রানা চক্রবর্তীঃ বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঊনিশ শতকের ভারতের ইতিহাসে হিন্দু পুনরভ্যুত্থান আন্দোলনের প্রসঙ্গটি বিভিন্ন ভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। সেই উদ্যোগ যেমন ঔপনিবেশিকতা-বিরোধী জাতীয়তাবাদী মনোভাব বিস্তারে সহায়ক হয়েছিল, তেমনি সেটার সঙ্গে বহু প্রতিক্রিয়াশীল চেতনার আমদানিও ঘটেছিল, যেগুলোর খেসারত বর্তমানেও সমাজকে দিতে হচ্ছে। ঊনিশ শতকের হিন্দু-পুনরভ্যুত্থান আন্দোলনের মূল্যায়ন করাটা এই প্রবন্ধের প্রতিপাদ্য বিষয় নয়, হিন্দু পুনরভ্যুত্থান আন্দোলন নেতৃত্বে রামকৃষ্ণকে সংশ্লিষ্ট করবার যৌক্তিকতা বিচার করে এই প্রবন্ধের মূল আলোচ্য বিষয়। যেহেতু হিন্দু পুনরুভ্যুত্থান আন্দোলনকালেই রামকৃষ্ণের আবির্ভাব ঘটেছিল, যেহেতু হিন্দু ধর্মপীঠস্থানেই তাঁর অবস্থান ছিল, আর যেহেতু তাঁর কণ্ঠে প্রায়শঃই ‘মা’ ‘মা’ ডাক শোনা গিয়েছিল, সেই কারণেই সিংহভাগ ঐতিহাসিকেরা তাঁকে হিন্দু পুনরভ্যুত্থানবাদদের সগোত্র করেছেন। যদিও অনেক ঐতিহাসিকই রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ প্রসঙ্গে ‘নব্যহিন্দু আন্দোলন’ বিশেষণটি প্রয়োগ করবারও পক্ষপাতী। বস্তুতঃ হিন্দু-পুনরভ্যুত্থানবাদীদের সঙ্গে রামকৃষ্ণকে সংশ্লিষ্ট করবার অর্থ, তাঁর চরিত্রের খণ্ডিত মূর্তির ওপরে সিদ্ধান্ত টানা ছাড়া অন্য কিছুই নয়। এই সিদ্ধানে, রামকৃষ্ণ জীবনের বৃহত্তর ও মূল্যবান অংশকে উপেক্ষা করা হয়েছে, যা অবশিষ্ট বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রাক্কালে অতীব জরুরি। রামকৃষ্ণ চরিত্রের বিশ্লেষণী তথ্য সামনে বাখলে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিতর্ক থাকবেই। সেই প্রসঙ্গে আলোকপাত করে এই নিবন্ধের উদ্দেশ্য।
ঊনিশ শতকের হিন্দু-পুনর্জাগরণের প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোচনার শুরু করা যাক। এই প্রসঙ্গে ‘সুনীতিরঞ্জন রায় চৌধুরী’ জানিয়েছিলেন যে, উক্ত শতকের হিন্দু-পুনরভ্যুত্থানবাদীরা প্রাচীন ভারতের ঐতিহ্যকে পুনঃপ্রবর্তিত করবার পক্ষপাতী ছিলেন। অতীতের কোন কোন যুগকে তাঁরা প্রত্যাবর্তন করাতে চেয়েছিলেন, সেটাও খুব স্পষ্ট। মনে হয় যে, বৈদিক যুগ, মহাভারতের যুগ, অশোক ও চন্দ্রগুপ্তের যুগই তাঁদের লক্ষ্য ছিল। এই প্রসঙ্গে সংস্কারবাদী ও হিন্দু-পুনরভ্যুত্থানবাদীদের পার্থক্যটিও অবশ্য উল্লেখ্য। উক্ত সময়ের সংস্কারবাদীরা বর্তমান সমাজব্যবস্থার কথাই চিন্তা করতেন, এবং বাস্তব পরিপ্রেক্ষিতে সেই সমস্যার সমাধানের কথা ভাবতেন। অন্যদিকে পুনরভ্যুত্থানবাদীরা গ্রীক দেবতা জেনাসের মতো অতীতের স্বর্ণযুগ কল্পনার সঙ্গে সঙ্গে সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের কথাও চিন্তা করেছিলেন। ইউরোপীয় সমাজ-চিন্তার অভিজ্ঞতা ও যুক্তিবাদ যেখানে সংস্কারবাদীদের আদর্শ ছিল, সেখানে পুনরভ্যুত্থানবাদীদের আদর্শ ছিল হিন্দু শাস্ত্র এবং ভারতের অতীত ইতিহাস। এই প্রসঙ্গে ‘লালা রাজপত রাই’ লিখেছিলেন, “The former are bent on relying more upon reason and the experience of European society while the latter are disposed to primarily look at the shastras and the past history and the traditions of their people and the ancient institutions of the land which were in vogue when nation was in the zenith of its glory.” সেই সময়ের ইংরেজি শিক্ষিত সম্প্রদায়ের হিন্দুধর্মের প্রতি অনাস্থা ও অবজ্ঞার প্রতিক্রিয়া স্বরূপই হিন্দু পুনরভ্যুত্থান আন্দোলন অনেকটা দানা বেঁধেছিল। তার সঙ্গে এদেশে খ্রিস্টধর্ম প্রচারকদের নির্বিচার ধর্মান্তরকরণ ও হিন্দু-বিদ্বেষ যুক্ত হয়েছিল। এর ফলে তখনকার একশ্রেণীর হিন্দুদের মনে ত্রাসের সৃষ্টি হয়েছিল, এবং তাঁরা হিন্দুধর্মের মাহাত্ম্য পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য সর্বতোভাবে উদ্যোগী হয়েছিলেন। ঊনিশ শতকের হিন্দু পুনরভ্যুত্থানবাদের মূলে সেই প্রচেষ্টায় ছিল। ‘শিবনাথ শাস্ত্রী’ ১৮৭০-৭৯ কালপর্বকে ‘ব্রাহ্মসমাজের প্রভাব হ্রাস ও হিন্দুধর্মের পুনরুত্থানের সূচনা কাল’ বলে উল্লেখ করেছিলেন। ‘প্রচার’ (প্রথম প্রকাশ ১৮৮৪), এবং ‘নবজীবন’ (১৮৮৪) পত্রিকার আত্মপ্রকাশ ও হিন্দুধর্মের নব ব্যাখ্যাদান সেই সময়ের উল্লেখযোগ্য ঘটনা। তাছাড়া ওই একই সময়ে ‘কৃষ্ণপ্রসন্ন সেন’ (১৮৪৯-১৯০২) ও ‘পণ্ডিত শশধর তর্ক চূড়ামণি’র (১৮৫১-১৯২৮) হিন্দুধর্মের ব্যাখ্যা ও নব্য হিন্দুধর্ম প্রচার হিন্দু পুনরভ্যুত্থান আন্দোলনকে তীব্র গতিদান করেছিল। ঊনিশ শতকের গবেষকেরা ধারণা করেন যে, উক্ত শতকের শেষপর্বে যে হিন্দু পুনরভ্যুত্থানের জোয়ার এসেছিল, সেটার অঙ্কুর ওই শতকের শুরুতেই বিভিন্ন ধর্মের পারস্পরিক প্রতিস্পর্ধী প্রবণতার মধ্য দিয়েই মাথা তুলেছিল। ঊনিশ শতকের প্রথমার্ধে খ্রিস্টধর্মই হিন্দুধর্মের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল। রামমোহন রায় খ্রিস্টীয় ‘ত্রিত্ববাদ’ খণ্ডন করে খ্রিস্টান পাদ্রীদের সঙ্গে যেমন তর্ক যুদ্ধে প্রবৃত্ত হয়েছিলেন, তেমনি আবার রামমোহনের পৌত্তলিকতা বিরোধী বেদান্ত প্রতিপাদ্য ধর্ম ও ব্রহ্মসভার (১৮৩০) বিরোধিতা করে রক্ষণশীল হিন্দুসমাজ ‘ধর্মসভা’ও (১৮৩০) প্রতিষ্ঠা করেছিল। রামমোহন খ্রিস্টধর্ম প্রবাহ রোধের উদ্যোগে যে ধর্ম ও ধর্মসভার সূচনা করেছিলেন, পরবর্তীকালে ‘মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের’ হাতে সেটাই ‘ব্রাহ্মসমাজ’ হয়েছিল। মহর্ষি ব্রাহ্মধর্মকে হিন্দুধর্মের সমুন্নত রূপ বলে মনে করতেন। মিশনারী ‘আলেকজাণ্ডার ডাফ’ (১৮০৬-৭৮) প্রবর্তিত ‘জেনারেল অ্যাসেমব্লি’ এই দেশীয় কিশোর ও যুবকদের খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করবার কেন্দ্র হয়ে উঠলে, তিনি সেকাজের প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠেছিলেন, এবং রক্ষণশীল হিন্দু ‘রাধাকান্তদেব’কে সাহায্য করবার জন্য এগিয়ে গিয়েছিলেন। অতঃপর ‘হিন্দু হিতার্থী বিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। অনুরূপ উদ্যোগেই ‘হিন্দু কলেজে’র খ্রিস্টান ব্যক্তিবর্গের অপ্রতিহত গতায়াতের প্রতিবাদেই রক্ষণশীল হিন্দু গোষ্ঠী ‘হিন্দুমেট্রোপলিটন কলেজ’ গড়ে তুলেছিল। পরবর্তীসময়ে দেবেন্দ্রনাথের ব্রাহ্মসমাজে ‘কেশবচন্দ্র সেন’ খ্রিস্টভাবনার অনুপ্রবেশ ঘটালে, এবং ‘ব্রাহ্মবিবাহ’ প্রসঙ্গে ‘ব্রাহ্মরা হিন্দু নয়’ বলে মন্তব্য করলে, প্রতিপক্ষ হিন্দুসমাজ তাঁদের হিন্দু পুনরভ্যুত্থান আন্দোলনকে আর জোরদার করেছিলেন। তাই হিন্দু পুনরভ্যুত্থান আন্দোলনের কারণ হিসাবে গবেষকরা মূলতঃ দুটি শর্তের কথা উল্লেখ করেন। সেগুলোর মধ্যে প্রথমটি হল, মূলগত (basic), এবং দ্বিতীয়টি হল তাৎক্ষণিক (immediate)। মূলগত কারণটি ছিল – হিন্দু সমাজ কর্তৃক প্রাচীন হিন্দু রীতিনীতিকে শ্রেষ্ঠত্ব জ্ঞান করে সেটার পুনঃপ্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা, আর তাৎক্ষণিক কারণের নেপথ্যে ছিল সমকালীন বিক্ষিপ্ত ঘটনার প্রবাহ; যথা – কেশবচন্দ্রের খ্রিস্টপ্রীতি, ব্রাহ্মবিবাহ বিধি প্রবর্তন (১৮৭২), ব্রাহ্ম স্ত্রী স্বাধীনতা, ইলবার্ট বিল (১৮৮২) ও সহবাস সম্মতি বিধি (১৮৯১)। ঊনিশ শতকের রক্ষণশীল হিন্দুসমাজ প্রায় বরাবরই ব্রাহ্মসমাজের বিরোধিতা করে গিয়েছিলেন। তাঁরা কেশবচন্দ্রের খ্রিস্টপ্রীতিকে যেমন ভালো চোখে দেখেন নি; তেমনি ব্রাহ্ম স্ত্রী স্বাধীনতা রক্ষণশীল হিন্দু চেতনার পরিপন্থী, ব্রাহ্মবিবাহ বিধি হিন্দু সমাজের বাল্যবিবাহ ও কৌলিন্য প্রথার প্রতিবাদস্বরূপ, এবং পরিশেষ সহবাস সম্মতি বিধির মাধ্যমে হিন্দুকন্যার বিবাহের সময়কাল (অর্থাৎ দৈহিক পরিণতির পর বিবাহ ব্যবস্থার) নির্ধারিত হলে হিন্দুসমাজ প্রমাদ গুণেছিল। তাঁরাই তখন বিদ্রোহী হয়ে পুনরভ্যুত্থানকে কামনা করেছিলেন। ইলবার্ট বিল সংক্রান্ত আন্দোলন সেই আন্দোলনে ঘৃতাহুতি দিয়েছিল। ওই বিলে এই দেশীয় বিচারকদের দ্বারা ইউরোপীয়দের বিচারের অধিকার দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ইউরোপীয়রা সেটা মানতে রাজি হননি। তাঁরা আন্দোলন করবার পরে সরকার সেই উদ্যোগকে পরিবর্তন করেছিলেন। ওই অবমাননা এই দেশে হিন্দু পুনরভ্যুত্থানকে অনেকাংশে প্রভাবিত করেছিল।
আরো পড়ুন- নাচতে নাচতে স্ট্রোক হয়ে যাচ্ছে, তবুও নাচ থামছে না! ডান্সিং প্লেগের ঘটনা কতখানি সত্যি?
