উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী ও কালাজ্বর - Bangla Hunt

উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী ও কালাজ্বর

By Bangla Hunt Desk - December 20, 2022

একজন বৈজ্ঞানিকের জীবনে যথেষ্ট অনিশ্চয়তা থাকে। অতীতে এমন অনেক বৈজ্ঞানিক ছিলেন বা এখনো আছেন, যাঁরা নিজেদের সারাজীবন ধরে গবেষণা করে গিয়েছিলেন বা এখনো গবেষণা করে চলেছেন, কিন্তু তেমন কিছু চমকপ্রদ আবিষ্কার করবার ভাগ্য তাঁদের হয় নি। আবার এমন অনেক বৈজ্ঞানিক ছিলেন বা এখনো আছেন, তাঁরা যা কিছুতেই হাত দিয়েছিলেন বা দিয়েছেন, তাতেই তাঁরা সফল হয়েছিলেন বা হয়েছেন। ডাঃ উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী এমনি একজন ভাগ্যবান বৈজ্ঞানিক ছিলেন। ১৮৭৩ সালের ১৯শে ডিসেম্বর তারিখে জামালপুরে উপেন্দ্রনাথের জন্ম হয়েছিল। সেখানে তাঁর পিতা ‘নীলমণি ব্রহ্মচারী’ রেলওয়ের ডাক্তার ছিলেন। স্কুল জীবন থেকেই উপেন্দ্রনাথের প্রতিভা ও তীক্ষ্ণ বুদ্ধির পরিচয় পাওয়া গিয়েছিল। তাঁর কলেজ জীবন কেটেছিল হুগলী কলেজে। সেখান থেকে তিনি বি. এ. পরীক্ষায় গণিতে অনার্সে প্রথমস্থান অধিকার করেছিলেন। এরপরে তিনি কলকাতায় রসায়ন নিয়ে এম. এ. ক্লাসে ভর্তি হয়েছিলেন। তাঁর পিতার ইচ্ছা ছিল যে, তাঁর প্রতিভাবান পুত্র যেন তাঁর মতোই চিকিৎসক হন। কিন্তু চিকিৎসা-বিদ্যায় উপেন্দ্রনাথের ঠিক ততটা উৎসাহ ছিল না, যতটা গণিত ও রসায়নের প্রতি ছিল। তবে তাঁর পিতার ইচ্ছাই শেষ পর্যন্ত পূর্ণ হয়েছিল। উপেন্দ্রনাথ কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে একথা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে যে, উপেন্দ্ৰনাথ যেদিন মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন, সেদিন দেশের জন্য এক শুভদিন সূচিত হয়েছিল, এবং সেজন্য উপেন্দ্রনাথেরও কোনোদিন অনুতাপ করবার কোনো কারণ ঘটেনি। একজন মানুষের জীবনে যা যা কাম্য থাকে – অর্থাৎ অর্থ, যশ, লোকের কৃতজ্ঞতা – সেসব কিছুই তিনি লাভ করেছিলেন। রসায়নশাস্ত্রে জ্ঞান ও চিকিৎসাবিদ্যার ব্যবহারিক নৈপুণ্য তাঁর গবেষণার ক্ষেত্রে বিশেষ সহায়ক হয়েছিল। মেডিক্যাল কলেজে পড়বার প্রথম বছরে তিনি এম. এ. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। সেই পরীক্ষাতেও তিনি প্রথম শ্রেণী লাভ করেছিলেন। ১৮৯৯ সালে ‘এম. বি.’ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। তাতে মেডিসিন ও সার্জারি – এই দুটি বিষয়েই তিনি প্রথম হয়েছিলেন। সেকালের কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের ইতিহাসে প্রধান দুটি বিষয়ে প্রথম হওয়ার কৃতিত্ব খুব অল্প লোকেরই ছিল। এরপরে ১৯০২ সালে তিনি ‘এম. ডি.’ ও ১৯০৪ সালে ‘পি. এইচ. ডি.’ ডিগ্রি লাভ করেছিলেন। ‘এম. বি.’ পাস করবার পরেই ডাঃ ব্রহ্মচারী ‘বেঙ্গল মেডিক্যাল সার্ভিসে’ যোগ দিয়েছিলেন। প্রথমে তিনি ঢাকার মেডিক্যাল স্কুলে ‘প্যাথলজি’ ও ‘মেটেরিয়ামেডিকা’র শিক্ষক হিসেবে কাজ শুরু করেছিলেন। ১৯০৫ সালে তিনি ‘ক্যাম্পবেল মেডিক্যাল স্কুলে’ বদলি হয়ে এসেছিলেন। তারপরে সেখানেই তাঁর কর্মবহুল জীবনের অনেকগুলি বছর অতিবাহিত হয়েছিল। ১৯২৩ সালে ডাঃ ব্রহ্মচারী কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে অতিরিক্ত চিকিৎসক হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন। তিনিই মেডিক্যাল কলেজের ইতিহাসের প্রথম ব্যক্তি ছিলেন, যিনি একজন ‘আই. এম এস.’ না হয়েও ওই পদে নিযুক্ত হয়েছিলেন। সেই একই সময়ে আরো দু’জন ভারতীয় চিকিৎসক মেডিক্যাল কলেজে অবৈতনিক চিকিৎসক হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন। তাঁরা ছিলেন ‘স্যার কৈলাসচন্দ্র বসু’ ও শস্ত্রচিকিৎসক ‘মেজর হাসান সুরাবর্দি’। ডাঃ ব্রহ্মচারী ১৯২৭ সালে সরকারী কাজ থেকে অবসর গ্রহণ করেছিলেন। তারপরে তিনি ‘কারমাইকেল মেডিক্যাল কলেজে’ কর্মরত ছিলেন। একই সাথে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ-রসায়নের অধ্যাপক পদেও নিযুক্ত হয়েছিলেন। ১৯৪৬ সালের ৬ই ফেব্রুয়ারি তারিখে ৭২ বছর বয়সে এই অনলস বৈজ্ঞানিকের জীবনাবসান ঘটেছিল।
ক্যাম্পবেল মেডিক্যাল স্কুলে কাজ করবার সময়ে, ১৯২০ সালে ডাঃ ব্রহ্মচারী ‘ইউরিয়া স্টিবেমাইন’ (Urea Stibamine) আবিষ্কার করেছিলেন। তাঁর সেই আবিষ্কারের ফলে লক্ষ্য লক্ষ্য মানুষের জীবন রক্ষা পেয়েছিল। সেই সময়ে ম্যালেরিয়ার মতো কালাজ্বরের কবলে পড়েও বাংলা ও আসামের হাজার হাজার মানুষ প্রতি বছর প্রাণ হারাতেন। কালাজ্বর তখন নিশ্চিত মৃত্যুর পরওয়ানা নিয়ে হাজির হত, কারণ, সেই রোগের তখন কোনো সুচিকিৎসাই ছিল না। অতীতের একটা সময়ে কালাজ্বরকে ম্যালেরিয়ারই অন্য রূপ বলে মনে করা হত। ১৯০০ সালে ‘লেইসমান’ (Leishman) প্রথম কালাজ্বরের জীবাণু আবিষ্কার করেছিলেন। তারপরে ১৯০৩ সালে ‘ডনোভেন’ও (Donovan) সেই জীবাণুর অস্তিত্ব প্রমাণ করেছিলেন। পরবর্তী সময়ের বৈজ্ঞানিকেরা প্রমাণ করেছিলেন যে ‘স্যাণ্ডফ্লাই’ (Sandfly) নামক এক ধরণের মাছি সেই রোগকে একজনের দেহ থেকে অন্যজনের দেহে ছড়িয়ে দেয়। ১৯১৫ সালে ‘রজার্স’ কালাজ্বরের চিকিৎসার জন্য প্রথম অ্যান্টিমনির (Antimony) ব্যবহার করেছিলেন। কিন্তু অধিক পরিমাণে সেই ওষুধ ব্যবহারে রোগীর দেহে বিষক্রিয়া দেখা দিত, আবার অল্প পরিমাণে ব্যবহার করলে কোন ফলই হত না। ডাঃ ব্রহ্মচারীর ‘ইউরিয়া স্টিবেমাইন’ যদিও অ্যান্টিমনি থেকেই তৈরি ছিল, তবুও সেই ওষুধ সব ধরণের দোষ থেকে মুক্ত ছিল। অতএব আবিষ্কারের অল্পদিনের মধ্যেই ইউরিয়া স্টিবেমাইনই ভারতে কালাজ্বরের একমাত্র ওষুধ হয়ে উঠেছিল। ইতিহাস বলে যে, ‘ক্রিস্টোফারস’ (S. R. Christophers), ‘শর্ট’ (H. E. Shortt), ‘ব্যারড’ (P. G. Barraud)-কে নিয়ে গঠিত ‘ভারতীয় কালাজ্বর কমিশন’ কেবলমাত্র ইউরিয়া স্টিবেমাইন ব্যবহার করেছিল। ওই ওষুধ আবিষ্কারের ফলে উপেন্দ্রনাথ চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছেন। ইউরিয়া স্টিবেমাইনের জন্য তিনি খ্যাতি ও সম্মান অজস্রভাবে লাভ করেছিলেন, প্রচুর অর্থও উপার্জন করেছিলেন। তবে একটু বললে সম্ভবতঃ কালাজ্বরের মত ভীষণ রোগের বিরুদ্ধে ডাঃ ব্রহ্মচারীর লড়াইকে অতি সরলীকরণ করা হয়ে যায়। সেজন্য ব্যাপারটা বিস্তারে আলোচনা করবার প্রয়োজন রয়েছে।
কল্পনা করুন ১৯২৩ সালের ১০ই সেপ্টেম্বর তারিখের সেই মর্মান্তিক দৃশ্য, যখন মারা যাচ্ছিলেন ‘সুকুমার রায়’। পরলোকের পথে পা বাড়িয়ে দেওয়া সেই পুত্রের পায়ের উপরে মুখ গুঁজে বসেছিলেন তাঁর বিধবা মা – ‘বিধুমুখী দেবী’। সুকুমারের স্ত্রী ‘সুপ্রভা দেবী’ তাঁর মাথার কাছে একটা ছোট টুলে বসেছিলেন, তাঁর মুখে কথা ছিল না, তাঁর বন্ধ চোখ থেকে বইছিল জলের ধারা। সুকুমারের মৃত্যু এসেছিল মাত্র পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে, বাংলা শিশু সাহিত্যে তাঁর অবিস্মরণীয় গ্রন্থ ‘আবোল তাবোল’ ছেপে বেরনোর ঠিক ন’দিন আগে। সুকুমার রায়ের রোগের নাম ছিল ‘কালাজ্বর’। ততদিনে কিন্তু কালাজ্বরের দিশি ওষুধ ইউরিয়া স্টিবামাইন বেরিয়ে গিয়েছিল। ১৯২২ সালের অক্টোবর মাসে, সুকুমারের মৃত্যুর প্রায় এক বছর আগেই, সেই ওষুধের অবিষ্কর্তা ডাঃ উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী ‘ইন্ডিয়ান জার্নাল অব মেডিক্যাল রিসার্চে’ সেই ওষুধের সফল প্রয়োগের কথা লিখেছিলেন। তা সত্ত্বেও সুকুমার কেন সেই ওষুধ পাননি? সম্ভবতঃ সেটার পিছনের একমাত্র কারণ ছিল যে, কলকাতার সাহেব ডাক্তাররা তখনও সেই ওষুধকে ছাড়পত্র দেননি। সুকুমারের চিকিৎসা করছিলেন তাঁরই ঘনিষ্ঠ আত্মীয়, মেয়ো হাসপাতালের অধ্যক্ষ, ‘দ্বিজেন্দ্রনাথ মৈত্র’। তিনি ক্যাম্বেল মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষক-চিকিৎসক উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারীর আবিষ্কারের কথা জানতেন কি না, কে জানে। তবে ‘লীলা মজুমদারের’ লেখা থেকে জানা যায় যে, “সেবাযত্ন, ওষুধপত্রের কোনও ত্রুটি হয়নি।” কিন্তু সেই ওষুধ কী ছিল, তা অবশ্য জানা যায় না। ঊনবিংশ আর বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে ব্রিটিশ অধ্যুষিত ভারতে মহামারি