বাংলা সাহিত্যের বটগাছ নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী - Bangla Hunt

বাংলা সাহিত্যের বটগাছ নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী

By Bangla Hunt Desk - December 26, 2022

শুধু অসাধারণ সাহিত্য সৃষ্টিই কি একজন সাহিত্যকারের মাপকাঠি। স্বয়ং ভাষার কাছেও তার দায় যে অপরিসীম। আসলে এমন বহু প্রিয় এবং বিশিষ্ট সাহিত্যকার আছেন যারা তাদের লিখনশৈলী এমন তারে বেঁধেছেন যা আমাদের মুগ্ধ করে রাখে যুগের পর যুগ ধরে। ভাষার ব্যবহারে এরা অনুনকরণীয়। আবার এমনও সাহিত্যকার আছেন যারা নিঃসাড়ে কাজ করে যান পাল্টে দেন ভাষার ব্যবহার, এক নতুন যুগ নিয়ে আসেন আড়ম্বর ছাড়াই। তাদের হাতের কলমই তাদের ছেনি হাঁতুড়ি। এই শেষ দলের এক পরম শ্রদ্ধেয় নাম নরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। তিনি একাধারে কবি, গদ্যকার, শিশুসাহিত্যিক, সম্পাদক, সাংবাদিক – লিস্ট অনেক লম্বা। নীরেন্দ্রনাথ, বলা ভাল ‘নীরেন দা’র সংস্পর্শে যারাই এসেছেন, সবারই কিছু না কিছু স্মৃতি রয়ে গেছে। এখন তো, সেই স্মৃতিগুলোকেই উস্কে নেওয়া।

পুব বাংলায় জন্মেছিলেন তিনি। সেখানকার প্রকৃতির স্পর্শেই কেটেছে শৈশব। নিজের ভেতর সবসময় নিয়ে চলতেন সেই মাঠ, ক্ষেত, রেল স্টেশন। বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে মানবপ্রকৃতিকে নিবিড়ভাবে দেখতেন। সেই নিয়েই একদিন কলকাতায় পা। ১৯৫৪। সিগনেট থেকে বের হল প্রথম কবিতার বই ‘নীলনির্জন’। তারপর কত বই, কত সম্মান পেয়েছেন তিনি। সে-বৃত্তান্ত এখন থাক। কবিতা, গল্প, সবেতেই যে তাঁর প্রধান নায়ক ছিল মানুষ, সে কথা বারবার দ্ব্যর্থহীন হয়ে বলেছেন তিনি।

নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী

নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী মনে করতেন, ‘‘কঠিন ভাষা যারা বলে, শোনে ও বোঝে, সহজ ভাষা বলে শোনে ও বোঝে তার চতুর্গুণ মানুষ। আর তাই আমার কবিতা যদি অনেক লোকের কাছে পৌঁছে দিতে হয় তো ভাষার স্তর নির্বাচনে কোনও ভুল করলে আমার চলবে না, সহজ বাংলার জনপথ ধরেই আমাকে হাঁটতে হবে।’’ কবি, লেখক, অনুবাদক, সম্পাদক, বাংলা ভাষার নীতি-নির্ধারক হিসেবে তিনি যা কিছু করেছেন তার মূল নীতিই ছিল লেখা ‘‘আরও অনেকের কাছে পৌঁছে দিতে চাই।’’

‘বাঙ্গালার পাঠক পড়ান ব্রত’ নামের অস্বাক্ষরিত লেখায় বঙ্গদর্শন পত্রে মন্তব্য করা হয়েছিল – ছাপাখানা আসার আগে কথকেরা পড়তে-না-জানা মানুষের কাছেও বলার গুণে তাঁদের বার্তা পৌঁছে দিতেন, এখন লেখক সম্পাদকের দায়িত্ব পড়তে-জানা-মানুষদের পাঠক হিসেবে গড়ে তোলা। আনন্দমেলা-র সম্পাদক নীরেন্দ্রনাথ এই পত্রিকার মাধ্যমে ভবিষ্যৎ পাঠকদের রুচি গড়ে তুললেন। এখন পঁয়ত্রিশ থেকে পঞ্চাশের মধ্যবর্তী যে বাঙালিরা বিশ্বের নানাখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন তাঁদের অনেকেই এই পত্রিকা পড়ে বাংলা ভাষায় মজেছেন। অনুবাদে বাংলা ভাষার সীমাকে যেমন তিনি সম্প্রসারিত করলেন তেমনি বাংলা ভাষার অল্পবয়স্ক পড়ুয়াদের ভাষাটির প্রতি মনোযোগী করে তোলার জন্য কাজে লাগালেন ভাষাবিদ পবিত্র সরকার ও কবি শঙ্খ ঘোষকে। স্কুলে স্কুলে তখনও ডাক্তারের প্রেসক্রিপশনের মতোই তেতো বাংলা ব্যাকরণ পড়ানো হত, আনন্দমেলার পাতায় কিন্তু প্রকাশিত হত ‘বাংলা বলো’। মুখের সজীব বাংলার রীতি-নীতি তাই ‘আমেরিকা ফেরত’ পবিত্র সরকারের লেখার বিষয়। শঙ্খ ঘোষ ‘কুন্তক’ ছদ্মনামে লিখতেন শব্দ নিয়ে খেলা। ‘বানানের শুদ্ধি-অশুদ্ধি বিচার’ নিয়ে এমন সহজ-গভীর বই বাংলায় দু’টি নেই।

