ঊনিশ শতকের রাজনীতিতে বালগঙ্গাধর তিলক - Bangla Hunt

ঊনিশ শতকের রাজনীতিতে বালগঙ্গাধর তিলক

By Bangla Hunt Desk - March 05, 2023

রানা চক্রবর্তীঃ ঊনিশ শতকে ভারতের জাতীয় আন্দোলন কিছুটা দ্বিধাগ্রস্তভাবেই শুরু হয়েছিল। কংগ্রেসের প্রথম যুগের নেতারা তখনকার শিক্ষিত উচ্চ-মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে এসেছিলেন। ফলে এটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার যে, সমসাময়িক অবস্থা সম্বন্ধে তাঁরা মোটামুটি সন্তুষ্টই ছিলেন। প্রধানতঃ প্রতিনিধিত্বমূলক সরকারই তাঁদের কাম্য ছিল। কিন্তু কংগ্রেসের দাবীর প্রতি সরকারের বিমাতৃ-সুলভ মনোভাবই ঐ প্রতিষ্ঠানকে ক্রমশঃই সরকার-বিরোধিতায় সক্রিয় করে তুলেছিল। ফলে কংগ্রেসের বক্তারা ক্রমশঃ অগ্নিবর্ষী হয়েছিলেন। ব্রিটিশ সরকারের প্রতি তাঁদের সমালোচনার পরিধি বৃদ্ধি পেয়েছিল এবং গভীরতর হয়েছিল। সেসবের ফলে, প্রথমদিকে ইংরেজ শাসনের সুফল সম্বন্ধে তাঁদের মধ্যে যে সরব সচেতনতা দেখা গিয়েছিল, সেটাও ক্রমে বন্ধ হয়ে, বরং একটা অশ্রদ্ধার ভাবই ক্রমশঃ প্রকাশ পেয়েছিল। একথা অস্বীকার করবার কোন উপায় নেই যে, শুধুমাত্র কৃতজ্ঞতার ভিত্তিতে একটা রাজনৈতিক আন্দোলনের সূত্রপাত করাটা কোন দূরদর্শীরই কাম্য নয়। কিন্তু ঊনিশ শতকের শেষ দশকে, এবং বিংশ শতকের প্রথম দশকের মধ্যেই ভারতের জাতীয় সংগ্রামে বিপ্লববাদের সূচনা দেখা দিয়েছিল। কংগ্রেসের প্রথম যুগের নেতাদের চেয়ে সেই বিপ্লবীবাদীদের বক্তব্য আরও সুস্পষ্ট ছিল, এবং তাঁদের মনোভাবে ব্রিটিশ সরকারের প্রতি এক প্রকার মৌল বিদ্বেষ ছিল। মারাঠী নেতা বাল গঙ্গাধর তিলক তখনকার সেই বিপ্লববাদী দলের অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন। ভারতের ইতিহাস থেকে সেই বিপ্লববাদের বিকাশের কারণ বিশ্লেষণ করলে দেখতে পাওয়া যায় যে, প্রথমতঃ, তখনকার শহরাঞ্চলের পেটি বুর্জোয়া শ্রেণীর, অর্থাৎ দরিদ্র ছাত্র, অর্ধভুক্ত বুদ্ধিজীবি আর ক্রমবর্ধমান বেকারদের, ধূমায়িত অসন্তোষ সেটার পিছনে ছিল। তাঁদের সামনে তখন অগ্রগতির কোন পথই প্রশস্ত ছিল না। ওই সময়ে তাঁদের জীবনযাত্রা হয়ে উঠেছিল ক্রমশঃই দুর্বিষহ হয়ে উঠছিল। স্বভাবতঃই তখনকার উচ্চ-মধ্যবিত্তশ্রেণীর নেতাদের ধীর-স্থির-প্রগতি তত্ত্বে আস্থা রাখাটা তাঁদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। দ্বিতীয়তঃ, ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের দাবীর প্রতি তখনকার সরকারী মনোভাব ক্রমশঃই বিরূপ হয়ে ওঠার ফলে, তৎকালীন কংগ্রেসের মিতাচারী নায়কদের (যাঁরা ‘মডারেট’ বলে পরিচিত ছিলেন) মধ্যেও সরকার-বিরোধী মনোভাব দানা বেঁধে উঠেছিল। তাছাড়া, তাঁরা যখন বুঝতে পেরেছিলেন যে, ভবিষ্যৎ ক্ষমতা অর্পণের আয়োজন অযথাই