Bangla Hunt Digital

‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের কালের সামাজিক অবস্থা’ (প্রথম পর্ব)

‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের কালের সামাজিক অবস্থা’ (প্রথম পর্ব)

রানা চক্রবর্তীঃ  প্রবন্ধের শুরুতেই প্রথমে চতুর্দশ শতকের বাঙলার রাজনৈতিক পটভূমিকার দিকে দৃষ্টিপাত করে নেওয়া যাক। ত্রয়োদশের শেষপাদে ‘বুগরাখান’ ও তাঁর দ্বিতীয় পুত্র ‘রুকনুদ্দীন কাইকাউস’ বাঙলার স্বাধীন সুলতান হিসাবে রাজ্য চালিয়েছিলেন। তারপরে তাঁদেরই একজন অনুচর ‘শামসুদ্দীন ফিরোজ শাহ’ শক্তিশালী হয়ে উঠে বাঙলার তখত দখল করে নিয়েছিলেন। তিনি শুধু তখ্তেই বসেন নি, নিজের রাজ্যের প্রতিষ্ঠার জন্য পশ্চিমে লখনৌতি বা গৌড়ে ও পূর্বদিকে সোনার-গাঁয়ে শক্ত ঘাঁটি তৈরী করেছিলেন, আর সেই দুটি ঘাঁটির যোগসূত্র হিসাবে মধ্যপথে সপ্তগ্রামে বা সাত-গাঁয়ে তৃতীয় একটি ঘাঁটিও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এর আগে থেকে সোনারগাঁ বাঙলার একটি প্রসিদ্ধ বন্দর তো ছিলই, তখন থেকে সাতগাঁয়েও বন্দরের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। উক্ত শামসুদ্দীনের কালেই পীর-দরবেশদের সাহায্যে মুসলমানেরা শ্রীহট্ট দখল করেছিলেন। সে কথায় পরে আসা যাবে। শামসুদ্দীনের মৃত্যুর পরে তাঁর তিন পুত্রের মধ্যে তখ্তের অধিকার নিয়ে লড়াই শুরু হয়েছিল। ‘গীয়াসুদ্দীন তুঘলক’ তখন দিল্লীর তখতে আসীন ছিলেন; ওই সব গোলযোগের ফয়সালা করতে তিনি প্রচুর সৈন্য নিয়ে বাঙলায় উপস্থিত হয়েছিলেন। তিনি শামসুদ্দীনের এক পুত্র ‘নাসিরউদ্দীন’কে লখনৌতির তখতে বসিয়ে পূর্ববাঙলাকে দিল্লীর খাসদখলে নিয়ে এসে, ‘বাহরাম খান’কে সেখানকার শাসক নিযুক্ত করেছিলেন। বাহরাম খানের মৃত্যুর পরে তাঁরই এক অনুচর ‘ফখরুদ্দীন’ গদি দখল করে নিয়েছিলেন; তাঁরই শাসনকালে ‘ইবন বতুতা’ বাঙলায় এসেছিলেন। তাঁর কথাও পরে বলা যাবে। ওই সব রাজনৈতিক গোলমালের ফলে বাঙলা তখন দিল্লী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল, আর ‘ইলিয়াস শাহ’ সুযোগ বুঝে লখনৌতি, সোনারগাঁও ও সাতগাঁ দখল করে নিয়েছিলেন। ইলিয়াস শাহ প্রায় অজ্ঞাতকুলশীল একজন মানুষ হলেও তাঁর প্রতাপ কিন্তু অসাধারণ ছিল। দিল্লীর মসনদে তখন গীয়াসুদ্দীন তুঘলকের ভ্রাতুষ্পুত্র ‘ফিরোজ’ অবস্থান করছিলেন; তখন তিনি বাঙলার জমিদারী দখল করতে এগিয়ে এসেছিলেন। তবে ফিরোজ বহু তোড়জোড় করে বাঙলা অধিকার করতে এগিয়ে আসলেও, খুব একটা