রানা চক্রবর্তীঃ ‘মুসলমান শাসকদের সমকালীন’ ভারতবর্ষকে আমরা সাধারণতঃ ‘মধ্যযুগ’ বলে থাকি৷ কিন্তু ‘প্রাচীনযুগের’ নিঃশেষ সমাপ্তির পরেই যে ‘মধ্যযুগের’ শুরু হয়েছিল, তা নয়। কোন বিশেষ রীতি রেওয়াজ ওভাবে শুরু বা শেষ হয় না, বিশেষ করে ভারতের মতো দেশে। এখানে বৈচিত্র্য ও স্বাতন্ত্র্য বড় বেশি৷ নতুন রীতিনীতিকে যত সহজে গ্রহণ করা হয়, পুরনো রীতিকে তত সহজে বর্জন করা হয় না, অর্থাৎ এখানে থেকেই যায় সব কিছু। সেইজন্যই ‘অজন্তার গুহাচিত্রে’ দেখতে পাওয়া যায় বিভিন্ন ধরনের সাজপোশাকের একত্র সমাবেশ। এই ‘মধ্যযুগেই’ ভারতীয় বস্ত্রশিল্পের চরমোৎকর্ষ দেখা দিয়েছিল৷ সাধারণতঃ সব দেশেই বিজিত বিজয়ীর অনুকরণ করে। শোনা যায়, ‘আর্য নারীদের’ উন্মুক্ত বক্ষ দেখে ‘দ্রাবিড় নারীরা’ লজ্জায় লুকিয়ে ফেলেছিলেন তাঁদের ‘কঞ্চুলিকা’। সব দেশেই দেশের রাজা রানীর সাজসজ্জার অনুকরণ করেন অভিজাত সমাজ, অভিজাতদের দেখাদেখি সাধারণ মানুষ। বহুদিনের ব্যবধানে সবাইকে এক সময়ের বলে মনে হয়। ভারতে আসা লুণ্ঠনকারী বিদেশী রাজারা যখন এদেশেই শাসক হয়ে বসেছিলেন তখন তাঁরাও ‘বর্ণাঢ্য ভারতীয় সাজসজ্জা’ দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। মুসলমান শাসকরা ভারতে আসার আগেই ‘চীন ও পারস্যের বস্ত্রশিল্পের’ সঙ্গে পরিচিত ছিলেন এবং ঐ দুটি দেশের বস্ত্রশিল্প চরমোৎকর্ষ লাভ করেছিল বহু পূর্বেই। কিন্তু ‘ধর্মীয় অনুশাসন’ মেনে মুসলমান শাসকরা যে পোশাক পরতেন সেগুলো ছিল সাদাসিধে, ঘোর রঙের এবং মোটা সুতি বস্ত্রের। তাতে না ছিল নকশা, না ছিল রঙ। সেই পোশাক অবশ্যই ‘যুদ্ধক্ষেত্রের উপযোগী’ ছিল। মেয়েরাও পরতেন একরঙা ‘পেশওয়াজ’ ও ‘পাজামা’। ভারতে এসে ‘রাজস্থানের মেয়েদের’ মতো তাঁরাও ‘ওড়না’র ব্যবহার শুরু করেছিলেন। প্রথমে এই ‘ওড়না’ বা ‘দোপাট্টা’ আকারে খুব ছোট ছিল, পরে ক্রমশই বড় হয়েছে। এই ‘ওড়না’র ক্রমবিবর্তনই বোধহয় ভারতীয় পোশাকের জগতে সবচেয়ে বড় বিস্ময়৷ সে প্রসঙ্গে পরে আলোচনা করা যাবে। তার আগে ‘হারেমের’ কথা বলা যাক। মুসলমানেরা ‘রাজ অন্তঃপুর’কে বলতেন ‘হারেম’; যতদূর মনে হয়, ‘হারেমে’ কড়াকড়ি বা পাহারা দেবার কঠোর ব্যবস্থার চল্ ছিল। হিন্দু রাজাদের সমযয়ে রানী বা ‘পুরাঙ্গনারা’ সত্যিই সম্পূর্ণ ভাবে অন্তরালবাসিনী ছিলেন কিনা সেই বিষয়ে ঐতিহাসিকদের যথেষ্ট সন্দেহ আছে। তবে ‘রাজপুত রাজাদের অন্তঃপুর বা রাওলা’র ‘পর্দা’ এবং কড়াকড়ি ‘মুঘল হারেমের’ মতোই যে ছিল সেই বিষয়ে ঐতিহাসিকদের কোন সন্দেহ নেই। সেই ব্যবস্থা বহিরাগত শত্রুর হাত থেকে নারীদের রক্ষা করবার জন্যে রাজারা নিজেরাই নিয়ম করেছিলেন, না কী, শাসকদের রীতি-রেওয়াজের অনুকরণে অন্তঃপুরে ‘পর্দা’র চল হয়েছিল, সেটা গবেষণার বিষয়। তবে দেখা যায় যে, ‘মুঘল হারেমে’ ‘রাজপুত রাজকন্যারা’ আসতেন ‘বেগম’ হয়ে – ভিন্ন রুচি ও ভিন্ন সংস্কৃতি নিয়ে। ‘হারেমের’ প্রাঙ্গণে ‘তুলসীগাছ’ রোপণের ব্যবস্থা দেখে বোঝা যায় তাঁরা নিজের নিজের ধর্মাচরণে যেমন বাধা পাননি তেমনি বাধা পাননি নিজস্ব সংস্কৃতির অনুশীলনে। ‘হারেমে’ তাঁরা এনেছিলেন ‘রাওলার রঙ ও ঔজ্জ্বল্য’। নিশ্চয় তাঁদের বর্ণাঢ্য ‘ঘাগরা’, ‘কাঁচুলি’, ‘ওড়না’ মুগ্ধ করেছিল একরঙা ‘পেশওয়াজ’ ও ‘পাজামা’ পরা ‘বেগমদের’। অনেকে বলেন, ‘রাজস্থানের’ প্রকৃতি এত রুক্ষ বলে ‘রাজপুতানী’র অঙ্গে এত রঙ। যাঁদের দেশের প্রকৃতি হরিৎ-শ্যামল, ফুলে-ফলে রঙিন, সে দেশের মেয়েরা পরেন ‘সাদা শাড়ি’। এখনও ভারতের অন্যান্য রাজ্যের চেয়ে ‘রাজস্থানে’ রঙের ব্যবহার বেশি। তবে এখন আর কোন রাজ্যই পিছিয়ে নেই। যাক সে কথা।
‘রাজপুত রাজাদের’ পোশাকের মধ্যে ‘কোমরবন্ধ’ বা ‘পটকা’র সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন ‘বাদশাহ’ এবং ‘শাহজাদারা’। এবং তাঁরাও ‘রাজপুতদের’ দেখাদেখি ‘সূক্ষ্ম জরির কাজ করা পটকা’ ব্যবহার করতে শুরু করেছিলেন। ‘জাহাঙ্গীরের’ সময়ের রকমারি নকশার ‘কোমরবন্ধ’ পাওয়া গেছে। সেই ‘পটকা’ ‘রাজপুত মেয়েরা’ও ব্যবহার করতেন ‘ঘাগরা’র সঙ্গে। ‘পটকা’ শুধু যে ‘বেল্টের’ কাজ করত তা নয়, তাঁদের কোমরটিকেও সরু রাখতে সাহায্য করত। মুসলিম সমাজে প্রথমদিকে ‘চিত্রিত পোশাক’ পরার ‘ধর্মীয় নিষেধ’ ছিল। তাঁরা ছবি আঁকতেন না কোন জীবিত বস্তু বা ব্যক্তির। সেজন্যে ‘কোরানের হরফগুলি’ সুন্দর করে চিত্রিত করা হত, বোনাও হত। অপরদিকে ‘চীনে’ ছিল কাপড়ের ওপর ‘সুতো’ বা ‘জরি’ দিয়ে ছবি আঁকার চল্। এছাড়া ছিল নানারকমের ‘ডোরা দেওয়া কাপড়’৷ ‘পারস্য’ প্রভৃতি অঞ্চলের মানুষেরা ‘ডোরা দেওয়া কাপড়ের জামা কিংবা পাজামা’ তৈরি করতেন, ‘পাগড়ি’ জাতীয় ‘শিরস্ত্রাণ’ও তৈরি করতেন। ভারতে হিন্দুদের মধ্যে সব জিনিসেরই প্রচলন ছিল – ‘ডোরা’, ‘নকশা’, ‘ছবি’, ‘অলঙ্কারের’ মতো ‘জড়োয়া সোনা-রুপোর ফুল’ বসানো ছাড়াও তাঁদের ঝোঁক ছিল ‘বস্ত্রের