জিৎ, প্রসেনজিৎ নাকি দেব, এই তিন নায়কের মধ্যে সবথেকে বেঁটে কে? নাকি দেব, এই তিন নায়কের মধ্যে সবথেকে বেঁটে কে?

টলিউডের সুপারস্টার বলতেই প্রথমেই যাদের নাম মাথায় আসে তারা হলেন প্রসেনজিৎ চ্যাটার্জী, জিৎ, দেব। এছাড়াও রয়েছেন অন্য আরও অনেক তারকা। পর্দায় নায়িকাদের সঙ্গে তাদের রোমান্স হোক কিংবা অ্যাকশন, জমিয়ে উপভোগ করেন দর্শকরা। টলিউডের এই সেরা অভিনেতাদের উচ্চতা (Tollywood Heroes Height) সম্পর্কে কোনও ধারণা আছে কি? প্রসেনজিৎ, দেব, জিৎ থেকে শুরু করে যিশু, আবিরদের প্রকৃত উচ্চতা কত? জেনে নিন আজকের এই প্রতিবেদন থেকে।

আবির চ্যাটার্জি (Abir Chatterjee) : এই প্রজন্মের কাছে টলিউডের অন্যতম হ্যান্ডসাম অভিনেতা হলেন আবির। বেশ কিছু ছবিতে অভিনয় করে তিনি এখন টলিউডের প্রথম সারির অভিনেতা। বাঙালি মহিলাদের হার্টথ্রব তিনি, তার উচ্চতা ৬ ফুট ২ ইঞ্চি।

দেব (Dev) : টলিউডের এই সুপারস্টার অভিনেতার উচ্চতা কিন্তু কিছু কম নয়। শুরুটা কমার্শিয়াল ছবি দিয়ে হলেও এখন ভিন্ন ভিন্ন ধারার ছবিতে নিজেকে মেলে ধরছেন দেব। ‘টনিক’ থেকে ‘কিশমিশ’, তার ছবিগুলো দর্শকদের থেকে আলাদাভাবে সাড়া পাচ্ছে। দেবের উচ্চতা ৬ ফুট ১ ইঞ্চি।

মিঠুন চক্রবর্তী (Mithun Chakraborty) : ৯০ এর দশকে বলিউড এবং টলিউডের অ্যাকশন সুপার হিরো ছিলেন মিঠুন চক্রবর্তী। ফাটাকেষ্ট থেকে মহাগুরু, আবার বলিউডের ডিস্কো ড্যান্সার! মিঠুনের রয়েছে অনেক নাম। তার উচ্চতা ৬ ফুট।

যিশু সেনগুপ্ত (Jishu Sengupta) : কেরিয়ারের শুরুতে বলিউডে সেভাবে জায়গা পাননি যিশু। তবে আজ সারা দেশ জুড়েই তার বিস্তৃতি। বাংলা ছবির পাশাপাশি বলিউডের বিভিন্ন ছবি এবং ওটিটি প্ল্যাটফর্ম ও সাউথ ইন্ডিয়ান ছবিতেও তাকে দেখা যাচ্ছে। যিশুর উচ্চতাও ৬ ফুট।

যশ দাশগুপ্ত (Yash Dasgupta) : সিরিয়াল দিয়ে কেরিয়ারের শুরুটা হলেও আজ টলিউডের জনপ্রিয় নায়কে পরিণত হয়েছেন যশ দাশগুপ্ত। যশের উচ্চতাও ৬ ফুট।

সোহম চক্রবর্তী (Soham Chakraborty) : একেবারে তিন বছর বয়স থেকে অভিনয় করছেন সোহম চক্রবর্তী। তিনিও আজ টলিউডের একজন সুপারস্টার। অন্যান্য অভিনেতাদের তুলনায় তার উচ্চতা কিছুটা কম। তার উচ্চতা হল ৫ ফুট ৯ ইঞ্চি।

জিৎ (Jeet) : প্রসেনজিতের পর জিৎ বাংলা ইন্ডাস্ট্রিতে নিজের জায়গা পাকা করে নিয়েছিলেন। ‘সাথী’, ‘নাটের গুরু’ সিনেমা থেকে শুরু করে আজকের ‘রাবণ’, ‘রংবাজ’, একের পর এক হিট ছবি উপহার দিয়েছেন টলিউডকে। তার বাস্তব উচ্চতা ৫ ফুট ৮ ইঞ্চি।

প্রসেনজিৎ (Prasenjit Chatterjee) : টলিউডের ইন্ডাস্ট্রি নামে পরিচিত প্রসেনজিৎ চ্যাটার্জির নামটা বিনোদনের দুনিয়াতে অনেক বড় নাম। শতাধিক ছবিতে অভিনয় করেছেন তিনি। বাস্তবে তার উচ্চতা হল ৫ ফুট ৬ ইঞ্চি।

অঙ্কুশ হাজরা (Ankush Hazra) : অঙ্কুশ হাজরা ঝুলিতেও রয়েছে টলিউডের অনেক সুপারহিট ছবির নাম। যদিও তাকে পর্দায় দেখলে বেশ লম্বা বলেই মনে হয় তবে তার আসল উচ্চতা হল ৫ ফুট ৬ ইঞ্চি থেকে একটু বেশি।

শ্রী চৈতন্যদেব কি সত্যিই পুরীর সমুদ্রে অথবা জগন্নাথের দারু অঙ্গেই লীন হয়ে গিয়েছিলেন

সালটা ছিল ২০০০…। পুরীর বিখ্যাত শ্রী জগন্নাথ মন্দিরের সংস্কার কার্য চলার সময় হঠাৎ-ই গর্ভগৃহ থেকে উদ্ধার হল একটি আস্ত নরকঙ্কাল! দৈর্ঘ্যতে যা ছিল প্রায় ছয় ফুটের কাছাকাছি।

গর্ভগৃহে কঙ্কাল…!! চারিদিকে হৈ-হৈ পড়ে গেল। কিন্তু কার দেহাস্থি এটি? চারিদিক জুড়ে মাসাধিক কাল ধরে চলল প্রবল বিতর্ক। পরীক্ষা করে জানা গেল মৃত ব্যক্তি ছিলেন অত্যন্ত দীর্ঘাঙ্গী এবং যার মৃত্যু হয়েছিল আজ থেকে প্রায় পাঁচশো বছর আগে।

পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি বিচার করে বেশিরভাগ মানুষ তখন এই সিদ্ধান্তেই উপনীত হলেন যে কঙ্কালটি আর যার-তার কারও নয়, এই বাংলার ভক্তি আন্দোলনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব … স্বয়ং শ্রী চৈতন্য দেবের!! একই সঙ্গে, দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা শ্রীচৈতন্যের সমুদ্রে লীন হবার তত্ত্বও খারিজ হবার পাশাপাশি পুরীর মন্দিরে তাঁকে হত্যা করবার বিষয়টিও আরও একবার জনসমক্ষে প্রতিষ্ঠিত হয়।

সে যাই হোক, জগন্নাথ মন্দিরের মধ্যে শ্ৰীচৈতন্যকে ‘গুমখুন’ করা হয়েছিল, এই অভিমত সর্বপ্রথম প্রচার করেন, ঐতিহাসিক ড. নীহাররঞ্জন রায়। ৫-৮-১৯৭৬ , তারিখে, পুরীর আনন্দময়ী আশ্রমের ড. জয়দেব মুখোপাধ্যায়কে লেখা একটি চিঠিতে ড. রায় লিখলেন, শ্ৰীমহাপ্ৰভু চৈতন্যদেবকে গুমখুন করা হয়েছিল পুরীতেই এবং চৈতন্যদেবের দেহের কোন অবশেষের চিহ্নও রাখা হয়নি কোথাও। এবং তা হয়নি বলেই তিনটি কিংবদন্তী প্রচারের প্রয়োজন হয়েছিল। তিনি আরও লিখেছেন ‘ওই গুমখুনের সমস্ত ব্যাপারটাই একটা বহুদিনের চিন্তিত, বহুজন সমৰ্থিত চক্রান্তের ফল। কে বা কারা ওই চক্রান্ত করেছিলেন, সে সম্পর্কে আমার একটা অনুমান আছে, কিন্তু তা বলতে পারব না। কারণ এখনও আরও কিছুদিন বেঁচে থাকতে চাই। চৈতন্যদেব, গান্ধী martyr হতে পারেন, কিন্তু আমার martyr হওয়ার বিন্দুমাত্র বাসনা নেই”।

দীনেশচন্দ্ৰ সেন তাঁর ‘চৈতন্য অ্যান্ড হিজ এজ’ – গ্রন্থে লিখেছেন, “শ্ৰীচৈতন্য যদি বিকেল ৪’টের সময় মন্দিরের মধ্যে দেহত্যাগ করে থাকেন, আমরা জানি, ওই দিন রাত ১১টা পর্যন্ত মন্দিরের দরজা খোলেনি। এই সময়টা লেগেছিল তাঁর দেহ (মন্দিরের মধ্যে) পুঁতে ফেলে মন্দিরের মেঝে আবার আগের মত করতে। রাত ১১টায় দরজা খুলে বলা হল, প্ৰভু জগন্নাথের দেহে চৈতন্য লীন হয়ে গেছেন।”
শুধু ডঃ রায় বা ডঃ সেনই নন, খগেন্দ্রনাথ মিত্র, গিরিজাশঙ্কর রায়চৌধুরি, ডঃ অমূল্যচন্দ্র সেন, ড. জয়দেব মুখোপাধ্যায়, মালীবুড়ো, ঔপন্যাসিক সমরেশ বসু – এঁদের সবার ধারণা, চৈতন্যদেবকে গুমখুন করা হয়েছিল। শুধু তাই নয়, চৈতন্যদেবের মৃত্যুরহস্য উদঘাটন করতে গেলে আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়কে খুনের হুমকি দেওয়া হয়েছিল। খগেন্দ্রনাথ মিত্র ও ডঃ দীনেশ সেন নিন্দিত হয়েছিলেন। ড. অমূল্য সেনের অবস্থা আরও শোচনীয় হয়েছিল। তবুও শত বিপদ ও মৃত্যুভয়ের মাঝেও ওঁরা চৈতন্যের মৃত্যুর ঘটনাটিকে ‘হোমিসাইড’ বলেছিলেন।

ড. দীনেশচন্দ্ৰ সেনের ধারণা ছিল, জগন্নাথ মন্দিরের পাণ্ডারা চৈতন্যকে পিটিয়ে মেরেছে। কিন্তু কেন ? – কী এমন মৃত্যুদণ্ডযোগ্য অপরাধ তিনি করেছিলেন?

ঐতিহাসিক মতপার্থক্য অনুযায়ী, সংসার করবেন না প্রচার করেও দুই বিবাহের অধিকারী চৈতন্য ঠিক ততদিন-ই ঠিকঠাক “শ্রী চৈতন্য” হতে পারেননি, যত দিন না … কাজীর বাড়ি ঘেরাওয়ের সফল আন্দোলন করতে সক্ষম হন। তাঁর সেদিনের সেই সাংগঠনিক শক্তির পরিচয় পেয়ে প্রমাদ গোনেন তৎকালীন বাংলার মুসলমান শাসনকর্তা হুসেন শাহ।
প্রতিপক্ষের মাথা কিনে নেবার ব্যাপারে ইসলামের সমকক্ষ এই বিশ্বে যেমন আজও কেউ নেই, তেমনি আগেও তার ব্যতিক্রম ছিল না। মনে করা হয়, ছলে বলে কৌশলে বা ভীতি প্রদর্শন করে যেমন ভাবেই হোক হুসেন শাহও তেমনি সেদিন শ্রী চৈতন্যকে বশীভূত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। খুব সম্ভবত তারই অঙ্গ হিসেবে পরবর্তীকালে একদিকে যেমন হুসেন শাহ তাঁর তীব্র হিন্দু বিরোধিতা ত্যাগ করেন, অন্যদিকে চৈতন্যও প্রায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বীতায় সারা বাংলা জুড়ে প্রবলভাবে হরিনাম প্রচার চালাতে থাকেন। সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া সে’কালে যা ছিল একান্তই অসম্ভব।
অস্ত্রধারী ভগবান শ্রীবিষ্ণুকে শ্রীচৈতন্য সম্পূর্ণ নিরস্ত্র রূপে এই বাংলার সামনে নবভাবে উপস্থাপিত করেন। তাঁরই প্রভাবে রাধা-তত্ত্ব ও প্রেমরসে নতুন ভাবে শ্রীকৃষ্ণকে গ্রহণ করে মন্ত্রমুগ্ধ বাঙ্গালী হিন্দু সমাজ। শ্রী চৈতন্যের আহ্বানে তারা দলে দলে অস্ত্র পরিত্যাগ করে; ত্যাগ করে আমিষ খাদ্যদ্রব্য! পরিবর্তিত হয় এক সম্পূর্ন যুদ্ধ-বিমুখ আত্মরক্ষার কৌশল বিবর্জিত ভগবৎ-মুখাপেক্ষী এক আত্মঘাতী জাতিসত্তায়।

বাংলার হিন্দুদের উপর তাঁর নৈতিক বিজয়ের পর, হুসেন শাহের দৃষ্টি পড়ে উড়িষ্যার উপর। খুব সম্ভবত তাঁরই নির্দেশে শ্রী চৈতন্য উড়িষ্যায় গমন করেন এবং সেখানে অষ্টাদশ বছর অবস্থানকালে সেখানকার রাজা প্রতাপ রুদ্রদেবকে তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণে সমর্থ হন। শুধু কি তাই? উড়িষ্যার রাজাকে নিরস্ত্র করতেও তিনি সক্ষম হন। এমনকি হুসেন শাহের উড়িষ্যা আক্রমণকালেও তাঁর নির্দেশ ছিল, প্রতাপ রুদ্র যেন হুসেন শাহের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ না করেন! বরং অদ্ভুত ভাবে তাঁর কারণেই নাকি সে-সময় দক্ষিণের একমাত্র হিন্দু রাজ্য বিজয়নগরের সাথে উড়িষ্যার সম্পর্কের অবনতির সূত্রপাত ঘটে!!

ফলস্বরূপ উড়িষ্যার হিন্দুরা, চৈতন্যের এই ষড়যন্ত্র বুঝতে পেরে, তাঁকে সেখান থেকে অতিস্বত্তর সরিয়ে দেবার চক্রান্ত করে। চৈতন্যের নিরুদ্দেশ হবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই প্রতাপ রুদ্র কটকে পলায়ন করেন এবং সেখানে তাঁর প্রধান সেনাপতি ভারু কর্তৃক পদচ্যুত ও নিহত হন। ইসলামিক আগ্রাসনের হাত থেকে রক্ষা পায় উড়িষ্যা। বেঁচে যান সেখানকার হিন্দুরা।
মানুষ মরণশীল। শ্ৰীচৈতন্যও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। তারও মৃত্যু ঘটেছিল। কিন্তু কী বঙ্গীয়, কী ওড়িয়া- সব চরিৎকারই তাঁর মৃত্যুর ধরণ, স্থান, সময় ও তারিখ সম্পর্কে কোনও নির্দিষ্ট তথ্য দিতে পারেননি। অবশ্য মনে রাখতে হবে, স্বরূপ দামোদর, রায় রামানন্দ, গদাধর পণ্ডিত ও অচ্যুতানন্দ এবং শিখী মাহাতি ছাড়া বাকিরা কেউই মহাপ্রভুর শেষলীলার প্রত্যক্ষদর্শী নন। অন্যরা কেউ কেউ আবার ১০০-১৫০ বছর পরের লোক। কৃষ্ণদাস কবিরাজ বলেছেন, ‘চৈতন্যের শেষলীলা রহিল অবশেষ’। অপর স্থানে বলেছেন, ‘প্রভুর যে শেষলীলা স্বরূপ দামোদর/সূত্র করি গাঁথিলেন গ্রন্থের ভিতর।’ আশ্চর্যের ব্যাপার, স্বরূপ দামোদরের সেই পুঁথি বেমালুম বেপাত্তা হয়ে গিয়েছিল পুরী থেকে। আজ পর্যন্ত তার কোনও খোঁজ মেলেনি। ঐতিহাসিকদের মতে, এই পুঁথিতে নিশ্চয়ই এমন কিছু স্বরূপ দামোদর লিখেছিলেন, যেটা ‘চৈতন্য-বিরোধী’রা মেনে নিতে পারেন নি। সে জন্যই তারা সেই পুঁথি লোপাট করে দিয়েছিলেন। যাই হোক, চরিৎকারগণ একই চৈতন্যদেবকে নিয়ে লিখেছেন, অথচ এই মৃত্যুর ব্যাপারে এদের গরমিল চোখে পড়ার মত। পুরীতে চৈতন্যের কোনও সমাধি মন্দির নেই। যত গোলমাল এখানেই!

– এখন দেখা যাক, তার চরিৎকারগণ তাঁর মৃত্যু সম্পর্কে কে কী বলেছেন।

১। অচ্যুতানন্দ, দিবাকর দাস, ঈশ্বর দাস, ঈশান নাগর, লোচন দাস – এঁদের মতে শ্ৰীচৈতন্য জগন্নাথের কালো অঙ্গে ‘লীন’ হয়ে গেছেন।
২। জয়ানন্দ, নরহরি, সদানন্দ, – এঁদের মতে, বাঁ পায়ে ইটের আঘাত পেয়ে চৈতন্য তোটা গোপীনাথের মন্দিরে আশ্রয় নেন, পরে সেখানেই তিনি ‘অন্তর্হিত’ হন। কিন্তু, তাঁর মায়াশারীর পড়েছিল।
৩। বৃন্দাবন দাস এ সম্পর্কে সম্পূৰ্ণ নীরব। কৃষ্ণদাস কবিরাজ, খালি ‘অন্তর্ধান’ কথাটি বলেছেন। সম্প্রতি বৃন্দাবন দাসের পুঁথির শেষের কিছু অংশ উদ্ধার করা হয়েছে। তাতে তিনিও ‘অন্তর্ধান’ কথাটিই বলেছেন ।
৪। সমুদ্রতীরে বিদ্যুতের মত ‘অন্তর্হিত’ হওয়ার কথা বলেছেন গোবিন্দ।
৫। আদি চরিৎকার মুরারী গুপ্ত, কবি কর্ণপুর এ সম্পর্কে কিছুই বলেননি। আবার, এঁদের কেউ কেউ বলেছেন, মহাপ্ৰভু দেহত্যাগ করেছেন বৈশাখ মাসের সন্ধ্যায়, কেউ বলেছেন আষাঢ় মাসের শুক্লা সপ্তমীতে, কেউ বলেছেন , আষাঢ় শুক্লা সপ্তমীতে রবিবার তৃতীয় প্রহরে, কেউ বলেছেন ফাল্গুনী পূর্ণিমায়। লোচনদাস তাঁর চৈতন্যমঙ্গলে বলেছেন, “একদিন প্ৰভু, একমাত্র গদাধর’কে সঙ্গে নিয়ে মন্দিরে প্রবেশ করেন। কিন্তু প্ৰভু একাই মন্দিরে প্রবেশ করার পর ‘কপাট’ আপনা আপনি বন্ধ হয়ে যায়। পিছনে ভক্তরা এসে কান্নাকাটি শুরু করতে একজন পান্ডা ভেতর থেকে এসে খবর দিল যে প্ৰভু জগন্নাথে লীন হয়ে গেছেন।” তাঁর ডক্তরা কেউ এ ঘটনার সাক্ষী হতে পারল না। সাক্ষী হলেন তাঁরই বিরুদ্ধে চক্রান্তকারী পান্ডাদের একজন।
এ সম্পর্কে বর্তমান ঐতিহাসিকদের মতে, সে দিন কী ঘটেছিল দেখা যাক। তা হলে পরিষ্কার একটা আভাস পাওয়া যাবে যে চৈতন্যের মৃত্যু স্বাভাবিকভাবে হয়নি। ঐতিহাসিকদের প্রশ্ন, কেন তিনি একাকী জগন্নাথ মন্দিরে প্রবেশ করলেন, যখন বিগ্রহগুলি গুণ্ডিচা মন্দিরে অবস্থান করছে? তা হলে কি তাঁরই কোনও ঘনিষ্ঠ পার্ষদ ‘জুডাস’-এর ভূমিকা নিয়েছিল? লোচন বলেছেন, প্ৰভু যখন একাকী মন্দিরে প্রবেশ করলেন তখন ‘দুয়ারে নিজ লাগিল কপট’। জগন্নাথ মন্দিরের ওই বিশাল বিশাল দরজাগুলি কীভাবে নিজেই লেগে গেল তা একমাত্র জগন্নাথদেবই বলতে পারবেন। ঐতিহাসিকদের মতে, সে সময় মন্দিরের ভেতরে যাঁরা ছিলেন, তাঁরাই চট করে দরজা বন্ধ করেন। তা যদি না থাকত, তা হলে পিছনে পিছনে তাঁর ভক্তরা যখন ‘ঘুচাহ কপাট প্ৰভু দেখি বড় ইচ্ছা’ বলে দরজা ধাক্কাধাক্কি করছেন, তখন নিজে লেগে যাওয়া কপাট’ খুলে গেল না কেন? কিন্তু শ্ৰীচৈতন্যের সঙ্গে ছিলেন গদাধর। বৃন্দাবনদাস ঠাকুর তাঁর অপ্রকাশিত চৈতন্য ভাগবতের অবশিষ্ট অংশে বলেছেন, “আচম্বিতে গদাধর হইল অন্তর্ধান”। কীভাবে গদাধর আচমকা ‘অন্তর্হিত’ হলেন? তাঁর তো অন্তৰ্হিত হওয়ার কথা ছিল না। তা ছাড়া তিনিও কি জগন্নাথের অঙ্গে লীন হলেন ? কে জানে? তা হলে কি অন্ধকার মন্দিরে লুকিয়ে থাকা শত্রুর দল তাঁকেও গুম করে দিয়েছিল? সাম্প্রতিক আবিষ্কৃত ওড়িয়া কবি বৈষ্ণব দাসের পুঁথিতে আছে, রাত্রি দশ দন্ডের সময় চৈতন্যের মৃতদেহ গরুড় স্তম্ভের পিছনে পড়েছিল, এটা নাকি তিনি নিজের চোখে দেখেছেন। এই যে প্রায় সমস্ত পন্ডিত বলছেন, শ্রীচৈতন্যকে হত্যা করা হয়েছিল, স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে কে হত্যা করেছিল চৈতন্য’কে? পণ্ডিতদের মতে, এই ঘৃণ্য কাজের দায়িত্ব ছিল জগন্নাথ মন্দিরের দ্বাররক্ষী বাহিনীর তৎকালীন প্রধান দলপতির ওপর। তার নাম ছিল, ‘দীনবন্ধু প্রতিহারী’। সে নাকি, ‘বুকের ওপর বসে, গলা টিপে শ্বাসরুদ্ধ করে মেরেছিল প্রভুকে’।
এখন প্রশ্ন হল, চৈতন্যের শবদেহটা কীভাবে ও কোথায় হত্যাকারীরা পাচার করল? পুরীর ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের প্রাক্তন কর্মসচিব স্বামী অভিনবানন্দজির মতে, মহাপ্রভুর দেহটিকে মণিকোঠার রত্নবেদীর নিচেই ‘সমাধিস্থ’ করা হয়েছিল। ড. দীনেশ সেনের ধারণাও তাই। ড. জয়দেব মুখোপাধ্যায়ের মতে ‘কইলি বৈকুণ্ঠ’ অথবা , ‘তোটা গোপীনাথে’র মন্দিরে সমাধি দেওয়া হয়েছিল। বিখ্যাত ঐতিহাসিক ও চৈতন্য বিশেষজ্ঞ পদ্মশ্ৰী সদাশিব রথ শর্মার মতে, তোটা গোপীনাথের বাঁধানো উঠানের বাম পাশ ঘেঁষে যে দুটি ছোট তুলসী মন্দির আছে, তার অপেক্ষাকৃত পুরনোটি হল চৈতন্যের সমাধি মন্দির।
শেষে কয়েকটি ঘটনার পর্যালোচনা করলে দেখতে পাব, চৈতন্যের মৃত্যু আদৌ স্বাভাবিকভাবে হয়নি।

১। চৈতন্যের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে চৈতন্যশিষ্য পুরীর রাজা প্ৰতাপ রুদ্র রথযাত্রা ফেলে প্রাণভয়ে কটকে পালিয়ে গেলেন কেন?

২। চৈতন্যের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে তাবৎ চৈতন্যপন্থী ও গৌড়ীয় বৈষ্ণবেরা উৎকল ছেড়ে চলে গেলেন কেন?

