বাংলার প্রথম নমঃশূদ্র ধর্মঘট - Bangla Hunt

বাংলার প্রথম নমঃশূদ্র ধর্মঘট

By Bangla Hunt Desk - February 02, 2023

রানা চক্রবর্তীঃ অতীতের ভারতীয় সমাজ গঠনে জাতিভেদ প্রথা অনড় থাকবার ফলে, ভারতের বিভিন্ন জাতির জীবনযাত্রা এক বিচিত্র পথে পরিচালিত হতে বাধ্য হয়েছিল। তখন প্রাচীন শাস্ত্রের বিচিত্র শাসনকে কোন সমাজই উপেক্ষা করতে পারেনি। গুণ ও কর্মের ভিত্তিতেই অতীতের ভারতীয় সমাজে চারটি বর্ণের সৃষ্টি হয়েছিল। গীতা ও মহাভারতে যে গুণ ও কর্মের প্রশ্নকে সামনে রেখেই যে বর্ণবিভেদ নির্ণীত হয়েছিল, সেই দৃষ্টান্ত ‘নহুষ’ ও ‘যুধিষ্ঠিরের’ কথাবার্তা থেকে পাওয়া যায়। সর্পরূপী নহুষের প্রশ্নের উত্তরে যুধিষ্ঠির ব্রাহ্মণের লক্ষণ বিচারে বলেছিলেন, “সত্য, অনিষ্ঠুরতা, দান, ক্ষমা, তপস্যা ও দয়া যে ব্যক্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয় তিনিই ব্রাহ্মণ।” যুধিষ্ঠিরের মুখে এই ধরনের উক্তি শুনে নহুষ তাঁকে পুনরায় প্রশ্ন করেছিলেন, “সত্য, দান, ক্ষমা প্রভৃতি গুণ যদি শূদ্রের মধ্যে দেখা যায়?” এই প্রশ্নের উত্তরে যুধিষ্ঠির জানিয়েছিলেন, “শূদ্রের জাতিগত গুণ (পরিচর্যা প্রভৃতি) যদি ব্রাহ্মণের মধ্যে দেখা যায়, তাহলে তাঁকে শূদ্র বলে স্বীকার করব। আর ব্রাহ্মণের গুণ (শম, দম প্রভৃতি) যদি শূদ্রের মধ্যে দেখা যায় তবে সেই শূদ্রকে ব্রাহ্মণ বলব।” অর্থাৎ, জন্মগত বা বর্ণগত শ্রেণী বিভাজনকে মহাভারতের ওই আখ্যায়িকায় স্বীকার করা হয়নি। অথচ ভারতবর্ষের প্রাচীন বর্ণ ব্যবস্থায় জন্মগত অধিকারই বরাবর মর্যাদা পেয়েছিল (এবং এখনও সম্ভবতঃ পাচ্ছে)। সেখানে কর্ম বা গুণগত বর্ণভেদের কোন দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া যায় না। সেখানে ব্রাহ্মণের ঔরসজাত সন্তান ব্রাহ্মণ, এবং শূদ্রের ঔরসজাত সন্তান শূদ্র হিসাবেই বিবেচিত হয়েছিল (এখনও সেটাই হয়)। তখন কোন শূদ্রের সন্তান গুণ ও কর্মে যতই মেধাসম্পন্ন হোন না কেন, তিনি তাঁর জন্মগত কুলবৃত্তি ত্যাগ করে কখনোই অন্য কোন বৃত্তি গ্রহণ করতে পারতেন না ৷ জন্মগত অধিকারই তাঁকে অন্য কোন শ্রেণীর সম-মর্যাদা থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে বাধ্য করত। এই বর্ণ বিভাজনই প্রাচীন ভারতবর্ষের সামাজিক গঠনের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল। সেই সময়ে জন্মগত বৃত্তি পরিবর্তন করলে ‘জাতি-চ্যুতি’ ঘটবার আশঙ্কায় কোন সমাজই সহজে বৃত্তি পরিবর্তনের সাহস পেতো না। কারণ মনু তাঁর ‘মেধাতিথি ভাষ্যে’ সেই বিষয়ে কতগুলি নির্দেশ পালনের প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছিলেন যে –
