বাগবাজারের নবীন দাস, রসোগোল্লার কলম্বাস - Bangla Hunt

বাগবাজারের নবীন দাস, রসোগোল্লার কলম্বাস

By Bangla Hunt Desk - May 29, 2023

সেটা ছিল ১৯৭১ সাল। বোম্বেতে কিংবদন্তি শিল্পী শচীনদেব বর্মনের বাড়ীতে একটা হিন্দী সিনেমার গানের রেকর্ডিং এর আগে রিহার্সাল চলছে ।

শচীন কর্তার সামনে বসে আছেন সেই সময়ের একঝাঁক নক্ষত্ররাজি, লতা, আশা, হরিপ্রসাদ চৌরাশিয়া (বাঁশি) এবং আরও অনেকে। রিহার্সাল এর মাঝখানে, শচীন কর্তা উঠে ভেতরের ঘরে গিয়ে একটা কৌটো এনে সবার মাঝে রাখলেন, বিখ্যাত কে,সি,দাস এর দোকানের রসগোল্লা, কলকাতা থেকে নিয়ে গেছেন। সবাইকে খেতে বললেন । কেউ কেউ খেলেন, কেউ বা খেলেন না। কৌটোতে অনেকগুলি রসগোল্লা থেকে গেলো। এরই মাঝে শচীনকর্তা আবার কোনও কাজে, ভেতরের ঘরে গেছেন, আসতে দেরী হচ্ছে , হরিপ্রসাদ চৌরাশিয়া এরমাঝে সবগুলি রসগোল্লা খেয়ে ফেলেন। শচীনকর্তা ফিরে এসে যখন দেখেন কৌটো পুরো খালি, ভীষণ রেগে যান, বলতে থাকেন,,,,,,,

”কেডা খাইলো, কেডা খাইলো ? কোন চুরা এতডি রসগোল্লা খাইছে ? আমার লিগ্যা একটাও রাখলো না । দেখছো নি চুরার কান্ডটা ”। সামনে যারা ছিলেন, তাঁরা চুপ। রিহার্সাল শেষ হলো, সবাই চলে গেলেন। পরদিন আবার যথারীতি কর্তার বাড়ীতেই রিহার্সাল চলছে। লতাজী গানের মুখড়াটা গেয়ে ছেড়েছেন, হরিজী ইন্টারল্যুডে বাঁশিতে বাজাচ্ছেন, শচীনকর্তা দুহাত তুলে সবাইকে থামালেন। সবাই তটস্থ, কোথায় কি ভুল হল ? কর্তা বললেন,,,,

“অখন বুজজি, কোন চুরা কাইল আমার সব রসগোল্লা চুরি করছে ? তোমরা বুঝতা না, আমি বুজজি। হরি’কে দেখিয়ে বললেন, “এই ছেমড়াই কামডা করছে , কাইল আমরার কইলকাতার অতডি মিষ্ঠি রসগোল্যা তার পেটে ঢুকছেনি, হের লাইগ্যাই আইজ তার বাঁশির আওয়াজও কাইলের থিক্যা বেশী মিডা লাগতাছে”। আবার তিনি ইশারা করতেই, শুরু হলো রিহার্সাল ।

কমল কুমার মজুমদারের লিখেছিলেন..

‘বাগবাজারের নবীন চন্দ্র দাস/রসগোল্লার কলম্বাস।’

বাংলা সাহিত্যেও রসগোল্লাকে নিয়ে রচিত হয়েছে সরেস সাহিত্যকর্ম। বিশিষ্ট রম্য সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলী রচনা করেছেন বিখ্যাত রম্যগল্প “রসগোল্লা” যা ইউরোপের বহু দেশে সমাদৃত হয়েছে।

যতদূর জানা যায় ভারতের পশ্চিমবঙ্গে প্রথম রসগোল্লা প্রস্তুত করা হয়েছিল। নবীন চন্দ্র দাস আধুনিক রশিগোলার আবিষ্কর্তা ছিলেন এবং তিনি ইতিহাসে জনপ্রিয় কণ্ঠে রসগোল্লার কলম্বাসের সাথে যুক্ত হয়েছেন। ১৪ শতকের শেষভাগে ১৫ শতকের ভক্তি আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ভীষণাভক্তি বৃদ্ধি লাভের সময় মিষ্টিটির প্রাচীনতা নাদিয়াতে ফিরে আসত। এর পর এই রসগোল্লা জনপ্রিয় হয়ে, পাশের রাজ্যগুলিতে ছড়িয়ে পড়ে। তবে কলকাতায় এটি উল্লেখযোগ্যভাবে জনপ্রিয়তা লাভ করে। রসগোল্লা নদীয়া থেকে কলকাতা ও ওড়িশায় ছড়িয়ে পড়ে।প্রতিবছর উল্টোরথের আগের দিন গোটা ওডিশায় পালিত হয় ‘রসগোল্লা দিবস’।এ বঙ্গেও দাবি ওঠে প্রতিবছর ১৪ নভেম্বরকে রসগোল্লা দিবস পালনের।