৩। চৈতন্যের অন্তর্ধানের পর তাঁর অন্যতম পার্ষদ স্বরূপ দামোদরকে আর জীবিত অবস্থায় দেখা গেল না কেন? দেখা গেল দামোদরের ‘হৃদয় ফেটে প্রাণ বাহির হইয়া গিয়াছে’। প্রকৃত অর্থে শত্রুর অস্ত্রের আঘাতে তো হৃদয় বিদীর্ণ হওয়ারই কথা।

৪। তাঁর মৃত্যুর কয়েক বছরের মধ্যে উৎকলের সিংহাসনে বসলেন ষড়যন্ত্রকারী গোবিন্দ বিদ্যাধর ভোই।

৫। ড. দীনেশচন্দ্র সেনের ‘চৈতন্য অ্যান্ড হিজ এজ’ গ্ৰন্থ থেকে জানা যাচ্ছে, চৈতন্যের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে দীর্ঘ ৫০ বছর পর্যন্ত বাংলাদেশে ও উৎকলে বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের সমস্ত রকম প্রচার, এমনকি নূন্যতম ‘কীর্তন গান’ পর্যন্ত বন্ধ হয়ে গিয়েছিল!
চৈতন্য যদি জগন্নাথের দারু অঙ্গেই লীন হয়ে গিয়েছিলেন, তা হলে তো সেই ঘটনা মানুষের মনে চৈতন্য এবং বৈষ্ণবপন্থার প্ৰস্ফুরণ ঘটাবার কথা। কিন্তু কাৰ্যত তা দেখা গেল না। উপরন্তু এক নিদারুণ আতঙ্কে| উৎকল ও বঙ্গের বৈষ্ণবমণ্ডলী স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। ড. জয়দেব মুখোপাধ্যায়ের মতে, সেই কারণেই চৈতন্যদেবের ওপর লেখা সমস্ত বৈষ্ণব গ্রন্থ ইচ্ছে করে এড়িয়ে গেছে চৈতন্যের তিরোধানের শেষ মুহূর্তের বর্ণনাতীত, “অসহ্য বর্ণনাকে” ।
তবে হ্যাঁ,… এই কঙ্কাল যে শ্ৰীচৈতন্যের, তা না-ও হতে পারে। হতে পারে – তা গদাধর পণ্ডিত বা অন্য কোন ব্যক্তির। একমাত্র সঠিক পদ্ধতিতে ও নিরপেক্ষ তদন্তসাপেক্ষ ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমেই এর যথার্থ সত্য উদ্ঘাটিত হওয়া সম্ভব। মন্দির কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি ঐতিহাসিক, প্রত্নতত্ত্ববিদ ও ভারত সরকারকেও এই কাজে এগিয়ে আসতে সনির্বন্ধ অনুরোধ জানাই।

সুন্দরী মহিলাকে এজেন্ট ব্যবহার করে দেশদ্রোহীকে গ্রেপ্তার! ইসরায়েলের গোয়েন্দাদের দুর্ধর্ষ অপারেশন

১৯৮৬ সালের কোন এক সন্ধ্যায় লন্ডনের রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে মোর্দেকায় নামে এক যুবক। আকর্ষনীয় চেহারা ও ব্যাক্তিত্বের অধিকারী এই যুবকের কাছে তখন সদ্য পাওয়া এক লাখ ডলার রয়েছে। সানডে টাইমস এই ব্যাক্তিটিকে বিশেষ কিছু গোপন তথ্য দেওয়ার কারনে তাকে এই একলাখ ডলার দিয়েছে। হঠাৎ মোর্দেকাই এর চোখ পড়ে এক অসাধারন সুন্দরী যুবতীর উপর। প্রথম দেখাতেই সেই তরুনীর প্রেমে পড়ে যায় মোর্দেকাই। সেই তরুনীর সাথে পরিচয় করবার উদ্দেশ্যে মোর্দেকাই সেই তরুনীর পরিচয় জিজ্ঞেস করে। উত্তরে সেই তরুনী জানায় তার নাম সিন্ডি এবং সে ইসরায়েলের বাসিন্দা। ইসরায়েল নামটা শুনেই মোর্দেকাই এর পায়ের নীচে থেকে যেন মাটি সরে যায়, মোর্দেকাই জানে সে যে তথ্য সানডে টাইমস ও ব্রিটিশ সরকারকে দিয়েছে সেই কথা ইসরায়েল জানতে পারলে তাকে ছেড়ে দেবেনা।

খানিকটা ভয়েই মোর্দেকাই সিন্ডিকে জিজ্ঞেস করে সে কী মোসাদের সাথে জড়িত। জবাবে সিন্ডি জানায় সে কোনওদিন মোসাদের নামই শোনেনি। সাথে সাথে যেন সব ভয় কেটে যায় মোর্দেকাই এর এবং সে সিন্ডির সাথে পরিচয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠে।

আরো পড়ুন- টাকিলার পূর্বপুরুষ! প্রাচীনকালে ব্যবহৃত নয়টি অদ্ভুত পানীয়

চারিদিকে শত্রু দ্বারা পরিবেষ্টিত ইসরায়েল দেশটি তৈরি হবার পর থেকেই একের পর এক আক্রমন সহ্য করে আসছে। আরব দেশ গুলো বারবার যৌথভাবে আক্রমন করেছে দেশটিতে। কিন্তু তা সত্বেও ইসরায়েল বারবার শত্রুদের পরাজিত করেছে এবং নিজেদের মধ্যপ্রাচ্যে একটি শক্তিশালী দেশ হিসাবে উপস্থাপিত করেছে। ইসরায়েলের এই সাফল্যের পেছনে ছিল তার অসাধারন মেধা, উন্নত প্রযুক্তি এবং তাদের শক্তিশালী গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ।

১৯৮০ এর দশকে ইসরায়েল ডিমোনা নিউক্লিয়ার রিয়্যাক্টার প্রজেক্টে কাজ করছিলো। এই প্রজেক্ট এতটাই গোপনীয় ছিল যে এই প্রজেক্টে কাজ করা ব্যাক্তিদের কঠোর ভাবে পরীক্ষা করে এখানে নিয়োগ করা হতো। ইসরায়েলের আভ্যন্তরীন গোয়েন্দা সংস্থা সাবাক নিজে প্রত্যেক কর্মচারীকে পরীক্ষা করতো। এই প্রজেক্টেই কাজ করত মোর্দেকাই। মরোক্কন বংশোদ্ভূত এই ব্যাক্তিটির ইচ্ছে ছিল ইসরায়েল বায়ুসেনাতে যোগ দেবার কিন্তু সেখানে পরীক্ষায় ব্যার্থ হয়ে সে বাধ্য হয়ে ইসরায়েল সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়।

১৯৮২ সালে লেবানন যুদ্ধের পর থেকে মোর্দেকাই ইসরায়েল বিরোধী পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করে। সে কিছু আরব দেশের সাথে যোগাযোগ শুরু করে। ইহুদী বিরোধী সন্ত্রাসী সংগঠন রাকার সাথে ঘনিষ্ঠতা হয় তার, এমনকী রাকার সন্ত্রাসীরা তার বাড়িতেও থাকতে শুরু করে। ফিলিস্তিন কর্মসূচিকে সমর্থন করার পাশাপাশি ইসরায়েল বিরোধী বক্তৃতা দিতেও শুরু করে মোর্দেকাই কিন্তু তা সত্বেও ইসরায়েলের এত গোপনীয় প্রজেক্টে কাজ পেয়েছিল সে এটা খুবই অদ্ভুত ব্যাপার।

মোর্দেকাই ব্যাক্তিগত জীবনে খুবই অস্থির মানসিকতার ব্যাক্তি ছিল। প্রথমে সে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া শুরু করে, পড়ে ইঞ্জিনিয়ারিং ছেড়ে দিয়ে দর্শন নিয়ে পড়া শুরু করে। কিছুদিন পর আবার দর্শন ছেড়ে দিয়ে অর্থনীতি নিয়ে পড়া শুরু করে। পরে আবারও অর্থনীতি ছেড়ে দিয়ে দর্শনে ফিরে আসে সে। এরকম ব্যাক্তি কী করে সাবাকের নজর এড়িয়ে যায় এটা খুবই আশ্চর্যের। ডিমোনা প্রজেক্টে ইন্সটিটিউট ২ এ কাজ করতো মোর্দেকাই। ইনস্টিটিউট ২ ডিমোনা প্রজেক্টের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন অংশ ছিল। এই প্রজেক্টে কাজ করা ২৭০০ কর্মচারীর মধ্যে মাত্র ১৫০ জনই ইন্সটিটিউট ২ এ কাজ করবার সুযোগ পেয়েছিল। বাইরে থেকে দেখে ইনস্টিটিউট ২ কে মনে হতো একটি দুতলা বাড়ি কিন্তু আসলে এটির তলায় ছয়তলা ভবন ছিল। যার প্রথমে ভাগে পাইপ ছিল, দ্বিতীয় ভাগে কন্ট্রোল রুম, তৃতীয় ভাগে ইউরেনিয়াম রড, চতুর্থ ভাগে উৎপাদন এলাকা, পঞ্চম ভাগে ধাতব অঞ্চল এবং ষষ্ঠ ভাগে তেজস্ক্রিয় অবশেষ নিষ্কাশনের বিশেষ ব্যবস্থা ছিল। একদিন মোর্দেকাই ক্যামেরা নিয়ে গোপনে প্রবেশ করে ডিমোনা প্রজেক্টে প্রবেশ করে এবং সমস্ত গোপন এলকার যাবতীয় ছবি তোলে। ১৯৮৫ সালে আট বছর এই প্রজেক্টে কাজ করার পর তাকে ডিমোনা প্রজেক্ট থেকে বের করে দেওয়া হয়। তবে রাজনৈতিক কারনে বের করে দেওয়া হয়নি তাকে বরং এই প্রজেক্টে বাজেট কমানোর কারনে মোর্দেকাই সহ বেশ কয়েকজনকে এই প্রজেক্ট থেকে বের করে দেওয়া হয়। তবে তাকে আটমাসের অগ্রীম মাইনে দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্ত তা সত্বেও এই ঘটনায় অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে মোর্দেকাই ঠিক করে ইসরায়েল ছেড়ে চিরকালের মতো বিদেশে চলে যাবে।

মোর্দেকাই প্রথমে গ্রীস যায়, সেখান থেকে থাইল্যান্ড, রাশিয়া এবং নেপাল হয়ে অস্ট্রেলিয়া যায়। সিডনিতে কয়েকমাস কাজ করার পর মোর্দেকাই পৌঁছায় সিডনির সেন্ট জর্জ গীর্জায়। সেখানে তার সাথে পরিচয় হয় জন ম্যাকনাইটের। উভয়ের মধ্যে বন্ধুত্ব তৈরি হয় এবং ১৭ আগস্ট, ১৯৮৬ মোর্দেকাই খ্রীষ্টান ধর্ম গ্রহন করে। সে তার নাম পরিবর্তন করে রাখে জন ক্রশম্যান রাখে।

একদিন এক সামাজিক সভায় সে ইসরায়েল ডিমোনা প্রজেক্ট সম্পর্কে আলোচনা করে এবং তার সাথে থাকা সমস্ত ছবি সবাইকে দেখায়। কিন্তু তার কথা সবাই বুঝতে না পারলেও একজন ব্যাক্তি ঠিকই বুঝতে পারে, তার নাম অস্কার গুরেরো। কলম্বিয়ান সাংবাদিক অস্কার গুরেরো এই ছবি গুলোর গুরুত্ব জানতো, সে পরিচয় করে মোর্দেকাই এর সাথে এবং তাকে ছবি গুলোর গুরুত্ব বোঝায়। মোর্দেকাই ঠিক করে এসব ছবি কোন সংবাদ মাধ্যমে বিক্রি করে মোটা অর্থ উপার্জন করবে সে। কিন্ত সে এটাও জানতো যদি এই ছবি প্রকাশিত হয় তাহলে সে চিরকালের জন্য ইসরায়েলে ফিরতে পারবে না এবং তাকে দেশদ্রোহী ঘোষনা করা হবে। কিন্তু অর্থের লোভে সে প্রথমে অস্ট্রেলিয়ান সংবাদ মাধ্যমে ও আমেরিকান সংবাদ মাধ্যমে যায় এগুলো প্রকাশের জন্য কিন্ত দুজায়গা থেকেই তাকে ফিরিয়ে দেওয়া হয় এই ছবি গুলোর সত্যতার কারন দেখিয়ে। এরপর মোর্দেকাই ও অস্কার গুরেরো লন্ডনে পৌঁছায় এবং সেখানে সানডে টাইমস তাদের সবকথা শোনার পর তারা মোর্দেকাইকে এক লাখ ডলার দিতে রাজি হয়ে যায় এই তথ্যের জন্য। এদিকে অস্ট্রেলিয়ান সংবাদমাধ্যম কাজ করা এক ব্যাক্তি মোর্দেকাই এর সেখানে ছবি বিক্রি করতে আসার এই তথ্য ইসরায়েল দূতাবাসে জানায়। সেখানে থেকে ইসরায়েলের রাজধানী তেল আভিবে মোসাদের অফিসে এই খবর যায়। সাথে সাথে মোসাদও অবাক হয়ে যায় এত গুরুত্বপূর্ন প্রজেক্টের তথ্য বাইরে এল কীভাবে সেকারনে।

সানডে টাইমস মোর্দেকাইকে শুধু একলাখ ডলারই দেয়নি বরং এই ছবিগুলো থেকে আয় হওয়া অর্থের ৪০ শতাংশ এবং ভবিষ্যতে এই তথ্যের উপর লেখা বইয়ের লভ্যাংশের ২৫ শতাংশও তাকে দেবার প্রতিশ্রুতি দেয়। মোর্দেকাইয়ের এই ঘটনায় বিখ্যাত সিনেমা নির্মান সংস্থা ২০ সেঞ্চুরি ফক্স একটি সিনেমাও তৈরি করবে ঠিক করেছিল। মোর্দেকাইকে সমস্ত সুযোগ সুবিধা দিয়ে শক্ত নিরাপত্তার মধ্যে রেখেছিল সানডে টাইমস। কারন তারা জনতো মোসাদ আসবেই মোর্দেকাইকে ধরতে৷ কিছুদিন পর লন্ডনে এক সন্ধ্যায় তার সাথে পরিচয় হয় সিন্ডির সাথে। দুজনের মধ্যে বন্ধুত্ব তৈরি হয়। এরপর প্রত্যেকদিনই উভয়ে দেখা করতে থাকে বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট, পাবে। ধীরে ধীরে দুজনের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। একদিন সিন্ডি মোর্দেকাইকে প্রস্তাব দেয় রোমে ঘুরতে যাবার, সেখানে তার বোনের বাড়ি। কোনরকম সন্দেহ ছাড়াই মোর্দেকাই রাজি হয়ে যায় যা ছিল তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল। এই সিন্ডি আসলে ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের এজেন্ট ছিল। মোসাদ অস্ট্রেলিয়াতে তাদের এজেন্টের মাধ্যমে জানতে পারে মোর্দেকাই লন্ডনে গেছে। কিন্তু লন্ডনে অপারেশন করা সম্ভব ছিলনা মোসাদের পক্ষে সেজন্য মোসাদ সিন্ডির মাধ্যমে মোর্দেকাইকে প্রেমের জালে ফাঁসিয়ে তাকে রোম নিয়ে আসার পরিকল্পনা করে কারন ইটালিয়ান গোয়েন্দা সংস্থার সাথে মোসাদের খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। প্রেমের মোহে পড়ে কোন সন্দেহ না করেই মোর্দেকাই ১৯৮৬ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর রোম চলে যায় সিন্ডির সাথে।

রোমের নির্দিষ্ট বাড়িতে প্রবেশ করার পরই মোর্দেকাইকে আগে থেকেই লুকিয়ে থাকা মোসাদ এজেন্টরা অজ্ঞান করে ফেলে। পরে থাকে একটি গাড়িতে করে ইটালির একটি বন্দরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে একটি স্পিড বোটে করে তাকে গভীর সমুদ্রে থাকা ইসরায়েল নৌবাহিনীর জাহাজে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে তাকে ইসরায়েল নিয়ে যাওয়া হয়। পুরো পথে মোর্দেকাইকে অজ্ঞানই রাখা হয়েছিল। ইসরায়েল পৌছাঁতেই তাকে গ্রেফতার করে সাবাক। চোখ খোলার পর মোর্দেকাই দেখতে পায় তার সামনে বসে আছে বেশ কিছু মোসাদ এজেন্ট। মোর্দেকাই বুঝতেই পারেনি সে রোম থেকে ইসরায়েল কীভাবে চলে এসেছে। সে আরও অবাক হয়ে যায় এটা শুনে যে সিন্ডি মোসাদ এজেন্ট যার আসল নাম চেরিল বেনতোফ। কড়া জিজ্ঞাসাবাদের পর মোর্দেকাইকে জেলে বন্দী করা হয়।

এদিকে সানডে টাইমস ইসরায়েল প্রজেক্ট ডিমোনা সম্পর্কে সমস্ত তথ্য প্রকাশ করে দেয়। সানডে টাইমস মোর্দেকাইকে খোঁজার অনেক চেষ্টা করে কিন্তু ব্যার্থ হয়। চল্লিশ দিন পর ইসরায়েল সানডে টাইমসকে জানায় মোর্দেকাই তাদের হেফাজতে আছে। দেশদ্রোহীতার অপরাধে আঠারো বছরের কারাদন্ড হয় মোর্দেকাই এর। এভাবেই মোসাদ তার সমস্ত শত্রুদের খুঁজে খুঁজে বের করে। যার কারনে ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদকে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী গোয়েন্দা সংস্থা বলা হয়।

টাকিলার পূর্বপুরুষ! প্রাচীনকালে ব্যবহৃত নয়টি অদ্ভুত পানীয়

সভ্যতা আসার সাথে সাথে নেশা নামক জিনিসটার সঙ্গেও পরিচিত হয়েছিল মানুষ। নেশা বললে যে শুধুমাত্র পানিও নেশা তাই নয়, বিভিন্ন খেলাধুলা বা কোন কর্মের প্রতি বেশি আগ্রহকেও‌ নেশা বলা হয়। কিন্তু নেশার নাম উল্লেখ হলেই পানিয়র কথায় সকলের মাথায় আসে। বর্তমানে কত ধরনের কত নামের পানীয় আছে যার নেশার দ্রব্য হিসাবে বিক্রি হয়। তবে প্রাচীনকালেও কিছু কম ছিল না এই নেশার দ্রব্য। এই প্রতিবেদনে প্রাচীনকালে ব্যবহৃত নয়টি নেশার পানীয়র বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছে।

I) পুলক :- দুধের মতো ধবধবে সাদা এই পানিওটি মেক্সিকোর ইতিহাসে জনপ্রিয় অ্যালকোহল হিসেবে পরিচিত। পুলক নামের এই পানীয়টি টাকিলার পূর্বপুরুষ হিসেবে কাজ করে এবং এটা ম্যাগুয়ের রস পাতানোর গাজন হিসাবে তৈরি করা হয় যেটি বর্তমানে অ্যাগেভ নামে পরিচিত।

এই পানিয়র স্বাদ অনেকটা টক খামেরির মতো এবং এতে প্রচুর পরিমাণে প্রোবায়োটিক রয়েছে যা স্বাস্থ্যের পক্ষে খুবই ভালো। এই পানির বয়স আনুমানিক ২ হাজার বছরেরও বেশি। এটা শুধুমাত্র অ্যালকোহলযুক্ত পানীয়ই নয়, একে ঘিরে রয়েছে এক গুচ্ছ পৌরাণিক কাহিনী। পৌরাণিক কথা অনুযায়ী হারিয়ে যাওয়া ঐশ্বরিক স্বর্গে তৈরি করা হয়েছিল এই পানীয় এবং এর সঙ্গে ম্যাগুয়ের দেবী ‘মায়াহুয়েল’-এর যোগসুত্র রয়েছে। উদ্ভিদের মাধ্যমে অ্যাগুয়ামিল সংগ্রহ করা মূলত তার রক্ত বলে মনে করা হতো।

আরো পড়ুন- পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে বিপত্তি! ভোগের গরম ডাল পড়ে গুরুতর জখম হলেন ২ জন

II)সোমা :- প্রাচীন ভারতের বৈদিক সংস্কৃতিতে বহুল ব্যবহৃত হতো সোমা নামের পানীয়টি। এই তরল পানীয়টির পেছনেও রয়েছে যথেষ্ট কাহিনী। পুরান মতে উল্লেখ করা রয়েছে যে সোমা ছিলেন একজন দেবতা। যাকে চাঁদের সঙ্গে বাধা এবং নিরাময়কারী দেবতা হিসাবে মনে করা হতো। গাছের ডালের তরল নিংড়ে ফেটে দুধ এবং জলের মিশ্রণের মাধ্যমে তৈরি করা হয়েছিল ঋগ্বেদে সোমা। বৈদিক অর্থ অনুযায়ী সোমা কথার মানে হলো নির্যাস, পাতন এবং ছিটিয়ে দেওয়া। সোমা পানীয়টি পান করলে যে হ্যালুসিনেশন হতো সেটি প্রমাণ সাপেক্ষ।

III) শেদেহ:- প্রাচীন মিশরের রহস্যময় পানীয় শেদেহ আজও চর্চিত। কারণ পূর্বে মনে করা হতো এই পানীয়টি তৈরি করা হয়েছিল ডালিম ফল থেকে কিন্তু বর্তমানে নানান তর্ক বিতর্কের পর মনে করা হয় এটি লাল আঙ্গুর থেকে তৈরি করা হয়েছে। মিশরের ফারাওদের অতি পছন্দের ছিল এই তরলটি।‌ প্রাচীন মিশরের রাজা তুতেনখামেনের মৃত্যুর পর তাকে যে সমাধি দেওয়া হয়েছিল সেখানেও এই তরলের অস্তিত্ব পাওয়া গিয়েছিল।

IV) কনডিটাম:- রোমানে মসাদার ওয়াইন হিসেবে পরিচিত ছিল কনডিটাম। এই শব্দের অর্থ করলে এর মানে দাঁড়ায় যে মসলাযুক্ত ও মধু দ্বারা তৈরি একটি পানীয়। রোমানে এই পানীয় যতটা জনপ্রিয় ছিল তার থেকে অধিক জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল বাইজেনটাইন যুগ ও তারপরে। এই পানীয়র জনপ্রিয়তার কারণ ছিল এর ভেতরে দেওয়া মশলা। মূলত এখানে মশলা হিসেবে ব্যবহার করা হতো, ভেজানো খেজুর, খেজুরের বীজ, জাফরান, লবঙ্গ, গোলমরিচ সহ একাধিক দ্রব্য। ভ্রমণকারী ও পর্যটকদের জন্য এই তরল ছিল অতি জনপ্রিয়।

V)ফ্যালারিয়ান ওয়াইন :- বর্তমানে মাউন্ট ম্যাসিকো থেকে পাওয়া আঙ্গুর থেকে তৈরি করা হতো ফ্যালারিয়ান ওয়াইন। এই সাদা ওয়াইন অতি জনপ্রিয় ছিল রোমানিদের কাছে। এই ওয়াইন ছিল মূলত তিন ধরনের শুষ্ক, মিষ্টি এবং হালকা। আঙ্গুর তৈরি সিজন ছাড়া এই ওয়াইন তৈরি করা যেত কারণ রোমের বাসিন্দারা আঙ্গুর সংগ্রহ করে সেগুলো শুকিয়ে রাখত। কারণ তারা মনে করত আমিও শুকিয়ে গেলে তার স্বাদ পানীয়তে বহুগুণ বেড়ে যাবে। এই পানীয় এতটাই জনপ্রিয় ছিল যে রোমের সম্রাট জুলিয়াস সিজার নিজের আনন্দ উদযাপন করার সময় এই ওয়াইন ব্যবহার করতেন। এছাড়াও বহু মানুষ নকল ওয়াইন তৈরি করে ফ্যালারিয়ান ওয়াইন বলে চালিয়ে দিতো।

VI)মিশরীয় বিয়ার :- আনুমানিক ৫০০০ বছর পূর্বে মিশরীয় শ্রমিকরা তাদের নিজেদের জন্য এক ধরনের বিয়ার তৈরি করেছিলেন। খামির দিয়ে বার্লি গাজন করে সেটা ছেকে নিলেই তৈরি হয়ে যেত বিয়ার। কিন্তু কালের ক্রমে যখন মিশরের আধিপত্য চলে গিয়েছিল মুসলিম সম্প্রদায়ের হাতে, তখন বিশেষ কিছু ধর্মের কারণে তারা এই বিয়ার প্রচলনের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন। সে কারণে কিছুটা সময়ের জন্য বিয়ার প্রচলন বন্ধ হলেও আজ পর্যন্ত এই বিয়ার জনপ্রিয় রয়েছে মিশরে। বর্তমানে যদি মিশরে নজর দেওয়া যায় তাহলে দেখা যাবে যে, ১০০ ভাগের মধ্যে ৫৪ শতাংশ মিশরীয় বিয়ারের প্রচলন রয়েছে।

VII)কাইকেয়ন :- প্রাচীন গ্রীসে তৈরি হয়েছিল কাইকেয়ন নামক পানীয়টি। এই তরল ওয়াইন কি দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল সে সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকলেও বিশেষ করে অনুমান করেন যে পনির, বার্লি ও ওয়াইনের অদ্ভুত এক মিশ্রণ ছিল এই তরল। এই সাইকেডেলিক পানীয়টি সে সময় জাদুকর পানীয় হিসেবে পরিচিত ছিল। এছাড়াও এই ওয়াইনের সঙ্গে কিছু ধর্মীয় বাণী যুক্ত ছিল। মনে করা হতো এই ওয়াইন পান করার মাধ্যমে দেবী ডিমিটার এবং এলিউসিসের কৃপা দৃষ্টি বর্ষণ হবে। সেই কারণে কোন অনুষ্ঠান হলে সেই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী এবং অনুষ্ঠানের পালনকারীরা এই ওয়াইন পান করতেন দেবীর দর্শন পাবার আশায়।

VIII)রেটসিনা :- সাদা ও লাল ওয়াইন রেড সিনা প্রচলিত ছিল গ্রীকে। তবে যারা এই ওয়াইন খেয়েছেন তারা মনে করতেন এর টার্পেনটাইন স্বাদ ছিল মূলত অ্যালকোহলে উপস্থিতও ফাইন এবং রজনের কারণে। বহু আগে তৈরি হয়েছিল তখন পাইন রেজিনে এটিকে সংগ্রহ করে রাখা হতো। কিন্তু রোমানীয়রা পরবর্তীকালে ৩য় শতাব্দীতে এই ওয়াইনকে বোতলে সংরক্ষণ করতেন। রেটসিনা ওয়াইনের বয়স আজ থেকে আনুমানিক ৩ কিংবা ৪ হাজার বছর হলেও আজও রোমানে এই ওয়াইনের জনপ্রিয়তা একটুও কমেনি।

IX)পসকা :- প্রাচীন রোমের সবচেয়ে সহজলভ্য পানীয় ছিল পসকা। জল, ভিনেগার, লবন ও কিছু ভেষজের মিশ্রণে পানীয় তৈরি করা হতো এবং সেটি তৃষ্ণা নিবরনের জন্য ছিল খুবই উপযুক্ত। সেই সময়কার যুগে এই পানীয় উচ্চ ব্যক্তিরা তুচ্ছ মনে করলেও দাস ও শ্রমিকদের কাছে ছিল তৃষ্ণা নিবারণের অন্য উপকরণ। তখন পানীয়টি বানানো খুব সহজ হলেও আজ তার উৎস অজানা। তবে মনে করা হয় এই পানীয়র নাম পসকা দেওয়ার অন্যতম কারণ ছিল এটির ল্যাটিন শব্দ পোটর যার অর্থ পান করা বা গ্রীক শব্দ ইপোক্সিস যার অর্থ তৃষ্ণা থেকে উদ্ভুত।

১৯৭১ যুদ্ধের আগে কিভাবে পাকিস্তানের গোয়েন্দাদের বোকা বানিয়েছিল ভারতীয় গোয়েন্দারা?

১৯৭১ সালে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যে যুদ্ধ হয় তার ফলেই পূর্ব পাকিস্তান আলাদা হয়ে আজকের বাংলাদেশ গঠন হয়। তেরো দিনের এই যুদ্ধে পাকিস্তানের প্রায় ৯৩,০০০ সেনা আত্মসমর্পন করে। তবে এই যুদ্ধ জয়ের পিছনে এমন এক পরিকল্পনা ছিল যা এর আগে কোনওদিন করা হয়নি। এমন এক মিশন যা পৃথিবীর তাবড় তাবড় গোয়েন্দা সংস্থা গুলো ভাবতেও পারেনি তা সে আমেরিকার সিআইএ হোক কিংবা ভারতের পরম বন্ধু ইসরায়েলের মোসাদই হোক। এমনই এক অসাধারন পরিকল্পনা সম্ভব করেছিলো ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা র এবং ইনটেলিজেন্স ব্যুরো বা আইবি, যার ফলস্বরূপ লজ্জাজনক আত্মসমর্পনের মাধ্যমে পাকিস্তান পরাজিত হয় এবং বাংলাদেশ তৈরি হয়।

১৯৫০ এর দশকে জম্মু কাশ্মীরে একটি রাজনৈতিক দল তৈরি হয় যার নাম জম্মু কাশ্মীর প্লেবিসাইট ফ্রন্ট।

এই দলের লক্ষ্য ছিল এটা ঠিক করা যে জম্মু কাশ্মীরের কাশ্মীর ভারতের অংশ হবে নাকী পাকিস্তানের অংশ হবে অথবা স্বাধীন একটি দেশ হিসাবে থাকবে। এই দলের প্রতিষ্ঠাতা ছিল মির্জা আফজাই বেগ। এই সংগঠনের সাথে কিছুদিন পর এক ব্যাক্তি যুক্ত হয় যার নাম মকবুল ভাট। কিছুদিনের মধ্যেই সংগঠনের পরিচিত মুখ হয়ে ওঠে সে। কিন্তু ধীরে ধীরে অপরাধ মূলক কাজকর্মে জড়িয়ে পড়তে থাকে সে। যার কারনে জম্মু কাশ্মীর পুলিশ তাকে খুঁজতে শুরু করে। পুলিশের থেকে বাঁচতে মকবুল ভাট ১৯৫৮ সালের আগস্ট মাসে পাকিস্তান পালিয়ে যায়। পাকিস্তানে গিয়ে পেশোয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে উর্দুতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করে মকবুল। ততদিনে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই এর সাথে রীতিমতো যোগাযোগ শুরু হয়ে গিয়েছিল তার। মকবুল ভাট পাকিস্তানেই একটি সন্ত্রাসী সংগঠন তৈরি করে ১৯৬৫ সালে যার নাম ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট বা এনএলএফ। এই সংগঠনের কাজ ছিল কাশ্মীর উপত্যকায় সন্ত্রাস তৈরি করা এবং কাশ্মীরকে ভারত থেকে আলাদা করে পাকিস্তানে যুক্ত করা। এই সংগঠনের পেছনে ছিল আইএসআই।

আরো পড়ুন- “মানুষের মাংস খাওয়া কী ঠিক হবে?” এটা কোনও প্রশ্ন নয় বরং প্রশ্ন হলো “কোন লাশের মাংস খাবো?”