বিলম্বিত হচ্ছে, তখন তাঁরা আর সেই কৃতজ্ঞতা-বোধ আশ্রিত, নিয়ম-তান্ত্রিক আন্দোলনে বিন্দুমাত্র বিশ্বাসী থাকতে পারেন নি। তৃতীয়তঃ, ওই সময়ে সত্যিকারের কার্যকরী কিছু করবার প্রয়োজনীয়তা সকলেই উপলব্ধি করছিলেন। জাতীয় নেতারা বেশ বুঝতে পারছিলেন যে, শুধুমাত্র মৌখিক বুলির সাহায্যে কখনোই অভীষ্ট সংস্কার-সাধন সম্ভব নয়। চতুর্থতঃ, নেতাদের আপোষ-মীমাংসার নীতির প্রতি সাধারণের অসহিষ্ণুতা যতক্ষণ দিনে দিনে বেড়েই চলেছিল। আর সেই কারণেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ও পরাধীনতার বিরুদ্ধে আপোষহীন ও চূড়ান্ত সংগ্রামের ব্যাকুলতা দেখা দিয়েছিল। তাছাড়া, পশ্চিমী শিক্ষা ও সভ্যতার প্রভাবে ভারতীয় সমাজের তথাকথিত ‘বিজাতীয়করণের’ ফলে, বিক্ষুব্ধ রক্ষণশীল সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্রিটিশ-বিরোধিতা প্রকট হয়ে উঠেছিল। পরিশেষে, তখন যেখানে বিপ্লববাদের সূচনা ঘটেছিল, সেই মহারাষ্ট্রে, ব্রিটিশ শাসনের প্রতি অসহিষ্ণু বিদ্বেষ বহুদিনের ঐতিহ্যগত ছিল। আসলে মারাঠীরাই শেষ ভারতীয় শক্তি ছিলেন, যাঁরা এদেশে ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে দৃঢ়-প্রতিজ্ঞ সংগ্রাম চালিয়েছিলেন। এমন কি ১৮৬২ সালে এবং ১৮৭৯ সালে পর্যন্ত মহারাষ্ট্রে বিদ্রোহ দেখা দিয়েছিল। কিন্তু শেষপর্যন্ত নতি স্বীকার করতে বাধ্য হলেও ওই সব বিদ্রোহের স্মৃতি মারাঠীদের একটি বিরাট অংশকে সব সময়েই প্রভাবিত করেছিল। মহারাষ্ট্রের চিৎপাবন ব্রাহ্মণ শ্রেণী, যাঁদের মধ্যে থেকে সেই বিপ্লববাদের নায়ক তিলক উঠে এসেছিলেন, পেশোয়াদের আমল থেকেই তাঁরা দেশের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে চলেছিলেন। মারাঠীদের দেশে তাঁরাই তখন রাজনীতিতে ও মননশীলতায় অভিজাত ছিলেন; সেখানে তাঁরাই তখন আইন, শিক্ষা এবং সরকারী কাজের পুরোধা ছিলেন। তাঁদেরই মধ্যে কেউ কেউ পেশোয়াদের লুপ্ত গৌরব পুনরুদ্ধারের স্বপ্নও দেখতেন।

ওই সময়ের জাতীয় আন্দোলনে চরমপন্থীদের ভূমিকা যাঁরা নিয়েছিলেন, প্রকৃতপক্ষে ভারতে তাঁরা এক নতুন রাজনৈতিক ভাবধারার প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন, যেটা মূলতঃ নিশ্চিত এবং চূড়ান্তরূপে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে সব সম্পর্ককে চুকিয়ে দিতে চেয়েছিল। তখনকার রাজনৈতিক দিক থেকে সেটা প্রগতিধর্মী ছিল। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে আপোষহীন সংগ্রামই তাঁদের নীতি ছিল, এবং সেটার জন্য তাঁরা সারা দেশ জুড়ে আন্দোলনের ব্যবস্থাও করেছিলেন। তৎকালীন কংগ্রেসী আন্দোলনের মধ্যে তাঁরা বিরোধীপক্ষের ভূমিকা নিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁদের সেই আন্দোলন কখনোই গণ-আন্দোলনের রূপ নিতে পারে নি। কিছু সীমিতসংখ্যক লোকের ব্যক্তিগত এষণাই সেই আন্দোলনের মূল অনুপ্রেরণা ছিল। প্রকৃতপক্ষে ওই আন্দোলন স্বল্পসংখ্যক বিক্ষুব্ধ নিম্ন-মধ্যবিত্ত-শ্রেণীতে নিহিত ছিল, জনগণের সাথে যেটার সংযোগই ছিল না। আর সেই কারণেই তাঁদের অভীষ্টসিদ্ধি অসম্ভবপ্রায় ছিল। এর ফলে, ওই আন্দোলন ব্যক্তিগত কয়েকজনের অরাজক কার্যধারায় পর্যবসিত হয়েছিল। ওই চরমপন্থী রাজনৈতিক আন্দোলনে কিছুটা অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্বের অস্তিত্বও ইতিহাস থেকে অনুধাবন করা যেতে পারে। রাজনৈতিক দিক থেকে যথেষ্ট উন্নত হয়েও সেই আন্দোলন, সামাজিক ও ধর্মীয় রক্ষণশীলতার দ্বারস্থ হয়ে ছিল, এবং সেই প্রাচীন রক্ষণশীল হিন্দু সামাজিক ও ধর্মীয় ব্যবস্থাকেই জাতীয় আন্দোলনের মূল উপজীব্য করতে চেয়েছিল। এরই ফলে সেই আন্দোলনের রূপ বেশ কিছুটা সাম্প্রদায়িকও হয়ে উঠেছিল। আধুনিক কালের একজন চিন্তাবিদের মতে, আন্দোলনটির সেই বিশেষ রূপ পরিগ্রহণের যথার্থ কারণ এটাই ছিল যে, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে সঙ্গে ভারতে যে সাম্রাজ্যবাদী বুর্জোয়া সংস্কৃতির প্রবর্তন ঘটতে শুরু করেছিল, সেকালের শিক্ষিত মধ্যবিত্তসমাজ, সেটার কোন বিকল্প খাড়া করতে পারেন নি। চরমপন্থীরা আসলে যতটা ছিলেন ব্রিটিশ শাসনের আনুষঙ্গিকের বিরোধী ছিলেন, ততটা পাশ্চাত্য-সভ্যতা বিরোধী ছিলেন না। তাঁরা সাম্রাজ্যবাদী প্রভুত্বের দোষগুলোকেই পাশ্চাত্য সভ্যতার অভিশাপ ভেবে ভুল করেছিলেন। ঊনিশ শতকের অধিকাংশ সামাজিক ও ধর্মীয় আন্দোলনই, অংশতঃ বা সামগ্রিকভাবে পুরাতন প্রতিষ্ঠিত সমাজ ও ধর্মব্যবস্থার মোহান্ধতায় নিহিত ছিল। এমন কি ১৮৫৭ খ্রীষ্টাদের সিপাহী বিদ্রোহও কিছুটা হলেও, নতুন নীতির বিরুদ্ধে প্রাচীনের জেহাদ ছিল। অবশ্য উপরোক্ত দু’ প্রকার ব্যাখ্যাই আপাতঃ অর্থে সত্যি; বর্তমান জ্ঞানের পরিধিতে সেসবের কোন নির্দিষ্ট ও চূড়ান্ত ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব নয়।

জাতীয় আন্দোলনের চরমপন্থীরা সাধারণতঃ বাল গঙ্গাধরের ব্যক্তিত্বকে কেন্দ্র করেই সঙ্ঘবদ্ধ হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন চিৎপাবন ব্রাহ্মণ ছিলেন। বোম্বাই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক হলেও, তাঁর ওপরে পশ্চিমী শিক্ষার প্রভাব সামান্যই পড়েছিল। তাছাড়া তিনি একজন সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত ছিলেন, এবং অচিরেই শিক্ষাব্রতী ও সাংবাদিক হিসেবে প্রখ্যাত হয়েছিলেন। তিলকের দৃঢ়সংকল্প চরিত্র, মনীষা ও পাণ্ডিত্য, ইংরেজী ও মারাঠী ভাষায় অসীম দখল এবং বাগ্মিতার জন্য, মহারাষ্ট্রে তাঁর গুণমুগ্ধ অনুগামীর সংখ্যা ক্রমেই বাড়তে শুরু করেছিল। পশ্চিমী সভ্যতার