কিছু করতে পারেন নি। তাঁর আক্রমণ থেকে নিজেকে রক্ষা করবার জন্য ইলিয়াস একডালার দুর্ভেদ্য দুর্গে আশ্রয় নিয়েছিলেন। বাঙালী পদাতিক সৈন্যবাহিনী তাঁর সহায় হয়েছিল; সেই দুর্ধর্ষ সৈন্যবাহিনীর ব্যূহ ভেদ করাটা দিল্লীর সৈন্যদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে উঠেছিল। ইলিয়াসের বাহিনীর কারণে বাঙালীর বীরত্ব অক্ষয় হয়ে ইতিহাসের পৃষ্ঠায় স্থান পেয়েছিল। বোঝাই যায় যে, ওই সময়ের বাঙালীর কাছে সামরিক জগৎ অগম্য ও ভয়াবহ ছিল না। সেই বিখ্যাত একডালা দুর্গটি যে ঠিক কোথায় অবস্থিত ছিল, তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতদ্বৈধ রয়েছে; কেউ কেউ বলেন যে, সেটি আধুনিক দিনাজপুর জেলায় অবস্থিত ছিল, তো কেউ আবার বলেন যে, সেটি গৌড়ের কাছাকাছি কোথাও ছিল। ওদিকে প্রচলিত কিংবদন্তী আবার সেটিকে পূর্ববঙ্গে গঙ্গা (পদ্মা) ও যমুনার সঙ্গমস্থলে, অধুনাতন গোয়ালন্দের অনতিদূরে ঠেলে দিয়েছে। বলা বাহুল্য যে, ওই জায়গাটি বহুদিন আগেই জলমগ্ন হয়ে হারিয়ে গিয়েছে। যাই হোক, তখন ফিরোজকে শেষপর্যন্ত পিছিয়ে যেতে হয়েছিল। কিন্তু এরপরে তিনি আবার প্রায় ছ’বছর পরে, পূর্ববঙ্গের গদিচ্যুত নবাব ফখরুদ্দীনের জামাতার অনুরোধে বাঙলায় এসে উপস্থিত হয়েছিলেন। তখন গৌড়-বঙ্গের গদিতে ইলিয়াসের ছেলে ‘সিকন্দর’ আসীন ছিলেন। তিনিও তাঁর পিতার মতোই একডালায়, বাঙালী সৈন্যের হেপাজতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সেবারেও আগেরবারের মতোই ফল হতে চলেছিল। কিন্তু সিকন্দরের হঠাৎ কি মনে হওয়ায়, হয়ত তিনি চিরবিদ্রোহের অস্থিরতার চেয়ে স্বস্তিকে বেশি পছন্দ করায়, সোনারগাঁ ফিরিয়ে দিতে রাজী হয়েছিলেন। কিন্তু ফখরুদ্দীনের জামাতা দিল্লীর সুখসুবিধা ছেড়ে শেষপর্যন্ত পূর্ববঙ্গের জল-জঙ্গল ও রোগাকীর্ণ অঞ্চল, যেটাকে তখন ‘দোখজপুর নিয়ামত’ বা নানা আশীর্বাদপূত নরক বলা হত, সেখানে আর ফিরে আসতে চাননি। ফলে, ফিরোজ গৌড়-বঙ্গকে সিকন্দরের হাতেই তুলে দিয়ে, বার্ষিক কিছু ভেটের প্রত্যাশা নিয়ে দিল্লীতে ফিরে গিয়েছিলেন। তারপরে হয়ত তিনি উদ্যান-রচনায় মন দিয়েছিলেন; কারণ, ইতিহাস বলে যে, ওই সময়ের পরে তিনি দিল্লীর চারিদিকে বারোশো’ বাগ-বাগিচা তৈরি করিয়েছিলেন। ওই কাজটা অবশ্য নতুন কিছু ছিল না; বহু আগে থেকেই ভারতবর্ষের সর্বত্র ফুলের চাষ হত। তারপরে বাঙলার সুলতানের প্রায় দু’শো বছর ধরে দিল্লীর নামমাত্র তাঁবেদার হয়ে থেকে গিয়েছিলেন।