১৯৬৬ সালে এনএলএফ জম্মু কাশ্মীরে এক সিআইডি অফিসার অমর চাঁদকে হত্যা করে যার পরেই জম্মু কাশ্মীর পুলিশ মকবুল ভাট সহ এনএলএফের বহু সদস্যকে গ্রেফতার করে। শ্রীনগর আদালতে মকবুল ভাটকে ফাঁসির সাজা দেওয়া হয়। কিন্তু ১৯৬৮ সালে ফাঁসির আগেই মকবুল ভাট জেল থেকে পালিয়ে যায়। এই বছরই প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী র বা রিসার্চ এন্ড অ্যানলিসিস উইং তৈরি করেন এবং এর প্রধান হিসাবে নিযোগ করা হয় রামেশ্বর নাথ কাওকে। জেল থেকে পালিয়ে গিয়ে মকবুল ভাট শ্রীনগরেই আত্মগোপন করে আইএসআই এর সাথে গোপনে যোগাযোগ করতে থাকে।

১৯৬৯ সালে মকবুলের সাথে পরিচয় হয় ১৭-১৮ বছরের দুজন ছেলে হাসিম কুরেশি ও আশরাফ কুরেশি। জম্মু ও কাশ্মীরের ধনী ব্যাবসায়ী পরিবারের এই দুই ছেলেকে এনএলএফের সদস্য করে মকবুল। এর একবছর পর অর্থাৎ ১৯৭০ সালে মকবুল ভারতের জেলে বন্দী থাকা ৩৬ জন এনএলএফ সন্ত্রাসীকে মুক্তি পাওয়ানোর জন্য এবং কাশ্মীর সমস্যাকে আন্তর্জাতিক স্তরে আলোচনার জন্য একটি ঘাতক পরিকল্পনা তৈরি করে। পরিকল্পনা অনুযায়ী ভারতের একটি বিমান হাইজ্যাক করা হবে এবং সেই বিমানকে লাহোরে আনা হবে। বিমানের যাত্রীদের বন্ধক বানিয়ে ভারত সরকারকে বাধ্য করা হবে তাদের দাবি মানতে, এটাই পরিকল্পনা ছিল মকবুল ও আইএসআই এর। এই পুরো মিশনের দায়িত্ব দেওয়া হয় হাসিম ও আশরাফকে। এর জন্য তাদের রীতিমতো প্রশিক্ষন দেওয়া হয় পাকিস্তানে। এরপর তাদের পিস্তল ও হ্যান্ড গ্রেনেড দিয়ে শ্রীনগরে পাঠানো হয়। কিন্তু এই দুজন বিএসএফের হাতে ধরা পড়ে যায় এবং জিজ্ঞাসাবাদের সময় তারা সমস্ত পরিকল্পনা জানিয়ে দেয়। ফলে আইএসআই এর পরিকল্পনা ব্যার্থ হয়ে যায়।

এদিকে ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতিও পরিবর্তন হয়। পাকিস্তানের জেনারেল ইয়াইয়া খানের নেতৃত্বে ১৯৭০ সালে পাকিস্তানে সাধারন নির্বাচন হয় যাতে পূর্ব পাকিস্তানের মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগ দল ১৬৭ আসনে জয়লাভ করে। সেসময় পাকিস্তানের লোকসভায় ৩১৩ টি আসন ছিল। অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছিল জুলফিকার আলি ভুট্টো যে ১২২ এর মতোন আসন পেয়েছিল। র তার এজেন্টদের মাধ্যমে খবর পায় মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনের স্বপ্ন দেখছে যার কারনে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ক্রমাগত পাকিস্তানি সেনাদের পূর্ব পাকিস্তানে পাঠানো হচ্ছে এবং পাকিস্তান মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তারের পরিকল্পনা করছে। এই খবর পেয়েই আর এন কাও প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে একটি জরুরি বৈঠক করেন, বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন ভারতের কিংবদন্তি ফিল্ড মার্শাল স্যাম মানেকশ। বৈঠকে পূর্ব পাকিস্তানে সেনাবাহিনী পাঠানোর কথাও ওঠে কিন্তু স্যাম মানেকশ জানান ভারত এই মহূর্তে যুদ্ধের জন্য প্রস্তত নয় অন্তত ছয় মাস লাগবে প্রস্তত হতে। এদিকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ক্রমাগত বিমানে করে পাকিস্তান সেনা ও হাতিয়ার পাঠাতে থাকে পূর্ব পাকিস্তানে।

পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ভারতের আকাশসীমা হয়েই বিমান মাত্র দুই ঘন্টায় পূর্ব পাকিস্তানে পৌঁছাত। ভারত বারনও করতে পারতো না কারন পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানের মাঝে ভারত ছিল সেতুর মতোন তাই আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী ভারতকে তার আকাশ সীমা কোন কারন ছাড়া বন্ধ করতে পারতোনা। ভারত বুঝতে পারে যদি আকাশ সীমা অবিলম্বে বন্ধ না করা হয় তাহলে পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তানকে পুরো কব্জা করে ফেলবে যাতে বিপদ বাড়বে ভারতের। র একটা পরিকল্পনা তৈরি করে। হাসিম ও আশরাফ কুরেশিকে তৈরি করে র এই পরিকল্পনার জন্য। হাসিম ও আশরাফ বিএসএফের হাতে গ্রেফতার হয়েছে তা জনত না আইএসআই, এটারই সুযোগ নেয় র। হাসিম ও আশরাফকে পাকিস্তান যে বিমান হাইজ্যাকের জন্য ভারতে পাঠিয়েছিল সেই মতোই পরিকল্পনা তৈরি করে র।

হাসিম ও আশরাফকে নকল বন্দুক ও গ্রেনেড দেওয়া হয়। বহুদিন ধরে অবসরে যাওয়া একটি বিমান গঙ্গাকে তৈরি করা হয় কিছুদিনের মধ্যে। এই বিমানে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ত্রিশ জন সদস্য যাত্রী সেজে বসে, হাসিম ও আশরাফকে নির্দেশ দেওয়া হয় এই বিমান হাইজ্যাক করে লাহোরে নিয়ে যাওয়ার। ১৯৭১ সালের ৩০ জানুয়ারি র এর পরিকল্পনা অনুযায়ী হাসিম ও আশরাফ এই বিমান হাইজ্যাক করে লাহোরে নিয়ে যায়৷ আইএসআই খুশি হয়, পাকিস্তানের বড় মন্ত্রী জুলফিকর আলি ভুট্টো নিজে এসে হাসিম ও আশরাফকে অভ্যত্থনা জানায়, পাকিস্তানে এই দুজনকে রীতিমতো রাজকীয় সম্মান দেওয়া হয়। এরপর পাকিস্তান ভারতের কাছে জানায় এনএলএফের ৩৬ জন সদস্যকে ছেড়ে দেবার জন্য কিন্তু ভারত পরিকল্পনা অনুযায়ী এই দাবী প্রত্যাখান করে তার যাত্রীদের নিরাপদে ভারতে পৌঁছে দেবার কথা বলে।

কুটনৈতিক চাপে পড়ে পাকিস্তান পাঞ্জাব সীমান্ত দিয়ে ওই ত্রিশ জনকে ভারতে পৌঁছে দেয়। এদিকে হাসিম ৩১ জানুয়ারি ভারতীয় বিমানটিতে আগুন লাগিয়ে দেয়। ফলে ভারত সুযোগ পেয়ে যায় এবং ৪ ফেব্রুয়ারী ভারত ঘোষনা করে পাকিস্তানের জন্য তারা আকাশ সীমা বন্ধ করছে। ফলে সমস্যায় পড়ে পাকিস্তান।

ভারতীয় আকাশ সীমা হয়ে পাকিস্তান মাত্র দুই ঘন্টায় পূর্ব পাকিস্তানসে সেনা ও অস্ত্র পাঠাচ্ছিল কিন্তু ভারতের এই সিদ্ধান্তের কারনে পাকিস্তান বাধ্য হয় শ্রীলঙ্কা হয়ে ঘুরে পূর্ব পাকিস্তানে বিমান পাঠাতে। এতে দুই ঘন্টার জায়গায় নয় ঘন্টা সময় লাগতে শুরু করে এবং খরচ ও চার পাঁচ গুন বেড়ে যায়, ফলে বিমান পাঠানের সংখ্যা বাধ্য হয়ে কমিয়ে দেয় পাকিস্তান। এতে জেনারেল স্যাম মানেকশ যে ছয়মাস সময় চেয়েছিল তাও পেয়ে যায়। ছয়মাসে ভারতীয় সেনাবাহিনী পুরো যুদ্ধের জন্য প্রস্তত হয়ে যায়। ভারত ট্যাঙ্ক ও সেনাবাহিনী পাঠায় পাকিস্তানে। পূর্ব পাকিস্তানের মুজিবুর রহমানের অনুগামী বা স্বাধীন বাংলাদেশের সমর্থক মুক্তিবাহিনীকে প্রশিক্ষন দেয় র। ফলে যখন যুদ্ধ শুরু হয় মাত্র তেরো দিনে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সামনে আত্মসমর্পন করে পুরে পাকিস্তান সেনা এবং বাংলাদেশের জন্ম হয়। র এর অসাধারন পরিকল্পনায় রীতিমতো বোকা হয়ে যায় আইএসআই। পরে পাকিস্তান রীতিমতো তদন্ত করে একবছর ধরে এই পুরে ঘটনার। তদন্তে পাকিস্তান বুঝতে পারে গঙ্গা বিমানের হাইজ্যাকিং পুরো র এর পরিকল্পনা এবং হাসিম ও আশরাফ কুরেশি ভারতের এজেন্ট। ফলে হাসিম ও আশরাফকে গ্রেফতার করা হয় এবং সাত বছরের জন্য জেল হয় তাদের। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে হাসিম লন্ডন চলে যায়। মে, ১৯৭৬ সালে মকবুল ভাটকে আবারও গ্রেফতার করা হয় জম্মু কাশ্মীরে। মকবুল ভাট গ্রেফতার হতেই জম্মু কাশ্মীরে এনএলএফের মেরুদন্ড ভেঙে যায়, তবে মকবুল ভাটকে ছাড়ানের জন্য বিভিন্ন সন্ত্রাসী সংগঠন অনেক চেষ্টাই করেছিল কিন্তু শেষপর্যন্ত ১৯৮৪ সালের ১১ ফেব্রুয়ারী দিল্লির তিহাড় জেলে মকবুল ভাটের ফাঁসি হয়।

“মানুষের মাংস খাওয়া কী ঠিক হবে?” এটা কোনও প্রশ্ন নয় বরং প্রশ্ন হলো “কোন লাশের মাংস খাবো?”

বর্তমানে চিকিৎসা বিজ্ঞান উন্নত হওয়ার পাশাপাশি বদলেছে পুরনো দিনের অনেক রীতি-নীতিও। আগে চিকিৎসা শাস্ত্রে উন্নতি না হওয়ার কারণে ষোরশ এবং সপ্তদশ শতাব্দীতে এমন অনেক রেওয়াজ প্রচলিত ছিল যেটা আজকের দিনে অবাস্তব বলেই মনে হবে। কারণ সেই সময় রাজ রাজা থেকে শুরু করে পুরোহিত এমনকি বিজ্ঞানীরা পর্যন্ত নিজেদের রোগ নিরাময়ের জন্য শবদেহ ভক্ষণ করত। সপ্তদশ শতাব্দি খুব একটা পুরনো নয়। অর্থাৎ ২০০ বছর আগে পর্যন্ত ইউরোপে প্রচলিত ছিল মৃতদেহকে খাওয়ার রীতি।

তাহলে একটু পরিষ্কারভাবেই বলা যাক, কয়েক বছর আগে ইউরোপে ঠিক কেমন প্রথা প্রচলন ছিল? ইউরোপে প্রকাশিত বেশ কয়েকটি স্বনামধন্য বই যেমন – নোবেলের বই, মেডিসিনাল ক্যানিবালিজম ইন আর্লি মডার্ন ইংলিশ লিটারেচার অ্যান্ড কালচার, এবং ইংল্যান্ডের ডারহাম ইউনিভার্সিটির রিচার্ড সুগের বই, মমিস, ক্যানিবালস অ্যান্ড ভ্যাম্পায়ারস: দ্য হিস্ট্রি অফ কর্পস মেডিসিন ফ্রম দ্য রেনেসাঁ টু দ্য ভিক্টোরিয়ান্স ইউরোপে নরখাদকের প্রচলনের বিষয় তুলে ধরা আছে।

এই সকল বইয়ের লেখা অনুযায়ী বলা হয়েছে যে, কয়েকশো বছর আগে অর্থাৎ ষোড়শ এবং সপ্তদশ শতকে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি রাজা থেকে শুরু করে বিজ্ঞানীরাও তাদের রোগ নিরাময়ের জন্য সব দেহ কিংবা মমির থেকে প্রাপ্ত মাথার খুলি, হাড় ও একাধিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিতো রোগের প্রতিকারক হিসেবে। যার কারণে সেই সময় কবর খুঁড়ে মৃতদেহ তোলা বা মিশরীয় সমাধি থেকে মমি চুরি করা এবং আইরিশ সমাধি স্থল থেকে মাথার খুলি নেওয়া ও সেগুলিকে বেআইনিভাবে প্রকাশ্যে বাজারে বিক্রি করার ঢল পড়ে গিয়েছিল। এমনকি রমরমা চলছিল সেই বাজারও। মাথা ব্যাথা শুরু করে মৃগী রোগ পর্যন্ত যেকোনো রোগের দাওয়াই তৈরি করার মূল মন্ত্র ছিল মৃতদেহের হাড় রক্ত কিংবা চর্বি দিয়ে তৈরি ওষুধ। রিচার্ড সুগেরের কথায়, “মানুষের মাংস খাওয়া কী ঠিক হবে?” এটা কোনও প্রশ্ন নয় বরং প্রশ্ন হলো “কোন লাশের মাংস খাবো?”

এবার আসা যাক ইউরোপীয় বাসিন্দারা কিভাবে এই মৃত মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে ওষুধ ব্যবহার করত। প্রথমে মিশরীয় মমিকে গুঁড়ো করে নেওয়া হত তারপর আরকের সঙ্গে সেটাকে মিশিয়ে রক্তপাত বন্ধের ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করা হত। প্রথমে এই পদ্ধতিতে রক্তপাত বন্ধ হওয়ার কাজ হলেও পরবর্তীতে মাথাব্যথা থেকে শুরু করে মৃগিরও সমস্ত রোগের ওষুধে ব্যবহার করা হতো মৃত মানুষের দেহাবশেষ। এছাড়াও মাথাব্যথা চিকিৎসা হিসাবে ব্যবহার করতো করোটি গুড়া। কারণ তখনকার বিজ্ঞানীরা মনে করতেন শব দেহে নিশ্চিত রয়েছে ভেষজ গুণ এবং সেই ভেষজ গুণের প্রয়োগে সারবে সাধারণ মানুষের রোগ। অর্থাৎ ইউরোপীয় বিজ্ঞানীদের কথা মতোই শব দেহের মাংস ,করোটি, হাড়, মস্তিষ্ক ব্যবহার করতেন বিজ্ঞানী থেকে শুরু করে যাজক, রাজা এবং সাধারন মানুষেরা।

শুধুমাত্র যে শবদেহের অঙ্গ গুঁড়ো করে ওষুধ হিসেবে ভক্ষণ করতো বিজ্ঞানীরা তাই নয়, এক একটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিয়ে নানান গবেষণাও করেছেন বিজ্ঞানীরা। সেই বিজ্ঞান চর্চার মাধ্যমে শব্দ শতকের একজন ইউরোপীয় বিজ্ঞানী টমাস উইলিস অ্যাপোলেক্সি বা মস্তিষ্কের অভ্যন্তরে রক্তক্ষরণ একটি পানীয় ঔষধি আবিষ্কার করেছিলেন। কি ওষুধ যে তিনি তৈরি করেছিলেন মৃত মানুষের মাথার খুলি এবং চকলেটের সংমিশ্রণে? সে সময়কার ইংল্যান্ডের রাজা দ্বিতীয় চার্লস নিজের মস্তিষ্ক ঠিক রাখার জন্য দ্য কিংস ড্রপস নামের একটি পানীয় পান করতেন। যে পানীয়তে চোবানো থাকতো মৃত মানুষের মাথার খুলি। এছাড়াও মাটির তলে যে সমস্ত মৃতদেহ কবরস্থ করা থাকতো সেই মাটির উপরের জন্তু এক প্রকার শ্যাওলার আস্তরণ। যেটিকে তখনকার বিজ্ঞানীরা ইউসেনা বলে নামকরণ করেছিলেন। এই শ্যাওলার আস্তরণ টিকেও চিকিৎসা ক্ষেত্রে ভেষজ হিসেবে ব্যবহার করতেন বিশেষজ্ঞরা। এই ভেষজের মাধ্যমে নাক থেকে রক্তক্ষরণ এবং মৃগী রোগ নিরাময় করা যায় বলেই মনে করতেন তারা। শুধুমাত্র মাথার খুলি নয়, মৃত মানুষের চর্বি জীবিত মানুষের শরীরের বাইরে আঘাতের চিকিৎসার জন্য ব্যবহার করা হতো। ইউরোপ নয় জার্মানিতে দেখা গিয়েছে ক্ষতস্থান হোক কিংবা গেটে বাতের ব্যথা এই সকল রোগ নিরাময়ের জন্য চর্বি মাখা ব্যান্ডেজ ঘষা ও লাগাতেন চিকিৎসকেরা।

শব দেহ থেকে উৎপন্ন ওষুধ সেই সময়ের বাজারে বিক্রি হতো চড়া দামে। সেক্ষেত্রে গরিব মানুষের পক্ষে কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল এই ওষুধ কিনা। কিন্তু তারাও নরদেহজাত কথিত ওষুধের‌ সেবন করার সুযোগ পেয়েছিলেন। ওষুধের পাশাপাশি মৃতদেহের তাজা রক্ত সেবন করার প্রথা ছিল, কারণ তাদের অনুমান ছিল রক্ত পান করলে প্রাণশক্তি ভরপুর থাকবে।

বঙ্গীয় ব্রাহ্মণদের আদি বাসস্থান

রানা চক্রবর্তীঃ বঙ্গদেশীয় ব্রাহ্মণদের দুটি ভাগ – ‘রাঢ়ী’ ও ‘বারেন্দ্র’। এই দুই ভাগের ব্রাহ্মণদের আদি বাসস্থান কোথায় ছিল তা নিয়ে সেই অতীতকাল থেকে বিতর্ক চলে আসছে। প্রচলিত প্রবাদানুসারে বঙ্গদেশের ‘রাঢ়ী’ ও ‘বারেন্দ্র’ ব্রাহ্মণদের পূর্বপুরুষ – ‘পঞ্চ ব্রাহ্মণ’ – ‘কান্যকুব্জ’ (কনৌজ) থেকে গৌড়ে এসেছিলেন। অর্থাৎ তাঁরা আদতে মূল বঙ্গদেশের বাসিন্দা ছিলেন না বা বহিরাগত ছিলেন। কিন্তু ‘রাঢ়ী’ ও ‘বারেন্দ্র’, উভয় বিভাগের ব্রাহ্মণদের প্রাচীন কুলগ্রন্থসমূহ এই প্রবাদকে সমর্থন করে না। উভয় ব্রাহ্মণের ‘কুলজী’ মতে তাঁদের পূর্ববাসস্থান ছিল ‘কোলাঞ্চ’। এখন প্রশ্ন ‘কোলাঞ্চ’ ও ‘কান্যকুব্জ’ কি একই জায়গা? যদি সেটা না হয়, তবে ‘কোলাঞ্চ’ কোথায় ছিল? – সেই সম্বন্ধে আলোচনাই এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য। প্রাচীন বঙ্গের রাঢ়ীয় ব্রাহ্মণদের প্রাচীনতম কুলগ্রন্থকারদের মধ্যে ‘হরিমিশ্র’ ছিলেন অন্যতম। তিনি লিখেছিলেন –
“কোলাঞ্চদেশতঃ পঞ্চ বিপ্ৰা জ্ঞানতপোযুতাঃ।
মহারাজাদিশূরেণ সমানীতাং সপত্নীকাঃ॥”
(বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস, ব্রাহ্মণকাণ্ড, ১০৪ পৃষ্ঠার পাদটীকা)
আবার হরিমিশ্রের থেকে কম প্রাচীন ‘বাচস্পতি মিশ্র’ তাঁর ‘কুলরমা’ গ্রন্থে লিখেছিলেন –
“আরুহ্য পঞ্চ তুরগানসিবাণতৃণকোদগুরম্যকবচাদিশরীরবেশাঃ।
কোলাঞ্চতো দ্বিজবরা মিলিতা হি গৌড়ে রাজাদিশূরপুরতো জ্বলদগ্নিতুল্যাঃ॥”
(বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস, ব্রাহ্মণকাণ্ড, ১০৫ পৃষ্ঠার পাদটীকা)
অন্যদিকে, রাঢ়ীয় কুলগ্রন্থানুসারে পঞ্চ ব্রাহ্মণের সকলেই ‘কোলাঞ্চ’ থেকে এসেছিলেন। কিন্তু বারেন্দ্র কুলাচার্যদের মধ্যে এই বিষয়ে মতভেদ দেখতে পাওয়া যায়। ‘বারেন্দ্রকুলপঞ্জিকা’য় লেখা আছে যে, পঞ্চ ব্রাহ্মণ বিভিন্ন জায়গা থেকে বঙ্গদেশে এসেছিলেন। তাঁদের মধ্যে একমাত্র ‘কাশ্যপগোত্রীয়’দের বীজী পুরুষ – ‘সুষেণ’ – কোলাঞ্চ থেকে এসেছিলেন –
“নারায়ণাখ্যো যস্তেযাং শাণ্ডিল্যগোত্র এর সঃ।
রাজাজ্ঞয়া সমায়াতঃ গ্রামতো জম্বুচত্বরা॥
ই ধরাধরো বাৎস্যগোত্রস্তাড়িতগ্রামতঃ স্বয়ম্।
সুষেণঃ কাশ্যপো জ্ঞেয়ঃ কোলাঞ্চাৎ ত্বরয়াগতঃ॥
গৌতমাখ্যো ভরদ্বাজগোত্র ঔড়ম্বরাত্তথা।
পরাশরস্ত সাবর্ণো মদ্রগামাৎ সমাগতঃ॥”
(বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস, ব্রাহ্মণকাণ্ড, ১০৬ পৃষ্ঠার পাদটীকা)
উপরে উল্লেখিত ‘বারেন্দ্রকুলপঞ্জিকা’র শ্লোকে যে কোলাঞ্চের উল্লেখ করা হয়েছে, সেটা সম্ভবতঃ ‘করঞ্জ’ হবে। কারণ, ১৪১৫ শকে (“শরবিধুমনুভিঃ শকস্য বর্ষে”) অর্থাৎ ১৪৯৩ সালে, ‘করঞ্জগাঞি’ ‘চতুর্ভুজ ভট্টাচার্য’ লিখিত ‘হরিচরিত কাব্যে’ দেখতে পাওয়া যায় যে, ‘স্বর্ণরেখ’ নামের এক ‘বিপ্র’ (বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ) রাজা ‘ধর্মপালের’ কাছ থেকে ‘বারেন্দ্রে করঞ্জ’ নামের গ্রামটি পেয়েছিলেন। এই স্বর্ণরেখের বংশে ‘ভুন্দু’ জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ভুন্দুর পুত্র ছিলেন ‘দিবাকর আচার্য’। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, ‘বারেন্দ্র কাশ্যপ গোত্রের’ আদি গাঞি হল ‘করঞ্জ’ (Catalogue of Nepal Mss No 1608 ছ)। বারেন্দ্র কুলজী গ্রন্থে দেখা যায় যে, স্বর্ণরেখের পৌত্র ছিলেন ‘কৈতাই’ (ভাদুড়ি গাঞি) এবং ‘মৈতাই’ (মৈত্র গাঞি); তাঁরা ছিলেন প্রথম ‘বল্লালী কুলীন’। এবং ‘কৈতাই ভাদুড়ি’র পৌত্র ছিলেন ‘ভল্লু’ (হরিচরিতের ভুন্দু)। ভল্লুর পুত্র ছিলেন ‘যোগেশ্বর ভাদুড়ি’ ও ‘দিবাকর করঞ্জ’। সুতরাং কুলজী মতে ‘ভাদুড়ি গাঞি’ই আদি এবং সেটা থেকেই ‘করঞ্জ গাঞি’র উৎপত্তি ঘটেছে। গবেষকদের কিন্তু হরিচরিতের কথা অর্থাৎ – ‘করঞ্জ গাঞি’ই ‘কাশ্যপ গোত্রীয় বারেন্দ্র ব্রাহ্মণদের আদি গাঞি’ – এটা বেশি বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয়। তবে ‘স্বর্ণরেখ’ কি তাঁহার পূর্বপুরুষ ‘স্বর্ণক’ ওই গ্রাম পেয়েছিলে, সেই বিষয়ে গবেষকরা সন্দেহ প্রকাশ করে থাকেন। কারণ, বল্লালসেনের সমসাময়িক ‘কৈতাই ভাদুড়ি’র পিতামহ ‘স্বর্ণরেখ’ কখনই ধর্মপালের সমসাময়িক হতে পারেন না। রাঢ়ীয় প্রাচীন কুলগ্রন্থকর্তা ‘হরিমিশ্র’ লিখেছিলেন যে, কাশ্যপ গোত্রে ‘কৃষ্ণমিশ্র’ জন্মগ্রহণ করেছিলেন, তাঁর পুত্র ছিলেন ‘তমিস্র’, তাঁর পুত্র ছিলেন ‘ওঙ্কার’, তাঁর পুত্র ছিলেন ‘স্বর্ণক’ আর তাঁর পুত্র ছিলেন ‘বীতরাগ’, তিনিই গৌড়মণ্ডলে গিয়েছিলেন। তাঁর পুত্রদের নাম ছিল – ‘দক্ষ’, ‘সুষেণ’ ও ‘কৃপানিধি’ (রাঢ়ীয় ব্রাহ্মণ কাণ্ড)। ‘দক্ষ’ ছিলেন রাঢ়ীয় ব্রাহ্মণদের এবং ‘সুষেণ’ ছিলেন বারেন্দ্রদের পূর্বপুরুষ। ‘বারেন্দ্রকুলপঞ্জিকা’ প্রণেতা ‘চতুর্ভুজ’ সম্ভবতঃ এই ‘স্বর্ণক’ এবং ‘স্বর্ণরেখ’-এ গোলমাল করে ফেলেছিলেন। ‘স্বর্ণক’ থেকে ‘কৈতাই ভাদুড়ি’ পর্যন্ত ত্রয়োদশ পুরুষ হয়। বল্লালসেনের রাজ্যারম্ভ হয়েছিল ১০৮২ শকে বা ইংরেজি ১১৬০ সালে। আর ধর্মপালের রাজ্যারম্ভ হয়েছিল ইংরেজি ৭৬০ সালে। দু’জনের মধ্যে ৪০০ বছরের পার্থক্য। তিন পুরুষে একশো বছর ধরলে ‘স্বর্ণক’ কিন্তু ধর্মপালের সমকালবর্তী হন। শ্লোকের প্রথম লাইনে ‘শাণ্ডিল্য’ ‘নারায়ণ’ ‘জম্বুচত্বর’ গ্রাম থেকে এসেছিলেন বলে লেখা হয়েছে। এটাও সম্ভবতঃ ঠিক নয়। কারণ ‘তৃতীয় বিগ্রহপালের’ ‘আমগাছিশাসনে’ দেখতে পাওয়া যায় যে, ‘শাণ্ডিল্যগোত্রীয়’ ‘খোদুল শর্মা’র পূর্বপুরুষরা ‘ক্রোড়ঞি’ (কোলাঞ্চ) থেকে এসে ‘মৎস্যাবাস’ গ্রামবাসী হয়েছিলেন। সেখান থেকে তাঁরা ‘ছত্র গ্রামে’ বাস স্থাপন করেছিলেন। ‘মৎস্যাবাস’ বা ‘মৎস্যাসী’ হল বারেন্দ্র ব্রাহ্মণদের শাণ্ডিল্য গোত্রের অন্যতম গাঞি। প্রকৃতপক্ষে গবেষকরা প্রাচীন লিপির যত জায়গায় ‘কোলাঞ্চ ব্রাহ্মণের’ উল্লেখ পেয়েছেন, তাঁরা সকলেই ‘শাণ্ডিল্যগোত্রীয়’। আবার বারেন্দ্র কুলপঞ্জীতে লেখা হয়েছে যে, ‘ভট্টনারায়ণ’ কোলাঞ্চ দেশ থেকে আগমন করেছিলেন। তাঁর পুত্র ‘আদিগাঞি’ নামক ‘বিপ্র’ (বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ) রাজা ‘ধর্মপালের’ কাছ থেকে যজ্ঞের দক্ষিণাস্বরূপ ‘ধামসা’র গ্রাম পেয়েছিলেন (বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ কাণ্ড)। ‘জম্মু’ শাণ্ডিল্য গোত্রীয়দের অন্যতম গাঞি। এই ‘জম্বু’ ও ‘জম্বুচত্বর’ সম্ভবতঃ একই জায়গা বলে গবেষকরা মনে করেন এবং খুব সম্ভবতঃ, এই ‘জম্বুচত্বর’ – ‘দামোদরপুরের তাম্রশাসনে’ উল্লিখিত ‘জম্বুনদী’র তীরে অবস্থিত ছিল। শাণ্ডিল্য গোত্রের প্রথম বল্লালী কুলীন ‘পীতাম্বর’ (লাহেড়ি গাঞি) ছিলেন, তাঁর পূর্বপুরুষ ‘আদিগাঞি’ থেকে ত্রয়োদশ পুরুষ। সুতরাং এই ‘আদিগাঞি’ও ‘কাশ্যপগোত্রীয়’ ‘স্বর্ণকের’ মত ধর্মপালের সমসাময়িক ছিলেন। তিনিই প্রথম গ্রাম দান পেয়েছিলেন বলেই সম্ভবতঃ তাঁর নাম ‘আদিগাঞি’ হয়ে গিয়েছিল। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, বারেন্দ্র ব্রাহ্মণদের ‘কাশ্যপ’ এবং ‘শাণ্ডিল্য’ গোত্রীয়দের মধ্যে প্রথম গ্রাম লাভ হয়েছিল মহারাজ ‘ধর্মপালের’ সময় থেকে। সুতরাং তাঁদের ‘আদিশূর’ ছিলেন ‘মহারাজ ধর্মপাল’। এর আগে তাঁরা কোলঞ্চবাসী ছিলেন। সেই কোলাঞ্চ গৌড়েই ছিল কিনা সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। তবে রাঢ়ী ব্রাহ্মণদের ‘আদিশূর’ বোধ হয় বিভিন্ন ব্যক্তি ছিলেন এবং তিনি রাঢ় প্রদেশের কোন রাজা ছিলেন। কারণ, সেই রাজা তাঁদের যে ‘পঞ্চ গ্রাম’ দান করেছিলেন, সেই গ্রামগুলি উত্তররাঢ়ের অন্তর্গত ছিল বলেই মনে হয়। সেই পঞ্চ গ্রামের নাম হল – ‘কামঠী’ বা ‘কামকোটী’, ‘ব্রহ্মপুরী’, ‘হরিপুর’, ‘কঙ্কগ্রাম’ ও ‘বটগ্রাম’ (রাঢ়ীয় ব্রাহ্মণ কাণ্ড)। এই ‘কঙ্কগ্রাম’ এবং ‘মুর্শিদাবাদ’ জেলার ‘কাঁগ্রাম’ একই জায়গা বলে গবেষকরা মনে করেন (পঞ্চপুষ্প, ফাল্গুন, ১৩৩৯ বঙ্গাব্দ, ৩৭০ পৃঃ)। আশ্চর্যের বিষয় হল যে, ‘বঙ্গজ কায়স্থ কুলজীগ্রন্থে’ ‘রাঢ়ীয় কায়স্থদের’ যে আটটি গ্রামের উল্লেখ পাওয়া যায়, সেগুলোর মধ্যেও তিনটি গ্রামের নাম হল – ‘হরিপুর’, ‘বটগ্রাম’ ও ‘কঙ্কগ্রাম’। রাঢ়ী ও বারেন্দ্র ব্রাহ্মণদের কতকগুলি গাঞি নামেও মিল দেখা যায়, যথা – ‘বাৎস্যগোত্রীয় ঘোষ গাঞি’। রাঢ়ীরা বলেন, ‘ঘোষ গাঞি’ রাঢ় দেশে, আবার বারেন্দ্রদের মতে সেটা বরেন্দ্র দেশে অবস্থিত।