শ্রীরামকৃষ্ণকে হিন্দু পুনরভ্যুত্থান আন্দোলনের নায়ক হিসাবে চিহ্নিত করবার প্রবণতা, এবং সেই চিন্তার পৃষ্ঠপোষকের সংখ্যা যথেষ্টই বলে দেখতে পাওয়া যায়। অনেকে যেমন স্রেফ ভাবাবেশে এই সিদ্ধান্তকে মেনে নেন, অনেকে তেমনি জোর করে যুক্তি খাড়া করে এই সিদ্ধান্ত অন্যকে মানাতে চান। এই প্রসঙ্গে তিনটি তত্ত্বকে উল্লেখ করা যেতে পারে। প্রথম তত্ত্বটি হল ‘প্রাতিষ্ঠানিক গুণাবলীভিত্তিক’ বা ‘Institutional concept’, দ্বিতীয় তত্ত্বটি হল ‘আচরণিক ভিত্তি’ বা ‘Behavioural concept’, এবং তৃতীয় তত্ত্বটি হল ‘উদ্ধৃতিভিত্তিক তত্ত্ব’ বা ‘Quotational concept’। যাঁরা শ্রীরামকৃষ্ণকে তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক বৈশিষ্ট্য গুণে হিন্দু পুনরভ্যুত্থানবাদী বলে চিহ্নিত করতে চান, তাঁদের বক্তব্য হল যে, কৈবর্ত রমণী রানী রাসমণি জাতিতে শূদ্র বংশীয়া ছিলেন। তিনি জাত্যকৌলীন্যে উন্নীত হওয়ার জন্যই দক্ষিণেশ্বরে ভবতারিণী মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, এবং সেখানে দরিদ্র ব্রাহ্মণ গদাধরকে পুরোহিত থেকে অবতার পদে ঢক্কানিনাদের জোরে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। যেহেতু হিন্দু আরাধ্যা দেবী কালীর কাছে পৌরোহিত্য জোরে তিনি অবতার হয়েছেন, সেই কারণে সমকালীন হিন্দু পুনরভ্যুত্থান আন্দোলনে তিনি সহজেই অংশীদার। আচরণীয় বৈশিষ্ট্যে যাঁরা রামকৃষ্ণকে ঐ পর্যায়ভুক্ত করবার পক্ষপাতী তাঁদের মতে, হিন্দুধর্ম পুনরভ্যুত্থান প্রচেষ্টায় রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের সর্বাপেক্ষা তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তিনি তাঁর কথায় ও কাজে হিন্দুধর্মকে নিম্নস্তর থেকে তুলে এনে উচ্চতম আসনে অধিষ্ঠিত করে গিয়েছেন। হিন্দু পুনরভ্যুত্থানের বড় বৈশিষ্ট্য হল যুক্তি বিরোধী ভক্তি চর্চা। রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব শুধু ভক্তি রসের প্রতিষ্ঠা করে ক্ষান্ত থাকেন নি, তিনি পাণ্ডিত্যকেও চরম আঘাত করেছিলেন। ভক্তিবাদভিত্তিক হিন্দু-জাগরণের দিক থেকে সেটার প্রয়োজনীয়তা হয়ত তিনি উপলব্ধি করেছিলেন। পাণ্ডিত্যাভিমানীদের সঙ্গে শকুনদের তুলনা করে তিনি বলতেন যে, শকুনি যত উপরেই উড়ুক না কেন, তার নজর যেমন সব সময় ভাগাড়ের দিকে থাকে, তেমনি পণ্ডিতেরাও কখনো কামিনী-কাঞ্চনের আসক্তি থেকে মুক্ত হতে পারে না। তিনি মনে করতেন যে, বেশি পড়াশুনা করবার কোন প্রয়োজন নেই – স্রেফ ভক্তি থাকলেই হল। গীতা পড়লে কি হয়? দশবার ‘গীতা’ ‘গীতা’ বললে যা হয়। ‘গীতা’ ‘গীতা’ বললে ‘ত্যাগী’ হয়ে যায়। সংসারে কামিনী কাঞ্চনে যাঁর আসক্তি ত্যাগ হয়ে গেছে, সে ঈশ্বরেতে ষোল আনা ভক্তি দিতে পেরেছে, সেই গীতার মর্ম বুঝেছে। এছাড়া তিনি আরো বলেছিলেন যে, পাণ্ডিত্যে কি আছে? ব্যাকুল হয়ে ডাকলে তাঁকে পাওয়া যায়। নানা বিষয়ে জানবার দরকার নেই। এই পাণ্ডিত্যবিরোধী মনোভাবের জন্য তিনি ‘শশধর তর্ক চূড়ামণি’ ও ‘ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের’ প্রতি কিছুটা কটাক্ষ করেছিলেন। যাঁরা উদ্ধৃতিমূলক তথ্য দিয়ে রামকৃষ্ণকে হিন্দু পুনরভ্যুত্থানবাদী প্রমাণের নমুনা হিসেবে উপস্থিত করতে চান, তাঁরা বলেন যে, ঐ যুগের সর্বাপেক্ষা রহস্যবাদী ও আধ্যাত্মিক শিক্ষার ক্ষেত্রে শ্রীরামকৃষ্ণ সর্বোচ্চ স্থানের অধিকারী ছিলেন। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর বা কেশবচন্দ্র সেন – এই দুই আধ্যাত্মিক পুরুষের যেমন একটা পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রেক্ষাপট ছিল, রামকৃষ্ণ ঠিক তার বিপরীতে ছিলেন। বাংলায় গ্রাম্যজীবন ও শিক্ষা-দীক্ষা-পূজা-অর্চনা ইত্যাদির প্রেক্ষাপটেই রামকৃষ্ণ তাঁর আধ্যাত্মিক পরিণতির দিকে অগ্রসর হয়েছিলেন। অতি সহজ সরল গ্রাম্য ভাষায় তিনি তাঁর ভক্তদেরকে আধ্যাত্মিক শিক্ষা দিয়েছিলেন। দেবেন্দ্রনাথ ও কেশবচন্দ্ৰ যেমন তাঁদের ব্রাহ্ম সমাজে আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে ভারতীয় আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে পাশ্চাত্য শিক্ষাদীক্ষার একটা সমন্বয় ঘটিয়েছিলেন, রামকৃষ্ণের ক্ষেত্রে সেটা সম্পূর্ণতঃই ভারতীয় ঐতিহ্যগত ছিল, এবং পরিণামে হিন্দু পুনরুত্থানবাদী হয়ে উঠেছিল। রামকৃষ্ণের শ্রেষ্ঠতম শিষ্য ‘স্বামী বিবেকানন্দের’ ভাষায় – “আর্য জাতির প্রকৃত ধর্ম কি, এবং সতত বিবাদমান আপাত-প্রতীয়মান বহুধা বিভক্ত সর্বথা-প্রতিযোগী, আচার সঙ্কুল সম্প্রদায়ে সমাচ্ছন্ন, স্বদেশীয় ভ্রান্তিস্থান ও বিদেশীয় ঘৃণাস্পদ হিন্দুধর্ম নামক যুগ যুগান্তরব্যাপী বিখণ্ডিত ও দেশ-কালযোগে ইতঃস্ততঃ বিক্ষিপ্ত ধর্মখণ্ড সমষ্টির মধ্যে যথার্থ একতা কোথায় – এবং কালবেশে নষ্ট এই সনাতন ধর্মের সার্বলৌকিক, সার্বকালিক ও সার্বদেশিক স্বরূপ স্বীয় জীবনে নিহিত করিয়া, লোকসমক্ষে সনাতন ধর্মের জীবন্ত উদাহরণ স্বরূপ আপনাকে প্রদর্শন করিতে লোকহিতের জন্য শ্রীভগবান রামকৃষ্ণ অবতীর্ণ হইয়াছেন। … নবযুগ ধর্ম সমগ্র জগতের বিশেষতঃ ভারতবর্ষের কল্যাণের বিচার এবং হে নবযুগ ধর্ম প্রবর্তক শ্রীভগবান পূর্বগ শ্রীযুগধর্ম প্রবর্তকদিগের পুনঃ সংস্কৃত প্রকাশ। হে মানব, ইহা বিশ্বাস কর ও ধারণ কর।” তৃতীয় তত্ত্বের প্রবক্তারা বলে যে, শ্রীরামকৃষ্ণ সম্পর্কে স্বামী বিবেকানন্দের উক্ত বক্তব্যের পরে আর কোন ব্যাখ্যার প্রয়োজনীয়তা থাকতে পারে না। নিঃসন্দেহেই রামকৃষ্ণের আবির্ভাবকে তিনি হিন্দু পুনরুভ্যুত্থানবাদী দৃষ্টিতেই দেখেছিলেন, এবং সেই ভাবেই তাঁর ভক্তি শ্রদ্ধা প্লাবিত হয়েছিল। ঐ দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেকানন্দের উক্ত বিশ্লেষণ সম্পূর্ণ সঠিক ছিল। রামকৃষ্ণের সমগ্র জীবন ও উপদেশাবলী খুব সাধারণ, সরল এবং গ্রাম্য পদ্ধতিতে হিন্দু পুনরুভ্যুত্থানবাদের লক্ষ্যেই পরিচালিত হয়েছিল।
গবেষক সুনীতিরঞ্জন রায়চৌধুরী তাঁর গ্রন্থে বহু তথ্যের সমাবেশে ঊনিশ শতকের হিন্দু পুনরভ্যুত্থান আন্দোলনের নায়কদের কর্মপ্রয়াসকে লিপিবদ্ধ করেছিলেন। ওই আন্দোলনের বিশেষ নেতৃত্ব প্রসঙ্গে তিনি ‘শশধর তর্কচূড়ামণি’ (১৮৫১-১৯২৮), ‘কৃষ্ণপ্রসন্ন সেন’ (১৮৮৯-১৯০২), ‘চন্দ্ৰনাথ বসু’ (১৮৪৪-১৯১০), ‘অক্ষয় চন্দ্র সরকার’ (১৮৪০-১৯১৭), ‘ইন্দ্ৰনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়’ (১৮৪৯-১৯১১) ও ‘যোগেশ চন্দ্র বসু’র (১৮৫৪-১৯০৫) নামোল্লেখ, এবং তাঁদের কর্মধারার বিস্তৃত বিবরণ উপস্থাপন করেছিলেন। তাঁর গবেষণার বিস্তৃত বিশ্লেষণী ধারা থেকে হিন্দু পুনরভ্যুত্থানবাদীদের তিনটি মুখ্য বৈশিষ্ট্যকে শনাক্ত করা যেতে পারে। প্রথমতঃ, অহিন্দুদের প্রতি তাঁদের বিরূপ মনোভাব (শশধর তর্কচূড়ামণি খ্রিস্টান বিরোধী এবং অক্ষয়চন্দ্র সরকার ব্রাহ্ম প্রতিরোধী ছিলেন); দ্বিতীয়তঃ, প্রাচীন আচার ও কুসংস্কারকে আদর্শ হিসাবে গ্রহণের প্রবণতা (কৃষ্ণপ্রসন্ন সেন ও শশধর তর্কচূড়ামণি কর্তৃক হিন্দু আচার সর্বস্বতার ভ্রান্ত বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেওয়ার প্রবণতা), এবং তৃতীয়তঃ, প্রগতিবাদী চিন্তা চেতনার বিরোধিতা (কৃষ্ণপ্রসন্ন সেন কর্তৃক সহবাস সম্মতি আইনের বিরোধিতা, চন্দ্রনাথ বসু কর্তৃক খাদ্যাখাদ্যের বিচার, জাতিভেদ ও বর্ণভেদের সমর্থন, ইন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় কর্তৃক নারী স্বাধীনতার ব্যঙ্গ করা; এবং যোগেশ চন্দ্র বসুর বিধবা বিবাহের বিরুদ্ধাচারণ)।
আগেই বলা হয়েছে যে, ঊনিশ শতকের হিন্দু পুনরভ্যুত্থানবাদীদের চরিত্রের অন্যতম লক্ষণ ছিল অহিন্দু অসহনীয়তা। অথচ রামকৃষ্ণ ছিলেন ঐ চেতনার পরিপন্থী ছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ জীবনী পাঠক-পাঠিকা মাত্রেই অবগত আছেন যে, তিনি একাধিক ধর্মের অনুশীলনে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন, এবং বিভিন্ন ধর্মসম্প্রদায়ের ব্যক্তিদের সঙ্গে তাঁর নিবিড় সখ্যও অব্যাহত ছিল। ১৮৬৭ সালে তিনি ইসলাম ধর্ম সাধনা করবার জন্য ‘ওয়াজেদ আলি খাঁ’র কাছ থেকে দীক্ষা নিয়েছিলেন। ওই সময়ে তিনি, দক্ষিণেশ্বরের গাজিপীরের তলায় ত্রিসন্ধ্যা নামাজ পাঠ করেছিলেন। তখন তিনি প্রায়ই মোল্লাপাড়ার (দক্ষিণেশ্বর) মসজিদে নামাজ পাঠের সময়ে উপস্থিত থাকতেন। এছাড়া ‘ফকির ওস্তাগরের’ কাছে তিনি দীর্ঘদিন ধরে কোরান পাঠ নিয়েছিলেন। তাঁর কাছে যেমন ‘ডাঃ ওয়াজিজের’ মত শিক্ষিত মুসলমানও আসতেন, তেমনি একাধিক ব্যবসায়ী ও শ্রমজীবী মুসলমানও (শেখ আবদুল শোভান, যোছন মোল্লা, খাতির মিস্ত্রি প্রমুখ) তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিলেন। কেবলমাত্র ইসলাম প্রতিনিধিরাই নন, একাধিক শিখ প্রতিনিধির সঙ্গেও রামকৃষ্ণের নিবিড় সংযোগ তাঁর বিভিন্ন জীবনীগ্রন্থে বিবৃত করা হয়েছে। সমকালে দক্ষিণেশ্বরের সরকারি বারুদগোলার পাহারায় শিখ সৈন্যদের যে পল্টন ছিল, সেই শিখ ব্যক্তিদের সঙ্গে রামকৃষ্ণের প্রত্যহ সংযোগ ছিল; এবং সেই সূত্র ধরেই ব্যারাকপুর ও দমদম ক্যান্টনমেন্টের ব্যারাকের শিখ সৈন্যরা তাঁদের কাজের অবসরে রামকৃষ্ণের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিলেন। হাবিলদার ‘কুঁয়োর সিং’-এর সঙ্গে রামকৃষ্ণের যোগাযোগের