের নাম তিয়ানগং যাতে গতবছরই তিনজন মহাকাশচারীকে পাঠিয়েছিল চীন। এই কারনে মহাকাশ অভিযানে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে। বিংশ শতকে মহাকাশ অভিযান নিয়ে প্রতিযোগিতা হয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আমেরিকার মধ্যে যাতে সোভিয়েত ইউনিয়ন মহাকশে প্রথম মানুষ পাঠিয়েছিল ইউরি গ্যাগারিন। আমেরিকা চাঁদে প্রথম মানুষ পাঠিয়েছিল নীল আর্মস্ট্রংকে। যদিও এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে অনেক বিতর্ক আছে। তবে আমেরিকার এই চাঁদে মানুষ পাঠানোর ঘটনাকে বাদ দিলে এই প্রতিযোগিতায় সোভিয়েত ইউনিয়নই বিজয়ী হয়েছিল। একবিংশ শতাব্দীতে আবারও আমেরিকা ও চীনের মধ্যে মহাকাশ অভিযানে প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। যাদিও নাসার তুলনায় চীনের মহাকাশ সংস্থার বাজেট অনেক কম তবুও প্রযুক্তিগত এবং আর্থিক দিক দিয়ে চীন ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। বিভিন্ন দেশের বেসরকারী মহাকাশ সংস্থাও এগিয়ে এসেছে মহাকাশ অভিযানে। আমেরিকার ইলন মাস্কের স্পেশ এক্সের স্টারশিপ বিশ্বের প্রথম চাঁদকে প্রদক্ষিন করার মহাকাশ ভ্রমনকারী রকেট। ব্রিটিশ ধনকুবের রিচার্ড ব্রানসনের ভার্জিন গ্যালাকটিকও একটি বেসরকারি মহাকাশ ভ্রমন সংস্থা। তবে ভার্জিন গ্যালকটিকের একবার মহাকাশ ভ্রমনে যাত্রীপতি খরচ ৪,৫০,০০০ ডলার বা ভারতীয় মুদ্রায় তিন কোটি ষাঠ লাখ টাকা। অ্যামাজনের মালিক জেফ বেজোসের ব্লু অরিজিন নামেও একটি সংস্থা রয়েছে। তবে বিশ্ব আর্থিক মন্দা থেকে বেসরকারী সংস্থা গুলোও বাদ যায়নি।

২০২২ সালে বেসরকারী সংস্থাগুলোতে বিনিয়োগ কমেছে ৫৮ শতাংশ! ২০২২ সালে বেসরকারী মহাকাশ সংস্থা গুলোতে বিনিয়োগ হয়েছে মাত্র কুড়ি বিলিয়ন ডলার যা ২০১৫ সালের পর সর্বনিম্ন। মহাকাশ অভিযানে তৃতীয় যে সমস্যা আসতে চলেছে তা হচ্ছে স্পেশ ডার্বি বা স্যাটেলাইট, রকেটের ধ্বংসাবশেষ। ব্যাপরটা ভালোভাবে বলা যাক। ২০০০ সালে ৮০০ স্যাটেলাইট লঞ্চ করা হয়, ২০২১ সালে সংখ্যাটা এসে দাঁড়িয়েছে ৫০০০! আগামী কয়েক বছরে আরও কয়েক হাজার স্যাটেলাইট লঞ্চ করা হবে যার কারনে স্যাটেলাইটদের মধ্যে সংঘর্ষ হলে একটার পর একটা স্যাটেলাইট ধ্বংস হতে থাকবে। কেসলার নামে এক বিজ্ঞানী এই কথা প্রথম জানিয়েছিল বলে একে কেসলার সিনড্রোম বলা হয়। একবার স্যাটেলাইট ধ্বংস হয়ে গেলে স্যাটেলাইট ফোন, স্যাটেলাইট ইন্টারনেট, জিপিএস সিস্টেম, আবহওয়ার খবর জানা যাবে না, টিভি দেখা যাবে না। চতুর্থ সমস্যা হচ্ছে আউটার স্পেশ আইন।

১৯৬৭ সালে এই আইন তৈরি হয়েছিল যা এখনও চলছে। কিন্তু এই আইনে বেসরকারি সংস্থা, ধনকুবেরদের সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি, সেজন্য দাবি উঠেছে এই আইন সংশোধন করার। সুতরাং ভবিষ্যতে কোন বড় মহাকাশ অভিযানের ক্ষেত্রে এইসব সমস্যা দূরীকরনে দেশগুলোকে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব দূরে সরিয়ে রেখে একসাথে কাজ করতে হবে। তবেই হয়ত অন্য গ্রহে মানুষ পাঠানো কিংবা মঙ্গলে বসতি স্থাপনের মতন বড় বড় প্রজেক্ট সফল হবে।

‘ইউরোপীয়দের চোখে পাল্কী’

রানা চক্রবর্তীঃ ইউরোপীয়দের দৃষ্টিতে পাল্কী নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে শুরুতেই একটি কাহিনী কল্পনা করা যাক। আঠারো শতকের কলকাতা। নবাগত এক ইংরেজ-নন্দন জাহাজ থেকে নেমে চৌরঙ্গীতে এসে দাঁড়ালেন। তারপরে নেশার ঘোরে রাঙা চোখ দুটি দিয়ে কোন রকমে একটা ল্যাম্পপোষ্টে ভর দিয়ে পথের দিকে চেয়ে দেখলেন; এবং যা দেখলেন তাতে তাঁর নেশা ছুটে যাওয়ার দাখিল হল। তিনি দেখলেন যে, সামনের রাস্তা সার বেঁধে কফিন নিয়ে শব-বাহকের দল ছুটে চলেছে। দেখতে দেখতে পাঁচ মিনিটের মধ্যে ছ’টি কফিন সেই রাস্তা দিয়ে পার হয়ে গেল। তিনি ভাবলেন, কলকাতায় কোন ‘এপিডেমিক’ লেগেছে নাকি? তবে সেটা যে কোন মহামারী ছিল না, সেই তত্ত্ব তিনি অবশ্য কয়েক মিনিট পরেই বুঝতে পেরেছিলেন। নেশার ঝোঁকে যেটাকে তিনি কফিন বলে ভেবেছিলেন, পরে জেনেছিলেন সেটারই নাম হল পাল্কী। তাতে জ্যান্ত মানুষকেই বহন করা হয়, আর একমাত্র ধনী লোকেরাই ওই বিচিত্র যানটির আরোহী হতে পারেন। সেকালে ইউরোপ থেকে কোন এক নবাগত ইংরেজ যুবকের দৃষ্টি বিভ্রমকে অবলম্বন করে ‘চারিভরি’তে উপরোক্ত কল্প-কাহিনীর কার্টুনটি প্রকাশিত হয়েছিল।

