মারাঠা সাহিত্য ও গীতি ছত্রপতি শিবাজি মহারাজ ছাড়া যেন অসম্পূর্ণ! বিখ্যাত মারাঠা সাম্রাজ্য ও কিংবদন্তি নায়ক ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ - Bangla Hunt

মারাঠা সাহিত্য ও গীতি ছত্রপতি শিবাজি মহারাজ ছাড়া যেন অসম্পূর্ণ! বিখ্যাত মারাঠা সাম্রাজ্য ও কিংবদন্তি নায়ক ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ

By Bangla Hunt Desk - May 13, 2023

সময়টা তখন সতেরো দশকের, ভারতবর্ষে বিশেষ করে দিল্লিতে মুঘল সাম্রাজ্য প্রবলভাবে বিদ্যমান। এইসময় উত্থান হয় মারাঠা সাম্রাজ্যের যা মুঘল সাম্রাজ্যের ভিত নাড়িয়ে দেয়। ১৬৫৮ সালে দিল্লির সিংহাসনে বসে ঔরাঙ্গজেবে, তার সময়েই মুঘল সাম্রাজ্যের আরও বিস্তার ঘটেছিল। সিংহাসনে বসেই ঔরাঙ্গজেব আরও সাম্রাজ্য বৃদ্ধিতে মনোযোগ দেয়। ঔরজেবের প্রধান লক্ষ্য ছিল ডেকান বিজয়। কিন্তু সেখানেই উত্থান ঘটে মারাঠাদের, যাদের পরাক্রমের সামনে বারবার পরাস্ত হয় ঔরাঙ্গজেব। তবে ঔরাঙ্গজেবের আগেও মহম্মদ বিন তুঘলকেরও ডেকানে আগ্রহ ছিল যার কারনে দৌলতাবাদে নিজের রাজধানী স্থানান্তর করেছিল মহম্মদ বিন তুঘলক। মারঠাদের উত্থানের পেছনে বেশ কয়েকটি কারন ছিল।

ডেকান অঞ্চলের পার্বত্যভূমি, ঘন জঙ্গল, ডেকান অঞ্চলের অদক্ষ শাসক, ঔরাঙ্গজেবের হিন্দু বিরোধী নীতি এবং সাধু তুকারাম, একনাথ ও রামদাসের মতন মারাঠা সাধুদের ভক্তি আন্দোলনের ফলে মারাঠা সাম্রাজ্যের উত্থান হয়। মারাঠারা মুঘলদের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ করত। মারাঠা সাম্রাজ্য স্থাপনের প্রধান কারিগর সাহাজী ভোঁসলে এবং ওনার পুত্র কিংবদন্তি নায়ক ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ। মারাঠাদের মধ্যে ঐক্য স্থাপন, সুদক্ষ প্রজাদরদি শাসক হিসাবে মারাঠা সহ ভারতের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র ছত্রপতি শিবাজি মহারাজ। মারাঠা সাহিত্য ও গীতি ছত্রপতি শিবাজি মহারাজ ছাড়া যেন অসম্পূর্ণ। বিখ্যাত মারাঠা সাম্রাজ্য ও মহান শাসক ছত্রপতি শিবাজি মহারাজ সম্পর্কেই বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।