বিস্তৃত সংবাদ পাওয়া যায়। তাঁদের কাছেই রামকৃষ্ণ ‘গ্রন্থ সাহেবের’ পাঠ নিয়েছিলেন। রামকৃষ্ণ জীবনীগ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ১৮৬৪ সালে তিনি শিখ ধর্মেও দীক্ষা নিয়েছিলেন। বৌদ্ধধর্মের প্রতিও তাঁর যথেষ্ট অনুরাগ ছিল। এমনকি খ্রিস্টানদের প্রতিও তাঁর স্বভাবজাত প্রীতি ছিল। তিনি সেই ধর্মানুশীলনও করেছিলেন। শিবনাথ শাস্ত্রীর সঙ্গে ‘পাদ্রী যোশেফ কুক’ তাঁর সন্দর্শনে এলে তিনি তাঁকে সসম্ভ্রমে প্রণাম জানিয়েছিলেন। তদানীন্তন প্রেসিডেন্সী কলেজের অধ্যক্ষ ‘এইচ. সি. টনি’ও নিজের লেখায় রামকৃষ্ণ প্রসঙ্গে গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেছিলেন। এই সমস্ত ঘটনা নিঃসন্দেহে প্রমাণ করে দেয় যে, রামকৃষ্ণের সঙ্গে সকল ধর্ম সম্প্রদায়েরই গভীর সম্প্রীতি ছিল। মুসলমানরা রামকৃষ্ণকে তাঁদের ‘পীর’ বলে ভাবতেন। শিখরা সকলের সামনেই তাঁকে ‘তুমিই নানক’ বলে সম্বোধন করতেন। সমকালীন ব্রাহ্ম সমাজের স্তম্ভ দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কেশবচন্দ্র সেন ও শিবনাথ শাস্ত্রী প্রমুখ সকলের সঙ্গেই রামকৃষ্ণের আত্মিক সম্পর্ক ছিল। এই পটভূমিকায় প্রশ্ন তোলা যেতে পারে যে, শ্রীরামকৃষ্ণ যদি সত্যিই হিন্দু পুনরভ্যুত্থান আন্দোলনের নায়ক ছিলেন, তাহলে অহিন্দু ব্যক্তিবর্গ কিভাবে তাঁর কাছে নৈকট্য ও নিরপত্তা পেয়েছিলেন? হিন্দু পুনরভ্যুত্থানবাদীদের দ্বিতীয় প্রকৃতি, যা কুসংস্কারকে আঁকড়ে ধরে রাখতে চেয়েছিল, শ্রীরামকৃষ্ণ সেখানেও প্রতিবাদী ছিলেন। ব্রাহ্মণ বংশে জন্মগ্রহণ করে জীবনের প্রথম পর্বে দেবীপূজায় লিপ্ত থেকেও তিনি ব্রাহ্মণের বর্ণচিহ্ন উপবীত বর্জন করেছিলেন। লোকাচার, জাতিভেদ, খাদ্যাখাদ্যের বিচার করেননি; মেথরকে আলিঙ্গন করেছিলেন। আচার-সর্বস্ব ভক্তকে বলেছিলেন, “শুচিবাই ছেড়ে দাও। যাঁদের শুচিবাই, তাঁদের জ্ঞান হয় না।” হিন্দু পুনরভ্যুত্থানবাদীরা যখন আচারতন্ত্রকে জোরালো ভাষায় সমর্থন ঘোষণা করেছিলেন, রামকৃষ্ণ তখন বলেছিলেন যে, শাস্ত্রজ্ঞান, আচার-অনুষ্ঠান, যাগযজ্ঞ, কৃচ্ছ্রসাধন, জপতপ কোনটাই অপরিহার্য নয়। মনই আসল – মানুষ মনেতেই মুক্ত, মনেতেই বদ্ধ। প্রসঙ্গতঃ নিজের জনৈক একজন ভক্তকে তিনি বলেছিলেন, “কোশাকুশি ফেলে দাও।” শশধর তর্কচূড়ামণি যখন সবকিছু কুসংস্কারের পিছনে ‘বেদে আছে’ বলে বিশেষণ যোগ করেছিলেন, তখন রামকৃষ্ণ তাঁকে বলেছিলেন, “কলিতে বেদ মত চলে না।” তিনি যেমন প্রতিক্রিয়াশীলতার প্রতিরোধ করেছিলেন, তেমনি প্রগতিবাদী চেতনার পৃষ্ঠপোষকতাও করেছিলেন, এবং সেই চেতনায় তাঁর পার্ষদবর্গকে উদ্বুদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। তাঁর বক্তব্যে ভক্তিরসের প্রাধান্য থাকলেও যুক্তিনিষ্ঠা কিন্তু কোন অংশেই কম কিছু ছিল না। তিনি বলতেন, “ভক্ত হবি তো বোকা হবি কেন?” তিনি আরো বলেছিলেন, “শুধু মেনে লওয়া কপটতা!” তাঁর বিশেষ শিক্ষা নির্দেশ ছিল – “ভদ্রতার নামে কাপুরুষ হবে না। সর্বভূতে ঈশ্বর দর্শন করলেও নপুংসক হবে না। কাম সম্পর্কে শুচিবাইগ্রস্ত হবে না।” তিনি যে নারী স্বাধীনতার পূর্ণ সমর্থক ছিলেন, সেটা তাঁর জীবনী পাঠক-পাঠিকা মাত্রেই অবগত রয়েছেন। তিনি যেমন তাঁর স্ত্রী ‘সারদাদেবী’কে ভক্তদের ঘরে যাতায়াতের নির্দেশ দিয়েছিলেন, তেমনি ভক্তা ‘গৌরীদাসী’কে মহিলাদের শিক্ষা দেওয়ার জন্য একটি বিদ্যালয় খোলবার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনি চাইতেন যে, তাঁর পার্ষদেরা ইংরাজীতে কথাবার্তা বলুন। সমকালীন বিজ্ঞান আন্দোলনের পথিকৃৎ ‘মহেন্দ্রলাল সরকারের’ ‘বিজ্ঞান সভা’ (Science Association) সম্পর্কে তাঁর বিশেষ কৌতূহল ছিল। নিজের বিশাল ভক্তমণ্ডলীর মধ্যে তিনি তাঁর পার্ষদ হিসাবে যাঁদের চিহ্নিত করেছিলেন, তাঁরা প্রায় সকলেই কিন্তু পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন। সর্বোপরি তাঁর আচার-আচরণে বিজ্ঞানমনস্কতার লক্ষণ প্রতি পদে পদে প্ৰকাশ পেয়েছিল। এরকম বহু নমুনাই তাঁর প্রগতিবাদী চেতনার দ্যোতক হিসেবে উপস্থাপন করা যেতে পারে। অতঃপর রামকৃষ্ণের ‘কালী সাধনা ও হিন্দু জাগরণ’ সরলীকরণ প্রবণতা প্রসঙ্গে নজর দেওয়া যাক। রামকৃষ্ণ ধর্মীয় পুরুষ ছিলেন। ধর্মকে তিনি একটা সামাজিক শর্ত হিসাবেই দেখেছিলেন। তিনি নিজে একাধিক ধর্ম অনুশীলন করেছিলেন, এবং সকল ধর্মের প্রকৃত উদ্দেশ্য যে একই, সেই প্রত্যয় দ্বিধাহীন কণ্ঠে সবাইকে জানিয়েছিলেন। কিন্তু তবুও বহুল প্রচারে তিনি একজন কালীপূজক রূপেই চিহ্নিত হয়ে রয়েছেন। এটাকে ইতিহাসের অপব্যাখ্যা ছাড়া অন্য কিছু বলা যায় না। সকলেই জানেন