বেকন বিলেতে থাকতে জনসনের ডিক্সনারীতে পাল্কী শব্দের অর্থ দেখেছিলেন – ‘Indian Sedan’; এবং তারপরে ভারতে এসে তিনি যখন প্রথমবারের জন্য পাল্কী প্রত্যক্ষ করেছিলেন, তখন জনসনের বাপান্ত করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেন নি। বেকন তাঁর লেখায় ভারতীয় পাল্কীকে – “barbarous method of locomotion” – বলে অভিহিত করেছিলেন। ‘চার্লস গ্রান্ট’ তাঁর লেখায় তখনকার পাল্কী নিয়ে আরও অপ্রিয় সত্য ফাঁস করে দিয়ে লিখেছিলেন, “সাহেবদের মধ্যে প্রায় প্রত্যেকেই প্রথমবার পাল্কী চড়তে গিয়ে অপ্রস্তুত হতেন। যেখানে পা রাখতে হয় সেখানে মাথা রাখতেন, আর মখমল আঁটা যে জায়গাটিতে পিঠ ঠেকাবার নিয়ম, সেখানে পা রাখতেন।”

আরো পড়ুন-

অন্যান্য যানের মত পাল্কীও নানাবিধ বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে অগ্রসর হয়েছিল। ‘লিনসোটেন’ তাঁর গ্রন্থে ১৫৯৮ সালের প্রচলিত পাল্কীর একটি ছবি দিয়েছিলেন। সেটার পোশাকী নাম যাই হোক না কেন, সেটা আসলে বাঁশে ঝোলানো একটা চৌপাই ছাড়া আর কিছুই ছিল না। ‘হ্যাডলী’ সাহেব সেই চৌপাইকে ‘বেড প্যালাঙ্কিন’ বলেছিলেন। তাঁর মতে ওই পাল্কী দু’রকমের ছিল – ‘চেয়ার পাল্কী’ ও ‘বেড পাল্কী’। চেয়ার পাল্কী অনেকটা সিডান চেয়ারের মত দেখতে ছিল। সেটা তখন একমাত্র কলকাতা শহরেই চলত। আর বেড পাল্কী ছিল কোচের মত বেশ সুন্দর গদী-আঁটা। দূর পাল্লার যাত্রায় সেই পাল্কী খুব জোরে যেতে পারত। সম্ভবতঃ সেই কারণেই ‘উইলিয়মসন’ সেটাকে ‘ফ্লাই-প্যালাঙ্কি’ বলে অভিহিত করেছিলেন। তবে ওগুলোকে চারপাই বা পাল্কী, যাই বলা হোক না কেন, সেগুলির খুব বাহার ছিল। আঠারো শতকের শুরু থেকে সেগুলোর গায়ে অলঙ্করণ করা শুরু হয়েছিল। তখনই সেগুলোর চারটি পায়ে পিতলের তবক আঁটা হয়েছিল, আর কোচের দুই হাতার সম্মুখের দিক তক্ষণ করে বাঘ বা কুমীরের মুখ আঁকা শুরু হয়েছিল। এছাড়া বর্ষার সময়ে যাত্রী যাতে ভিজে না যান, সেটার জন্য বাঁশের ফ্রেম বানিয়ে মোম মাখানো কাপড় আঁটা হয়েছিল। প্রথম দিকে ওগুলির পায়া খুব বড় ছিল, সেজন্য যাত্রীকে তখন মাটি থেকে বেশ একটু উঁচুতে উঠে সেগুলোর মধ্যে বসতে হত। পরবর্তী কালে সেগুলোর পায়া ছোট করা হয়েছিল, আর মাথার উপরটাও আর নিরাবরণ রাখা হয়নি। যাত্রী যাতে বেশ একটু আরামে হাত পা ছড়িয়ে বসতে পারেন সেজন্য ভিতরে যথেষ্ট জায়গার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। উইলিয়মসনের বিবরণ অনুসারে সেগুলি চওড়ায় সাড়ে চার ফুট ছিল।
তখন যাঁদের অবস্থা কিছুটা ভাল ছিল, তাঁরা নিজেদের বাড়িতে দু’রকমের পাল্কী রাখতেন। সেগুলোর মধ্যে একটি নিত্য ব্যবহার্য ছিল, আর দ্বিতীয়টি কোন বিশেষ উৎসব উপলক্ষে ব্যবহার করা হত। সেকালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর অফিসারেরা দেশীয় রাজন্যদের সঙ্গে টেক্কা দিয়ে নিজেদের জন্য পাল্কী তৈরি করাতেন। তাঁদের পাল্কীর সাজগোজ রীতিমত দেখবার মত ছিল। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে যে, কোম্পানীর ১৭১৬ সালের ১২ই জুন তারিখের ‘কন্সালটেসনে’ বলা হয়েছিল, “পুরাতন তিনটি পাল্কী অব্যবহার্য হয়ে পড়ায় সেগুলির যাবতীয় রূপার সাজ ওজন করে বিক্রী করে দেওয়া হোক।” আঠারো শতকের শেষের দিকটা বঙ্গদেশে বেড পাল্কীর স্বর্ণ যুগ ছিল। ঊনিশ শতকের শুরুতেই সেই জায়গায় ‘মহন্না’ দেখা দিয়েছিল। ১৮১০ সালে উইলিয়মসন ১৮১০ সালে লিখেছিলেন, “বেড পাল্কী এত সেকেলে হয়ে গিয়েছে যে, ইউরোপীয়ানরা কেউ আর সেটা ব্যবহার করেন না। এখন প্রায় সবাই মহন্না ব্যবহার করেন। মহন্নার চারটি পায়া, উচ্চতা মাটি থেকে এক ফুট। উচ্চতা এমন যাতে একটি প্রমাণ আকারের মানুষ খাড়া হয়ে তাতে বসতে পারেন। অর্থাৎ, তিন থেকে সাড়ে তিন ফুট, লম্বায় ছ’ ফুট, চওড়ায় দুই থেকে আড়াই ফুট।” মহন্না যাতে বেশী ভারী না হয়, সেজন্য তাতে কম কাঠ ব্যবহার করা হত, বেত ও বাঁশের ব্যবহারই বেশী ছিল। সেটির দু’ পাশে অনেকটা জায়গা দরজা হিসাবে ব্যবহারের জন্য খালি রাখা হত। বাকীটুকুর মধ্যে নিম্নাংশের পাতলা কাঠের ও উপরাংশের ভেনেসিয়ান কাঁচের আবরণ থাকত। বসবার জায়গায় গদী আঁটা থাকত, এবং চারদিকে সাদা রঙের দেওয়াল ছিল। এছাড়া সেটির দু’ পাশে দুটি সেলফ, একটি ছোট আয়না, চিরুণী, হয়ত টুকিটাকী আরও কিছু জিনিস রাখবার জায়গা থাকত। গরমকালে সেটির খোলা দরজায় খস ঝুলিয়ে দেওয়া হত। সেই খস সর্বদা ভিজে রাখবার জন্য দু’জন ভিস্তিওয়ালা পাল্কীর দুই পাশে জল নিয়ে ছুটতেন।

