রানা চক্রবর্তীঃ ‘আলী মর্দানের’ পরবর্তী শাসক ‘হিসামুদ্দীন ইওজ খিলজি’ লখনৌতির তখতে আরোহণ করে ‘গিয়াসুদ্দীন ইওজ শাহ’ নাম নিয়েছিলেন। ইতিপূর্বে ইওজ বরাবরই দিল্লীর প্রতি তাঁর বশ্যতার পরিচয় দিয়েছিলেন। দিল্লীর প্রতি বশ্যতার পরিচয় দিয়েই তিনি ‘মুহম্মদ শিরান খিলজি’র বিরুদ্ধে গিয়েছিলেন, এবং শিরানের বিরুদ্ধে প্রেরিত ‘কাএমাজ রুমী’কে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন। সেসবের জন্য পুরস্কার হিসেবে তাঁকে দিল্লীর অধীনে দেবকোটে লখনৌতি-রাজ্যের শাসনকর্তা নিযুক্ত করা হয়েছিল। এরপরে যখন আলী মর্দান দিল্লীর অনুমোদন পেয়ে বাংলায় ফিরে এসেছিলেন, তখন দিল্লীর প্রতি বশ্যতার কারণেই ইওজ নিজে থেকে এগিয়ে গিয়ে আলী মর্দানকে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন, এবং বিনা বাক্যে তাঁকে লখনৌতি রাজ্যের শাসনভার ছেড়ে দিয়েছিলেন। অথচ আলী মর্দানকে তিনি ভাল করেই চিনতেন, ওরকম দুর্দান্ত ব্যক্তি একটা আস্ত রাজ্যের শাসনভার পেলে কী করবেন, সেটা তিনি বুঝতে পেরেও তখন চুপ করে ছিলেন। ওইভাবে দিল্লীর বশংবদ ইওজের সমর্থনে আলী মর্দান কয়েক বছর ধরে লখনৌতি-রাজ্য শাসন করে সেখানে বিভীষিকার রাজত্ব কায়েম করেছিলেন। অবশেষে খিলজি আমীররা সমবেত হয়ে যখন আলী মর্দানকে হত্যা করে ইওজকে তখতে বসাবার জন্য আহ্বান জানিয়েছিলেন, তখন ইওজ বিনা দ্বিধায় একজন স্বাধীন সুলতান হিসাবে তখতে বসেছিলেন, দিল্লীর প্রতি বশ্যতার কথা তখন আর তাঁর মনে থাকেনি; শুধু সেটাই নয়, তখন থেকেই তিনি দিল্লীর বিরুদ্ধাচরণও করতে শুরু করে দিয়েছিলেন। এর থেকেই বোঝা যায় যে, সেই সময়ের অন্য পাঁচজন আমীরের মত ইওজও একজন উচ্চাভিলাষী ও সুযোগ-সন্ধানী ব্যক্তি ছিলেন, বারবার নিজের ভোল পাল্টাতে তিনি কখনো দ্বিধাবোধ করতেন না। তাঁর চরিত্রের অনেক সদগুণ থাকা সত্ত্বেও এই দিকটার কথা ভুলে গেলে চলবে না। তাঁর সম্বন্ধে ‘তবকৎ-ই-নাসিরী’ গ্রন্থে বলা হয়েছিল, “হুসামুদ্দীন ইওজ সৎ লোক ছিলেন। তিনি ঘোরী-দেশীয় গর্মশিরের খিলজি। কথিত আছে, তিনি একবার ঘোরী সীমান্তের ওয়ালিস্তান নামক জায়গা থেকে – যাকে উচ্চ ভূখণ্ডের দেশ বলা হয়, – সেই পোশ-তাহ-ই-আফরোস যাওয়ার পথে, ভারবাহী গাধা চালিয়ে একটি গ্রামের দিকে যাচ্ছিলেন। সেখানে ছিন্ন পোষাক পরিহিত দু’ জন দরবেশ তাঁর কাছে এসে প্রশ্ন করলেন, ‘তোমার কোন খাদ্য আছে কি?’ ইওজ খলজী জবাব দিলেন, ‘আছে’। তাঁর কাছে পথ-চলবার সময়ে খাওয়ার জন্য রুটি ছিল, সেগুলি তিনি গাধার পিছনে বাঁধা থলি থেকে নিয়ে দরবেশদের সামনে মেলে ধরলেন। তাঁদের ভোজন চলবার সময়ে গাধার পিঠে বাঁধা জল হাতে নিয়ে তাঁদের দেবার জন্য দাঁড়িয়ে রইলেন। দরবেশদের যখন এত তাড়াতাড়ি খাদ্য ও পানীয় দেওয়া হল, তখন তাঁরা নিজেদের মধ্যে বললেন, ‘এই ভাল লোকটি আমাদের সেবা করেছে, তাই সেবার প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়।’ তাঁরা ইওজ খলজীর দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, ‘সর্দার! তুমি হিন্দুস্তানের দিকে যাও। সে দেশে যতদূর ইসলাম বিস্তার লাভ করেছে, ততদূরের দেশ আমরা তোমাকে দিচ্ছি।’ দরবেশদের এই নির্দেশে তিনি সেখান থেকে ফিরে গেলেন এবং গাধার উপরে স্ত্রীকে বসিয়ে তিনি হিন্দুস্তানের পথ ধরলেন। তিনি মুহম্মদ বখতিয়ারের সঙ্গে যোগ দিলেন। তাঁর সৌভাগ্য এতদূর ফলপ্রসূ হযেছিল যে (তখতে আরোহণের পরে) সমগ্র লখনৌতি রাজ্যে তাঁর নামে খুৎবা পাঠ করা হয়, এবং মুদ্রায় তাঁর নাম অঙ্কিত করা হয়। তাঁকে ‘সুলতান গিযাসুদ্দীন’ উপাধি দেওয়া হয়। তিনি লখনৌতি নগরকে তাঁর শাসন পরিচালনার কেন্দ্র করলেন (দেবকোট থেকে রাজধানী সরিয়ে নিয়ে গিয়ে) এবং বসনকোট দুর্গ তৈরী করলেন। চারদিক থেকে জনসাধারণ তাঁর কাছে আসতে লাগল, কারণ তিনি ছিলেন ভাল স্বভাবের লোক, সচ্চরিত্র ও পরিচ্ছন্ন অভ্যাসের অধিকারী। তিনি মুক্তহস্ত, ন্যায়নিষ্ঠ ও দাতা ছিলেন। তাঁর রাজত্বকালে সৈন্যেরা ও জনসাধারণ, স্বস্তি ও আরামের সঙ্গে বাস করত। তাঁর অধীনস্থ সব আমীর তাঁর উপহার দানে খুবই কতার্থ হয়েছিলেন এবং প্রভূত ধন লাভ করেছিলেন। তিনি দেশের মধ্যে তাঁর সদাশয়তার অনেক স্মৃতিচিহ্ন রেখে গেছেন। তিনি বহু মসজিদ ও খানকাহও নির্মাণ করিয়েছেন। বিশিষ্ট আলিম এবং শেখ ও সৈয়দদের জন্য তিনি বৃত্তির বন্দোবস্ত করে দিতেন। অন্যান্য শ্রেণীর লোকদেরও তিনি ধন-সম্পত্তি দান করতেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, জামালুদ্দীন গজনবীর পুত্র – যিনি জলালুদ্দীন নামে অভিহিত হতেন – তিনি ছিলেন ফিরোজকোহর ইমামজাদা। তিনি ৬০৮ সনে (হিজরায়) অনুচরবর্গ সমেত হিন্দুস্তানে আসেন ও কয়েক বছর পরে তিনি প্রভূত ধন সমেত ফিরোজকোহতে ফেরেন। কীভাবে তিনি ঐ সম্পদ লাভ করলেন তা জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন যে, হিন্দুস্তানে পৌঁছে তিনি দিল্লী যাত্রা করেন এবং সেখান থেকে তিনি লখনৌতি যাত্রা করেন। সেখানে গিয়াসুদ্দীনের দরবাবে একটি ধর্মীয় উপদেশের উল্লেখ করা হয়। সেই সচ্চরিত্র সুলতান তাঁর কোষাগার থেকে স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রায় পূর্ণ একটি বড় পাত্র তাঁকে দান করেন, যার মূল্য দশ হাজার রৌপ্য তঙ্কার (টাকার) মত। তিনি তাঁর অধীনস্থ মালিক, আমীর ও দরবারের সম্ভ্রান্ত লোকদের কিছু দান করতে আদেশ দেন; তদনুসারে প্রত্যেকে তাঁকে কিছু দান করেন যার পরিমাণ তিন হাজার টাকার মত, তাঁর বিদায়ের সময়ে, আগে তিনি যা পেয়েছিলেন, তার সঙ্গে আরও পাঁচ হাজার টাকা যোগ করা হল; এর ফলে ইমামজাদা লখনৌতিক রাজা গিযাসুদ্দীন খিলজির দয়ায় আঠারো হাজার তঙ্কা