Bangla Hunt Digital

বঙ্গীয় ব্রাহ্মণদের আদি বাসস্থান

বঙ্গীয় ব্রাহ্মণদের আদি বাসস্থান

রানা চক্রবর্তীঃ বঙ্গদেশীয় ব্রাহ্মণদের দুটি ভাগ – ‘রাঢ়ী’ ও ‘বারেন্দ্র’। এই দুই ভাগের ব্রাহ্মণদের আদি বাসস্থান কোথায় ছিল তা নিয়ে সেই অতীতকাল থেকে বিতর্ক চলে আসছে। প্রচলিত প্রবাদানুসারে বঙ্গদেশের ‘রাঢ়ী’ ও ‘বারেন্দ্র’ ব্রাহ্মণদের পূর্বপুরুষ – ‘পঞ্চ ব্রাহ্মণ’ – ‘কান্যকুব্জ’ (কনৌজ) থেকে গৌড়ে এসেছিলেন। অর্থাৎ তাঁরা আদতে মূল বঙ্গদেশের বাসিন্দা ছিলেন না বা বহিরাগত ছিলেন। কিন্তু ‘রাঢ়ী’ ও ‘বারেন্দ্র’, উভয় বিভাগের ব্রাহ্মণদের প্রাচীন কুলগ্রন্থসমূহ এই প্রবাদকে সমর্থন করে না। উভয় ব্রাহ্মণের ‘কুলজী’ মতে তাঁদের পূর্ববাসস্থান ছিল ‘কোলাঞ্চ’। এখন প্রশ্ন ‘কোলাঞ্চ’ ও ‘কান্যকুব্জ’ কি একই জায়গা? যদি সেটা না হয়, তবে ‘কোলাঞ্চ’ কোথায় ছিল? – সেই সম্বন্ধে আলোচনাই এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য। প্রাচীন বঙ্গের রাঢ়ীয় ব্রাহ্মণদের প্রাচীনতম কুলগ্রন্থকারদের মধ্যে ‘হরিমিশ্র’ ছিলেন অন্যতম। তিনি লিখেছিলেন –
“কোলাঞ্চদেশতঃ পঞ্চ বিপ্ৰা জ্ঞানতপোযুতাঃ।
মহারাজাদিশূরেণ সমানীতাং সপত্নীকাঃ॥”
(বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস, ব্রাহ্মণকাণ্ড, ১০৪ পৃষ্ঠার পাদটীকা)
আবার হরিমিশ্রের থেকে কম প্রাচীন ‘বাচস্পতি মিশ্র’ তাঁর ‘কুলরমা’ গ্রন্থে লিখেছিলেন –
“আরুহ্য পঞ্চ তুরগানসিবাণতৃণকোদগুরম্যকবচাদিশরীরবেশাঃ।
কোলাঞ্চতো দ্বিজবরা মিলিতা হি গৌড়ে রাজাদিশূরপুরতো জ্বলদগ্নিতুল্যাঃ॥”
(বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস, ব্রাহ্মণকাণ্ড, ১০৫ পৃষ্ঠার পাদটীকা)
অন্যদিকে, রাঢ়ীয় কুলগ্রন্থানুসারে পঞ্চ ব্রাহ্মণের সকলেই ‘কোলাঞ্চ’ থেকে এসেছিলেন। কিন্তু বারেন্দ্র কুলাচার্যদের মধ্যে এই বিষয়ে মতভেদ দেখতে পাওয়া যায়। ‘বারেন্দ্রকুলপঞ্জিকা’য় লেখা আছে যে, পঞ্চ ব্রাহ্মণ বিভিন্ন জায়গা থেকে বঙ্গদেশে এসেছিলেন। তাঁদের মধ্যে একমাত্র ‘কাশ্যপগোত্রীয়’দের বীজী পুরুষ – ‘সুষেণ’ – কোলাঞ্চ থেকে এসেছিলেন –
“নারায়ণাখ্যো যস্তেযাং শাণ্ডিল্যগোত্র এর সঃ।
রাজাজ্ঞয়া সমায়াতঃ গ্রামতো জম্বুচত্বরা॥
ই ধরাধরো বাৎস্যগোত্রস্তাড়িতগ্রামতঃ স্বয়ম্।
সুষেণঃ কাশ্যপো জ্ঞেয়ঃ কোলাঞ্চাৎ ত্বরয়াগতঃ॥
গৌতমাখ্যো ভরদ্বাজগোত্র ঔড়ম্বরাত্তথা।
পরাশরস্ত সাবর্ণো মদ্রগামাৎ সমাগতঃ॥”
(বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস, ব্রাহ্মণকাণ্ড, ১০৬ পৃষ্ঠার পাদটীকা)
উপরে উল্লেখিত ‘বারেন্দ্রকুলপঞ্জিকা’র শ্লোকে যে কোলাঞ্চের উল্লেখ করা হয়েছে, সেটা সম্ভবতঃ ‘করঞ্জ’ হবে। কারণ, ১৪১৫ শকে (“শরবিধুমনুভিঃ শকস্য বর্ষে”) অর্থাৎ ১৪৯৩ সালে, ‘করঞ্জগাঞি’ ‘চতুর্ভুজ ভট্টাচার্য’ লিখিত ‘হরিচরিত কাব্যে’ দেখতে পাওয়া যায় যে, ‘স্বর্ণরেখ’ নামের এক ‘বিপ্র’ (বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ) রাজা ‘ধর্মপালের’ কাছ থেকে ‘বারেন্দ্রে করঞ্জ’ নামের গ্রামটি পেয়েছিলেন। এই স্বর্ণরেখের বংশে ‘ভুন্দু’ জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ভুন্দুর পুত্র ছিলেন ‘দিবাকর আচার্য’। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, ‘বারেন্দ্র কাশ্যপ গোত্রের’ আদি গাঞি হল ‘করঞ্জ’ (Catalogue of Nepal Mss No 1608 ছ)। বারেন্দ্র কুলজী গ্রন্থে দেখা যায় যে, স্বর্ণরেখের পৌত্র ছিলেন ‘কৈতাই’ (ভাদুড়ি গাঞি) এবং ‘মৈতাই’ (মৈত্র গাঞি); তাঁরা ছিলেন প্রথম ‘বল্লালী কুলীন’। এবং ‘কৈতাই ভাদুড়ি’র পৌত্র ছিলেন ‘ভল্লু’ (হরিচরিতের ভুন্দু)। ভল্লুর পুত্র ছিলেন ‘যোগেশ্বর ভাদুড়ি’ ও ‘দিবাকর করঞ্জ’। সুতরাং কুলজী মতে ‘ভাদুড়ি গাঞি’ই আদি এবং সেটা থেকেই ‘করঞ্জ গাঞি’র উৎপত্তি ঘটেছে। গবেষকদের কিন্তু হরিচরিতের কথা অর্থাৎ – ‘করঞ্জ গাঞি’ই ‘কাশ্যপ গোত্রীয় বারেন্দ্র ব্রাহ্মণদের আদি গাঞি’ – এটা বেশি বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয়। তবে ‘স্বর্ণরেখ’ কি তাঁহার পূর্বপুরুষ ‘স্বর্ণক’ ওই গ্রাম পেয়েছিলে, সেই বিষয়ে গবেষকরা সন্দেহ প্রকাশ করে থাকেন। কারণ, বল্লালসেনের সমসাময়িক ‘কৈতাই ভাদুড়ি’র পিতামহ ‘স্বর্ণরেখ’ কখনই ধর্মপালের সমসাময়িক হতে পারেন না। রাঢ়ীয় প্রাচীন কুলগ্রন্থকর্তা ‘হরিমিশ্র’ লিখেছিলেন যে, কাশ্যপ গোত্রে ‘কৃষ্ণমিশ্র’ জন্মগ্রহণ করেছিলেন, তাঁর পুত্র ছিলেন ‘তমিস্র’, তাঁর পুত্র ছিলেন ‘ওঙ্কার’, তাঁর পুত্র ছিলেন ‘স্বর্ণক’ আর তাঁর পুত্র ছিলেন ‘বীতরাগ’, তিনিই গৌড়মণ্ডলে গিয়েছিলেন। তাঁর পুত্রদের নাম ছিল – ‘দক্ষ’, ‘সুষেণ’ ও ‘কৃপানিধি’ (রাঢ়ীয় ব্রাহ্মণ কাণ্ড)। ‘দক্ষ’ ছিলেন রাঢ়ীয় ব্রাহ্মণদের এবং ‘সুষেণ’ ছিলেন বারেন্দ্রদের পূর্বপুরুষ। ‘বারেন্দ্রকুলপঞ্জিকা’ প্রণেতা ‘চতুর্ভুজ’ সম্ভবতঃ এই ‘স্বর্ণক’ এবং ‘স্বর্ণরেখ’-এ গোলমাল করে ফেলেছিলেন। ‘স্বর্ণক’ থেকে ‘কৈতাই ভাদুড়ি’ পর্যন্ত ত্রয়োদশ পুরুষ হয়। বল্লালসেনের রাজ্যারম্ভ হয়েছিল ১০৮২ শকে বা ইংরেজি ১১৬০ সালে। আর ধর্মপালের রাজ্যারম্ভ হয়েছিল ইংরেজি ৭৬০ সালে। দু’জনের মধ্যে ৪০০ বছরের পার্থক্য। তিন পুরুষে একশো বছর ধরলে ‘স্বর্ণক’ কিন্তু ধর্মপালের সমকালবর্তী হন। শ্লোকের প্রথম লাইনে ‘শাণ্ডিল্য’ ‘নারায়ণ’ ‘জম্বুচত্বর’ গ্রাম থেকে এসেছিলেন বলে লেখা হয়েছে। এটাও সম্ভবতঃ ঠিক নয়। কারণ ‘তৃতীয় বিগ্রহপালের’ ‘আমগাছিশাসনে’ দেখতে পাওয়া যায় যে, ‘শাণ্ডিল্যগোত্রীয়’ ‘খোদুল শর্মা’র পূর্বপুরুষরা ‘ক্রোড়ঞি’ (কোলাঞ্চ) থেকে এসে ‘মৎস্যাবাস’ গ্রামবাসী হয়েছিলেন। সেখান থেকে তাঁরা ‘ছত্র গ্রামে’ বাস স্থাপন করেছিলেন। ‘মৎস্যাবাস’ বা ‘মৎস্যাসী’ হল বারেন্দ্র ব্রাহ্মণদের শাণ্ডিল্য গোত্রের অন্যতম গাঞি। প্রকৃতপক্ষে গবেষকরা প্রাচীন লিপির যত জায়গায় ‘কোলাঞ্চ ব্রাহ্মণের’ উল্লেখ পেয়েছেন, তাঁরা সকলেই ‘শাণ্ডিল্যগোত্রীয়’। আবার বারেন্দ্র কুলপঞ্জীতে লেখা হয়েছে যে, ‘ভট্টনারায়ণ’ কোলাঞ্চ দেশ থেকে আগমন করেছিলেন। তাঁর পুত্র ‘আদিগাঞি’ নামক ‘বিপ্র’ (বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ) রাজা ‘ধর্মপালের’ কাছ থেকে যজ্ঞের দক্ষিণাস্বরূপ ‘ধামসা’র গ্রাম পেয়েছিলেন (বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ কাণ্ড)। ‘জম্মু’ শাণ্ডিল্য গোত্রীয়দের অন্যতম গাঞি। এই ‘জম্বু’ ও ‘জম্বুচত্বর’ সম্ভবতঃ একই জায়গা বলে গবেষকরা মনে করেন এবং খুব সম্ভবতঃ, এই ‘জম্বুচত্বর’ – ‘দামোদরপুরের তাম্রশাসনে’ উল্লিখিত ‘জম্বুনদী’র তীরে অবস্থিত ছিল। শাণ্ডিল্য গোত্রের প্রথম বল্লালী কুলীন ‘পীতাম্বর’ (লাহেড়ি গাঞি) ছিলেন, তাঁর পূর্বপুরুষ ‘আদিগাঞি’ থেকে ত্রয়োদশ পুরুষ। সুতরাং এই ‘আদিগাঞি’ও ‘কাশ্যপগোত্রীয়’ ‘স্বর্ণকের’ মত ধর্মপালের সমসাময়িক ছিলেন। তিনিই প্রথম গ্রাম দান পেয়েছিলেন বলেই সম্ভবতঃ তাঁর নাম ‘আদিগাঞি’ হয়ে গিয়েছিল। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, বারেন্দ্র ব্রাহ্মণদের ‘কাশ্যপ’ এবং ‘শাণ্ডিল্য’ গোত্রীয়দের মধ্যে প্রথম গ্রাম লাভ হয়েছিল মহারাজ ‘ধর্মপালের’ সময় থেকে। সুতরাং তাঁদের ‘আদিশূর’ ছিলেন ‘মহারাজ ধর্মপাল’। এর আগে তাঁরা কোলঞ্চবাসী ছিলেন। সেই কোলাঞ্চ গৌড়েই ছিল কিনা সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। তবে রাঢ়ী ব্রাহ্মণদের ‘আদিশূর’ বোধ হয় বিভিন্ন ব্যক্তি ছিলেন এবং তিনি রাঢ় প্রদেশের কোন রাজা ছিলেন। কারণ, সেই রাজা তাঁদের যে ‘পঞ্চ গ্রাম’ দান করেছিলেন, সেই গ্রামগুলি উত্তররাঢ়ের অন্তর্গত ছিল বলেই মনে হয়। সেই পঞ্চ গ্রামের নাম হল – ‘কামঠী’ বা ‘কামকোটী’, ‘ব্রহ্মপুরী’, ‘হরিপুর’, ‘কঙ্কগ্রাম’ ও ‘বটগ্রাম’ (রাঢ়ীয় ব্রাহ্মণ কাণ্ড)। এই ‘কঙ্কগ্রাম’ এবং ‘মুর্শিদাবাদ’ জেলার ‘কাঁগ্রাম’ একই জায়গা বলে গবেষকরা মনে করেন (পঞ্চপুষ্প, ফাল্গুন, ১৩৩৯ বঙ্গাব্দ, ৩৭০ পৃঃ)। আশ্চর্যের বিষয় হল যে, ‘বঙ্গজ কায়স্থ কুলজীগ্রন্থে’ ‘রাঢ়ীয় কায়স্থদের’ যে আটটি গ্রামের উল্লেখ পাওয়া যায়, সেগুলোর মধ্যেও তিনটি গ্রামের নাম হল – ‘হরিপুর’, ‘বটগ্রাম’ ও ‘কঙ্কগ্রাম’। রাঢ়ী ও বারেন্দ্র ব্রাহ্মণদের কতকগুলি গাঞি নামেও মিল দেখা যায়, যথা – ‘বাৎস্যগোত্রীয় ঘোষ গাঞি’। রাঢ়ীরা বলেন, ‘ঘোষ গাঞি’ রাঢ় দেশে, আবার বারেন্দ্রদের মতে সেটা বরেন্দ্র দেশে অবস্থিত।