যে, – “যত মত তত পথ” – রামকৃষ্ণেরই সারস্বত বাণী। কিন্তু তবুও তাঁকে একক ধর্মের নিগঢ়ে আটকে রাখবার দূরভিসন্ধির কারণ বুঝতে পারা যায় না। রামকৃষ্ণ ১৮৫৩ সালে কলকাতায় এসেছিলেন। ১৮৫৫ সাল থেকে ১৮৮৬ সাল পর্যন্ত তিনি দক্ষিণেশ্বরে অবস্থান করেছিলেন। দক্ষিণেশ্বর তথা কলকাতায় তাঁর ৩১ বছর ধরে অবস্থানের মধ্যে মাত্র তিন বছর (১৮৫৬-৫৮ সাল) তিনি কালীপূজক পদে ব্রতী ছিলেন। তারপর তাঁকে আর পূজকরূপে দেখা যায় নি। সেই জায়গায় পর্যায়ক্রমে তাঁর ভাই ‘রামতারক’, তাঁর ভাইপো ‘রামঅক্ষয়’ ও ‘রামলাল’ হাজির হয়েছিলেন। এর পরবর্তী কালপর্বে তিনি বিভিন্ন ধর্মসাধনায় ও বিবিধ লোকশিক্ষার কাজে ব্যাপৃত ছিলেন। এহেন কর্মবিন্যাসে যুক্ত রামকৃষ্ণকে কিভাবে শুধু একজন কালীপূজক রূপে চিহ্নিত করা সঙ্গত? এটা যেমন সত্যের অপলাপ, তেমনি ইতিহাস বিকৃতিও বটে। এই প্রসঙ্গে রামকৃষ্ণের অন্যতম সমালোচক, বৈদিক রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ডাইরেক্টর ‘শৈলেন্দ্রনারায়ণ ঘোষাল’ গভীর প্রত্যয়ের সঙ্গে জানিয়েছিলেন, “রামকৃষ্ণ কালীকিঙ্কর ছিলেন না। রামকৃষ্ণের সিদ্ধিলাভ প্রস্তরময়ী কালীমূর্তি পূজা করে নয়। তা এসেছিল তাঁর আকুতি, সত্যনিষ্ঠা ও ধ্যান তন্ময়তায়।” রামকৃষ্ণ কণ্ঠে প্রায় উচ্চারিত ‘মা’ শব্দটি কোন মূর্তির আঙ্গিক ছিল না, সেটা ‘উন্নত চেতনার’ প্রতীক ছিল। অতীতে রামকৃষ্ণ মিশনের একাধিক সন্ন্যাসীও এই একই অভিমত প্রকাশ করেছিলেন। রামকৃষ্ণ বলতেন, ব্রহ্ম ও শক্তি অভেদ। যেই ‘মা’ – সেই-ই ‘ব্ৰহ্ম’। গবেষক-সন্ন্যাসী ‘স্বামী সোমেশ্বরানন্দ’ রামকৃষ্ণের ‘ঈশ্বর’ ও ‘মা কালী’ প্রসঙ্গে বিশেষ বিশ্লেষণী ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছিলেন, “এ বিশ্বে সবচেয়ে মহান সম্পদ মানুষের চেতনা। বিশ্বের সবচেয়ে প্রগতিশীল শক্তিও এটিই। বিভিন্ন দেশ-কালে এই মানবচেতনা বিভিন্ন রূপে আত্মপ্রকাশ করছে নানান ক্রিয়াকাণ্ডে। … পূর্ণতা প্রাপ্তির আকুতিতেই মানবচেতনার শুরু। চেতনার পূর্ণবিকাশে এই পূর্ণতাকেই শ্রীরামকৃষ্ণ ‘ঈশ্বর’ বলে অভিহিত করেছেন। … ধর্মের মাধ্যমে মানুষের যে মৌল আকুতি সুপ্রাচীন যুগে দেখা দিয়েছিল তার প্রকাশ ঘটেছিল পিতৃ-উপাসনা ও প্রকৃতি উপাসনার মধ্যে দিয়ে। পরবর্তীযুগে কখনো পুরোহিত কখনও রাজা ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসাবে গণ্য হলেন। ভারত-মিশর-গ্রীস-ব্যাবিলনের ইতিহাস আমাদের এই তথ্যই দেয়। এর পরের যুগে ভারতীয় লোক-চেতনায় নতুন চিন্তা দেখা যায়। তখন মানুষ আর ঈশ্বর প্রতিনিধি নয়, ঈশ্বরের সমতুল্য হতে চাইছে। … আবার কখনো মানুষ ঈশ্বরকে অস্বীকার করে নিজেই ঈশ্বর হতে চাইল, ঈশ্বরের স্থানে বসার প্রয়াস করল। নীৎসের অতিমানব এই মতেরই প্রবক্তা। কমিউনিস্ট সম্প্রদায়ে মার্কস, লেনিন, মাও সে তুং, হো-চি-মিনও একই পথের পথিক। গত দুই শতকের ভারতে দেখা দিল নতুন চিন্তা। বহু মনীষী ও সমাজনেতা আবির্ভূত হয়ে জাতিকে পথ দেখাবার চেষ্টা করলেন। এঁদের অনেকে যেমন সরাসরি ঈশ্বর-বিশ্বাসকে পাথেয় করে এগোতে চাইলেন, অনেকে আবার ঈশ্বরের স্থানে বসাতে চাইলেন অন্য কিছুকে। ‘ঈশ্বরের স্থানে’ অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ স্থানে, সার্ত্রের ভাষায় যা ‘পরম’ তার স্থানে। অক্ষয়কুমার দত্ত বসালেন বিজ্ঞানকে, ডিরোজিও যুক্তিকে, কবি ঈশ্বর গুপ্ত মাতৃভাষাকে, রাজেন্দ্রলাল মিত্র স্বজাতির ইতিহাসকে। পাশ্চাত্যেও দেখি একই ধারা। ঈশ্বরের স্থানে দস্তয়েভস্কি বসাতে চাইলেন ন্যায়কে, রুশো জনসাধারণের ইচ্ছাকে, হেগেল রাষ্ট্রকে, আর মার্কস সর্বহারা শ্রেণীকে। পৃথিবীর ইতিহাসে মানুষের যে বিভিন্ন চিন্তাধারা দেখা গেছে তা এভাবেই মূলত ঈশ্বরকেন্দ্রিক। মানুষ কখনো ঈশ্বরের সমতুল্য হতে চেয়েছে, কখনো ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী, কখনো বা নিজেই ঈশ্বর হতে চেয়েছে, কখনো আবার ন্যায়-রাষ্ট্র-শ্রেণী-ভাষা-স্বদেশ-বিজ্ঞান ইত্যাদির কোন একটিকে ঈশ্বরের স্থানে বসিয়েছে। মানুষ এটা করতে চাইছে কারণ এটাই তাঁর মৌল প্রবৃত্তি যাকে আমরা মানবচেতনা বলে আগে উল্লেখ করেছি, সার্ত্রে যাকে বলেছেন ‘পরম’। … শ্রীরামকৃষ্ণের পূজা পদ্ধতির মধ্যেও এই সত্যের প্রমাণ পাই। সাধক অবস্থায কালী প্রতিমার পায়ে ফুল দিতে গিয়ে বারবার ফুল দিয়েছেন নিজের মাথায়। সমস্ত সাধনার শেষে ষোড়শী পুজোয় সাধনার ফল আর জপের মালা অর্পণ করলেন মানুষেরই পায়ে। আবার পৃথিবীর মঞ্চ থেকে বিদায় নেবার আগে কাশীপুরের শেষ শয্যায় যে ফটোতে তিনি শেষবারের মত ফুল দিলেন সেই ফটোটিও ছিল মানুষের। এই তিনটি ঘটনা তাৎপর্যময়। দেবতার ফুল বারবার গিয়ে পড়েছে মানুষের কাছে। সাধক অবস্থায় যে শ্রীরামকৃষ্ণ ঈশ্বরের কাছে কেঁদে কেঁদে বলেছিলেন – ‘মা, আরেকটা দিন চলে গেল, দেখা দিলি না!’ সাধনার শেষে তিনিই কেঁদেছেন মানুষের জন্য – ‘ওরে, তোরা কে কোথায আছিস, আয়।’ শ্রীরামকৃষ্ণ ঈশ্বরকে মানুষের মধ্যেই খুঁজে পেয়েছিলেন।”