এবারে প্রশ্ন হল, উভয় ব্রাহ্মণের কুলুজী গ্রন্থে যে ‘কোলাঞ্চ’র কথা বলা হয়েছে, সেটা আদতে কোথায় ছিল? ‘প্রাচ্যবিদ্যামহার্ণব’ ‘নগেন্দ্রনাথ বসু’ তাঁর ‘বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস’ গ্রন্থের ‘রাজন্যকাণ্ডে’ এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, “এ দেশে কোলাঞ্চ বলিলে সাধারণতঃ সকলেই কান্যকুব্জ মনে করিয়া থাকেন, কিন্তু প্রাচীন কোন সাহিত্যে, কোষগ্রন্থে অথবা শিলালিপি বা তাম্রশাসনে কান্যকুব্জের নামান্তর যে কোলাঞ্চ, সে প্রসঙ্গ আদৌ নাই। শব্দরত্নাবলী অভিধানে কোলাঞ্চ দেশবিশেষ বলিয়া লিখিত আছে, অথচ কান্যকুব্জের স্বতন্ত্র উল্লেখ ও তাহার পর্যায়, মহোদয়, কান্যকুব্জ, গাধিপুর, কৌশ ও কুশস্থলের উল্লেখ থাকিলেও ইহার মধ্যে কোলাঞ্চ শব্দই নাই। এরূপ স্থলে কোলাঞ্চ বলিলে কিরূপে কান্যকুব্জ স্বীকার করা যায়? বামন-শিবরাম-আপ্তে তাঁহার সংস্কৃত অভিধানে কোলাঞ্চের ‘name of a country of the Kalingas’ এইরূপ অর্থ করিয়াছেন। মণিয়র উইলিয়মস তাঁহার বৃহৎ সংস্কৃত ইংরাজি অভিধানে কোলাঞ্চ সম্বন্ধে লিখিয়াছেন – ‘Name of Kalinga (the Coromandel Coast from Cuttack to Madras); but according to some, this place is in Hindustan with Kanauj for its capital’, অর্থাৎ কোলাঞ্চ বলিলে কলিঙ্গদেশ, কটক হইতে মাদ্রাজ পর্যন্ত করমণ্ডল উপকূলভাগ বুঝায়, কিন্তু কাহারও কাহারও মতে উহা কনৌজ রাজধানী সমন্বিত হিন্দুস্থান মধ্যে অবস্থিত।” কোলাঞ্চ যে প্রদেশেই অবস্থিত হোক না কেন, দশম শতাব্দী ও তার পরবর্তীকালে সেটা যে ‘বেদজ্ঞ’ ‘সদ ব্রাহ্মণদের’ বাসস্থান বলে প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল, সেটার প্রমাণ প্রাচীন লিপিতেও পাওয়া যায়। কোলাঞ্চ থেকে ব্রাহ্মণরা যে কেবলমাত্র বঙ্গদেশে এসেছিলেন, তা নয়; ‘বিহার’, ‘উড়িষ্যা’ ও ‘আসাম’ প্রদেশেও তাঁরা সেখানকার শাসকদের দ্বারা ভূমিদানে সম্মানিত হয়ে উপনিবিষ্ট হয়েছিলেন। অতীতে ‘উড়িষ্যা’র ‘ঢেঙ্কানলে’ দশম শতাব্দীর অক্ষরে লেখা ‘শুল্কী-বংশীয়’ ‘পঞ্চমহাশব্দ’ সমধিগত মহারাজাধিরাজ ‘জয়স্তম্ভদেবের’ একটি ‘তাম্রশাসন’ পাওয়া গিয়েছিল। তাতে দেখা যায় যে, ‘জয়স্তম্ভদেব’ গোইল্লবিষয়ান্তঃপাতি কোদালকমণ্ডলে কঙ্কুলখণ্ডে ‘চন্দ্রপুর’ নামের একটি গ্রাম – কোলাঞ্চবিনির্গত, ‘শাণ্ডিল্যগোত্র’ আসিতদৈবলপ্রবর, ছন্দোগচরণ কৌথুমশাখাধ্যায়ী ত্রৈবিদ্যসামান্য ভটপুত্র ‘নির্বাণের’ পৌত্র, ‘খম্ভের পুত্র’ ‘বাবন’কে দান করেছিলেন। ওই কোলাঞ্চ প্রসঙ্গে ‘মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী’ লিখেছিলেন, “বঙ্গদেশের কুলজীগ্রন্থে মহারাজ আদিশূর কর্তৃক কোলাঞ্চ হইতে বেদজ্ঞ আনয়নের কথা আছে। ইহার পূর্বে কোন প্রাচীন লিপিতে কোলাঞ্চের উল্লেখ পাওয়া যায় নাই। এই স্থানের অবস্থান অনিশ্চিত। এ সম্বন্ধে বহু মতবাদ আছে, কিন্তু কোনটিই বিশ্বাসযোগ্য নহে।” বিহারের ‘লাহিরিয়া সরাই’ শহরের ছয় মাইল পশ্চিমে ‘পাঁচোভ’ নামের জায়গায়, ‘মহারাজাধিরাজ পরমেশ্বর মহামাণ্ডলিক’ ‘শ্রীমৎ সংগ্রামগুপ্তের’ একটি ‘তাম্রশাসন’ পাওয়া গিয়েছিল। তাতেও কোলাঞ্চ থেকে আগত ব্রাহ্মণদের উল্লেখ পাওয়া যায়। গবেষকদের মতে ওই তাম্রশাসনের অক্ষরগুলো ‘বিজয়সেনের দেওপাড়া-প্রশক্তি’র অক্ষরের মতন, সুতরাং ওই তাম্রশাসনটিকে দ্বাদশ শতাব্দীর বলা যেতে পারে। ওই তাম্রশাসনে লেখা ছিল যে, ‘সংগ্রামগুপ্ত’ ‘শাণ্ডিল্যাসিতদৈবলপ্রবর’, কোলাঞ্চবিনির্গত, ভট্ট শ্রীরামের পৌত্র, ‘ভট্ট শ্রীকৃষ্ণাদিত্যের’ পুত্র যজুর্বেদবিদুষ আয়ুয্য ‘বটুকভট্ট শ্রীকুমারস্বামিশর্মা’কে ভূমি দান করেছিলেন। ওই তাম্রশাসনের প্রাপ্তিস্থান থেকে প্রায় এক মাইল পূর্ব দিকে, ‘বঙ্গালিডিহি’ নামে একটি উচ্চ জায়গা আছে। ‘পাঁচোভ’ মৌজার এক মাইল পূর্বেও ঐ ধরণের আরো একটি জায়গা আছে। ওই ‘বঙ্গালিডিহি’ – বাঙালি উপনিবেশকে সূচনা করে। সম্ভবতঃ, সংগ্রামগুপ্তের তাম্রশাসনে উল্লেখিত কোলাঞ্চ থেকে আগত ব্রাহ্মণরা বাঙালি ছিলেন। তাঁদের অতীতের বাসস্থানই ‘বঙ্গালিডিহি’ নামে পরিচিত হয়েছিল। ঐতিহাসিকদের এই ধরণের সন্দেহ করবার যথেষ্ট কারণ আছে, সেই প্রসঙ্গে পরে আসা যাবে। আবার বঙ্গের পালরাজবংশীয় ‘তৃতীয় বিগ্রহপালদেবের’ রাজত্বের দ্বাদশ বর্ষে লিখিত ‘আমগাছি তাম্রশাসনে’ দেখতে পাওয়া যায় যে – ‘বিগ্রহপালদেব’, ‘শাণ্ডিল্যগোত্র’ শাণ্ডিল্যাসিতদৈবলপ্রবর হরিসব্রহ্মচারী, সামবেদী, কৌথুমশাখাধ্যায়ী, মীমাংসা-ব্যাকরণ-তর্কবিদ্যাবিৎ, ‘ক্রোড়াঞ্চি’ বিনির্গত – মৎস্যাবাসবিনির্গত, ছত্রাগাম-বাস্তব্য, বেদান্তবিৎ, ‘পদ্মাবনদেবপৌত্র’, ‘মহোপাধ্যায় অর্কদেবপুত্র’ ‘খোদুলশর্মা’কে শ্রীপুণ্ড্রবৰ্দ্ধন ভুক্তিতে, কোটিবর্ষবিষয়ান্তঃপাতি ব্রাহ্মণীমণ্ডলে ‘বিষমপুর’ গ্রামের অংশ দান করেছিলেন। ওই জায়গায় ‘ক্রোড়ঞ্চি’ ও ‘কোলাঞ্চ’ – এক জায়গা বলেই গবেষকদের মনে হয়। ‘ক্রোড়’ শব্দকে প্রচলিত বঙ্গভাষায় ‘কোল’ বলা হয়। সংস্কৃতেও ‘ক্রোড়’ বা ‘কোল’ – সমানার্থবাচক শব্দ। বারেন্দ্র ব্রাহ্মণদের শাণ্ডিল্যগোত্রের অন্যতম গাঞি হল – ‘মৎস্যাস’’। ‘মৎস্যাবাস’ ও ‘মৎস্যাসী’ও এক। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, ‘খোদুলশর্মা’র পূর্বপুরুষরা, ‘ক্রোড়ঞ্চি’ বা ‘কোলাঞ্চ’ থেকে ‘মৎস্যাবাস’ বা ‘মৎস্যাসী’ এবং সেখান থেকে ‘ছত্রাগ্রামে’ গিয়ে বসতি স্থাপন করেছিলেন। অধুনা বাংলাদেশের ‘বগুড়া’ জেলার ‘ক্ষেতলাল’ থানায় ‘ছত্রগ্রাম’ নামে একটি জায়গা আছে। আবার ওই একই জেলার ‘শিবগঞ্জ’ থানায় ‘ছত্র’ নামের একটি গ্রাম আছে। তাই তাম্রশাসনে ‘খোদুলশর্মা’ যে বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ ছিলেন, সেটা নিশ্চয় করেই বলা যেতে পারে। ঐতিহাসিকেরা ‘তৃতীয় বিগ্রহপালের’ রাজ্যকাল, একাদশ শতাব্দীর তৃতীয় পাদে ছিল বলে অনুমান করে থাকেন। উপরে এখনো পর্যন্ত যে তিনটে তাম্রশাসনের কথা আলোচনা করা হয়েছে, সেগুলোতে কোলাঞ্চের উল্লেখ পাওয়া গেলেও, সেটার অবস্থান কোথায় ছিল – সেই বিষয়ে কোন তথ্য পাওয়া যায় না। কিন্তু আর একটি তাম্রশাসন অবশ্য উল্লেখ্য, যেটার সাহায্যে কোলাঞ্চ কোথায় ছিল – এই বিষয়ে কিছুটা আলোকপাত করা যেতে পারে। ‘কামরূপরাজ ধর্মপালের’ তৃতীয় অব্দের ‘শুভঙ্করপাটক তাম্রশাসনে’ লেখা হয়েছিল – “শ্রাবস্তীতে ক্রোসঞ্জ নামে একটি গ্রাম আছে – তাহাতে কলির পাপ, যাজ্ঞিকগণের হোমধূমে অন্ধ (হওয়াতে) প্রবেশ করিতে পারে নাই॥ (১৬) সেই গ্রামে সমুৎপন্ন ব্রাহ্মণদিগের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি উদারধী কৌথুমশাখী (ব্রাহ্মণদের) প্রধান সামবেদজ্ঞদের মধ্যে অখণ্ডনীয় (প্রভাববান্) রামসদৃশ রামদেব জাত হইয়াছিলেন।” (১৭) (কামরূপশাসনাবলী, নগেন্দ্রনাথ বসু অনূদিত) ওই তাম্রশাসনের সঙ্কলয়িতা ‘পদ্মনাথ ভট্টাচার্য’, ওই গ্রামের নাম ‘ক্রোসঞ্জ’ পাঠ করেছিলেন। গবেষকদের মতে, প্রকৃত পাঠ ‘ক্রোড়াঞ্চ’ হবে। বর্তমানে সেই তাম্রশাসনটি, কলিকাতা জাদুঘরের আর্কিওলজিক্যাল বিভাগে সংরক্ষিত রয়েছে। তাই ‘ক্রোড়াঞ্জ’ ও ‘কোলাঞ্জ’ বা ‘কোলাঞ্চ’ যে একই জায়গা – সেই বিষয়ে ঐতিহাসিকেরা একমত। ঐতিহাসিকেরা ওই তাম্রশাসনের ‘ধর্মপাল’কে দ্বাদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগের লোক বলে মনে করেন। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে ‘কোলাঞ্চ’ মোটেও ‘কান্যকুব্জ’ বা ‘কনৌজ’ নয়। কেউ হয়ত বলবেন যে, ‘কোলাঞ্চ’ ‘কান্যকুব্জ’ না হোক, ওই প্রদেশের অন্তর্গত কোন জায়গা হতে পারে। আজ পর্যন্ত কিন্তু এমন কোন প্রমাণ পাওয়া যায় নি যে, কান্যকুব্জ প্রদেশে কোলাঞ্চ নামের কোন জায়গা ছিল বা আছে। ‘আপ্তে’ ও ‘মণিয়র উইলিয়মস’ লিখেছিলেন যে, কোলাঞ্চ ‘কলিঙ্গের’ একটি নাম। সম্ভবতঃ তাঁরাও ‘কোলাঞ্চ’ ও ‘কোলাঞ্চল’ বা ‘কোলাচল’কে এক মনে করে ঐ ধরণের কথা লিখেছিলেন। যদি ধরে নেওয়া যায় যে, কোলাঞ্চ কলিঙ্গের অন্য নাম, তাহলেও স্বীকার করতে হয় যে, কলিঙ্গ সুপ্রসিদ্ধ এবং কোলাঞ্চ অপ্রসিদ্ধ নাম। ব্রাহ্মণরা তাঁদের অতীতের ‘কুলস্থান’ নির্দেশ করতে গিয়ে, কেন যে সর্বজনবিদিত ‘কলিঙ্গ’ নাম ছেড়ে, অপরিচিত কোলাঞ্চ নামই বার বার উল্লেখ করেছিলেন, সেটার কোন প্রকৃষ্ট কারণ তো খুঁজে পাওয়া যায় না। কোলাঞ্চ কলিঙ্গ প্রদেশের কোন জায়গা বলে গ্রহণ করা চলে না। কেন না, প্রমাণাভাব। আর ‘আপ্তে’ কিংবা ‘মণিয়র উইলিয়মস’ও সেটা বলেননি। ‘মণিয়র উইলিয়মস’ প্রদত্ত দ্বিতীয় অর্থের মূলে যে বঙ্গের প্রচলিত প্রবাদ রয়েছে, সে বিষয়ে সন্দেহ করবার কোনও কারণ দেখা যায় না। তাহলে কোলাঞ্চ যদি কান্যকুব্জ কিংবা কলিঙ্গ না হয়, তাহলে সেটা কোথায় ছিল? ঐতিহাসিকেরা ‘কামরূপ’ ‘ধর্মপালের’ ‘শুভঙ্করপাটক তাম্রশাসনে’ পেয়েছিলেন – “গ্রামঃ ক্রোড়াঞ্চনামাস্তি শ্রাবস্ত্যাং যত্র যজুনাং। হোমধূমান্ধকারান্ধং নাবিশৎ কলিকল্মষং॥” অৰ্থাৎ, ‘শ্রাবস্তী’তে ‘ক্রোড়াঞ্চ’ নামের একটি গ্রাম আছে, যাতে কলির পাপ, যাজ্ঞিকগণের হোমধূমান্ধকার দ্বারা অন্ধ হয়ে প্রবেশ করতে পারেনি। এখন দেখা যাক যে, এই ‘শ্রাবস্তী’ কোথায় ছিল। ‘শ্রাবস্তী’ শুনলেই অনেকে ‘অযোধ্যা’ প্রদেশের প্রসিদ্ধনামা ‘শ্রাবস্তী’কে মনে করেন। এই আন্দাজ ঠিক নয়। প্রাচীনকালে ওই শ্রাবস্তী ছিল বৌদ্ধপ্রধান এবং বৌদ্ধ সাহিত্যেই সেটার বহুল উল্লেখ পাওয়া যায়। আর তাম্রশাসনে যে শ্রাবস্তীর কথা বলা হচ্ছে, সেটা ছিল ব্রাহ্মণ-প্রধান এবং ব্রাহ্মণদের কুলস্থান। তাম্রশাসনের শ্রাবস্তীর বর্ণনায় হোমধূমের প্রাচুর্য দেখতে পাওয়া যায়। সেটা নিশ্চয়ই বৌদ্ধপ্রাধান্যের পরিচয় দেয় না। ওই ‘ধর্মপালের’ প্রপিতামহ ‘ইন্দ্রপালের’ ‘গুয়াকুচি তাম্রশাসনে’ও ঐতিহাসিকেরা ‘শ্রাবস্তী’র (সাবথি) উল্লেখ পেয়েছিলেন। যথা – “সাবথ্যামক্তি বৈনামা গ্রামো ধাম দ্বিজন্মনাং। ধর্মস্যাধর্মভীতস্য দুর্গলভনিভঃ কলৌ॥” অর্থাৎ, ‘সাবথি’তে দ্বিজদের বাসভূমি ‘বৈ’ নামক একটি গ্রাম আছে – কলিকালে সেটা অধর্মভীত ধর্মের সমাশ্রিত দুর্গসদৃশ। ‘ইন্দ্রপাল’ ওই বৈগ্রামের ‘কাঘশাখী’, ‘যজুর্বেদী’, ‘কাশ্যপগোত্রজ’, সাক্ষাৎ ব্রহ্মার সদৃশ পুণ্যাত্মা, ‘সোমদেবের পৌত্র’, ‘বসুদেবের পুত্র’ শ্রীমান ‘দেবদেব’ নামের এক ব্রাহ্মণকে ভূমি দান করেছিলেন। সেখানেও ব্রাহ্মণ প্রাধান্য ও ব্রাহ্মণের কুলস্থানের বর্ণনা পাওয়া যায়। ঐতিহাসিকেরা ওই শ্রাবস্তীর উল্লেখ সপ্তম শতাব্দীর আগে পর্যন্ত কোথাও পাননি, আর বৌদ্ধদের শ্রাবস্তী বহু প্রাচীন। সুতরাং এই উভয় শ্রাবস্তী কখনই এক জায়গা হতে পারে না। এই ‘শ্রাবস্তী’ ও ‘সাবথি’ যে একই জায়গা, সেই সম্বন্ধে ঐতিহাসিকদের কোন সন্দেহ নেই, যদিও ‘পদ্মনাথ ভট্টাচার্য’ উভয়কে বিভিন্ন স্থান বলে প্রতিপন্ন করতে চেষ্টা করেছিলেন। তিনি ওই দুটো জায়গাকে ‘কামরূপের’ অন্তর্গত বলে যুক্তিতর্কের অবতারণা করেছিলেন। পরে বাধ্য হয়ে কেবলমাত্র শ্রাবস্তীকে কামরূপের প্রান্তে বঙ্গের মধ্যে বলে স্বীকার করে নিয়েছিলেন। তাঁর মতে ‘সাবথি’ ছিল আলাদা জায়গা এবং সেটার অবস্থান ছিল কামরূপে। যদিও ঐতিহাসিকেরা পরে দেখেছিলেন যে, উভয় জায়গাই এক এবং দুটোই উত্তরবঙ্গে অবস্থিত ছিল। আসলে তাম্রশাসনের ব্রাহ্মণ-প্রধান শ্রাবস্তীর অবস্থান ছিল প্রাচীন বঙ্গদেশের গৌড়ে। সেই শ্রাবস্তীর অন্তর্গত ‘তর্কারি’ নামের জায়গা – ব্রাহ্মণ ও কায়স্থদের কুলস্থান ছিল। ওই ‘তর্কারি’র বর্ণনাতেও ‘বেদস্মৃতি’র আলোচনা ও ‘হোমধূমের’ কথা পাওয়া যায়; যথা –
“যেষাং তস্য হিরণ্যগর্ভবপুযঃ স্বাঙ্গপ্রসূতাঙ্গিরোবংশে জন্ম সমানগোত্রবচনোৎকর্ষো ভরদ্বাজতঃ।
তেষামাৰ্য্যজনাভিপূজিতকুলং তর্কারিরিত্যাখ্যয়া শ্রাবস্তী প্রতিবদ্ধমক্তি বিদিতং স্থানং পুনর্জনানাং॥২
যস্মিন্ বেদস্মৃতিপরিচয়োদ্ভিন্নবৈতানগার্হ্যপ্রাজ্যাবৃত্তাহুতিযু চরতাং কীর্তিভির্বোন্নি শুভ্রে।
ব্যাভ্রাজত্তো পরিপরিসরস্হোমধূমা দ্বিজানাং দুগ্ধান্তোধিপ্রস্তবিলসচ্ছৈবালালীচয়াভাঃ॥৩
তৎপ্রসূতশ্চ পুণ্ড্রেষু সকটীব্যবধীনবান্।
বরেন্দ্রীমণ্ডনং গ্রামো বালগ্রাম ইতি শ্ৰুতঃ॥৪
ষট্‌ত্রিংশতঃ করণকর্মনিবাসপূতা আসন্ পুরঃ পরমসৌখ্যগুণাতিরিক্তাঃ।
তন্মধ্যগা বিবুধলোকমতা বরিষ্ঠা টক্কারিকা সমজনি স্পৃহণীয়কল্পা॥২॥
সর্বোপকারকরণৈকনিধেঃ স্বকীয়বংশস্য পাত্রসুভগস্য দ্বিজাশ্রয়স্য।
কল্পাবসানসময়স্থিতয়ে পুরীং যাং বাস্তঃ স্বয়ং সমধিগম্য সমাসসাদ॥৩॥
তস্যাং শ্রুতের্মিনদশঙ্খনিনাদিতায়াং বাস্তব্যবংশভবিনঙ্করণাস্ত আসন্।
আশাঃ সমস্তভুবনানি যদীয়কীর্তা পূর্ণানি হংসধবলানি বিশেষয়ন্ত্যা ॥৪॥”
এই বর্ণনা-সাদৃশ্য দেখে, কামরূপশাসনদ্বয়ে উল্লিখিত ‘শ্রাবস্তী’ এবং ‘সিলিমপুর-প্রশক্তি’র ‘শ্রাবস্তী’কে ঐতিহাসিকদের এক বলেই মনে হয়। শ্রাবস্তীর অন্তর্গত গ্রামগুলি থেকে ব্রাহ্মণ গমনের কথা, আরো কয়েকটি লিপিতে পাওয়া গিয়েছিল। এগুলো থেকে মনে হয় যে, প্রাচীন গৌড়ে শ্রাবস্তী নামের যে কেবলমাত্র একটি নগর ছিল, তা নয়; অতীতে ঐ নামে একটি দেশও ছিল। ‘অজয়গড় লিপি’তে দেখা যায় যে, ছত্রিশটি গ্রাম দ্বিজাশ্রয় কায়স্থদের বসে পবিত্র হয়েছিল। বলা বাহুল্য যে, ওই গ্রামগুলোতে কিন্তু ব্রাহ্মণরাও বাস করতেন। ‘প্রথম রণভঞ্জদেবের’ অষ্টপঞ্চাশতম বর্ষের বৌধলিপি – ‘সাবথি’র (শ্রাবস্তী) অন্তর্গত তকারিবিনির্গত ভরদ্বাজগোত্রীয় কাণ্বশাখাধ্যায়ী যজুর্বেদচরণ ‘শুভদাম’ নামক ব্রাহ্মণকে প্রদত্ত হয়েছিল। ‘গয়াড়তুঙ্গদেবের তালচরলিপি’ – বরেন্দ্রমণ্ডলে মুখরুথভট্টগ্রামরিনির্গত ওড্রবিষয়ে সাবিরভটগ্রামবাস্তব্য কাশ্যপগোত্র আবৎসার-নৈধ্রুবপ্রবর যজুর্বেদচরণকণ্বশাখাধ্যায়ী পদমপুত্র ‘দেবশর্মা’কে ও ‘সাবিথি’ (শ্রাবস্তী) বিনির্গত যমগর্ভমণ্ডলবাস্তব্য বৎসগোত্রপঞ্চার্ষেয়প্রবর যজুর্বেদচরণ কণ্বশাখাধ্যায়ী লম্বরসুত ‘বৃষ্টিদেব’ ও তাঁর পুত্র ‘রামদেব’কে প্রদত্ত হয়েছিল। ‘বিনীততুঙ্গদেবের তালচরলিপি’ – পুণ্ড্রবর্ধনবিনির্গত ও শ্রাবস্তীবনির্গত ব্রাহ্মণদেরকে প্রদত্ত হয়েছিল। ‘মহাশিবগুপ্ত যযাতির পাটনা-শাসন’ – শ্রাবস্তীমণ্ডলান্তর্গত কাশিলিবিনির্গত গৌতম (কৌথুম?) চরম কৌশিকগোত্রীয় ‘মহোদধি’ নামক ব্রাহ্মণকে প্রদত্ত হয়েছিল। ‘দ্বিতীয় মহাভবগুপ্তের কটকশাসন’ – শ্রাবস্তীমণ্ডলান্তর্গত কাশিল্লিগ্রামবিনির্গত সামবেদ কৌথুমচরণ কৌশিকগোত্র ‘রাণকরচ্ছো’কে ‘গৌড়সিমিনিল্লি’ নামক গ্রাম প্রদত্ত হয়েছিল। এই জায়গায় প্রদত্ত গ্রামের আগে ‘গৌড়’ বিশেষণ বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। ‘কুমারাধিরাজ সোমেশ্বরদেবের শোণপুর শাসন’ – সাবখি (শ্রাবস্তী) মণ্ডলান্তৰ্গত মহুবালিগ্রামবিনির্গত ভট্টপুত্র ‘উদয়কর শর্মা’কে প্রদত্ত হয়েছিল। ‘প্রতিহাররাজ মহেন্দ্রপালের ৯৫৫ সম্বতে প্রদত্ত দিঘোয়া-দুবৌলি শাসন’ – শ্রাবস্তী ভুক্তিতে শ্রাবস্তীমণ্ডলান্তঃপাতি বালয়িকবিষয়সম্বন্ধ পানীয়ক গ্রাম সাবর্ণগোত্রীয় কৌথুমশাখী ছান্দোগব্রহ্মচারী ‘পদ্মসার’কে প্রদত্ত হয়েছিল। ‘কীর্তিপালের লখনউ মিউজিয়াম-শাসন’ – শ্রাবস্তীবিষয়ান্তঃপাতি ডবিরামগ্রামকুলোৎপন্ন, – গৌতমগোত্রীয় পণ্ডিত শ্রীকেশবের পৌত্র, পণ্ডিত শ্রীবিশ্বরূপের পুত্র, ‘ঠক্কুর শ্রীপ্রহসিতশর্মা’ নামক ব্রাহ্মণকে প্রদত্ত হয়েছিল। ‘কান্যকুজের মহারাজপুত্র গোবিন্দ্রচন্দ্রদেবের ১১৬২ সম্বতে (১১০৫ খ্রিঃ) প্রদত্ত শাসন’ – সাবিথদেশবিনির্গত বাজসনেয়শাখী বংধুল গোত্র বধুল অঘমর্ষণ বিশ্বামিত্র ত্রিপ্রবর দীক্ষিত নাগানদ (নন্দ?) পৌত্র, দীক্ষিত পুরবাসপুত্র যজুর্বেদবিদ্যানলিনীবিকাসন প্রত্যক্ষ ‘ভাস্কর দীক্ষিত বীহলক’কে প্রদত্ত হয়েছিল। ‘মহারাজ হর্ষবর্ধনের মধুবন-শাসন’ – শ্রাবস্তীভুক্তিতে কুণ্ডধানীবিষয়ান্তঃপাতি সোম কুণ্ডিকা গ্রাম, সাবর্ণিগোত্র চ্ছন্দোগব্রহ্মচারী ভট্টবাতস্বামী ও বিষ্ণুবৃদ্ধগোত্র বহবব্রহ্মচারী ‘শিবদেব স্বামী’কে প্রদত্ত হয়েছিল। এখানে উল্লেখিত লিপিগুলোতে ‘কোলাঞ্চ’ ছাড়া শ্রাবস্তীর অন্তর্গত আরও কতগুলি গ্রামের উল্লেখ পাওয়া যাচ্ছে। এবারে দেখা যাক, বঙ্গদেশে এই সব গ্রামের সন্ধান পাওয়া যায় কি না।
(১) ‘ক্রোড়ঞ্চি’, ‘ক্রোড়াঞ্জ’ ও ‘কোলাঞ্চ’: এই তিনটিই যে এক গ্রাম, সেটা আগেই বলা হয়েছে। অধুনা বাংলাদেশের ‘বগুড়া’ জেলার ‘পোলাদশী পরগণা’র ‘পাঁচবিবি থানা’র অন্তর্গত ‘কুলাচ’ নামের একটা গ্রাম আছে। অতীতের কোলাঞ্চই সম্ভবত ‘কুলাচে’ পরিণত হয়েছে। ব্রিটিশ শাসনাধীন অবিভক্ত ভারতের মানচিত্রে ওই গ্রামের নাম ‘Koolarch’ বলে লেখা হয়েছিল। পরে ওই গ্রামটি ‘কুলচ’ নাম ধারণ করেছিল। সম্ভবতঃ অর্থযুক্ত শুদ্ধ ভাষায় ‘কুলাচ’, ‘কুলর্চে’ পরিণত হয়েছিল। ‘কুলৰ্চ’ অর্থাৎ ‘পূজনীয়কুল’। যদিও এই পরিবর্তনের মূলেও কোন প্রকার প্রবাদ আছে কি না, সেটা অনুসন্ধানযোগ্য। কোলাঞ্চ প্রধানতঃ ‘শাণ্ডিল্য গোত্রের’ কুলস্থান। উল্লেখ্য, ঐতিহাসিক ‘প্রভাসচন্দ্র সেন’ একটি পত্রে ‘নগেন্দ্রনাথ বসু’কে জানিয়েছিলেন যে, “এই গ্রামকে সাধারণ লোকে ‘কুলোচ’ বলে। বর্তমান সময়ে এই গ্রামে মুসলমানের বাস। তবে এখানে ‘কালীর থান’ আছে। ঐ গ্রামে প্রাচীন চিহ্ন বিশেষ কিছুই নাই। পার্শ্ববর্তী বায়ারী গ্রামে প্রাচীন দিঘি ও ভগ্ন প্রস্তরমূর্তি আছে। যাহা হউক, কুলোচে যে হিন্দুর বাসস্থান ছিল, তাহার সাক্ষী ‘কালীর থান’। যাহা হউক, কুলোচে বর্তমান সময়ে প্রাচীনত্বের কোন নিদর্শন না পাইলেই যে ইহকে আধুনিক স্থান মনে করিতে হইবে, তাহার কোন কারণ নাই। শুনিতে পাই, বর্তমান সিলিমপুর গ্রামে প্রাচীন প্রস্তরলিপি এবং প্রস্তরনির্মিত বরাহমূর্তি পাওয়া গেলেও ঐ স্থান দেখিয়া উহাকে প্রাচীন গ্রাম বলিয়া মনে হয় না। প্রাচীন স্তূপ ইত্যাদি কৃষকগণ সমভূমিতে পরিণত করিয়া তথায় চাষ করিতেছে।”
(২) ‘তর্কারি’: এই গ্রামের অবস্থান সম্বন্ধে আজও কিছু জানা যায় না। ‘সিলিমপুর-প্রশস্তি’ লিখিত ওই গ্রামের কাছাকাছি অন্য দুটি গ্রামের (বালগ্রাম ও সিয়াম্বর) যখন সন্ধান পাওয়া যায়, তখন নিশ্চয়ই ‘তর্কারি’ – সিলিমপুরের কাছেই কোন জায়গায় ছিল। ‘বগুড়া’ জেলার থানা ‘আদমদিঘি’, ডাকঘর ‘সুলতানপুরের’ অন্তর্গত ‘টিকারি’ নামের একটা গ্রাম আছে, কিন্তু সেটাকে পৃথক গ্রাম বলেই গবেষকরা মনে করেন। ‘তর্কারি’ প্রধানতঃ ‘ভরদ্বাজ গোত্রের’ কুলস্থান।
(৩) ‘বৈগ্রাম’: বাংলাদেশের ‘দিনাজপুর’ জেলার ‘নবাবগঞ্জ’ থানায় ‘বৈগ্রাম’ নামে একটি গ্রাম আছে। সেটা ‘হিলি’ রেলওয়ে স্টেশনের খুব কাছে অবস্থিত। অতীতে, বৈগ্রাম থেকে গুপ্তযুগের একটা তাম্রশাসন আবিষ্কৃত হয়েছিল। গবেষকরা মনে করেন যে, দামোদরপুরে প্রাপ্ত তাম্রশাসনপঞ্চকের তৃতীয়সংখ্যক শাসনটিতে যে ‘বায়ীগ্রামের’ উল্লেখ পাওয়া যায়, সেটা ও এই ‘বৈগ্রাম’ অভিন্ন।
(৪) ‘কাশিলি’ ও ‘কাশিল্লি’: গবেষকরা এই দুটো গ্রামকে অভিন্ন বলে মনে করেন। ‘বগুড়া’ জেলার ‘পাঁচবিবি’ থানায় ‘কুশইল’ (Kushaila) নামের একটি গ্রাম আছে।
(৫) ‘মহুবালি’ গ্রাম: ‘বগুড়া’ জেলার ‘খেতলাল’ থানায় ‘মোয়াইল’ নামের একটা গ্রাম আছে। বারেন্দ্র ব্রাহ্মণদের ‘কাশ্যপ’ গোত্রের ‘মোয়ালি গাঞি’ সম্ভবতঃ ওই ‘মহুবালি’ গ্রাম থেকে উৎপন্ন হয়েছিল। কোন কোন প্রাচীন পুঁথিতে ‘মৌহালী’ নামও পাওয়া যায়।
(৬) ‘বালগ্রাম’: সিলিমপুর প্রশস্তিতে বালগ্রামের উল্লেখ পাওয়া যায়। ‘সিলিমপুরের’ কাছে ‘খেতলাল’ থানায় ‘বলিগ্রাম’ নামের একটা গ্রাম আছে। গবেষকদের মতে ওই ‘বলিগ্রাম’ বা ‘বেলগাঁও’ এবং ‘বালগ্রাম’ অভিন্ন।
(৭) ‘শিয়ম্বগ্রাম’: সিলিমপুর প্রশস্তিতে এই গ্রামের উল্লেখ পাওয়া যায়। ‘শিম্ব’ বা ‘শিম্বি’ – ‘ভরদ্বাজগোত্রীয়’ বারেন্দ্র ব্রাহ্মণদের একটি গাঞি। সিলিমপুরলিপি ভরদ্বাজগোত্রেীর ‘প্রহাস’ নামক এক ব্রাহ্মণের কুলপ্রশস্তি। ওই প্রহাসের বাড়ি ছিল শিয়ম্ব গ্রামে। গবেষকদের মতে, বর্তমান সিলিমপুরই প্রাচীন ‘শিয়ম্ব’ এবং ওই জায়গা থেকেই শিম্ব গাঞির উৎপত্তি ঘটেছিল।
(৮) ‘কুটুম্বপল্লী’: সিলিমপুর প্রশস্তিতে এই গ্রামেরও উল্লেখ পাওয়া যায়। ‘কুড়ুম্ব’ বা ‘কুড়মুড়ি’ – বারেন্দ্র ব্রাহ্মণদের ‘বাৎস্য’ গোত্রের একটি গাঞি এবং সেটার উৎপত্তি ঘটেছিল ওই ‘কুটুম্বপল্লী’ থেকে।
(৯) ‘বালয়িক বিষয়’: ‘রাজশাহী’ জেলার ‘বাগমারা’ ও ‘বরইগ্রাম’ থানায় ‘বালিয়া’ গ্রাম এবং ‘মান্দা’ থানায় মালসেরা
ডাকঘরের অধীন ‘বালিচ’ নামের গ্রাম আছে।
(১১) ‘পানীয়ক গ্রাম’: ‘রাজশাহী’ জেলার ‘বাগমারা’ ও ‘সিংরা’ থানায় ‘পানিয়া’ গ্রাম এবং ‘মান্দা’ থানায় ‘মালসেরা’ ডাকঘরের অধীনে ‘পানিয়াল’ গ্রাম আছে। ‘প্রতীহাররাজ মহেন্দ্রপালের দিঘোয়া-দুবৌলি শাসনে’ উপরোক্ত ‘বালয়িক বিষয়ান্তঃপাতি’ পানীয়ক গ্রামে এক ব্রাহ্মণকে জমি দান করা হয়েছিল। ওই শাসনটি ‘বিহারের’ ‘সারণ’ জেলার ‘দিঘোয়া-দুবৌলি’ গ্রামের এক ব্রাহ্মণের কাছ থেকে পাওয়া গিয়েছিল। আশ্চর্যের বিষয় হল, ‘রাজশাহী’ জেলার ‘চারঘাট’, ‘নগাঁও’ ও ‘পাঁচপুর’ থানায় ‘Atrai’ ডাকঘরের অধীনে ‘দীঘা’ গ্রাম, আবার ঐ ‘পাঁচপুর’ থানায় ঐ ডাকঘরের অধীনে এবং ‘মান্দা’ থানায় ‘মালসেরা’ ডাকঘরের অধীনে ‘দুবৈল’ নামের গ্রাম আছে। সম্ভবতঃ ওই দুই গ্রাম থেকে ব্রাহ্মণরা ‘সারণ’ জেলায় গিয়েছিলেন এবং ‘দিঘোয়া-দুবৌলি’ গ্রামটি স্থাপন করেছিলেন। তাঁদেরই পূর্বপুরুষরা ‘মহেন্দ্র পালের’ কাছ থেকে ‘পানীয়ক’ গ্রামটি লাভ করেছিলেন।
(১২) ‘ডবিরামকুল’: বগুড়া জেলার ‘আদমদিঘি’ থানায় ‘Darakul’ নামের একটি গ্রাম আছে। ‘কীর্তিপালের’ শাসনোক্ত ওই ‘ডবিরামকুল’ গ্রামোপন্ন ব্রাহ্মণের নাম ছিল – ‘ঠক্কুর প্রহসিতশর্মা’। বগুড়া খেতলাল থানার ‘মাথরাই’ বা ‘মাত্রাই’ গ্রামে ‘প্রহসিতশর্মা’ নামাঙ্কিত একটি ভগ্ন স্তম্ভলিপি পাওয়া গিয়েছিল।
(১৩) ‘কুণ্ডধানী বিষয়’: এর অবস্থান সম্বন্ধে কোন তথ্য পাওয়া যায়নি।
(১৪) ‘সোমকুণ্ডিকা’: রাজশাহী জেলার ‘বোয়ালিয়া’ থানায় ‘সোমইকুণ্ডি’ (Shomaikundi) নামের একটি গ্রাম আছে। ‘নগেন্দ্রনাথ বসু লিখেছিলেন, “রাজশাহী গিয়া সোমাইকুণ্ডি গ্রাম সম্বন্ধে অনুসন্ধান করিয়াছিলাম। ঐ জেলায় ‘কুণ্ডি’ বা ‘কুঁড়ি’ নামান্ত কয়েকটি গ্রাম থাকিলেও সোমাইকুণ্ডি গ্রামের সন্ধান পাওয়া গেল না। তবে শহরের নিকটে ‘সোনাইকান্দি’ নামে গ্রাম আছে।”
প্রাচীন গ্রন্থের স্থান নির্দেশ ঠিক হলে প্রমাণ হয় যে, হর্ষবর্ধনের সাম্রাজ্য ৬৩১ খ্রিস্টাব্দে গৌড় পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। ‘ভাস্করবর্মা’র ‘নিধনপুর তাম্রশাসন’ ‘কর্ণসুবর্ণ’ থেকে প্রদত্ত হয়েছিল। কেউ কেউ তা থেকে অনুমান করেন যে, শশাঙ্কের গৌড়রাজ্য হর্ষের জীবিতকালেই ভাস্করবর্মার হস্তগত হয়েছিল। কিন্তু কয়েকটি কারণে ঐতিহাসিকেরা এই মত গ্রহণ করতে পারেন না। শশাঙ্ক ছিলেন হর্ষের ‘ভ্রাতৃহন্তা’ ও প্রবলপরাক্রান্ত প্রতিদ্বন্দ্বী। যে রাজ্যবলে বলীয়ান হয়ে শশাঙ্ক ভারতের সার্বভৌম নরপতি হবার স্পর্ধা করেছিলেন, হর্ষ বহু কষ্টে সেই রাজ্য জয় করে তাঁহার ‘মিত্ররাজ’ ভাস্করবর্মাকে ছেড়ে দেবেন এবং সেটা করে তাঁকে নিজের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিরূপে পরিণত করবেন, এটা কখনই বিশ্বাসযোগ্য নয়। হর্ষবর্ধনের মত রাজনীতিবিশারদের এই ধরণের একটা প্রকাণ্ড ভুল করা সম্ভবপর ছিল না। জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা ‘রাজ্যবর্ধনের’ মৃত্যুসংবাদ শুনে মর্মাহত হয়ে হর্ষ প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে, তিনি পৃথিবীকে ‘নিগৌড়’ (গৌড় বিহীন) করবেন। তিনি সেই প্রতিজ্ঞা পালনকল্পে কি করেছিলেন, সেটা কেউই বলেন নি। তবে তিনি যে সেটা বৃথা গর্বোক্তিতে পর্যবসিত হতে দিয়েছিলেন, এই ধরণের কিছু মনে করবার কোন কারণ দেখা যায় না। গৌড় জয় দিয়েই ‘পৃথিবী নিগৌড়’ হয়ে যায় না। সম্ভবতঃ তিনি গৌড় জয় করে নিজের সাম্রাজ্যভুক্ত করেছিলেন এবং গৌড় নামটা লোপ করে দিয়ে, অন্য কোন নামকরণ করেছিলেন। সম্ভবতঃ তিনি গৌড়রাজ্যকে তাঁহর রাজ্যের পূর্বসীমান্তস্থিত ‘শ্রাবস্তীভুক্তি’র অন্তর্ভুক্ত করে দিয়ে গৌড় নামটা লোপ করে দিয়েছিলেন। হর্ষের ‘বাঁশখেরা শাসন’, ‘বর্ধমানকোটি’ থেকে প্রদত্ত হয়েছিল। এই ‘বর্ধমানকোটি’র অবস্থান কেউ নির্ণয় করেননি। বাংলাদেশের ‘রঙ্গপুর’ জেলায় ‘বর্ধনকোটি’ নামের একটি প্রাচীন জায়গা আছে। কিছু গবেষকের মতে সেই উভয় জায়গা এক হতে পারে। সপ্তম শতাব্দীর আগে বঙ্গের শ্রাবস্তীর উল্লেখ আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। হর্ষ যে শশাঙ্কের রাজ্য নিজের সাম্রাজ্যভুক্ত করেছিলেন, সেটার আরও প্রমাণ এই যে, তিনি ৬৪১ সালে চীনসম্রাটের কাছে যে বার্তা প্রেরণ করেছিলেন, তাতে তিনি নিজেকে ‘মগধেশ্বর’ বলে উল্লেখ করেছিলেন। তার আগে ‘মগধ’ যে শশাঙ্কের রাজ্যভুক্ত ছিল, সে বিষয়ে ঐতিহাসিকদের কোন সন্দেহ নেই। ‘রোটাসগড়ে’ প্রাপ্ত শশাঙ্কদেবের নামাঙ্কিত শীল এবং ‘বুদ্ধগয়া’য় তাঁর অবাধ অত্যাচারই সেটা প্রমাণ করে। তাহলে গবেষকদের উপরিউক্ত অনুমান যদি ঠিক হয়, তবে ‘কোলাঞ্চ’ কান্যকুব্জরাজ্যের তথা শ্রাবস্তীর অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়েছিল। সেক্ষেত্রে ব্রাহ্মণদের কান্যকুব্জ থেকে বঙ্গদেশে আগমনের ভিত্তি বোধ হয় এখানে। পালরাজারা পুনরায় ‘গৌড়’ নাম প্রবর্তন করেছিলেন। কিন্তু ‘প্রতীহাররাজ মহেন্দ্রপালের দিঘোয়া-দুবৌলি তাম্রশাসনে’ আবার ‘শ্রাবস্তীভুক্তি’ ও ‘শ্রাবস্তীমণ্ডলের’ উল্লেখ পাওয়া যায় এবং সেই শ্রাবস্তীমণ্ডলস্থ ‘পানীয়ক’ গ্রামের সন্ধানও ‘গৌড়মণ্ডলে’ই পাওয়া যায়। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, মহেন্দ্রপালের পুত্র ‘বিনায়কপালের’ ৯৩১ সালে প্রদত্ত শাসনোল্লিখিত জায়গাগুলিও গৌড়মণ্ডলেই পাওয়া যায়। ওই শাসন দ্বারা ‘প্রতিষ্ঠানভুক্তন্তঃপাতি বারাণসী বিষয়সম্বন্ধ-কাশীপার-পথক-প্রতিবদ্ধ টিক্করিকা গ্রাম’ দান করা হয়েছিল। ওই তাম্ৰশাসনটি ‘Bengal Asiatic Society’s Plate’ নামে পরিচিত। কিন্তু সেটি কোথা থেকে পাওয়া গিয়েছিল, সেটা জানা যায় না। ‘ক্লিট’ সাহেব ওই ‘টিক্করিকা’ ও ‘কাশী’র চার মাইল দক্ষিণে অবস্থিত বর্তমান ‘টিক্রি গ্রাম’কে একই বলে মনে করেছিলেন। কিন্তু ঐতিহাসিকেরা, ‘বগুড়া’ জেলার ‘পাঁচবিবি’ থানায় ‘বারাণসী’, এবং ঐ জেলার ‘আদমদিঘি’ থানায় ‘সুলতানপুর’ ডাকঘরের অধীনে ‘কাশীপাড়া’ (Kashipara) ও ‘টিকারী’ গ্রামের সন্ধান পেয়েছিলেন। ঐতিহাসিকদের এই অবস্থান নির্দেশ যদি ঠিক হয়, তবে দশম শতাব্দীর মধ্যভাগেও গৌড় প্রতীহারসাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। উপরে ব্রাহ্মণ-সম্বন্ধীয় যতগুলি শ্রাবস্তী পাওয়া গেছে, সেগুলোর কোনটি ‘ভুক্তি’, কোনটি ‘মণ্ডল’, কোনটি ‘বিষয়’, কোনটি ‘দেশ’ এবং কোনটি শুধুই ‘শ্রাবস্তী’। স্পষ্টভাবে শ্রাবস্তী নামের কোন নগরীর উল্লেখ ইতিহাসের কোথাও পাওয়া যায় না। শুধু শ্রাবস্তী, জনপদ কিংবা নগরী, এই উভয়ের কোন একটা হতে পারে। ওই ‘ব্রাহ্মণ-শ্রাবস্তী’ যে অতীতের বঙ্গদেশেই অবস্থিত ছিল, সেটা ‘বালগ্রাম’ (বালিগ্রাম), ‘শিয়ম্ব’ (শিলিমপুর), ‘মহুবালি’ (মোয়াইল), ‘বৈগ্রাম’, ‘কোলঞ্চ’ (কুলাচ বা কালঞ্জ) গ্রামগুলির অবস্থান দ্বারাই প্রতিপন্ন হয়। সেই শ্রাবস্তী ছিল একটি জনপদ, যেটা বর্তমান বাংলাদেশের ‘দিনাজপুর’ ও ‘বগুড়া’ জেলা ব্যাপী ছিল, সেটা কিন্তু স্পষ্টই বোঝা যায়। ‘কূর্মপুরাণ’-এ স্পষ্টই লেখা হয়েছে যে – শ্রাবস্তী, গৌড়দেশে শ্রাবস্তী নামের একটা ‘মহাপুরী’ নির্মাণ করেছিলেন –
“তস্য পুত্রোভবদ্বীরঃ শ্রাবস্তিরিতি বিশ্রুতঃ।
নির্মিতা যেন শ্রাবস্তী গৌড়দেশে মহাপুরী॥”
আজ পর্যন্ত ঐতিহাসিকেরা উত্তরবঙ্গে শ্রাবস্তী কিংবা সেটার সদৃশ নামযুক্ত কোন জায়গার সন্ধান করতে পারেননি। অন্য পক্ষে মধ্যদেশের ‘শ্রাবস্তী’ নগরী বলেই ইতিহাসে প্রসিদ্ধ। সেখানে শ্রাবস্তী নামের কোন প্রদেশের উল্লেখ ইতিহাসে পাওয়া যায় না। সুতরাং পুরাণোল্লিখিত গৌড়দেশ ‘মধ্যদেশেই’ ছিল বলে মনে হতে পারে। কিন্তু বর্তমানে বঙ্গদেশে শ্রাবস্তী নামের কোন নগরীর সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না বলেই যে সেটা কোন কালে ছিল না, এই ধরণের কোন সিদ্ধান্ত করা সমীচীন নয়। ‘সিলিমপুর লিপি’তে লেখা হয়েছিল যে, শ্রাবস্তী প্রতিবদ্ধ ‘তর্কারি’ ও ‘বালগ্রামের’ মধ্যে ‘শকটিগ্রাম’ অবস্থিত ছিল এবং সেটার কাছেই ‘শিয়ম্বগ্রাম’ ছিল। ওই লিপিতে আরও লেখা হয়েছিল যে, ‘বালগ্রাম’ বরেন্দ্র ব্রাহ্মণদের বাসস্থান ছিল। গবেষকরা বলেন যে – ‘শকটি’, ‘বালগ্রাম’ ও ‘শিয়ম্ব’ – বারেন্দ্র ব্রাহ্মণের ভরদ্বাজ গোত্রীয়দের গাঞি নাম। সুতরাং এর দ্বারাও প্রমাণিত হয় যে, ঐ গ্রামগুলি বরেন্দ্রে অবস্থিত ছিল। কিন্তু ‘বালগ্রাম’ ও ‘শিয়ম্বের’ সন্ধান পাওয়া গেলেও ‘তর্কারি’ কিংবা ‘শকটি’ গ্রামের কোন সন্ধান পাওয়া যায় না। এই প্রমাণে কি বলা যেতে পারে যে, ‘তর্কারি’ এবং ‘শকটি’ নামের কোন গ্রাম বরেন্দ্রে ছিল না? ‘শকটি’ ও ‘বালগ্রাম’ যখন ‘বরেন্দ্রদেশের’ অন্তর্গত ছিল, তখন সেগুলোর খুব কাছের গ্রাম ‘তর্কারি’ যে অন্য একটি বিভিন্ন প্রদেশের অর্থাৎ শ্রাবস্তী দেশের অন্তর্গত ছিল, এই ধরণের কিছু মনে করা ঠিক নয়। ‘শ্রাবস্তী-প্রতিবদ্ধ তর্কারি’ বলতে বোধ হয়, ‘শ্রাবস্তী নগরী-প্রতিবদ্ধ’ মনে করাই যুক্তিসিদ্ধ হবে। সুতরাং এই শ্রাবস্তী নগরী বগুড়া জেলার সিলিমপুরের কাছেই ছিল বলে মনে হয়। পরবর্তীকালে হয়ত সেটার নামের পরিবর্তন ঘটেছিল।

