Bangla Hunt Digital

সেকালের কলকাতার বসন্তোৎসব

সেকালের কলকাতার বসন্তোৎসব

রানা চক্রবর্তীঃ কলকাতার বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায় যে, অতীতের কলকাতা শহরে বসবাসকারী বিভিন্ন প্রদেশের ও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ দোল উৎসবকে একটি উচ্ছৃঙ্খল আমোদে পরিণত করে তুলেছিলেন। কিন্তু পরিবেশ, রুচি ও শিক্ষা সংস্কৃতির সমন্বয়ে তখনকার দোল উৎসবটি কেমন মনোরম ও শিল্পশ্রীমণ্ডিত হয়ে উঠেছিল, সেকথা জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবারের তিন প্রজন্মের স্মৃতিচারণে খুব স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এই প্রসঙ্গে ‘অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর’ অনেক কথা জানিয়েছিলেন। দোলের আমোদে-প্রমোদে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির সেদিনগুলো বড়ই আনন্দের দিন ছিল। তখন ঠাকুরবাড়ির বন্ধুবান্ধবেরা দোল উপলক্ষ্যে সেখানে এসে মিলিত হতেন। অক্ষয়বাবুর তানপুরা বাজানো সকলে মুগ্ধ হয়ে শুনতেন। শুধুই কী তানপুরা বাজানো আর সংগীত পরিবেশনেই ওই সময়ের ঠাকুরবাড়ির দোলের আনন্দ মিটে যেত, মোটেই তা নয়! একই সাথে আরো মনোহর আয়োজনও করা হত। এমনকি নৃত্যগীতি পরিবেশনের জন্য তখন বাইরে থেকে ‘নাচিয়ে’ও সেখানে আসতেন। প্রিন্স দ্বারকানাথের কাল ততদিনে অস্তমিত হয়েছিল; তাঁর বিলাসী-জীবন তখন প্রায় গল্পকথা হয়ে গেলেও, ঠাকুরবাড়ির দোলের আমোদে কিন্তু কোন ভাটা পড়েনি। অবনীন্দ্রনাথ তাঁর ‘জোড়াসাঁকোর ধারে’ গ্রন্থে পিতা ‘গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুরের’ কথা বলেছিলেন। শিল্পী মনের মানুষ গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুরবাড়ির দোল উৎসবকে মনোরম ও সৌন্দর্যমণ্ডিত করে তুলেছিলেন। অবনীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “দোতলায় বাবামশায়ের বৈঠকখানায় হোলি উৎসব হত। সেখানে যাবার হুকুম ছিল না। উঁকিঝুঁকি মারতুম, এদিক ওদিক থেকে। আধহাত উঁচু আবীরের ফরাস। তার উপর পাতলা কাপড় বিছানো। তলা থেকে লাল আভা ফুটে বের হচ্ছে। বন্ধুবান্ধব এসেছেন অনেক …। ঘরে ফুলের ছড়াছড়ি। বাবামশায়ের সামনে গোলাপ জলের পিচকারি। কাঁচের গড়গড়া, তাতে গোলাপ জলে গোলাপের পাপড়ি মেশানো। নলে টান দিলেই জলে পাপড়িগুলো ওঠানামা করে। সেবার এক নাচিয়ে এল। ঘরের মধ্যে নন্দ ফরাস এনে রাখল মস্ত বড় আলোর ডুম। নাচিয়ে ডুমটি ঘুরে ঘুরে নেচে গেল। নাচ শেষ হলে দেখা গেল পায়ের তলায় একটি আলপনার পদ্ম আঁকা। … অদ্ভুত সে নাচ!” তবে সেই আনন্দযজ্ঞে সবার নিমন্ত্রণ ছিল না। ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধবদের মাঝে বসে, খানিক আভিজাত্যের গরিমায় গুণেন্দ্রনাথ তারিয়ে তারিয়ে সেই আনন্দ উপভোগ করতেন। ৬নং জোড়াসাঁকোর বাড়িতে ‘দেবেন্দ্রনাথ’ ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করবার পরে হিন্দুধর্মের পৌত্তলিক অনুষ্ঠানাদি বর্জন করলেও – জামাইষষ্ঠী, ভাইফোঁটা, দোল প্রভৃতি অনুষ্ঠান ও লোকাচার বজায় রেখেছিলেন। তাই ৬নং বাড়িতেও দোল খেলা হত। অবনীন্দ্রনাথ তাঁর ছোট বয়সে নিজেদের দোল খেলার কথা বলতে গিয়ে লিখেছিলেন, “আমাদের জন্য আসত টিনের পিচকারি৷ … বালতি ভরা লাল জলে ডুবিয়ে যাকে সামনে পাচ্ছি পিচকারি দিয়ে রঙ ছিটিয়ে দিচ্ছি। আর তাঁরা চেঁচামেচি করে উঠছে। দেখে আমাদের ফূর্তি কি।” এরপরে তিনি আরো লিখেছিলেন, “দোলের দিনে আবির নিয়ে এ বাড়ি (৫নং) ও বাড়ি (৬নং) অন্দরে ঢুকে বড়দের পায়ে দিতুম, ছোটদের মাথায় মাখাতুম।” দোলের দিন ঠাকুরবাড়ির ছোটদের আনন্দলাভের মধ্যে যে নির্মলতা ছিল, বড়দের ক্ষেত্রে অবশ্য সেটার ঘাটতি থেকে যেত। তবে সেদিন ঠাকুরবাড়ির দেউড়িতে অন্য ছবি দেখতে পাওয়া যেত। সেখানে আনন্দ বিতরণের দেদার ব্যবস্থা করা হত; ঢোল বাজত, গানের সঙ্গে নাচও হত। এমনকি ‘রাজপুতানী’ নিয়ে এসে কোথাও নাচের আসরও বসানো হত, এবং সেই আসরে ছোটদেরও অবাধ প্রবেশাধিকার ছিল। দোলের দিন ঠাকুরবাড়ির আনন্দকে আরো বাড়িয়ে তোলার জন্যই প্রকাণ্ড একটা পাত্রে সিদ্ধি গোলা হত। দেউড়ির দিকে ঢোলের তালে তালে আবির উড়ত, আর মাঝে মাঝেই ‘হোরি হ্যায় হোরি হ্যায়’ বলে আনন্দোল্লাস শুনতে পাওয়া যেত। দোলের দিন ঠাকুরবাড়ির ছোটরা দারোয়ানদের একটুও ভয় পেত না। ফলে দোলের দিনে মনোহর সিংয়ের দাড়িতেও রং লেগে তাঁর ধপধপে সাদা দাড়ি রং বদল করে টকটকে লাল হয়ে উঠত। বাড়ির ছোটরা তাঁর কাছে গিয়ে দাড়িতে আবির মাখিয়ে দিত। দেউড়িতে দারোয়ানদের দোলোৎসবই অবনীন্দ্রনাথকে বেশি আকর্ষণ করত। তাঁর মনে হয়েছিল, “বৈঠকখানা আর দেউড়ির উৎসব, এ দুটোর মধ্যে আমার লাগত ভালো রাজপুত দারোয়ানদের উৎসবটাই। বৈঠকখানায় শখের দোল, শৌখিনতার চূড়ান্ত সেখানে লটকানে-ছোপানো গোলাপি চাদর, আতর, গোলাপ, নাচ, গান, আলো ফুলের ছড়াছড়ি। কিন্তু সত্যি দোল-উৎসব করত দারোয়ানরাই – উদ্দণ্ড উৎসব, সব লাল, চেনবার জো নেই। সিদ্ধি খেয়ে চোখ দুটো পর্যন্ত সবার লাল। দেখলেই মনে হত হোলিখেলা এদেরই। … বৈঠকখানার উৎসব ছিল কৃত্রিম, তাই তা ভালো লাগত না আমার।” পরবর্তীকালে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির সেই দোল যে রবীন্দ্র ভাবনায় শান্তিনিকেতনে নতুনতর ব্যাপ্তি পেয়েছিল, সেটা এখন আর কারো অজানা নয়। তাঁর লেখা “ওরে গৃহবাসী খোল দ্বার” – গানে গানে মানুষের মনের রুদ্ধ দরজা আনন্দ-হিল্লোলে আজও খুলে যায়। তবে সেটা অন্য প্রসঙ্গ। সেকালের ঠাকুরবাড়িতে দোলের আনন্দ বাড়ির সকলেই উপভোগ করতেন, তাঁরা যে যাঁর নিজের মতো করে আনন্দ খুঁজে নিতেন। ছোটরা সমবয়েসিদের রং দিতেন, বড়দের আবির দিতেন। বড়রা ‘শখের দোলে, শৌখিনতার চূড়ান্তে’ মেতে উঠতেন। বাড়ির মেয়ে-বউরাও সেই আনন্দ থেকে বঞ্চিত হতেন না। তাঁরাও সানন্দে, সাড়ম্বরে সেই উৎসবে শামিল হতেন। তখন ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা দোলের দিন নিজেদের শুধু সাজিয়ে তুলতেন না, রাঙিয়ে তুলতেন। সকালের দিকে রঙে রঙে রঞ্জিত হয়ে সেই রং ধুয়েমুছে সাফ করে বিকেলে তাঁরা নতুন করে সেজে উঠতেন। তবে তখনকার ঠাকুরবাড়ির সব উৎসবে তাঁরা একই রকমভাবে নিজেদের সাজিয়ে তুলতেন না। তাঁদের সাজসজ্জায় যথেষ্ট বৈচিত্র ছিল। কারণ খালি সাজলেই তো হয় না, সেই সাজ পরিবেশ পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিয়ে উপযোগী হওয়ারও প্রয়োজন রয়েছে। সেকালের ঠাকুরবাড়ির দোল খেলা নিয়ে গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মেয়ে ‘পূর্ণিমা’ও অনেক কথা লিখেছিলেন। “দোলের দিন সকাল থেকে তোড়জোড় চলত। পিচকারি, রং আসছে। আগের দিন ঠাকুরের পুজোর চাঁচর হত। তার পরদিন বারটা অবধি আবির খেলা হত। বাগান, বাড়ি লাল হয়ে যেত। বোতল বোতল গোলাপ জল ঢেলে রং গোলা হত! আমাদের খেলার পর বাবা-কাকাদের খেলা শুরু হত। খেলা শেষ করে খেতে তিনটে চারটে বেজে যেত। পাড়ার এ বাড়ি ও বাড়ি থেকে অনেকেই আসতেন। … তারপর সন্ধ্যের সময় বসে গানবাজনা হত।” ‘দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের’ পৌত্র ‘সৌম্যেন্দ্রনাথ’ও সেকালের ঠাকুরবাড়ির দোলের কথা লিখতে গিয়ে বলেছিলেন, “আমরাও দোল খেলতুম প্রতি বৎসর। ও বাড়ির (৫নং) বাগানে লতা ঢাকা চায়ের ঘরে বসত আমাদের ছেলেদের আড্ডা। আমাদের বন্ধুরা এসে জুটতো। গাইতুম আমি হোলির গান আর আমার জ্যাঠতুতো ভাই নরেন্দ্র (গগনেন্দ্রনাথের ছেলে) নাচত। বাড়ির মধ্যে মেয়েরাও দোল খেলতেন।” রবীন্দ্রনাথের কনিষ্ঠা কন্যা ‘মীরা’ এবং সৌম্যেন্দ্রনাথের স্মৃতিতে অতীতের ঠাকুরবাড়ির একটি পারিবারিক দোল খেলার মধুর স্মৃতি চিরকাল উজ্জ্বল হয়ে ছিল। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী ‘জ্ঞানদানন্দিনী দেবী’, একবার জোড়াসাঁকো পরিবারের প্রায় সকলকেই তাঁদের স্টোর রোডের বিশাল বাড়িতে দোল খেলতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। এই প্রসঙ্গে মীরা লিখেছিলেন, “একবার দোলের দিন মেজমা (জ্ঞানদানন্দিনী) জোড়াসাঁকো বাড়ির সবাইকে দোল খেলতে নিমন্ত্রণ করেছিলেন। রং খেলা হয়ে গেলে সবাই গেলেন পুকুরে স্নান করতে। স্টোর রোডের বাড়িতে দুটো পুকুর ছিল। একটা পুকুর ছিল একটু পিছন দিকে। বউঠানরা এইখানে স্নান করবেন ঠিক করলেন। সেদিন বউঠানদের খুব আমোদ হয়েছিল। জোড়াসাঁকো বাড়িতে থাকেন তাঁরা, পুকুরে স্নানের এরকম সুযোগ পাবেন কেমন করে। স্নানের পর মেজমা ছেলেদের ও বউদের সবাইকে নতুন কাপড় দিলেন পরতে। একতলার একটা বড় ঘরে খাওয়ার আয়োজন করা হয়েছিল। সাদা পাথরের মেঝের উপর কলাপাতার বদলে দিয়েছিলেন বড় বড় পদ্মপাতা৷” সৌম্যেন্দ্রনাথও জ্ঞানদানন্দিনী আয়োজিত সেই বিশেষ দোলের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে লিখেছিলেন, “একবার মনে আছে আমার মেজদিদিমা জ্ঞানদানন্দিনীদেবী, সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী, ১৯নং স্টোর রোডের বাড়িতে দোল খেলবার নেমন্তন্ন করেছিলেন সবাইকে। সেবার তিনপুরুষের দোল খেলা হয়েছিল – ১৯নং স্টোর রোডের বিরাট বাগানে। মেজদাদা সত্যেন্দ্রনাথ, নতুনদাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, মেজদিদি জ্ঞানদানন্দিনী – এঁদের দল, তারপর বাবা কাকা কাকিদের দল আর আমাদের ভাইবোনদের দল।” অবনীন্দ্রনাথ জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবারে সেকালের দোল উপলক্ষে পুরুষদের একটি বিশেষ সাজের কথা বলেছিলেন – “লটকান ছোপান গোলাপি চাদর, আতর, গোলাপ।” তাঁর ভাগ্নি, বিনয়নীদেবীর কন্যা ‘প্রতিমা’ দোল পূর্ণিমায় সেকালের ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের বিশেষ সাজের কথা লিখতে গিয়ে বলেছিলেন, “দোল পূর্ণিমারও একটি সাজ ছিল। সে হল হালকা মসলিনের শাড়ি, ফুলের গয়না আর আতর গোলাপের গন্ধমাখা মালা। দোলের দিন সাদা মসলিন পরার উদ্দেশ্য ছিল যে আবিরের লাল রং – সাদা ফুরফুরে শাড়ির উপর রঙিন বুটি ছড়িয়ে দেবে।” তাঁর লেখা থেকে ওই সময়ের ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের সেই শ্রীমণ্ডিত সাজের কথার পরে আরও জানা যায় যে, তখন ঠাকুরবাড়ির পুরুষেরা – “সন্ধ্যেবেলা শান্তিপুরি ধুতি চাদর পরতেন।” এছাড়া তখন ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা গলায় মালা পরতেন, ও আতর ব্যবহার করতেন। তারপরে দোলপূর্ণিমার আকাশে যখন মস্ত বড় চাঁদটি নিজের রুপো-গলা আলোয় চারপাশকে প্লাবিত করে দিত, সেই জ্যোৎস্না আলোয় তাঁরা আরও সুন্দরী হয়ে উঠতেন। একবার ৫ ও ৬নং বাড়ির পুরুষেরা মিলে মহা আড়ম্বরে জোড়াসাঁকো বাড়ির বাগানে বসন্তোৎসবের আয়োজন করেছিলেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনীকার ‘বসন্তকুমার চট্টোপাধ্যায়’ জ্যোতিরিন্দ্রনাথের বয়ানেই সেকথা লিখেছিলেন – “একদিন এক বসন্ত সন্ধ্যায় সমস্ত উদ্যান বিবিধ রঙিন আলোকে আলোকিত হইয়া নন্দনকাননে পরিণত হইয়া উঠিল। পিচকারি, আবির, কুঙ্কুম প্রভৃতি প্রয়োজনীয় সমস্ত সরঞ্জাম উপস্থিত হইয়া গেল। খুব আবীর খেলা হইতে লাগিল, তারপর গান বাজনা, আমোদ-প্রমোদও কিছুমাত্র বাদ গেল না। ইহাতে অনেকগুলি টাকাও খরচ হইয়া গেল।”