লেগেই থাকত। কখনো বন্যা, কখনো খরা, আবার কখনো বা ম্যালেরিয়া- কলেরা-কালাজ্বর। ‘স্যার রোনাল্ড রস’ এই ভারতেই গবেষণা করে ‘ম্যালেরিয়া’ যে মশাবাহিত রোগ সেটা আবিষ্কার করেছিলেন। তাঁর সেই আবিষ্কার ম্যালেরিয়ার কিছুটা প্রকোপ কমালেও কালাজ্বরের উপদ্রব থেকে ভারতবাসীর তখনও পর্যন্ত রেহাই ছিল না। বাংলা, বিহার আর আসামের গ্রামের পর গ্রাম জনপদ শূন্য হয়ে গিয়েছিল সেই রোগের কবলে পড়ে। জনগণের কথা ভেবে, ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল সার্ভিস তখন স্যার রোনাল্ড রসকে কালাজ্বরের ওষুধ আবিষ্কারের জন্য নিযুক্ত করেছিল। কিন্তু তিনি তখন ম্যলারিয়ার জীবাণু আবিষ্কার করবার পরে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। তাই সেই নতুন দায়ভার নেওয়ার মত মানসিক অবস্থা তখন তাঁর ছিল না। শেষ পর্যন্ত কালাজ্বরের ওষুধ আবিষ্কার করে ডাঃ ব্রহ্মচারী সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। আগেই বলা হয়েছে যে, উপেন্দ্রনাথ কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ থেকে ডাক্তারি পাশ করে ‘প্রভিন্সিয়াল মেডিক্যাল সার্ভিসে’ যোগদান করেছিলেন। কিন্তু তাঁর আসল কাজ শুরু হয়েছিল কলকাতার ক্যাম্পবেল মেডিক্যাল কলেজে যোগদান করবার পরে। সেই কলেজেই ডাঃ ব্রহ্মচারী ভারতের মত গ্রীষ্মপ্রধান দেশের বিভিন্ন দুরারোগ্য মারনব্যাধির নিরাময় সংক্রান্ত গবেষণায় নিমজ্জিত হয়েছিলেন। বলা বাহুল্য যে, রসায়ন শাস্ত্রে তাঁর অগাধ নৈপুণ্য তাঁকে সেই ব্যাপারে বেশ সাহায্য করেছিল। ওই মেডিক্যাল কলেজের এক অন্ধকার ল্যাবরেটরিতেই তিনি কালাজ্বরের ওষুধ আবিষ্কার করেছিলেন। ক্যাম্পবেল কলেজের সেই ল্যাবরটেরিতে কোন ন্যূনতম সুযোগ সুবিধা পর্যন্ত ছিল না। সেখানে না ছিল বুন্সেন বার্নার, আর না ছিল ইলেকট্রিক বাতি। লন্ঠনের অল্প আলোয় আলোকিত সেই ল্যাবে কাজ করেই একদিন রাত দশটা নাগাদ তিনি তাঁর বহু প্রত্যাশিত ফল পেয়েছিলেন। সেটা ছিল একটি রায়ায়নিক পদার্থ – যেটা কালাজ্বরের জীবাণুকে দহনে সক্ষম ছিল। গবেষণাগারের ঐসব প্রতিকূলতা ডাঃ ব্রহ্মচারীর মনোবলকে এতটুকু ক্ষুণ্ণ করতে পারে নি। সেই আবিষ্কারের অনেকদিন পরে তিনি মন্তব্য করেছিলেন, “ওই ল্যাবরেটরি আমার কাছে তীর্থস্থানের সমান।” কিন্তু কিভাবে তিনি সফল হয়েছিলেন কালাজ্বরের ওষুধ আবিষ্কারে? সে গল্প নিতান্তই অনুপ্রেরনাদায়ক।