‘কবিতার ক্লাস’ নেওয়া মাস্টারমশাই নীরেন্দ্রনাথ জনপ্রিয় হলেও, ওঁর আরেকটা কাজ ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ। ছিল কেন, আজও আছে। ‘বাংলা কী লিখবেন, কেন লিখবেন’। আনন্দবাজারের বানানবিধি, কাগজের প্রুফ দেখা, লেখার ধরন – সমস্ত কিছুকেই দুই মলাটে রেখেছিলেন তিনি। আজও, তরুণ সাংবাদিকদের কাছে এই বইটি সর্বক্ষণের সঙ্গী।

বাংলা ভাষার প্রমিত রূপ নির্মাণের যে চেষ্টা তাঁর সম্পাদনায় আনন্দমেলার পাতায় শুরু হয়েছিল, পরে তা সম্প্রসারিত রূপ পেল। বাংলা কী লিখবেন কেন লিখবেন নামের বিধিগ্রন্থ নীরেন্দ্রনাথ গড়ে তুলেছিলেন। ঢাকা বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত দু’খণ্ডের প্রমিত বাংলা ভাষার ব্যাকরণের অন্যতম উপদেষ্টা ছিলেন তিনি। চলিতের প্রতি, পথচলতি মানুষের প্রতি তাঁর বরাবর পক্ষপাত। তখন তিনি ‘ল কলেজের’ ছাত্র, আজ়াদ-হিন্দ ফৌজের বন্দি সেনাদের মুক্তির ছাত্র-আন্দোলনে পুলিশি হামলা। রাস্তার ওপর চাপ-চাপ রক্ত, ছেঁড়া বইখাতা, চপ্পলের পাটি, ভাঙা চশমা। নিহত হলেন তরুণ রামেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৯৪৫-এর নভেম্বর মাসের সেই ঘটনা নিয়ে লেখা কবিতা ‘শহিদ রামেশ্বর’। দেশ পত্রিকায় পাতা জুড়ে ছাপা হল। পথের মানুষদের সম্বন্ধে বিশ্বাস দৃঢ় ছিল বলেই এক সময় জীবনানন্দের কবিতায় তিনি দেখেছিলেন ‘আত্মঘাতী ক্লান্তি।’

১৯২৪ সালের ১৯ অক্টোবর অবিভক্ত ভারতের ফরিদপুরে তাঁর জন্ম। প্রাথমিক পড়াশোনা সেখানকার পাঠশালায়। পরে ১৯৩০-এ কলকাতায় চলে আসা। শহরের মিত্র ইনস্টিটিউশন, বঙ্গবাসী এবং সেন্ট পলস কলেজে পড়াশোনা। ১৯৫১ সালে আনন্দবাজার পত্রিকায় কাজে যোগ দেন। একটা দীর্ঘ সময় তিনি ‘আনন্দমেলা’ পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। কবির পাশাপাশি নীরেন্দ্রনাথ ছিলেন ছড়াকার, প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক, গদ্যকার, গোয়েন্দা-গল্পকার, শিশুসাহিত্যিক, ভ্রমণ-কাহিনির লেখক, সম্পাদক এবং বানান-বিশেষজ্ঞ।