সতেরো শতকের শুরুতেই মুঘল সাম্রাজ্য উত্তর ডেকান পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। ডেকান প্রদেশ সেসময় পাঁচভাগে বিভক্ত ছিল। আহমেদনগর যার নেতৃত্বে ছিল মালিক নিজাম শাহ, আদিল শাহের নেতৃত্বে বিজাপুর, ফাহতুল্লাহ ইমাদ উল মুলকের নেতৃত্বে বেরার, কোয়াসিম বারিদের নেতৃত্বে বিদার এবং কুতুব উল মুলকের নেতৃত্বে গোলকুন্ডা। মারাঠি ভাষা বলা মারাঠিরা প্রথমে আহমেদনগর ও বিজাপুর রাজ্যে মনসাবদার ও সেনানায়কের কাজ করত কারন তাদের মত বীর খুব কমই ছিল। মারাঠা গোষ্ঠী গুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল ভোঁসলে গোষ্ঠী। সাহাজী ভোঁসলের জন্ম হয় ১৫৯৪ সালে আহমেদনগরের মালোজী ভোঁসলের পরিবারে। মালোজী ভোঁসলে পুনে ও সুপে জেলা দুটির দায়িত্বে ছিলেন। সাহাজী ভোঁসলে প্রথমে আহমেদনগর সুলতানের প্রধান সেনাপতি হিসাবে নিযুক্ত হন। এইসময় মুঘল সম্রাট শাহজাহান ডেকান বিজয় করবার অভিযান শুরু করে। সাহাজী ভোঁসলে শাহজাহানের সাথে হাত মিলিয়ে জুনার ও সঙ্গমের দখল করে কিন্তু ১৬৩২ সালে মুঘলরা সাহাজী ভোঁসলের থেকে তার অংশ কেড়ে নেয় ফলে সাহাজী ভোঁসলে বিজাপুর সুলতানের সাথে হাত মিলিয়ে ১৬৩৪ সালে পুনে ও সুপা জেলা দখল করে। ১৬৩৬ সালে মুঘল ও সাহাজী ভোঁসলের মধ্যে পারিন্দায় যুদ্ধ হয় যাতে সাহাজী ভোঁসলে পরাজিত হয় এবং মুঘল বিজাপুর শান্তি চুক্তি সাক্ষরিত হয় যাতে জুনার সহ বেশ কিছু অংশ মুঘলকে দিতে বাধ্য হয় সাহাজী ভোঁসলে। পুনে থেকেও চলে যেতে বাধ্য করা হয় তাকে এবং পুনের দায়িত্ব দেওয়া হয় তার স্ত্রী জীজাবাই এবং পুত্র ছত্রপতি শিবাজি মহারাজকে। এখান থেকেই ডেকান রাজনীতিতে উত্থান শুরু হয় ছত্রপতি শিবাজি মহারাজের। পুনের কাছে শিবনির দুর্গে ১৬৩০ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারী জন্ম হয় ছত্রপতি শিবাজি মহারাজের। ওনার গুরু ছিলেন দাদু কোন্ডাদেব এবং সাধক রামদাস। ১৬৪৭ সালে দাদু কোন্ডাদেবের মৃত্যুর পর পুনার দায়িত্ব পান তিনি, তবে এর একবছর আগে থেকেই মাত্র ষোলো বছর বয়সেই তিনি সাম্রাজ্য বিস্তার শুরু করেছিলেন বিজাপুর অন্তর্ভুক্ত তোরনা দুর্গ অধিকার করে। ১৬৫৬ সালে রায়গড় দুর্গ অধিকার করেন যা ১৬৭৪ সালে মারাঠা সাম্রাজ্যের রাজধানী হয়েছিল। ১৬৫৬ সালে তিনি বিরোধী মারাঠা গোষ্ঠীর প্রধান চন্দ্ররাও মোরেকে পরাস্ত করে জাভেলি দখল করে যা বিজাপুরে তার অবস্থানকে মুজবুত করেছিল। এরপর বিজাপুরের একের পর অঞ্চল বিজয় করতে শুরু করেন তিনি, ফলে ১৬৫৯ সালে বিজাপুরের সুলতান আদিল শাহ দ্বিতীয়র সাথে তার প্রতাপগড়ের যুদ্ধ হয়। ছত্রপতি শিবাজির বীরত্বে ভীত হয়ে আদিল শাহ দ্বিতীয় তার সেনাপ্রধান আফজাল খাঁ ও দশ হাজার সেনা পাঠায় প্রতাপগড়ে। আফজাল খাঁ ছত্রপতি শিবাজি মহারাজকে চিঠি লিখে যুদ্ধের সরাসরি বৈঠকের আমন্ত্রন জানান। ছত্রপতি শিবাজি মহারাজ জানতেন এটা একটি চাল সেজন্য তিনি জবাব দেন দুজনের সাথে দেখা হবার সময় একজন দেহরক্ষী ছাড়া কেউ থাকবে না এবং কেউ কোন অস্ত্র নিয়ে যেতে পারবেনা। ছত্রপতি শিবাজি মহারাজ একটি সুরক্ষা কবজ পড়ে ও ডান হাতে একটি অস্ত্র লুকিয়ে নিয়ে আফজাল খাঁর সাথে দেখা করেন। আফজাল খাঁ হঠাৎই একটি ছোরা নিয়ে ছত্রপতি শিবাজি মহারাজের শরীরে আঘাত করেন কিন্তু আচ্ছাদন থাকায় ওনার কোন ক্ষতি হয়নি, এরপর ছত্রপতি শিবাজি মহারাজের ডানহাতের অস্ত্রলর আঘাতে মিত্যু হয় আফজাল খাঁর। ছত্রপতি শিবাজি মহারাজ এরপর বিজাপুরের সেনাকে পরাস্ত করে সব অস্ত্র কেড়ে নেন। ছত্রপতি শিবাজি মহারাজের ভয়ে ভীত হয়ে ঔরাঙ্গজেব সরাসরি ডেকান আক্রমনের বদলে শায়েস্তা খানকে প্রধান সেনাপতি করে পাঠায় ডেকানে।