তবে তখনকার সবচেয়ে রাজকীয় পাল্কীর নাম ছিল ‘নোলকি’। তবে ইউরোপীয়দের মধ্যে কেউই নিজের লেখায় সেটার কোন বর্ণনা দেননি, শুধুমাত্র নাম উল্লেখ করেছিলেন। সম্ভবতঃ নবাবেরাই সেগুলি ব্যবহার করতেন। তখনকার সাহেব-মহলে সবচেয়ে বেশী ব্যবহৃত হয়েছিল ‘বোচা’ বা চেয়ার পাল্কী। মেমসাহেবরা তো হামেশাই বোচা ব্যবহার করতেন। দূরে কোথাও যাত্রার সময়ে সাহেবরাও বোচা পছন্দ করতেন; কারণ, বোচা খুব সরু পথ দিয়েও চলতে পারত, এবং তাতে বাহক কম লাগত। তবে দু’জন যাত্রী হলে তখন ‘তাঞ্জাম’ ব্যবহার করা হত। বোচা ও তাঞ্জামের অঙ্গসজ্জা রীতিমত দেখবার জিনিস। একটা রথের উপরে সিডান চেয়ার বসালে যেমন দেখতে হয়, বোচাও তেমনি দেখতে ছিল; আর তাঞ্জাম ছিল পাহাড়ী-পথের ঝাঁপানের মত। ইউরোপীয়ানরা তাঞ্জাম কম ব্যবহার করলেও, সবাই সেটার সাজ-সজ্জার প্রশংসা করেছিলেন।
১৭৮০-তে হ্যাডলী লিখেছিলেন, “The palanquin is so necessary an article at Calcutta that even European artificers keep them.” কিন্তু যতই ‘নেসেসারী’ হোক না কেন, কোম্পানীর লণ্ডনস্থ ডিরেক্টররা নিম্নস্তরের কর্মচারীদের পাল্কী ব্যবহারে বাদ সেধেছিলেন। তাঁদের কাছে সামান্য বেতনের রাইটারদের পাল্কী ব্যবহার করাটা বিলাসিতা মাত্র ছিল। ১৮৫৪ সালে রাইটারদের ঘোড়া চেয়ার বা পাল্কীর খরচ বন্ধ করবার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। তবে রাইটাররা কিন্তু সেই আদেশ নিঃশব্দে মেনে নেন নি, তাঁরা লণ্ডনে ডিরেক্টরদের কাছে ওই আদেশ পুনর্বিবেচনার জন্য আবেদন জানিয়েছিলেন। যতদিন পর্যন্ত সেই আবেদনের জবাব না আসে, ততদিন পর্যন্ত কলকাতার স্থানীয় কর্তৃপক্ষ রাইটারদের পাল্কী ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছিলেন। বলা বাহুল্য যে, তখন ভারত থেকে লণ্ডনের অফিসে কোন আবেদনপত্র পাঠালে, সেখান থেকে সেটার জবাব আসতে কমপক্ষে এক বছর সময় লেগে যেত। তাই একবছর পরে সেই বিষয়ে কোম্পানির জবাব এসেছিল। তাঁরা জানিয়েছিলেন যে, রাইটারদের পাল্কী ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া কিছতেই সম্ভব নয়। কারণ, কোম্পানির কর্মচারীদের বিরুদ্ধে মাঝে মাঝে অসাধু উপায়ে অর্থ উপার্জনের যে অভিযোগ পাওয়া যায়, তাঁদের পাল্কী ব্যবহারের দ্বারা সেই অভিযোগের সত্যতাই প্রমাণিত হয়। তবে লণ্ডনের ডিরেক্টররা অনুমতি না দিলেও কোম্পানির কর্মচারীরা কিন্তু পাল্কীর ব্যবহার চালিয়ে গিয়েছিলেন, এবং তাতে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের যে কোন মৌনসম্মতি ছিল না – এমনটা কিন্তু নয়। শেষে ১৮৫৮ সালে কোম্পানির ডিরেক্টররা রাইটারদের পাল্কীর ব্যবহার নিয়ে চরম হুকুমনামা পাঠিয়েছিলেন, “… no writer whatsoever be permitted to keep either palanquin, horse or chaise, on pain of being immediately dismissed from our service.” কিন্তু সেবারেও কোম্পানির আগের আদেশের মতোই ওই আদেশেও কেউ কর্ণপাত করেন নি। অবশ্য তখন সেটার কোন প্রয়োজনও ছিল না। কারণ তার বহু আগেই কলকাতার রাস্তার নতুন একটি চক্রযানের অভ্যুদয় ঘটেছিল। লর্ড হেস্টিংসের আমল থেকেই কোম্পানির কর্মচারীরা একটু একটু করে পাল্কী ছেড়ে ‘কেরাঞ্চি’ গাড়ি ব্যবহার করতে শুরু করেছিলেন। এরপরে সেই ব্যবহার ব্যাপকভাবে শুরু হয়েছিল।

‘বিশপ হেবার’ ঊনিশ শতকের কলকাতার (১৮২৪-২৫) ইউরোপীয়দের বিলাসিতার বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছিলেন, “তাঁরা এমন পাল্কী ব্যবহার করেন যেটার দাম তিনশো টাকা। আগে নাকি এক একটি পাল্কী তিন হাজার টাকা দামেও বিক্রি হয়েছিল!” ঊনিশ শতকের প্রথম দিকেও কলকাতায় পাল্কীর পরাক্রম অব্যাহত ছিল। সাহেবরা তখন পাল্কী চড়ে যেতে যেতে বাহকের কণ্ঠে পাল্কীর গান শুনতেন। একবার এক সাহেবের সেই গানের মর্মার্থ জানবার জন্য খুব আগ্রহ হয়েছিল। এবং সব শুনে তাঁর চক্ষুস্থির হয়ে গিয়েছিল। ‘ডিউয়ার’ সাহেব গানটি সংগ্রহ করে অনুবাদ করেছিলেন –
“Oh what a heavy bag.
No, it is an elephant.
He is an awful weight.
Let us throw his palki down.
Let us set him in the mud.
Let us leave him to his fate.
Aye, but he will hit us then with a thick stick.
Then let us make haste and get along
… Hop along quickly.”
চার্লস গ্রান্ট ঊনিশ শতকের কলকাতায় পাল্কী রাখবার খরচ সম্পর্কে বিস্তৃত তথ্য দিয়েছিলেন। তাঁর সময়ে, অর্থাৎ ১৮৪০ সালে, একটা ঠিকা পাল্কীর ভাড়া ছিল মাসিক ২৫ টাকা; অবশ্য তখন বাড়িতে পাল্কী রাখলে মাসিক ৩৫ টাকা খরচ হত। সেই সময়ে সাহেবরা খুব কমই ভাড়া পাল্কী ব্যবহার করতেন। তখন প্রাইভেট পাল্কীর বেহারারা ‘রব্বানি’ হলে ছ’জন লাগত, আর ‘উড়িয়া’ হলে পাঁচজন লাগত। রব্বানীরা ছ’জনই পাল্কীর সঙ্গে ছুটতেন, কিন্তু উড়িয়ারা পাঁচজনে পাল্কীর সঙ্গে ছুটতেন, আর একজন সঙ্গীদের আহার্য বহন করতেন। সেই সময়ে একজন ঠিকা বেহারার দৈনিক ভাড়া ছিল পাঁচসিকে; সেটার মধ্যে পাল্কী ভাড়া ছিল চার আনা, আর বাকী এক টাকা সকলের মধ্যে বণ্টিত হত। ঠিকা পাল্কী সারা দিনের জন্য ভাড়া নিতে হত। বাহকদের নিজস্ব বলে কোন পাল্কী ছিল না। গ্রান্টের সময়ে কলকাতার রাস্তায় ঘোড়ার প্রাধান্য খুবই বেশী ছিল। সেজন্য নিজের লেখায় পাল্কীর নাম তিনি সব শেষে উল্লেখ করেছিলেন। তাঁর সময়ে কলকাতায় পাল্কী-বাহকের সংখ্যা ছিল এগারো হাজার পাঁচশো জন। সেই বিপুল সংখ্যক বাহকদের তিনি কর্মান্তরে নিয়োগ করবার জন্য কাউন্সিলের কাছে প্রস্তাব করেছিলেন। মানুষকে পশুর মত ব্যবহৃত হতে দেখে তাঁর অন্তর ব্যথিত হয়ে উঠেছিল। ভারতের পাল্কী প্রসঙ্গে ‘John De Couteur’ লিখেছিলেন, “It must be acknowledged that no man of consequence ever makes use of his legs, or goes out of his house but in his palanquin, the ladies are carried in a kind of sedan chair and the gentlemen on little couches six feet long and two feet broad, which in summer has generally a covering scarlet and in a rainy season, one of oiled cloth, they are lined with silk and well stuffed with cotton.”