নবীন দাস

বিশেষজ্ঞদের মতে রসগোল্লার আদি উৎপত্তিস্থল বর্তমান বাংলাদেশের বরিশাল অঞ্চলে। বিশেষ করে, পিরোজপুরের ভান্ডারিয়ায় পর্তুগীজদের সময় সেখানকার ময়রাগণ ছানা, চিনি, দুধ ও সুজি দিয়ে গোলাকার একধরণের মিষ্টান্ন তৈরি করেন যা ক্ষীরমোহন বা রসগোল্লা নামে পরিচিত। পরবর্তীতে বরিশাল এলাকার হিন্দু ময়রাগণের বংশধর ভারতের পশ্চিমবঙ্গ তথা কলকাতা কিংবা ওড়িশায় বিস্তার লাভ করে। ২০১৫ সালের জুন মাস থেকেই ওড়িশা রসোগোল্লা তাদের বলে দাবি তোলে।সুপ্রীম কোর্ট অবশ্য মান্যতা দেয়না।

জিওগ্রাফিক ইন্ডিকেশন (জিআই)’ নামক প্রতিষ্ঠান রসগোল্লাকে পশ্চিমবঙ্গের মিষ্টান্ন বলে ইতোমধ্যেই স্বীকৃতি দিয়েছে। তবে বাংলাদেশী মিষ্টান্ন ব্যবসায়ীদের মতে, রসগোল্লার আদি উৎস কলকাতা কিংবা উড়িষ্যা নয়, বরং বাংলাদেশের পটুয়াখালি অঞ্চলে এর উৎপত্তি।

#নবীন_চন্দ্র_দাস। তিনি ১৫১ বছর আগে রসে ভেজানো গোলাকার এই রসগোল্লা তৈরি করেন।নবীন চন্দ্র দাসের এই সাফল্যের পিছনেও আছেন এক নারী৷ তিনি নবীনচন্দ্র দাসের স্ত্রী ক্ষীরোদমণি দেবী৷ জানা যায়, নবীন চন্দ্র দাসের গোটা ব্যবসার রাশ ছিল তাঁর হাতেই৷

যদিও খ্যাতির আড়ালে থেকে গিয়েছেন ক্ষীরোদমণি দেবী৷ রসগোল্লার কারিগর নবীন চন্দ্র দাসের স্ত্রী ছিলেন তিনি৷ প্রখ্যাত মিষ্টান্ন কারিগর ভোলা ময়রার মেয়ে৷ চোদ্দ বছর বয়সে নবীন ময়রার সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়৷ রাশভারী মহিলা ছিলেন৷ স্বামীর উদ্ভাবনী ক্ষমতা থাকলেও যেহেতু ব্যবসায়িক দক্ষতা ছিল না তাই ক্ষীরোদমণি দেবীই ব্যবসার রাশ নিজের হাতে নেন৷ এমনকি ছেলে কে.সি দাস আলাদা দোকান করলেও আমৃত্যু পর্যন্ত নবীন চন্দ্র দাসের দোকান একাই চালিয়েছেন তিনি৷

গবেষকদের মত অনুযায়ী ১৮৬৮ সালে কলকাতায় বাগবাজারের নবীনচন্দ্র দাসের হাতে সৃষ্টি এই রসগোল্লা। যতটুকু জানা যায়, একটি ছোট্ট মেয়ে নবীন দাসের কাছে বায়না ধরে,

“চটচটে নয়, শুকনো হতে মানা,
দেখতে হবে ধবধবে চাঁদপানা,
এমন মিষ্টি ভূ-ভারতে নাই,
নবীন ময়রা, এমন মিষ্টি চাই।”

অক্ষরে অক্ষরে নবীন দাস কথা রাখেন মেয়েটির, ছানা আর গরম চিনির রস মিলিয়ে ঠিক যেন চাঁদপানার মতোই তৈরী করলেন রসগোল্লা। এই “রসগোল্লা”ই মিলিয়ে দিলো নবীন দাস আর সেই মেয়েটিকে, নাম যাঁর “ক্ষীরোদমনি”, বাগবাজারের তত্‍কালীন বিখ্যাত কবিয়াল “ভোলা ময়রা”র মেয়ে। নবীন দাসের ঘরণী হয়ে আসেন এই ক্ষীরোদমনি।

১৮৬৪ সালে কলকাতার জোড়াসাঁকোতে একটি মিষ্টির দোকান খোলেন কলকাতার চিনি ব্যবসায়ী নবীন চন্দ্র দাস। বেশি দিন ওই মিষ্টির দোকানটি চলেনি। ফের ১৮৬৬ সালে কলকাতার বাগবাজারে আরেকটি মিষ্টির দোকান খোলেন তিনি। এই দোকানটির প্রধান মিষ্টি ছিল সন্দেশ। তবে কলকাতা শহরের খানদানি বণিকদের যেন সন্দেশে আশ মিটছিল না। তাই নবীন চন্দ্র দাস নতুন মিষ্টি তৈরির কথা ভাবছিলেন। পরে দুই বছরের মধ্যে তিনি তিনি তৈরি করেন রসগোল্লা।