এবারে প্রশ্ন হল, উভয় ব্রাহ্মণের কুলুজী গ্রন্থে যে ‘কোলাঞ্চ’র কথা বলা হয়েছে, সেটা আদতে কোথায় ছিল? ‘প্রাচ্যবিদ্যামহার্ণব’ ‘নগেন্দ্রনাথ বসু’ তাঁর ‘বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস’ গ্রন্থের ‘রাজন্যকাণ্ডে’ এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, “এ দেশে কোলাঞ্চ বলিলে সাধারণতঃ সকলেই কান্যকুব্জ মনে করিয়া থাকেন, কিন্তু প্রাচীন কোন সাহিত্যে, কোষগ্রন্থে অথবা শিলালিপি বা তাম্রশাসনে কান্যকুব্জের নামান্তর যে কোলাঞ্চ, সে প্রসঙ্গ আদৌ নাই। শব্দরত্নাবলী অভিধানে কোলাঞ্চ দেশবিশেষ বলিয়া লিখিত আছে, অথচ কান্যকুব্জের স্বতন্ত্র উল্লেখ ও তাহার পর্যায়, মহোদয়, কান্যকুব্জ, গাধিপুর, কৌশ ও কুশস্থলের উল্লেখ থাকিলেও ইহার মধ্যে কোলাঞ্চ শব্দই নাই। এরূপ স্থলে কোলাঞ্চ বলিলে কিরূপে কান্যকুব্জ স্বীকার করা যায়? বামন-শিবরাম-আপ্তে তাঁহার সংস্কৃত অভিধানে কোলাঞ্চের ‘name of a country of the Kalingas’ এইরূপ অর্থ করিয়াছেন। মণিয়র উইলিয়মস তাঁহার বৃহৎ সংস্কৃত ইংরাজি অভিধানে কোলাঞ্চ সম্বন্ধে লিখিয়াছেন – ‘Name of Kalinga (the Coromandel Coast from Cuttack to Madras); but according to some, this place is in Hindustan with Kanauj for its capital’, অর্থাৎ কোলাঞ্চ বলিলে কলিঙ্গদেশ, কটক হইতে মাদ্রাজ পর্যন্ত করমণ্ডল উপকূলভাগ বুঝায়, কিন্তু কাহারও কাহারও মতে উহা কনৌজ রাজধানী সমন্বিত হিন্দুস্থান মধ্যে অবস্থিত।” কোলাঞ্চ যে প্রদেশেই অবস্থিত হোক না কেন, দশম শতাব্দী ও তার পরবর্তীকালে সেটা যে ‘বেদজ্ঞ’ ‘সদ ব্রাহ্মণদের’ বাসস্থান বলে প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল, সেটার প্রমাণ প্রাচীন লিপিতেও পাওয়া যায়। কোলাঞ্চ থেকে ব্রাহ্মণরা যে কেবলমাত্র বঙ্গদেশে এসেছিলেন, তা নয়; ‘বিহার’, ‘উড়িষ্যা’ ও ‘আসাম’ প্রদেশেও তাঁরা সেখানকার শাসকদের দ্বারা ভূমিদানে সম্মানিত হয়ে উপনিবিষ্ট হয়েছিলেন। অতীতে ‘উড়িষ্যা’র ‘ঢেঙ্কানলে’ দশম শতাব্দীর অক্ষরে লেখা ‘শুল্কী-বংশীয়’ ‘পঞ্চমহাশব্দ’ সমধিগত মহারাজাধিরাজ ‘জয়স্তম্ভদেবের’ একটি ‘তাম্রশাসন’ পাওয়া গিয়েছিল। তাতে দেখা যায় যে, ‘জয়স্তম্ভদেব’ গোইল্লবিষয়ান্তঃপাতি কোদালকমণ্ডলে কঙ্কুলখণ্ডে ‘চন্দ্রপুর’ নামের একটি গ্রাম – কোলাঞ্চবিনির্গত, ‘শাণ্ডিল্যগোত্র’ আসিতদৈবলপ্রবর, ছন্দোগচরণ কৌথুমশাখাধ্যায়ী ত্রৈবিদ্যসামান্য ভটপুত্র ‘নির্বাণের’ পৌত্র, ‘খম্ভের পুত্র’ ‘বাবন’কে দান করেছিলেন। ওই কোলাঞ্চ প্রসঙ্গে ‘মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী’ লিখেছিলেন, “বঙ্গদেশের কুলজীগ্রন্থে মহারাজ আদিশূর কর্তৃক কোলাঞ্চ হইতে বেদজ্ঞ আনয়নের কথা আছে। ইহার পূর্বে কোন প্রাচীন লিপিতে কোলাঞ্চের উল্লেখ পাওয়া যায় নাই। এই স্থানের অবস্থান অনিশ্চিত। এ সম্বন্ধে বহু মতবাদ আছে, কিন্তু কোনটিই বিশ্বাসযোগ্য নহে।” বিহারের ‘লাহিরিয়া সরাই’ শহরের ছয় মাইল পশ্চিমে ‘পাঁচোভ’ নামের জায়গায়, ‘মহারাজাধিরাজ পরমেশ্বর মহামাণ্ডলিক’ ‘শ্রীমৎ সংগ্রামগুপ্তের’ একটি ‘তাম্রশাসন’ পাওয়া গিয়েছিল। তাতেও কোলাঞ্চ থেকে আগত ব্রাহ্মণদের উল্লেখ পাওয়া যায়। গবেষকদের মতে ওই তাম্রশাসনের অক্ষরগুলো ‘বিজয়সেনের দেওপাড়া-প্রশক্তি’র অক্ষরের মতন, সুতরাং ওই তাম্রশাসনটিকে দ্বাদশ শতাব্দীর বলা যেতে পারে। ওই তাম্রশাসনে লেখা ছিল যে, ‘সংগ্রামগুপ্ত’ ‘শাণ্ডিল্যাসিতদৈবলপ্রবর’, কোলাঞ্চবিনির্গত, ভট্ট শ্রীরামের পৌত্র, ‘ভট্ট শ্রীকৃষ্ণাদিত্যের’ পুত্র যজুর্বেদবিদুষ আয়ুয্য ‘বটুকভট্ট শ্রীকুমারস্বামিশর্মা’কে ভূমি দান করেছিলেন। ওই তাম্রশাসনের প্রাপ্তিস্থান থেকে প্রায় এক মাইল পূর্ব দিকে, ‘বঙ্গালিডিহি’ নামে একটি উচ্চ জায়গা আছে। ‘পাঁচোভ’ মৌজার এক মাইল পূর্বেও ঐ ধরণের আরো একটি জায়গা আছে। ওই ‘বঙ্গালিডিহি’ – বাঙালি উপনিবেশকে সূচনা করে। সম্ভবতঃ, সংগ্রামগুপ্তের তাম্রশাসনে উল্লেখিত কোলাঞ্চ থেকে আগত ব্রাহ্মণরা বাঙালি ছিলেন। তাঁদের অতীতের বাসস্থানই ‘বঙ্গালিডিহি’ নামে পরিচিত হয়েছিল। ঐতিহাসিকদের এই ধরণের সন্দেহ করবার যথেষ্ট কারণ আছে, সেই প্রসঙ্গে পরে আসা যাবে। আবার বঙ্গের পালরাজবংশীয় ‘তৃতীয় বিগ্রহপালদেবের’ রাজত্বের দ্বাদশ বর্ষে লিখিত ‘আমগাছি তাম্রশাসনে’ দেখতে পাওয়া যায় যে – ‘বিগ্রহপালদেব’, ‘শাণ্ডিল্যগোত্র’ শাণ্ডিল্যাসিতদৈবলপ্রবর হরিসব্রহ্মচারী, সামবেদী, কৌথুমশাখাধ্যায়ী, মীমাংসা-ব্যাকরণ-তর্কবিদ্যাবিৎ, ‘ক্রোড়াঞ্চি’ বিনির্গত – মৎস্যাবাসবিনির্গত, ছত্রাগাম-বাস্তব্য, বেদান্তবিৎ, ‘পদ্মাবনদেবপৌত্র’, ‘মহোপাধ্যায় অর্কদেবপুত্র’ ‘খোদুলশর্মা’কে শ্রীপুণ্ড্রবৰ্দ্ধন ভুক্তিতে, কোটিবর্ষবিষয়ান্তঃপাতি ব্রাহ্মণীমণ্ডলে ‘বিষমপুর’ গ্রামের অংশ দান করেছিলেন। ওই জায়গায় ‘ক্রোড়ঞ্চি’ ও ‘কোলাঞ্চ’ – এক জায়গা বলেই গবেষকদের মনে হয়। ‘ক্রোড়’ শব্দকে প্রচলিত বঙ্গভাষায় ‘কোল’ বলা হয়। সংস্কৃতেও ‘ক্রোড়’ বা ‘কোল’ – সমানার্থবাচক শব্দ। বারেন্দ্র ব্রাহ্মণদের শাণ্ডিল্যগোত্রের অন্যতম গাঞি হল – ‘মৎস্যাস’’। ‘মৎস্যাবাস’ ও ‘মৎস্যাসী’ও এক। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, ‘খোদুলশর্মা’র পূর্বপুরুষরা, ‘ক্রোড়ঞ্চি’ বা ‘কোলাঞ্চ’ থেকে ‘মৎস্যাবাস’ বা ‘মৎস্যাসী’ এবং সেখান থেকে ‘ছত্রাগ্রামে’ গিয়ে বসতি স্থাপন করেছিলেন। অধুনা বাংলাদেশের ‘বগুড়া’ জেলার ‘ক্ষেতলাল’ থানায় ‘ছত্রগ্রাম’ নামে একটি জায়গা আছে। আবার ওই একই জেলার ‘শিবগঞ্জ’ থানায় ‘ছত্র’ নামের একটি গ্রাম আছে। তাই তাম্রশাসনে ‘খোদুলশর্মা’ যে বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ ছিলেন, সেটা নিশ্চয় করেই বলা যেতে পারে। ঐতিহাসিকেরা ‘তৃতীয় বিগ্রহপালের’ রাজ্যকাল, একাদশ শতাব্দীর তৃতীয় পাদে ছিল বলে অনুমান করে থাকেন। উপরে এখনো পর্যন্ত যে তিনটে তাম্রশাসনের কথা আলোচনা করা হয়েছে, সেগুলোতে কোলাঞ্চের উল্লেখ পাওয়া গেলেও, সেটার অবস্থান কোথায় ছিল – সেই বিষয়ে কোন তথ্য পাওয়া যায় না। কিন্তু আর একটি তাম্রশাসন অবশ্য উল্লেখ্য, যেটার সাহায্যে কোলাঞ্চ কোথায় ছিল – এই বিষয়ে কিছুটা আলোকপাত করা যেতে পারে। ‘কামরূপরাজ ধর্মপালের’ তৃতীয় অব্দের ‘শুভঙ্করপাটক তাম্রশাসনে’ লেখা হয়েছিল – “শ্রাবস্তীতে ক্রোসঞ্জ নামে একটি গ্রাম আছে – তাহাতে কলির পাপ, যাজ্ঞিকগণের হোমধূমে অন্ধ (হওয়াতে) প্রবেশ করিতে পারে নাই॥ (১৬) সেই গ্রামে সমুৎপন্ন ব্রাহ্মণদিগের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি উদারধী কৌথুমশাখী (ব্রাহ্মণদের) প্রধান সামবেদজ্ঞদের মধ্যে অখণ্ডনীয় (প্রভাববান্) রামসদৃশ রামদেব জাত হইয়াছিলেন।” (১৭) (কামরূপশাসনাবলী, নগেন্দ্রনাথ বসু অনূদিত) ওই তাম্রশাসনের সঙ্কলয়িতা ‘পদ্মনাথ ভট্টাচার্য’, ওই গ্রামের নাম ‘ক্রোসঞ্জ’ পাঠ করেছিলেন। গবেষকদের মতে, প্রকৃত পাঠ ‘ক্রোড়াঞ্চ’ হবে। বর্তমানে সেই তাম্রশাসনটি, কলিকাতা জাদুঘরের আর্কিওলজিক্যাল বিভাগে সংরক্ষিত রয়েছে। তাই ‘ক্রোড়াঞ্জ’ ও ‘কোলাঞ্জ’ বা ‘কোলাঞ্চ’ যে একই জায়গা – সেই বিষয়ে ঐতিহাসিকেরা একমত। ঐতিহাসিকেরা ওই তাম্রশাসনের ‘ধর্মপাল’কে দ্বাদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগের লোক বলে মনে করেন। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে ‘কোলাঞ্চ’ মোটেও ‘কান্যকুব্জ’ বা ‘কনৌজ’ নয়। কেউ হয়ত বলবেন যে, ‘কোলাঞ্চ’ ‘কান্যকুব্জ’ না হোক, ওই প্রদেশের অন্তর্গত কোন জায়গা হতে পারে। আজ পর্যন্ত কিন্তু এমন কোন প্রমাণ পাওয়া যায় নি যে, কান্যকুব্জ প্রদেশে কোলাঞ্চ নামের কোন জায়গা ছিল বা আছে। ‘আপ্তে’ ও ‘মণিয়র উইলিয়মস’ লিখেছিলেন যে, কোলাঞ্চ ‘কলিঙ্গের’ একটি নাম। সম্ভবতঃ তাঁরাও ‘কোলাঞ্চ’ ও ‘কোলাঞ্চল’ বা ‘কোলাচল’কে এক মনে করে ঐ ধরণের কথা লিখেছিলেন। যদি ধরে নেওয়া যায় যে, কোলাঞ্চ কলিঙ্গের অন্য নাম, তাহলেও স্বীকার করতে হয় যে, কলিঙ্গ সুপ্রসিদ্ধ এবং কোলাঞ্চ অপ্রসিদ্ধ নাম। ব্রাহ্মণরা তাঁদের অতীতের ‘কুলস্থান’ নির্দেশ করতে গিয়ে, কেন যে সর্বজনবিদিত ‘কলিঙ্গ’ নাম ছেড়ে, অপরিচিত কোলাঞ্চ নামই বার বার উল্লেখ করেছিলেন, সেটার কোন প্রকৃষ্ট কারণ তো খুঁজে পাওয়া যায় না। কোলাঞ্চ কলিঙ্গ প্রদেশের কোন জায়গা বলে গ্রহণ করা চলে না। কেন না, প্রমাণাভাব। আর ‘আপ্তে’ কিংবা ‘মণিয়র উইলিয়মস’ও সেটা বলেননি। ‘মণিয়র উইলিয়মস’ প্রদত্ত দ্বিতীয় অর্থের মূলে যে বঙ্গের প্রচলিত প্রবাদ রয়েছে, সে বিষয়ে সন্দেহ করবার কোনও কারণ দেখা