প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়েও তিলক কিন্তু তাঁর অভীষ্ট সাধনের জন্য পশ্চিমী বিপ্লবপন্থাকেই বেছে নিয়েছিলেন। তাঁর প্রথম কাজ ছিল দুটি সংবাদপত্রের প্রতিষ্ঠা – ‘কেশরী’ ও ‘মারাঠা’। সেই দু’টিরই বৈশিষ্ট ছিল উগ্র ব্রিটিশ বিরোধিতা, আর সেগুলির ভাষা ছিল আপোষহীনতার চরম নিদর্শন। অচিরেই, ‘রাণাডের’ নেতৃত্বাধীন বোম্বাই সমাজের প্রগতিশীল অংশের সাথে বিরোধ দেখা দিয়েছিল। সেই সুযোগে তিলক তাঁদের থেকে ‘পুণ্য সার্বজনিক সভা’, এবং ‘দাক্ষিণাত্য শিক্ষা সমিতি’ নামের সংস্থা দু’টিকে ছিনিয়ে নিতে চেয়েছিলেন। তবে সেই ব্যাপারে তিনি শুধু যে ব্যর্থ হয়েছিলেন তাই নয়, ওই দু’টি প্রতিষ্ঠান থেকেই তাঁকে বিতাড়িতও করা হয়েছিল। ইতিমধ্যে, ১৮৯০ খ্ৰীষ্টাব্দে ‘সহবাস সম্মতি আইনের’ বিলটি (Age of Consent Bill) পাশ হওয়ায়, তিলকের কর্মতৎপরতা আরো বৃদ্ধি পেয়েছিল। ওই সময়ে ‘কেশরী’তে প্রকাশিত কতগুলো প্রবন্ধে তিনি সরকারের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করেছিলেন। তাঁর বক্তব্য ছিল যে, সরকার হিন্দুদের প্রাচীন ধর্মীয় রীতিতে হস্তক্ষেপ করেছে, এবং হিন্দুরা প্রয়োজন হলে নিজেদের প্রাণের বিনিময়েও তাঁদের ধর্মীয় স্বার্থকে রক্ষা করবেন। তখন যে সমস্ত হিন্দুরা ওই বিলটির স্বপক্ষে ছিলেন, তাঁদেরও তিনি দেশদ্রোহী ও স্বধর্মত্যাগী আখ্যা দিয়েছিলেন। ফলে তিলকের সঙ্গে বোম্বাইয়ের প্রগতিপন্থী নেতাদের, যেমন ‘ভাণ্ডারকার’, ‘চন্দ্রাভরকর’ ও ‘গোপালকৃষ্ণ গোখলে’ প্রমুখের বিবাদ দেখা দিয়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিলক, ‘নাটু’ ভাইদের সহযোগিতায় সেই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে স্কুল-কলেজে জোর প্রচারকার্য চালাতে সমর্থ হয়েছিলেন, এবং ইংরেজ শক্তিকে আটকানোর জন্য বলপ্রয়োগের প্রয়োজনীয়তার ওপরে জোর দিয়েছিলেন। ওই সময়েই মহারাষ্ট্রে বিভিন্ন ব্যায়ামচর্চার আখড়া গড়ে উঠেছিল, এবং সেগুলোই পরে সশস্ত্র বিপ্লবের কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। ১৮৯৩ সালেই বোম্বাইতে একটা অবাঞ্ছিত হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা দেখা দিয়েছিল। অতঃপর তিলক ‘গো-রক্ষা সমিতি’ নামে একটি প্রতিক্রিয়াশীল সমিতি গঠন করেছিলেন, যেটার মূল উদ্দেশ্যই ছিল মুসলমানদের বিরুদ্ধাচরণ করা। আজও ঐতিহাসিকেরা অভিযোগ করেন যে, সেই সমিতি থেকে প্রকাশিত পুস্তকাদিতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার তীব্র উস্কানি দেওয়া হত। এরপরে তিলক বোম্বাইতে ‘গণপতি উৎসবেরও’ প্রবর্তন করেছিলেন। তখন প্রত্যেক বছর দশদিন ধরে সেই উৎসব পালন করা হত। এখনকার মত তখনও ওই উৎসবের সময়ে শোভাযাত্রা বের করা হত, এবং তাতে এমন কিছু আমোদ প্রমোদের