কোলাঞ্চ কি ভাবে পরবর্তীকালে কান্যকুব্জে পরিণত হয়ে গিয়েছিল, এর কোন সন্তোষজনক কারণ ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যায় না। উপরে একটা অনুমান করা হয়েছে মাত্র, কিন্তু সেটাকে খুব সন্তোষজনক হয়ত বলা চলে না। এই বিষয়ে ঐতিহাসিকদেরআরেকটি অনুমানের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। আসামের ইতিহাসে দেখা যায় যে, ত্রয়োদশ কিংবা চতুর্দশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে ‘কামতারাজ’ ‘দুর্লভনারায়ণের’ নিমন্ত্রণে ‘গৌড়ের’ ‘কনৌজ নগর’ থেকে ‘সপ্ত ব্রাহ্মণ’ এবং ‘সপ্ত কায়স্থ’, কামতার রাজধানী ‘কামতাপুরে’ গমন করেছিলেন। সেই কায়স্থরাই ছিলেন আসামের ‘আদি বারভূঁইয়া বংশের’ মূল। ওই কামতা রাজ্য কামরূপের পশ্চিমে ‘করতোয়া’ থেকে ‘বরনদী’ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। বর্তমান ‘রঙ্গপুর’ এবং ‘কোচবিহার’ ছিল ওই কামতা রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত। কামতাপুরের ধ্বংসাবশেষ, কোচবিহার রাজ্যের ‘দিনহাটা’য় আজও বর্তমান। অনেক গবেষক মনে করেন যে, একাদশ শতাব্দীর পরে এবং চতুর্দশ শতাব্দীর আগে, শ্রাবস্তী দেশ ‘কনৌজ’ এবং শ্রাবস্তী নগরী ‘কনৌজ নগর’ নাম ধারণ করেছিল। সেই কারণেই কোলাঞ্চাগত ব্রাহ্মণরা পরবর্তীকালে ‘কনৌজাগত’ বলে পরিচিত হয়েছিলেন। সেই কনৌজ নগর থেকে যখন আসামে ব্রাহ্মণ ও কায়স্থ গমনের প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে, তখন সেই কনৌজরাজ্য থেকে গৌড়ে ব্রাহ্মণ ও কায়স্থ গমনের প্রবাদও অসম্ভব বলে মনে হয় না। সম্ভবতঃ ঐ সময়ে – কনৌজ ও গৌড় – দুটো ক্ষুদ্র ও ভিন্ন রাজ্য ছিল, তাই কোলাঞ্চ থেকে গৌড়ে গমনের কথা ব্রাহ্মণদের কুলজী গ্রন্থগুলোতে দেখতে পাওয়া যায়। সম্ভবতঃ চতুর্দশ শতাব্দীতে কনৌজ নগর গৌড়রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। ঐতিহাসিকেরা ভারতের নানা প্রদেশ থেকে বিভিন্ন প্রদেশে ব্রাহ্মণ গমনের কথা প্রাচীন লিপিতে দেখতে পেয়েছেন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল, আজ পর্যন্ত কান্যকুব্জ থেকে ব্রাহ্মণ গমনের কথা কোন প্রাচীন লিপিতে ঐতিহাসিকদের চোখে পড়েনি। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, গৌড় রাজ্যে – ‘গৌড়’, ‘শ্রাবস্তী’, ‘কৌশাম্বী’, ‘বারাণসী’, ‘কনৌজ’ ইত্যাদি নামের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্য এবং নগর এক সময়ে বর্তমান ছিল। সুতরাং এই সব নাম প্রাচীন লিপি ও গ্রন্থে পেলেই সেগুলোকে খুঁজতে যে ভারতের উত্তর-পশ্চিম প্রদেশে যেতে হবে – এই মতবাদ ও চিন্তাভাবনা ভুল। ইতিহাস বলে যে, গৌড়ে বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণের কোন সময়েই অভাব হয়নি। দেশে যখন বৌদ্ধ পালরাজারা রাজত্ব করছিলেন, তখনও দেখা যায় যে, এই শ্রাবস্তীর ব্রাহ্মণ ও কায়স্থরা ‘বৈদিকাচারী’ ছিলেন। নবম শতাব্দী থেকে বহু ব্রাহ্মণ যে, ওই গৌড় থেকেই ভারতের অন্যান্য প্রদেশে সসম্মানে উপনিবিষ্ট হয়েছিলেন, সেটারও প্রমাণ ইতিহাসে পাওয়া যায়। তাই শেষে, নিশ্চিন্তে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় যে, বঙ্গীয় ব্রাহ্মণদের রাঢ়ী ও বারেন্দ্র পূর্বপুরুষরা ওই গৌড়মণ্ডলেরই অধিবাসী ছিলেন। তাঁরা অন্য দেশ থেকে বঙ্গদেশে এসে উপস্থিত হননি। পরিশেষে, ‘নগেন্দ্রনাথ বসু’ প্রদত্ত একটি আশ্চর্যজনক তথ্য দিয়ে প্রসঙ্গে ইতি টানা যাক। ‘বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস’ গ্রন্থের এক জায়গায় ‘ফুটনোটে’ তিনি লিখেছিলেন – “আশ্চর্যের বিষয় এই যে, রাজশাহী জেলার নওগাঁ থানায় কনৌজ এবং চারঘাট থানায় কনৌজগরি নামক গ্রাম পাইতেছি (Village Directory of Rajshahi District)।”