ভারতে কালাজ্বর রোগটা প্রথমে ধরা পড়েছিল পশ্চিমী ডাক্তারদের হাতে, সম্ভবতঃ ১৮২৪ সালে বর্তমান বাংলাদেশের যশোর শহরে। কিন্তু প্রথমে তাঁরা সেই রোগকে ম্যালেরিয়া বলে ভুল করেছিলেন। ওই রোগের প্রধান লক্ষণগুলো ছিল – যকৃৎ ও প্লিহার বৃদ্ধি, গুমো জ্বর, রক্তাল্পতা আর ‘শরীরে কালো রঙের দাগ (যে কারণে ওই রোগের নাম দেওয়া হয়েছিল কালাজ্বর)। ১৯০৩ সালে ‘চার্লস ডোনোভেন’ কালাজ্বরের জীবাণু আবিষ্কারের পরে তাঁর ও উইলিয়াম লাইশম্যানের নামানুসারে সেই প্রোটোজোয়ার নাম দেওয়া হয়েছিল – ‘লাইশম্যান ডোনভানি’। যাই হোক, সেই সময়ে কালাজ্বরের উপশমের জন্য যে কয়টি ওষুধ জানা ছিল সেগুলোর কোনটাই খুব একটা কাজ করত না। যেমন – ‘টারটার এমেটিক’ (‘অ্যান্টিমনি টারটারেটের পটাসিয়াম লবণ’) কালাজ্বর আক্রান্তের শিরায় প্রয়োগ করা হত। কিন্তু বহুদিন ধরে সেই ওষুধ নিলে আক্রান্তের মধ্যে বেশ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যেত। তাছাড়া ওই ওষুধগুলো সব সময় টাটকা বানাতে হত, সেগুলো সংরক্ষণের বেশ অসুবিধা ছিল, আর বানাতেও বেশ কাঠখড় পোড়াতে হত। উপরন্তু, ঠিকমত সাবধানতা অবলম্বন না করলে শিরায় ইঞ্জেকশন দেওয়ার সময়ে তখন অন্য রোগের সংক্রমনের সম্ভাবনাও প্রবল ছিল। তাই ডাঃ ব্রহ্মচারী ঠিক করেছিলেন যে সেটার কিছু একটা বিহিত করতে হবে। তখন দরকার ছিল সহজলভ্য কার্যকরী কালাজ্বরের ওষুধ। সেই সময়ে বৈজ্ঞানিক মহলে অ্যান্টিমনির কিছু অজৈব রাসায়নিকের বিষক্রিয়ার কথা জানা ছিল। তাই ডাঃ ব্রহ্মচারী মনস্থির করেছিলেন যে, অ্যান্টিমনির সেই রাসায়নিকগুলো দিয়েই তিনি কালাজ্বরের জীবাণুদের নিধন করবেন। সেই মত কিছু কিছু কম্পাউন্ডও তৈরি করেছিলেন। সেগুলো প্রয়োগে কিন্তু আশানুরূপ কোন ফল হয় নি। তারপরে তিনি অজৈব এন্টিমনি পদার্থ থেকে জৈব পদার্থের দিকে নিজের চোখ ফিরিয়েছিলেন। সেই সময়ে তিনি ‘স্টিবানিলিক অ্যাসিডের’ নানান লবণ তৈরি করেছিলেন। একটার পর একটা পদার্থের বিষক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। কিন্তু সেখানেও তিনি অসফল হয়েছিলেন। সেই অসফলতা সত্ত্বেও কিন্তু তিনি ভেঙ্গে পড়েন নি। তিনি অন্য কোন রাস্তার কথা ভাবতে শুরু করেছিলেন। এরপরেই তাঁর মাথায় এসেছিল যে ‘ইউরিয়া’কে অন্য কোন ওষুধের সাথে প্রয়োগ করলে সেটা ব্যথা নিরাময়ের কাজ করে। তিনি ভেবেছিলেন যে, এন্টিমনির লবণগুলো আর ইউরিয়াকে মেশালে কেমন হয়! তারপরে তিনি সেই কাজ শুরু করেছিলেন। এরপরে একটা সময়ে তিনি ইউরিয়া আর স্টিবানিলিক অ্যাসিডকে একসাথে মিশিয়ে তাপপ্রয়োগ করেছিলেন। তাতেই সফলতা এসেছিল। তৈরি হয়েছিল ‘ইউরিয়া স্টিবামাইন’। ডাঃ ব্রহ্মচারী এবং ইন্ডিয়ান মেডিকেল সার্ভিসের শ্রট সাহেব দেখেছিলেন যে, সেই নতুন পদার্থ কালাজ্বরের জীবাণু মারতে দিব্যি সক্ষম। শুধু তাই নয়, সেটার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াও অনেক কম। এরপরে তাঁর সেই নতুন আবিষ্কারের কথা সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়েছিল। দিকে