আয়োজন থাকত, যেগুলি স্বভাবতঃই মুসলমানদের পক্ষে আপত্তিকর ও অস্বস্তিকর হয়েছিল। ফলে মুসলমানেরা ওই জাতীয় আমোদ-প্রমোদের বিরুদ্ধে নিজেদের আপত্তি জানিয়েছিলেন, এবং রাউলাট কমিটির রিপোর্টেও সেই উৎসব পরিচালকদের বিরুদ্ধে নানারকম অভিযোগ আনা হয়েছিল। তিলকের সময়ে ‘ম্লেচ্ছ’দের বিরুদ্ধে ঘৃণার মনোভাব জাগিয়ে তোলবার জন্য গণপতি উৎসবে বিভিন্ন ধর্মীয় সঙ্গীতানুষ্ঠান, এবং ধর্মীয় শ্লোক আবৃত্তির ব্যবস্থাও করা হয়েছিল; তাছাড়া ওই উৎসবের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তখন ভারতে বিদেশী শাসনের প্রতি নিন্দার সঙ্গে সঙ্গে মুসলমানদের আচার ব্যবহারের নিন্দা করাও চলত। সুতরাং ঐতিহাসিকদের মতে, তিলক প্রবর্তিত ‘গণপতি উৎসব’ তখন অংশতঃ সাম্প্রদায়িক এবং অংশতঃ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ছিল। উক্ত সময়ে ‘পুণা সার্বজনিক সভা’র মত মিতাচারী সংস্থাও সেই উৎসবের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলতে উদ্যত হয়েছিল। শিবাজীই প্রথম মোঘল শাসনের বিরুদ্ধে মারাঠাদের একত্র করেছিলেন; তিলক তাই শিবাজীর স্মৃতি-স্তম্ভ সংস্কার সম্পর্কীয় একটা আন্দোলন গড়ে তোলবার বিষয়ে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন, এবং শিবাজীর স্মৃতির উদ্দেশ্যে একটি উৎসবের প্রবর্তন করেছিলেন। সেই ‘শিবাজী উৎসবের’ মাধ্যমে তিলক মারাঠাদের মধ্যে একটা বলিষ্ঠ জাতীয়তাবোধের সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন, এবং দেশবাসীকে শিবাজীর আদর্শ অনুসরণের জন্য আবেদন জানিয়েছিলেন। ১৮৯৫ সালের প্রথম শিবাজী উৎসবের সময়ে একটি সংস্কৃত শ্লোকের সাহায্যে হিংসাত্মক কার্যকলাপের প্রতি খোলাখুলি আস্থা ঘোষণা করা হয়েছিল, এবং একজন ব্রাহ্মণ মহৎ লোকেরা নৈতিকতার সাধারণ আদর্শের ঊর্ধ্বে বলে শিবাজীর সঙ্গে আফজল খাঁর সংঘর্ষকে সমর্থন জানিয়েছিলেন। তখন একথাও বলা হয়েছিল যে, নিঃস্বার্থ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপরাধও সমর্থনীয়। উক্ত সময়ে তিলক দেশবাসীকে পেনাল কোডের বাধ্যবাধকতার বাইরে এসে শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার উচ্চমার্গে প্রবেশ করবার উপদেশ দিয়েছিলেন। এরপরে তিলক তদানীন্তন বোম্বাইয়ের বিধান পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। সংসদের মধ্যেও তাঁর বক্তৃতার ভাষা, তাঁর গণভাষণ ও সম্পাদকীয়ের ভাষার মতই উগ্র ছিল। পরিষদে চরমপন্থীদের মনোভাব ও অনুভূতি তাঁর মধ্য দিয়ে বাণীরূপ পেয়েছিল। দাক্ষিণাত্যে ১৮৯৬ সালে মর্মান্তিক দুর্ভিক্ষের সময়ে তিলক খাজনা-বন্ধ আন্দোলন সংগঠিত করেছিলেন। সেই সময়ে তিনি দুর্ভিক্ষ-পীড়িত অঞ্চলগুলির রায়তদের কাছে নিজস্ব প্রতিনিধি পাঠিয়ে এই মর্মে মিথ্যা