সূক্ষ্মতা’র ওপর। ভারতের উষ্ণ আবহাওয়ার জন্যেও প্রাচীন যুগে ভারতীয়রা ‘পাতলা কাপড়’ পছন্দ করতেন। নতুন যে কোন জিনিসকে পরম সমাদরে গ্রহণ করার মতো উদার মন ও সুন্দরকে চিনে নেবার মতো শিল্পসম্মত দৃষ্টিও ভারতীয় নারীর সাজসজ্জাকে উন্নততর করতে বহুলাংশে সাহায্য করেছে। ‘মুঘল আমলের’ আগে এবং পরে সাধারণভাবে ‘ইসলাম ধর্মাবলম্বী বেগমদের’ পোশাকে ‘ডোরা কাটা সিল্ক’ ও ‘মসলিনের’ প্রাধান্য চোখে পড়ে। পুরনো আমলের আঁকা ছবিতে দেখতে পাওয়া যায় যে ‘হারেমের মেয়েরা’ পরতেন ‘সাদা পাজামা’ ও ‘আঁটসাট কুর্তা’। সেই ‘কুর্তা’র নিচের দিকটা ‘আধুনিক কামিজের’ মতো সমান ছিল না – চারটে বা ছ’টা কোণ থাকত তাতে, অনেকটা ত্রিভুজের মতো দেখাত সেগুলি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেই পোশাক ছিল সাধারণ মেয়েদের পোশাক। ছবিতে দেখা যায়, পরিচারিকা সেইরকম ‘কুর্তা’ পরে ‘সুরা’ পরিবেশন করছেন। ভৃত্যদের পোশাকেও সেই কোণ চোখে পড়ে। এমনকি সেই পোশাক ‘রাজস্থানে’ও দুর্লভ ছিল না। গবেষকদের যতদূর মনে হয়, সেই পোশাকটিতে ‘ভারতীয় রীতি’র সঙ্গে ‘পারসীক রীতি’র মিশ্রণ ঘটেছিল। ‘কুর্তা’র সেই কোণের সঙ্গে দেখা যেত ইংরেজি ‘ভি’-এর মত গলা, এবং সেখানে থাকত ‘জরি বা সামান্য সুতোর কাজ’। ‘মুসলমান শাসকদের পোশাকে’ বহুদিন পর্যন্ত কোন ‘নকশা’ ছিল না। কিন্তু ‘বেগমদের পোশাকে’ পরিবর্তন এসেছিল দ্রুতভাবে। এবং সেই সময় থেকেই বস্ত্রশিল্পের, বিশেষ করে ‘কিংখাবের’ প্রভূত উন্নতি দেখা দিয়েছিল। সেই ‘খানদানী’ ব্যাপার আজও চলে আসছে ‘বেনারসী’র জগতে। সেখানে এখনও ‘তসবীর’, ‘লহরিয়া’, ‘চারখানা’, ‘খানজুরি’, ‘ডোরিয়া’, ‘সালাইদার’, ‘মোটরা’, ‘ইলায়েচা’, ‘সঙ্গী’, ‘বুলবুলচশম’, ‘চশমানকশা’, ‘আড়িবেল’, ‘খাজুরিবেল’, ‘পানবুটি’, ‘ফুল বুটি’, ‘কলগাবুটা’, ‘শিকারগাহ’, ‘গুলদাউদি’, ‘চিনিয়াপট মখমলী’, ‘বুটি মানাতাশি’, ‘জামেয়ার বুটি’, ‘ফর্দি বুটি’, ‘পাংখা বুটি’, ‘আসরফি বুটি’, ‘জালি কী তুরঞ্চ বুটি’, ‘বুটা ঝাড়দার’, ‘মেহরাব’, ‘তনছই’, ‘ভাসকট’, ‘আড়াগুঞ্জর’, ‘গুলবদন’, ‘বেলদার’, ‘কাঙ্গুরী’, ‘ফুলোয়ার’ প্রভৃতি নামের ছড়াছড়ি। এই নামগুলো মনে পড়িয়ে দেয় ‘বেনারসী শিল্পের’ বিশেষ একটা জগৎকে। সে জগটা শুধু ‘নকশার জগৎ’ নয়, বস্ত্রশিল্পের প্রতি আগ্রহী ব্যক্তিদেরও জগৎ। ‘সম্রাট জাহাঙ্গীর’ এবং ‘সম্রাজ্ঞী নূরজাহান’ দু’জনেই ছিলেন শিল্পপ্রেমিক। ‘নূরজাহান’ নিজেই ছিলেন শিল্পী। সূক্ষ্ম কারুকাজ করতে পারতেন কাপড়ের ওপর। অনেক নকশা নাকি তাঁরই আবিষ্কার। আসলে ‘নূরজাহান’ ভারতীয় নারীর পোশাকে এনেছিলেন নতুনত্ব ৷ অবশ্য তিনি ‘হারেমে’ ‘পারসিক প্রভাব’টিকে পুরোমাত্রায় বজায় রাখতে চেয়েছিলেন; তবে সেটা বহু পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে। প্রথমদিকে ‘হারেমের’ মেয়েরা ‘কিংখাব’ ব্যবহার করতেন না। ‘একরঙা’ বা ‘ডোরাকাটা’ ‘জামা ও পাজামা’র ওপরে তাঁরা পরতেন মাকড়সার জালের মতো সূক্ষ্ম ‘মসলিনের পেশওয়াজ’। ‘কিংখাব’ জিনিসটা নারীদের পোশাকের উপকরণ হিসেবেও ছিল বেমানান। সেটা ছিল ভারী এবং জরির কাজের জন্য কিছুটা কর্কশ৷ এছাড়া ভারতীয় মেয়েরা পরতেন গা ভর্তি সোনা রুপোর অলঙ্কার। তাই তাঁদের পোশাকে সোনার ফুল রুপোর পাতার বাহারের প্রয়োজন কী! দুইয়ে মিলে রূপ খুলত না, গয়না-পোশাক দুই-ই মাঠে মারা যেত। তাই ‘কিংখাবের অঙ্গরাখা’ পরতেন পুরুষেরা। মুঘল সম্রাটেরা – ‘জাহাঙ্গীর’, ‘শাহজাহান’ ও ‘ঔরঙ্গজেব’ তিন জনেই ছিলেন ‘কিংখাবের’ সমঝদার। ‘ঔরঙ্গজেব’ পছন্দ করতেন নানা ধরনের ‘মসলিন’, বিশেষ করে কাজকরা ‘জামদানী মসলিন’। ‘আবরোয়া নয়নসুখ’ ও ‘জামদানী’ও সেই সময়েই উন্নতির চরম শিখরে উঠেছিল। ‘চিকন কাপড়ে’ও দেখা গিয়েছিল নানা বৈচিত্র্য। ভারতীয় নারীদের মধ্যে জুতো পরার চল্ খুব বেশি ছিল না। যদিও ‘বেলুরের’ দু-একটি ‘মদনিকা’র পায়ে দেখা যায় ‘হাই-হিল হাওয়াই চটি’র মতো পাদুকা। ‘হারেমবাসিনীরা’ সকলেই জুতো পরতেন, সেই জুতোর সামনেটা ছিল কারুকাজ করা ঢাকা, পিছনের দিকটা ছিল কারুর ঢাকা আবার কারুর বা চটির মতো খোলা। তাঁদের জুতোর কারুকাজ করা অংশে ‘কিংখাবের’ ব্যবহার শুরু হয়েছিল। ‘পারসীক নারীরা’ ‘ওড়না’ ব্যবহার করতেন কিনা সেই বিষয়ে কোন তথ্য পাওয়া যায় না। হয়ত রুমালের মতো ছোট ‘ওড়না’র ব্যবহার তাঁরা জানতেন। সেটার পরিবর্তে তাঁদের মাথায় উঠেছিল ‘টুপি’। তবে ভারতীয় নারীরা টুপি পরতেন না, ‘মুকুট’ পরতেন রানীরা। মুসলমান সমাজে নারী-পুরুষ উভয়েরই ‘টুপি’ পরার চল ছিল। ‘বেগমদের’ ‘টুপি’ও তৈরি হত মহার্ঘ ‘জরির ফুলদার কিংখাব’ দিয়ে, তাতে বসানো হত ‘দামী জহরৎ’ ও ‘মুক্তো’। মুঘল ‘হারেমে’ ‘টুপি’র ওপরে বাঁদিকে ‘বোতাম’ বসানো হত। ভারতে এসে মুঘল অন্তঃপুরের নারীরা দেখেছিলেন ‘কাঁচুলি’, ‘ঘাগরা’ ও ‘ওড়না’ পরা সুবেশা ‘রাজপুতানী’দের। তাঁরা মুগ্ধ হয়েছিলেন সেই পোশাকটির সুন্দর সাবলীলতায়। প্রথমে ‘রাজপুতানী’দের, বিশেষ করে ‘কাংড়া অঞ্চলের’ মেয়েদের ‘পটকা’ এবং পরে তাঁদের ‘কাঁচুলি’ ও ‘ওড়না’টিও ‘হারেমবাসিনীরা’ গ্রহণ করেছিলেন। ‘নূরজাহানের’ ছবিতে দেখা যায় যে তাঁর পরনে ‘ডোরাকাটা পাজামা’র ওপরে থাকত ‘হ্রস্ব জামা’, যা ‘কাঁচুলি’ ও ‘কুর্তা’র সমন্বয়ে তৈরি হয়েছিল এবং ‘মসলিনের পেশওয়াজ’। ‘হারেমবাসিনী’ যেমন ‘টুপি’ বা ‘তাজ’ পরতেন, সেটি গ্রহণ করেছিলেন ‘রাজস্থানের’ কোন কোন ‘রাওলার নারীরা’। ‘বুঁদী’র রাজকন্যারা ‘লম্বা টুপি’ পরতেন৷