(তথ্যসূত্র:
১- Charles Grant And British Rule In India.
২- Letters Chiefly From India, John De Couteur.
৩- Memoir of a Cadet, A Bengalee.
৪- The Life and Writings of Bishop Heber: The Great Missionary to Calcutta, the Scholar, the Poet, and the Christian; Reginald Heber.)

যে সার্জন নিজেই তাঁর সার্জারি করেছিলেন!

১৯৬১ সালের ২৯ শে এপ্রিল, Dr. Leonid Rogozov সাধারন দূর্বলতা, বমি বমি ভাব ও মাঝারি ধরণের জ্বর এবং এবডোমেনের ডান পাশের সামান্য নিচু অংশে ব্যাথা অনুভব করেন। কিন্তু দুঃখজনকভাবে তখন সম্ভাব্য সকল কনসারভেটিভ ট্রিটমেন্ট কোন ভালো ফল বয়ে আনতে পারেনি।

এদিকে ৩০শে এপ্রিল, ধীরে ধীরে তাঁর লোকালাইজড পেরিটোনাইটিসের সকল লক্ষণসমূহ স্পষ্টত প্রকাশ পেতে থাকে এবং সন্ধ্যা নাগাদ অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকে।
তখন সবচেয়ে কম দূরত্বে থাকা “মিরনি” নামক সোভিয়েত রিসার্চ স্টেশনও Novolazarevskaya থেকে প্রায় ১,৬০০ কি.মি. দূরত্বে ছিলো। অন্যান্য দেশের এন্টার্কটিক রিসার্চ স্টেশনেও তখন একটি এয়ারক্রাফট ছিলনা। তাছাড়া তখন মারাত্মক তুষারঝড়ের কারণে যেকোন বিমানের অবতরণা বাধাগ্রস্থ করেছিলো।
ডাঃ রোগোজভ তখন নিজের উপর অপারেশন করা ছাড়া আর কোন উপায় দেখলেন না।

বিখ্যাত সেই অপারেশনটি হয়, ৩০শে এপ্রিল দুপুর ২ টার দিকে। তাঁর চালক ও একজন আবহাওয়াবিদের সহায়তায় শুরু হয়েছিল, যারা যন্ত্রাদি সরবরাহ করছিলেন এবং সরাসরি দৃশ্যমান নয় এমন অংশগুলো পর্যবেক্ষণ করার জন্য একটি আয়না ধরে রেখেছিলেন।

যখন Dr. Rogozov, semi-reclining পজিশনে ছিলেন তিনি তার বামপাশের দিকে অর্ধেক ঘুরে যান। আর এবডোমিনাল ওয়ালে লোকাল এনেস্থিসিয়া হিসেবে তখন ০.৫ % নোভোকেইন সলিউশন ব্যবহার করেন। Dr. Rogozov তখন প্রায় ১০-১২ সে.মি. এর একটা ইনসিশন করেন এবং আস্তে আস্তে এপেন্ডিক্সকে খুঁজে বের করেন।

অপারেশন শুরুর প্রায় ৩০-৪০ মিনিট পরে আবারো তাঁর সাধারণ দুর্বলতা এবং বমি বমি ভাব শুরু হতে থাকে যার ফলে কিছু সময়ের জন্য অল্প অল্প করে বারংবার বিশ্রামের প্রয়োজন পরেছিল।

তাঁর প্রতিবেদন অনুসারে এপেন্ডিক্সের গোড়ায় ২ x ২ সেমি ছিদ্র হয়েছিলো বলে জানা যায়। পরে এন্টিবায়োটিকগুলি পেরিটোনাল গহ্বরে সরাসরি প্রয়োগ করা হয়েছিল। প্রায় মধ্যরাতের মধ্যেই তাঁর অপারেশন শেষ হয়েছিল।

অপারেশনের অল্প সময় পর কিছু সময় ধরে দুর্বলতায় ভুগলেও, পেরিটোনাইটিসের লক্ষণগুলি ধীরে ধীরে ভালো হয়ে যায়। এদিকে Dr. Rogozov এর তাপমাত্রা পাঁচ দিন পরে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে এবং অপারেশনটির সাত দিন পরে স্টিচগুলো সরানো হয়।
তিনি প্রায় দুই সপ্তাহের মধ্যে পুনরায় তাঁর নিয়মিত দায়িত্ব শুরু করেন।

“বিশ্বের শ্রেষ্ঠ কুটনীতিবিদ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এবং হনুমানজী”- জয়শঙ্কর! মহাভারত ও বর্তমান সময়ের বিশ্বরাজনীতির মধ্যে মিল

