বটুকেশ্বর দত্ত! দেশের জন্য মাত্র ১৮ বছর বয়সে কারাগারের অন্ধকার কুঠুরিতে জীবন অতিবাহিত করেছিলেন - Bangla Hunt

বটুকেশ্বর দত্ত! দেশের জন্য মাত্র ১৮ বছর বয়সে কারাগারের অন্ধকার কুঠুরিতে জীবন অতিবাহিত করেছিলেন

By Bangla Hunt Desk - December 30, 2023

১৯২৯ সালে ৮ই এপ্রিল সেন্ট্রাল লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলির (Central Legislative Assembly) ভিতর হঠাৎ কেপে ওঠে এক বোমা বিস্ফোরণে। সাথে সাথে ধোঁয়ায় ধোঁয়া হয়ে যায় চারিদিক। এরই মধ্য থেকে একটি স্লোগান ভেসে আসে সবার কানে “ইনক্লাব জিন্দাবাদ”। আস্তে আস্তে ধোঁয়ায় আবরণ করা অস্পষ্ট মুখ দুটি স্পষ্ট হতে থাকে। তবুও তারা সেখান থেকে পালানোর চেষ্টা করে না। যথারীতি এই দুই বিপ্লবীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এই দুই বিপ্লবের মধ্যে একজন হলেন ভারতের অন্যতম স্বাধীনতা সংগ্রামী ভগত সিং এবং আরেকজন হলেন বটুকেশ্বর দত্ত যিনি মাত্র ১৮ বছর বয়সে কারাগারের অন্ধকার কুঠুরিতে জীবন অতিবাহিত করেছিলেন।

তাঁর বৈপ্লবিক জীবনের হাতে খড়ি হয়েছিল ভারতের অন্যতম স্বাধীনতা সংগ্রামী শচীন সান্যাল এর হাত ধরে। .১৯২৫ . সালে তিনি কানপুরের পি পি এন হাই স্কুলের থেকে তাঁর স্কুল স্তরে পড়াশোনা শেষ করে ভর্তি হয়েছিলেন কানপুর কলেজে।

আরো পড়ুন- শ্রী চৈতন্যদেব কি সত্যিই পুরীর সমুদ্রে অথবা জগন্নাথের দারু অঙ্গেই লীন হয়ে গিয়েছিলেন

তবে কানপুরে তিনি থাকলেও তিনি জন্মগ্রহন করেছিলেন তৎকালীন পরাধীন ভারতের অধুনা পশ্চিমবঙ্গের বর্তমানে পূর্ব বর্ধমান জেলার খণ্ডঘোষ থানার ওঁয়াড়ি গ্রামে।

১৯১০ সালে ১৮ নভেম্বর তাঁর জন্মের কিছুদিন পর তাঁর পিতা গোষ্টবিহারী দত্ত কাজের সূত্রে উত্তরপ্রদেশের কানপুরে আসেন। তাঁর পিতার সাথে তিনিও চলে আসেন কানপুরে। বটুকেশ্বর দত্ত নামে পরিচিত হলেও গ্রামে ছোটবেলায় তিনি ‘মোহন’ নামে পরিচিত ছিলেন। কলেজে পড়াকালীন সময়ে তিনি সংস্পর্শ এসেছিলেন শচীন্দ্রনাথ সান্যালের ওরফে লাট্টুর। শচীন্দ্রনাথ সান্যাল ছিলেন দেশের স্বাধীনতার জন্য লড়া অন্যতম এক বিপ্লবী এবং রাসবিহারী বসুর অনুগামী। যখন রাসবিহারী বসু তাঁর দেশের মাটি ত্যাগ করেছিলেন সেই সময় তিনি দেশের স্বাধীনতার দায়িত্ব তুলে দিয়েছিলেন বারাণসীর তাঁর এই অনুগামীর হাতে।

১৯২০ সালে শচীন সান্যালের সাথে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর মতভেদ তৈরি হয়েছিল দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের পদ্ধতি নিয়ে। তাদের এই মতভেদ নিয়ে তৎকালীন পত্রিকা ইয়ং ইন্ডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছিল লেখা। সেই লেখা পড়েই শচীন সান্যাল এর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন বটুকেশ্বর। এরপরই শচীন সান্যাল বটুকেশ্বরকে রাসবিহারী বসুর আদর্শে অনুপ্রাণিত করেছিলেন।