যায় না। তাহলে কোলাঞ্চ যদি কান্যকুব্জ কিংবা কলিঙ্গ না হয়, তাহলে সেটা কোথায় ছিল? ঐতিহাসিকেরা ‘কামরূপ’ ‘ধর্মপালের’ ‘শুভঙ্করপাটক তাম্রশাসনে’ পেয়েছিলেন – “গ্রামঃ ক্রোড়াঞ্চনামাস্তি শ্রাবস্ত্যাং যত্র যজুনাং। হোমধূমান্ধকারান্ধং নাবিশৎ কলিকল্মষং॥” অৰ্থাৎ, ‘শ্রাবস্তী’তে ‘ক্রোড়াঞ্চ’ নামের একটি গ্রাম আছে, যাতে কলির পাপ, যাজ্ঞিকগণের হোমধূমান্ধকার দ্বারা অন্ধ হয়ে প্রবেশ করতে পারেনি। এখন দেখা যাক যে, এই ‘শ্রাবস্তী’ কোথায় ছিল। ‘শ্রাবস্তী’ শুনলেই অনেকে ‘অযোধ্যা’ প্রদেশের প্রসিদ্ধনামা ‘শ্রাবস্তী’কে মনে করেন। এই আন্দাজ ঠিক নয়। প্রাচীনকালে ওই শ্রাবস্তী ছিল বৌদ্ধপ্রধান এবং বৌদ্ধ সাহিত্যেই সেটার বহুল উল্লেখ পাওয়া যায়। আর তাম্রশাসনে যে শ্রাবস্তীর কথা বলা হচ্ছে, সেটা ছিল ব্রাহ্মণ-প্রধান এবং ব্রাহ্মণদের কুলস্থান। তাম্রশাসনের শ্রাবস্তীর বর্ণনায় হোমধূমের প্রাচুর্য দেখতে পাওয়া যায়। সেটা নিশ্চয়ই বৌদ্ধপ্রাধান্যের পরিচয় দেয় না। ওই ‘ধর্মপালের’ প্রপিতামহ ‘ইন্দ্রপালের’ ‘গুয়াকুচি তাম্রশাসনে’ও ঐতিহাসিকেরা ‘শ্রাবস্তী’র (সাবথি) উল্লেখ পেয়েছিলেন। যথা – “সাবথ্যামক্তি বৈনামা গ্রামো ধাম দ্বিজন্মনাং। ধর্মস্যাধর্মভীতস্য দুর্গলভনিভঃ কলৌ॥” অর্থাৎ, ‘সাবথি’তে দ্বিজদের বাসভূমি ‘বৈ’ নামক একটি গ্রাম আছে – কলিকালে সেটা অধর্মভীত ধর্মের সমাশ্রিত দুর্গসদৃশ। ‘ইন্দ্রপাল’ ওই বৈগ্রামের ‘কাঘশাখী’, ‘যজুর্বেদী’, ‘কাশ্যপগোত্রজ’, সাক্ষাৎ ব্রহ্মার সদৃশ পুণ্যাত্মা, ‘সোমদেবের পৌত্র’, ‘বসুদেবের পুত্র’ শ্রীমান ‘দেবদেব’ নামের এক ব্রাহ্মণকে ভূমি দান করেছিলেন। সেখানেও ব্রাহ্মণ প্রাধান্য ও ব্রাহ্মণের কুলস্থানের বর্ণনা পাওয়া যায়। ঐতিহাসিকেরা ওই শ্রাবস্তীর উল্লেখ সপ্তম শতাব্দীর আগে পর্যন্ত কোথাও পাননি, আর বৌদ্ধদের শ্রাবস্তী বহু প্রাচীন। সুতরাং এই উভয় শ্রাবস্তী কখনই এক জায়গা হতে পারে না। এই ‘শ্রাবস্তী’ ও ‘সাবথি’ যে একই জায়গা, সেই সম্বন্ধে ঐতিহাসিকদের কোন সন্দেহ নেই, যদিও ‘পদ্মনাথ ভট্টাচার্য’ উভয়কে বিভিন্ন স্থান বলে প্রতিপন্ন করতে চেষ্টা করেছিলেন। তিনি ওই দুটো জায়গাকে ‘কামরূপের’ অন্তর্গত বলে যুক্তিতর্কের অবতারণা করেছিলেন। পরে বাধ্য হয়ে কেবলমাত্র শ্রাবস্তীকে কামরূপের প্রান্তে বঙ্গের মধ্যে বলে স্বীকার করে নিয়েছিলেন। তাঁর মতে ‘সাবথি’ ছিল আলাদা জায়গা এবং সেটার অবস্থান ছিল কামরূপে। যদিও ঐতিহাসিকেরা পরে দেখেছিলেন যে, উভয় জায়গাই এক এবং দুটোই উত্তরবঙ্গে অবস্থিত ছিল। আসলে তাম্রশাসনের ব্রাহ্মণ-প্রধান শ্রাবস্তীর অবস্থান ছিল প্রাচীন বঙ্গদেশের গৌড়ে। সেই শ্রাবস্তীর অন্তর্গত ‘তর্কারি’ নামের জায়গা – ব্রাহ্মণ ও কায়স্থদের কুলস্থান ছিল। ওই ‘তর্কারি’র বর্ণনাতেও ‘বেদস্মৃতি’র আলোচনা ও ‘হোমধূমের’ কথা পাওয়া যায়; যথা –
“যেষাং তস্য হিরণ্যগর্ভবপুযঃ স্বাঙ্গপ্রসূতাঙ্গিরোবংশে জন্ম সমানগোত্রবচনোৎকর্ষো ভরদ্বাজতঃ।
তেষামাৰ্য্যজনাভিপূজিতকুলং তর্কারিরিত্যাখ্যয়া শ্রাবস্তী প্রতিবদ্ধমক্তি বিদিতং স্থানং পুনর্জনানাং॥২
যস্মিন্ বেদস্মৃতিপরিচয়োদ্ভিন্নবৈতানগার্হ্যপ্রাজ্যাবৃত্তাহুতিযু চরতাং কীর্তিভির্বোন্নি শুভ্রে।
ব্যাভ্রাজত্তো পরিপরিসরস্হোমধূমা দ্বিজানাং দুগ্ধান্তোধিপ্রস্তবিলসচ্ছৈবালালীচয়াভাঃ॥৩
তৎপ্রসূতশ্চ পুণ্ড্রেষু সকটীব্যবধীনবান্।
বরেন্দ্রীমণ্ডনং গ্রামো বালগ্রাম ইতি শ্ৰুতঃ॥৪
ষট্‌ত্রিংশতঃ করণকর্মনিবাসপূতা আসন্ পুরঃ পরমসৌখ্যগুণাতিরিক্তাঃ।
তন্মধ্যগা বিবুধলোকমতা বরিষ্ঠা টক্কারিকা সমজনি স্পৃহণীয়কল্পা॥২॥
সর্বোপকারকরণৈকনিধেঃ স্বকীয়বংশস্য পাত্রসুভগস্য দ্বিজাশ্রয়স্য।
কল্পাবসানসময়স্থিতয়ে পুরীং যাং বাস্তঃ স্বয়ং সমধিগম্য সমাসসাদ॥৩॥
তস্যাং শ্রুতের্মিনদশঙ্খনিনাদিতায়াং বাস্তব্যবংশভবিনঙ্করণাস্ত আসন্।
আশাঃ সমস্তভুবনানি যদীয়কীর্তা পূর্ণানি হংসধবলানি বিশেষয়ন্ত্যা ॥৪॥”