শিল্পানুরাগিণী ‘নূরজাহান’ ছিলেন অনেকগুলি কাপড় ও নকশার আবিষ্কর্ত্রী। তিনি একে একে প্রবর্তন করেছিলেন ‘পাচতোলিয়া ওড়না’, ‘দুদামী পেশওয়াজ’, ‘বাদলা’ বা ‘এক ধরনের কমদামী জরি’, ‘কিনারি’ বা ‘লেস’, ‘আতর ই জাহাঙ্গিরী’, ‘নূরমহালী কিংখাব’ এবং আরও কত কী। ‘নূরজাহান’ পোশাকের ওপর সূক্ষ্ম কাজ পছন্দ করতেন। অনেকের মতে ‘চিকনের নকশা’ও তাঁরই আবিষ্কার। তা যদি না-ও হয়, তিনিই যে সেই শিল্পটির প্রভূত উন্নতি করেছিলেন তাতে গবেষকদের কোন সন্দেহ নেই। ‘বেগমদের’ বিয়ের সাজ তৈরি হত জমকালো ‘কিংখাব’ দিয়ে। ‘নূরজাহান’ স্থির করেছিলেন, বিয়ের সময় সকলেই ‘জমকালো জরির পোশাক’ পরবেন। আহা গরীবদেরও তো ইচ্ছে করে একদিনের জন্যে ‘বাদশা-বেগম’ হতে! সেই এক দিনটি তাঁদের জীবনে আর কবে হতে পারে বিয়ের দিনটি ছাড়া! সম্রাজ্ঞীর খেয়াল! তাঁর কোন অভাব ছিল না, কিন্তু তাঁর দাসীরা? প্রতিদিন যাঁরা তাঁকে সাজিয়ে দিতেন, তাঁরা সাজবেন না! কিন্তু ‘কিংখাবের’ পোশাক ছিল বড় দামী। গরীবরা সেটা পরবেন কি করে? ভেবে চিন্তে ‘নূরজাহান’ নিজেই একটা নকশা তৈরি করে ফেলেছিলেন। ‘ফাঁকা’র ওপর ‘জমকালো’। যে সব নকশা খুব সূক্ষ্ম নয়, অথচ পুরো জমিটা ভরে থাকত, সেটাকে বলা হত ‘ফাঁকার কাজ’। ‘নূরজাহানের’ পরিকল্পনা মতো সেই কাপড় বুনতে সময় কম লাগত, দেখতে ঝলমলে হলেও পরিশ্রম কম বলে সেগুলোর দামও ছিল কম। সেই নতুন জরির পোশাকের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘নূরমহালী’। ‘নূরজাহান’ নিজের পরিচারিকা ও তাঁদের কন্যাদের বিয়েতে উপহার দিতেন ‘নূরমহালী’ পোশাক। সেই পোশাক তৈরি করতে তখনকার দিনে খরচ পড়ত পঁচিশ টাকা, মতান্তরে পঁচিশ মোহর বা একশো টাকা। আজও সেই রীতি আমাদের দেশে জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে পালিত হচ্ছে। অর্থাৎ ‘নূরজাহানের’ সেই সঙ্কল্প ভারতীয় নারীর পোশাকে নিয়ে এসেছিল এক নতুন দিগন্ত। ইতিপূর্বে ‘বিয়ের সাজ’ বলে আলাদা কিছু ছিল না। ‘রাজ্যশ্রী’র বিয়ের বড় মাপের আয়োজনের কথা ‘বাণভট্ট’ লিখেছিলেন কিন্তু সেই সাজপোশাকের স্তূপ থেকে ‘রাজ্যশ্রী’র ‘রক্তিম পট্টবস্ত্র’টিকে আলাদা করে চিনে নেওয়া যায়নি, বরং ‘ভারতীয় সনাতন রীতি’ অনুযায়ী বিয়ের সাজ ছিল সাদা এবং সেখানে ঔজ্জ্বল্যের পরিবর্তে পবিত্র ও সুন্দরেরই প্রাধান্য ছিল। এখানেই মধ্যযুগের সাজের ক্ষেত্রে একটা বড় রকমের পরিবর্তন ঘটিয়ে দিয়েছিলেন ‘নূরজাহান’। এরপর থেকে ‘বিয়ের কনের সাজ’ মানেই ‘জমকালো জড়োয়ার প্রাচুর্য’।
এই প্রসঙ্গে ‘অভিজাত ঘরের মুসলমান মেয়েরা’ ‘বিয়ের সাজে’ কেমন সাজতেন সেটার একটা নিখুঁত বিবরণ ‘আন্না হ্যারিয়েট লিউনাউসের’ বর্ণনা থেকে পাওয়া যায়। ‘আন্না’ ভারতে এসেছিলেন খ্রীস্টিয় ঊনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে। তখন ‘খানদানী পরিবারের সাবেকী ধারা’ পুরোমাত্রায় বজায় ছিল। ‘লিউনাউসের’ নিজের ভাষায়, ‘‘… she wore a purple silk petticoat embroidered with a rich border of scattered bunches of flowers, each flower formed of various gems, while the lines and stems were of embroidered gold and silk threads. The bodice was of the same meterial as the petti coat, the entire vest being marked with circular rows of pearls and rubies. Hair was parted in the Greek style and confined at the back in a graceful knot bound by a fillet of a gold. On her forehead rested a beautiful flashing star of diamonds. Her slippers, adorned with gold and seed pearls, were open at the heads showing her henna-tinted feet and curved up in front towards the instep, while from her head flowed a delicate kincauli scarf woven from gold thread, of the finest texture and of a transperant, sunbeam like appearance. This was draped round her person and concealed her eyes and nose revealing only the mouth and chin …’’ নারীসুলভ আগ্রহ ও ঔৎসুক্য নিয়ে লেখিকা বধূটির সাজ পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। তাঁর লেখা বর্ণনার মধ্যে সবার আগে যেটা চোখে পড়ে সেটা হল ‘জাঁকজমকের প্রাচুর্য’। ‘মুঘলযুগের আড়ম্বর’ যেন পরবর্তীকালের নারীদের সাজসজ্জাকে সম্পূর্ণভাবে প্রভাবিত করেছিল। একই সঙ্গে সব কিছুকে ‘সোনাদানা’, ‘রঙ’, ‘কারুকাজ’ দিয়ে ভরিয়ে দেওয়ার সেই প্রবণতা ‘হিন্দুযুগে’ ছিল না। নববধূটির পরণের ‘বেগুনি-লাল ঘাগরা’, লেখিকা যেটাকে ‘পেটিকোট’ বলেছিলেন, সেই ‘কুর্তা’ বা ‘কাঁচুলি’তে ‘জরি’র সঙ্গে ‘জড়োয়া পাথর’ বসানো হয়েছিল, ‘কাঁচুলি’তে ছিল ‘মুক্তোর সারি’; নববধূর চুলে, কপালে, এমনকি জুতোতেও ছিল ‘সোনা’ এবং মাথার উপরে ছিল স্বচ্ছ সোনালী রঙের ‘ওড়না’ – এগুলো সব মিলে যা সৃষ্টি করেছিল তাতে ছিল না একটুও অবসর। অথচ কোন কিছুর অভাব চোখে পড়ে না, এবং সেটাই হয়ে দাঁড়ায় সৌন্দর্য নির্ণয়ের পথে প্রধান অন্তরায়। বস্তুতঃ এরপর থেকেই নারীর সাজসজ্জায় ‘প্রাচুর্যের ভূমিকা’ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। গবেষকদের যতদূর মনে হয়, ‘অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে’ নারী কিছুটা নিরাপত্তার অভাব বোধ করতে শুরু করেছিলেন সেই সময় থেকে। একই সঙ্গে স্বামীকে ‘সপত্নী’দের হাত থেকে রক্ষা করে নিজের প্রতি আকৃষ্ট করবার বাসনাও তাঁদের মধ্যে প্রবল হয়ে উঠেছিল। বস্তুতঃ, নারীসমাজের সেই অবস্থা যে ‘হিন্দুযুগে’ও ছিল না তা কিন্তু নয়, কিন্তু ‘হারেম সংস্কৃতি’তে এর বাড়াবাড়ি চোখে পড়ে। তাছাড়া মুঘলরা সকলেই ছিলেন ‘আড়ম্বরপ্রিয়’। তাঁদের ‘সাজসজ্জার আড়ম্বর’ তৎকালীন অভিজাত সমাজে গৃহীত হয়েছিল ‘ফ্যাশান’ হিসেবে। সেই ‘ফ্যাশনে’ সর্বপ্রথম প্রভাবিত হয়েছিলেন ‘রাজপুত নারীরা’, পরে সেই প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছিল ‘গুজরাট’ ও অন্যান্য সব অঞ্চলে।
‘মুঘল আমলে’ আড়ম্বরের মধ্যেও নারীর সাজকে রুচিসম্মত করে তুলতে ‘নূরজাহান’ চেষ্টার ত্রুটি করেননি, কিন্তু তাঁর এবং তাঁর সময়কার সাজে-প্রসাধনে ‘অলঙ্কার’ হিসেবে গৃহীত হয়নি কোন ‘ফুল’ কিংবা ‘কচি পাতা’, ‘আধফোটা ফুলের কুঁড়ি’ বা ‘পদ্মের মৃণাল’। তার বদলে তাঁরা ব্যবহার করতেন ‘সোনার ফুল’, ‘হীরের ফুল’, ‘দামী পাথর বসানো রুপোর ফুল’, ‘জরির ফুল’। তবে ‘মুঘলরা’ সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়েছিলেন ‘রাজপুত রাজা ও রাজকন্যাদের সাজপোশাকে’। সেই পোশাকের অনুকরণ অব্যাহত ছিল সর্বক্ষণই। ‘কাংড়া’র মেয়েরা পরতেন ‘লম্বা চোলি’, সেটার ‘আস্তিন’টা কবজি ছুঁতো। সেটিও ‘মুঘল অন্তঃপুরে’ প্রবেশ করেছিল। এছাড়া সেখানে এসেছিল আর-এক ধরনের জামা, সেটির নাম ছিল ‘জাঙ্গুলি’ – লম্বায় সেটি ছিল হাঁটু পর্যন্ত, সামনে-পিছনে ছিল হীরে-জহরতের ছড়াছড়ি। জামাকাপড়ে ‘জহরৎ’ বসানোর চল শুরু করেছিলেন ‘জাহাঙ্গীর’, তাঁর আগে ‘মুসলমান শাসক’ বা ‘আমীর-ওমরাহরা’ জামায় ‘হীরে-মুক্তো’ বসাতেন না, নিজেরাও গয়না পরতেন না। কিন্তু ‘রাজপুত রাজারা’ গয়না পরতেন, কতদিন আর গয়না না পরে থাকা যায়! মেয়েদের ‘গয়না-প্রীতির’ অনেক গল্প শোনা যায়। প্রায়ই সে সব গল্পে লোভ শোভনতার সীমা অতিক্রম করে। কিন্তু ভারতীয় পুরুষেরাও গয়না পরতে কম ভালবাসতেন না। বেশবাস সম্বন্ধে অতিমাত্রায় সচেতন ছিলেন বলেই ‘জাহাঙ্গীর’ একদিন কান বিঁধিয়ে ফেলে দু’কানে দুটি উজ্জ্বল ‘মুক্তো’ পরে ফেলেছিলেন। শোনা যায় হিন্দুরা কান বিঁধিয়ে গয়না পরতেন, কারণ তাঁদের ধারণা ছিল যে কান বেঁধালে চোখ ভাল থাকে। ওরকম হাস্যকর ধারণার কোন কারণ ছিল বলে তো মনে হয় না। ‘জাহাঙ্গীর’ শখ করেই কানে গয়না পরেছিলেন এবং তাঁর দেখাদেখি ‘আমীর-ওমরাহরা’ও কানে গয়না পরা শুরু করেছিলেন। ‘মধ্যযুগের’ ভারতে গয়নাগাটির চল ভালোমতোই ছিল এবং আগেই বলা হয়েছে যে সেই পর্বে ছিল ‘সোনা-রুপো’ ও ‘হীরে-জহরতের’ ছড়াছড়ি। ‘হিন্দুযুগের’ সেই ‘শুচিস্মিত লাবণ্যে পূর্ণ তনু’টিকে ‘পুষ্পাভরণে’ সাজাবার প্রবণতা ‘মধ্যযুগে’ অন্তর্হিত হয়ে গিয়েছিল। সেই পর্বের জন্য ‘ভাস্কর্যের’ কোন উদাহরণ নেই, আছে ‘চিত্র’। সেসব ছবিতে দেখতে পাওয়া যায় ‘হারেম কন্যাদের’ নানারকম সাজ। ‘ডোরাকাটা বা ছাপা কাপড়ের আঁট পাজামা’, তার ওপরে ‘মসলিনের অঙ্গাবরণ’ ও ‘ওড়না’ প্রায় সকলকেই ঘিরে থাকত। অনেক সময় মনে হয় ‘আঁটসাট পাজামা’র ওপরে তাঁরা পরতেন ‘মসলিনের স্বচ্ছ ঘাগরা’। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাঁরা ‘লম্বা হাতাওয়ালা চোলি’ পরতেন। এছাড়া তাঁদের সর্বাঙ্গে থাকত অজস্র গয়না৷ ‘মুঘল আমলে’ অজস্র নতুন ধরনের গয়না এসেছিল। সেগুলোর কোনটি ছিল ‘পুরনো গয়নার নতুন সংস্করণ’ কোনটি বা সম্পূর্ণ নতুন। ‘পারসী’রা অলঙ্কারের ওপরে ‘মিনার কাজ’ করতে পারতেন। তাঁদের স্থাপত্যেও পাওয়া যায় নয়নাভিরাম ‘মিনাকারী’। ‘কুন্দন-মিনাকারী’ আজও প্রসিদ্ধ।