ওই সময় থেকে তরুণ বিপ্লবী বটুকেশ্বর দেশ থেকে পরাধীনতাকে হটাতে কাজ শুরু করেন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে। সেই সময় তার সাথে পরিচয় হয় শচীন বাবুর আরেক শীষ্য ভগৎ সিং এর সাথে। তাদের এই পরিচয় দ্রুত পরিণত হয়েছিল বন্ধুত্বের। ভগৎ সিং এর সংস্পর্শে এসে বটুকেশ্বরের মধ্যে ঘটেছিল আরো বৈপ্লবিক চেতনার বিকাশ। তিনি ছোটবেলা থেকে অত্যন্ত সাহসী এবং দেশপ্রেমী ছিলেন। এরপর তিনি যোগ দিয়েছিলেন “হিন্দুস্তান রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন” নামের এক গুপ্ত বিপ্লবী সংগঠনে। এই গুপ্ত বিপ্লবী সংগঠনটি মূল উদ্দেশ্য ছিল বিপ্লবী অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পতন ঘটানো। পরবর্তীকালে এই সংগঠনটির নাম পরিবর্তন করে হয়েছিল “হিন্দুস্তান সোশালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন”। এরপর তাঁর পরিচয় হয়েছিল আরও এক বিপ্লবী চন্দ্রশেখর আজাদের সাথে। তাদের সে সম্পর্কও ঘনিষ্ঠ মিত্রতায় পরিণত হয়েছিল। এরপর তিনি শেখেন বোমা বানানো, তাঁর সাথে এই শিক্ষা গ্রহণের সহযোগী ছিলেন ভগৎ সিং, শুকদেব। বিপ্লবী সদস্যদের কাছে তিনি বি.কে নামে পরিচিত ছিলেন।

এরপর বটুকেশ্বর যতীন্দ্রনাথ দাস যিনি পরবর্তীকালে বোম বানানোর কাজে বিপ্লবীদের দীক্ষাগুরু হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয় উত্তর ভারতের বিপ্লবী গোষ্ঠীর। এরই মধ্যে ব্রিটিশ সরকার বিপ্লবী আন্দোলনকে দমন করার জন্য সিদ্ধান্ত নেয় কেন্দ্রীয় আইনসভার ভারতীয় প্রতিরক্ষা বিল পেশ করার। তখন এই পাবলিক সেফটি বিলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার উদ্দেশ্যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছিল সেন্ট্রাল লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলির (Central Legislative Assembly) ভিতরে বোমা নিক্ষেপ করার। পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৯২৯ সালে ৮ই এপ্রিল ভগৎ সিং এবং তাঁর সহযোগী বটুকেশ্বর দত্ত অ্যাসেম্বলির ভেতর অধিবেশন চলাকালীন সময়ে দুটি বোমা নিক্ষেপ করেন। তবে কাউকে হত্যা করা ছিল না এই পরিকল্পনার উদ্দেশ্য। তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল পাবলিক সেফটি বিলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা। যথারীতি এই বোমা নিক্ষেপ করায় বেশ কিছু কাউন্সিলের সদস্য আহত হয়েছিল। এই বোমা দুটি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছিল যাতে নিক্ষেপ করার পরে অ্যাসেম্বলির চারদিক ধোয়ায় ভরে যায় এবং সেই ফাঁকে তারা দুজনে সেখান থেকে পালিয়ে যেতে পারতেন। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী সব কিছু হলেও সেখান থেকে পালিয়ে যান না ভগৎ সিং এবং বটুকেশ্বর দত্ত। উল্টে “ইনকিলাব জিন্দাবাদ” বলে স্লোগান দিতে শুরু করলেন সেখানেই। এরপর ব্রিটিশ পুলিশ তাদেরকে গ্রেফতার করে।