১৬৬০ সালে শায়েস্তা খান পুনে দখল করে এবং পুনেতে মারাঠাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়। কিন্তু ১৬৬৩ সালে ৫ এপ্রিল একটি বিবাহ উপলক্ষে মারাঠাদের পুনেতে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়, এই সুযোগে ছত্রপতি শিবাজি মহারাজ ও চারশো মারাঠা সেনা ছদ্মবেশে ঢুকে পুনে দখল করে। ছত্রপতি শিবাজি মহারাজ শায়েস্তা খানের তিনটি আঙ্গুল কেটে দিয়েছিলেন যার জন্য ৫ এপ্রিল দিনটিকে শিবতেজ দিবস হিসাবে পালন করা হয় মহারাষ্ট্রে। পরাজয়ের ফলে হতাশায় ঔরাঙ্গজেব শায়েস্তা খানকে বাংলায় পাঠিয়ে দেয়। ১৬৬৫ সালে আম্বেরের রাজা জয়সিং এর নেতৃত্বে পুনরায় মুঘল ও মারাঠাদের যুদ্ধ হয় যাতে পুরন্দর দুর্গ দখল করে নেয় মুঘলরা এবং উভয়পক্ষের মধ্যে পুরন্দরের চুক্তি হয়। চুক্তি অনুযায়ী ছত্রপতি শিবাজি মহারাজকে তার ৩৫ দূর্গের মধ্যে থেকে ২৩ টি দুর্গকে মুঘলদের দিতে হয়। তবে মুঘলদের এই বিজয় ক্ষনস্থায়ী ছিল।

১৬৭০ সালে ছত্রপতি শিবাজি মহারাজ পুনরায় মুঘলদের আক্রমন করে সমস্ত দুর্গ পুনরুদ্ধার করেন। ১৬৭৪ সালে রায়গড় দুর্গে তার রাজ্যাভিষেক হয় এবং তাঁকে ছত্রপতি উপাধি দেওয়া হয়। ১৬৮০ সালের ৩ এপ্রিল এই মহান শাসক বীরগতি প্রাপ্ত হন।