মুঘল অলঙ্কারের মধ্যে ‘তাজ’ ও ‘ঝাপটা’ এসেছিল নতুন করে। ‘হিন্দুযুগে’ সেই দুটি মেয়েদের ‘শিরোভূষণ’ ছিল না, ছিল না ‘টায়রা’ কিংবা ‘টিকলি’, তবে ‘মাথায় ফুল’ ও ‘ফুলের মালা’র ব্যবহার ছিল, সিঁথিতে ফুল পরাও চলত, নববধূর ‘সিথিমৌর’ এসেছিল পরবর্তীকালে ‘টায়রা’ ও ‘টিকলি’র যোগফল হিসেবে। গবেষকদের মনে হয়, ‘টায়রা’ এসেছিল সমুদ্র পার হয়ে ‘বিদেশিনীদের অলঙ্কার’ হিসেবে। এই প্রসঙ্গে অতীতের ‘টায়ার’ রাজ্যের কথা মনে হওয়া স্বাভাবিক। তারপর সেটাকে ভারতীয় করে নেওয়া হয়েছিল। মেয়েবা মাথায় পরতে শুরু করেছিলেন ‘চৌঙ্ক’, ‘শিসফুল’, ‘ছোটি’, ‘মৌলি’। তাঁরা কপালে পরতেন ‘দম্নি’, ‘কুটবি’, ‘তাওইট’, ‘চাঁদটিকা’, ‘ঝুমর’, ‘গুছই’, ‘বারওয়াট’ ও ‘বিন্দলি’। সেগুলো সবই ছিল ‘কপাল অলঙ্করণের অলঙ্কার’। প্রাচীন ভারতীয় সাজসজ্জায় সেসব একেবারেই ছিল না। নারীরা সাজতেন ‘টিপ’ ও ‘অলকা তিলকা’য়৷ ‘মুসলমান সমাজে’ ‘টিপ’ বা ‘চন্দন-কস্তুরী’ পরার চল্ ছিল না, অবশ্য তাঁরা হাত-পা এবং নখ রাঙাতেন ‘মেহেদী’ বা ‘হেনা’ দিয়ে এবং সেটা তাঁরা শিখেছিলেন ‘রাজপুত-ললনাদের’ কাছ থেকে। এছাড়া তাঁরা মুখে ব্যবহার করতেন নানারকমের ‘ধাতব অলঙ্কার’ – সেগুলি সবই ছিল ‘টিপ’, ‘টিকলি’ প্রভৃতির সমগোত্রীয়। এ তো গেল ‘মাথার অলঙ্কার’। কানেও উঠেছিল নানারকম গয়না! যদিও ভারতে এর আগেও ‘কর্ণাভরণের’ অভাব ছিল না, ‘কাশী’র ‘মণিকর্ণিকা’ ঘাট তো সেই প্রাচীন কাল থেকে ‘পার্বতীর কর্ণাভরণের স্মৃতি’ বহন করে চলেছে। ‘মুঘল অলঙ্কারে’ দেখা গিয়েছিল আরও কয়েকটি নতুন নাম – ‘গোসওয়াড়া’, ‘বাহাদুরি’, ‘ঝমকা’, ‘বালা’, ‘খুংরিদার’, ‘মছলিয়ান’, ‘পতং’, ‘তানতুর’ এবং ‘মোর ফুলওয়ার’। সেসব অলঙ্কার কিছুটা নাম পালটে কিংবা সামান্য রূপ বদল করে বিশ শতকের গোড়াতেও দেখা গিয়েছিল৷ বাঙালীদের মধ্যে ‘মদনকড়ি’ ও ‘বীরবৌলী’ নামের দুটি ‘কর্ণাভরণের’ কথা শোনা যায়। এছাড়া ‘কানবালা’, ‘কানপাশা’, ‘কান’ – এ সবেতেই ‘মুঘল প্রভাব’ প্রত্যক্ষ করা যায়। ‘নাকের অলঙ্কার’ হিসেবে নতুনভাবে পাওয়া গিয়েছিল ‘নথ’, ‘বুলক’, ‘লটকান’, ‘লং’, ‘নোলক’ প্রভৃতি। প্রাচীন ভারতে সেগুলির কোনটাই ছিল না। পরবর্তীকালে ‘নথ’ ও ‘নোলক’ হয়ে দাঁড়িয়েছিল ‘আয়তির চিহ্ন’। ‘ফাদি নথ’ নাকি এতবড় আকারের হত যে সেটার ভেতর দিয়ে অনায়াসে ভাত খাওয়া যেত, গ্রাস তোলবার সময় ‘নথ’টিকে ‘টানা’ দিয়ে আটকে রাখতে হত না। বলা বাহুল্য সেই অলঙ্কার ছিল পরবর্তীকালের। তবে ‘মুঘল হারেমের’ কোন ছবিতে এত ‘বিশাল নথ’ চোখে পড়ে না। ‘নথ’ সবাই যে পরতেন তা নয়, ‘নবাবী আমলে’ স্বামীর সম্মান অনুযায়ী স্ত্রীর ‘নথ’ পরবার অধিকার জন্মাত। ‘শ্রীহট্টের’ ‘গৌররাম রৈ’ ছিলেন সম্পন্ন ‘বারুজীবী’, তিনি নিজের স্ত্রী-কন্যাকে ‘নথ’ পরাবার জন্যে অনুমতি চেয়েছিলেন আঠারো’শো শতকের মাঝামাঝি সময়ে। তারপর ১১৫৬ সালের ২২শে আষাঢ় তিনি পেয়েছিলেন তাঁর বহু ইপ্সিত প্রার্থনার উত্তর – তাঁর বাড়ির মেয়েদের পুরুষানুক্রমে ‘নথ’ পরবার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। এসব উদাহরণ দেখে গবেষকরা মনে করেন যে, অলঙ্কার ধারণের ওপর নানারকম বিধিনিষেধ ‘উচ্চবর্ণের সম্প্রদায়ের’ জন্য না হলেও ‘শ্রমিক সমাজের’ জন্য প্রচলিত ছিল। ‘রাজপরিবারের মেয়েরা’ ছাড়া অন্য কেউ পায়ে ‘সোনার নূপুর’ বা অন্য গয়না পরতে পারতেন না। ‘ব্রহ্মানন্দ’ ‘কেশবচন্দ্র সেনের’ তিন কন্যার বিবাহ হয়েছিল রাজপরিবারে – তাঁরা যখন ‘সোনার নূপুর’ পরে বসতেন তখন তাঁদের, বিশেষ করে তাঁদের ‘নূপুর’ পরা পা দু’খানি দেখবার জন্যে মেয়েরা ভিড় করতেন। ‘মুকুট’ পরা সম্বন্ধেও সেই ধরনের বিধি-নিষেধ ছিল। সেই নিয়ম ছিল বিবাহিতা ও অবিবাহিতা নারীর অলঙ্কারের ক্ষেত্রেও, কোথাও ‘মঙ্গলসূত্র’, কোথাও ‘টিকলি’, তো কোথাও ‘নোলক’ বা ‘নাকছাবি’ – এগুলো সবই ছিল ‘সধবার চিহ্ন’। ‘আঠারো’শো শতকের বঙ্গদেশে কতরকমের ‘নাকের গয়না’ পাওয়া যেত সেটা জানতে ইচ্ছে হলে ‘মঙ্গলকাব্যের’ পাতায় উঁকি মেরে দেখতে হবে। মেয়েরা ‘বাপের বাড়ি’ এসে পুরনো গয়না ভেঙে নতুন গয়না গড়াতেন। ‘দুর্গা’ও ‘কৈলাসে’ গিয়ে ‘নথ’ ভেঙে ‘নাকচনা’ গড়াচ্ছেন – ‘মঙ্গলকাব্যে’ এই দৃশ্য দুর্লভ নয়। সেগুলোর নামও ছিল নানারকম – ‘মাক্কি’, ‘বেশর’, ‘পিপলিপাত’, ‘ডাইলিবালি’, ‘চমকিবালি’, ‘ঝিলকিবালি’, ‘আন্নিবালি’, ‘চুন্নিবালি’, ‘ডালবোলাক’, ‘চানবোলাক’, ‘হীরাকাট বোলাক’। ‘নাকছাবি’ও ছিল নানারকমের – ‘ডালিমফুল’, ‘লবঙ্গ’, ‘বড়ইফুল’, ‘চালতাফুল’, ‘দামালকাট’ – সবই নকশা অনুযায়ী নাম। সেই আমলে ‘দাঁতের অলঙ্কার’ হিসেবে ‘রখন’ অভিনবত্ব এনেছিল। ‘সোনা বাঁধানো দাঁতের’ চল ছিল একসময়। ‘গলায় হার’, ‘মালা’, ‘লহর’ বা ‘মুক্তোর ছড়া’ পরার চল্ ছিল ‘হিন্দু আমলে’। অল্পবিস্তর সব ভারত-ললনাই ‘কণ্ঠাভরণ’ ব্যবহার করতেন। সেগুলোর নতুন নামকরণ হলেও ‘চম্পাকলি’, ‘হাম্বুলি’, ‘ইতরাদন’, ‘গুলবন্ধ’, ‘কান্দি’, ‘মোহরণ’, ‘হাউলদিল’ – এগুলো সবই ছিল আগে থেকেই। ‘মুঘল