ভারতের বিদেশমন্ত্রী এস জয়শংকর কে এই মহূর্তে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদেশমন্ত্রী বলা হয়। সম্প্রতি একটি সাক্ষাৎকারের কারনে তিনি ভাইরাল হয়ে গেছেন। সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন তাঁর কাছে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ কুটনীতিবিদ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এবং ভগবান হনুমানজী। তিনি হনুমানজীর লঙ্কা অভিযানের উদাহারনও দিয়েছেন। তিনি আরও বলেন যদি অন্য কোনও ভারতীয়কে জিজ্ঞেস করা হয় বিশ্বের শ্রেষ্ঠ কুটনৈতিক বইয়ের কথা, তাহলে বেশীরভাগই ম্যাকিয়েভেলির দি প্রিন্সের উদাহারন দেবে কিন্ত তাঁর মতে মহাভারত বিশ্বের শ্রেষ্ঠ কুটনৈতিক বই যাতে বর্তমান বিশ্বের বিশ্বরাজনীতি সম্পর্কে সবচেয়ে ভালো ব্যাখা রয়েছে। বর্তমান বিশ্বরাজনীতিতে একাধিক শক্তি রয়েছে, যাদের বেশীরভাগই পরস্পরের বিরোধী।

যার কারনে শক্তির ভারসাম্য বজায় রাখা খুবই সমস্যার এখন। বর্তমান বিশ্বের পরিস্থিতির সাথে ভারতের মহাভারতের সময়ের সাথে মিল রয়েছে। বর্তমান বিশ্বের রাজনৈতিক সংকট ঠিক যেন মহাভারতের কুরুক্ষেত্রের ময়দান। পশ্চিমি কুটনীতিকে যেমন ম্যাকিয়াভেলির দি প্রিন্স এবং চীনের কুটনীতিকে থ্রি কিংডমসের মাধ্যমে জানা যায় ঠিক তেমনি ভারতের কথা বললেই প্রথমেই মহাভারতের কথা আসে। ডঃ এস জয়শংকরের দি ইন্ডিয়া ওয়ে বইয়ের একটি বিভাগ কৃষ্ণাস চয়েসে মহাভারতের সাথে বর্তমান পরিস্থিতির মেলবন্ধন তুলে ধরেছেন তিনি।

আরো পড়ুন- অতিমানবীয় ক্ষমতা। ভবিষ্যত দেখা ও টেলিপ্যাথির ক্ষমতা অর্জন। আমেরিকার গোয়েন্দাদের রহস্যময় প্রজেক্ট

২৮ জানুয়ারি, ২০২৩, পুনেতে এস জয়শংকের বই দি ইন্ডিয়া ওয়ে স্ট্রাটেজিস ফর এন আনশার্টেন ওয়ার্ল্ডের মারাঠি সংস্করন ভারত মার্গ প্রকাশিত হয়। এই অনুষ্ঠানে তিনি দ্রুত পরিবর্তিত হওয়া বিশ্বরাজনীতিতে ভারতের বৈদেশিক নীতি আলোচনা করেন। ভারতের বিদেশ নীতি কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনস্থ। বেশীরভাগ দেশরই বৈদেশিক নীতি দেশটির কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনেই থাকে। ভারতের মতো বিশাল দেশের বিদেশ নীতি শুধু দেশটির রাজধানী কেন্দ্রিক হয়না। এস জয়শংকর জানান যদি উত্তর ভারতের কোন ব্যাক্তিকে প্রাচীন ভারতীয় নৌবাহিনী সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয় তাহলে সে হয়ত ততটা নাও জানতে পারে। কিন্তু এই একই প্রশ্ন যদি ভারতের দক্ষিন উপকূলের কোন রাজ্যবাসীকে করা হয় সে গৌরবের সাথে ভারতীয় নৌবাহিনী সম্পর্কে জানাবে। অর্থাৎ ভারতের বিদেশনীতি তৈরির ক্ষেত্রে প্রত্যেকটি রাজ্যের গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা আছে। এস জয়শংকরের মতে বিদেশনীতি শুধু দেশের সীমান্ত থেকে শুরু হয়না বরং আমাদের সবার ঘর থেকেই শুরু হয় এবং ঘরে এসেই শেষ হয়। এর জন্য তিনি কোভিড ১৯ মহামারী ও রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের উদাহারন দিয়েছেন, এই দুটি ঘটনাই ভারতের বাইরে তৈরি হয়েছে কিন্তু এর প্রভাব আমাদের সবার উপরেই পড়েছে।

ভারতের বৈদেশিক নীতির একটি গুরুত্বপূর্ন অংশ হচ্ছে বিশ্বায়ন। বিগত কয়েক বছরে পশ্চিমা বিশ্বের বানিজ্যের একটি বড় অংশ চীনের উপর নির্ভর ছিল। কিন্তু কোভিড-১৯ এর ফলে বড় ধাক্কা খেয়েছে চীন। সেজন্য পশ্চিমাবিশ্ব চীন+১ নীতি নিয়েছে, এটাই ভারতের জন্য সবচেয়ে বড় সুযোগ। এর জন্য ভারতকে তার নিজস্ব উৎপাদন ক্ষমতা, শিল্প, কৃষি, প্রযুক্তি, ম্যানেজমেন্ট এবং জনবলকে সঠিক ভাবে ব্যবহার করতে হবে। এস জয়শংকর ভারতের উন্নতির মাপকাঠিকে ছয়টি ভাগে ভাগ করেছেন। প্রথমে রয়েছে আত্মনির্ভরতা বা মেক ইন ইন্ডিয়া। কোভিশিল্ড, কোভ্যাক্সিন এর মতোন করোনা ভ্যাকসিনের ভারতে ব্যাপক উৎপাদন, আইফোনের উৎপাদন ভারতে হওয়া এবং ভারতীয় অস্ত্রে বিদেশী দেশ গুলোর আগ্রহ প্রমান করছে ভারত কত দ্রুত আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠছে। দ্বিতীয় ধাপ হচ্ছে আত্মবিশ্বাস। কোন দেশকে বিশ্বগুরু হয়ে উঠতে গেলে তাকে সব দেশের সাথেই সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হবে, তবেই সেই দেশ সুপার পাওয়ার হয়ে উঠবে। বর্তমানে ভারত শুধু দেশের মানুষই নয় বরং বিদেশেও যেকোন পরিস্থিতিতে সাহায্য করছে। যেমন করোনা মহামারীর সময়ে উহানে যাওয়া ভারতীয় বিমান ভারতীয়দের পাশাপাশি বিদেশীদেরও উদ্ধার করে। তুরস্কের ভূমিকম্পের উদ্ধার কার্যেও ভারত সহায়তা করেছে। বসুধাইবা কুটম্বকম ও জনকল্যান ভারতের মূল লক্ষ। এভাবে এই বই প্রকাশ অনুষ্ঠানে এস জয়শংকর ভারতের বিদেশনীতি সম্পর্কে কিছু বক্তব্য বলেন কিন্ত যে কথাটা সবচেয়ে বেশী আলোচিত হচ্ছে তা হল মহাভারত নীতি।