(১) পৃথিবীর যাবতীয় সম্পদ ও সম্পত্তি ব্রাহ্মণের। কারণ ব্রাহ্মণের সৃষ্টি ঈশ্বরের মুখ থেকে হয়েছে।
(২) বৈশ্য ও শূদ্র কতগুলো বিশেষ কাজ করতে বাধ্য। কারণ তাঁরা কাজ না করলে গোটা বিশ্বের অবস্থা চরমে পৌঁছাবে।
(৩) ক্ষমতা থাকলেও, শূদ্রের সম্পদ সংগ্রহের কোন অধিকার নেই। শূদ্র সম্পদ সংগ্রহ করলে ব্রাহ্মণের কষ্ট বৃদ্ধি পাবে।
মনু আরো জানিয়েছিলেন যে, এইসব শাস্ত্রীয় নীতি লঙ্ঘন করলে পরলোক সুখের হবে না ইত্যাদি ইত্যাদি। এইসব শাস্ত্রীয় প্রবচন তখন নিম্নবর্ণের ক্ষেত্রে এক বিভ্রান্তিকর অবস্থার সৃষ্টি করেছিল। সেই সময়ে, ব্রাহ্মণ এবং শূদ্রের একই অপরাধের ক্ষেত্রে সামাজিক দণ্ডবিধিরও তারতম্য ছিল। দুই বর্ণের সামাজিক শাস্তি কিন্তু একই ছিল না। তখন ব্রাহ্মণের উপরে গুরু পাপে লঘু দণ্ড, শূদ্রের উপরে লঘু পাপে গুরুদণ্ড প্রযুক্ত হত। তৎকালীন সমাজের অসমনীতির ফলে শূদ্রেরা বরাবরই পদানত থেকেছিলেন, আর সেটাই ছিল সেকালের ভারতের বর্ণব্যবস্থার সবচেয়ে বড় কুফল। প্রাচীন ভারতের ব্রাহ্মণ্য সমাজ ব্যবস্থার অসাম্য নীতি কখনোই শূদ্রদের মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে দেয়নি। অথচ ব্রাহ্মণদের সেই বিভেদনীতিকে অন্যান্য বর্ণরা, অর্থাৎ ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য সম্প্রদায় কিন্তু কখনোই মেনে নেননি। ব্রাহ্মণদের সৃষ্ট ওই সব অসম নীতি কিংবা অসঙ্গত জুলুমের বিরুদ্ধে তাঁরা প্রয়োজনে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন, সেগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলেন।
ঊনবিংশ শতাব্দীর ভারতে জাতিভেদ বা বর্ণভেদ প্রথার নগ্ন রূপ সবচেয়ে বেশি করে ফুটে উঠেছিল। তখন নানা মত ও মতান্তরে জাতিভেদ বিষয়ে এদেশের নির্যাতিত অংশরা প্রশ্ন তুলেছিলেন। তখন থেকেই তাঁরা নানাভাবে জাতিভেদ প্রথার মূলোচ্ছেদ ঘটাতে চেয়েছিলেন। উক্ত শতাব্দীতে এই দেশের এই শ্রেণীর মানুষ জাতিভেদ প্রথার অভিশাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য বার বার প্রতিবাদ জানিয়ে জনমত গঠনেরও চেষ্টা করেছিলেন। বস্তুতঃ রাজা রামমোহন রায়ের যুগ থেকেই বঙ্গদেশে বর্ণভেদের বিরুদ্ধে অনেক প্রতিবাদের ঝড় বয়ে গিয়েছিল। আর সেইসব প্রতিবাদের ফলে হিন্দুদের সমাজ কাঠামোর বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে বর্ণভেদের বিবর্তন লক্ষ্য করা গিয়েছিল। সেই বিবর্তন মূলতঃ কর্ম ও গুণের ভিত্তিতেই ঘটেছিল। তাই প্রাচীন কাল থেকে আধুনিক কালের সূচনা পর্যন্ত বঙ্গদেশে যে বর্ণ-বিবর্তন লক্ষ্য করা যায়, সেটা হল –