(তথ্যসূত্র:
১- বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস, নগেন্দ্রনাথ বসু।
২- সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকা, দ্বিতীয় সংখ্যা, ১৩৪১ বঙ্গাব্দ।
৩- গৌড়ে ব্রাহ্মণ, মহিমাচন্দ্র মজুমদার।
৪- ব্রাহ্মণ সমাজ (মাসিকপত্র), দশম বর্ষ, অষ্টম সংখ্যা, বৈশাখ, ১৩২৯ বঙ্গাব্দ।
৫- জাতি তত্ত্ব বারিধি (ভাগ-২), উমেশচন্দ্র গুপ্ত।
৬- রাজসাহীর ইতিহাস, কমল চৌধুরী।)

বৌদ্ধ ভারতে নারী শিক্ষা

রানা চক্রবর্তীঃ বৌদ্ধযুগের ভারতে যেসব নারী বৌদ্ধধর্মের বৃত্তের বাইরে ছিলেন, তাঁদের শিক্ষা সম্বন্ধে প্রাচীন বৌদ্ধগ্রন্থগুলি থেকে কোন তথ্য পাওয়া যায় না। তবে তখন যেসব নারী বৌদ্ধধর্মের দ্বারা প্রভাবান্বিতা হয়েছিলেন, তাঁদের সম্বন্ধে প্রাচীন বৌদ্ধগ্রন্থগুলিতে যে বিবরণ পাওয়া যায়, সেটা থেকে মনে হয় যে, তাঁরা ধর্মোপদেশ বেশ ভালোই বুঝতে পারতেন; অর্থাৎ, তাঁরা একেবারে অশিক্ষিতা ছিলেন না। প্রকৃতপক্ষে বৌদ্ধযুগের অনেক নারীই শিক্ষা-দীক্ষায় পুরুষদের সমকক্ষ ছিলেন। তখন কোন অবিবাহিতা বালিকাকে কোন বিদ্যালয়ে পাঠিয়ে শিক্ষা দেওয়া হত, কিংবা গৃহেই তাঁর শিক্ষার ব্যবস্থা করা হত – সেই ধরণের কোন কথার ইঙ্গিত অবশ্য প্রাচীন বৌদ্ধ-সাহিত্যে পাওয়া যায় না; কিন্তু সেগুলিতে তখনকার শিক্ষিতা নারীদের উল্লেখ প্রচুর পরিমাণেই পাওয়া যায়। পালিধর্ম গ্রন্থ সমূহের মতে ‘থেরীগাথা’র শ্লোকগুলি ঋষিকল্পা নারীদের দ্বারা রচিত হয়েছিল। বৌদ্ধযুগের নারীদের প্রতিভার প্রমাণ-স্বরূপ ‘সুক্কা’র ধর্মবক্তৃতা, এবং ‘ক্ষেমা’ ও ‘ধম্মদিন্না’র দার্শনিক আলোচনা প্রভৃতির উল্লেখ করা যেতে পারে। সুতরাং সে যুগের নারীদের জন্য কোন ধরণের শিক্ষার ব্যবস্থা যে একেবারেই ছিল না, একথা বললে বৌদ্ধ-সাহিত্যে যেসব ঐতিহাসিক সত্যি রয়েছে, সেগুলোকে উপেক্ষা করা হয়। প্রাচীন ভারতে পাণ্ডিত্যের জন্য যেসব বৌদ্ধ নারী খ্যাতি লাভ করেছিলেন তাঁদের দু’-চার জনের নাম এখনও অন্ততঃ বহু ভারতবাসীর স্মৃতিতে জেগে রয়েছে। তখন যাঁরা থেরীগাথা গান করতেন, তাঁরাই যে সেই গাথাগুলি রচনা করেছিলেন, সেই বিষয়ে অবশ্য ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতদ্বৈধ দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু, এই বিষয়ে বিরুদ্ধ-মতাবলম্বীদের যুক্তি অতি সামান্য ভিত্তির উপরে প্রতিষ্ঠিত। যত দিন পর্যন্ত না তাঁদের মধ্যে কেউ, এই বিষয়ে কোন ঐতিহাসিক প্রমাণ দেখাতে পারছেন, ততদিন তাঁদের কথা বিশ্বাস করবার কোনও সার্থকতা অন্ততঃ দেখতে পাওয়া যায় না। বস্তুতঃ এটাই যুক্তি সঙ্গত বলে মনে হয় যে, বুদ্ধের সময়ে যাঁরা সাংসারিক জীবন পরিহার করে অতীন্দ্রিয় আনন্দের রসাস্বাদনে সমর্থ হয়েছিলেন, বহু সময়ে বিশেষভাবে তাঁরা যখন সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও ইন্দ্রিয়-লালসার লোভ বা নানাবিধ বিভীষিকা দ্বারা বিপথগামী হতেন, তখন তাঁরাই মুখে মুখে পাণ্ডিত্যপূর্ণ ভাবময় শ্লোকগুলি রচনা করিয়া গান করতেন। তাঁদের রচিত সেই গাথাগুলি যে নারীদের দ্বারাই গাওয়া হত, সেকথা নিঃসংশয়ে বলা যেতে পারে। তাছাড়া, তখন যে সমস্ত নারী শিক্ষাদানের ব্রত গ্রহণ করেছিলেন, তাঁদের কয়েক জনের বিবরণও প্রাচীন বৌদ্ধগ্রন্থগুলি থেকে পাওয়া যায়। বুদ্ধের সময়ে ভারতে বৌদ্ধধর্মালম্বী নারীদের মধ্যে শিক্ষার ব্যবস্থা যে প্রচলিত ছিল, সেটা এই দৃষ্টান্তগুলি থেকে বুঝতে পারা যায়।


সেযুগে ভালো বক্তৃতা করতে পারতেন এমন একজন নারীর উল্লেখ ‘সংযুক্তনিকায়’ গ্রন্থে পাওয়া যায়। ‘সুক্কা’ নামের একজন ভিক্ষুণী রাজগৃহের এক বৃহৎ জনতার সম্মুখে ধৰ্ম-সম্বন্ধে বক্তৃতা করেছিলেন। তাঁর সেই বক্তৃতা শুনে একজন যক্ষ এতই প্রীতি লাভ করেছিলেন যে, তিনি রাজগৃহের রাস্তায় রাস্তায় বলে বেড়িয়েছিলেন, “সুক্কা সুধা বিতরণ করিতেছেন, যাঁহারা বুদ্ধিমান তাঁহাদের সেই সুধা পান করিয়া আসা উচিত।” (১ম খণ্ড, পৃ: ২১২-২১৩) ‘ক্ষেমা’ নামের আরেক বৌদ্ধ নারী বিনয়গ্রন্থটি অতি উত্তমরূপে আয়ত্ত করেছিলেন। তিনি শিক্ষিতা ও বুদ্ধিমতী ছিলেন, চমৎকার বক্তৃতা করতে পারতেন, এবং তাঁর অসাধারণ প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব ছিল। একদা রাজা প্রসেনজিৎ তাঁর কাছে গিয়ে তাঁকে প্রণাম করে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “মৃত্যুর পর জীবের পুনর্জন্ম হয় কি না?” তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, “ভগবান বুদ্ধ এ কথার কোনও উত্তর দেন নাই।” তারপরে রাজা তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “ভগবান এ প্রশ্নের উত্তর দেন নাই কেন?” তখন সেই ভিক্ষুণী রাজাকে পাল্টা প্রশ্ন করেছিলেন, “আপনি এমন কাহাকেও কি জানেন যিনি গঙ্গার বালুকা এবং সমুদ্রের জলবিন্দু গণনা করিতে পারেন?” রাজা জানিয়েছিলেন যে, সেরকম কোন মানুষের কথা তাঁর জানা নেই। তখন ভিক্ষুণী তাঁকে বলেছিলেন, “যদি কেহ পঞ্চ খন্ধের আকর্ষণ হইতে আপনাকে মুক্ত করিতে পারে তবে সে অসীম অতলস্পর্শ সমুদ্রের আকার ধারণ করে; সুতরাং মৃত্যুর পর এইরূপ জীবের পুনর্জন্ম ধারণার অতীত বস্তু।” তাঁর উত্তর শুনে রাজা পরিতৃপ্ত হয়ে তাঁর কাছ থেকে বিদায় নিয়েছিলেন। (সংযুক্তনিকায়, ৪র্থ খণ্ড, পৃ: ৩৭৪-৩৮০)
‘ভদ্দা কুণ্ডলকেশা’ সংসার ত্যাগ করে নিগন্ঠ সম্প্রদায়ে প্রবেশ করেছিলেন। তারপরে নিগণ্ঠদের ধর্ম-মত অধিগত করে তাঁদের সাহচর্য্য পরিত্যাগ করে তিনি বৌদ্ধ পণ্ডিতদের কাছ থেকে তাঁদের জ্ঞান-পদ্ধতি আয়ত্ত করবার চেষ্টা করেছিলেন। তর্কে ‘সারিপুত্ত’ ছাড়া অন্য কেউই তাঁর সমকক্ষ ছিলেন না। একমাত্র সারিপুত্তই তাঁকে তর্ক-বিচারে পরাজিত করতে পেরেছিলেন। (থেরীগাথা ভাষ্য, পৃ- ৯৯)
‘মজঝিমনিকায়’ গ্রন্থে বৌদ্ধদর্শনে সুপণ্ডিতা ‘ধম্মদিন্না’ নামের একজন শিক্ষিতা মহিলার উল্লেখ পাওয়া যায়। একদিন ধম্মদিন্নার স্বামী তাঁকে ‘সক্কায়দিটঠি’ (দেহকে আত্মা বলে বিশ্বাস ), ‘সক্কায় নিরোধ’ (দেহের বিনাশ), ‘অরিয় অটঠঙ্গিক মগগো’ (আর্য্য-অষ্টাঙ্গিকমার্গ), ‘সংখার’ (সংস্কার), ‘নিরোধসমাপত্তি’ (ধ্যানের একটি স্তর যেখানে কায়-মন-বাক্যের সংস্কারের বিনাশ সাধিত হয়), ‘নিরোধসমাপত্তি’ থেকে উত্থানের উপায়, এবং নানা প্রকার বেদনা সম্বন্ধে অনেকগুলি প্রশ্ন করেছিলেন। ধম্মদিন্না তাঁকে প্রত্যেকটি প্রশ্নেরই যথাযথ উত্তর প্রদান করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “পঞ্চ উপাদানখন্ধের দ্বারা সক্কায় (দেহ) নিৰ্ম্মিত। তৃষ্ণার অর্থ সক্কায়সমুদয়। তৃষ্ণা ধ্বংসের অর্থ সক্কায় বিনাশ, মহান আটটি পথের দ্বারা সক্কায়-নিরোধ লাভ করা যায়। অজ্ঞ ব্যক্তিরাই পঞ্চ উপাদানখন্ধকে একত্রে এবং পৃথকভাবে অত্তা (আত্মা) বলিয়া দেখে। জ্ঞানী শিষ্যেরা বাক্য, নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস এবং মনের কার্য্যকে এইরূপ ভাবে গ্রহণ করেন না। বেদনা তিন প্রকারের – যথা ‘সুখ, দুঃখ এবং অদুঃখ-অসুখ’। …” (১ম খণ্ড, পৃ- ২৯৯) ধম্মদিন্না বিনয়গ্ৰন্থ বিশেষভাবে আয়ত্ত করেছিলেন। (দীপবংশ, ৮ম পৰ্ব)
‘বিমানবত্থুভাষ্যে’ (পৃ- ১৩১) বৌদ্ধযুগের একটিমাত্র শিক্ষিত নারীর উল্লেখ পাওয়া যায়। তিনি শ্রাবস্তীর
জনৈক উপাসকের কন্যা ছিলেন, তাঁর নাম ছিল – ‘লতা’। তিনি শিক্ষিতা, জ্ঞানী ও বুদ্ধিমতী ছিলেন। ‘সঙ্ঘমিত্তা’ (অশোকের কন্যা সঙ্ঘমিত্রা) ত্রিবিধ বিজ্ঞানে পারদর্শিনী ছিলেন। যাদুবিদ্যাতে তাঁর বিশেষ অভিজ্ঞতা ছিল। (দীপবংশ, ১৫ পৰ্ব) তিনি ‘বিনয়পিটক’ গ্রন্থটি এমনভাবে আয়ত্ত করেছিলেন যে, অন্যদের সেই শাস্ত্র সম্বন্ধে শিক্ষা দিতে পারতেন। বস্তুতঃ অনুরাধপুরে বিনয়পিটক, সুত্তপিটকের পাঁচটি গ্রন্থ, এবং অভিধর্মের সাতটি গ্রন্থ সম্বন্ধে তিনি শিক্ষা দিয়েছিলেন। (দীপবংশ, ১৮ পৰ্ব) ‘অঞ্জলি’ ছয়টি অলৌকিক গুণ এবং মহান দৈবশক্তির অধিকারিণী ছিলেন। সঙ্ঘমিত্তার মত তাঁরও বিনয়পিটকে অসাধারণ ব্যুৎপত্তি ছিল। তিনিও অন্যদের সেই গ্রন্থ থেকে শিক্ষাদান করতে পারতেন। তিনি অনুরাধপুরে ১৬ হাজার ভিক্ষুণীসহ গমন করেছিলেন, এবং তাঁদের বিনয়পিটক থেকে শিক্ষাও দান করেছিলেন। ‘উত্তরা’ ত্ৰিবিধ বিজ্ঞান আয়ত্ত করেছিলেন, এবং যাদুবিদ্যা সম্বন্ধেও তাঁহার গভীর জ্ঞান ছিল। তিনি প্রচুর অধ্যয়ন করেছিলেন। অনুরাধপুরে গিয়ে তিনি বিনয়পিটক, সুত্তপিটকের পাঁচটি গ্রন্থ এবং অভিধর্মের সাতটি গ্রন্থের অধ্যাপনার ভার গ্রহণ করেছিলেন। ‘কালি’ একজন দুশ্চরিত্রের কন্যা ছিলেন, কিন্তু তাঁর নিজের মন অত্যন্ত পবিত্র ছিল, এবং তিনি সমস্ত ধৰ্ম-শাস্ত্রেই সুপণ্ডিতা ছিলেন। তিনিও অনুরাধপুরে বিনয়পিটক সম্বন্ধে উপদেশ দান করেছিলেন। এছাড়া বৌদ্ধযুগের যেসব ভিক্ষুণী বিনয় আলোচনার দ্বারা জ্ঞানার্জন করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে ‘সপত্তা’, ‘ছন্না’, ‘উপালি’ এবং ‘রেবতী’র নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ‘সীবলা’ এবং ‘মহারুহা’ অনুরাধপুরে বিনয়পিটক, সুত্তপিটকের পাঁচটি গ্রন্থ এবং অভিধর্মের সাতটি গ্রন্থের অধ্যাপনা করতেন। ‘সমুদ্দনাভা’ অনুরাধপুরে বিনয়পিটক শিক্ষা দান করেছিলেন। (দীপবংশ, ১৮ পৰ্ব) ‘হেমা’ ত্রিবিধ বিজ্ঞানে পারদর্শিনী ছিলেন, এবং অলৌকিক শক্তি সম্বন্ধেও তাঁর জ্ঞান ছিল। (দীপবংশ, ১৫ পর্ব) তিনি বিনয়পিটক, সুত্তপিটকের পাঁচটি গ্রন্থ এবং অভিধর্মের সাতটি গ্রন্থ সম্বন্ধে উপদেশ দিতেন। (১৮ পৰ্ব) ‘অগ্‌গিমিত্তা’ (অগ্নিমিত্রা) ত্রিবিধ বিজ্ঞান আয়ত্ত করেছিলেন এবং অলৌকিক শক্তি সম্বন্ধেও তাঁর অভিজ্ঞতা ছিল। (১৫ পৰ্ব) ‘চূলনাগা’, ‘ধন্না’, ‘সোণা মহাতিসসা’, ‘চুল-সুমনা’ এবং ‘মহাস্থমনা’ প্রভৃতি নারীরাও শিক্ষিতা, প্রতিভাসম্পন্না এবং শাস্ত্রজ্ঞা ছিলেন। (১৮ পৰ্ব) ‘নন্দুত্তরা’ বিদ্যা এবং শিল্পে পারদর্শিনী ছিলেন। (থেরীগাথা ভাষ্য, পৃ- ৮৭) তখনকার যে সমস্ত ভিক্ষুণী বিনয়পিটক আয়ত্ত করেছিলেন, ‘পটাচারা’ তাঁদের মধ্যে শ্রেষ্ঠস্থানের অধিকারিণী ছিলেন (অঙ্গুত্তরনিকায়, ১ম খণ্ড, পৃ- ২৫; দীপবংশ, ১৮ সর্গ) এখানে উল্লেখিত থেরীগণ (ভিক্ষুনী) ছাড়াও তখনকার আরও অনেক নারীর নাম বৌদ্ধগ্রন্থগুলি থেকে পাওয়া যায়, যাঁরা তাঁদের বিদ্যাবত্তার জন্য সেই সময়ে খ্যাতিলাভ করেছিলেন। ‘উপলবন্না’, ‘সোভিতা’, ‘ইসিদাসিকা’, ‘বিশাখা’, ‘সবলা’, ‘সঙ্ঘদাসী’, এবং ‘নন্দা’ – বিনয় গ্রন্থ বিশেষরূপে আয়ত্ত করেছিলেন। ‘থেরী উত্তরা’, ‘মল্লা’, ‘পৰ্ব্বতা ফেগগু’, ‘ধৰ্ম্মদাসী’, ‘অগুগিমিত্তা’ এবং ‘পসাদপালা’ অনুরাধপুরে বিনয়পিটক ও সুত্তপিটকের পাঁচটি গ্রন্থ, এবং অভিধর্মের সাতটি গ্রন্থ থেকে উপদেশ প্রদান করতেন। ‘সধম্মনন্দি’, ‘সোমা’, ‘গিরিদ্ধি’, ‘দাসী’, এবং ‘ধম্মা’ – বিনয় গ্রন্থ বেশ ভাল ভাবেই পাঠ করেছিলেন। ‘সুমনা’, ‘মহিলা মহাদেবী’, ‘পছমা’ এবং ‘হেমসো’ অনুরাধপুরে বিনয়পিটক থেকে শিক্ষাদান করতেন। (দীপবংশ, ১৮ পৰ্ব) এছাড়া ‘দিব্যাবদান’ গ্রন্থে রাত্রিকালে বুদ্ধবচন-পাঠ নিরতা নারী-ছাত্রীর উল্লেখ পাওয়া যায়। (পৃ- ৫৩২)

(তথ্য সহায়ক গ্রন্থ:
১- Tāranātha’s History of Buddhism in India.
২- Power, Wealth and Women in Indian Mahayana Buddhism; Douglas Osto.
৩- The Position Of Women In Ancient Indian Buddhism, Kavita Chauhan.)