শুরু হয় তাদের বিরুদ্ধে মামলা। এরই মধ্যে উঠে এসেছিল তাদের বিরুদ্ধে একটি ডেপুটি কমিশনার জি পি স্যান্ডার্স হত্যাকাণ্ডের তথ্য। শুরু হয়েছিল তাদের বিরুদ্ধে আরেক মামলা যা ইতিহাসে পাতায় লাহোর ষড়যন্ত্র মামলা নামে পরিচিত। স্যান্ডার্সকে হত্যাকে করেছিলেন ভগৎ সিং এবং তার অন্যান্য সহকারীরা। কারণ ১৯২৮ সালে যখন সাইমন কমিশনের বিরুদ্ধে লাহোরে আন্দোলন করা হয়। সেই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী লালা লাজপত রাই। এই আন্দোলনে ক্ষুব্ধ হয়ে পুলিশ সুপার জেমস স্কট নির্দেশ দেন বিক্ষোভকারীদের উপর লাঠি চার্জ করার। স্কট নিজেই এই লাঠি চার্জে করতে গিয়ে ধরে ফেলেন লালা লাজপত রাইকে। রিপোর্টে দাবি অনুসারে, লালা লাজপত রাইকে ধরার পর লাঠি দিয়ে আঘাত করেন স্কট। যার ফলে তিনি মারাত্মকভাবে আহত হন এবং কয়েকদিনের মধ্যেই মৃত্যুবরন করেন। তবে অবশ্য সেই দাবী অস্বীকার করেছিল ব্রিটিশ আদালত। ভগৎ সিং ছিলেন লালা লাজপত রাইয়ের অনুগামীদের মধ্যে অন্যতম। এই ঘটনার প্রতিশোধ নেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহন করলেন তিনি। তাঁর এই অভিযানে যোগদান করেন চন্দ্রশেখর আজাদ, রাজগুরু এবং শুকদেব থাপার। তবে তাদের সেই পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়ে যায় কারণ তারা ভুলবশত স্কটের পরিবর্তে অ্যাসিট্যান্ট পুলিশ সুপার স্যান্ডার্সকে হত্যা করেন। এরপর এই মামলা চলেছিল ১৯২৯ সালের ১১ জুলাই থেকে ১৯৩০ সালের ৭ অক্টোবর পর্যন্ত। সেই মামলায় অভিযুক্ত ছিলেন ভগৎ সিং, শুকদেব, শিবরাম রাজগুরু, বটুকেশ্বর দত্ত সহ আরো অনেক বিপ্লবীরা। এই মামলার রায়ে ভগৎ সিং, শুকদেব, শিবরাম রাজগুরুকে ফাঁসির আদেশ, বটুকেশ্বর দত্তকে যাবজ্জীবন কারাদন্ডের আদেশ দেওয়া হয়েছিল এবং বাকিদের বিভিন্ন মেয়াদী শাস্তি দেওয়া হয়েছিল। সেই জেলে বহু বিপ্লবীরা ব্রিটিশদের নির্মম অত্যাচারে শারীরিক এবং মানসিক দিক থেকে অসুস্থ হয়ে পড়ছিলেন। এরই মধ্যে বটুকেশ্বর দত্তের মধ্যে বাসা বেঁধেছিল টিবি রোগ। এরপর রোগাক্রান্ত হওয়ায় জেল থেকে ১৯৩৮ সালে মুক্তি পায় বটুকেশ্বর। কিন্তু তাঁর বাংলা, পাঞ্জাব ও উত্তরপ্রদেশ প্রবেশ নিষিদ্ধ হয়ে যায়।

তিনি ছিলেন বিপ্লবী তাই তাঁকে দমিয়ে রাখা অসম্ভব ছিল। মুক্তি লাভের পর তিনি পুনরায় ফিরে আসেন তাঁর পুরনো রাস্তায়। যোগদান করেন ভারতছাড়ো আন্দোলনে। যার কারণে তাঁকে পুনরায় কারারুদ্ধ হতে হয়েছিল তিন বছরের জন্য।

তবে তাঁর শেষ জীবনটা কেটেছিল চরম কষ্টে। যিনি সারা জীবন দেশের জন্য তাঁর প্রাণপাত করে গেছিলেন সেই প্রানেরই দাম দেয়নি এই দেশ। সরকারি সাহায্য বা সম্মান বিশেষ কিছু পাননি তিনি।

একদিন যেখানে তিনি বিপ্লবীর বেশে এসেছিলেন সেখানেই তিনি শেষ জীবনে এসেছিলেন এক অসহায় অসুস্থ দারিদ্রের বেশে। এইভাবেই তিনি ভারতের রাজধানী দিল্লিতে তাঁর শেষ জীবন কাটিয়েছেন। তখনও তিনি ষাট পেরোয়নি তার শরীরকে ঘিরে ফেলেছিল রোগে। দিন দিন তাঁর অবস্থা ক্রমাগত অবনতি হতে থাকে। অবশেষে ১৯৬৫ সালে ২০ জুলাই, মাত্র ৫৪ বছর বয়সে দিল্লীর একটি হাসপাতালে লোকচক্ষুর আড়ালে মৃত্যুবরন করেন। বটুকেশ্বর দত্তের তাঁর শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী তাঁর শেষ কাজ করা হয়েছিল তার বন্ধু ভগৎ সিং এবং রাজগুরুর মতো পাঞ্জাবের হুসেইনিওয়ালায়।

তাঁর নামে নামকরন করা রয়েছে দিল্লি এয়ারপোর্ট এর পাশের একটি রাস্তার নাম যা বি.কে দত্ত কলোনি নামে পরিচিত হয়ে রয়েছে।

সব খবর পড়তে আমাদের WhatsApp গ্রুপে যুক্ত হোনএখানে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *


প্রাসঙ্গিক খবর