পেলেন। … এই বইয়ের লেখক (মীনহাজুদ্দিন) যখন ৬৪১ হিজরায় লখনৌতিতে পৌঁছান, তখন লখনৌতি রাজ্যের চারদিকে এই রাজার সৎকার্য দেখেন। গঙ্গার দুই দিকে লখনৌতি রাজোর দু’টি অংশ আছে; পশ্চিম দিকের অংশটিকে ‘রাল’ (রাঢ়) বলা হয়, লখনোর নগর এই দিকে অবস্থিত, পূর্ব দিকটিকে ‘বরিন্দ’ (‘বরেন্দ্র’) বলা হয়, দেওকোট (দেবকোট/দেবীকোট) নগর ঐ দিকে অবস্থিত। লখনৌতি থেকে লখনোরের ফটক পর্যন্ত এবং অন্যান্য অঞ্চল থেকে দেওকোট নগর পর্যন্ত উঁচু বাস্তা বানানো হয়েছিল, এবং এগুলি দৈর্ঘ্যে দশ দিনের যাত্রাপথের মত করা হযেছিল। এর কারণ এই যে, বর্ষার সমযে সমগ্র দেশ প্লাবিত হত এবং যদি উঁচু রাস্তা না থাকত, তবে মানুষদের বিভিন্ন অঞ্চলে ও স্থানে নৌকায় করে যেতে হত। তাঁর রাজত্বকালে এই রাস্তাগুলির দরুন সব লোকের চলাচলের উপায হয়। … এও বলা হয় যে, মালিক নাসিরুদ্দীন মাহমুদের মৃত্যুর পরে যখন সুলতান সৈয়দ শামসুদ্দীন (ইলতুৎমিশ) ইখতিয়ারুদ্দীনের বিদ্রোহ দমন করতে লখনৌতিতে আসেন, তখন তিনি গিয়াসুদ্দীনের সংকার্যসমূহ দেখেছিলেন। পরে যখনই তিনি গিয়াসুদ্দীনের নাম উচ্চারণ করতেন তখনই তাঁকে তিনি ‘সুলতান গিয়াসুদ্দীন ইওজ শাহ’ বলতেন, এবং এই কথা বলেছিলেন যে এত কল্যাণসাধক ব্যক্তিকে ‘সুলতান’ উপাধিতে বিভূষিত করতে কোন ব্যক্তির দ্বিধা হওয়া উচিত নয। প্রকৃতপক্ষে, তিনি ছিলেন কল্যাণকামী, দাতা, ন্যায়নিষ্ঠ এবং সৎ লোক। … লখনৌতির পার্শ্ববর্তী সমস্ত রাজ্য, যথা জাজনগর, বঙ্গ (পূর্ববঙ্গ) প্রদেশ, কামরূদ (কামরূপ) ও ত্রিহুত তাঁর কাছে উপঢৌকন পাঠাতো। (বলে রাখা দরকার যে, এই কথার যাথার্থে সংশয়ের অবকাশ রয়েছে। কারণ, জাজনগর প্রভৃতি দেশ তখন মুসলমানদের অধীন ছিল না, পক্ষান্তরে ওই সব দেশের সঙ্গে ইওজ শাহের শত্রুতার সম্পর্ক ছিল। তিনি জাজনগর রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন এবং বঙ্গ ও কামরূপ রাজ্য জয় করাব জন্য ব্যর্থ চেষ্টা করেছিলেন। উড়িষ্যার রাজা অনঙ্গভীমের (১২১১-১২৩৮ খৃষ্টাব্দ) একটি শিলালিপিতে বলা হয়েছিল যে, অনঙ্গভীমের মন্ত্রী ও সেনাপতি বিষ্ণু ‘যবনাবনীন্দু’র সঙ্গে যুদ্ধে অবর্ণনীয় বীরত্বের প্রদর্শন করেছিলেন। সেই ‘যবনাবনীন্দু’ নিঃসন্দেহে গিয়াসুদ্দীন ইওজ শাহ ছিলেন, যিনি লখনোর জয় করেছিলেন।) লখনোর জেলা সম্পূর্ণভাবে তাঁর অধিকারভুক্ত হয়েছিল। (এখান থেকে) প্রভূত পরিমাণে হাতী, রাজস্ব ও ধনসম্পদ তাঁর হস্তগত হয় এবং এখানে তিনি তাঁর আমীরদের অধিষ্ঠিত করেছিলেন। … সুলতান শামসুদ্দীন (ইলতুৎমিশ) কয়েকবার দিল্লী থেকে লখনৌতিতে সৈন্যবাহিনী পাঠান এবং বিহার জয় করে সেখানে তাঁর আমীরদের নিযুক্ত রাখেন। ৬২২ হিজরায় তিনি লখনৌতি আক্রমণ করলেন। তখন গিয়াসুদ্দীন তাঁর নৌকাগুলি উঠিয়ে নিলেন (এর থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, গিয়াসুদ্দীন