সেকালের কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির বিশিষ্ট ব্যক্তিদের উপরোল্লিখিত বিবরণ থেকে এটা পরিষ্কার বুঝতে পারা যায় যে, পুরানো কলকাতায় দুর্গোৎসবের পরে যে উৎসবকে ঘিরে ব্যাপক আনন্দ ও হুল্লোড় হত, সেটা হল দোল বা বসন্তোৎসব। পুরানো কলকাতা সম্পর্কিত নানা গ্রন্থে, কিছু ব্যক্তিগত স্মৃতিচর্চায় সেই আমোদ-উল্লাসের ছবি আজও খুঁজে পাওয়া যায়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলের বাংলায় একটানা পাঁচদিন দোলের ছুটি থাকত। তখন কলকাতার দোলকে নিয়ে ছাতুবাবু-লাটুবাবুদের আনন্দ-ফুর্তির ব্যাপকতাকে সেই ছুটি-পরিসরই বুঝিয়ে দেয়। পুরানো কলকাতায় দোল-আনন্দে নাচ-গানের ব্যবস্থাও করা হত। সেটা ঘরোয়া পরিবেশে সাধারণ কোন নৃত্যগীতি ছিল না, দোল উপলক্ষ্যে তখন রীতিমতো বাঈনাচের আসর বসত। রংখেলাও প্রবল উৎসাহে হত। ওই সময়ে দোলের কথা ভেবে রং গোলার জন্য কলকাতার ধনীবাড়িগুলির ছাদে আগে থেকেই চৌবাচ্চাও তৈরী করা থাকত। তখন দোল খেলার জন্য গোলা-রঙে গাজিপুরের গোলাপজল মেশানো হত। তবে দোলের সেই আনন্দ-হুল্লোড়ে প্রায়শঃই বিশৃঙ্খলাও দেখা দিত। এমনকী চাবুকের আস্ফালন, নির্দয় রক্তপাত ইত্যাদিও বাদ পড়ত না। একবার পুরানো কলকাতার জমিদার চৌধুরি-বাড়িতে দোল খেলা দেখতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কয়েকজন মত্ত ইংরেজ কর্মচারী ঢুকে পড়েছিলেন। সেদিন সেখানে তাঁদের সেই অনধিকার প্রবেশ নিয়ে হুলুস্থুল কাণ্ড বেঁধে গিয়েছিল। জমিদার-কর্মচারীরা প্রবল প্রতাপে তাঁদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর ফলে হাতাহাতিতে রক্তও ঝরেছিল। সেই বার্তা পেয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে চাবুক উঁচিয়ে স্বয়ং জোব চার্নক সেখানে ছুটে এসেছিলেন। কথিত রয়েছে যে, সেদিন কবিয়াল এন্টনী ফিরিঙ্গীর পিতামহ, যিনি তখন চৌধুরিদের সেরেস্তায় কাজ করতেন, চার্নকের হাতে প্রহৃত হয়েছিলেন। পুরনো কলকাতার দোলোৎসবে ওই সব ঘটনা যেমন ঘটেছিল, তেমনই প্রীতিময় সৌহার্দ্যের পরিবেশ রচনার উদ্যোগও দেখতে পাওয়া গিয়েছিল। তখন দোল উপলক্ষ্যে আত্মীয়কুটুম্বের বাড়ি-বাড়ি তত্ত্ব পাঠানোর চল ছিল। আর সেই তত্ত্বে মঠ-ফুটকড়াই অপরিহার্য ছিল। তখন দোলে শুধু রং-আবির খেলা নয়, দোল-রাতে বাজিও পোড়ানো হত। দোল নিয়ে গানের রেকর্ডও বের হত। মঞ্চে মঞ্চে ‘দোললীলা’ অভিনীত হত। পুরানো কলকাতার বাবুদের বাড়িতে দোলের রকমারি আমোদপ্রমোদের মাঝে নাটক-যাত্রার আসরও বসত। এক কথায় বলতে গেলে, পুরনো কলকাতার দোল-চিত্র আমোদেপ্রমোদে বড়ই বৈচিত্রময় ছিল। কলকাতার ইতিহাস বলে যে ‘প্রিন্স দ্বারকানাথের ঠাকুর’ পরিবার বরাবরই স্বাতন্ত্র্যে উজ্জ্বল ছিল। শিক্ষায়-দীক্ষায় বৈভবে সেকালের কলকাতার অন্য দশটি পরিবারের সঙ্গে সেই পরিবার কখনওই তুলনীয় ছিল না। তখন দোলোৎসবকে ঘিরে বাংলার সমাজজীবনে যে উন্মাদনা দেখা দিয়েছিল, সেটার আঁচ কিন্তু জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতেও গিয়ে লেগেছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলার অন্যতম ধনাঢ্য ব্যক্তি হিসাবে সমাজে দ্বারকানাথের সম্ভ্রম ছিল। তাঁর আমলে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির দুর্গাপুজোর জাঁকজমক ঢের বেড়ে গিয়েছিল। অবশ্য জোড়াসাঁকোর দুর্গাপুজোর প্রবর্তক তিনি ছিলেন না, সেই ‘নীলমণি ঠাকুরের’ আমলেই সেখানে দুর্গাপুজো শুরু হয়েছিল; আর ব্রাহ্মধর্মাবলম্বী দেবেন্দ্রনাথের কালে জোড়াসাঁকোয় দুর্গাপুজো পাকাপাকিভাবে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের জন্মের বছর তিনেক আগেই ঠাকুরবাড়ির সমস্ত পুজো বন্ধ হয়ে গেলেও, পুজোর আনন্দ কিন্তু রবীন্দ্রনাথকেও প্রবলভাবে স্পর্শ করত। শুধু রবীন্দ্রনাথকে নয়, ঠাকুরবাড়ির সকলকেই স্পর্শ করত। ঠিক তেমনভাবেই দোলের আনন্দও ঠাকুরবাড়ির সকলকে স্পর্শ করেছিল। তাই ব্রাহ্ম পরিবার হলেও, ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হলেও, তাঁরা কোনদিনই নিজেদের দোলের আনন্দ থেকে কখনও দূরে সরিয়ে রাখেননি। একটু আগেই জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ‘জীবনস্মৃতি’ গ্রন্থ থেকে সেকালের ঠাকুরবাড়ির আনন্দ মুখরিত রং-আবিরময় একটি দিনের বর্ণনা তুলে ধরা হয়েছে। তখন বসন্তোৎসবকে সামনে রেখে ঠাকুরবাড়িতে নাটকও লেখা হয়েছিল। শুধু লেখাই নয়, সেই নাটক অভিনয়ের ব্যবস্থাও করা হয়েছিল। একবার ‘স্বর্ণকুমারী দেবী’ ‘বসন্ত উৎসব’ নামের একটি নাটক লিখেছিলেন, এবং জোড়াসাঁকোতে সেই নাটকের অভিনয়ও হয়েছিল। পরে সেই চল্লিশ পৃষ্ঠার ছোট্ট গীতিনাট্যটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছিল। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের উৎসাহ ও প্রেরণাতেই স্বর্ণকুমারী ‘বসন্ত উৎসব’ লিখেছিলেন। স্বর্ণকুমারী নিজেও সেই নাটকে অভিনয় করেছিলেন, এবং জ্যোতিরিন্দ্রনাথ তাতে নায়ক সেজেছিলেন। নাটকটির নায়িকা ‘লীলা’র ভূমিকায় ‘কাদম্বরী দেবী’ ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তখন বিলেতে থাকবার জন্য সেই নাটকটির অভিনয়ের সাক্ষী হতে পারেন নি। অবশ্য তারপরেও ‘বসন্ত উৎসব’ জোড়াসাঁকোয় অভিনীত হয়েছিল, এবং রবীন্দ্রনাথও তাতে অভিনয় করেছিলেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ‘বসন্ত উৎসব’ গীতিনাট্য রচনায় স্বর্ণকুমারীকে শুধু প্রাণিত করেননি, তিনি নিজেও সম্ভবতঃ প্রাণিত হয়েছিলেন। আর তাই তিনিও ‘বসন্তলীলা’ নামের একটি গীতিনাট্য লিখেছিলেন। রবীন্দ্রসাহিত্যে, বিশেষতঃ সংগীতে বহুবার ঋতুরাজ বসন্তের কথা এসেছে। ঠাকুরপরিবারের আরও কারো কারো রচনাকর্মেও বসন্তোৎসবের উল্লেখ পাওয়া যায়। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ‘বসন্ত লীলা’ লেখবার বছরখানেক আগে ‘পুনর্বসন্ত’ নামেও একটি গীতিনাট্য লিখেছিলেন। ‘পুনর্বসন্ত’-এ রয়েছে – “এসো এসো বসন্ত এ কাননে, আন কুহুতান প্রেম গান, / আন গন্ধমদ-ভরে অলস সমীরণ,/ আন নবযৌবন-হিল্লোল নবপ্রাণ,/ প্রফুল্ল নবীন বাসনা এ কাননে।” ‘বসন্তলীলা’র একটি গানে প্রকৃতির অনুষঙ্গে ‘হোরি’ খেলার যে শব্দ-ছবি রয়েছে, সেটা বড়ই জীবন্ত। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “(আজি) আইল বসন্ত, হিম-ঋতু অন্ত,/ প্রকৃতি আনন্দে৷/ তরুলতাগুলি, অলসে হেলিদুলি/ হরষে কোলাকুলি করিছে।/ কিশোরী সাথে হরি খেলিবে আজ হোরি,/ রঙ্গে ব্রজপুরী মাতিছে।” এভাবেই ঠাকুরবাড়ির সাহিত্যে বারবার মাধুর্যময় বসন্ত, বসন্তোৎসবের কথা ফুটে উঠেছিল।

ফাগুনের আগুন রঙে যখন প্রকৃতি রঙিন হয়ে ওঠে, ঠিক তখন বাঙালির মনেও রঙের ছোঁয়া লাগে। সেই রং আসলে উৎসবে, আনন্দে, আবেগে মেতে ওঠার এক উপলক্ষ মাত্র। তাই সেকাল থেকে একাল পর্যন্ত কলকাতার ‘দোল-বিলাস’ এখনও চালু রয়েছে। শুধু সময়টা বদলে গিয়েছে। অতীতের দোল বিলাসের কত না কাহিনী আজ কিংবদন্তী। এক কালে কলকাতার বাবুদের বিলাসিতার আরেক নাম ছিল হোলি খেলা। প্রাচীন কালের ‘মদনোৎসবের’ সঙ্গে মিল ছিল সেই দোল উৎসবের। ইতিহাসে কান পাতলে শোনা যায় দোলের বিচিত্র গল্পের কথা।
জোব চার্নক ১৬৮৬ সালে কলকাতায় এসেছিলেন। কিন্তু, বেশি দিন একটানা এখানে থাকতে পারেননি। পরে, ১৬৯০ সালের ঘোর বর্ষায় চার্নক যখন তৃতীয় বার এখানে এলেন, তখন কলকাতা এক গণ্ডগ্রাম। সেখানে না ছিল বাবু, না ছিল অভিজাত সমাজ। প্রাসাদোপম সেই সব বাড়িও ছিল না তখন। তাই নবাগত ইংরেজদের তখন ঠাঁই বলতে কখনও তাঁবু তো কখনও বা নৌকা। বেশ কিছু দিন থাকার পরে জীবনযাত্রায় একঘেয়েমি কাটাতে চার্নক এবং তাঁর সাঙ্গপাঙ্গরা চাইলেন নেটিভদের সঙ্গে মেলামেশা করতে। কিন্তু নেটিভরা সেই সময় তাঁদের পাত্তাও দিতেন না। প্রায় ৩২৫ বছর আগে এমনই এক বসন্তে, কয়েক জন ফিরিঙ্গি ছোকরা গ্রামের ভেতরে ঘুরতে বেরিয়েছিল। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ তাঁদের কানে এল গানের সুর। সেই সুর অনুসরণ করে তাঁরা এগোতে এগোতে পৌঁছলেন এক দীঘির পাড়ে। সেখানে তাঁরা যা দেখলেন, তা বিস্ময়কর! দীঘির দক্ষিণে এবং উত্তরে দু’টি খাড়াই মঞ্চ। তার একটিতে গোবিন্দজি এবং অন্যটিতে শ্রীরাধিকার অধিষ্ঠান। দুই দেব-দেবীকে মাঝে রেখে চলছিল দোল খেলা। যাঁরা দোল খেলছিলেন তাঁদের পোশাকেও ছিল অভিনবত্ব। আবিরে চার দিক লাল। পিচকারিতে তরল রং নিয়ে চলছিল খেলা। কাতারে কাতারে লোক এসেছেন সেই উৎসবে। বসেছিল মেলাও। দীঘির উত্তর পাড়ে অর্থাৎ রাধাবাজারে, স্তূপ করে রাখা ছিল আবির। পথঘাটের সঙ্গে দিঘির জলও লাল হয়ে গিয়েছিল। গোপিনীদের নৃত্য, উত্তেজক চটকদারি সঙ্গীত আর চারপাশের পরিবেশ সেই ইংরেজ ছোকরাদের প্ররোচিত করে তোলে। এই গোপিনীরা যে আসলে সকলেই পুরুষ তা ভাবতেও পারেননি ওই ফিরিঙ্গি ছোকরারা। প্রাচীন গ্রিসের ‘স্যাটারনালিয়া’র সঙ্গে এই রং-উৎসবের মিল খুঁজে পেয়ে তাঁরা ভেবেছিল বুঝি ‘কামোৎসব’। এর পরে তাঁরাও অংশ নিতে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করেন। ফলে এক কাণ্ড ঘটে বসল! এটা ফিরিঙ্গিদের বেয়াদপি মনে করে নেটিভরা তাঁদের উৎসবে ঢুকতে বাধা দিলেন। শুধু তাই নয়! তাঁদের পিঠে পড়েছিল চড় থাপ্পড়। ‘বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের’ একটি প্রবন্ধে ঘটনাটির উল্লেখ মেলে। পরে ইংরেজরা এ দেশে আসার পরে ঔপনিবেশিকতার প্রভাবে যে নব্য বাবুসমাজ গড়ে উঠেছিল, হোলি উৎসব তাতে প্রাধান্য পেয়েছিল। আর যে বাবুরা “দিনে ঘুমিয়ে, ঘুড়ি উড়িয়ে, বুলবুলির লড়াই দেখে রাতে বারাঙ্গনা দিগের আলয়ে গীতবাদ্য ও আমোদ করিয়া কাল কাটাইত” তাঁদের হোলি উদযাপনও বিচিত্র ধরনের ছিল। আর জীবনযাত্রায় এই সব ভোগ-বিলাসের লীলাসঙ্গিনী