ঘোষণা করতে বলেছিলেন যে, সরকার ঐ বছরের জন্য রাজস্ব সংগ্রাহকদের কর আদায় করতে নিষেধ করেছেন। তাঁর সেই কৌশল বেশ ভালোভাবেই কাজ করেছিল। এরপরে বোম্বাইতে চাপেকার ভাইদের একজন, রাণী ভিক্টোরিয়ার মূর্তিটির ক্ষতি সাধন করেছিলেন। ওই ধরনের বৃটিশ-বিরোধী মনোভাবের প্রকাশ ছাড়াও সেই আন্দোলন খুব শীঘ্রই একটা কদর্য রূপ নিয়েছিল; যেমন – ভারতীয় মডারেটদের রাস্তায় নিগ্রহের চেষ্টা, এবং গুণ্ডামী ইত্যাদির দ্বারা অরাজক অবস্থার সৃষ্টি করা। চাপেকার ভাইয়েরা ‘হিন্দুধর্মের প্রতিবন্ধক দূরীকরণ সমিতি’ নামে (যদিও নামটা কিছুটা প্রতিক্রিয়াশীল) একটা বিদ্রোহী সংস্থাও গঠন করেছিলেন। ইতিমধ্যে বোম্বাইতে প্লেগ রোগ দেখা দিলে সরকার প্রতিবিধানের সুব্যবস্থার জন্যে ‘W. C. Rand’-এর হাতে ক্ষমতা দিয়েছিলেন। প্লেগ নিবারণে র‍্যাণ্ডের ব্যবস্থা মারাঠী সমাজের গোঁড়া লোকেদের মনঃপূত হয়নি। উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে যে, র‍্যাণ্ড বৃটিশ সৈন্যদের দ্বারা তৎকালীন বোম্বাইয়ের প্রতিটি ভারতীয় গৃহের স্বাস্থ্য-ব্যবস্থা পরিদর্শনের জন্য গৃহতল্লাসীর ব্যবস্থা করেছিলেন। সত্য-মিথ্যা যাই হোক না কেন, সেই সৈন্যদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ক্ষেত্রে আতিশয্যের অভিযোগ আনা হয়েছিল, এর ফলে সরকারকে উগ্র সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছিল। ১৮৯৭ সালে র‍্যাণ্ডের ব্যবস্থার তীব্র সমালোচনা করে ‘কেশরী’তে পর পর কয়েকটি প্রবন্ধ ছাপা হয়েছিল, এবং সেই বছরেরই ২২শে জুন তারিখে, চাপেকার ভাইদের হাতে র‍্যাণ্ড এবং আয়ার্টের মৃত্যু ঘটেছিল। আধুনিক ভারতের ইতিহাসে সেটাই প্রথম রাজনৈতিক হত্যা ছিল, এবং অভিযুক্ত ব্যক্তিদের স্বীকারোক্তি থেকে জানা গিয়েছিল যে, ওই হত্যাকাণ্ডের প্রেরণা হিসেবে তিলকের চিন্তা ও প্রচার কার্যকরী ভূমিকা নিয়েছিল। সেই হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত অভিযুক্ত ব্যক্তিরা আদালতে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছিলেন, এবং ওই বিচারে তিলকেরও ১৮ মাস সশ্রম কারাদণ্ডের আদেশ হয়েছিল। বিচারকদের মতে, উক্ত সময়ে ‘কেশরী’তে প্রকাশিত প্রবন্ধগুলি প্ররোচনা ও রাজদ্রোহমূলক ছিল। এক বছর পরে তিলক জেল থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন। কিন্তু ১৮৯৯ সালেই মহারাষ্ট্রে আরো দুটো রাজনৈতিক হত্যার (সরকারী গুপ্তচর হত্যা) পরিকল্পনা ও রূপায়ণ হয়েছিল। চাপেকার ভাইদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত সমিতির কয়েকজন সভ্য সেই হত্যাকাণ্ডের মূলে ছিলেন। তিলকের কারাদণ্ড অথবা সরকারের দমননীতি, কোনটাই কিন্তু মহারাষ্ট্রে তিলকের প্রভাবকে বিন্দুমাত্র কমাতে পারেনি। এরপরে ‘কেশরী’ আরো উগ্র