(ক) প্রথম যুগের বর্ণ বিভাজন: ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র।
(খ) দ্বিতীয় যুগের বর্ণ বিভাজন:

(১) উত্তম সংকর (সৎ শূদ্র): বৈদ্য, কায়স্থ, নাপিত, মোদক, বারুজীবী, তাম্বলী, মালাকার, কর্মকার, শঙ্খকার, তন্তুবায়, কুম্ভকার প্রভৃতি।
(২) মধ্যম সংকর (অশুদ্র): ছুতোর, স্বর্ণকার, আভীর, তৈলিক, কৈবর্ত, রজক, শুঁড়ি প্রভৃতি।
(৩) অধম সংকর (অন্ত্যজ শ্রেণী): ব্যাধ, হাড়ি, ডোম, মুচি, মেথর, চামার, চণ্ডাল প্রভৃতি।
(গ) তৃতীয় যুগের বর্ণ বিভাজন: (১) ব্রাহ্মণ, (২) বৈদ্য ও কায়স্থ, (৩) নবশাখ সম্প্রদায় (উত্তম সংকর): গোপ, মালি, তাম্বুলী, শঙ্খকার, কর্মকার, তন্তুবায়, নাপিত প্রভৃতি।
(ঘ) চতুর্থ যুগের (ঊনিশ শতকের) বর্ণ বিভাজন: (১) ব্রাহ্মণ, (২) কায়স্থ ও বৈদ্য, (৩) নবশাখ সম্প্রদায় (মধ্যভাগ): (অ) গোপ, মালি, তাম্বুলি, শঙ্খকার, কাংস্যকার, তাঁতি, নাপিত, তিলি, বারুজীবী, গন্ধবণিক ও মোদক; (আ) কৈবর্ত, মাহিষ্য, উগ্রক্ষত্রিয়, সুবর্ণবণিক, সাহা, শুঁড়ি, তেলি, কলু ও ধোপা; (ই) যুগী, চাঁড়াল, নমঃশূদ্র, চামার, মুচি, হাড়ি, ডোম, বাগদী প্রভৃতি (এঁরা সকলই অস্পৃশ্য ছিলেন)।
উপরোক্ত সারণিগুলি থেকে সহজেই বুঝতে পারা যায় যে, এদেশের বর্ণ ব্যবস্থা কখনোই একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকেনি। ইতিহাস বলে যে, বঙ্গদেশের বর্ণ ব্যবস্থায় এমন বিবর্তন বিভিন্ন সময়েই ঘটেছিল, এবং ঊনবিংশ শতাব্দীতেই সেটা সবচেয়ে বেশি পরিমাণে ঘটেছিল। কারণ, উক্ত শতাব্দীর অর্থনৈতিক ব্যবস্থাই বঙ্গদেশের প্রচলিত বর্ণভেদ প্রথার ক্ষেত্রে শিথিলতা এনে দিয়েছিল। কলকাতা শহরের বৃদ্ধি ও তৎকালীন বাংলার গ্রামীণ আর্থ-সমাজ-ব্যবস্থার ভাঙনই সেটার একমাত্র কারণ ছিল বলে গবেষকেরা মনে করে থাকেন। ওই সময়ে কলকাতা শহরের আয়তন যতই বৃদ্ধি পেয়েছিল, ততই বঙ্গদেশের কৃষি নির্ভর সমাজেও পরিবর্তনের জোয়ার এসেছিল। এর ফলে তৎকালীন বাংলার গ্রামীণ সমাজ ব্যবস্থাও ভাঙতে শুরু করেছিল। আর সেই ভাঙনের পথ ধরেই, কলকাতা শহরে বহু লোকের আনাগোনা আরম্ভ হয়েছিল। তখনকার বাংলার ব্যবসা-বাণিজ্যও মূলতঃ কলকাতা নগরীকে আশ্রয় করেই বেড়ে উঠতে শুরু করেছিল। আর কলকাতা শহরে যেহেতু বর্ণভেদের কোন বলাই ছিল না, তাই নিম্নবর্ণের অনেকেই নিজেদের আর্থিক অবস্থা ফেরানোর জন্য কলকাতাকেই বেছে নিয়েছিলেন। এরই সঙ্গে ঊনিশ শতকের প্রথম দিকের কলকাতার ‘ধর্মতলা অ্যাকাডেমি’র মতো কয়েকটি স্কুলের, এবং দেশীয় ব্যক্তিদের