সামাজিক বিচারে চতুর্দশ শতক মূলতঃ ত্ৰয়োদশেরই অনুকৃতি ছিল; উক্ত কালের চণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ দ্বাদশ শতকের জয়দেবের ‘গীত-গোবিন্দের’ই সার্থক অনুসরণ ছিল। দ্বাদশ, ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ শতকের বাঙালী হিন্দুসমাজ নিছকই কামচর্চায় মোহগ্রস্ত ও দুর্বল ছিল। ঐতিহাসিকদের মতে, সম্ভবতঃ চতুর্দশ শতকের প্রথম পাদে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন রচিত হয়েছিল, এবং সেটাই হয়ত প্রাচীনতম বাঙলা হরফের পুঁথি। ভাষার দিক থেকে পুঁথিটির ভাষা হয়ত চর্যাপদেরই পরিণতি, তবে সেটির মাঝে শূন্যপুরাণের ভাষাও পাওয়া যায়। ‘চণ্ডীদাস’ এক নাকি বহু, আদি চণ্ডীদাসের বাড়ি বাঁকুড়া নাকি বীরভূম, চতুর্দশ শতকের বাংলার সাধারণ মানুষের ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে, ওই সব তর্কে ঢোকবার কোন প্রয়োজন নাই। চণ্ডীদাস বাঙালী ছিলেন, এবং শ্রীকৃষ্ণকীর্তন যে সেকালের বাঙালী-মানসের প্রতিচ্ছবি – এই তথ্যটিই শুধু এই প্রবন্ধের বিষয়ান্তর্গত। মনে রাখতে হবে যে, এই প্রবন্ধের আলোচ্য বিষয় সাহিত্য বা ভাষাগত নয়, সেটা হল সামাজিক। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের মূলকথা হল “ভাগিনা সুরতি মাগে দানের ছলে”। পরদার বলে রাধা রেহাই পেতে পারেন না কারণ,
“নিজ পরনারী দোষ নাহিক সংসারে
যত সতীপণ সব মিছা জাণ তারে॥
পরদারে পাপ নাহি বোলন্ত কাহ্নাঞিঁ।”
এই কামলালসা সহজযানের ‘স্বসংবেদ্য সুখের’ পরিকল্পনায় উদ্বুদ্ধ; ‘স্বসংবেদ্য সুখ’, অর্থাৎ, যে সুখ শুধু নিজেই বোঝা যায়, কিন্তু অপরকে বোঝানো যায় না। সেই সুখ কি?
“সুন্দর যুবক সমে যে হএ শৃঙ্গার
সকল সংসার মানে সেই সুখসার।”
তবে শুধু সহজযান নয়, শ্রীকৃষ্ণকীর্তনেও তন্ত্রের ষটকর্মের প্রভাব দেখতে পাওয়া যায় –
“স্তম্ভন মোহন আর দহন শোষণে
উছাটিন (উচাটন) বাণে লঅ রাধার পরাণে।”
এ ছাড়াও,
“ইড়া পিঙ্গলা সুসমনা সন্ধি
মন পবন তাত কৈল বন্দী।”
এ সব যে নিছক নির্লজ্জ যৌন অনাচার সেটার চিহ্ন –
“সহজে সুরতী ভুঞ্জ দেব গদাধর
নিশাস এড়িতেঁ মোকে দেহ অবসর।”