ছিল গণিকাকুল। ভবনীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নব বাবুবিলাস’-এ সেই সব বাবুদের জীবনযাপনের উল্লেখ মেলে। বাবু-বিলাসের নিধুবন ছিল তাঁদের সখের বাগানবাড়ি। রুপোর রেকাবিতে রাখা আতর মেশানো আবির উড়িয়ে, রুপোর পিচকারির সুগন্ধী রঙিন জল ছিটিয়ে, গেলাসে রঙিন পানীয় ঢেলে, হোলির ঠুমরি কিংবা দাদরার তালে তালে দোস্ত ইয়ারদের নিয়ে মাতাল হয়ে ওঠার আনন্দটা কেমন ছিল তা শুধু বাবুরাই জানতেন! বাবু কালচারের হোলির বিবরণ দিতে গিয়ে কবি ‘ঈশ্বর গুপ্ত’ লিখেছিলেন “ক্রমেতে হোলির খেলা, নবীনা নাগরী মেলা, ছুটে মুটে যায় এক ঠাঁই। … যাঁর ইচ্ছা হয় যারে, আবির কুমকুম মারে, পিচকারি কেহ দেয় কায়। উড়ায় আবীর যত, কুড়ায় লোকেতে কত, জুড়ায় দেখিলে মন তায়। ঢালিয়া গোলাপ জল, অঙ্গ করে সুশীতল, মাঝে মাঝে হয় কোলাহল।” পুরানো কলকাতার দোল প্রসঙ্গে ইতিহাসের পাতায় প্রমাণ মেলে যে, “সে সময়ে কোনও ব্যক্তির বেদাগ বস্ত্র থাকিত না, দলে দলে মিছিল বাহির হইতেছে, পিচ্কারি ও আবিরে পথঘাট ঘরবাড়ি লালে লাল হইয়া যাইতেছে।” সে কাল থেকে এ কাল দোলের একটা জিনিস বদলায়নি, সেটা হল আবেগ। ধনী দরিদ্র নির্বিশেষে সকলে দোলের আনন্দে মেতে উঠতেন।

‘বালথাজার সলভিন্স’ তাঁর ‘Les Hindoues’ গ্রন্থে দোলযাত্রার একটি ছবির বর্ণনায় সে কালের রং উৎসবের বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি উল্লেখ করেছিলেন যে, হিন্দুদের এই দোল উৎসবে খ্রিস্টান ও মুসলমানেরাও আমোদ-প্রমোদে মেতে উঠতেন। লখনৌর নির্বাসিত নবাব ‘ওয়াজেদ আলি শাহ’ যখন মেটিয়াবুরুজে থাকতেন, তখন তিনিও তাঁর মিত্র-পারিষদদের নিয়ে সাড়ম্বরে হোলি খেলতেন। এমনকি, হোলি উপলক্ষে তিনি নতুন গানও রচনা করতেন। দোল উপলক্ষে এক কালে কলকাতার বিভিন্ন রাজবাড়িতে বাঈনাচের আসর বসত। তেমনই এক আসরে সেকালের বিখ্যাত বাঈজি ‘গহরজান’ উপস্থিত ছিলেন। মেঝেতে পুরু করে আবির বিছিয়ে তার উপর কাপড় ঢেকে সেখানে হয়েছিল নাচ। নাচের শেষে আবিরের উপর থেকে কাপড় সরিয়ে দেখা গিয়েছিল, সেই আবিরের উপর পদ্মের আকৃতির নকশা হয়ে গিয়েছে। পাথুরিয়াঘাটার রাজবাড়িতে ধ্রুপদী সঙ্গীতের আসর বসত। সেখানে গাইতেন ‘অঘোর চক্রবর্তী’, ‘পিয়ারা সাহেব’, কিংবা ‘আহমদ খান’। গবেষকদের মতে সাবেক কলকাতার দোল উৎসব প্রাচীন কালের মদনোৎসবের আদলে গড়া ছিল। বর্তমানে যাঁরা দোলের সময় রাস্তাঘাটে চটুল পরিবেশের কথা বলে রে-রে করে ওঠেন, তাঁরা শুনলে অবাক হবেন সে কালেও দোলে চটুলতা ছিল। সেটার প্রমাণ ইতিহাসের পাতায় পাওয়া যায়। “… মিছিলওয়ালারা সুশ্রাব্য ও অশ্রাব্যগীতিতে পাড়া মাতাইয়া এবং নরনারী যাহাকে সম্মুখে পাইত, তাহাকে আবির ও পিচকারিতে ব্যতিব্যস্ত করিয়া চলিয়া যাইত। এমন অশ্রাব্য গীত এবং কুৎসিত সং প্রকাশ্যে পথে বাহির করিতেন যে, এখনকার লোকে তাহা কল্পনা করিতে পারে না। কর্তারা কিন্তু তাহা লইয়া আমোদ করিতেন। গৃহিনীও বালক-বালিকাদের সহিত শ্রবণ ও দর্শন করিতেন।” তবে বিলাসিতা কিংবা আমোদ-প্রমোদ যতই হোক না কেন, এই সব বিলাসী বাবুরা ছিলেন সাবেক হিন্দু ধর্মে বিশ্বাসী। তাই দোল উপলক্ষে এই সব বাড়িতে বিশেষ পুজোআচ্চা হত। তৈরি হত বিশেষ মিষ্টি এবং শরবতও। কিছু কিছু পুরনো পরিবারে আজও সেই সব রীতি দেখা যায়। বাবু-বিলাসের দিন ফুরলেও ফুরোয়নি সেই ঐতিহ্যের রং। কালের গরিমায় অনেক কিছু হারালেও বনেদি পরিবারগুলিতে আজও অটুট এবং অক্ষুণ্ণ দোল বিলাসের সেই মেজাজটা। সময়ের স্রোতে বাঙালির দোলযাত্রায় পড়েছে প্রাদেশিকতার ছাপ। তবু তার মাঝেই পুরনো কলকাতার দোল বিলাস স্মৃতির সুরভি নিয়ে অতীত আর বর্তমানের মাঝে একটা রঙিন যোগসূত্র।
‘দেল’ (দেউল), ‘দোল’, ‘দুর্গোৎসব’ – এই তিন নিয়েই ছিল প্রাচীন কলকাতার ধর্মার্চনা, আনন্দ-উৎসব। বঙ্গদেশে সেদিন দেউল বা মন্দিরের অভাব ছিল না। সেই সব মন্দিরে প্রধানতঃ রাধা-কৃষ্ণের যুগল মূর্তির আরাধনা চলত নিরবচ্ছিন্নভাবে। বৈষ্ণবদের তখন রমরমা ছিল। সময়টা ছিল ষোড়শ-সপ্তদশ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ। কৃষ্ণনগরের মহারাজা ‘কৃষ্ণচন্দ্র’ এই বৈষ্ণবীয় পরিমণ্ডলে লালিত-পালিত হয়েও বাংলায় শক্তিদেবীর আরাধনা – বৈষ্ণব বিরোধী শাক্ত সাধনাকে প্রসারিত করবার জন্য রাষ্ট্রশক্তিকে কাজে লাগিয়েছিলেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে যুদ্ধে সিরাজউদ্দৌল্লার পরাজয়ের পরে (১৭৫৭) বণিকের মানদণ্ড রাজদণ্ড রূপে দেখা দেওয়ায় বাংলার অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের পাশাপাশি রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা চরমে পৌঁছেছিল। সেই দিনগুলিতে অভিজাত-অভাজনেরা বিপর্যয় থেকে মুক্তি পেতে কৃষ্ণের বাঁশির পরিবর্তে শক্তিদেবীর অসিকেই প্রাধান্য দিয়েছিলেন। কিন্তু কালে-কালান্তরে দেখা গিয়েছিল, জমিদার-ইজারাদার-ইমানদার তথা ভূস্বামীরা কৃষ্ণ আরাধনার পাশাপাশি শক্তি আরাধনাকেও গুরুত্ব দিয়েছিলেন। সেই পরিপ্রেক্ষিতেই বঙ্গদেশে দুর্গা ও কালীপুজোর সূচনা ঘটেছিল। তাতে কৃষ্ণের বংশীধ্বনির মাধুর্য কিন্তু হারিয়ে যায়নি। তখনকার অভিজাত ব্যবসায়ী এবং সাধারণ কুলীন মানুষেরা যাঁদের মধ্যে ‘বেনিয়ান’, ‘মুৎসুদ্দি’, ‘রাইটার’, ‘কেরানি’, ‘মুন্সি’ প্রমুখরা ছিলেন, তাঁরা রাধাকৃষ্ণের মধুর লীলার আস্বাদন ও আরাধনাকে নতুন রূপ দিয়েছিলেন। জোব চার্নকের উদ্যোগে নগর কলকাতা গড়ে ওঠার পরে দেখা গিয়েছিল যে, সেখানকার অভিজাত ধনবান মানুষদের বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত দেউল অর্থাৎ মন্দিরে সাড়ম্বরে রাধা-কৃষ্ণের আরাধনা নানাভাবে চলছে। অতীতে ‘সুতানুটি’, ‘গোবিন্দপুর’ ও ‘কলকাতা’ – এই তিনটি গ্রাম নিয়েই তৈরি হয়েছিল নগর কলকাতা। যা বর্তমানে কলকাতা মহানগরীতে রূপান্তরিত। প্রাচীনকাল থেকেই এই তিন জনপদের অস্তিত্ব লক্ষ্যণীয় ছিল। চার্নক গঙ্গা পূর্বতীরবর্তী এই তিন গ্রামকে কেন্দ্র করে কলকাতা মহানগরীর রূপরেখাটি চিত্রায়িত করেছিলেন। সুতানুটি অর্থাৎ উত্তর কলকাতা যেখানে সুতো তথা বস্ত্র নিয়ে কাজ কারবার ও সেসবের ব্যবসাই তখন প্রধান ছিল। গোবিন্দপুর ছিল বর্তমানে ফোর্ট উইলিয়াম ও সন্নিহিত গড়ের মাঠ অঞ্চলটি। আর কলকাতা ছিল দক্ষিণ অংশের কালীঘাট-ভবানীপুর থেকে বড়িশা-বেহালা পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চল। সেই অংশটির মালিক ছিলেন ‘সাবর্ণ গোত্রীয় রায়চৌধুরী’রা। কালীঘাটের মন্দির তাঁদের হাতেই গড়ে উঠেছিল। কলকাতা ফোর্ট যখন গড়ে উঠল, তখন গোবিন্দপুরে বসবাসকারী তাঁতি-বস্ত্র ব্যবসায়ীরা বর্তমান ‘বড়বাজারে’, ‘পাথুরিয়াঘাটা’ অঞ্চলে উঠে গিয়েছিলেন। প্রসঙ্গতঃ ‘পিরালি ঠাকুর পরিবার’ ওই গোবিন্দপুরেই প্রথমে বসবাস করতেন। পরে তাঁরা পাথুরিয়াঘাটা-জোড়াসাঁকোতে চলে গিয়েছিলেন। আর সুতানুটি সুতানুটিতেই থেকে গিয়েছিল। পুরনো কলকাতার দোল উৎসব বিশেষভাবে পালিত হতো সুতানুটি, গোবিন্দপুর এবং মধ্যবর্তী বড়বাজার সন্নিহিত অঞ্চলে। আর অভিজাত ব্যবসায়ী, কোম্পানির শাসকদের কৃপায় রাজা-জমিদার-ইজারাদার প্রমুখের প্রধানতঃ সুতানুটি অঞ্চলে নির্মিত অট্টালিকা সংলগ্ন মন্দিরে নিত্য রাধা-কৃষ্ণের আরাধনার ব্যবস্থা ছিল। সংলগ্নবাগান বাড়িতে দোল উৎসব হত।

কলকাতার বাঙালী সমাজে দোল এখন প্রায় অস্তগামী। অথচ আজ থেকে একশো বছর আগেও দোল কলকাতার একটা বেশ বড় উৎসব ছিল। তখনকার লোক কোনও বর্ধিষ্ণু পরিবারের উল্লেখ করতে গিয়ে প্রায়ই বলতেন যে, “এঁদের বাড়ি দোল-দুর্গোৎসব হয়।” অর্থাৎ, তখন এটি দুর্গোৎসবের মতই একটা বড় উৎসব ছিল। এর সমর্থন পাওয়া যায় ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির ১৭৮৭ সালের সরকারি ছুটির তালিকা থেকে। সেই সময়, অন্যান্য পরবে সরকারি অফিস যেখানে দু’-এক দিনের বেশি বন্ধ রাখা হত না, সেখানে দুর্গোৎসবের জন্য আটদিন ও দোলযাত্রার জন্য পাঁচদিনের ছুটি বরাদ্দ ছিল। পুরনো কলকাতার এই পাঁচটি দিন রঙের অনুষঙ্গে কাটতো। সেই সময় দোল উপলক্ষে বিভিন্ন জায়গায় ‘সঙ’-ও বের হত। মিছিল করে লোকে এমন কুৎসিত সঙ প্রকাশ্যে বের করত ও তাঁরা এমন অশ্রাব্য গান গাইত যে আজকালকার মানুষ তা কল্পনাতেও আনতে পারবেন না। সেই মিছিলের চলার রাস্তায় নারী-পুরুষ যাঁকেই সামনে পাওয়া যেত, তাঁরই গায়ে রং দিয়ে দেওয়া হত। ওই ধরণের মিছিলে কারুর গায়েই রঙ ছাড়া অন্য কোন কাপড় থাকত না! তাছাড়া, আবির ও নানা রঙে পথঘাট লাল হয়ে যেত। আর লোকে তা নিয়ে খুব আমোদ করত। পুরানো কলকাতার বড়লোকদের বাড়িতে খুব ঘটা করেই দোল উৎসব পালিত হত। যেমন – অতীতের কলকাতার ‘রানী রাসমণি দেবী’র বাড়িতে ‘রঘুনাথ জীউ’ থাকার জন্য দোল, রাস ও জন্মাষ্টমীর উৎসবগুলি নিয়মিতভাবে পালিত হত এবং প্রতিটি উৎসবে রাসমণি দেবী পূজা ছাড়াও দানধ্যান ও দরিদ্রনারায়ণের সেবায় প্রচুর অর্থ ব্যয় করতেন। এছাড়া সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেরও অভাব ছিল না। উৎসব মানেই আনন্দ – সেই আনন্দ উপভোগের জন্য যা কিছু করণীয় তার সবই করতেন রাণী রাসমণি দেবী। রাসমণি দেবীর বাড়িতে দোলৎসবের বর্ণনা প্রসঙ্গে ‘প্রবোধচন্দ্র সাঁতরা’ তাঁর ‘রাণী রাসমণি’ গ্রন্থে লিখেছিলেন, “রঘুনাথ জীউ ঠাকুরের দোল ও রাসোৎসব হইত। যে দেখে নাই, সে বুঝিবে না, দোলের সময় কি বিরাট ব্যাপার হইত। গোয়ালিয়রের বিখ্যাত গায়ক ‘জ্বলাপ্রসাদ’ আসিয়া সন্ধ্যার পর দোলের দিবস সকলকে গানে পরিতৃপ্ত ও মোহিত করিতেন। তেমন গায়ক বুঝি আর ভারতে জন্মিবেন না।” দোলের দিন সকালে রঘুনাথ জীউকে ঠাকুর দালানে এনে ও মঞ্চে স্থাপন করা হত। রাণীর জামাতারা স্নান করে ও পট্টবস্ত্র পরে আগে আগে গঙ্গাজল ছিটাতে ছিটাতে আসিতেন আর তাঁদের পিছন পিছন পুরোহিত ‘ঠাকুর’ নিয়ে আসতেন। ঠাকুরের অভিষেক কার্য্য শেষ হলে, সকলে ঠাকুর প্রণাম, ব্রাহ্মণ গুরুজনকে প্রণাম, প্রণামী প্রদান করে দোলের পার্বনী নিয়ে দোল খেলা শুরু করতেন। জানা যায় যে, ১০/১২ টি গরুর গাড়িতে করে পিচকারী, ফাগ, আবির, কুমকুম, নানাবিধ চিনির খেলনা আসত। নববস্ত্র, পার্ব্বনী, পিচকারী, রং সকলকে দেওয়া হত। ফাগ, আবির, কুমকুম রাণীর বাড়ির ভিতরে বাইরে স্তরে স্তরে রাখা হত। যাঁর যত ইচ্ছা নিত, মাখিত, খেলত, পরস্পরের অঙ্গে দিত, কারও কোন নিষেধ ছিল না। কেউ কাউকে কুমকুম দিতেন, কেউ আবার কাউকে পিচকারী দিয়ে রং দিতেন, রং গোলাপ জলে ভিজিয়ে নেওয়া হত ফলে চারিদিক সৌরভে ভরে থাকত। রাণীর বাড়ির