ছত্রপতি শিবাজি মহারাজ একদজন দক্ষ শাসক ছিলেন৷ তিনি রাজ্যপরিচালনার জন্য অষ্টপ্রধান গঠন করেছিলেন যারা সরাসরি রাজাকে তথ্য দিতেন। প্রথমেই ছিল পেশোয়া যাকে প্রধানমন্ত্রী বলা হত এরপর সেনাপতি, অমাত্য, ওয়াকানবিশ, সচিব, সুমন্ত, নেয়াধিশ এবং পন্ডিতরাও পদে ছিলেন। ছত্রপতি শিবাজি মহারাজ শক্তিশালী নৌবহর গঠন করেছিলেন। মারঠা নৌবহরে প্রায় ৪০০ টি জাহাজ ছিল। এজন্য ওনাকে ভারতীয় নৌবাহিনীর জনক বলা হয়। কর সংগ্রহের জন্য বিশেষ পদ ছিল তার শানকালে, যাদের কারকুনস বলা হত। মারাঠা সাম্রাজ্যে চৌথ এবং সারদেশমুখী নামে দুটি প্রধান কর ছিল। চৌথ মানে ভূমির প্রধান লভ্যাংশের চারভাগের একভাগ এবং সরদেশমুখী মানে ভূমির বাকী লভ্যাংশের দশভাগের একভাগ। তবে এসব কর মারাঠা সাম্রাজ্যের লোকেদের দিতে হত না বরং মারাঠা আক্রমন থেকে বাঁচতে সীমান্তবর্তী রাজ্য গুলোকে দিতে হত যারা অন্য সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল। ছত্রপতি শিবাজি মহারাজের পর মারাঠা সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকার নিয়ে ওনার দুই পুত্র রাজারাম ও সাম্ভাজী মহারাজের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়, শেষপর্যন্ত সাম্ভাজী মহারাজ মারাঠা সাম্রাজ্যের প্রধান হন কিন্তু ১৬৮৯ সালে ঔরাঙ্গজেব সাম্ভাজী মহারাজকে হত্যা করে মারাঠাদের রাজধানী রায়গড় দখল করে নেয় এবং সাম্ভাজী মহারাজের পুত্র সাহু মহারাজকে বন্দী করে নেয় মারঠা সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী হিসাবে। এরপরেই মারাঠা সাম্রাজ্যে পেশোয়াদের উত্থান শুরু হয়। ১৭১৩ সালে সাহু মহারাজ পেশোয়া বালাজী বিশ্বনাথকে পেশোয়া নিয়োগ করেন যিনি মারাঠা সাম্রাজ্যের ভিত পুনরায় শক্তিশালী করেন। ১৭২২ সালে নতুন পেশোয়া নিযুক্ত হন বালজী বিশ্বনাথের পুত্র বাজীরাও ১, যাকে মারাঠি ইতিহাসে সবচেয়ে শক্তিশালী পেশোয়া বলা হয়। তার সময়েই ভারতবর্ষের এক তৃতীয়াংশে মারাঠা সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। বহু মুঘল রাজ্যের শাসক সহ হায়দ্রাবাদের নিজামকেও পরাস্ত করেছিলেন তিনি। বিশাল মারাঠা সাম্রাজ্য পরিচালনার জন্য তিনি মারাঠাদের পাঁচভাগে বিভক্ত করেছিলেন বরোদাতে গায়কোয়াড, নাগপুরে ভোঁসলে, ইন্দোরে হোলকার, গোয়ালিয়রে সিন্ধিয়া এবং পুনেতে পেশোয়া। মারাঠাদের ক্ষমতা বৃদ্ধি ও আফগান আক্রমণে ভীত হয়ে মুঘলরা ১৭৫২ সালে মারাঠাদের সাথে সন্ধি করে যাতে মারাঠারা মুঘল সাম্রাজ্যকে আফগান আক্রমন থেকে রক্ষা করার বদলে বিপুল কর পায় মুঘলদের থেকে। তবে ইতিহাসে সব বড় সাম্রাজ্যের মতোন মারাঠা সাম্রাজ্যেরও পতন হয়। যেকোনো সাম্রাজ্যের পতনের প্রধান কারন হচ্ছে দুর্বল শাসক ও অর্ন্তদ্বন্দ, মারাঠা সাম্রাজ্যেও তাই হয়। পুনেতে পেশোয়া নারায়ন রাওয়ের হত্যার পর উত্তরাধিকার নিয়ে দ্বন্দ্ব শুরু হয় যার সুযোগে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাথে মারাঠাদের ১৭৭৫-৮২ এর মধ্যে প্রথম অ্যাংলো মারাঠা যুদ্ধ হয়।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তখন পলাশী ও বক্সারের যুদ্ধে জয়লাভের পর ভারতে সাম্রাজ্য বিস্তার শুরু করেছিল। তবে তখনও মারাঠারা শক্তিশালী ছিল ফলে ইংরেজরা পরাজিত হয় এবং সলবাইয়ের সন্ধি অনুযায়ী কুড়ি বছরের শান্তির কথা হয়। ১৮০৩-০৫ এ দ্বিতীয় অ্যাংলো মারাঠা যুদ্ধ হয়, যাতে সিন্ধিয়া ও ভোঁসলেদের পরাস্ত করে একাধিক সন্ধি করা হয়। ১৮১৭ সালে অবশেষে তৃতীয় অ্যাংলো মারাঠা যুদ্ধের পর মারাঠা সাম্রাজ্যের পতন নিশ্চিত হয়। এছাড়াও কর সুনির্দিষ্ট করনীতির অভাব, গেরিলা যুদ্ধের উপর অতিরিক্ত ভরসা এবং পাঁচ মারাঠা গোষ্ঠীর মধ্যে বিরোধীতাও এই সাম্রাজ্যের পতনের কারন ছিল। তবে শূন্য থেকে উঠে আসা এক বিশাল সাম্রাজ্যের বিজয়গাথা ও তার কিংবদন্তি শাসক ছত্রপতি শিবাজি মহারাজের কথা ভারতের ইতিহাসে স্বর্নাক্ষরে লেখা আছে।

সব খবর পড়তে আমাদের WhatsApp গ্রুপে যুক্ত হোনএখানে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *


প্রাসঙ্গিক খবর