হারেমে’ ‘আঁটসাট গলাবন্ধ জামা’ পরার চল্ ছিল, সেখানে সুযোগ ছিল না বিশেষ কোন ‘হার’ পরার, তবুও সেখানে ‘মুক্তোর মালা’, ‘চিক’ ও ‘গুলবন্ধের’ ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। ‘হাতের গয়না’ সম্বন্ধেও একই কথা বলা চলে। ‘বাজুবন্ধ’, ‘জৌসান’, ‘তাবিজ’, ‘অনন্ত’, ‘বাউটি’, ‘ভাওটা’, ‘জশমবাঁক’ এগুলো সবই ছিল নতুন ও পুরনো মেশানো ‘হস্তাভরণ’। সেই যুগের বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য দুটি অলঙ্কার হচ্ছে ‘মানতাসা’ ও ‘রতনচূড়’। ‘হিন্দুযুগের ভাস্কর্যে’ সে দুটির দেখা পাওয়া যায় না। ‘মানতাসা’য় ছিল ‘যুদ্ধক্ষেত্রের কবচের স্মৃতি’, অনেক সোনা দিয়ে তৈরি করা সেই অলঙ্কারে সুক্ষ্মতার অভাব ছিল এবং সেজন্যই সেটি হিন্দু নারীদের পছন্দসই অলঙ্কার হয়ে ওঠেনি। প্রাচীনযুগের নারীরা নিচের হাতে কোন আঁটসাট অলঙ্কার’ পরতেন না – ‘চুড়ি’, ‘বালা’ ও ‘কঙ্কণ’ই ছিল প্রধান আভরণ। ‘মানতাসা’, ‘চূড়’, ‘ব্রেসলেট’, ‘রিস্টলেট’, ‘চেন’, ‘ব্যাঙ্গেল’ সবই এসেছিল পরে; তবে ‘চূড় বালা’ – ‘কঙ্কণের’ মতোই অলঙ্কার, ‘খিল দেওয়া চূড়’ বা ‘চূড়ের মতো গয়নার’ চল্ কবে থেকে হয়েছিল সেটা জানা যায়না। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে ‘কুলুপিয়া’ শঙ্খের উল্লেখ পাওয়া যায়। ‘রতনচূড়’ পরা হত (আজও অনেকে পরেন) ‘হাত ও হাতের পাঁচ আঙল মিলিয়ে’। খুব সুন্দর অলঙ্কার। ‘বাঈজীদেব অলঙ্কার’ হিসেবে সেটি সুপরিচিত ছিল, নিশ্চিত করে বলা না গেলেও গবেষকরা মনে করেন যে, সেটিতে ‘রাজপুত ঘরানার ছাপ’ রয়েছে। ‘মুঘলযুগের অলঙ্কারে’ ‘রাজস্থান’ ও ‘গুজরাটের’ মহিলাদের অলঙ্কারের প্রভাব সবচেয়ে বেশি লক্ষ্য করা গিয়েছিল। আবার তাঁরাই মুঘল অলঙ্কারের অনুকরণ করেছিলেন অন্যদের চেয়ে বেশি, তাই তাঁদের ‘শিল্পরুচি’ অভিন্ন ছিল বলে মনে হতে পারে। আসলে ‘রাজ অন্তঃপুরের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য’ তাঁদের মধ্যে ছিল, কারণ ‘রাজপুত-ললনারা’ ‘মুঘল হারেমে’ ‘বেগম’ হয়ে প্রবেশ করতেন। অপরদিকে ‘বেগম’ ও ‘শাহজাদীদের’ সাজ ছিল সম্ভ্রান্তবংশীয়া বধূ-বিবিদের অনুকরণীয়। এখন যেমন, তখনও তেমনি তাঁরা উন্মুখ আগ্রহে প্রতীক্ষা করতেন ‘হারেমের’ ‘ফ্যাশান’ বা নতুন সাজপোশাক কি আসছে তা জানবার জন্যে এবং সেটাই হয়ে যেত তাঁদের সমকালীন সাজ। দূরের দেশগুলিতে সবসময় সেটা সম্ভব হত না। ‘প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা’ না থাকায় তাঁদের ‘কল্পনার আশ্রয়’ নিতে হত। অর্থাৎ মূল গয়নাটি তৈরি হত ঠিকই কিন্তু তাতে যুক্ত হত সেই দেশের শিল্পীদের পরিচিত কোন নকশা। পোশাকের ক্ষেত্রেও সেটাই ঘটত। ‘শালে’ ছিল না ‘ধানের ছড়ার নকশা’, ‘বালুচরী শাড়ি’র লতাপাতায় কোনদিন ফোটেনি ‘চিনার পাতার আদল’। ‘মুঘল হারেমে’ কি ‘রাজপুত রাওলা’য় ছিল না ‘মাছের আদলে গড়া কানফুল’ কি ‘শাড়ির পাড়ে শাঁখের নকশা’। ‘দক্ষিণ ভারতে’ ছিল ‘গোপুরমের’ মতো মাথা উঁচু করা নকশা, ‘শিকারের নকশা’ এসে কোনদিন ছায়া ফেলেনি সেখানে। ‘আংটি’ পরার অভ্যাস যে প্রাচীন ভারতে ছিল সেটা ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলম্’ পড়েই বোঝা যায়। শুধু তাই নয়, রাজার ‘আংটি’ অনেক সময় ‘অভিজ্ঞান’ হিসেবে ব্যবহৃত হত। ‘মুঘলযুগে’ ‘আরশি’ আর ‘ছল্লা’ ‘আঙুলের অলঙ্কার’ হিসেবে পরিচিত ছিল। সেগুলো ছিল একটু বড় আকারের আংটি এবং পরা হত ‘তর্জনীতে। সাধারণতঃ মহিলারা কেউই গয়না হিসেবে ‘তর্জনী’ বা ‘অঙ্গুষ্ঠে’ ‘আংটি’ পরেন না, পরেন বাকি তিন আঙুলে, বিশেষ করে ‘অনামিকা’য়। ‘বেলুরের মদনিকার অঙ্গুষ্ঠে’ কিংবা ‘ভুবনেশ্বরের নায়িকার তর্জনী’তে ‘আংটি’ রয়েছে বলে দেখা যায়, তবে তাঁদের সংখ্যা বেশি নয়। ‘আরশি’তে মুখ দেখাও চলত; অনেক সময় আংটির পাথরের নিচে লুকোনো থাকত ‘উগ্র বিষ’, পান করে মৃত্যুবরণ করবার জন্যে। বলা বাহুল্য সেসব আয়োজন ছিল রাজা ও রাজপরিবারের জন্যে। সাধারণ মানুষের তো হঠাৎ আত্মহত্যা করবার দরকার পড়ত না, তাই তাঁদের নাগালের বাইরেই থাকত সেসব ‘আংটি’। কোমর থেকে পা পর্যন্ত খুব বেশি গয়না পরবার অবকাশ ছিল না বলে ভারতীয় নারীরা সেই অংশ পোশাকে আবৃত করে রাখতে ভালবাসে, আর দেখা না গেলে গয়না পরে লাভ কি! মজার ব্যাপার এই যে, ‘নবাবী আমলে’ ‘হারেমে’ আবার ‘দেখা-গয়না’ পরার ভারী নিন্দে ছিল। অর্থাৎ গয়না পরা হবে, অথচ দেখা যাবে না – তা কি করে হয়? সম্ভ্রান্ত পরিবারের নারীরা হাতে-বাহুতে গয়না পরে তার ওপরে ‘মসলিনের পটি’ জড়িয়ে রাখতেন। স্বচ্ছ ‘মসলিনের’ ভেতর থেকে দেখা যেত অলঙ্কারের দ্যুতি। সরাসরি গয়না পরতেন ‘নর্তকী’ এবং ‘গায়িকা’ অর্থাৎ ‘পেশাদার বাঈজীরা’। যাঁরা পুরো হাত ঢাকা জামা পরতেন তাঁদের হাতের কিছুটা অংশ কেটে সেখানে ‘মসলিনের টুকরো’ কিংবা পরবর্তীকালে ‘নেট’ লাগানো হয়েছিল। কোমরে পরার জন্যে