দিকে কালাজ্বরের নিরাময়ের জন্য সেই ওষুধ প্রয়োগ হতে শুরু হয়েছিল। ফলও এসেছিল হাতেনাতে। ধীরে ধীরে সেই রোগের প্রকোপে মৃত্যুর সংখ্যা কমতে শুরু হয়েছিল। এই প্রসঙ্গে আসামের তদানীন্তন গভর্নর, ‘স্যার জন কের’ তাঁর বিদায়কালীন সম্ভাষণে বলেছিলেন, “কালাজ্বর সংক্রান্ত ডাঃ ব্রহ্মচারীর গবেষণা নিঃসন্দেহে এক উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব। তাঁর এই কাজের জন্যই আসামে গত দশ বছরে অন্তত তিন লাখ লোক এই রোগের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে।” এরপর থেকেই চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসে কালাজ্বর আর উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী – দুটি অচ্ছেদ্য নাম হয়ে গিয়েছিল। উপেন্দ্রনাথকে তাঁর সফলতার জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘কোটস’ পদক, স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিনের ‘মিন্টো-পদক’, এশিয়াটিক সোসাইটির ‘স্যার উইলিয়ম জোন্‌স ও বার্কলে’ পদক, ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে ‘কাইজার-ই-হিন্দ’ পদক দেওয়া হয়েছিল। এছাড়াও ব্রিটিশ সরকার তাঁকে ‘রায় বাহাদুর’ ও ‘নাইটহুড’ উপাধি দিয়ে সম্মানিত করেছিল। তিনি ১৯৩৬ সালে অনুষ্ঠিত ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের সাধারণ সভাপতি হয়েছিলেন। ডাঃ ব্রহ্মচারী প্রথম বাঙালি ও ভারতীয় চিকিৎসক ছিলেন যিনি মূল কংগ্রেসের সভাপতি হতে পেরেছিলেন। তাঁর আগে অবশ্য একজন ভারতীয় চিকিৎসক মূল কংগ্রেসের সভাপতি হয়েছিলেন, তিনি ছিলেন অধ্যাপক ‘শিবরাম কাশ্যপ’। যদিও কাশ্যপ আগ্রা মেডিক্যাল স্কুল থেকে ডিপ্লোমা নিয়ে কিছুদিন চিকিৎসাবৃত্তি চালিয়েছিলেন, কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই তিনি একজন উদ্ভিদ বিজ্ঞানীরূপে যশস্বী হয়ে উঠেছিলেন, এবং লাহোর গভর্ণমেন্ট কলেজে উদ্ভিদবিদ্যার অধ্যাপক হয়েছিলেন। তাঁর জীবন উদ্ভিদবিদ্যার চর্চায় কেটেছিল, অতএব তাঁকে চিকিৎসক বলা চলে না। ডাঃ ব্রহ্মচারীর আগে কংগ্রেসের মূল সভাপতিদের মধ্যে তিনজন চিকিৎসক ছিলেন, আর সেই তিনজনই ছিলেন বিদেশী। ১৯২৯ সালে অনুষ্ঠিত ‘রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গলের’ একটি সভার সভাপতির ভাষণে ডাঃ ব্রহ্মচারী বলেছিলেন, “ক্যাম্পবেল হাসপাতালের সেই রাতটির কথা মনে হলে এখনো আনন্দ হয়। রাত দশটায়, কেরোসিনের ক্ষীণ আলোয় ধূমাচ্ছন্ন ঘরের ভিতর আমার গবেষণার প্রথম ফল প্রত্যক্ষ করলাম। তখনো জানতাম না, ঈশ্বর আমার হাতে এমন এক তামোঘ অস্ত্র দিয়েছেন যা দিয়ে আমার দেশের লক্ষ লক্ষ লোকের প্রাণ রক্ষা