উপরের আলোচনা থেকে দেখা গেল যে, হিন্দু পুনরভ্যুত্থানবাদীদের ক্রিয়াকলাপের সঙ্গে রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের ক্রিয়া পারম্পর্য সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল। তাই ঊনিশ শতকের ইতিহাসে ধর্ম সাংস্কৃতিক আন্দোলনের চিহ্নিত ব্যক্তিত্ব রামকৃষ্ণকে বিশ্লেষণের জন্য স্বতন্ত্র শিরোনামের প্রয়োজন রয়েছে। বস্তুতঃ ঊনিশ শতকের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের দুটি ধারার পরিবর্তে তিনটি ধারা দেখতে পাওয়া যায়। সেগুলির মধ্যে একটি ধারা পাশ্চাত্য অনুসারী (মুখ্যতঃ ইয়ং বেঙ্গল গোষ্ঠী), দ্বিতীয় ধারাটি প্রাচ্য অনুসারী (মুখ্যতঃ হিন্দু পুনরভ্যুত্থানবাদীরা), এবং তৃতীয় ধারাটি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সম্মিলনকামী, অর্থাৎ শ্রীরামকৃষ্ণের প্রক্রিয়াটি যেমন আধুনিক তেমনি ভারতীয়। সেই কারণে রামকৃষ্ণকে তৃতীয় ধারার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করাই বিধেয়। রামকৃষ্ণ চরিত্রের স্বাতন্ত্র্য সকল ঐতিহাসিকই একবাক্যে স্বীকার করে নিয়েছেন। ঊনিশ শতকের ইতিহাসে হিন্দু পুনরভ্যুত্থানের প্রগতিবাদী চেতনাসমূহ ‘নব্য হিন্দু আন্দোলন’ শিরোনামে উপস্থিত হওয়ার নেপথ্য কারণ রামকৃষ্ণই। রামকৃষ্ণের ধর্ম ও আধুনিকতার যৌথচর্চার জন্য গবেষকদেরকে ঐ জাতীয় শিরোনাম ব্যবহার করতে হয়েছে। ঊনিশ শতকের ধর্ম সংস্কৃতির আন্দোলনকে দ্বিমুখী ধারায় ব্যাখ্যা করতে অনেক ঐতিহাসিকই দ্বিধাগ্রস্ত। এই প্রসঙ্গে প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ‘নরহরি কবিরাজের’ মন্তব্যটি উপস্থাপন করলে সিদ্ধান্তে আসা সহজতর হবে। তিনি বলেছিলেন, “বাংলার জাগরণের প্রথম পর্বটি পাশ্চাত্যকরণের যুগ, এবং দ্বিতীয় পর্বটি প্রাচ্যকরণের যুগ – এভাবে দেখা উচিত নয়। প্রথম পর্বে বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল পাশ্চাত্য সভ্যতার সুফলগুলিকে আয়ত্ত করার – আধুনিকতাকে গ্রহণ করার সুতীব্র আগ্রহ। প্রথম পর্বে কেউ কেউ (বিশেষ করে ইয়ং বেঙ্গল) ইংরেজিয়ানা ও আধুনিকতা – এই দুটিকে সম-অর্থবাচক বলে মনে করতেন। তবে সেই পর্বের শ্রেষ্ঠ প্রতিনিধিরা – যেমন, রামমোহন, বিদ্যাসাগর, অক্ষয়কুমার পাশ্চাত্যকরণ ও আধুনিকতা – এই দুইয়ের পার্থক্য সম্পর্কে বিশেষ সজাগ ছিলেন, এবং তাঁরা দেশকে পাশ্চাত্যকরণের দিকে নয়, আধুনিকতার দিকে নিয়ে যেতে বিশেষ সচেষ্ট হন। … আবার যাঁরা মনে করেন – ভারতীয় ঐতিহ্যের মধ্যেই সৃজনশীলতার মূল উপাদানগুলি লুক্কায়িত ছিল, এবং বাইরে থেকে আনা এক-আধটু সংশোধনই যথেষ্ট ছিল, তাঁরা ভারতীয় সামন্ততান্ত্রিক অচলায়তনটি জীবনের স্রোতধারাকে যে সম্পূর্ণরূপে রুদ্ধ করে দিয়েছিল – এটি বিস্মৃত হন। তাঁরা ভারতীয় ঐতিহ্যকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে যুগধর্মের গুরুত্বটি খুবই ছোট করে দেখেন। মনে রাখতে হবে বঙ্কিম-বিবেকানন্দ দেশের ঐতিহ্য সন্ধানে বিশেষ আগ্রহ দেখিয়েছেন, কিন্তু আধুনিকতাকে বাদ দিয়ে নয়। … আধুনিকতা ও ঐতিহ্যের সম্পর্কটি কি – এই প্রশ্ন অবশ্যই উঠতে পারে। কি রামমোহন, কি ইয়ং বেঙ্গল, কি বিদ্যাসাগর, কি বঙ্কিমচন্দ্র, কি বিবেকানন্দ, কি রবীন্দ্রনাথ – সকলের কাছেই প্রশ্নটি উত্থাপিত হয়েছিল। এইভাবে – আধুনিকীকরণের সঙ্গে পরিচয় ছাড়া দেশবাসীর পক্ষে ইউরোপীয়দের সমকক্ষ হওয়া ও দেশের জাগরণের পথ প্রশস্ত করার আর কোন উপায় নেই। আবার দেশের ঐতিহ্যের সঙ্গে আধুনিকীকরণের প্রক্রিয়াটিকে সংযুক্ত করতে না পারলে, এই প্রক্রিয়াটি দেশবাসীর চেতনার প্রবেশ করবে না, এবং এটি বন্ধ্যা হয়ে রইবে। রামমোহন ব্রাহ্ম আন্দোলনের মাধ্যমে এই কাজটি সুসম্পন্ন করতে চাইলেন। এমনকি ইয়ং বেঙ্গল – যাঁদের চোখে পাশ্চাত্যকরণ ও আধুনিকীকরণ – এই দুটি প্রক্রিয়া প্রায় একাকার হয়ে গিয়েছিল – তাঁরা বলতে বাধ্য হলেন যে ইউরোপীয় চিন্তা আমাদের গ্রহণ করতে হবে, তবে তাকে প্রকাশ করতে হবে ভারতীয় ভঙ্গীতে। বিদ্যাসাগর চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল তাঁর আধুনিকতা, যদিও জাতীয় ঐতিহ্যের বলিষ্ঠ দিকটির প্রতি দৃঢ়মূল থেকেই তিনি যুগধর্মকে গ্রহণ করতে