বাঙলার সামাজিক ইতিহাসের বিচারে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন চতুর্দশ শতকের পূতিগন্ধময় সমাজদেহের এক নগ্নমূর্তি মাত্র। অন্ধ ভক্তির পূত চন্দনেও সেই দুর্গন্ধকে দূর করা যায় না। তখনকার ক্রমবর্ধমান অন্ধ ভক্তিবাদ একদিকে যেমন বাঙালী হিন্দুসমাজকে দুর্বল করে তুলেছিল, তেমনি যৌন অনাচার প্রবল হয়ে মানুষ মোহগ্রস্ত-আত্মরক্ষায় অসমর্থ ও বিমুখ হয়ে উঠেছিল; তার উপরে গোড়া থেকেই তো সমাজ দ্বিধাবিভক্ত ছিল। নাহলে গৌড়-বঙ্গে তুর্কী সৈন্যের প্রবেশও অত সহজ হত বলে মনে হয় না। তখন বাঙালীর মধ্যে যে শৌর্যবীর্যের অভাব ছিল তা কিন্তু নয়, একডালায় বাঙালী পদাতিকের বীরত্ব – যার ফলে দিল্লী বহুকাল আর বঙ্গদেশের কাছে ঘেঁষতে সাহস পায়নি – সেটার ঐতিহাসিক প্রমাণ দেয়। কিন্তু বাঙালী হিন্দু শাসকদের চরিত্রহীনতার ফলে যে সংহত শক্তি বাঙলার হতে পারত, সেটাকে অনায়াসে তুর্কী শাসকেরা দখল করে বসেছিলেন, আর পীর-দরবেশদের কেরামতির ফলে তৎকালীন বাঙালী সমাজের একটি বিশিষ্ট অংশ ইসলামী উত্তরীয় গায়ে দিয়ে নতুন এক ধর্মসাধনায় মত্ত হয়ে উঠেছিল। বিশেষ করে উত্তর ও পূর্ববঙ্গে সেই পরিণতি ঘটেছিল। পুনরায় শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের আসরে ফেরা যাক। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে সেকালের বাঙলার সামাজিক ইতিহাসের কিছু কিছু চিত্র পাওয়া যায়। তখন নানা ধরণের খোঁপা বাঁধাটা বাঙালী মেয়েদের সাজসজ্জার একটা অঙ্গ ছিল; তবে সেসবের মধ্যে ‘ঘোড়াচুলা’ তখন হয়ত শ্রেষ্ঠ ছিল। “খোঁপাত উপর তোর বউল মাল দেখী” – অর্থাৎ তখন বাঙালী নারীর খোঁপার উপরে বকুল মালা শোভা পেত। আর অলঙ্কার ছিল – “সাতেসরী হার, কানের কুণ্ডল, মুকুটমাথার, হাথের বলয়, বাহুটী, আ-আর আঙ্গুঠী, কঙ্কণ, নূপুর ও কেয়ূর। পায়ে মগর খাড়ু, হাথে বলয়া।” তারপরে,
“পাট পরিধান তোর নেতের আঁচল ল
মাণিকেঁ খঞ্চিল দুঈ পাশে”
উক্ত সময়ে মেয়েদের মধ্যে ওড়নারও প্রচলন ছিল। সেই সময়ে পাটের শাড়ি মেয়েদের অতি প্রিয় বস্তু ছিল, আর ‘নেতবাস’ ও ‘ময়ূরকণ্ঠী’ – এই দুটোই তখন বাঙলার প্রসিদ্ধ রেশমী কাপড় ছিল। তারপরে – “সীমন্তে সুরঙ্গ (হিঙ্গুলজাত উজ্জ্বলবর্ণবিশিষ্ট সিঁদুর), কাজলে উজল, কণ্ঠদেশে শঙ্খমালা, কর্পূরবাসিত তাম্বুল।” এবারে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন থেকে স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণের বরবেশের রূপটি দেখা যাক।
“ময়ুর পুছেঁ বান্ধিআঁ চুড়া
তাত কুসুমের মালা।
চন্দন তিলকে শোভিত ললাট
বেহ্ন চাঁদ ষোলকলা॥
নেত ধডি পরিধানে
হাথে কনকের বাঁশী।”
শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের বৃন্দাবন খণ্ডে সেকালের বাঙলার ফলের একটি তালিকা পাওয়া যায়। সেই তালিকায় রয়েছে – “ছোলঙ্গ (টাবা), নারঙ্গ (কমলালেবু), কামরঙ্গ, আমু, লেম্বু, ডালিম্ব, জাম্বু, জাম্বীর, আম্বরা, ‘চেরু বেরু অফেরু’ (অজ্ঞাত), জলপায়ি, চালিতা, তেন্তলি, সতকড়া (কমলাজাতীয়), গুআ, নারিকেল, কণ্ঠোআল (কাঁঠাল), তাল, কদলক, শ্রীফল, খরমুজা, বাঙ্গী।” তখন যাত্রাকালে ‘হাছি জিঠী’, অর্থাৎ হাঁচি, টিকটিকি প্রবল বাধা বলে গণ্য হত; পায়ে আঘাত পাওয়াও তদ্রূপ ব্যাপার ছিল। এরপরে যাত্রাকালে আরো অশুভ লক্ষণ হিসেবে পাওয়া যায় –
“কথো দূরপথে মো দেখিলো সুগণী (ব্যাধ)।
হাথে খাপর (খর্পর = নরকপাল) ভিখ মাঙ্গএ যোগিনী॥
কান্ধে কুরুয়া লআঁ তেলী আগে জাএ।
সুখান ডালেতে বসি কাক কাঢ়ে রাএ॥”
ওই সময়ে দূতী পাঠাতে সঙ্গে পান-গুআ দেওয়া হত। তখন বিভিন্ন জিনিসের উপরে পণ্যশুল্কের প্রভেদ ছিল, ‘কুতঘাট’ বা শুল্ক আদায়ের নির্দিষ্ট স্থান ছিল, আর ‘দানী’ বা শুল্ক-সংগ্রাহক ছিলেন। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন থেকে তখনকার রক্ষকেরও খবর পাওয়া যায়। এছাড়া উক্ত গ্রন্থ থেকে করতাল ও মৃদঙ্গের উদ্দেশ্যও জানা যায়, সহজিয়া বৌদ্ধদের মত কৃষ্ণমন্ত্রী হিন্দুরাও সেকালে সংকীর্তনে মত্ত হয়েছিলেন। ‘নষ্টচন্দ্ৰ’ দেখলে মানুষের অপকলঙ্ক যে অনিবার্য, এই প্রবাদের শুরু হয়েছে হয়ত সেকালেই বা তারও আগে থেকে হয়েছিল।

“হরিতালী চন্দ্র দেখিলোঁ ভাদ্রমাসে।
হাথ ভরিলোঁ কিবা পুরিণ কলসে॥
ভূমিত আখর কিবা লিখিলোঁ জলে।
মিছা দোষে বন্ধন আম্বার তার ফলে॥”
উপরোক্ত সবগুলিই এখনো সারা গ্রাম-বাঙলার হিন্দুসমাজ মেনে চলে; কিছু কিছু তো মুসলমানেরাও মানেন। এগুলির মধ্যে নষ্টচন্দ্র বা ভাদ্রের শুক্লা চতুর্থীর চাঁদ দেখা, পূর্ণ-কলসীতে হাত পোরা, মাটির উপর জলের আঁক দেওয়া রয়েছে। তখন বাঙালী মেয়েরা পসরা সাজিয়ে হাটে যেতেন; রাধাও যেতেন।
“ঘৃত, দধি, দুধ, ঘোলেঁ সাজিআঁ পসার
নেত বসন দিয়া উপরে তাহার॥
আনুমতী লআঁ রাধা সামুড়ীর থানে” …
রাধা হাটের পথে পা বাড়াতেন। বাঙলার প্রচলিত প্রবাদ ‘গুপ্ত বৃন্দাবন’, বা গোপনে দুশ্চরিত্রতা-সূচক কাজের সম্পর্কে শ্লেষ সেকালেরই উৎপত্তি বলে গবেষকরা মনে করে থাকেন। চর্যাপদের “আপনা মাংসে হরিণা বৈরী”, শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে “আপণ গাত্রর মাসে হরিণি বিকলী” রূপ পেয়েছে।