তাঁর একটি নিজস্ব এক নৌবহর গঠন করেছিলেন) এবং তাঁদের মধ্যে শাস্তি স্থাপিত হল। তিনি ইলতুৎমিশকে আটত্রিশটি হাতী এবং ৮০ লাখ তঙ্কা মূল্যের ধনবত্ব প্রদান করেন। তিনি সুলতানের নামে খুৎবা পাঠের প্রচলন করেন। (এই উক্তির সত্যতা সম্বন্ধে আরও প্রমাণ হল যে, ঐতিহাসিকেরা ৬২২ হিজরায় উৎকীর্ণ কিছু মুদ্রা পেয়েছিলেন, যেগুলোতে শামসুদ্দীন ইলতুৎমিশ ও গিয়াসুদ্দীন ইওজ – দু’জনেবই নাম ছিল (JNSI, 1979, p: 42-62)। বিদায়ের সময়ে সুলতান মালিক আলাউদ্দীন জানীকে বিহার দেন। গিয়াসুদ্দীন ইওজ লখনৌতি থেকে বিহারে এসে তা অধিকার করলেন এবং অন্যায় কাজ করতে লাগলেন। (বোঝা যায় যে, গিয়াসুদ্দীন ইওজও অন্যায় কাজ করতে জানতেন।) … ৬২৪ হিজরায় সুলতান শামসুদ্দীনের পুত্র মালিক শহীদ নাসিরুদ্দীন এক হিন্দুস্তানী সৈন্যবাহিনী সংগ্রহ কবে মালিক জানীকে সঙ্গে নিয়ে, অযোধ্যা থেকে লখনৌতির দিকে অগ্রসর হলেন। সেই সময়ে গিযাসুদ্দীন ইওজ হোসেন খিলজি বঙ্গ (নৌবহর গঠন করার ফলেই তাঁর পূর্ববঙ্গ অভিযানে যাওয়া সম্ভব হয়েছিল) ও কামরূদ (কামরূপ) অভিযানে গিয়েছিলেন এবং লখনৌতি রক্ষক-বর্জিত অবস্থায় রেখেছিলেন। (এর থেকে মনে হয় গিয়াসুদ্দীন ইওজের বাস্তব বুদ্ধির অভাব ছিল; কারণ, তাঁর পিছনে ইলতুৎমিশের মত প্রবল একজন শত্রু থাকা সত্ত্বেও রাজধানী লখনৌতি অরক্ষিত অবস্থায় রেখে যাওয়াটা তাঁর কখনোই উচিত হয় নি)। মালিক নাসিরুদ্দীন লখনৌতি অধিকার করলেন। এই বিপদের ফলে গিয়াসুদ্দীন ফিরে এসে মালিক নাসিরুদ্দীন মাহমুদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হলেন। কিন্তু, তাঁকে ও তাঁর সমস্ত আমীরকে বন্দী করা হল। বারো বছর রাজত্বের পরে তিনি নিহত হলেন।”
উপরোক্ত বিবরণ থেকে গিয়াসুদ্দীন ইওজ শাহের স্বভাব এবং রাজত্বের ঘটনাবলী সম্বন্ধে পরিষ্কার কিছু তথ্য পাওয়া যায়। মীনহাজ অন্যত্র লিখেছিলেন, “গিয়াসুদ্দীন তাঁর সমস্ত আত্মীয়স্বজন, খলজী আমীর, সমস্ত অর্থভাণ্ডার ও হাতীর পাল সমেত তাঁর (নাসিরুদ্দীনের) হাতে ধরা পড়েন। গিয়াসুদ্দীনকে তিনি হত্যা করলেন এবং তাঁর ধনসম্পদ বাজেয়াপ্ত করলেন।” ঐতিহাসিকেরা গিয়াসুদ্দীন ইওজ শাহের অনেক মুদ্রা পেয়েছিলেন। তবে সেই মুদ্রাগুলিতে টাঁকশালের কোন নাম ছিল না, কিন্তু সেগুলোর মধ্যে – ৬১৬, ৬১৭, ৬১৯, ৬২০, ৬২১ – প্রভৃতি হিজরার বছর, এবং ‘১৯শে সফর ৬১৬, রবি-উস-সানী ৬১৭, ৬১৯, ৬২০; ২০শে রবি-উস-সানী ও জমাদি-উস-সানী ৬২১’ প্রভৃতি তারিখের উল্লেখ পাওয়া গিয়েছিল। ওই মুদ্রাগুলিতে দেখা গিয়েছিল যে, গিয়াসুদ্দীন সেগুলিতে নিজের অনেক উপাধি উৎকীর্ণ করিয়েছিলেন। সেই উপাধিগুলি তাঁর রাজকীয় মর্যাদার পরিচায়ক ছিল। সেগুলোর মধ্যে দু’টি উপাধি ঐতিহাসিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ – ‘নাসির আমীর উল-মোমেনীন’ ও ‘কসীম আমীর-উল-মোমেনীন’। এই দুই উপাধি দ্বারা গিয়াসুদ্দীন নিজেকে ‘আব্বাসী খলিফা’র সাহায্যকারী বলে ঘোষণা করেছিলেন। এর থেকে ‘এডওয়ার্ড টমাস’ প্রভৃতি পাশ্চাত্য গবেষকেরা সিদ্ধান্ত করেছিলেন যে, ইওজ শাহ আব্বাসী খলিফা ‘আল-নাসিরের’ কাছ থেকে সনদ পেয়েছিলেন। কিন্তু গবেষক ‘ডঃ আহমদ হাসান দানী’ এবং তাঁর অনুবর্তী গবেষক ‘ডঃ আবদুল করিম’ পরবর্তীকালে দেখিয়ে দিয়েছিলেন যে, ইওজ শাহ আদৌ সেরকম কোন সনদ কখনো পান নি। (বাংলার ইতিহাসে সুলতানি আমল, ডঃ আবদুল করিম, পৃ: ১০০-১০২) এই প্রসঙ্গে ডঃ করিম লিখেছিলেন, “এই বিষয়ে ডঃ আই. এইচ. কোরেণীর মত প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন যে, মুসলিম সাম্রাজ্য চারিদিকে বিস্তৃতি লাভ করিবার পর অনেক এলাকার স্বাধীন মুসলমান শাসক নিজেদের শাসন আইনানুগ করার উদ্দেশ্যে আব্বাসী খলিফার অনুমতি ছাড়াই তাঁহাদের নাম ব্যবহার করিতেন।” তাই মনে হয় যে, গিয়াসুদ্দীন ইওজ খিলজিও সেটাই করেছিলেন; এমনকি ইলতুৎমিশও প্রথম দিকে সেটাই করেছিলেন, যদিও পরবর্তী সময়ে তিনি সত্যিই খলিফার সনদ আনিয়েছিলেন। গিয়াসুদ্দীন ইওজ শাহের মুদ্রা সম্পর্কে ডঃ আবদুল করিম আরো লিখেছিলেন, “কোন কোন মুদ্রায় তিনি ওলী আহাদ বা যুবরাজ আলা-উল-হক্ক-ওয়াদ-দীন (সংক্ষেপে অ লা-উদ-দীন) এর নামও উল্লেখ করিয়াছেন।” (বাংলার ইতিহাসে সুলতানি আমল, ডঃ আবদুল করিম, পৃ- ১০০) গিয়াসুদ্দীনের কোন কোন মুদ্রায় জনৈক ‘মুইজ-উদ-দুনিয়া ওয়াদ-দীন আবুল মুজাফ্ফর’-এর উল্লেখ পাওয়া যায়; টমাস ভুলভাবে সেইসব মুদ্রার পাঠোদ্ধার করেছিলেন, এবং সেগুলোর থেকে সিদ্ধান্ত করেছিলেন যে, আব্বাসী খলিফা ইওজ শাহকে প্রত্যক্ষভাবে হস্তক্ষেপ করে সুলতান পদে নিযুক্ত করেছিলেন। কিন্তু সে সম্বন্ধে ডঃ আবদুল করিম লিখেছিলেন, “উপরোক্ত অর্থ করিলে মুদ্রার সম্পূর্ণ বাক্যটির কোন অর্থই হয় না। হোয়ের্নল এবং রাইটের পাঠ মানিয়া লইলে সম্পূর্ণ বাক্যটির অর্থ হয়। অর্থ নিম্নরূপ – ‘গিয়াস-উদ-দুনিয়া ওয়াদ দীন যিনি কদীম আমীর-উল মোমেনীন, সুলতান- উস-সলাতীন এবং নাসির আমীর-উল-মোমেনীন ছিলেন, তিনি মুঈজ-উদ-দুনিয়া ওয়াদ-দীন আবুল মুজফ্ফরকে নিযুক্ত করেন।’ … অন্য কোন সূত্রে মুইজ-উদ-দীনের নামও পাওয়া যায় না। হয়ত যুববাজ আলা-উল-হক্কের অকাল মৃত্যু হয় এবং সেই জন্য পরবর্তী মুদ্রায় ইওজ খলজী অন্য একজন যুবরাজ মুইজ-উদ-দীনের নাম অঙ্কিত করিয়াছেন।” (বাংলার ইতিহাসে সুলতানি আমল, ডঃ আবদুল করিম, পৃ- ১০৫) কিন্তু ডঃ করিমের ব্যাখ্যাও সম্পূর্ণ সঠিক নয়; কারণ, মুদ্রাটিতে ‘আলায়দ’ শব্দটি রয়েছে ধরে নিয়ে সেটির বঙ্গানুবাদ – “নিযুক্ত করেন” – করা হয়েছিল। কিন্তু ‘ডঃ জেড. এইচ. দেশাই দেখিয়ে দিয়েছিলেন যে, ‘আলায়দ’ আসলে