এই বর্ণনা-সাদৃশ্য দেখে, কামরূপশাসনদ্বয়ে উল্লিখিত ‘শ্রাবস্তী’ এবং ‘সিলিমপুর-প্রশক্তি’র ‘শ্রাবস্তী’কে ঐতিহাসিকদের এক বলেই মনে হয়। শ্রাবস্তীর অন্তর্গত গ্রামগুলি থেকে ব্রাহ্মণ গমনের কথা, আরো কয়েকটি লিপিতে পাওয়া গিয়েছিল। এগুলো থেকে মনে হয় যে, প্রাচীন গৌড়ে শ্রাবস্তী নামের যে কেবলমাত্র একটি নগর ছিল, তা নয়; অতীতে ঐ নামে একটি দেশও ছিল। ‘অজয়গড় লিপি’তে দেখা যায় যে, ছত্রিশটি গ্রাম দ্বিজাশ্রয় কায়স্থদের বসে পবিত্র হয়েছিল। বলা বাহুল্য যে, ওই গ্রামগুলোতে কিন্তু ব্রাহ্মণরাও বাস করতেন। ‘প্রথম রণভঞ্জদেবের’ অষ্টপঞ্চাশতম বর্ষের বৌধলিপি – ‘সাবথি’র (শ্রাবস্তী) অন্তর্গত তকারিবিনির্গত ভরদ্বাজগোত্রীয় কাণ্বশাখাধ্যায়ী যজুর্বেদচরণ ‘শুভদাম’ নামক ব্রাহ্মণকে প্রদত্ত হয়েছিল। ‘গয়াড়তুঙ্গদেবের তালচরলিপি’ – বরেন্দ্রমণ্ডলে মুখরুথভট্টগ্রামরিনির্গত ওড্রবিষয়ে সাবিরভটগ্রামবাস্তব্য কাশ্যপগোত্র আবৎসার-নৈধ্রুবপ্রবর যজুর্বেদচরণকণ্বশাখাধ্যায়ী পদমপুত্র ‘দেবশর্মা’কে ও ‘সাবিথি’ (শ্রাবস্তী) বিনির্গত যমগর্ভমণ্ডলবাস্তব্য বৎসগোত্রপঞ্চার্ষেয়প্রবর যজুর্বেদচরণ কণ্বশাখাধ্যায়ী লম্বরসুত ‘বৃষ্টিদেব’ ও তাঁর পুত্র ‘রামদেব’কে প্রদত্ত হয়েছিল। ‘বিনীততুঙ্গদেবের তালচরলিপি’ – পুণ্ড্রবর্ধনবিনির্গত ও শ্রাবস্তীবনির্গত ব্রাহ্মণদেরকে প্রদত্ত হয়েছিল। ‘মহাশিবগুপ্ত যযাতির পাটনা-শাসন’ – শ্রাবস্তীমণ্ডলান্তর্গত কাশিলিবিনির্গত গৌতম (কৌথুম?) চরম কৌশিকগোত্রীয় ‘মহোদধি’ নামক ব্রাহ্মণকে প্রদত্ত হয়েছিল। ‘দ্বিতীয় মহাভবগুপ্তের কটকশাসন’ – শ্রাবস্তীমণ্ডলান্তর্গত কাশিল্লিগ্রামবিনির্গত সামবেদ কৌথুমচরণ কৌশিকগোত্র ‘রাণকরচ্ছো’কে ‘গৌড়সিমিনিল্লি’ নামক গ্রাম প্রদত্ত হয়েছিল। এই জায়গায় প্রদত্ত গ্রামের আগে ‘গৌড়’ বিশেষণ বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। ‘কুমারাধিরাজ সোমেশ্বরদেবের শোণপুর শাসন’ – সাবখি (শ্রাবস্তী) মণ্ডলান্তৰ্গত মহুবালিগ্রামবিনির্গত ভট্টপুত্র ‘উদয়কর শর্মা’কে প্রদত্ত হয়েছিল। ‘প্রতিহাররাজ মহেন্দ্রপালের ৯৫৫ সম্বতে প্রদত্ত দিঘোয়া-দুবৌলি শাসন’ – শ্রাবস্তী ভুক্তিতে শ্রাবস্তীমণ্ডলান্তঃপাতি বালয়িকবিষয়সম্বন্ধ পানীয়ক গ্রাম সাবর্ণগোত্রীয় কৌথুমশাখী ছান্দোগব্রহ্মচারী ‘পদ্মসার’কে প্রদত্ত হয়েছিল। ‘কীর্তিপালের লখনউ মিউজিয়াম-শাসন’ – শ্রাবস্তীবিষয়ান্তঃপাতি ডবিরামগ্রামকুলোৎপন্ন, – গৌতমগোত্রীয় পণ্ডিত শ্রীকেশবের পৌত্র, পণ্ডিত শ্রীবিশ্বরূপের পুত্র, ‘ঠক্কুর শ্রীপ্রহসিতশর্মা’ নামক ব্রাহ্মণকে প্রদত্ত হয়েছিল। ‘কান্যকুজের মহারাজপুত্র গোবিন্দ্রচন্দ্রদেবের ১১৬২ সম্বতে (১১০৫ খ্রিঃ) প্রদত্ত শাসন’ – সাবিথদেশবিনির্গত বাজসনেয়শাখী বংধুল গোত্র বধুল অঘমর্ষণ বিশ্বামিত্র ত্রিপ্রবর দীক্ষিত নাগানদ (নন্দ?) পৌত্র, দীক্ষিত পুরবাসপুত্র যজুর্বেদবিদ্যানলিনীবিকাসন প্রত্যক্ষ ‘ভাস্কর দীক্ষিত বীহলক’কে প্রদত্ত হয়েছিল। ‘মহারাজ হর্ষবর্ধনের মধুবন-শাসন’ – শ্রাবস্তীভুক্তিতে কুণ্ডধানীবিষয়ান্তঃপাতি সোম কুণ্ডিকা গ্রাম, সাবর্ণিগোত্র চ্ছন্দোগব্রহ্মচারী ভট্টবাতস্বামী ও বিষ্ণুবৃদ্ধগোত্র বহবব্রহ্মচারী ‘শিবদেব স্বামী’কে প্রদত্ত হয়েছিল। এখানে উল্লেখিত লিপিগুলোতে ‘কোলাঞ্চ’ ছাড়া শ্রাবস্তীর অন্তর্গত আরও কতগুলি গ্রামের উল্লেখ পাওয়া যাচ্ছে। এবারে দেখা যাক, বঙ্গদেশে এই সব গ্রামের সন্ধান পাওয়া যায় কি না।
(১) ‘ক্রোড়ঞ্চি’, ‘ক্রোড়াঞ্জ’ ও ‘কোলাঞ্চ’: এই তিনটিই যে এক গ্রাম, সেটা আগেই বলা হয়েছে। অধুনা বাংলাদেশের ‘বগুড়া’ জেলার ‘পোলাদশী পরগণা’র ‘পাঁচবিবি থানা’র অন্তর্গত ‘কুলাচ’ নামের একটা গ্রাম আছে। অতীতের কোলাঞ্চই সম্ভবত ‘কুলাচে’ পরিণত হয়েছে। ব্রিটিশ শাসনাধীন অবিভক্ত ভারতের মানচিত্রে ওই গ্রামের নাম ‘Koolarch’ বলে লেখা হয়েছিল। পরে ওই গ্রামটি ‘কুলচ’ নাম ধারণ করেছিল। সম্ভবতঃ অর্থযুক্ত শুদ্ধ ভাষায় ‘কুলাচ’, ‘কুলর্চে’ পরিণত হয়েছিল। ‘কুলৰ্চ’ অর্থাৎ ‘পূজনীয়কুল’। যদিও এই পরিবর্তনের মূলেও কোন প্রকার প্রবাদ আছে কি না, সেটা অনুসন্ধানযোগ্য। কোলাঞ্চ প্রধানতঃ ‘শাণ্ডিল্য গোত্রের’ কুলস্থান। উল্লেখ্য, ঐতিহাসিক ‘প্রভাসচন্দ্র সেন’ একটি পত্রে ‘নগেন্দ্রনাথ বসু’কে জানিয়েছিলেন যে, “এই গ্রামকে সাধারণ লোকে ‘কুলোচ’ বলে। বর্তমান সময়ে এই গ্রামে মুসলমানের বাস। তবে এখানে ‘কালীর থান’ আছে। ঐ গ্রামে প্রাচীন চিহ্ন বিশেষ কিছুই নাই। পার্শ্ববর্তী বায়ারী গ্রামে প্রাচীন দিঘি ও ভগ্ন প্রস্তরমূর্তি আছে। যাহা হউক, কুলোচে যে হিন্দুর বাসস্থান ছিল, তাহার সাক্ষী ‘কালীর থান’। যাহা হউক, কুলোচে বর্তমান সময়ে প্রাচীনত্বের কোন নিদর্শন না পাইলেই যে ইহকে আধুনিক স্থান মনে করিতে হইবে, তাহার কোন কারণ নাই। শুনিতে পাই, বর্তমান সিলিমপুর গ্রামে প্রাচীন প্রস্তরলিপি এবং প্রস্তরনির্মিত বরাহমূর্তি পাওয়া গেলেও ঐ স্থান দেখিয়া উহাকে প্রাচীন গ্রাম বলিয়া মনে হয় না। প্রাচীন স্তূপ ইত্যাদি কৃষকগণ সমভূমিতে পরিণত করিয়া তথায় চাষ করিতেছে।”