মধ্যযুগে এসেছিল ‘পাহজেব’, ‘বঞ্জর’, ‘জিঞ্জির’ ও ‘ঘুংরু’। আগেকার ‘মেখলা’, ‘চন্দ্রহার’ ও ‘কিঙ্কিণী’ই নাম বদল করেছিল বলা চলে। পায়ে ‘মল’, ‘ছানলা’, ‘চুটকি’ এসব তো ছিলই। নিম্নমধ্যবিত্তরা ব্যবহার করতেন কোমরে ‘গোটহার’ ও ‘নিমফল’ – এগুলো কিছুদিন আগেও ছিল। এছাড়া ‘মুঘল শাহজাদী’ অর্থাৎ ‘রাজকুমারীরা’ ব্যবহার করতেন ‘মুক্তোর জালের চাদর’। ‘ওড়না’র মতো সেই ‘মুক্তোর চাদর’ তাঁদের দুই কাঁধের দু’পাশে ঝুলত। লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য যা, তা ছিল, সেই পর্বে গয়না ও সাজসজ্জায় অতিরিক্ত আড়ম্বর। সৌন্দর্য নয়, ‘সংখ্যাধিক্য’ই যেন লক্ষ্য ছিল। এর রেশ ছিল আধুনিক যুগের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত।
কিন্তু ‘নূরজাহান’ সেই ‘সংখ্যাধিক্যে’ বিশ্বাসী ছিলেন বলে মনে হয় না। ‘বার্ণিয়েরের’ বর্ণনা থেকে জানা যায়, ‘মুঘল হারেমের পোশাক’ এতটাই সূক্ষ্ম হত যে, কোন কোন পোশাক একরাত্রির বেশি ব্যবহার করা যেত না। সেই পোশাকে থাকত ‘সোনার ঝালর’, ‘সূক্ষ্ম নকশা’, ‘রেশমের ফুল’, ‘জরির কাজ’ – ‘নূরজাহান’ নিজে আবিষ্কার করেছিলেন অনেক ‘নকশা’, ‘কিনারি’ বা ‘লেস’। শোনা কথা, অন্যান্য অনেক জিনিসের মতো ‘বোতামের’ আবিষ্কর্ত্রী ছিলেন তিনিই। গল্পটি হল, ‘নূরজাহান’ একদিন রাজদরবারে যাবেন, মুঘল মহিষীদের মধ্যে একমাত্র তিনিই রাজসভায় যেতেন বলে জানা যায়, দরবারে যাবার উপযুক্ত বেশবাস সম্পূর্ণ হবার পর দেখা গিয়েছিল তাঁর পোশাকের এক জায়গায় ফিতে বসাতে ভুলে গিয়েছিলেন দর্জি। কী হবে? দর্জির বুঝি গর্দান যায়! তখন সম্রাজ্ঞীর এক প্রত্যুৎপন্নমতি পরিচারিকা নিজের কান থেকে ‘সোনার ঝুমকো’ দেওয়া ‘কুণ্ডল’টি খুলে সেটি দিয়ে আটকে দিয়েছিলেন জামার দুটি প্রান্তভাগ। মুগ্ধ হয়েছিলেন ‘নূরজাহান’। আদেশ দিয়েছিলেন, তাঁর সব পোশাকে ‘ফিতে’ বা ‘পটি’র বদলে সেই নতুন জিনিসটি লাগানো হবে, আর যে পরিচারিকার কল্পনা থেকে সেটি উদ্ভূত হয়েছিল তাঁকে তিনি শুধু ‘পারিতোষিক’ই দেননি, তাঁর নামেই সেটির নাম হয়েছিল ‘বাট্টান’। এখন এটিকে নিছক গল্প বলে মনে হলেও মনে রাখতে হবে ‘নূরজাহান’ এজাতীয় অনেক কিছু আবিষ্কার করেছিলেন। ‘প্রসাধন সামগ্রী’ হিসেবে তাঁর অসামান্য আবিষ্কার হল ‘আতর’। ‘প্রসাধনের’ ক্ষেত্রে ‘মুঘল-রমণীরা’ ‘হিন্দুদের প্রসাধন’ ব্যবহার করতেন না। ‘কাজলের’ বদলে তাঁরা চোখে পরতেন ‘সুরমা’, ‘আলতা’র বদলে পরতেন ‘মেহেদি’। তবে শুধু পায়ে নয়, নিজেদের হাত দু’খানিতেও তাঁরা ‘মেহেদির পাতা’ দিয়ে নানারকম নকশা আঁকতেন। দরিদ্র মেয়েরা ‘রতনচূড়’ পরতে পারতেন না, তাঁরা হাতের ওপরদিকেও নানারকম নকশা এঁকে ‘রতনচূড়ের’ অভাব দূর করতেন। আরো দরিদ্র গ্রামবাসীরা গয়নার বদলে হাতে-গলায় গয়না পরবার জায়গায় ‘উলকি’ দিয়ে আঁকিয়ে নিতেন গয়নার নকশা। বিহারের গ্রামাঞ্চলে এখনও এ দৃশ্য দুর্লভ নয়। অপরদিকে সম্ভ্রান্ত পরিবারে, বিশেষতঃ বঙ্গদেশে, নারীদের ‘উলকি’ পরা নিষিদ্ধ ছিল বলা চলে। ‘মুঘল সাজপোশাকের’ সঙ্গে ‘দাক্ষিণাত্যের বিজাপুর রাজ্যের’ মেয়েদের সাজপোশাকেরও মিল ছিল। তাঁরা পরতেন ‘পিরান’, ‘দোপাট্টা’ ও ‘পাজামা’, তবে তাঁরা ‘মুকুট’ পরতেন না। ‘মুসলমান সমাজে’ ‘খোঁপা’ বাঁধারও চল্ ছিল না, তাঁরা ‘লম্বা বেণী’ বাঁধতেন ‘মুক্তোর গুছি’ দিয়ে৷ তাঁরা ‘টিপ’ পরতেন না, তাঁদের কপালে থাকত নানারকম অলঙ্কার৷ ‘বুঁদি’র রাজপরিবারের মেয়েরাও পরতেন ‘পিরান’, ‘পাজামা’, ‘পটকা’ ও ‘দোপাট্টা’; মাথায় পরতেন ‘লম্বা টুপি’। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যেটি বেশি চলত তা হল – ‘ঘাগরা’, ‘চোলি’ ও ‘ওড়না’। ‘পাহাড়ী চিত্রে’ এর প্রাধান্য চোখে পড়বেই। তাঁদের ‘ঘাগরা’র ঘের ছিল বেশি, প্রায় মাটি-ছোঁয়া ৷ তাঁদের ‘ওড়না’ও ছিল বিশাল, মাথা ও বুক ছাড়িয়েও পেছনে থাকত পর্যাপ্ত অংশ। ‘কাংড়া চিত্রে’ও সেই পোশাকের প্রাধান্য দেখা যায়৷ কোন কোন ছবিতে দেখা যায় ‘ওড়না’র একপ্রান্ত কোমরে গোঁজা। তার ফলে ‘ঘাগরা’ও ঢেকে গিয়েছিল ‘ওড়না’য়। অনেক গবেষকের মতে, আধুনিক যুগে ভারতীয় নারীর সবচেয়ে প্রিয় পরিচ্ছদ ‘শাড়ি’ জন্ম নিয়েছিল সেই ‘ওড়না’ থেকেই। ‘হিন্দুযুগে’ ‘চাদর’ ব্যবহারের কোন বাধ্যবাধকতা ছিল না। বধূ ছাড়া কাউকে ‘ঘোমটা’ টানতে হত বলেও কোথাও দেখা যায় না। তাই নানারকম ‘খোঁপা’ বাঁধার চল্ ছিল পুরোমাত্রায়। ‘মুঘল আমলে’, যদিও ‘পারস্যে’ ‘ওড়না’র প্রচলন হয়েছিল কিনা – সেই বিষয়ে কিছু জানা যায় না, তবে ‘অবগুণ্ঠন’ নারীর জন্য অত্যাবশ্যকীয় হয়ে উঠেছিল। সেই ‘ওড়না’ ছিল খুব ছোট, শুধু মাথা-মুখ ঢাকা দেবার জন্যে, ‘বোরখার ঝরোকা’র মতো। ভারতে সেই ছোট্ট ‘ওড়না’টি রূপ বদল করতে শুরু করেছিল এদেশের ‘চাদরের’ অনুকরণে। ‘রাজস্থানে’ ‘ওড়না’ নিয়ে বেশ কড়াকড়ি ছিল এবং সেই সময় থেকেই মেয়েরা ধীরে ধীরে ‘অন্তরালবর্তিনী’ হতে শুরু করেছিলেন। ‘মুসলিম কন্যাদের’ বাইরে বেরোতে হলে ‘বোরখা’ পরতে হত। হিন্দু মেয়েরা টানতেন দীর্ঘ ‘ঘোমটা’, যদিও তাঁরা ক্রমেই লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যেতে শুরু করেছিলেন। হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়েরই সম্ভ্রান্ত পরিবারে ‘বালিকা বধূ’ একবার দীর্ঘ ‘ঘোমটা’ টেনে পিত্রালয়ের গণ্ডি পার হয়ে সেই যে শ্বশুরবাড়িতে প্রবেশ করতেন আর কখনও সে বাড়ির চৌকাটের ওপারে পা রাখতেন না। ‘লক্ষ্মণের অদৃশ্য গণ্ডি’ টানা হয়ে যেত তাঁদের চারপাশে। এর মূলে কী ছিল? লজ্জা? না, শত্রুর হাত থেকে আত্মরক্ষার কৌশল? ‘আসামের শিবসাগর অঞ্চলে’ ‘আহোম রাজাদের’ বাসস্থান হিসেবে যে ‘গড়গাঁও কারেং’ তৈরি হয়েছিল, সেখানে আলো-হাওয়া যুক্ত সুন্দর ঘরগুলিতে থাকতেন ‘রাজবাড়ির পরিচারিকা’ ‘লিগড়ি দাসীরা’, আর রানী ও রাজপরিবারের কন্যা ও বধূরা থাকতেন মাটির নিচের অপেক্ষাকৃত আলো-বাতাসহীন ঘরগুলিতে। কারণ? শত্রু আক্রমণ করলে এবং রাজবাড়িতে প্রবেশ করলে তাঁরা ‘সুসজ্জিতা দাসীদের’ সুসজ্জিত ঘর থেকে রানী ভেবে ধরে নিয়ে যাবে। ওদিকে নিচে, সাধারণ পোশাকে লুক্কায়িতা রানী রক্ষা পাবেন দুর্বৃত্তদের হাত থেকে। কম বেশি সেই মনোভাব থেকেই সম্ভবতঃ এদেশে ‘পর্দা’র উৎপত্তি ঘটেছিল। অনেক গবেষক মনে করেন যে, ‘শাড়ির আবিষ্কর্ত্রী’ ছিলেন দরিদ্র নারীরা। ধনী হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে যখন তিনটি করে পোশাক পরতেন – ‘ঘাগরা’, ‘কাঁচুলি ও ওড়না এবং পিরান’, ‘পাজামা ও দোপাট্টা’; তখন গরীব মানুষেরা নিরুপায় হয়েই একখানি কাপড়ে নিজেদের সর্বাঙ্গ আবৃত করতে শুরু করেছিলেন। সেই কাপড়টি প্রথমে ছিল ‘ওড়না’, পরে রূপান্তরিত হয়েছিল ‘শাড়ি’তে। ‘ওড়না’ যখন বড় হতে শুরু করেছিল তখন অন্য দুটি অর্থাৎ ‘ঘাগরা’, ‘কাঁচুলি’ পর্যবসিত হয়েছিল ‘সায়া’ ও ‘ব্লাউজে’। সেটা অবশ্য অনেক পরের কথা, অনেক জল ঘোলা হয়ে যাবার পরের ঘটনা। দীর্ঘদিন ধরে এক বস্ত্রই ছিল সাধারণ ঘরের মেয়েদের একমাত্র পোশাক৷ সেই বস্ত্ৰই হচ্ছে ‘শাটি’ বা ‘শাড়ি’ বা ‘ধুতি’। ‘ধুতি’ শুধু পুরুষেরা পরতেন না – মেয়েরাও পরতেন অভাবের দিনে। ‘শ্রীমতী লিওনাউস’ এক হিন্দু বধুর সাজও দেখেছিলেন এবং মুগ্ধ হয়েছিলেন একখানি শাড়িকে অপূর্ব ভঙ্গিতে সর্বাঙ্গে জড়িয়ে আবার সেই ‘শাড়ির আঁচল’ দিয়েই ‘ঘোমটা’ টানা দেখে। তাঁর মনে হয়েছিল সেই সাজটি নারীকে শুধু যে নতুন ব্যক্তিত্ব দেয় তা নয়, তাতেই ভারতীয় চারিত্র-বৈশিষ্ট্য সবচেয়ে বেশি প্রকাশ পায় ৷
আরো পড়ুন- সেকালের কলকাতার বসন্তোৎসব
তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, ভারতীয় নারীর সাজসজ্জার ক্রমবিবর্তনের মধ্যে ‘পরিবর্তন’ থাকলেও তার মধ্যে ‘সম্পূর্ণ বৈপরীত্য’ কখনও ছিল না। সেই ‘সূক্ষ্ম বস্ত্র’, সেই ‘মনোরম নকশা ও রঙ’, সেইসব ‘নয়নমোহন অলঙ্কার’ এবং ‘প্রসাধন’ – ‘প্রাচীনযুগে’ও যা ছিল, ‘মুসলমান শাসকদের’ সময়েও তা একেবারে বর্জিত হয়নি। বরং বদলেছিল ‘বিদেশিনীদের পরিচ্ছদ’ – তাঁরা যা এনেছিলেন ‘পারস্য’ থেকে, সেই ‘পারসীক পোশাক’ আবার প্রভাবিত হয়েছিল ‘চীন’ থেকে আসা বস্ত্রের প্রভাবে। ‘চীনা সিল্কের বয়নরীতি’তে মিশে গিয়েছিল ‘পারসীক নকশা’ – ভারতে সবই এসেছিল। আগেও আসত, তবে এতটা ব্যাপকভাবে নয়। নবাগত শাসকরা তাঁদের নিজস্ব পোশাক বলে সেগুলিকে কিছুদিন সযত্নে ব্যবহার করেছিলেন, ‘আমীর-ওমরাহ’, ‘রাজা-উজির’রা অনুকরণ করবার জন্যে সেগুলো নিয়ে গিয়েছিলেন নিজেদের অন্তঃপুরে এবং ভারতীয় পোশাকের সঙ্গে সেগুলো কিভাবে মিলেমিশে গিয়েছিল তা তাঁরা নিজেরাও বুঝতে পারেননি। ভারতীয় পোশাকের আর একটি বৈশিষ্ট্য ছিল লক্ষ্য করবার মতো। সব সময়ই যে কোন পোশাকের ‘সৌন্দর্য এবং সৌকর্য’-গুণটি সে নিজের পোশাকের সঙ্গে মিশিয়ে দিতে পারত। যা অন্য কোন দেশের পোশাকের মধ্যে নেই। যা ছিল শুধু ‘আচ্ছাদন’, ভারতে এসে তা হয়ে উঠেছিল ‘রমণীয়’, ‘সুন্দর’ ও ‘আরামপ্রদ’। এই তিনটি গুণ যে ভারতীয় পোশাকে নেই, সে পোশাক এখানে স্থায়ীভাবে থাকতে পায়নি, ‘ফ্যাশানের’ মতো এসেছে, আবার চলেও গেছে। ‘শ্রীমতী লিওনাউস’ আরো একটি জিনিস লক্ষ্য করেছিলেন, সেটি হল ‘ভারতীয় নারীদের রঙ নির্বাচনের আশ্চর্য ক্ষমতা’ এবং সেই ক্ষমতা বিশেষভাবে দেখা যেত ‘হিন্দু নারীদের নিজস্ব নির্বাচনে’। তাঁর মতে, নিতান্ত সাদাসিধে মেয়েরাও ‘বর্ণ বৈচিত্র্য’ সম্বন্ধে নিখুঁত জ্ঞানের পরিচয় দিয়েছিলেন এবং তার ফলে তাঁরা নিজেদের সাজপোশাকের মধ্যে একটি ‘Perfect harmony’ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
(তথ্যসূত্র:
১- Indian dress: A brief history, Charles Louis Fabri, Orient Longman.
২- Dress and ornaments in ancient India, Indu Prabha Pandey, Bharatiya Vidya Prakashan.)