ভ্রান্ত পাঠ, প্রকৃত পাঠ হওয়া উচিত ছিল ‘আলী শের’। (Epigraphia Indica, Arabic & Persian Supplement, 1975, p- II) যাই হোক, ‘মুইজুদ্দীন’ যে গিয়াসুদ্দীন ইওজ শাহের পুত্র ছিলেন, সেটা পরবর্তীকালে আবিষ্কৃত হয়েছিল। অতীতে ঐতিহাসিকেরা বীরভূম জেলার ‘সিয়ান’ গ্রামে (বোলপুর থেকে ৪ মাইল দূরে অবস্থিত) ‘মখদুম শাহের দরগা’ নামে পরিচিত একটি দরগায় একটি খণ্ডিত শিলালিপি পেয়েছিলেন। অতীতে অনেকেরই ধারণা ছিল যে, উক্ত মখদুম শাহ ছিলেন ‘শেখ জলালুদ্দীন তব্রিজী’। কিন্তু তাঁদের সেই মতের স্বপক্ষে সামান্যতম কোন প্রমাণ পাওয়া যায় নি। উক্ত শিলালিপিটি পাল রাজাদের (নয়পাল বা তৃতীয় বিগ্রহপালের রাজত্বকালের) আমলের একটি শিলালিপির উল্টোপিঠে উৎকীর্ণ করা হয়েছিল। (ডঃ দীনেশচন্দ্র সরকার সেই শিলালিপিটির পাঠোদ্ধার করেছিলেন, এবং নানা জায়গায় সে সম্বন্ধে আলোচনা করেছিলেন।) ‘ডঃ জেড. এইচ. দেশাই সেটির যে পাঠোদ্ধার করেছিলেন (Epigraphia Indica, Arabic & Persian Supplement, 1975, p: 7-8) তা নিম্নরূপ –
“(1) In the name of Allah, the Beneficent, the Merciful (In houses which Allah has permitted to be exalted and that) His name may be remembered in them; there glorify Him therein in the mornings and evenings,
(2) men whom neither merchandise nor selling diverts from the remembrance (of Allah and the keeping up of prayer and the giving of poor-rate, they fear a day in which shall turn about,
(3) ‘the hearts and the eyes’ (Saying quoted) from the Messenger of Allah, may Allah’s (peace and salutations be upon him in) the sahlh ‘Men are in their prayer-houses (mosques) and Allah is (looking) after their needs.’
(4) this Khanqah was (built and donated by the humble creature (al-Faqir), the sinful, the one who l opes (for the mercy of his Nourisher,) son of Muhammad al-Marāghi., (i.e by origin, of Maragha), for the benchers (Ahl-i Suffa i. e. ascetics, sufis) who all the while abide in the presence.
(5) of the Exalted Allah and occupy themselves in the remembrance of the Exalted Allah in the (time of the government? of the Shelter?) of Islam and the Muslims, Chief among the monarchs and the Sultāns one who is specially favoured.
(6) by the lordship of the Time in the Worlds, ‘Ali Shir son of ‘Iwad, Burhanu Amiri’l-Mu’minin lit. Proof of the Commander of the Faithful), on the seventh day of (the month of Jumādā II, year (A. H.) eighteen and six hundred (7 Jumādā II 618-29 July 1221).”