প্রচেষ্টায় স্থাপিত ‘হিন্দু কলেজে’র শিক্ষিত দেশীয় যুবকেরা সেই সময়ের নতুন চিন্তা ও চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠেছিলেন। তাতে বঙ্গদেশে এক নতুন ধরণের সামাজিক আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল, যার ফলে নতুন ও পুরানো আদর্শের মধ্যে সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। কিন্তু তৎকালীন বাংলার বিদেশী শাসকেরা সেই বিষয়ে সম্পূর্ণ উদাসীন ছিলেন। তাঁরা একদিকে যেমন বঙ্গদেশের ধর্মীয় ও সামাজিক ব্যাপারে কখনোই হস্তক্ষেপ করতে চাননি, অপরদিকে সেটাকে তেমনি সমর্থনও করেননি। এর ফলে কলকাতার দেশীয় সমাজের বাঁধন শিথিল হতে কোন বাধা পায় নি। ফলে, ওই সময়ের কলকাতাকে আশ্রয় করে অতীতের বঙ্গদেশের বর্ণ-বিন্যাসে ভাঙ্গনের অবকাশে সৎ-শূদ্র পর্যায়ের লোকেরা যেমন সামাজিক মর্যাদালাভের জন্য সচেষ্ট হয়েছিলেন, তেমনি অন্য শ্রেণীও অর্থকৌলীন্যে প্রতিষ্ঠিত হয়ে ওঠবার পরে নিজেদের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধির দাবিতে আবেদন-নিবেদন না করে গণ-আন্দোলনের পথকেই বেছে নিয়েছিলেন। সেই সময়ে অনেকেই বর্ণ গোত্র অর্থাৎ আত্ম-পরিচয় ছিন্ন করে নতুনভাবে সমাজে পরিচিত হতে চেয়েছিলেন। যেমন, মৎসজীবী কৈবর্তরা তখন অধিকতর সামাজিক মর্যাদার দাবি করে নিজেদের মাহিষ্য বলে পরিচয় দিতে শুরু করেছিলেন। একইভাবে তখনকার গোপ ও তেলি সমাজও অপরাপর ‘নবশাখ’ সম্প্রদায়ের সমান সামাজিক মর্যাদার দাবীতে আন্দোলন আরম্ভ করেছিলেন। ওই সব বর্ণগোষ্ঠীকৃত সামাজিক আন্দোলনের ফলে অপরাপর বহু বর্ণের তখন মানুষ ‘জলচল নবশাখ’ সম্প্রদায়ে উন্নীত হতে পেরেছিলেন। কিন্তু তখনও পর্যন্ত বঙ্গদেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী, যাঁরা অর্ধ-সংকর হিসাবে সমাজে চিহ্নিত ছিলেন, তাঁরা নিজেদের দাবীকে তেমনভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন নি।
উক্ত শতাব্দীতে বঙ্গদেশের অন্যান্য বর্ণের অবস্থার দিকে লক্ষ্য রেখেই শূদ্র-জাগরণ সূচিত হয়েছিল। পূর্ববঙ্গের (অধুনা বাঙলাদেশের) নমঃশূদ্র জাতির ভেতরেই সেই শূদ্র জাগরণ প্রথম দেখা গিয়েছিল। তাঁরাই ওই সময়ে প্রথম নিজেদের সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে উঠে পড়ে লেগেছিলেন। কিন্তু তাঁদের সেই সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই নিয়ে কিছু বলবার আগে, প্রাচীন এবং সমকালীন সমাজে তাঁদের কি পরিচয় বা ভূমিকা ছিল – সে প্রসঙ্গে কিছু জানবার প্রয়োজন রয়েছে। প্রাচীন গ্রন্থগুলি থেকে