মারাঠা সাহিত্য ও গীতি ছত্রপতি শিবাজি মহারাজ ছাড়া যেন অসম্পূর্ণ! বিখ্যাত মারাঠা সাম্রাজ্য ও কিংবদন্তি নায়ক ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ

সময়টা তখন সতেরো দশকের, ভারতবর্ষে বিশেষ করে দিল্লিতে মুঘল সাম্রাজ্য প্রবলভাবে বিদ্যমান। এইসময় উত্থান হয় মারাঠা সাম্রাজ্যের যা মুঘল সাম্রাজ্যের ভিত নাড়িয়ে দেয়। ১৬৫৮ সালে দিল্লির সিংহাসনে বসে ঔরাঙ্গজেবে, তার সময়েই মুঘল সাম্রাজ্যের আরও বিস্তার ঘটেছিল। সিংহাসনে বসেই ঔরাঙ্গজেব আরও সাম্রাজ্য বৃদ্ধিতে মনোযোগ দেয়। ঔরজেবের প্রধান লক্ষ্য ছিল ডেকান বিজয়। কিন্তু সেখানেই উত্থান ঘটে মারাঠাদের, যাদের পরাক্রমের সামনে বারবার পরাস্ত হয় ঔরাঙ্গজেব। তবে ঔরাঙ্গজেবের আগেও মহম্মদ বিন তুঘলকেরও ডেকানে আগ্রহ ছিল যার কারনে দৌলতাবাদে নিজের রাজধানী স্থানান্তর করেছিল মহম্মদ বিন তুঘলক। মারঠাদের উত্থানের পেছনে বেশ কয়েকটি কারন ছিল।

ডেকান অঞ্চলের পার্বত্যভূমি, ঘন জঙ্গল, ডেকান অঞ্চলের অদক্ষ শাসক, ঔরাঙ্গজেবের হিন্দু বিরোধী নীতি এবং সাধু তুকারাম, একনাথ ও রামদাসের মতন মারাঠা সাধুদের ভক্তি আন্দোলনের ফলে মারাঠা সাম্রাজ্যের উত্থান হয়। মারাঠারা মুঘলদের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ করত। মারাঠা সাম্রাজ্য স্থাপনের প্রধান কারিগর সাহাজী ভোঁসলে এবং ওনার পুত্র কিংবদন্তি নায়ক ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ। মারাঠাদের মধ্যে ঐক্য স্থাপন, সুদক্ষ প্রজাদরদি শাসক হিসাবে মারাঠা সহ ভারতের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র ছত্রপতি শিবাজি মহারাজ। মারাঠা সাহিত্য ও গীতি ছত্রপতি শিবাজি মহারাজ ছাড়া যেন অসম্পূর্ণ। বিখ্যাত মারাঠা সাম্রাজ্য ও মহান শাসক ছত্রপতি শিবাজি মহারাজ সম্পর্কেই বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।

সতেরো শতকের শুরুতেই মুঘল সাম্রাজ্য উত্তর ডেকান পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। ডেকান প্রদেশ সেসময় পাঁচভাগে বিভক্ত ছিল। আহমেদনগর যার নেতৃত্বে ছিল মালিক নিজাম শাহ, আদিল শাহের নেতৃত্বে বিজাপুর, ফাহতুল্লাহ ইমাদ উল মুলকের নেতৃত্বে বেরার, কোয়াসিম বারিদের নেতৃত্বে বিদার এবং কুতুব উল মুলকের নেতৃত্বে গোলকুন্ডা। মারাঠি ভাষা বলা মারাঠিরা প্রথমে আহমেদনগর ও বিজাপুর রাজ্যে মনসাবদার ও সেনানায়কের কাজ করত কারন তাদের মত বীর খুব কমই ছিল। মারাঠা গোষ্ঠী গুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল ভোঁসলে গোষ্ঠী। সাহাজী ভোঁসলের জন্ম হয় ১৫৯৪ সালে আহমেদনগরের মালোজী ভোঁসলের পরিবারে। মালোজী ভোঁসলে পুনে ও সুপে জেলা দুটির দায়িত্বে ছিলেন। সাহাজী ভোঁসলে প্রথমে আহমেদনগর সুলতানের প্রধান সেনাপতি হিসাবে নিযুক্ত হন। এইসময় মুঘল সম্রাট শাহজাহান ডেকান বিজয় করবার অভিযান শুরু করে। সাহাজী ভোঁসলে শাহজাহানের সাথে হাত মিলিয়ে জুনার ও সঙ্গমের দখল করে কিন্তু ১৬৩২ সালে মুঘলরা সাহাজী ভোঁসলের থেকে তার অংশ কেড়ে নেয় ফলে সাহাজী ভোঁসলে বিজাপুর সুলতানের সাথে হাত মিলিয়ে ১৬৩৪ সালে পুনে ও সুপা জেলা দখল করে। ১৬৩৬ সালে মুঘল ও সাহাজী ভোঁসলের মধ্যে পারিন্দায় যুদ্ধ হয় যাতে সাহাজী ভোঁসলে পরাজিত হয় এবং মুঘল বিজাপুর শান্তি চুক্তি সাক্ষরিত হয় যাতে জুনার সহ বেশ কিছু অংশ মুঘলকে দিতে বাধ্য হয় সাহাজী ভোঁসলে। পুনে থেকেও চলে যেতে বাধ্য করা হয় তাকে এবং পুনের দায়িত্ব দেওয়া হয় তার স্ত্রী জীজাবাই এবং পুত্র ছত্রপতি শিবাজি মহারাজকে। এখান থেকেই ডেকান রাজনীতিতে উত্থান শুরু হয় ছত্রপতি শিবাজি মহারাজের। পুনের কাছে শিবনির দুর্গে ১৬৩০ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারী জন্ম হয় ছত্রপতি শিবাজি মহারাজের। ওনার গুরু ছিলেন দাদু কোন্ডাদেব এবং সাধক রামদাস। ১৬৪৭ সালে দাদু কোন্ডাদেবের মৃত্যুর পর পুনার দায়িত্ব পান তিনি, তবে এর একবছর আগে থেকেই মাত্র ষোলো বছর বয়সেই তিনি সাম্রাজ্য বিস্তার শুরু করেছিলেন বিজাপুর অন্তর্ভুক্ত তোরনা দুর্গ অধিকার করে। ১৬৫৬ সালে রায়গড় দুর্গ অধিকার করেন যা ১৬৭৪ সালে মারাঠা সাম্রাজ্যের রাজধানী হয়েছিল। ১৬৫৬ সালে তিনি বিরোধী মারাঠা গোষ্ঠীর প্রধান চন্দ্ররাও মোরেকে পরাস্ত করে জাভেলি দখল করে যা বিজাপুরে তার অবস্থানকে মুজবুত করেছিল। এরপর বিজাপুরের একের পর অঞ্চল বিজয় করতে শুরু করেন তিনি, ফলে ১৬৫৯ সালে বিজাপুরের সুলতান আদিল শাহ দ্বিতীয়র সাথে তার প্রতাপগড়ের যুদ্ধ হয়। ছত্রপতি শিবাজির বীরত্বে ভীত হয়ে আদিল শাহ দ্বিতীয় তার সেনাপ্রধান আফজাল খাঁ ও দশ হাজার সেনা পাঠায় প্রতাপগড়ে। আফজাল খাঁ ছত্রপতি শিবাজি মহারাজকে চিঠি লিখে যুদ্ধের সরাসরি বৈঠকের আমন্ত্রন জানান। ছত্রপতি শিবাজি মহারাজ জানতেন এটা একটি চাল সেজন্য তিনি জবাব দেন দুজনের সাথে দেখা হবার সময় একজন দেহরক্ষী ছাড়া কেউ থাকবে না এবং কেউ কোন অস্ত্র নিয়ে যেতে পারবেনা। ছত্রপতি শিবাজি মহারাজ একটি সুরক্ষা কবজ পড়ে ও ডান হাতে একটি অস্ত্র লুকিয়ে নিয়ে আফজাল খাঁর সাথে দেখা করেন। আফজাল খাঁ হঠাৎই একটি ছোরা নিয়ে ছত্রপতি শিবাজি মহারাজের শরীরে আঘাত করেন কিন্তু আচ্ছাদন থাকায় ওনার কোন ক্ষতি হয়নি, এরপর ছত্রপতি শিবাজি মহারাজের ডানহাতের অস্ত্রলর আঘাতে মিত্যু হয় আফজাল খাঁর। ছত্রপতি শিবাজি মহারাজ এরপর বিজাপুরের সেনাকে পরাস্ত করে সব অস্ত্র কেড়ে নেন। ছত্রপতি শিবাজি মহারাজের ভয়ে ভীত হয়ে ঔরাঙ্গজেব সরাসরি ডেকান আক্রমনের বদলে শায়েস্তা খানকে প্রধান সেনাপতি করে পাঠায় ডেকানে।

১৬৬০ সালে শায়েস্তা খান পুনে দখল করে এবং পুনেতে মারাঠাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়। কিন্তু ১৬৬৩ সালে ৫ এপ্রিল একটি বিবাহ উপলক্ষে মারাঠাদের পুনেতে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়, এই সুযোগে ছত্রপতি শিবাজি মহারাজ ও চারশো মারাঠা সেনা ছদ্মবেশে ঢুকে পুনে দখল করে। ছত্রপতি শিবাজি মহারাজ শায়েস্তা খানের তিনটি আঙ্গুল কেটে দিয়েছিলেন যার জন্য ৫ এপ্রিল দিনটিকে শিবতেজ দিবস হিসাবে পালন করা হয় মহারাষ্ট্রে। পরাজয়ের ফলে হতাশায় ঔরাঙ্গজেব শায়েস্তা খানকে বাংলায় পাঠিয়ে দেয়। ১৬৬৫ সালে আম্বেরের রাজা জয়সিং এর নেতৃত্বে পুনরায় মুঘল ও মারাঠাদের যুদ্ধ হয় যাতে পুরন্দর দুর্গ দখল করে নেয় মুঘলরা এবং উভয়পক্ষের মধ্যে পুরন্দরের চুক্তি হয়। চুক্তি অনুযায়ী ছত্রপতি শিবাজি মহারাজকে তার ৩৫ দূর্গের মধ্যে থেকে ২৩ টি দুর্গকে মুঘলদের দিতে হয়। তবে মুঘলদের এই বিজয় ক্ষনস্থায়ী ছিল।

১৬৭০ সালে ছত্রপতি শিবাজি মহারাজ পুনরায় মুঘলদের আক্রমন করে সমস্ত দুর্গ পুনরুদ্ধার করেন। ১৬৭৪ সালে রায়গড় দুর্গে তার রাজ্যাভিষেক হয় এবং তাঁকে ছত্রপতি উপাধি দেওয়া হয়। ১৬৮০ সালের ৩ এপ্রিল এই মহান শাসক বীরগতি প্রাপ্ত হন।

ছত্রপতি শিবাজি মহারাজ একদজন দক্ষ শাসক ছিলেন৷ তিনি রাজ্যপরিচালনার জন্য অষ্টপ্রধান গঠন করেছিলেন যারা সরাসরি রাজাকে তথ্য দিতেন। প্রথমেই ছিল পেশোয়া যাকে প্রধানমন্ত্রী বলা হত এরপর সেনাপতি, অমাত্য, ওয়াকানবিশ, সচিব, সুমন্ত, নেয়াধিশ এবং পন্ডিতরাও পদে ছিলেন। ছত্রপতি শিবাজি মহারাজ শক্তিশালী নৌবহর গঠন করেছিলেন। মারঠা নৌবহরে প্রায় ৪০০ টি জাহাজ ছিল। এজন্য ওনাকে ভারতীয় নৌবাহিনীর জনক বলা হয়। কর সংগ্রহের জন্য বিশেষ পদ ছিল তার শানকালে, যাদের কারকুনস বলা হত। মারাঠা সাম্রাজ্যে চৌথ এবং সারদেশমুখী নামে দুটি প্রধান কর ছিল। চৌথ মানে ভূমির প্রধান লভ্যাংশের চারভাগের একভাগ এবং সরদেশমুখী মানে ভূমির বাকী লভ্যাংশের দশভাগের একভাগ। তবে এসব কর মারাঠা সাম্রাজ্যের লোকেদের দিতে হত না বরং মারাঠা আক্রমন থেকে বাঁচতে সীমান্তবর্তী রাজ্য গুলোকে দিতে হত যারা অন্য সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল। ছত্রপতি শিবাজি মহারাজের পর মারাঠা সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকার নিয়ে ওনার দুই পুত্র রাজারাম ও সাম্ভাজী মহারাজের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়, শেষপর্যন্ত সাম্ভাজী মহারাজ মারাঠা সাম্রাজ্যের প্রধান হন কিন্তু ১৬৮৯ সালে ঔরাঙ্গজেব সাম্ভাজী মহারাজকে হত্যা করে মারাঠাদের রাজধানী রায়গড় দখল করে নেয় এবং সাম্ভাজী মহারাজের পুত্র সাহু মহারাজকে বন্দী করে নেয় মারঠা সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী হিসাবে। এরপরেই মারাঠা সাম্রাজ্যে পেশোয়াদের উত্থান শুরু হয়। ১৭১৩ সালে সাহু মহারাজ পেশোয়া বালাজী বিশ্বনাথকে পেশোয়া নিয়োগ করেন যিনি মারাঠা সাম্রাজ্যের ভিত পুনরায় শক্তিশালী করেন। ১৭২২ সালে নতুন পেশোয়া নিযুক্ত হন বালজী বিশ্বনাথের পুত্র বাজীরাও ১, যাকে মারাঠি ইতিহাসে সবচেয়ে শক্তিশালী পেশোয়া বলা হয়। তার সময়েই ভারতবর্ষের এক তৃতীয়াংশে মারাঠা সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। বহু মুঘল রাজ্যের শাসক সহ হায়দ্রাবাদের নিজামকেও পরাস্ত করেছিলেন তিনি। বিশাল মারাঠা সাম্রাজ্য পরিচালনার জন্য তিনি মারাঠাদের পাঁচভাগে বিভক্ত করেছিলেন বরোদাতে গায়কোয়াড, নাগপুরে ভোঁসলে, ইন্দোরে হোলকার, গোয়ালিয়রে সিন্ধিয়া এবং পুনেতে পেশোয়া। মারাঠাদের ক্ষমতা বৃদ্ধি ও আফগান আক্রমণে ভীত হয়ে মুঘলরা ১৭৫২ সালে মারাঠাদের সাথে সন্ধি করে যাতে মারাঠারা মুঘল সাম্রাজ্যকে আফগান আক্রমন থেকে রক্ষা করার বদলে বিপুল কর পায় মুঘলদের থেকে। তবে ইতিহাসে সব বড় সাম্রাজ্যের মতোন মারাঠা সাম্রাজ্যেরও পতন হয়। যেকোনো সাম্রাজ্যের পতনের প্রধান কারন হচ্ছে দুর্বল শাসক ও অর্ন্তদ্বন্দ, মারাঠা সাম্রাজ্যেও তাই হয়। পুনেতে পেশোয়া নারায়ন রাওয়ের হত্যার পর উত্তরাধিকার নিয়ে দ্বন্দ্ব শুরু হয় যার সুযোগে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাথে মারাঠাদের ১৭৭৫-৮২ এর মধ্যে প্রথম অ্যাংলো মারাঠা যুদ্ধ হয়।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তখন পলাশী ও বক্সারের যুদ্ধে জয়লাভের পর ভারতে সাম্রাজ্য বিস্তার শুরু করেছিল। তবে তখনও মারাঠারা শক্তিশালী ছিল ফলে ইংরেজরা পরাজিত হয় এবং সলবাইয়ের সন্ধি অনুযায়ী কুড়ি বছরের শান্তির কথা হয়। ১৮০৩-০৫ এ দ্বিতীয় অ্যাংলো মারাঠা যুদ্ধ হয়, যাতে সিন্ধিয়া ও ভোঁসলেদের পরাস্ত করে একাধিক সন্ধি করা হয়। ১৮১৭ সালে অবশেষে তৃতীয় অ্যাংলো মারাঠা যুদ্ধের পর মারাঠা সাম্রাজ্যের পতন নিশ্চিত হয়। এছাড়াও কর সুনির্দিষ্ট করনীতির অভাব, গেরিলা যুদ্ধের উপর অতিরিক্ত ভরসা এবং পাঁচ মারাঠা গোষ্ঠীর মধ্যে বিরোধীতাও এই সাম্রাজ্যের পতনের কারন ছিল। তবে শূন্য থেকে উঠে আসা এক বিশাল সাম্রাজ্যের বিজয়গাথা ও তার কিংবদন্তি শাসক ছত্রপতি শিবাজি মহারাজের কথা ভারতের ইতিহাসে স্বর্নাক্ষরে লেখা আছে।

রাশিয়ার তীব্র ঠান্ডায় জঙ্গলে পর্বতারোহী দলের সাথে ঠিক কী হয়েছিল তা আজও রহস্যময়! ডিয়াটলোভ পাস রহস্য

প্রকৃতি এতটা রহস্যময় যে মানুষের সাধ্য নেই তাকে সম্পূর্ন বোঝার। প্রতিনিয়ত কত যে রহস্যময় ঘটনা ঘটে চলেছে তার কারন অনুসন্ধান করা মানুষের সাধ্যের বাইরে। প্রকৃতি যেমন মানুষকে জীবন ধারনের প্রয়োজনীয় উপকরন দেয় ঠিক এখানে পদে পদে মৃত্যুও অপেক্ষা করে রয়েছে। কত রকমের বিষাক্ত জীব, হিংস্র পশু থেকে শুরু করে প্রাকৃতিক বিপর্যয় প্রতিনিয়তই কত মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। হয়ত প্রকৃতির রহস্য কোনওদিনও সম্পূর্ন ভাবে ব্যাখা করতে পারবে না মানুষ। যেমন রাশিয়ার একদল পর্বতারোহীর সাথে যা হয়েছে তা আজও ব্যাখা করা সম্ভব হয়নি। এই ঘটনা ডিয়াটলোভ পাস রহস্য নামে পরিচিত। রাশিয়ার তীব্র ঠান্ডায় জঙ্গলে এই পর্বতারোহী দলের সাথে ঠিক কী হয়েছিল তা আজও রহস্যময়।

আজ থেকে প্রায় ষাট বছর আগে সেখানে ঠিক কী হয়েছিল তা আজও অধরা।

সালটা ১৯৫৯, রাশিয়ার উরাল পলিটেকনিক কলেজের দশজন বিদ্যার্থী ঠিক করে কোথাও ভ্রমনে যাবে। তারা ওরাল পর্বতে অভিযান করবে ঠিক করে। ২৫০০ কিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত ওরাল পর্বত এশিয়াকে ইউরোপ থেকে আলাদা করে। এই পুরো দলের নেতা ছিল ইগর ডিয়াটলোভ নামে ২৩ বছর বয়সী যুবক যে নিজেকে পর্বতারোহনের ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ বলে দাবি করতো। রাশিয়ার ভয়ানক ঠান্ডায় সে এর আগেও বহুবার পর্বতারোহন করেছিল যার কারনে সবাই তাকে ভরসা করতো। দলের বাকী সদস্যরাও পর্বতারোহনের ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ ছিল তারা গ্রেড ২ বিভাগের ছিল। এই অভিযান সম্পন্ন হলে সোভিয়েত ইউনিয়ন সরকার তাদের গ্রেড ৩ বিভাগের অন্তর্ভুক্ত করতো যা তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নে সবচেয়ে অভিজ্ঞ শ্রেনীর সম্মান বলা হত। ৩০০ কিলোমিটার পর্বতারোহন করলে তাকে গ্রেড ৩ শ্রেনীর সম্মান দেওয়া হত। প্রথমে দশজন সদস্যের একটি দল অভিযানে যাবে ঠিক করেছিল যাতে আটজন পুরুষ ও দুই জন মহিলা ছিল কিন্ত শারীরিক সমস্যার কারনে পরে একজন না যাবার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৫৯ সালের ৮ জানুয়ারি সেভারডলোভস্ক শহরের কর্তৃপক্ষ এই দলকে উরাল পর্বত অভিযানের ছাড়পত্র দেয়। এই দলের লক্ষ্য ছিল উত্তর উরাল পর্বতের অন্তর্গত ওটোরটেন পর্বতে অভিযান করা। পুরো তিন সপ্তাহ লাগবে এই পুরো অভিযান সম্পন্ন হতে, এরকমই ঠিক ছিল। ২৫ জানুয়ারি সেই দলটি ট্রেনে করে ইভদিলে এসে পৌঁছায়। এখান থেকে গাড়িতে করে ভিজহাই যায় তারা। ওটোরটেন পর্বতের পাদদেশে অবস্থিত ভিজহাই শেষ জনপদ। ভিজহাই এর পরবর্তী এলাকাকে রাশিয়াতে মৃত্যু উপত্যকা বলা হত কারন এরপরে আর কোন জনবসতি নেই৷ মাঝে মাঝে কিছু যাযাবর মানুষ থাকে এখানে, যাদের সাথে সভ্য সমাজের কোন সম্পর্ক ছিলনা। ২৭ জানুয়ারি সকালে তারা অভিযান শুরু করে কিন্তু ২৮ জানুয়ারি ইওরি ইওডিন নামে একজন সদস্য শারীরিক সমস্যার কারনে ভিজহাইএ ফিরে যায়। ৩১ জানুয়ারি দলটি ওটোরটেন পর্বতের একদম নীচে একটি জঙ্গলে এসে উপস্থিত হয়, এখান থেকেই পর্বতে ওঠার অভিযান শুরু হয়। পরের দিন তারা অভিযান শুরু করে কিন্তু তীব্র তুষার ঝড় ও খারাপ আবহওয়ার কারনে তারা পথ হারিয়ে ফেলে এবং পর্বতের অন্যপ্রান্ত খোলাত শাখহালের দিকে চলে যায় খানিকটা। রাশিয়ান ভাষায় খোলাত শখহালের অর্থ মৃত পর্বত। যখন তারা তাদের ভুল বুঝতে পারে ততক্ষনে তারা অন্তত দেড় কিলোমিটার এগিয়ে চলে এসেছিল। সেখানেই রাত্রিবাস করবে ঠিক করে। ইগর ডিয়াটলোভ কলেজ কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে এসেছিল পুরো তিন সপ্তাহের মধ্যেই মিশন শেষ হবে এবং তারা পর্বত থেকে ভিজহাই এ ফিরে এসে ১২ ফেব্রুয়ারির মধ্যে টেলিগ্রাম করবে। কিন্ত তিন সপ্তাহের বেশী অতিক্রান্ত হয়ে যাবার পরও কোন টেলিগ্রাম আসেনি। বাধ্য হয়ে সমস্ত সদস্যর বাড়ির লোকজন ২০ ফেব্রুয়ারী পুলিশকে জানায়। পুলিশ ও সেনাবাহিনী যৌথভাবে উদ্ধারকার্য শুরু করে। ২৬ ফেব্রুয়ারী একটি হেলিকপ্টার খোলাত শাখায়েলে সেই দলটির তাঁবু খুজে পায়। তাঁবুটি যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত ছিল এবং বরফে প্রায় ঢেকেছিল। তাঁবুটা ভিতর থেকে কেউ যেন কেটে দিয়েছিল। তাঁবুতে নয় জোড়া জুতো এবং সেই দলটির ব্যাবহারযোগ্য সব জিনিস রাখা ছিল। অনুসন্ধান কারী দল এটা দেখে অবাক হয়ে যায় যে এই তীব্র ঠান্ডায় জুতো গুলো রাখা কেন? যার অর্থ সেই দলের সদস্যরা খালি পড়ে অথবা মোজা পড়ে অভিযানে গেছে যা এই তীব্র ঠান্ডায় অসম্ভব। আরও অদ্ভুত ব্যাপার দেখা যায় যে সেই দলটির পায়ের ছাপ ক্রমশ নীচের দিকে জঙ্গলের দিকে গেছে অর্থাৎ তারা পর্বতারোহন না করে কোনও অজানা কারনে যেন জঙ্গলের দিকে গেছে। মোটামুটি পাঁচশো মিটার পর তাদের পায়ের ছাপ বরফে ঢাকা পড়ে গেছে। উরাল পর্বতে মাইনাস ৩৫ ডিগ্রি তাপমাত্রায় কোন সুস্থ মানুষ খালি পায়ে যাবেনা, এর অর্থ একটাই যে এমন কিছু হয়েছিল যে সেই দলটি তাঁবু ছেড়ে জুতো পড়বারও সময় পায়নি দৌড়ে নীচে নেমে গেছে। উদ্ধারকারী দল যখন পায়ের ছাপ অনুসরন করে জঙ্গলের কাছে পৌঁছায় তারা দেখে দুটো প্রায় নগ্ন মৃতদেহ পড়ে আছে। এই দুজন ওই পর্বতারোহী দলেরই সদস্য ছিল। ওই দুই ব্যাক্তির পা এবং হাত জ্বলে গিয়েছিল এবং একজনের মুখে তারই একটি কাটা আঙুল ছিল। তাদের শরীরে পোষাক গেল কোথায় এটাও অবাক করার মত বিষয়। এরপর তিনমাস ধরে অনুসন্ধান চালানোর পর বাকী সদস্যদের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়।

প্রথম পাঁচজনের মৃতদেহ পাবার পর উদ্ধারকারী দলের মনে হয়েছিল এরা বোধহয় হাইোথার্মিয়ার কারনে মারা গেছে কারন অতিরিক্ত ঠান্ডায় হাইপোথার্মিয়া হয় মানুষের। কিন্তু শেষ চারজনের মৃতদেহ পাবার পর এই ধারনা বদলাতে বাধ্য হয় সবাই কারন শেষ চারজনের শরীরে আঘাতের চিহ্ন ছিল। মাথার খুলি ভেঙে গিয়েছিল, শরীরের ভিতর হাড় ভেঙে গিয়েছিল। কারও দুটি চোখই ছিলনা, কারও জিভ, ভ্রু, ঠোঁটের অংশ কিছুই ছিলনা। তাদের শীরর এমনভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছিল দেখে মনে হচ্ছিল কোন বড় গাড়ি দুর্ঘটনা হয়োছে। তাদের পোষাক পর্যন্ত অদ্ভুত রকমের হয়ে গিয়েছিল। যদি ঠান্ডার কারনেই তারা মারা গিয়ে থাকে তাহলে তাদের অনেকের শরীরে পোষাক নেই কেন, শরীরে এত আঘাত কেন!! এসবই ভাবছিল উদ্ধারকারী দল। সোভিয়েত ইউনিয়ন পুলিশ তদন্ত শুরু করে। প্রথমে সন্দেহ করা হয় স্থানীয় মানসি উপজাতির যাযাবর মানুষেররা বোধহয় তাদের হত্যা করেছে কিন্তু মানসিদের জিজ্ঞাসাবাদে তারা নির্দোষ প্রমানিত হয়। মে মাসে এই তদন্ত বন্ধ করে দেওয়া হয় বলা হয় প্রাকৃতিক কারনে তাদের মৃত্যু হয়েছে, তাদের তদন্ত ফাইল গোপন জায়গায় রাখা হয়। রহস্যময় ঘটনাকে কেন্দ্র করে কিছু গুজব সবসময় ছড়িয়ে পড়ে। এই ঘটনার ক্ষেত্রেও তাই হয়। একটি খবর ছড়িয়ে পড়ে ওটোরটেন পর্বতে থাকা বিগ ফুট বা ইয়েতি এদের হত্যা করেছে। কিন্তু এই সম্ভবনা বাতিল করে দেওয়া হয় কারন যদি ইয়েতিই এই কাজ করত তাহলে তার পায়ের ছাপ পাওয়া যেত কিন্তু এখানে শুধুমাত্র ওই নয়জনেরই পায়ের ছাপ পাওয়া গেছে। আরও একটি খবর প্রচলিত হয়যে এদের এলিয়েন হত্যা করেছে কারন সেসময় আকাশে উজ্জ্বল আলো দেখা গিয়েছিল। কিন্তু এই সম্ভবনাও বাতিল হয়ে যায় কারন আকাশে যে উজ্জ্বল আলোর কথা বলা হচ্ছিল তা আসে মেরুজ্যোতি বা আরোরা যা উত্তর মেরু সহ এই অঞ্চলে দেখা যায়। সেসময় আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধ চলছিল, দুই দেশই অনেক গোপন প্রজেক্টে কাজ করছিল। এখানে নয় ব্যাক্তি সোভিয়েত ইউনিয়নেরই কোন গোপন প্রজেক্টের শিকার হয়েছে বলেও কথা ওঠে। কেউ কেউ দাবি করে এই নয় ব্যাক্তি তেজস্ক্রিয়তা ও প্যারাসুট মাইনের শিকার হয়েছে। কিন্তু এই সব তথ্যও বাতিল হয়ে যায় কারন তেজস্ক্রিয়তায় গোটা শরীর জ্বলে যাওয়ার কথা। সেসময় সোভিয়েত ইউনিয়ন প্যারাসুটের করে বোম্ব ফেলে পরীক্ষা করছিলো। কিন্তু যদি মাইন ফেটে থাকে তাহলে মৃতদেহ টুকরো টুকরো হয়ে যাবার কথা। কিন্তু মৃতদেহ গুলো মোটামুটি অক্ষতই ছিল, শুধু শরীরে পোষাক ছিলনা তেমন। তাদের শরীরে বাইরে থেকে আঘাতের কোন চিহ্ন ছিলনা বরং শরীরের ভিতর অনেক হাড় ভেঙে গিয়েছিল। ২০১৯ সালে এই ঘটনার বন্ধ হয়ে যাওয়া ফাইল পুনরায় খোলা হয় এবং আবার তদন্ত শুরু হয়। তাদের শরীরে পোষাক না থাকার কারন হিসাবে বলা হয় অতিরিক্ত ঠান্ডার কারনে মাথা কাজ করা বন্ধ করে দেয় এর কারন প্যারাডক্সিয়াল আনড্রেসিং রোগ। যার কারনে কোন মানুষ তীব্র ঠান্ডার মধ্যেও প্রচুর গরম অনুভব করে এবং সে তার পোষাক খুলে ফেলে দেয়।

২০২০ সালে রাশিয়ার সরকার জানায় ডিয়াটলোভ পাসের ঘটনা ঘটে তুষার ধসের কারনে। কিন্তু রাশিয়ান সরকারের এই সিদ্ধান্ত অনেক দেশই বাতিল করে দিয়েছে কারন তুষার ধ্বসে কারও মৃত্যু হলে সে পোষাক খোলবার সময় পাবে না এবং তুষার ধ্বস হলে মৃতদেহ গুলো বরফের তলায় থাকতো এবং তাদের তাঁবুও বরফে ঢাকা থাকত। কিন্তু মাত্র দুই সপ্তাহের মধ্যে উদ্ধারকারী দল তাঁবু ও মৃতদেহ খুজে পেয়েছিল সেখানে হালকা বরফ ছিল শুধুমাত্র। তুষারধ্বসে আসা বরফ দুই সপ্তাহে গলে যাবে না!! সবথেকে বড় কথা ১৯৫৯ সালের আগে থেকে এখনও অবধি ওই অঞ্চলে তুষারধ্বসের কোনও প্রমান পাওয়া যায় নি। ডিয়াটলোভ পাসে আসলে কী ঘটেছিল তা হয়ত রহস্যময় ঘটনা হিসাবেই থেকে যাবে।