(২) ‘তর্কারি’: এই গ্রামের অবস্থান সম্বন্ধে আজও কিছু জানা যায় না। ‘সিলিমপুর-প্রশস্তি’ লিখিত ওই গ্রামের কাছাকাছি অন্য দুটি গ্রামের (বালগ্রাম ও সিয়াম্বর) যখন সন্ধান পাওয়া যায়, তখন নিশ্চয়ই ‘তর্কারি’ – সিলিমপুরের কাছেই কোন জায়গায় ছিল। ‘বগুড়া’ জেলার থানা ‘আদমদিঘি’, ডাকঘর ‘সুলতানপুরের’ অন্তর্গত ‘টিকারি’ নামের একটা গ্রাম আছে, কিন্তু সেটাকে পৃথক গ্রাম বলেই গবেষকরা মনে করেন। ‘তর্কারি’ প্রধানতঃ ‘ভরদ্বাজ গোত্রের’ কুলস্থান।
(৩) ‘বৈগ্রাম’: বাংলাদেশের ‘দিনাজপুর’ জেলার ‘নবাবগঞ্জ’ থানায় ‘বৈগ্রাম’ নামে একটি গ্রাম আছে। সেটা ‘হিলি’ রেলওয়ে স্টেশনের খুব কাছে অবস্থিত। অতীতে, বৈগ্রাম থেকে গুপ্তযুগের একটা তাম্রশাসন আবিষ্কৃত হয়েছিল। গবেষকরা মনে করেন যে, দামোদরপুরে প্রাপ্ত তাম্রশাসনপঞ্চকের তৃতীয়সংখ্যক শাসনটিতে যে ‘বায়ীগ্রামের’ উল্লেখ পাওয়া যায়, সেটা ও এই ‘বৈগ্রাম’ অভিন্ন।
(৪) ‘কাশিলি’ ও ‘কাশিল্লি’: গবেষকরা এই দুটো গ্রামকে অভিন্ন বলে মনে করেন। ‘বগুড়া’ জেলার ‘পাঁচবিবি’ থানায় ‘কুশইল’ (Kushaila) নামের একটি গ্রাম আছে।
(৫) ‘মহুবালি’ গ্রাম: ‘বগুড়া’ জেলার ‘খেতলাল’ থানায় ‘মোয়াইল’ নামের একটা গ্রাম আছে। বারেন্দ্র ব্রাহ্মণদের ‘কাশ্যপ’ গোত্রের ‘মোয়ালি গাঞি’ সম্ভবতঃ ওই ‘মহুবালি’ গ্রাম থেকে উৎপন্ন হয়েছিল। কোন কোন প্রাচীন পুঁথিতে ‘মৌহালী’ নামও পাওয়া যায়।
(৬) ‘বালগ্রাম’: সিলিমপুর প্রশস্তিতে বালগ্রামের উল্লেখ পাওয়া যায়। ‘সিলিমপুরের’ কাছে ‘খেতলাল’ থানায় ‘বলিগ্রাম’ নামের একটা গ্রাম আছে। গবেষকদের মতে ওই ‘বলিগ্রাম’ বা ‘বেলগাঁও’ এবং ‘বালগ্রাম’ অভিন্ন।
(৭) ‘শিয়ম্বগ্রাম’: সিলিমপুর প্রশস্তিতে এই গ্রামের উল্লেখ পাওয়া যায়। ‘শিম্ব’ বা ‘শিম্বি’ – ‘ভরদ্বাজগোত্রীয়’ বারেন্দ্র ব্রাহ্মণদের একটি গাঞি। সিলিমপুরলিপি ভরদ্বাজগোত্রেীর ‘প্রহাস’ নামক এক ব্রাহ্মণের কুলপ্রশস্তি। ওই প্রহাসের বাড়ি ছিল শিয়ম্ব গ্রামে। গবেষকদের মতে, বর্তমান সিলিমপুরই প্রাচীন ‘শিয়ম্ব’ এবং ওই জায়গা থেকেই শিম্ব গাঞির উৎপত্তি ঘটেছিল।
(৮) ‘কুটুম্বপল্লী’: সিলিমপুর প্রশস্তিতে এই গ্রামেরও উল্লেখ পাওয়া যায়। ‘কুড়ুম্ব’ বা ‘কুড়মুড়ি’ – বারেন্দ্র ব্রাহ্মণদের ‘বাৎস্য’ গোত্রের একটি গাঞি এবং সেটার উৎপত্তি ঘটেছিল ওই ‘কুটুম্বপল্লী’ থেকে।
(৯) ‘বালয়িক বিষয়’: ‘রাজশাহী’ জেলার ‘বাগমারা’ ও ‘বরইগ্রাম’ থানায় ‘বালিয়া’ গ্রাম এবং ‘মান্দা’ থানায় মালসেরা
ডাকঘরের অধীন ‘বালিচ’ নামের গ্রাম আছে।
(১১) ‘পানীয়ক গ্রাম’: ‘রাজশাহী’ জেলার ‘বাগমারা’ ও ‘সিংরা’ থানায় ‘পানিয়া’ গ্রাম এবং ‘মান্দা’ থানায় ‘মালসেরা’ ডাকঘরের অধীনে ‘পানিয়াল’ গ্রাম আছে। ‘প্রতীহাররাজ মহেন্দ্রপালের দিঘোয়া-দুবৌলি শাসনে’ উপরোক্ত ‘বালয়িক বিষয়ান্তঃপাতি’ পানীয়ক গ্রামে এক ব্রাহ্মণকে জমি দান করা হয়েছিল। ওই শাসনটি ‘বিহারের’ ‘সারণ’ জেলার ‘দিঘোয়া-দুবৌলি’ গ্রামের এক ব্রাহ্মণের কাছ থেকে পাওয়া গিয়েছিল। আশ্চর্যের বিষয় হল, ‘রাজশাহী’ জেলার ‘চারঘাট’, ‘নগাঁও’ ও ‘পাঁচপুর’ থানায় ‘Atrai’ ডাকঘরের অধীনে ‘দীঘা’ গ্রাম, আবার ঐ ‘পাঁচপুর’ থানায় ঐ ডাকঘরের অধীনে এবং ‘মান্দা’ থানায় ‘মালসেরা’ ডাকঘরের অধীনে ‘দুবৈল’ নামের গ্রাম আছে। সম্ভবতঃ ওই দুই গ্রাম থেকে ব্রাহ্মণরা ‘সারণ’ জেলায় গিয়েছিলেন এবং ‘দিঘোয়া-দুবৌলি’ গ্রামটি স্থাপন করেছিলেন। তাঁদেরই পূর্বপুরুষরা ‘মহেন্দ্র পালের’ কাছ থেকে ‘পানীয়ক’ গ্রামটি লাভ করেছিলেন।
(১২) ‘ডবিরামকুল’: বগুড়া জেলার ‘আদমদিঘি’ থানায় ‘Darakul’ নামের একটি গ্রাম আছে। ‘কীর্তিপালের’ শাসনোক্ত ওই ‘ডবিরামকুল’ গ্রামোপন্ন ব্রাহ্মণের নাম ছিল – ‘ঠক্কুর প্রহসিতশর্মা’। বগুড়া খেতলাল থানার ‘মাথরাই’ বা ‘মাত্রাই’ গ্রামে ‘প্রহসিতশর্মা’ নামাঙ্কিত একটি ভগ্ন স্তম্ভলিপি পাওয়া গিয়েছিল।