ভাষায় প্রকাশিত হতে শুরু করেছিল, এবং তিলক যথার্থই জাতীয় নেতা হয়ে উঠেছিলেন। ১৮৯৭ সালের কংগ্রেসে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তিলকের প্রতি তাঁর সর্বান্তঃকরণ সমর্থন জানিয়ে বলেছিলেন যে, তিলকের বন্দী অবস্থা সমগ্র দেশকে শোকাচ্ছন্ন করেছে। তৎকালীন বঙ্গদেশেও বঙ্গভাষী পত্রিকাগুলিতে কেশরীর অনুকরণে খোলাখুলি বিপ্লবাত্মক ভাবনা ও প্রেরণা প্রকাশিত হতে শুরু করেছিল।

ইতিহাস বলে যে, তিলকের সেই চরমপন্থা বিপ্লবী রাজনীতির উদ্ভবে অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছিল, এবং ভারতের অন্যান্য অংশের কাছে আদর্শ হয়ে উঠেছিল। ভারতবর্ষে পরবর্তীযুগের বিপ্লবী আন্দোলন তিলকের ধারণা এবং সংগঠন প্রণালীকে, প্রায় পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অনুসরণ করেছিল। তিলক পরিচালিত আন্দোলনে রাজনৈতিক উগ্রতা ও সামাজিক প্ৰতিক্রিয়ার এক বিপত্তিকর সম্মিলন হয়েছিল বলে ঐতিহাসিকেরা মনে করেন। সেই অদ্ভুত সংমিশ্রণের প্রভাব মারাঠী জাতীয় আন্দোলনের ইতিহাসেই ছড়িয়ে পড়েছিল। এর ফলে, রাজনৈতিক সচেতনতার প্রসার বিলম্বিত হয়েছিল, আর ভারতীয় শিক্ষিত সমাজে উদারনৈতিক রাজনীতির বিস্তারও বিনষ্ট হয়েছিল। আরও দুর্ভাগ্যজনক হল যে, সেসবের ফলে তখন এদেশের প্রগতিশীল শক্তিগুলির মধ্যেও নীতিগত বিরোধ দেখা দিয়েছিল। তক্ষকের রাজনীতিতে যাঁরা মিতাচারী ছিলেন, তাঁরা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে চরমপন্থীদের চেয়ে উন্নত ছিলেন বলে গবেষকরা মনে করেন। আবার জওহরলালের পিতা পণ্ডিত মতিলাল নেহেরু তৎকালীন রাজনীতিতে সেই মডারেটদের শ্রেণীভূক্ত না হলেও, তিলকের প্রতিক্রিয়াশীলতার প্রতি তাঁর কোন সহানুভূতিই ছিল না; সুতরাং তিনি তিলকের সাথে কখনোই হাত মেলান নি। তাছাড়া ওই আন্দোলন কিছুটা সাম্প্রদায়িক রূপ নেওয়ার ফলে সেখান থেকে মুসলমানদের বাদ দিতে বাধ্য হতে হয়েছিল। ওই আন্দোলনের প্রত্যক্ষ ফলসমূহ দুর্বল, এবং কতগুলি ব্যক্তিগত পর্যায়ের বিপ্লববাদী কর্মধারার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু সেই ব্যক্তিগত পর্যায়ের বিপ্লববাদ ভারতে ও অন্যান্য দেশে ব্রিটিশ রাজের মনে গভীরভাবে রেখাপাত করতে সমর্থ হয়েছিল। ফলে ভারতের জরুরী অবস্থা সম্পর্কে ইংরেজরা যথেষ্ট সচেতন হয়ে উঠেছিলেন।

(তথ্যসূত্র:
১- Bal Gangadhar Tilak: His Writings And Speeches.
২- Indian Unrest, Valentine Chirol.
৩- A History Of The Indian Nationalist Movement, Verney Lovett.
৪- The Sedition Committee Report, 1918.
৫- The Tilak Trial, 1897.)

সব খবর পড়তে আমাদের WhatsApp গ্রুপে যুক্ত হোনএখানে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *


প্রাসঙ্গিক খবর