অন্তঃপুরে, বাইরে, উপরে, নীচে, ভিত্তিগাত্রে, উঠানে এত ফাগ ও আবির পড়ে থাকত যে দোলের পরেও অন্তঃত এক সপ্তাহ ধরে ফাগের উপর দিয়েই সকলকে যাতায়াত করতে হত। এই কারণে দোলের পরে রাণীর বাড়ি পুনরায় সংস্কার করতে হত, না হলে বাড়ি বসবাসযোগ্য হত না। প্রবোধচন্দ্র সাঁতরার লেখা থেকে জানা যায় যে, “… সর্বোপরি দৌবারিকদিগের আমোদ অত্যাধিক। লাল রঙে রঞ্জিত হইয়া নানাবিধ বাদ্য সহযোগে গান করিত। কোলাহলে আকুল করিত। কয়েক দিবস নিদ্রাই হইত না। মনে হইত, যেন নিবৃত্ত হইলেই রক্ষা পাওয়া যায়।” এই উৎসবে রাণী দীন দরিদ্র কাউকেই অভুক্ত রাখতেন না। রাণীর বাড়ির রাস্তার ধারে নানান ধরণের খেলনা আর খাবারের দোকান বসত। এছাড়াও নাচ ও তামাসারও বন্দোবস্ত করা হত। রাণী রাসমণির বাড়ির দোল উৎসবের বর্ণনা থেকে তখনকার দিনের দোলৎসবের নির্দোষ আনন্দের একটা ছবি দেখতে পাওয়া যায়, যা বর্তমানে অনেক ক্ষেত্রে কুৎসিত, মারাত্মক ও বিপদজ্জনক আনন্দে পরিণত হয়েছে – একথা মেনে নেওয়াই সঙ্গত।

বিংশ শতাব্দীর ত্রিশের দশকের শুরু পর্যন্ত প্রতিটি গৃহস্থকে তাঁদের জামাইবাড়িতে ‘দোলের তত্ত্ব’ পাঠাতে হত। সেই তত্ত্বে থাকত – কাপড়-জামা, মিষ্টান্ন, পিতলের পিচকারি, পিতলের বালতি, রঙের বাক্স, আবির, সাদা বাতাসা, সাদা ও রঙিন ‘মঠ’, চিনির মুড়কি, ফুটকড়াই, তিলেখাজা ইত্যাদি। এখন এটা বন্ধই হয়ে গিয়েছে। এখন থেকে সত্তর-আশি বছর আগের কলকাতা শহরে দোলের দিন সকালে যেরকম মাতামাতি হত, সেটার বর্ণনা ভাষায় ফুটিয়ে তোলা কঠিন। তখন ‘জার্মানি’ থেকে সস্তার রঙ আসত, সেজন্য রাস্তাঘাটে রঙ ছোড়াছুঁড়িটাও খুব বেশি রকমের হত। তাছাড়া সেই সময়ে পিচকারির দামও ছিল খুব সস্তা। গোলাপি-সবুজ-গাঢ় নীল ইত্যাদি রং এলেও সাধারণ মানুষ কিন্তু লাল রংটিই পছন্দ করত বেশি। রঙের উৎসব দোল খেলার পর পথঘাট লাল হয়ে থাকত বেশ কয়েকদিন পর্যন্ত। একটা বাঁশের পিচকারির দাম ছিল এক পয়সা। টিনের পিচকারি, সাইজ অনুযায়ী দু’-পয়সা থেকে দু’-আনা ও ছ’-আনা থেকে দশ আনা পয়সায় একটা পিতলের পিচকারি পাওয়া যেত। ধনী-অভিজাত বাড়ির দোলখেলায় পিতলের পিচকিরি, পিতলের বালতিতে রং, কিংবা সুগন্ধী আবির, পিতল বা কাঁসার রেকাবিতে অভ্র ও ফুলের পাপড়ি ছড়ানো আবির ইত্যাদি ব্যবহার করা হতো। তুলনায় সাধারণ মধ্যবৃত্তের সম্বল বলতে ছিল বাঁশ-টিনের পিচকিরি। বাড়ির অন্তঃপুরে মেয়েরাও রঙ নিয়ে খুব মাতামাতি করতেন। আর বাইরে রাস্তায় ছেলের দল যাঁকেই সামনে পেত, তাঁর গায়েই রঙ দিয়ে দিত। সেজন্য সেকালে দোলের দিন লোকে ছেঁড়া জামা-কাপড় পরে রাস্তায় বের হত। তবে তখন কনিষ্ঠরা কখনও নিজেদের গুরুজনদের গায়ে রং দিতেন না। তখন গুরুজনদের পায়ে আবির দেওয়াটাই প্রথা ছিল। ওই সময় সকালে রঙের খেলা শেষ হয়ে গেলে, বিকালে আবির খেলা হত। এছাড়া বিকালে কনসার্ট পার্টি ও গানও বের হত। বিকেল-সন্ধ্যায় ঘরোয়া গানের আসর যেমন থাকত, তেমন কেউ কেউ ওস্তাদ গাইয়ে-বাজিয়েদেরও আমন্ত্রণ জানাতেন বাড়িতে। ‘নিধুবাবুর টপ্পা’, ‘যদু ভট্টের গান’ – এর মধ্যে উল্লেখ্য। বাঈজি নাচও হতো। বৈষ্ণবরা আয়োজন করতেন কীর্তন গানের। এছাড়া কবিগান, তরজা, আখড়াই-হাফ আখড়াই গানেরও ব্যবস্থা হতো। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে নাট্যাভিনয়ের কালে ‘দোললীলা’, ‘বসন্তলীলা’, ‘প্রহ্লাদচরিত’, ‘কংসবধ’ বিষয়ক নাটকও অভিনীত হয়েছিল। সব মিলিয়ে দোলের উৎসবের প্রেক্ষাপট ছিল রঙিন এবং বর্ণাঢ্য।
সেকালে নগর কলকাতায় কোনও পরিবার বর্ধিষ্ণু কি না জানতে মানুষ জিজ্ঞেস করত, সেই পরিবারে কি দোল ও দুর্গোৎসবের আয়োজন হয়? দুর্গাপুজোর মতোই দোল উৎসব ছিল জাঁকজমকপূর্ণ এবং সম্মানসূচক; যেটাকে বলে ‘স্ট্যাটাস সিম্বল’। তখন মন্দিরে রাধাকৃষ্ণের বিগ্রহের নতুন সাজ, ফুলের অঙ্গসজ্জা, বিশেষ ভোগরাগের ব্যবস্থা থাকত। বিগ্রহের পায়ে-গায়ে ছোঁয়ানো হত আবির। সাদা, গোলাপি বাতাসা, সাদা ও রঙিন মঠ (চিনি দিয়ে তৈরি ত্রিভূজাকৃতির মিষ্টি) – নানা পাখি, ফুল ইত্যাদির ছাঁচ তৈরি করে এই ‘মঠ’কে বিভিন্ন আকৃতি দেওয়া হত। এছাড়াও মুড়কি-কদমা-ছোলা ও চিনি সহযোগে তৈরি একরকমের মিষ্টি যা ‘ফুটকড়াই’ নামে জনপ্রিয় ছিল, সেটাও পুজোয় দেওয়া হত। আর সেই প্রসাদ বাচ্চা-বুড়ো সবার কাছেই ‘দোল স্পেশাল’ হিসেবে খুবই জনপ্রিয় ছিল।
প্রাচীন কলকাতার ব্রিটিশ পুলিস বিভাগ থেকে দোলের বেশ কয়েকদিন আগেই প্রচার করা হতো শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখা এবং অনিচ্ছুক ব্যক্তিদের গায়ে রং না দেওয়ার জন্য। এখনকার মাইক-মাইক্রফোন বা প্রিন্ট ইলেক্ট্রনিকস মিডিয়ার মাধ্যমে যে প্রচার জনস্বার্থে করা হয়, সেই সময়ে ‘ঢুলি’ সম্প্রদায় ঠিক সেই জাতীয় প্রচারই করত। তখন বিভিন্ন জরুরি খবর সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার কাজটি সেই ঢুলিরাই করতেন। কলকাতার জনবহুল অঞ্চলগুলি – বারোয়ারিতলা, বাজার-হাট, কখনও বা যাত্রাপালা, কীর্তনের আসরের আগে পরে ঢুলিরা ঢোল বাজিয়ে পুলিস, আদালত ইত্যাদির সরকারি আদেশ-নির্দেশ প্রচার করতেন। সেবিষয়ে যদি কোনও রকম অভিযোগ থানায় যায়, তবে সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তি বা ব্যক্তিবর্গকে আটক করা হবে বলেও তখন জোর প্রচার চালানো হত। অনেক ধনী বা জমিদার ব্যক্তি, ব্যক্তিগত উদ্যোগে নিজের বাড়ি কিংবা বাগানবাড়িতে তখন যে দোল খেলার এলাহি আয়োজন করতেন, সেটার প্রচারও ওই ঢুলিদের দিয়েই করানো হত। তারা ‘ঢ্যাঁড়া’ পিটিয়ে সেইসব বাবু সম্প্রদায়ের মানুষজনের মহিমা প্রচার করতেন। তখনকার অনেক বিত্তশালী-জমিদার আবার কলকাতার বিভিন্ন বস্তি অঞ্চলে ঢুলিদের ঘর দিয়ে বিভিন্ন প্রচারের স্বার্থে তাঁদের সেখানে থাকতে দিতেন। সেই ঢুলিরা ডোম সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন।