ছোটবেলা থেকেই ছড়া লিখতেন নীরেন্দ্রনাথ। ১৯৫৪ সালে প্রকাশ পায় তাঁর প্রথম কবিতার বই ‘নীল নির্জন’। তখন কবির বয়স ৩০। তার পর একে একে প্রকাশ পায় ‘অন্ধকার বারান্দা’, ‘নিরক্ত করবী’, ‘নক্ষত্র জয়ের জন্য’, ‘আজ সকালে’… অজস্র কবিতার বই। পেয়েছেন আনন্দ পুরস্কার, সাহিত্য অকাদেমি। ১৯৯০-এ বিশ্ব কবি সম্মেলনে ভারতের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেন তিনি। একটা সময়ে ‘দেশ’ পত্রিকায় বেশ কিছু ছোটগল্প লিখেছেন। সেই লেখাও পাঠক মহলে সাড়া ফেলে দিয়েছিল। তাঁর লেখা কবিতা ‘অমলকান্তি রোদ্দুর হতে চেয়েছিল…’ বা ‘রাজা তোর কাপড় কোথায়…’ বাঙালির কাছে রীতিমতো প্রবাদে পরিণত হয়েছে।

মুখে স্বকীয়তা নিয়ে বেঁচে থাকার শিক্ষা আজও আমাদের পাথেয় এবং তাই থাকবে চিরটাকাল।

শুধু শিল্পী বা শিল্প নিয়েই নয়। নীরেন্দ্রনাথ ছিলেন একজন সমাজ সচেতন কবি, সমাজ এবং আগামীর প্রতি তাঁর দায়িত্ববোধ ছিলো অপরিসীম। সামাজিক বিভেদ, মসজিদ না মন্দির এই প্রসঙ্গে কবি নীরেন্দ্রনাথের মনে হয়েছে যে লেংটি পরা ক্ষুধার্ত, খেটে খাওয়া মানুষের কাছে এই প্রশ্ন নিতান্ত অবান্তর, তিনি মনে করতেন :-

“পিতলের থালায় এক চিমটি নুন ছিটিয়ে
ছাতু ঠাসতে-ঠাসতে
তবুও যে তারা হাসছে, তার কারণ, তাদের
একজনের নাম হতেই পারত সিকান্দর শাহ্‌ আর
অন্যজনের সেলুকাস”

শুধু কি বড়দের জন্যেই লিখেছেন তিনি! ছোটোদের জন্য তাঁর সেরা উপহার অনন্দমেলার অসাধারণ সম্পাদনা। একসময় আনন্দমেলা বছরে একটি বার প্রকাশিত হত। ক্রমে ক্ষুদে, কচি-কাঁচাদের হাতে আনন্দমেলা পৌঁছাতে লাগলো প্রতি মাসে। অসাধারণ প্রবন্ধ, গল্প, কবিতা, ধাঁধা, এবং বাংলা কমিকস সমৃদ্ধ এই কিশোর ম্যাগাজিন বহু ছেলে-মেয়ের বেড়ে ওঠার বছরগুলোর শ্রেষ্ঠ সহায় ছিলো। বহু বড়দের লেখকের কলম থেকে শিশু সাহিত্যের ফোয়ারা ছুটিয়েছেন এই নীরেন্দ্রনাথ। তাঁর বদান্যতায় আমরা পেয়েছি বাংলায় অনূদিত টিনটিন! স্নোয়ির বদলে কুট্টুসকে, জনসন-রনসনকে! নিজেই নীরেন্দ্রনাথ ছিলেন অনুবাদকের ভূমিকায়।

অতিক্রান্ত হবার আগেই তাঁর জন্ম; অথচ আশ্চর্য ব্যাপার, সেই শতকের প্রান্তরেখা সম্পূর্ণ পেরিয়ে গিয়ে যখন নূতন শতকে ঢুকছেন, তাঁর পদক্ষেপ তখনও সমান দুঃসাহসী, তখনও জরার জং ধরেনি তাঁর কবিকণ্ঠে। এই রুগ্ন সমাজের ব্যাখ্যাতা তিনি, এই দুঃসময়ের ভাষ্যকার। প্রেম, প্রতিবাদ, করুণা, কৌতুক, ব্যঙ্গ, বেদনা, শ্লেষ ও সহানুভূতির এক আশ্চর্য সংমিশ্রণ ঘটেছে তাঁর কবিতায়, যার দীপ্তি ও দ্যোতনা আমাদের গোটা জীবন জুড়ে ছড়িয়ে যায়।

সব খবর পড়তে আমাদের WhatsApp গ্রুপে যুক্ত হোনএখানে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *


প্রাসঙ্গিক খবর