চেয়েছিলেন। … বঙ্কিম-বিবেকানন্দ হিন্দু ঐতিহ্যের পুনরুজ্জীবনের পক্ষপাতী হলেও সাধারণভাবে আধুনিকতার বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করেননি। এঁদের চিন্তায় সমকালীন ইউরোপের প্রগতিশীল চিন্তাধারার চূড়ান্ত প্রভাব লক্ষ্য করার বিষয়। … আধুনিকীকরণ ও ঐতিহ্য সন্ধান পরস্পর সংযুক্ত। আধুনিকীকরণ যদি দেশের মাটির সঙ্গে সম্পর্ক শূন্য হয় তাহলে তা নকলনবীশীর নামান্তর হয়ে উঠতে বাধ্য। কাজেই ঐতিহ্য যাচাই করে নেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। রামমোহন, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র রবীন্দ্রনাথ – এঁরা সকলেই নিজের মত করে এই যাচাই করার কাজে হাত দেন। অবশ্য, কার চেষ্টা কতটা সার্থক হয়ে উঠেছে কালের বিচারে তার চূড়ান্ত হিসাব মিলবে। যুগধর্মের আলোকে ঐতিহ্য সন্ধানের কাজে লেনিনের যে লেখাগুলি মার্কসবাদীদের কাছে দিক নির্দেশক হতে পারে তা হলো ‘The Heritage of Renounce’, ‘In Memory of Herzen, Tolstoy’, ‘The Mirror of Revolution’, ‘The National Pride of the Great Russians’ প্রভৃতি। …” শ্রীরামকৃষ্ণ ধর্মীয় পরিভাষায় কথা বললেও, ভারতীয় ঐতিহ্যের সারস্বত বাণীকেই প্রচার ও প্রসার ঘটাতে প্রয়াসী হয়েছিলেন। রামকৃষ্ণের ধর্মচেতনার স্বাতন্ত্র্য আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। ধর্মকে তিনি ‘সোশ্যাল কমিটমেন্টের’ সামিল করতে চেয়েছিলেন। ধর্মের ভ্রান্তি দূর করে তিনি সেটাকে সামাজিকীকরণের বিশেষ শর্ত হিসাবে চিহ্নিত করতে চেয়েছিলেন। ধর্মের ফোরামে দাঁড়িয়েই তিনি ধর্মতন্ত্রকে চূড়ান্ত আঘাত হেনেছিলেন। তাই তাঁর শিক্ষাকে জনগণ সহৃদয়তা দিয়ে গ্রহণ করেছিল। শ্রীরামকৃষ্ণের ধর্মীয় সার্বভৌমিকতার কথা কিন্তু স্বামী বিবেকানন্দ সোচ্চার কণ্ঠে প্রতিনিয়তই ঘোষণা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “শ্রীরামকৃষ্ণ যা শিখিয়ে গেছেন তা-ই হচ্ছে ঠিক ঠিক ধর্ম। তাকে হিন্দুরা হিন্দুধর্ম বলে। অন্যেরা তাঁদের রুচিমত নাম দেয়।” শ্রীরামকৃষ্ণের ধর্মচেতনা যে ওই সময়ের মৌলবাদী ধর্ম চেতনা থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ছিল, ঐতিহাসিক গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের লেখনীতেও সেটা স্পষ্টভাবে ধরা দে। তিনি বলেছিলেন, “যে ধর্মসংস্কারে রামকৃষ্ণ পরমহংসে ব্রতী হন সেখানে ধনী-নির্ধন, উচ্চ-নীচ, সবাই সমান; সবাই মায়ের সন্তান। তখনকার সমাজের হাওয়ার সঙ্গে এই ধর্মীয় সাম্যবাদ সহজেই সঙ্গতি খুঁজে পেল। জাতপাতের ঊর্ধ্বে উঠে সমস্ত মানুষকে এক মায়ের আহ্বানে সামিল করে, রামকৃষ্ণ তখনকার সমাজে এক আলোড়ন সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন। এই ঐক্যবোধ সেদিনকার জাতীয় আন্দোলনের ছিল, এক পরম সম্পদ।” এহেন রামকৃষ্ণকে হিন্দু পুনবভ্যুত্থানবাদী হিসাবে চিহ্নিত করা অত্যন্ত অন্যায় বলেই মনে হয়। শ্রীরামকৃষ্ণ যেমন অন্ধ পাশ্চাত্য অনুসারী ছিলেন না, তেমনি অন্ধপ্রাচ্য অনুগামীও ছিলেন না; তিনি মধ্যপন্থা অবলম্বী – আধুনিক ও ভারতীয় ছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ চরিত্রের এই উজ্জ্বল বৈশিষ্ট্যটি কেউ বিস্মৃত না হলেই সমাজ ও ইতিহাসের মঙ্গল হবে।
(তথ্যসূত্র:
১- ভারতের মুক্তি সংগ্রামে চরমপন্থী পর্ব, অমলেশ ত্রিপাঠী।
২- Bengal Renaissance and other Essays, Sushovan Sarker.
৩- বাংলা প্রগতি সাহিত্যের আত্মসমালোচনা, মার্কসবাদী, রবীন্দ্র গুপ্ত।
৪- ঊনিশ শতকে নব্য হিন্দু আন্দোলনের কয়েকজন নায়ক, সুনীতিরঞ্জন রায়চৌধুরী।
৫- লোকজীবনে শ্রীরামকৃষ্ণ, স্বামী সোমেশ্বরানন্দ।
৬- স্বাধীনতার সংগ্রামে বাঙলা, নরহরি কবিরাজ।
৭- রুশ বিপ্লব ও বাংলার মুক্তি আন্দোলন, গৌতম চট্টোপাধ্যায়।
৮- Hinduism through the Ages, D. S. Sarma.
৯- সমসাময়িক দৃষ্টিতে শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস, ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও সজনীকান্ত দাস।
১০- শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ লীলাপ্রসঙ্গে, স্বামী সারদানন্দ।
১১- শ্রীরামকৃষ্ণ: নৈঃশব্দেব রূপ, ধনগোপাল মুখোপাধ্যায়।
১২- উদ্বোধন, শ্রীরামকৃষ্ণ শতবার্ষিকী সংখ্যা।
১৩- রামকৃষ্ণ জীবনী ও প্রসঙ্গ, স্বামী তেজসানন্দ।
১৪- রামকৃষ্ণ ভক্তিমালিকা, স্বামী গম্ভীরানন্দ।
১৫- আত্মচরিত, শিবনাথ শাস্ত্রী।
১৬- শ্রীরামকৃষ্ণ ও যুগধর্ম, স্বামী ভুতেশানন্দ।
১৭- রামকৃষ্ণ ও সমকালীন কামারপুকুর, তড়িৎ কুমার বন্দোপাধ্যায়।
১৮- শ্রীরামকৃষ্ণ দেব, শশীভূষণ ঘোষ।)