উত্তর পূর্ব ভারতকে অশান্ত করতে ষড়যন্ত্র করছে চীন এবং পাকিস্তান

ভারতের বিদেশনীতির কেন্দ্রে রয়েছে ভারতের উত্তর পূর্ব অংশ কারন অর্থনৈতিক ও কুটনৈতিক ভাবে শক্তিশালী হবার জন্য ভারত আসিয়ানের সাথে জোট করছে যার ফলে ভারত উৎপাদন কেন্দ্রে পরিনত হচ্ছে এবং ভারতের আর্থিক ব্যবস্থা ভবিষ্যতে আরও মজবুত হবে। এর জন্য উত্তর পূর্ব অঞ্চল খুবই গুরুত্বপূর্ন ভারতের জন্য। কিন্তু চীন ও পাকিস্তান উত্তর পূর্ব ভারতে শান্তি বিঘ্নিত করতে বহুদিন ধরেই চেষ্টা করে যাচ্ছে। সম্প্রতি চারদিনের জন্য চীন সফরে গিয়েছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল মুনির। ইনটেলিজেন্স তথ্য অনুযায়ী জেনারেল মুনিরকে চাইনিজ সরকার নির্দেশ দিয়েছে উত্তর পূর্ব ভারতে সমস্যা তৈরি করার, বিশেষ করে অরুনাচল প্রদেশে। গত দুই মাস ধরে আইএসআই এর বাংলাদেশ বিভাগ এই ব্যাপারে কাজ করছে বলে খবর পাওয়া গেছে।

এর জন্য চীন অর্থ সাহায্য করছে। উত্তর পূর্ব ভারতের সাথে সীমানা রয়েছে চীনের কিন্ত এখানে পাকিস্তান এল কীভাবে? এবং অতীতে পাকিস্তান সাথে এই অঞ্চলে কী সম্পর্ক ছিল সেটা জানা দরকার আগে।

ভারতের ব্রিটিশ শাসনের সময়ে ১৯১১ সালের দিকে ভারতের ভাইসরয় ছিল লর্ড কার্জন। সেসময় উত্তর পূর্ব ভারতকে তিনটি অংশে ভাগ করেছিল লর্ড কার্জন। প্রথম অংশের নাম দেওয়া হয়েছিল প্রশাসনিক অঞ্চল। দ্বিতীয় অংশকে বলা হত প্রোটেকটিভ ফ্রন্টিয়ার। এই অঞ্চলে উপজাতিদের দমানোর জন্য ইংরেজরা প্রায়ই পুলিশ বা সেনা পাঠাতো। তৃতীয় অংশকে বলা হত স্ট্রাটেজিক ফ্রন্টিয়ার। এই অঞ্চলে ব্রিটিশ সরকার মাঝেমধ্যে অভিযান করতো যদি নতুন কোন বানিজ্য পথ খুঁজে পাওয়া যায় সেই উদ্দেশ্যে। ব্রিটিশ সরকারের সময়ে উত্তর পূর্ব ভারতের প্রশাসনিক অঞ্চল বলতে মূলত আসামকে বোঝাত। কারন এখানে চা, তেল, কয়লার জন্য এটি অর্থনৈতিক কেন্দ্র ছিল। আসামের ডিগবয়কে আসামের তেলের শহর বলা হয়। ১৮৬৬ সালে এশিয়ায় প্রথম খনিজ তেল এখানেই পাওয়া যায়। ১৯০১ সালে এখানেই দেশের প্রথম তেল কেন্দ্র তৈরি করা হয়। যার কারনে এই অঞ্চল থেকে বহু সংখ্যক স্থানীয় উপজাতিদের জোর করে সরানো হয় এবং সরাসরি ব্রিটিশরা এই এলাকা নিজেদের অধীনে নিয়ে আসে। স্বাধীনতার আগে ভারতে কিছুদিনের জন্য একটি সরকার তৈরি হয়েছিল সেখানেও ভোট দিতে দেওয়া হয়নি। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের মূলধারা থেকেও এখানের মানুষদের আলাদা রেখেছিল ব্রিটিশরা। ব্রিটিশ সরকার সবসময় এই অঞ্চলকে ভারতের মূলভাগের থেকে আলাদা ভাবে একটি দেওয়াল হিসাবে ঘিরে রেখেছিল।

১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হয়। পাকিস্তান গঠন হয় এবং আজকের বাংলাদেশ সেসময়ের পূর্ব পাকিস্তান ছিল। কিন্তু উত্তর পূর্ব ভারতে রাজ্য গঠনে একটা সমস্যা দেখা যায়। উত্তর পূর্ব ভারতে অনেক উপজাতি সম্প্রদায় ছিল। যেমন নাগাল্যান্ড গঠিত হয় নাগা উপজাতিদের নিয়েই কিন্তু নাগা উপজাতি শুধু নাগাল্যান্ডেই নয় আসামের কিছু অংশেও আছে, তাহলে কথা উঠতে শুরু করে যখন একই ধরনের উপজাতি রয়েছে তাদের একই ধরনের সরকারের অধীনেই থাকা দরকার। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকর আলি ভুট্টো একটা বই লিখেছিল মিথ অফ ইন্ডিপেনডেন্স যাতে স্পষ্ট লেখা হয়েছে কাশ্মীরের মতোই আসামও গুরুত্বপূর্ন। তার মতে আসাম সহ বেশ কিছু জেলা পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হওয়া উচিত ছিল। যার অর্থ স্পষ্ট ছিল পাকিস্তান আসাম সহ বিস্তীর্ন অঞ্চলে নাশকতার পরিকল্পনা করছিলো। জুলফিকর আলি ভুট্টো এটাও জানিয়েছিল আসামের অহিন্দু জনগোষ্ঠীর সাথে বিশেষ যোগাযোগ রাখা দরকার যতক্ষন আসাম পূর্ব পাকিস্তানে যুক্ত না হচ্ছে। ১৯৫৬ সালে নাগা ন্যাশনাল কাউন্সিল তৈরি হয়। যার লক্ষ্য ছিল নাগাল্যান্ডের স্বায়ত্তশাসন। এই দলকে প্রথমেই সমর্থন করে পাকিস্তান। নাগা ন্যাশনাল কাউন্সিলের নেতা ফিজোকে পাকিস্তান অস্ত্র সাহায্য ও গোরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষন দেবার আশ্বাস দেয়। সাথে নাগাল্যান্ডের দাবীকে আন্তর্জাতিক করবার জন্য ফিজোকে নকল পাসপোর্ট বানিয়ে ব্রিটেনে পাঠায় পাকিস্তান। এদিকে ১৯৬০ এর দিকে মিজোরামের লুসাই পাহাড়ে মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্ট বা এমএনএফ তৈরি হয়। এদের দাবী ছিল স্বাধীন মিজোরাম দেশের। এদেরও সমর্থন করে পাকিস্তান। এভাবে উত্তর পূর্ব ভারতের বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠমকে পাকিস্তান সহায়তা করতে শুরু করে এবং তারা প্রশিক্ষনের জন্য পূর্ব পাকিস্তানে যেতে শুরু করে। যার কারনে পূর্ব পাকিস্তানকে আলাদা করে বাংলাদেশ গঠন ছিল ভারতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন।

১৯৭১ সালে ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের পর বাংলাদেশ গঠন হয় ফলে উত্তর পূর্ব ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন গুলো ধাক্কা খায়। বিশেষ করে এমএনএফের নেতা লালডিঙ্গা ও তার সহকারীরা মায়ানমার পালিয়ে যায়। সেসময় মায়ানমারের আরাকান পাহাড়ে তারা আশ্রয় নেয়। মায়ানমারের কাচিন থেকে চীনের ইউনান প্রদেশে যায় এমএনএফের নেতা লালডিঙ্গা। কারন পাকিস্তান ভেঙ্গে গেছিল সুতরাং তাদের সাহায্য একমাত্র চীন করতে পারতো। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বার্মাতে সরাসরি সাহায্য করা সম্ভব ছিলনা। ১৯৭১ সালের পর থেকে ভারতের উত্তর পূর্ব রাজ্য গুলোতে অস্থিরতা তৈরি করতে সরাসরি কাজ শুরু করে চীন। চীন আবারও পাকিস্তানকে আবারও যুক্ত করে এই পরিকল্পনায়। পাকিস্তান একটা পরিকল্পনা তৈরি করে সমস্ত বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনকে একত্রিত করে একটি যৌথ সংগঠন করা। এই একই পরিকল্পনা পাকিস্তান কাশ্মীর দখল করতেও কাজে লাগিয়েছিল যে স্থানীয় মানুষকে ভারতের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা যখন কাশ্মীর প্রিন্সলি স্টেট ছিল। তবে ভারতীয় সেনাবাহিনী উপস্থিত হয়ে যাওয়ায় কাশ্মীরে পাকিস্তান সফল হয়নি। হেইন কেসলিং এর লেখা ফেইথ ইউনিটি ডিসিপ্লিন দি আইএসআই অফ পাকিস্তান বইতে তিনি বলেছেন ১৯৮০ সালের পর থেকে আইএসআই উত্তর পূর্ব ভারতে অস্থিরতা তৈরি করার কাজ শুরু করে। পাকিস্তানের উদ্দেশ্য ছিল যদি উত্তর পূর্ব ভারতকে অশান্ত করা যায় তাহলে ভারত কাশ্মীর রক্ষায় পূর্ন শক্তি প্রয়োগ করতে পারবেনা। তাহলে সেই সুযোগে পাকিস্তান কাশ্মীরে আক্রমন করতে পারবে। এই উদ্দেশ্যে আইএসআই উত্তর পূর্ব ভারতে মূলফা, মূলতা, আইএলএএ, হারকাত উল জিহাদ, হারকাত উল মুজাহিদ্দিন নামে বেশ কয়েকটি সন্ত্রাসী সংগঠন তৈরি করে।

১৯৮০ সালে কম্বোডিয়াতে সরকার পরিবর্তন হয় এবং সেখান থেকে লাইট মেশিন গান সহ অ্যাসল্ট রাইফেল সংগ্রহ করে পাকিস্তান। এইসব হাতিয়ার উত্তর পূর্ব ভারতের সন্ত্রাসী সংগঠন গুলোকে সরবরাহ করতে থাকে আইএসআই। এর জন্য বাংলাদেশের কক্সবাজার বন্দরকে ব্যবহার করা হয়। এই বন্দরের মাধ্যমেই উত্তর পূর্ব ভারতে হাতিয়ার পাঠাতে শুরু করে পাকিস্তান। ১৯৯০ সালে এক নাগা বিদ্রোহী ধরা পড়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীর হাতে যে স্বীকার করে আইএসআই তিনটি কিস্তিতে ১.৭ মিলিয়ন ডলার তাদের দিয়েছিল অস্ত্র কিনতে। কিন্তু পরে তারা নিজেরাই টাকা সংগ্রহ করতে শুরু করে হত্যা, লুঠ, অপহরন এবং ড্রাগসের মাধ্যমে। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী মায়ানমার, লাওস এবং থাইল্যান্ডের সীমানায় প্রায় সাড়ে নয় লাখ বর্গ কিলোমিটার অঞ্চলকে সোনালী ত্রিভুজ বলা হয়। এখানে সবচেয়ে বেশী আফিম চাষ হয় এবং এখান দিয়েই হেরোইন সহ বিভিন্ন ড্রাগসের সবচেয়ে বেশী চোরাকারবারি হয়। এখান থেকেই ড্রাগস উত্তর পূর্ব ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন গুলোর কাছে আসে। এসব সংগঠন বর্তমানে বেশীরভাগই লুকিয়ে আছে মায়ানমারের গভীর জঙ্গলে। আইএসআই মূলত তিনটি দেশ থেকে উত্তর পূর্ব ভারতে অশান্তি তৈরি করতে পারে মায়ানমার, বাংলাদেশ এবং নেপাল। সুতরাং উত্তর পূর্ব ভারতে শান্তি বজায় রাখতে মায়ানমার ভারতের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ন। যার জন্য মায়ানমার সেনাবাহিনীর সাথে ভারতের কুটনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। প্রয়োজনে দুইদেশের সেনাই যৌথভাবে অপারেশন করে মাঝে মধ্যে এদের শেষ করতে। এছাড়াও বাংলাদেশের সাথেও ভারতের কুটনৈতিক সম্পর্ক মজবুত যাতে আইএসআই বাংলাদেশের মাটি ব্যবহার করতে পারেনা। বিশেষ করে শিলিগুড়ি করিডরের নিরাপত্তার জন্য বাংলাদেশ ও নেপাল ভারতের জন্য গুরুত্বপূর্ন। নেপালে এর আগেও আইএসআই এর উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। কিছুদিন নেপালের সাথে ভারতের কিছু বিতর্ক ছিল তবে বর্তমানে তা মিটে গেছে এবং নেপালের সাথে আবারও ভারতের কুটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার হয়েছে। তবে চীন ও পাকিস্তান যাই করুক না কেন ভারতের র এবং সেনাবাহিনী সবরকম পরিস্থিতির জন্যই তৈরি আছে।

অপারেশন আইভার! দেশের স্বার্থে নিজেদের এজেন্টদেরকেও হত্যা করতে পিছপা হয়না ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা

সময়টা ১৯৫৪ সালের ডিসেম্বর মাসের কোন একদিন দুপুরবেলা, পূর্ব ভূমধ্যসাগরের উপর দিয়ে প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট ধীর গতিতে এগিয়ে চলেছে একটি কার্গো বিমান। আপাতদৃষ্টিতে সবকিছু স্বাভাবিক মনে হলেও বিষয়টি মোটেও স্বাভাবিক ছিলনা। বিমানের ভিতর তখন কয়েকজন লোক একটি বাক্সকে ঘিরে চিন্তায় রয়েছে। এই বাক্সকে ঘিরে চিন্তায় ছিল আরও একটি দেশও। কিছুক্ষন পর পাইলট নিশ্চিত করে আশেপাশে কোন বিমান বা জাহাজের উপস্থিতি নেই, তখনই বিমানটির পেছনের কার্গোর দরজা খুলে যায় এবং বাক্সটি সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হয়। এই বাক্সে ছিল এমন এক ব্যাক্তির মৃতদেহ যা সেসময় ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় শত্রু হয়ে উঠেছিল। এই ব্যাক্তিটির জন্যই পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ গোয়েন্দা সংস্থা ইসরায়েলের মোসাদ তাদের অত্যন্ত গোপন অপারেশন আইভার শুরু করেছিল যা শেষ হওয়ার পরবর্তী পাঁচ দশক অবধি গোটা বিশ্বের কাছে গোপন রাখা হয়েছিল।

আরো পড়ুন- প্রতাপগড়ের যুদ্ধঃ যেখানে ছত্রপতি শিবাজী মহারাজের অসাধারন রননীতির কাছে পরাস্ত হয়েছিল আফজল খানের বিশাল সেনা

পুরো মিশন শেষ হওয়া পর্যন্ত ইসরায়েল যথেষ্ট চিন্তায় ছিল।

১৯৪৯ সালে বুলগেরিয়ার এক ইহুদি পরিবারের তিন ভাই ইসরায়েলের হাইফা শহরে আসে কাজের সন্ধানে। ইসরায়েল সেসময় সদ্য তৈরি হয়েছে। বিশ্বের সমস্ত প্রান্ত থেকে ইহুদিরা দলে দলে তাদের নিজেদের দেশ ইসরায়েলে আসতে শুরু করেছিল। এই তিনভাইয়ের বড় ভাই ছিল আলেকজান্ডার ইসরায়েল, আকর্ষিক চেহারা, অসাধারন ব্যাক্তিত্ব এবং ব্যাপক বুদ্ধির জন্য খুব সহজেই সে ইসরায়েলের সেনাবাহিনীতে কাজ পায় এবং সেখান থেকে পরে ইসরায়েলের নৌবাহিনীতে অ্যানালিস্টের পদে যোগ দেয়। ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার এবং নতুন ধরনের অস্ত্র তৈরিতে সে সিদ্ধহস্ত ছিল। তার দক্ষতার কারনে অল্প সময়ের মধ্যেই সে তার উদ্বর্তনদের সুনজরে পড়ে যায়। যার কারনে খুব তাড়াতাড়িই আলেকজান্ডার ইসরায়েলি নৌবাহিনীর ক্যাপ্টেন পদ পায় এবং প্রতিরক্ষা সেক্টরের অনেক গোপন বিষয়েও তাকে যুক্ত করা হয়। ১৯৫৩ সালে আলেকজান্ডার তার নাম পরিবর্তন করে আভনির রাখে এবং তুরস্কের বংশদ্ভূত মার্টিলদা আর্টিরি নামে এক সুন্দরী মহিলাকে বিবাহ করে। দুজনে হাইফাতে বসবাস শুরু করে কারন এখানেই ইসরায়েল নৌবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি ছিল। আর পাঁচজন সদ্য বিবাহিত দম্পতির মতো তারাও যথেষ্ট সুখে জীবন কাটাতে থাকে। কিন্তু মার্টিলদা জানতনা যে আভনিরকে সে বিয়ে করেছে সে আদতে একজন অত্যন্ত খারাপ ব্যাক্তিত্বের মানুষ। আকর্ষক চেহারা ও ব্যাক্তিত্বের জন্য সুপরিচিত আলেকজান্ডার ওরফে আভনিরের ভিতরের রূপ সম্পর্কে কেউই জানত। মুখোশের আড়ালে আলেকজান্ডার ছিল অত্যন্ত নিষ্ঠুর এক ব্যাক্তি এবং তার অতীত ছিল অপরাধে পরিপূর্ণ। আলেকজান্ডার রিয়েল এস্টেট সংস্থার নামে অনেক দূর্নীতি করেছিল, একটি নামি ফ্রিজ সংস্থার নকল বিক্রেতা হিসাবে মানুষদের কাছ থেকে অনেক টাকা নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল। এরকম অনেক কাজে সে যুক্ত ছিল। ১৯৫৪ সালের ৮ নভেম্বর এরকমই একটি মামলায় তাকে আদালতে হাজিরা দিতে বলা হয়। এরই মধ্যে আলেকজান্ডার হাইফাতে ইটালিয়ান দূতাবাসের এক মহিলা কর্মীর সাথে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে যার ব্যাপারে তার স্ত্রী মার্টিলদা কিছুই জানতনা। ইটালিয়ান মহিলার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে আলেকজান্ডার তাকে বিবাহের প্রস্তাব দিয়ে বসে, এসব ঘটে যেসময় সেসময় মার্টিলদা প্রেগন্যান্ট ছিল। সেই ইটালিয়ান মহিলা বিবাহের জন্য আলেকজান্ডারকে ইহুদি ধর্ম পরিবর্তন করে ক্যাথলিক খ্রীষ্টান ধর্ম গ্রহনের শর্ত দেয় যাতে আলেকজান্ডার রাজি হয়ে যায় কারন এটা তার কাছে নতুন কিছু ছিলনা৷ এর আগে বুলগেরিয়াতে থাকার সময়ে তার সাথে একটি খ্রীষ্টান মেয়ের প্রনয়ের সম্পর্ক ছিল যা মেয়েটির বাড়ির লোক জানতে পেরে বন্দুকের ডগে জোর করে আলেকজান্ডারের ধর্ম পরিবর্তন করে মেয়েটির সাথে তার বিয়ে দেয়৷ এর কিছুদিন পরেই আলেকজান্ডার বুলগেরিয়া থেকে ইসরায়েল পালিয়ে আসে, সেই মেয়েটি তা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করে।

ইটালিয়ান মহিলাটিকে বিবাহ করার জন্য আলেকজান্ডার তার নাম আভনির থেকে পরিবর্তন করে আইভার রাখে। সবকিছু ঠিক চলছিল ১৯৫৪ সালের ৭ নভেম্বর ইটালিয়ান প্রেমিকার সাথে তার বিবাহের দিন নিশ্চিত হয় অর্থাৎ ৮ নভেম্বর আলেকজান্ডারের আদালতে উপস্থিত হবার একদিন আগে। কিন্তু এরই মধ্যে আলেকজান্ডারের মন ইটালিয়ান প্রেমিকার থেকে উঠে যায় এবং সে বিবাহ ও আদালত থেকে বাঁচতে একটি পরিকল্পনা তৈরি করে যাতে সে ইসরায়েলের সাথেই বেইমানি করবার সিদ্ধান্ত নেয়। ৪ নভেম্বর আলেকজান্ডার ইসরায়েল থেকে পালিয়ে যায়। তার এই পালিয়ে যাওয়ায় তার স্ত্রী মার্টিলদা, প্রেমিকার থেকেও মোসাদ চিন্তায় পড়ে যায়। কারন আলেকজান্ডার ছিল ইসরায়েল নৌবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ অফিসার এবং অনেক গোপন তথ্য তার কাছে ছিল। এরই মধ্যে ইটালিতে থাকা আরব দূতাবাসের কর্মীদের থেকে মোসাদের কাছে খবর আসে আলেকজান্ডার ইসরায়েলের সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মিশরকে বিক্রি করেছে। সেসময় মিশরের নেতৃত্বে আরব দেশগুলো ছিল ইসরায়েলের শত্রু, স্বভাবতই মোসাদ চিন্তায় পড়ে এবং মোসাদ তার সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ এজেন্টদের আলেকজান্ডারকে খুঁজে বের করতে নির্দেশ দেয়। মোসাদ আরও জানতে পারে আলেকজান্ডার পনেরো হাজার আমেরিকান ডলারের বিনিময়ে ইসরায়েল সেনাবাহিনীর বেসের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মিশরকে দিয়েছে। আরও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেবার জন্য মিশর তাকে কায়রো ডেকেছে এবং বিনিময়ে আরও অত্যাধিক মূল্য দেওয়া হবে। মোসাদ স্পষ্ট বুঝতে পেরেছিল আলেকজান্ডার কায়রো পৌঁছালে ইসরায়েলের সমস্ত গোপন তথ্য ফাঁস হয়ে যাবে। তাই সেইসময়ের মোসাদ প্রধান আইজার হ্যারেল একটি বিশেষ দল তৈরি করে যার লক্ষ্য ছিল অপারেশন আইভার যাতে আলেকজান্ডারকে কায়রো পৌঁছাতে না দিয়ে ইসরায়েলে ফিরিয়ে আনা। এই দলের নেতৃত্বে ছিল মোসাদের সেসময়কার সবচেয়ে সেরা এজেন্ট রাফি এইথেন।

মোসাদের দল এরপর রোম রওনা হয় কারন মোসাদের কাছে খবর ছিল রোম বিমানবন্দর থেকে আলেকজান্ডার কায়রো যাবে। রাফি এইথেনকে স্পষ্ট নির্দেশ দেওয়া ছিল প্রয়োজনে মেরে ফেলেও আলেকজান্ডারকে কায়রো যাওয়া আটকাতে হবে। তবে একবারে শেষমূহুর্তে আলেকজান্ডার রোম বিমানবন্দর দিয়ে কায়রো যাওয়া বাতিল করে। এরপর সে যেন হাওয়ায় মিলিয়ে যায়, ইউরোপের বিভিন্ন দেশ খুঁজেও তাকে পাওয়া যাচ্ছিলনা। কিন্তু ভাগ্য যেন মোসাদের উপর সুপ্রসন্ন ছিল। একদিন হঠাৎই মোসাদের হেড কোয়ার্টারে ভিয়েনা থেকে ফোন আসে। ফোনে ভিয়েনার এক মোসাদ এজেন্ট আলেকজান্ডারকে অদ্ভুতভাবে খুঁজে পাওয়ার ঘটনা জানায়। ঘটনাটা এইরকম যে ওই এজেন্টের স্ত্রী সেদিন সকালে এসে তাকে জানায় তার এক পুরোনো বন্ধুর সাথে দেখা হয়েছে যার সাথে কাল দুপুরে খেতে যাবে, বন্ধুর নাম বলে সে আলেকজান্ডার ইসরায়েল! এরপরই ভিয়েনাতে মোসাদের সমস্ত নেটওয়ার্ক আলেকজান্ডারের উপর নজর রাখতে শুরু করে। আলেকজান্ডার এর কিছুই বুঝতে পারেনা। এর কিছুদিন পর প্যারিস যাবার জন্য ভিয়েনা থেকে বিমানে ওঠে আলেকজান্ডার। তার সিটের পাশেই একজন খুব সুন্দরী মহিলার সিট ছিল। সুন্দরী মহিলাদের প্রতি আকর্ষন প্রথম থেকেই ছিল আলেকজান্ডারের, স্বভাবতই সে ওই মহিলার সাথে ভাব জমিয়ে ফেলে। তাদের মধ্যে এত ভাল সম্পর্ক গড়ে ওঠে যে প্যারিসে নামার পর ওই মহিলার সাথে তার বাড়িতে যেতে একটি গাড়িতে ওঠে আলেকজান্ডার। গাড়িতে উঠতেই আগে থেকে সেখানে থাকা একজন ব্যাক্তি আলেকজান্ডারের মুখে ঘুষি মেরে তাকে অজ্ঞান করে দেয়। এই ব্যাক্তিটি ছিল রাফি এইথেন এবং ওই সুন্দরী মহিলাটাও একজন মোসাদ এজেন্ট। প্যারিসে মোসাদের আস্তানায় দীর্ঘক্ষন জিজ্ঞাসাবাদের পর আলেকজান্ডার তার অপরাধ স্বীকার করে এবং মোসাদ নিশ্চিত হয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আলেকজান্ডার তখনও মিশরকে দিতে পারেনি। এরপর শুরু হয় তাকে ইসরায়েলে ফিরিয়ে আনার কার্যক্রম। প্যারিস থেকে সপ্তাহে একদিন করে ইসরায়েল বায়ুসেনার একটি বিমান কার্গো নিয়ে যেত যা মাঝে এথেন্সে জ্বালানির জন্য দাঁড়াত এবং তারপর আবার ইসরায়েল যেত। এতেই আলেকজান্ডারকে নিয়ে আসার পরিকল্পনা করা হয়। প্যারিসে মোসাদের আস্তানা থেকে বিমানবন্দর অবধি পথে আলেকজান্ডারকে একটি বাক্সে রেখে ড্রাগস দিয়ে অচেতন করে নিয়ে আসা হয় এবং বিমানে ওঠানো হয়। মাঝে মাঝেই ড্রাগস ইনজেক্ট করা হতে থাকে। কিন্তু অতিরিক্ত ড্রাগসের কারনে ইসরায়েল পৌঁছাতে পৌঁছাতে হার্ট অ্যাটাকে মারা যায় আলেকজান্ডার। যার জন্য তার মৃতদেহ লুকিয়ে ভূমধ্যসাগরে ফেলে দেওয়া হয়। সেসময় আজকের মতন ইসরায়েল এত শক্তিশালী ছিলনা, ফলে এই ঘটনা জানাজানি হলে সদ্য গঠন হওয়া ইসরায়েলের উপর রাজনৈতিক চাপ আসত, যার জন্য প্রায় পঞ্চাশ বছর এই ঘটনা লুকিয়ে রেখেছিল মোসাদ। বহুদিন পর্যন্ত আলেকজান্ডারের স্ত্রী, ছেলে, ভাই বিশ্বাস করত সে দক্ষিন আমেরিকার কোন দেশে আছে। এভাবেই মোসাদ গোপনে তার শত্রুকে শেষ করে দেয় ইসরায়েলের নিরাপত্তা অক্ষুন্ন রাখতে।