প্রথমদিকে নবীনবাবুদের ক্রিস্টাল সুগার রিফাইনের ব্যবসা ছিল৷ তাঁর বাবা মারা যাওয়ার পর তাঁকে পারিবারিক ব্যবসা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়৷ জমানো টাকা দিয়ে খুব কষ্ট করে পড়াশোনা করেন তিনি৷ তাই বেশি দূর পড়াশোনা হয়নি৷ মা-ছেলে দুজনের সংসার সামলাতে ১৬-১৭ বছর বয়সে কালীদাস ইন্দ্র নামে এক মিষ্টি বিক্রেতার কাছে কারিগরের কাজ নেন৷ কিন্তু সেখান থেকে বহিষ্কৃত হন তিনি৷
এরপর মায়ের জমানো টাকায় ১৮৬৪ সালে জোড়াসাঁকোতে একটি দোকান করেছিলেন নবীনবাবু৷ কিন্তু সেটা চলেনি৷ তারপর ফের মায়ের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে ওই কালীদাস ইন্দ্রের দোকানের উল্টোদিকে আবারও একটি মিষ্টির দোকান করেছিলেন তিনি৷ কিন্তু সেই ব্যবসাও ভালমতো চলত না৷ সেইসময় কিছু লোকজন তাঁকে বলতেন এমন মিষ্টি তৈরি করতে যাতে খিদের সঙ্গে তেষ্টাও মেটে৷এরপরই তিনি ছানার বল করে রসে দিলেন৷ কিন্তু প্রথম প্রথম তা ছেড়ে যেত৷ তারপর বেশ কিছুদিন এরকম হওয়ার পর শেষপর্যন্ত ঠিক হয়৷ সেই খুশিতে এবং নিজের মিষ্টির প্রচারের জন্য তিনি প্রায় সকলকে বিনা পয়সায় মিষ্টি বিলোতে থাকেন৷ তখন তিনি তেইশের যুবক।

একদিন তাঁদের বাগবাজারের দোকানের সামনে এসে দাঁড়ায় একটি ঘোড়া টানা গাড়ি। গাড়িতে ছিল কলকাতার ধনাঢ্য ব্যক্তি, ভগবান দাস বাগলার পরিবার। ভগবান দাসের এক ছেলের পিপাসা পেলে সে গাড়ি থেকে নেমে ওই মিষ্টির দোকানের সামনে আসে। ভগবান দাস কথায় ওই ছেলেটিকে এক গ্লাস জল ও একটি রসগোল্লা দেওয়া হয়। রসগোল্লা খেয়ে ওই ছেলে বেজায় খুশি হয়ে বাবাকে বলেন তোমারও খেতে হবে এই মিষ্টি। ভগবান দাস এরপর এক হাঁড়ি রসগোল্লা নিয়ে বাড়ি ফেরেন। এর কিছুদিনের মধ্যেই কলকাতার ছড়িয়ে পড়ে রসগোল্লার সুখ্যাতি।সুখ্যাতি তো ছড়াল৷ কিন্তু ব্যবসার হাল ধরবে কে? রসগোল্লার কারিগর তখন মিষ্টি শুভেচ্ছায় মোহিত৷ তাতেই লাটে উঠতে পারে ব্যবসা৷ অগত্যা হাল ধরলেন স্ত্রী ক্ষীরোদমণি৷ বাংলার মিষ্টান্ন শিল্পে জড়িয়ে গেল এই গৃহবধূর নাম৷ তিনি না থাকলে হয়তো রসগোল্লা হারিয়েই যেত৷।

জানা যায় ভারতীয় মহাকাশ সংস্থা, ইসরো ২০১৬ সালে পরিকল্পিত মনুষ্য অভিযানে ভারতীয় মহাকাশচারীদের জন্য নিরুদিত বা ডিহাইড্রেড দুধ সাদা নরম তুলতুলে রসোগোল্লা এবং অন্যান্য খাবারের উদ্ভাবন করেছিল। এমনই এই সাদা রসালো গোলকের মাহাত্ম।

হাতটি যখন বাড়িয়েছিলি
রসোগোল্লা চাঁদে,
ভাবিসনি তো পড়বি যে তুই
এমনতরো ফাঁদে !

প্রাথমিক ত্রুটি সারিয়ে আজ সোমবার ভারতীয় মহাকাশ সংস্থা ইসরোর ‘চন্দ্রযান দুই’ পাড়ি দিতে চলেছে চাঁদের পাহাড়। এই চন্দ্রযানে স্মারক হিসেবে থাকতেই পারে এককৌটো সাদা ‘রাজগোল্লা’ বা রসোগোল্লা .. কিন্তু প্রশ্ন হল থাকবে কি ..?..

সব খবর পড়তে আমাদের WhatsApp গ্রুপে যুক্ত হোনএখানে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *


প্রাসঙ্গিক খবর