শূদ্র পিতা এবং ব্রাহ্মণ মাতার ঔরস-জাত সন্তান হিসাবে নমঃশূদ্র জাতির বর্ণ-পরিচয় পাওয়া যায়। ওই সময়ে নমঃশূদ্রদের বসবাস গোটা বঙ্গদেশ জুড়ে না হলেও, পূর্ববঙ্গে তাঁরাই তখন সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিলেন। সেই সময়ের বর্ণগত বৃত্তিতে দেখা যায় তাঁরা মূলতঃ – “Engaged for the most part in boating and cultivation. Bengali Namasudras are for the most part peaceful, hard working, cheerful cultivators.” বাংলার নমঃশূদ্র জাতির পরিচয় সম্পর্কে আরো জানা যে, একদা রাজা বল্লালসেন তাঁর পিতার রোগ মুক্তির যজ্ঞ অনুষ্ঠানের জন্য কান্যকুব্জ থেকে ৫ জন বৈদিক ব্রাহ্মণকে আনিয়েছিলেন। তাঁদের সঙ্গে পাঁচ জন কায়স্থও এসেছিলেন, এবং তাঁদের বংশধরেরা পরবর্তীকালের বাংলার ব্রাহ্মণ কায়স্থ সমাজে কুলীন হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিলেন। প্রথমে কান্যকুব্জরাজ বঙ্গদেশে ব্রাহ্মণদের পাঠাতে অরাজী হলে বল্লালসেন ৫০০ জন অনার্যকে গরুর পিঠে চড়িয়ে তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবার জন্য পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। তখন গোহত্যার ভয়ে কান্যকুব্জরাজ কোন যুদ্ধ না করে তাঁর রাজ্য থেকে ৫ জন ব্রাহ্মণকে বঙ্গদেশে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। এরপরে বল্লালসেন প্রতিদানে সেই ৫০০ জন অনার্যকে তৎকালীন হিন্দু সমাজে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, এবং তাঁর সেই অনাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে ব্রাহ্মণদেরই একটি সম্প্রদায় রাজরোষে পতিত হয়েছিলেন। প্রাণভয়ে সেই ব্রাহ্মণেরা তখন নদী বহুল পূর্ববঙ্গে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন, এবং নিজেদের পরিচয় গোপন করবার জন্য তাঁরা পৈতা ছিঁড়ে ফেলেছিলেন ও জীবিকার জন্য মৎস্যশিকার ও কৃষিকার্যে লিপ্ত হয়েছিলেন। প্রয়োজনের খাতিরে শূদ্রদের পেশা গ্রহণ করলেও তাঁরা নিজেদের শূদ্রের নমস্য, অর্থাৎ, ‘নমঃশূদ্র’ নামে পরিচয় দিয়েছিলেন। কিন্তু রাজার নির্দেশে শিক্ষা ও সামাজিক মর্যাদায় বঞ্চিত হয়ে, দারিদ্র্য ও হীনতর জীবনযাত্রার জন্য তাঁরা অবশেষে ‘জল অচল’ সমাজে পরিণত হয়েছিলেন। সেই থেকেই হিন্দুদের সমাজ-ব্যবস্থায় নমঃশূদ্র জাতি একটি অস্পৃশ্য জাতি হিসাবেই গণ্য হয়ে এসেছিল। শূদ্র হিসাবে তাঁরা কোন সামাজিক মর্যাদা কোনদিনই পাননি। অবহেলা, অবজ্ঞা, ও বঞ্চনাতেই তাঁদের কাল কেটেছিল। কারণ, তৎকালীন বর্ণহিন্দু সমাজের কাছে – “Like & sudra … the servant of another, to be removed at will, to be slain at will.” কিন্তু সেই সামাজিক শোষণকে, বিশেষ করে নমঃশূদ্র সম্প্রদায় – ঊনিশ শতকের মধ্যভাগ থেকেই অস্বীকার করতে শুরু করেছিলেন। তাঁরা সেই সামাজিক শোষণ থেকে নিজেদের মুক্তি ঘোষণা করতে চেয়েছিলেন। ফলে, তাঁদের সঙ্গে তৎকালীন সমাজের উচ্চ-বর্ণের সংঘাত অনিবার্য হয়ে হয়েছিল। দেখতে দেখতে ব্যাপক অঞ্চল জুড়ে গোটা নমঃশূদ্র সমাজেই সেই প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছিল।
তৎকালীন পূর্ববঙ্গের বরিশাল, যশোহর, খুলনা, ফরিদপুর ও পদ্মা-মধুমতীর তীরের নমঃশূদ্রেরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিলেন। তখন তাঁদের জীবিকা মূলতঃ ছিল কৃষিকার্য। কিন্তু সেই উচ্চবর্ণের লোকেরা তাঁদের দিয়ে যত রকমের কায়িক পরিশ্রমের কাজ করানো সম্ভব, সে সবই করিয়ে নিতেন। তৎকালীন নমঃশূদ্র সমাজ উচ্চ বর্ণের সেই বিদ্বেষ ও নীচুতাকে একটা সময়ে আর সহ্য করতে পারেনি। তাঁরা ভিতরে ভিতরে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিলেন। এরপরেই তাঁরা নিজেদের সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন গড়ে তুলতে বদ্ধ পরিকর হয়েছিলেন। তখন জাত বিচারের প্রশ্নে বাংলার নমঃশূদ্র জাতি অন্যান্য ‘নবশাখ’ সম্প্রদায়ের মতই নিজেদের জন্য অধিকতর সামাজিক মর্যাদার দাবি করেছিলেন। সেই সময়ে মনু সংহিতার প্রচলিত অনুশাসনকে নমঃশূদ্ররা আর মানতে রাজী হননি। ফলে উচ্চবর্ণের লোকেরা নমঃশূদ্র জাতির প্রতি দুর্ব্যবহার করতে আরম্ভ করেছিলেন। বিশেষতঃ সেই সময়ে পূর্ববঙ্গের কায়স্থরা অহেতুকই নমঃশূদ্রদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়াতে চাইলে নমঃশূদ্র জাতিও নিজেদের আত্মমর্যাদার লড়াইয়ে নামতে হতে বাধ্য হয়েছিলেন। এর ফলে ১৮৭৩ সালে স্ব-জাতির সম্মান ও আত্মরক্ষার্থে, এবং কায়স্থদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর জন্য তৎকালীন বাংলার নমঃশূদ্র অধ্যুষিত অঞ্চলে একটি গণ-আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল। সেই গণ-আন্দোলনের কার্যক্রম কেবলমাত্র সভা-সমিতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তদানীন্তন নমঃশূদ্র সমাজের অগ্রণী অংশ ন্যূনতম কর্মসূচীর ভিত্তিতে বাংলার জনগণকে সেই আন্দোলনের সামিল হতে উদ্বুদ্ধও করেছিলেন। এরপরে ১৮৭৩ সালে গোটা ফরিদপুর জেলায় নমঃশূদ্রদের পক্ষ থেকে একটি সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হলে, অন্যান্য সম্প্রদায়ের মধ্যেও