‘পিঙ্গল’ কথাটি যদিও অতি প্রাচীন, কিন্তু তবুও বিদ্বজ্জনের মতে ‘প্রাকৃত-পিঙ্গল’ চতুর্দশ শতকের আগে অধুনাতন আকারে গ্রথিত হয়নি। সেটির অনেক শ্লোকে বিখ্যাত রাজস্থানী রাজা ‘হামিরের’ উল্লেখ পাওয়া যায়। হামির ১৩০৪ খ্রীষ্টাব্দ থেকে শুরু করে প্রায় চৌষট্টি বছর ধরে রাজত্ব করেছিলেন। উক্ত গ্রন্থের কিছু কিছু শ্লোকে ‘খোরাসান’, ‘উল্লা’ প্রভৃতি মুসলমান-গন্ধী শব্দেরও সন্ধান পাওয়া যায়। প্রাকৃত-পিঙ্গলে ‘অবহট্ঠ’ বা অপভ্রংশ ভাষায় রচিত নানা শ্লোকের সমষ্টি রয়েছে বলে দেখতে পাওয়া যায়; উক্ত গ্রন্থটি সেকালে প্রচলিত নানা কবির রকমারি ছন্দের সংগ্রহ। প্রাচীন ভারতে ছন্দের স্থান উচ্চে ছিল; ছয়টি বেদাঙ্গের মধ্যে সেটি অন্যতম। সেই ছন্দোমালার মধ্যে কোনো কোনটিতে সেকালের বাঙলার রীতিনীতির কিছু কিছু উদ্দেশ্য খুঁজে পাওয়া যায়। তবে প্রাকৃত-পিঙ্গল নিয়ে গবেষণা এখনো শেষ হয়নি, হয়ত কালক্রমে সেটা থেকে আরো অনেক তথ্য পাওয়া যাবে। আপাততঃ স্থূলদৃষ্টিতে গ্রন্থটি থেকে যেটুকু তথ্য পাওয়া যায়, সেটাই এখানে উদ্ধৃত করা হল। গ্রন্থটির চম্পকমালায় পাওয়া যায় –
“ঔগগর ভত্তা রংভঅ পত্তা
গাইক ঘিত্তা দুধধ সজুত্তা
মোহণি মচ্ছা লালিচ গচ্ছা
দিজুহ কংতা খা পুণবংতা।”
অর্থাৎ, কলাপাতে গরম ভাত সঙ্গে গাওয়া ঘি, দুধ, মাছ ও নালিতা বা পাটশাক স্ত্রী পরিবেশন করছেন আর তাঁর পুণ্যবন্ত স্বামী সেসব আহার করছেন। এটি যে সেকালের বাঙালী গৃহের চিত্র, তাতে কোন সন্দেহ নেই; কারণ, গব্যঘৃতের সাথে তপ্ত অন্ন (কাঁচালঙ্কা সহযোগে কি?) অন্যান্য প্রদেশবাসীরও রুচিকর হতে পারে, কিন্তু নালিতা ও মাছ বাঙলার একান্তই নিজস্ব খাদ্য। টীকাকার বলেছিলেন, “ভক্তং উদগলিতমণ্ডং”, ‘ঔগর’ ধান্যবিশেষ; “মোহণি মচ্ছা মদগুর মৎস্য”, পাঠান্তরে মোদিনী মৎস্যা বা মনোজ্ঞ মৎস্য; ‘নালীচো’ গৌড়দেশে “অনেনৈব নাম্না প্রসিদ্ধঃ” শাকবৃক্ষবিশেষঃ। প্রাকৃত-পিঙ্গল থেকে আরেকটি শ্লোক উদ্ধৃত করা যাক। এতে তন্ত্রের পঞ্চ ‘ম’-কার সাধনার স্থূল ও নির্লজ্জ চিহ্ন দেখতে পাওয়া যায়।
“মংতং ণ তংতং ণহু কিংপি জাণে
ভাণং চ ণো কিংপি গুরুপ্পসাআে।
মজ্জং পিবামো মহিলং রমামো
মোক্‌খং বজামো কুলমগ গলগ গা॥”
অর্থাৎ, “মন্ত্রং ন তন্ত্রং ন হি কিমপি জানে ধ্যানংচ ন কিমপি গুরুপ্রসাদাৎ। মদ্যং পিবামো মহিলাং রমাম (মহে) মোক্ষং চ যামঃ কুলমার্গলগ্নাঃ।” চলতি বাঙলায় – মন্ত্র, তন্ত্র, ধ্যান কিছুই জানি না। শুধু গুরুপ্রসাদে কুলমার্গের পথ অনুসরণ করে, মদ-খেয়ে ও কামচর্চায় মোক্ষ লাভ করব। তখন সহজিয়া বৌদ্ধ ও নাথপন্থীদের সামাজিক বিভিন্নতা বিশেষ কিছুই ছিল না, তারপরে তান্ত্রিক উচ্ছৃঙ্খলতার সেতু বেয়ে সহজিয়া বৌদ্ধ ও সাধারণ পৌরাণিক হিন্দুসমাজ অনেক কাছাকাছি এসে পড়েছিল। এর ফলে সেই সময়ের গোঁড়া চাতুর্বর্ণ্য সমাজ তাঁদের থেকে আরো দূরে সরে গিয়েছিল; সেই গোঁড়া দলের স্তম্ভস্বরূপ ছিল ব্রাহ্মণ, বৈদ্য ও করণ বা কায়স্থ সম্প্রদায়। তাঁদের সামাজিক ব্যবস্থা স্মৃতিকারদের নির্দেশে চলত।