ডঃ এস জয়শংকরের বই দি ইন্ডিয়া ওয়ের তৃতীয় বিভাগের নাম কৃষ্ণাস চয়েস, দি স্ট্রাটেজিক কালচার অফ এ রাইজিং পাওয়ার এর শুরুতে লেখা আছে যে জাতি তার অতীতকে সম্মান করেনা তার কোন ভবিষ্যত নেই। ডঃ জয়শংকর তার নীতি তৈরিতে ইতিহাসের উপর যথেষ্ট জোর দেন। তিনি মনে করেন ভারতের ইতিহাসে এমন কিছুু ভূল পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে যার ফল এখনও ভোগ করতে হচ্ছে যার জন্য তার লেখা এই বিভাগ বর্তমান ভারতকে অতীত ভারতের সাথে যুক্ত করে। এখানে তিনি জানিয়েছেন বর্তমান সময়ের মতো মহাভারত কালীন সময়েও ভারতে একাধিক শক্তিশালী রাজত্ব ছিল যারা বিভিন্ন পক্ষে বিভক্ত ছিল। বলরাম ও রুক্মার মতোন কিছু রাজা ছিল যারা কোন পক্ষেই ছিলনা। বর্তমান বিশ্বে অনেক দেশ বিদেশ নীতি সম্পর্কে অনেক সিদ্ধান্ত নেবার আগেই পরিস্থিতির চাপে পড়ে চুপ করে যায়। মহাভারতেও অর্জুন যুদ্ধক্ষেত্রে আত্মীয় স্বজনদের দেখে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে বিষাদগ্রস্থ হয়ে পড়েছিল। তার মনে এই নয় যে অর্জুনের মধ্যে ক্ষমতার অভাব ছিল, পরিস্থিতির কারনে অর্জুন সাময়িক কারনে দুঃখিত হয়ে পড়েছিল। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণের উপদেশে অর্জুনের সব কষ্ট চলে গিয়েছিল। ঠিক তেমনি ভারতও তার জাতীয় স্বার্থ অনুযায়ী নিজের শক্তিশালী বৈদেশিক নীতি তৈরি করেছে। মহাভারতে পান্ডবদের তুলনায় কৌরবরা সংখ্যায় বেশী ছিল। কৌরবদের পক্ষে ছিল এগারো অক্ষৌহিনী সেনা, যেখানে পান্ডবদের পক্ষে ছিল সাত অক্ষৌহিনী সেনা। কিন্তু জয় শেষ পর্যন্ত পান্ডবদেরই হয়েছিল।

ভারতেরও প্রতিবেশী শক্তিশালী শত্রু দেশ চীন হলেও ভারত নিজেও যথেষ্ট শক্তিশালী এবং চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ হলে ভারতীয় সেনাবাহিনী তার যথেষ্ট সামর্থ্যের পরিচয় দেবে, কারন ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইতিহাসে স্বর্নজ্জবল সমস্ত অধ্যায় আছে। ডঃ জয়শংকর মনে করেন অনেক পরিস্থিতিতে সরাসরি যুদ্ধের বদলে কিছুটা সহ্য করতে হয়। যেমন পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদের সাহায্য নিয়ে ভারতের ক্ষতি করার চেষ্টা করছে ভারত তার জবাব দিচ্ছে কিন্তু ভারত জানে সবসময় সরাসরি যুদ্ধ করা উচিত নয়। অতীতে প্রত্যেকবার ভারতের কাছে শোচনীয় পরাজিত হয়েছে পাকিস্তান, তাই ভারত তার ক্ষমতা সম্পর্কে জানে।

মহাভারতে শ্রীকৃষ্ণ শিশুপালের একশো অপরাধ ক্ষমা করেছিলেন। তিনি মহাভারত যুদ্ধ থামানোর জন্যও অনেক চেষ্টা করেছিলেন। আসলে যুদ্ধ সবসময় শেষ পদক্ষেপ হয়ে থাকে। কারন যুদ্ধের অর্থই জীবনহানি ও দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি খারাপ হওয়া। অকারনে যুদ্ধের কোন প্রয়োজন যেমন আমেরিকার ভিয়েতনাম, ইরাক ও আফগানিস্তানে এত লাখ লাখ ডলার খরচ করেও তেমন কোন লাভ হয়নি। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে পান্ডবরা যেমন নিজের অনেক পরিজনদের সাহায্য পায়নি ঠিক তেমনি ভারতেরও প্রধান শত্রু তার দুই প্রতিবেশী চীন ও পাকিস্তান। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের আগে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুন ও দুর্যোধনকে দুটি শর্ত দিয়েছিলেন একপক্ষে তিনি নিরস্ত্র হয়ে থাকবেন অন্যপক্ষে তার শক্তিশালী অপরাজেয় নারায়নি সেনা থাকবে। কিন্তু অর্জুন নিরস্ত্র শ্রীকৃষ্ণকেই বেছে নিয়েছিলেন যেখানে দুর্যোধন শক্তিশালী নারায়নি সেনাকে বেছেছিলেন এরপর বাকিটা ইতিহাস। ভারতকেও তেমন অস্ত্র ছাড়াও আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, উন্নত প্রযুক্তি এবং গবেষনা খাতে আরও খরচ করতে হবে। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের চোদ্দতম দিনে শ্রীকৃষ্ণ তার সুদর্শন চক্রের দ্বারা সূর্যকেই ঢেকে দিয়েছিলেন। কর্নের রথের চাকা মাটিতে বসে গিয়েছিল, সেই সুযোগে তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল। গুরু দ্রোনাচার্যকে যুধিষ্টির জানিয়েছিল অশ্বত্থামা মারা গেছে, যে কিনা দ্রোনাচার্যের ছেলে। এই খবর শুনে দ্রোনাচার্য দুঃখিত হয়ে পড়ে এবং এই সুযোগে তাঁকে হত্যা করা হয়। বাস্তবে অশ্বত্থামা নামে একটি হাতিকে মারা হয়েছিল। পিতামহ ভীষ্মকে হত্যা করার জন্য শীখন্ডিকে আনা হয়েছিল। অর্থাৎ মহাভারত আমাদের শেখায় যখন বড় কোন মঙ্গল উদ্দেশ্যে বা শান্তি স্থাপনে কোন কাজ করতে হয় তখন প্রয়োজনে যুদ্ধের নিয়ম বদলানো যায়। তবে বর্তমান বিশ্বরাজনীতে ভারত একটি বড় শক্তিশালী দেশ। শক্তিশালী সামরিক শক্তিশালী দেশ হওয়ার পাশাপাশি ভারত অর্থনৈতিক ভাবে ব্যাপক শক্তিশালী। আগামী দশকে ভারতের ক্ষমতা আরও বৃদ্ধি পাবে।

অতিমানবীয় ক্ষমতা। ভবিষ্যত দেখা ও টেলিপ্যাথির ক্ষমতা অর্জন। আমেরিকার গোয়েন্দাদের রহস্যময় প্রজেক্ট

১৯৯৮ সালে ইঙ্গো সোয়ান নামে এক ব্যাক্তি একটি বই লেখেন যার নাম পেনিট্রেশন। ওই বইয়ে সে দাবি করে সে একজন সাইকিক এবং সে বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী। সাইকিক ক্ষমতা একধরনের বিশেষ অতিমানবীয় ক্ষমতা যার প্রভাবে কোন ব্যাক্তি ভবিষ্যত দেখার এবং টেলিপ্যাথির ক্ষমতা অর্জন করে। বিজ্ঞানের ভাষায় একে ছদ্ম বিজ্ঞানও বলা হয়। বিজ্ঞানীরা যদিও এই ধরনের ক্ষমতায় বিশ্বাসী নয়। ইঙ্গো সোয়ানের এই বই সম্পর্কে হয়ত সব মানুষ বিশ্বাস করেনি, কিন্তু ২০০৬ সালে আমেরিকার গুপ্তচর সংস্থা সিআইএ বেশ কিছু গোপন নথি প্রকাশ করে। যাতে সিআইএ নিজেই জানিয়েছে তারা একটি বিশেষ প্রজেক্টে কাজ করছিল যার নাম প্রজেক্ট স্টারগেট। সিআইএ আরও জানিয়েছে ইঙ্গো সোয়ান নামে ওই ব্যাক্তি সাইকিক ক্ষমতার অধিকারী তাকে তারা তাদের এই প্রজেক্টে ব্যাবহার করেছে।

সেই নথিতে শুধু ইঙ্গো সোয়ানই নয় এমন অনেক সাইকিকের নাম পাওয়া গেছে। ইঙ্গো সোয়ানকে সিআইএ কাজ দিয়েছিল যে পৃথিবীতে বসে অতিমানসিক ক্ষমতা প্রয়োগে চাঁদের মানচিত্র তৈরি করা এবং আমেরিকার মহাকাশ গবেষনা সংস্থা নাসাকে সাহায্য করা। পৃথিবী থেকে সর্বদা চাঁদের একটি দিকই দেখা যায় কিন্তু চাঁদের অন্ধকার পৃষ্ঠ পৃথিবী থেকে দেখা যায় না। চাঁদের অন্ধকার পৃষ্ঠ সম্পর্কে জানতে হলে স্যাটেলাইট পাঠানো ও চাঁদে রোভার পাঠানো ছাড়া উপায় নেই। এইজন্য আমেরিকা, ভারত, চীন সহ বেশ কীছু দেশ চাঁদের অন্ধকার পৃষ্ঠে অভিযান করছে। সিআইএ ইঙ্গো সোয়ানকে চাঁদের এই অন্ধকার দিক সম্পর্কে বিশ্লেষন করার জন্যই নিয়োগ করেছিল। সিআইএর এই অতি রহস্যময় প্রজেক্ট স্টারগেট সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে শুরু হয় শীতল যুদ্ধ। দুই দেশই একে অপরকে ছাড়িয়ে নিজেকে শ্রেষ্ঠ প্রমানের জন্য একের পর এক প্রজেক্ট শুরু করে। আমেরিকার এমন অনেক প্রজেক্ট সফল হয়েছিল আবার বেশ কিছু প্রজেক্ট এত গোপনীয় ছিল যার ব্যাপারে আজও কোনও তথ্য পাওয়া যায়না। আমেরিকার এমনই একটি অত্যন্ত গোপনীয় ও অলৌকিক প্রজেক্ট হচ্ছে প্রজেক্ট স্টারগেট। ১৯৭৮ সালে আমেরিকার ডিফেন্স ইনটেলিজেন্স এজেন্সি বা ডিআইএ প্রজেক্ট স্টারগেটের সূচনা করে। সত্তরের দশক থেকেই ডিআইএ সাইকিক ক্ষমতার অধিকারী ব্যাক্তিদের গোপনে এই প্রজেক্টের জন্য নিয়োগ করছিল। মেরিল্যান্ডের একটি সেনা বেস ফোর্ট মিয়েড এবং উত্তর ক্যালিফোর্নিয়ার একটি বিশেষ জায়গায় এই প্রজেক্ট শুরু করা হয়েছিল। প্রথমে এই প্রজেক্টকে গন্ডোলা উইশ, গ্রিল ফ্লেম, সেন্টার লেন অনেক সাংকেতিক নামে ডাকা হত। ১৯৯১ সালে এই প্রজেক্টের নাম স্টারগেট ঠিক করা হয়। প্রথম দিকে এই প্রজেক্টে একটি বিশেষ জায়গা থেকে অনেক দূরে কোন জায়গায় কি হচ্ছে তা জানার ব্যাপারে জোর দেওয়া হয়েছিল। এই প্রজেক্ট এতটা গোপনীয় ছিল যে আমেরিকার তৎকালীন রাষ্ট্রপতি রোনাল্ড রিগন ও সেক্রেটারি ছাড়া কেউই জানত না।

আরো পড়ুন- দ্যা ক্রাইং বয়। অভিশপ্ত যে ছবির কারনে পুড়ে ছাই হয়েছিল একাধিক মানুষের বাড়ি

১৯৮১ সালে আমেরিকার রাষ্ট্রপতি রোনাল্ড রিগন, মিশরের রাজনীতিবিদ আনোয়ার আল সাদাত এবং পোপ জন পল ২ এর উপর আক্রমন হয়, যাতে আনোয়ার আল সাদাত মারা যায় কিন্ত বাকী দুজন বেঁচে যায়। যার জন্য ডিআইএ এই প্রজেক্টের উপর আরও বেশী জোর দেয়। এই প্রজেক্টে নিযুক্ত সাইকিকদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল আমেরিকার গুরুত্বপূর্ন ব্যাক্তিদের উপর হতে চলা আক্রমনের সম্পর্কে আগেই অনুমান করে সেই অনুযায়ী ব্যাবস্থা নেওয়া। আমেরিকা প্রজেক্ট স্টারগেট হঠাৎই শুরু করেনি, ১৯৭০ এর দিকে আমেরিকা খবর পায় সোভিয়েত ইউনিয়ন একটি প্রজেক্টে কাজ করছে সাইকোট্রনিক, যাতে সোভিয়েত ইউনিয়ন ৬০ মিলিয়ন রুবেল বিনিয়োগ করেছে। এটা একধরনের ইলেকট্রনিক ও ইলেকট্রোম্যাগনেটিক মানসিক অত্যাচার। তাড়িতচুম্বকীয় তরঙ্গ, রেডার ও সারভিল্যান্স ডিভাইস ব্যাবহার করে বিভিন্ন ধরনের শব্দ মানুষের মাথায় প্রয়োগ করা হত যার ফলে বন্দী ব্যাক্তিটি সব সত্যি কথা স্বীকার করতে বাধ্য হত। এর দেখাদেখি আমেরিকাও শুরু করে স্ক্যানেট নামে একটি প্রজেক্ট অর্থাৎ দূরে কোন ঘটনা দেখার চেষ্টা যা প্রথম দিকে ৬৫ শতাংশ সফল হয়। এই প্রজেক্টে ১৯৭৬ সালে সিআইএ সফল ভাবে একটি হারিয়ে যাওয়া সোভিয়েত গোয়েন্দা বিমানকে খুঁজে বার করে। এরপরেই এই প্রজেক্ট আরও বড় আকারে প্রজেক্ট স্টারগেট নামে শুরু হয়। এই প্রজেক্টে একটি সমস্যা ছিল বিভিন্ন সাইকিক ব্যাক্তি একজন বিশেষ ব্যাক্তির উপর হতে চলা আক্রমন সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য দিত, এমনকী আক্রমনকারী ব্যাক্তি সম্পর্কে দেওয়া তথ্যও ভিন্ন হত যার কারনে সিআইএ সমস্যায় পড়ে আসল তথ্য খুঁজে পেতে। এরই মধ্যে ১৯৮১ সালের ১৫ ডিসেম্বর একটি ঘটনা ঘটে। প্রজেক্ট স্টারগেটের সাইকিকদের মধ্যে সবচেয়ে দক্ষ ছিল গ্যারি ল্যাংফোর্ড যে নৌবাহিনীর একজন প্রাক্তন অফিসার ছিল।