সেটার মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলার জাতিভেদ বিষয়ে ওই ধরণের ধর্মঘট পালনের ডাক ভারত তথা বাংলার ধর্মঘটের ইতিহাসে সেই প্রথম এবং অভিনব ছিল। তখন জাত বিচারের প্রশ্নে বা বর্ণ বৈষম্যের বিরুদ্ধে নমঃশূদ্র জাতিরা ধর্মঘট পালনের ক্ষেত্রে নিজেদের কতগুলি দাবিকে প্রকাশ্যেই ঘোষণা করেছিলেন। তাঁদের প্রথম ও প্রধান দাবি ছিল যে, তাঁরা কিছুতেই অন্য কোন জাতির বা লোকের সেবা করবেন না। দ্বিতীয় দাবি ছিল যে, ব্রাহ্মণ ভিন্ন অন্য কোন জাতি বা সম্প্রদায়ের পাকান্ন তাঁরা গ্রহণ করবেন না। তখন মূলতঃ এই দুটি দাবিকে কেন্দ্র করেই একটা সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেওয়াটা সেকালের পক্ষে কম গৌরবের বিষয় ছিল না। আজও ভাবলে অবাক হতে হয় যে, তখন সামাজিক আত্মসম্মানের প্রশ্নে তাঁরা নিজেদের সমস্ত রকমের কাজকর্ম প্রায় বন্ধও করে দিয়েছিলেন। ওই সময়ে কিছু সংখ্যক নমঃশূদ্র তো নিজেদের জাতিগত বৃত্তি বর্জন করে, নৌকার মাঝি-মাল্লা হিসাবে জীবিকার্জনেরও চেষ্টা করেছিলেন।

দুর্ভাগ্যের বিষয় যে, নমঃশুদ্রদের সেই ধর্মঘট বেশী দিন স্থায়ী হয়নি, এবং তাঁদের সেই ধর্মঘট শেষ পর্যন্ত সফলও হয়নি। এমন কি ওই ধরঘটের ফলে তৎকালীন সমাজে তাঁদের বর্ণ বা জাতিগত মর্যাদাও কোন ভাবে বৃদ্ধি পায়নি। কিন্তু বাংলার শ্রমজীবী মানুষের কাছে তাঁদের সেই আন্দোলনের আবেদন একেবারে নিষ্ফল হয়ে যায়নি। ওই আন্দোলন তাঁদের কাছে একটি নতুন অর্থ ও শিক্ষা বহন করে এনেছিল। ঐসব শোষিত, নির্যাতিত মানুষের ঐক্যই সেই ধর্মঘটের প্রেরণা ও প্রাণ শক্তি ছিল, এবং তৎকালীন সমাজ থেকে বর্ণ-ব্যবস্থার উৎখাত ও সমান অধিকারের প্রশ্নটিও সেখানে মুখ্য হয়ে দেখা দিয়েছিল। ওই সময়ের সামন্ততান্ত্রিক শোষণের বিরুদ্ধেও নমঃশূদ্র জাতি সেই সামাজিক প্রতিষ্ঠা কামনার ভিতর দিয়েই একটি শোষণ মুক্ত সমাজ গড়ে তোলবার লক্ষ্যে পৌঁছতে চেয়েছিল। তাই শেষপর্যন্ত সাফল্য কিংবা ব্যর্থতা বড় কথা নয়, বঙ্গদেশে শূদ্র জাতির নবজাগরণের প্রাক-প্রস্তুতি হিসাবে ওই ধর্মঘট সেই সময়ের অন্যান্য শোষিত শ্রমজীবী মানুষকে মানবতাবাদে উজ্জীবিত করতে একটি সফল ভূমিকা নিয়েছিল। আর সেখানেই ছিল সেই আন্দোলনের মূল মর্মবস্তু ও সার্থকতার পরিচয়।

(তথ্যসূত্র:
১- প্রাচীন ভারতে শূদ্র, রামশরণ শর্মা।
২- বাঙ্গালী হিন্দুর বর্ণভেদ, নীহাররঞ্জন রায়।
৩- বাংলায় ধর্মঘট, অশোক ঘোষ।)

সব খবর পড়তে আমাদের WhatsApp গ্রুপে যুক্ত হোনএখানে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *


প্রাসঙ্গিক খবর