শামসুদ্দীনের আমলেও গৌড়-বঙ্গ পুরোপুরিভাবে তুর্কীদের অধিকারে চলে যায়নি। তখন তাঁদের দখলে ছিল উত্তর বঙ্গ বা গৌড়-লখোতি, উত্তর রাঢ়ের কিছু অংশ ও পশ্চিম-দক্ষিণ বঙ্গের কিছু অংশ। তৎকালীন গোঁড়া পৌরাণিক হিন্দুসমাজের বহুলাংশই তুর্কী অধিকারে থাকা অঞ্চলগুলি থেকে হিন্দু রাজার অধিকারে থাকা এলাকায় সরে গেলেও, তুর্কী এলাকাতেই সব সহজিয়া বৌদ্ধ, নাথপন্থী আর কিছু কিছু হিন্দু থেকে গিয়েছিলেন। ওদিকে চতুর্দশ শতক থেকেই পীর-দরবেশরা তান্ত্রিক সন্ন্যাসীদের একের পর এক আস্তানা দখল করতে শুরু করেছিলেন, সেসব জায়গায় একের পর এক মসজিদ, দরগা ও খানকা তৈরী হতে শুরু হয়েছিল। সেই পীর-দরবেশদের সাধারণ নাম ছিল ‘সূফী’; তাঁদের কথা পরে বলা যাবে। রাজ্য স্থাপনে বা রাজ্য শাসনে তখনকার তুর্কী শাসকদের যতটা না মন ছিল, রাজকোষে অর্থবৃদ্ধির দিকে তার চেয়ে বেশী নজর ছিল। তুর্কী শাসিত গৌড়-বঙ্গ তখন দিল্লী থেকে বিচ্ছিন্ন ও স্বাধীন থাকলেও, দিল্লী আবার বাঙলায় ছোঁ মারতে কতক্ষণ লাগত? তাই তুর্কীরা নিজেদের শক্তিরক্ষার জন্যই সেই সময়ের হিন্দু-প্রধানদের প্রাধান্য অব্যাহত রেখে দিয়েছিলেন, কিন্তু সাধারণজনের উপরে করভার বেড়ে উঠেছিল। দেশের দারিদ্র্য বেড়ে গিয়েছিল, আর সেই সঙ্গে খাদ্যের লোভে খানকাগুলিতে অতিথির সংখ্যাও ক্রমশঃ বৃদ্ধি পেয়েছিল। তখনকার তুর্কী শাসকদের কেউই দরগা, মসজিদ ও খানকা-স্থাপনে কোন কার্পণ্য করেন নি। এর ফলেও সেই সূফীদের চেষ্টায় বাঙলার তুর্কী-অধিকৃত অঞ্চলে ইসলামী ধর্মের প্রসার ঘটতে শুরু করেছিল। যেসব প্রখ্যাত সূফী চতুর্দশ শতকেই বাঙলায় নিজেদের আস্তানা গেড়ে বসেছিলেন, তাঁদের মধ্যে গৌড়-পাণ্ডুয়ার ‘সিরাজ-অল-দীন ওসমান’, মহাস্থানগড়ের (বগুড়া) ‘শাহ সুলতান’, সাজাদপুরের (পাবনা) ‘শাহদৌলা শাহীদ’, মঙ্গলকোটের (বর্ধমান) ‘রাজাপীর’, এবং শ্রীহট্টের ‘শাহ জালাল’ সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য ছিলেন। তবে সেক শুভোদয়া গ্রন্থের পীর সাহেব কোন ঐতিহাসিক মানুষ বলে প্রমাণিত হন নি। এরপরে ক্রমে ক্রমে তুর্কী রাজ্যও বেড়ে উঠেছিল, সেই সঙ্গে সূফীদের আস্তানাও বেড়ে গিয়েছিল। তখনকার অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে একথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, গৌড়-বঙ্গে একদা এমন একটি শহর বা গ্রামও ছিল না যেখানে পীরদের কোন আস্তানা গড়ে ওঠেনি। ফলে সারা দেশে ইসলাম ধর্ম ব্যাপক আকার নিয়েছিল। তখনও আনুষ্ঠানিকভাবে দেশে লোকগণনা শুরু না হলেও, বর্তমান সময়ের বিশেষজ্ঞদের অভিমত হল যে, শামসুদ্দীনের কালে সারা গৌড়-বঙ্গে হাজার ত্রিশেকের বেশী মুসলমান ছিলেন না, এবং তৎকালীন গৌড়ের জনসংখ্যা ছিল প্রায় দু’লক্ষ। সূফীদের সম্পর্কে বর্তমান জনসাধারণের একটা ভুল ধারণা রয়েছে; বর্তমানে তাঁদের সাধারণতঃ স্বধর্মনিষ্ঠ, কিন্তু পরধর্মসহিষ্ণু নিরীহ, উদার, সাধক সম্প্রদায় বলে গণ্য করা হয়। অনেকে আবার এটাও মনে করেন যে, তাঁরা প্রায় বেদান্তপন্থী ছিলেন। কেন একথা মনে করা হয়, সেটা পরে বলা যাবে। তবে দৃষ্টতঃ তাঁরা গোড়া ছিলেন না; কারণ সংগীত যদিও ইসলামে বর্জিত, তাঁরা কিন্তু বলেছিলেন যে, সংগীতের পথে পরমাত্মার সঙ্গলাভের আনন্দ ঘটে; এমনকি সিন্ধু প্রদেশে ‘শাহ লতিফ’ সম্প্রদায়ের সূফীরা তো হিন্দুদের ‘ওঁ’ মন্ত্রটিকেও গ্রহণ করে নিয়েছিলেন। কিন্তু একই সাথে একথাও ভুললে চলবে না যে, তাঁরা শুধু শাস্ত্র নিয়েই কারবার করতেন না, দরকার মত শস্ত্রপাণিও হতে জানতেন। তাঁরা ইসলাম ধর্মমতের ভিত্তিতে অমুসলমান শাসকদের বিরুদ্ধে কখনো নিজেরাই, তো কখনো আবার ইসলামী শাসকদের সহযোগে জিহাদ চালাতেন। এসবের অজস্র নজির ইতিহাসে পাওয়া যায়। সেসব থেকে এখানে শুধু প্রখ্যাত আরবী পর্যটক ইবন বতুতার লেখনী থেকে একটির কথা, অর্থাৎ শ্রীহট্ট দখলের কথা উদ্ধৃত করলেই যথেষ্ট হবে।
(চলবে)

(তথ্যসূত্র:
১- হরপ্রসাদ শাস্ত্রী রচনা সমগ্র।
২- বৌদ্ধধর্ম, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী।
৩- বাঙ্গালীর ইতিহাস, আদিপর্ব, নীহাররঞ্জন রায়।
৪- বাঙ্গালার ইতিহাস, রাখালদাস বন্দোপাধ্যায়।
৫- বাংলা দেশের ইতিহাস, রমেশচন্দ্র মজুমদার।
৬- বাংলার সামাজিক ইতিহাসের ধারা, বিনয় ঘোষ।
৭- বাঙ্গালার ইতিহাস (সামাজিক বিবর্তন), ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত।
৮- বাংলা মঙ্গলকাব্যের ইতিহাস, আশুতোষ ভট্টাচার্য।
৯- বাংলা ও বাঙালীর বিবর্তন, অতুল সুর।
১০- বৃহৎ বঙ্গ, দীনেশচন্দ্র সেন।
১১- পৌরাণিক উপাখ্যান, যোগেশচন্দ্র রায়।
১২- পূজা-পার্বণ, যোগেশচন্দ্র রায়।
১৩- প্রাচীন বাঙ্গলা সাহিত্যের ইতিহাস, ডঃ তমোনাশ চন্দ্র দাশগুপ্ত।
১৪- বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য।)