১৫ ডিসেম্বর ল্যাংফোর্ড হঠাৎ জানায় আগামী ১৭ ডিসেম্বর পেন্টাগনের একজন বড় অফিসারকে অন্য একটি দেশ থেকে অপহরন করা হবে, অপহরনকারী ব্যাক্তি দক্ষিন ইউরোপের কোন দেশের হবে। সেই অফিসারকে অপহরন করে হাত, মুখ বেঁধে একটি নীল গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়া হবে। এই খবর পাওয়া মাত্রই সিআইএ ততক্ষনাৎ তার নেটওয়ার্ক সক্রিয় করে পুরো দক্ষিন ইউরোপে কারন এর আগে কোন সাইকিক ভবিষ্যতের কোন ঘটনা সম্পর্কে এতটা নিখুঁত বর্ননা দিতে পারেনি। এরপরেই ইন্টারপোল বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে থাকা আমেরিকান অফিসারদের উপর সতর্কতা জারি করে। কিন্তু খোদ পেন্টাগনের অনেকেই এই প্রজেক্টের উপর বিশ্বাস করত না সেজন্য ততটা জোর দেওয়া হয়নি নিরাপত্তা ব্যবস্থায়। ১৭ ডিসেম্বর ইটালির ভেরোনা শহরে বিকেল সাড়ে পাঁচটায় এক আমেরিকান অফিসার জেমসের বাড়িতে কলমিস্ত্রীর ছদ্মবেশে দুজন এসে জেমস ও তার বৌকে অজ্ঞান করে। এরপর আরও দুইজন ব্যাক্তি একটি বড় ট্রাঙ্ক নিয়ে এসে তাতে জেমসকে ঢুকিয়ে একটি নীল ভ্যানে করে চলে যায়। ঠিক গ্যারি ল্যাংফোর্ড যেমনটা বলেছিল তেমনই হলো। আমেরিকা জেমসকে খুঁজে বের করার জন্য দুই মিলিয়ন ডলারের পুরস্কারও ঘোষনা করেছিল কিন্তু পাঁচদিন পর এক ব্যাক্তি ইটালির সবচেয়ে বড় সংবাদমাধ্যমে আরবি ভাষায় একটি তথ্য দেয় যাতে বলা হয় আমেরিকান অফিসার জেমসকে রেড ব্রিগেডের আদালতে অভিযুক্ত করা হয়েছে এবং তাকে হত্যা করা হয়েছে। রেড ব্রিগেড ইটালির একটি সন্ত্রাসী সংগঠন যারা চাইত ইটালি থেকে আমেরিকান সেনা চলে যাক। তবে রেড বিগ্রেডের এই কথায় বিশ্বাস করেনি সিআইএ। বেশ কিছু সাইকিক ব্যাক্তি সিআইএকে জানায় জেনারেল জেমস বেঁচে আছে কিন্তু তারা সঠিক অবস্থানের কথা বলতে পারেনা। পুরো ডিসেম্বর মাস জুড়ে আমেরিকান স্পেশাল ডেল্টা ফোর্স ইটালি জুড়ে অভিযান করে কিন্তু তাও জেনারেল জেমসকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয়নি।

১৯৮২ সালের ২ জানুয়ারি পেন্টাগন ও প্রজেক্ট স্টারগেটের দায়িত্বে থাকা অফিসারের বৈঠক হয় এবং ডেল গ্রাফ নামে এক ব্যাক্তিকে ইটালি পাঠানো হয় ডেল্টা ফোর্সের সদস্য হিসাবে জেনারেল জেমসকে খুঁজে বের করার জন্য। এই ডেল গ্রাফ ১৯৭৬ সালে সোভিয়েত গোয়েন্দা বিমান খুঁজে বের করার মিশনে ছিল এবং উত্তর ক্যালিফোর্নিয়ায় স্টারগেট মিশনের দায়িত্বে ছিল। ডেল গ্রাফ ইটালিতে পৌঁছে বেশ কিছু দিন চেষ্টা করেও জেনারেল জেমসকে খুঁজে পাচ্ছিলনা। হঠাৎ একদিন স্বপ্নে ডেল গ্রাফ একটি দোকান দেখতে পায় এবং দোকানের সামনে সাইনবোর্ড লেখা আছে পাডুয়া। ডেল গ্রাফ পরেরদিন পাডুয়া শব্দের অর্থ দেখে বুঝতে পারে এটি উত্তর ইটালির একটি শহর যা তাদের ডেল্টা ফোর্সের ক্যাম্প থেকে মাত্র ৪৩ কিলোমিটার। ডেল্টা ফোর্স সাথে সাথে সেই শহরে অভিযান চালায় এবং হবুহু ডেল গ্রাফের স্বপ্নে দেখা দোকান খুঁজে পায়। সেখানে অভিযান চালিয়ে জেনারেল জেমসকে খুঁজে পাওয়া না গেলেও রেড ব্রিগেডের একজন সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়, যে ১৭ ডিসেম্বর জেনারেল জেমসকে অপহরন করার সাথে যুক্ত ছিল।

জিজ্ঞাসাবাদ করার পর একটি নির্দিষ্ট বাড়িতে ডেল্টা ফোর্স ও ইটালিয়ান স্পেশাল ফোর্স যৌথভাবে অভিযান চালায় এবং উদ্ধার করা হয় জেনারেল জেমসকে। ১৯৯৫ সালে সিআইএ এই প্রজেক্ট বন্ধ করে দেয় কারন হিসাবে সিআইএ জানায় এই প্রজেক্টে সবসময় সঠিক তথ্য আসে না এবং তাদের অপারেশনে এই প্রজেক্ট থেকে প্রাপ্ত তথ্য ততটা সাহায্য করেনা। ২০১৭ সালে সিআইএ স্টারগেট প্রজেক্টের তথ্য প্রকাশ করে।