ঐতিহাসিকদের কাছে উক্ত শিলালিপিটি আজও বিশেষ মূল্যবান। কারণ, প্রথমতঃ, বাংলার মুসলমান আমলের এটিই প্রথম শিলালিপি – ১২২১ খৃষ্টাব্দে অর্থাৎ বখতিয়ারের নদীয়া জয়ের মাত্র ১৭ বছর পরে এই শিলালিপি উৎকীর্ণ করা হয়েছিল। দ্বিতীয়তঃ, অত আগে বীরভূমের অভ্যন্তর প্রদেশে অজয় নদের অনতিদূরে মুসলিম রাজত্ব যে বিস্তৃত হয়েছিল, সেটাও একটা চমকপ্রদ খবর; কিন্তু ওরকম হওয়া খুবই স্বাভাবিক ছিল, কারণ ‘সিয়ান’ নদীয়া ও লখনোরের প্রায় মাঝখানে অবস্থিত ছিল। তৃতীয়তঃ, শিলালিপিটিতে একটি খানকাহ, বা সুফী দরবেশদের ধর্মশালা প্রতিষ্ঠার উল্লেখ পাওয়া যায়; খানকাহ, প্রতিষ্ঠা সংক্রান্ত শিলালিপি ভারত উপমহাদেশে ঐতিহাসিকেরা খুব কমই পেয়েছেন; মীনহাজের ‘তাকাৎ-ই-নাসিরী’তে বখতিয়ারের খানকাহ স্থাপনের উল্লেখ রয়েছে, ইওজ শাহের রাজত্বকালেও যে সেই প্রথা চলেছিল, সেটার পাথুরে প্রমাণ ওই শিলালিপি থেকে পাওয়া যায়। চতুর্থতঃ, ইওজ শাহের পূর্বোক্ত মুদ্রায় (৬২১ হিজরায়) যে মুইজুদ্দীনের উল্লেখ পাওয়া যায়, তিনি এবং উক্ত শিলালিপিতে উল্লিখিত আলী শের অভিন্ন লোক ছিলেন। এই প্রসঙ্গে ডঃ জেড. এইচ. দেশাই লিখেছিলেন, “… the coin stated to have been minted in A. H. 621 and published by Hoernle, is assigned to him. But the legend on the reverse has (1) Ghiyathu, d-Dunya wa’d-Din (2) Abu’l- Fath ‘Iwad bin Husain (3) Qasimu Amiri ‘l-Mu’minin Sultan (4) u’s-Salātin Mu’izzu’d-Dunya wa’d-Din (5) Abul-Muzaffar ‘Ali Shir Iwad (6) Burhānu (?) Amiri I – Muminin.” ডঃ দেশাইও লিখেছিলেন, “Ali Shir mentioned in our record (শিলালিপি) as the son of ‘Iwad is identical with him (মুইজুদ্দীন) and the ‘Iwad of the record is none other than Ghiyath’ud-D.n ‘Iwad.” ডঃ দেশাই-এর মতে উক্ত মুইজুদ্দীন আলী শের ১২২১ খৃষ্টাব্দে স্বাধীনভাবে রাজত্ব করছিলেন; তাঁর যুক্তি ছিল যে, শিলালিপিটিতে আলী শেরের সে সব উপাধি দেখা যায়, সেগুলি “are used in inscriptions, coins and historical works only for monarchs and rulers.” আধুনিক সময়ের ঐতিহাসিকেরা তাঁর মতের সঙ্গে সহমত হতে পারেন নি। কারণ, ১২২১ খৃষ্টাব্দের কয়েক দশক পরে শামসুদ্দীন ফিরোজ শাহের ছেলেরা, তাঁদের পিতার অধীনস্থ শাসনকর্তা হিসাবেই পূর্ণ রাজকীয় উপাধি নিয়ে মুদ্রা জারী করেছিলেন। এক্ষেত্রেও অনুরূপ ব্যাপার হয়েছিল বলে ডঃ দেশাই এ কথাও বিশ্বাস করতে রাজী ছিলেন যে, গিয়াসুদ্দীন ইওজ শাহের রাজত্ব ৬১৭ হিজরায় শেষ হয়েছিল, কারণ পরবর্তী কালে লেখা একটি সূত্রে সেই তারিখই উল্লেখ করা হয়েছিল। কিন্তু ‘তবকাৎ ই-নাসিরী’র সব পুঁথিতেই দেখা যায় যে, ৬২৪ হিজরায় ইওজ শাহ নাসিরুদ্দীন মাহমুদ শাহের হাতে পরাজিত ও নিহত হয়েছিলেন; এরপরে নাসিরুদ্দীন দেড় বছর ধরে লখনৌতি-রাজ্য শাসন করেছিলেন, এবং ৬২৬ হিজরার জমাদী অল-আউয়ল মাসে ইলতুৎমিশের কাছে তাঁর মৃত্যু-সংবাদ পৌঁছেছিল; ৬১৭ হিজরায় ইওজ নাসিরুদ্দীনের হাতে নিহত হয়েছিলেন বললে ‘তবকাত-ই-নাসিরী’র আভ্যন্তরীণ সাক্ষ্যের সঙ্গেই বিরোধ দেখা দেয়। ডঃ দেশাই মনে করতেন, “the statements of the later authorities which must have been based on good copies of the earlier authorities including the Tabaqāt-i-Nasiri cannot be brushed aside easily or summarily.” কিন্তু সে রকম কোন ‘good copy’ না দেখা পর্যন্ত ‘তবকাৎ-ই-নাসিরী’র বর্তমান পুঁথিগুলির সাক্ষ্যকে উপেক্ষা করা যেতে পারে না। মোটের উপরে এক্ষেত্রে সেই ‘Later authority’-র সাক্ষ্য একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। গিয়াসুদ্দীন ইওজ শাহের ৬১৭ হিজরার পরবর্তী তারিখের অনেক মুদ্রাও ঐতিহাসিকেরা পেয়েছিলেন। সুতরাং মুইজুদ্দীন বা আলী শের ১২২১ খৃষ্টাব্দে তাঁর পিতা গিয়াসুদ্দীন ইওজ শাহের অধীনস্থ শাসনকর্তা হিসাবে সিয়ান ও তার আশপাশের অঞ্চলগুলি শাসন করতেন বলে সিদ্ধান্ত করা যেতে পারে। কারণ, ৬২১ হিজরায় উৎকীর্ণ গিয়াসুদ্দীন ইওজ শাহের যে মুদ্রাটিতে ডঃ দেশাই আলী শেরের নাম লেখা আছে বলে দেখিয়েছিলেন, সেটিতে ইজ শাহ ও আলী শের – দু’জনেরই নাম রাজকীয় উপাধি সমেত উল্লেখ করা হয়েছিল। অথচ কেবল গিয়াসুদ্দীনকেই ‘সুলতান’ বলা হয়েছিল। অতএব পিতার জীবদ্দশাতেই যে আলী শের রাজকীয় উপাধি ব্যবহারের অধিকার পেয়েছিলেন, সেটা প্রমাণিত হয়। ১২২১ খৃষ্টাব্দে বীরভূম অঞ্চলের শাসনকর্তা হিসাবে আলী শেরকে পাওয়া যায়; সম্ভবতঃ তাঁর কর্মকেন্দ্র লখনোরে ছিল।
মীনহাজ-ই-সিরাজের লেখা থেকে বোঝা যায় যে, মুহম্মদ শিরান বখতিয়ার কর্তৃক লখনোর জয়ের জন্য প্রেরিত হয়েছিলেন, কিন্তু বখতিয়ারের মৃত্যুর জন্য সেই জয় তিনি করতে পারেন নি। ইওজ শাহ প্রথমে লখনোর অধিকার করেছিলেন; সেই অধিকারের পরেই সম্ভবতঃ নিজের পুত্র আলী শেরের উপরে তিনি লখনোরের শাসনভার দিয়েছিলেন, এবং তাঁকে পূর্ণ রাজকীয় মর্যাদার অনুরূপ উপাধি ব্যবহারেরও অনুমতি দিয়েছিলেন। গিয়াসুদ্দীন ইওজ শাহ যে একজন যোগ্য শাসক ছিলেন, সে বিষয়ে ঐতিহাসিকদের কোন সন্দেহ নেই। অবশ্য তাঁর চরিত্রে দোষও ছিল। আগেই বলা হয়েছে যে, গোড়ার দিকে তিনি নির্লজ্জ সুবিধাবাদের পরিচয় দিয়েছিলেন, এবং শেষ দিকে তিনি উপযুক্ত বুদ্ধির পরিচয় দিতে পারেন নি। কিন্তু তাঁব নাম এই কারণে ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে যে, তিনিই বাংলার ‘প্রথম জনহিতৈষী মুসলমান সুলতান’ ছিলেন। ইতিপূর্বে বখতিয়ার খলজী তাঁর নিজের সম্প্রদাযের লোকেদের জন্য কিছু কিছু হিতকর কাজ করেছিলেন, কিন্তু অসাম্প্রদাযিক জনহিতকর কাজ বোধ হয় ইওজ শাহই প্রথম করেছিলেন। দেবকোট থেকে লখনোর অবধি বাস্তা তৈরী করা তাঁর অক্ষয় কীর্তি।
(তথ্যসূত্র:
১- Tabakat-i-Nasiri, Minhaj-us-Siraj, English translation by H.M. Elliot.
২- Tabaqat-i-Nasiri, Minhaj-us Siraj, Raverty’s Translation.
৩- বাংলার ইতিহাসে সুলতানি আমল, ডঃ আবদুল করিম।
৪- Journal of the Numismatic Society of India, ১৯৭৩।
৫- Social History of the Muslims of India, D. Abdul Karim.
৬- Epigraphia Indica, Arabic & Persian Supplement, 1975.)