পুরানো কলকাতার যে সব ধনীর বাড়িতে বেশ জাঁক করে দোল উৎসবের আয়োজন হতো তাঁরা ছিলেন – ‘প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর’, ‘মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর’, ‘প্রসন্নকুমার ঠাকুর’, ‘রাজেন্দ্রলাল মিত্র’, ‘দিগম্বর মিত্র’, ‘বলরাম বসু’, ‘পশুপতি বসু’, ‘বাবু পীতরাম দাস’, ‘বাবু বৈষ্ণবচরণ শেঠ’, ‘রাধাকান্তদেব বাহাদুর’, ‘বাবু আশুতোষ দেব’, ‘বাবু নবীনচন্দ্র বসু’, বাগবাজারের ‘ভুবন নিয়োগী’, অমৃতবাজার পত্রিকার সম্পাদক ‘শিশিরকুমার ঘোষ’ প্রমুখ। ইংরেজরা অতিথি হয়ে আসতেন সেই আয়োজনে। খানাপিনার সঙ্গে নাচ-গানও তখনকার দোল উৎসবের অপরিহার্য অঙ্গ ছিল। ইংরেজ প্রশাসকদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে নিজের খ্যাতি প্রতিপত্তিতে আরও খানিকটা জৌলুস আনার চেষ্টাও অনেক সময়েই থাকত। তখনকার অর্থবান মানুষেরা এই রঙের উৎসবে প্রিয়জনদের বাড়িতে তত্ত্ব পাঠাতেন। আত্মীয়স্বজন, বন্ধু বয়স্যদের বাড়িতে বিলিতি রঙের বাক্স নানা আকৃতির পিতলের পিচকিরি, পিতলের বালতি, আবির, গন্ধদ্রব্য, রঙিন মিষ্টি, কখনও বা বিলিতি প্রসাধন সামগ্রীও উপহার হিসেবে যেত বড় পিতল-কাঁসার পরাতে, বা কাঠের সুদৃশ্য বারকোশে। বিদেশ থেকে আমদানি করা লেসের ঢাকনা দেওয়া এইসব উপহার সামগ্রী তাঁদের আভিজাত্যেরই স্মারক।

আগেই বলা হয়েছে যে, পুরনো কলকাতায় দোল উপলক্ষে সঙের দল বেরত। কৃষ্ণ আরাধনা কেন্দ্রিক দোল উৎসবের সঙ্গে অবশ্য কলকাতার সেকালের নিম্নবর্গের মানুষজনের বিশেষ সংযোগ ছিল না। তাঁদের সাধনা-আরাধনা ছিলেন লৌকিক দেবদেবীরা; শীতলা, ষষ্ঠী, ধর্মঠাকুর, বাশুলী, শিব প্রমুখ। কিন্তু দোলের দিন কলকাতার জেলে ও কৈবর্তপাড়া থেকে সং বের হত। গাজন উৎসবে সঙের রমরমা থাকলেও দোলেও তা নেহাত কম হতো না। অভিজাতজনেরা অনেকাংশে তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। শীতলা, ষষ্ঠী, ধর্মঠাকুর, বাশুলী, শিব, মনসার পুজো করলেও দোলের দিন তাঁরা নিজেদের মতো করে কৃষ্ণ কথা নিয়ে মুখে মুখে রসরসিকতায় গান বাঁধতেন। বলাবাহুল্য যে, সেই সব গান, সব সময় জনরুচির উপযুক্ত হত না। সেই সঙেরা সমসাময়িক সমাজব্যবস্থার বিভিন্ন বিষয় নিয়েও দোলের দিন মুখে মুখে গান বাঁধতেন। ‘বউবাজার’ থেকে ‘ক্রিক রো’ ও সন্নিহিত অঞ্চলে সেই সঙের দল ঘুরে বেরাত। তাঁদের সঙ্গেও রং ও আবির থাকত। রাস্তায় ছেলে-বুড়ো যাঁকে পাওয়া যেত, তাঁকেই রং মাখানো চলত। তাঁরা নিজেদের মধ্যেও রং খেলতেন। কৃষ্ণ কথা ছাড়াও দোলের দিন সমসাময়িক বিষয় নিয়ে ছড়া বেঁধে তাঁদের গান গাওয়া চলত। সেসব উন্নত রুচির না হলেও তাতে সাধারণ মানুষ খুব আমোদ পেতেন। শুধু সংই নয়, সেকালে ‘বউবাজার’ থেকে ‘বাগবাজার’ পর্যন্ত বহু পল্লিতে দোলযাত্রার দিন নগর সংকীর্তনের দল বের হত। বহু দল ‘রূপচাঁদ পক্ষী’র গান গাইতেন। একটি দৃষ্টান্ত দেওয়া যেতে পারে –
“হোরি খেলিছে শ্রীহরি, সহ রাধাপ্যারী,
কুঙ্কুম ধূম, শ্যাম অঙ্গভরি।।
পুস্পমালা, হিন্দোল সাজায়ে ব্রজনারী,
রাই শ্যাম, অনুপম, দোলে তদুপরি।”
এছাড়া ‘রাম বসু’ ও ‘হরু ঠাকুরের’ কথকথাও সেকালের দোল-হোলিকে কেন্দ্র করে জনপ্রিয় হয়েছিল।
পুরনো কলকাতার দিনকাল গত হয়েছে। পরিবর্তনের শত-সহস্র স্রোত মানুষের জীবন ও সমাজের উপর দিয়ে প্রবাহিত। পরিপ্রেক্ষিত কিন্তু পাল্টায়নি। আজও ফাল্গুনী পূর্ণিমায় রঙের উৎসব দোল শুধু পালিত হয় না, সাড়ম্বরেই পালিত হয়। এই দিনটিতেই ১৪৮৬ খ্রিস্টাব্দে চৈতন্যদেব আবির্ভূত হয়েছিলেন। তাঁর ৫০০ বছর পূর্তি থেকে জন্মোৎসব উদযাপনের গুরুত্ব বহুগুণ বেড়েছে। দু’য়ে মিলে বৃন্দাবনের ‘বর্ষানা’ (রাধার জন্মস্থান), ‘নন্দ্‌গাঁও’ (কিশোর কৃষ্ণের অবস্থান) নদীয়ার নবদ্বীপের সঙ্গে মিলেমিশে বর্তমানের কলকাতা মহানগরী নব বৃন্দাবন সদৃশ হয়ে ওঠে বাঙালি-অবাঙালিদের দোল-হোলির উৎসবে।

(তথ্যসূত্র:
১- Fairs and Festivals of India, S.P. Sharma.
২- Festival of colours, Kabir Sehgal & Surishtha Sehgal.
৩- রাণী রাসমণি, প্রবোধচন্দ্র সাঁতরা।
৪- কলিকাতার সেকাল ও একাল, হরিসাধন মুখোপাধ্যায়।
৫- প্রাচীন কলিকাতা পরিচয়, হরিহর শেঠ।
৬- কলিকাতার কথা, প্রমথনাথ মল্লিক।
৭- জোড়াসাঁকোর ধারে, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
৮- জীবনস্মৃতি, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর।
৯- যাত্রী, সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর।
১০- স্মৃতি চিত্র, প্রতিমা দেবী।
১১- কলিকাতা দর্পণ, রাধারমণ মিত্র।
১২- শহর কলকাতার ইতিবৃত্ত, বিনয় ঘোষ।)

Related Post