হবে। যে ঘরটিতে আমি দিনের পর দিন, মাসের পর মাস কাজ করেছি, সে ঘরে না ছিল বিজলি বাতি, না ছিল গ্যাস, জলের ট্যাপ। তবু সে ঘর আমার কাছে চিরদিন তীর্থস্থান হয়ে থাকবে।” বর্তমানে নিজেদের অক্ষমতা ঢাকার জন্য অধিকাংশ মানুষই সময় সুযোগ সুবিধার অভাবের দোহাই দিয়ে থাকেন। একথা অবশ্য ঠিক যে, জটিল বৈজ্ঞানিক গবেষণায় সূক্ষ্ম যন্ত্রপাতি একান্ত দরকার হয়। কিন্তু যে সব উপকরণ হাতে থাকে, সেগুলিকেও কি পুরোপুরি কাজে লাগানো সম্ভব নয়! উপেন্দ্রনাথ প্রমাণ করে দিয়েছিলেন যে প্রতিভা, সংকল্প ও সহিষ্ণুতা থাকলে নানা অসুবিধার মধ্যেও সার্থকভাবে কাজ করা যায়। কালাজ্বরের উপর উপেন্দ্রনাথ বেশ কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। ‘Kala- azar: Its treatment’ (১৯১৭), ‘A Treatise on Kala-azar’ (১৯২৮), ‘Gleanings from My Researches’ (১৯৪০) গ্রন্থগুলি আজও তাঁর গবেষণালব্ধ অভিজ্ঞতার সাক্ষ্য বহন করে চলছে।

পরিশেষে, আরেকবার চলে যাওয়া যাক ১৯২৯ সালে। জায়গাটা ছিল সুইডেনের ‘ক্যারলিন্সকা ইন্সটিটিউট’। বিশ্বের তাবড় তাবড় চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের মধ্য থেকে কে বা কারা চিকিৎসাশাস্ত্রে ‘নোবেল’ পুরস্কার পাবেন, সেটা তখন ওই প্রতিষ্ঠানের অধ্যাপকেরা ঠিক করতেন, আর আজও তাঁরাই ঠিক করেন। সেই বছর চিকিৎসাশাস্ত্রে নোবেলের মনোনয়ন ঘাঁটতে ঘাঁটতে সেখানকার অধ্যাপকদের হাতে এক ভারতীয় চিকিৎসকের নাম উঠে এসেছিল, যিনি কিনা কলকাতার ক্যাম্পবেল মেডিকেল কলেজে (এখনকার ‘এন. আর. এস. মেডিক্যাল কলেজ’) গবেষণা করে কালাজ্বরের ওষুধ – ইউরিয়া স্টিবেমাইন আবিষ্কার করেছিলেন। খোদ ব্রিটিশ সরকারের রিপোর্ট জানিয়েছিল যে, সেই ওষুধ লক্ষ লক্ষ কালাজ্বরে আক্রান্ত মানুষকে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে এনেছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে সেই বছরের চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল ‘ক্রিশ্চিয়ান আইজম্যান’ এবং ‘ফ্রেড্রিক হপকিন্স’ সাহেবদের – পুষ্টিপ্রদায়ক ভিটামিন আবিষ্কারের জন্য। ডাঃ উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী ১৯২৯ সালে বা তার পরবর্তী কোন বছরেই আর নোবেল পান নি। কিন্তু তিনি লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণ রক্ষা করতে পেরেছিলেন। সেই উপলব্ধি সম্ভবতঃ তাঁর কাছে হাজার নোবেল পুরস্কারের থেকেও অনেক বেশি দামি ছিল। তাঁর সেই কাজ গোটা বিশ্বের মানুষের কাছে আশীর্বাদ স্বরূপ হয়ে উঠেছিল।

সব খবর পড়তে আমাদের WhatsApp গ্রুপে যুক্ত হোনএখানে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *


প্রাসঙ্গিক খবর