(১৩) ‘কুণ্ডধানী বিষয়’: এর অবস্থান সম্বন্ধে কোন তথ্য পাওয়া যায়নি।
(১৪) ‘সোমকুণ্ডিকা’: রাজশাহী জেলার ‘বোয়ালিয়া’ থানায় ‘সোমইকুণ্ডি’ (Shomaikundi) নামের একটি গ্রাম আছে। ‘নগেন্দ্রনাথ বসু লিখেছিলেন, “রাজশাহী গিয়া সোমাইকুণ্ডি গ্রাম সম্বন্ধে অনুসন্ধান করিয়াছিলাম। ঐ জেলায় ‘কুণ্ডি’ বা ‘কুঁড়ি’ নামান্ত কয়েকটি গ্রাম থাকিলেও সোমাইকুণ্ডি গ্রামের সন্ধান পাওয়া গেল না। তবে শহরের নিকটে ‘সোনাইকান্দি’ নামে গ্রাম আছে।”
প্রাচীন গ্রন্থের স্থান নির্দেশ ঠিক হলে প্রমাণ হয় যে, হর্ষবর্ধনের সাম্রাজ্য ৬৩১ খ্রিস্টাব্দে গৌড় পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। ‘ভাস্করবর্মা’র ‘নিধনপুর তাম্রশাসন’ ‘কর্ণসুবর্ণ’ থেকে প্রদত্ত হয়েছিল। কেউ কেউ তা থেকে অনুমান করেন যে, শশাঙ্কের গৌড়রাজ্য হর্ষের জীবিতকালেই ভাস্করবর্মার হস্তগত হয়েছিল। কিন্তু কয়েকটি কারণে ঐতিহাসিকেরা এই মত গ্রহণ করতে পারেন না। শশাঙ্ক ছিলেন হর্ষের ‘ভ্রাতৃহন্তা’ ও প্রবলপরাক্রান্ত প্রতিদ্বন্দ্বী। যে রাজ্যবলে বলীয়ান হয়ে শশাঙ্ক ভারতের সার্বভৌম নরপতি হবার স্পর্ধা করেছিলেন, হর্ষ বহু কষ্টে সেই রাজ্য জয় করে তাঁহার ‘মিত্ররাজ’ ভাস্করবর্মাকে ছেড়ে দেবেন এবং সেটা করে তাঁকে নিজের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিরূপে পরিণত করবেন, এটা কখনই বিশ্বাসযোগ্য নয়। হর্ষবর্ধনের মত রাজনীতিবিশারদের এই ধরণের একটা প্রকাণ্ড ভুল করা সম্ভবপর ছিল না। জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা ‘রাজ্যবর্ধনের’ মৃত্যুসংবাদ শুনে মর্মাহত হয়ে হর্ষ প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে, তিনি পৃথিবীকে ‘নিগৌড়’ (গৌড় বিহীন) করবেন। তিনি সেই প্রতিজ্ঞা পালনকল্পে কি করেছিলেন, সেটা কেউই বলেন নি। তবে তিনি যে সেটা বৃথা গর্বোক্তিতে পর্যবসিত হতে দিয়েছিলেন, এই ধরণের কিছু মনে করবার কোন কারণ দেখা যায় না। গৌড় জয় দিয়েই ‘পৃথিবী নিগৌড়’ হয়ে যায় না। সম্ভবতঃ তিনি গৌড় জয় করে নিজের সাম্রাজ্যভুক্ত করেছিলেন এবং গৌড় নামটা লোপ করে দিয়ে, অন্য কোন নামকরণ করেছিলেন। সম্ভবতঃ তিনি গৌড়রাজ্যকে তাঁহর রাজ্যের পূর্বসীমান্তস্থিত ‘শ্রাবস্তীভুক্তি’র অন্তর্ভুক্ত করে দিয়ে গৌড় নামটা লোপ করে দিয়েছিলেন। হর্ষের ‘বাঁশখেরা শাসন’, ‘বর্ধমানকোটি’ থেকে প্রদত্ত হয়েছিল। এই ‘বর্ধমানকোটি’র অবস্থান কেউ নির্ণয় করেননি। বাংলাদেশের ‘রঙ্গপুর’ জেলায় ‘বর্ধনকোটি’ নামের একটি প্রাচীন জায়গা আছে। কিছু গবেষকের মতে সেই উভয় জায়গা এক হতে পারে। সপ্তম শতাব্দীর আগে বঙ্গের শ্রাবস্তীর উল্লেখ আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। হর্ষ যে শশাঙ্কের রাজ্য নিজের সাম্রাজ্যভুক্ত করেছিলেন, সেটার আরও প্রমাণ এই যে, তিনি ৬৪১ সালে চীনসম্রাটের কাছে যে বার্তা প্রেরণ করেছিলেন, তাতে তিনি নিজেকে ‘মগধেশ্বর’ বলে উল্লেখ করেছিলেন। তার আগে ‘মগধ’ যে শশাঙ্কের রাজ্যভুক্ত ছিল, সে বিষয়ে ঐতিহাসিকদের কোন সন্দেহ নেই। ‘রোটাসগড়ে’ প্রাপ্ত শশাঙ্কদেবের নামাঙ্কিত শীল এবং ‘বুদ্ধগয়া’য় তাঁর অবাধ অত্যাচারই সেটা প্রমাণ করে। তাহলে গবেষকদের উপরিউক্ত অনুমান যদি ঠিক হয়, তবে ‘কোলাঞ্চ’ কান্যকুব্জরাজ্যের তথা শ্রাবস্তীর অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়েছিল। সেক্ষেত্রে ব্রাহ্মণদের কান্যকুব্জ থেকে বঙ্গদেশে আগমনের ভিত্তি বোধ হয় এখানে। পালরাজারা পুনরায় ‘গৌড়’ নাম প্রবর্তন করেছিলেন। কিন্তু ‘প্রতীহাররাজ মহেন্দ্রপালের দিঘোয়া-দুবৌলি তাম্রশাসনে’ আবার ‘শ্রাবস্তীভুক্তি’ ও ‘শ্রাবস্তীমণ্ডলের’ উল্লেখ পাওয়া যায় এবং সেই শ্রাবস্তীমণ্ডলস্থ ‘পানীয়ক’ গ্রামের সন্ধানও ‘গৌড়মণ্ডলে’ই পাওয়া যায়। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, মহেন্দ্রপালের পুত্র ‘বিনায়কপালের’ ৯৩১ সালে প্রদত্ত শাসনোল্লিখিত জায়গাগুলিও গৌড়মণ্ডলেই পাওয়া যায়। ওই শাসন দ্বারা ‘প্রতিষ্ঠানভুক্তন্তঃপাতি বারাণসী বিষয়সম্বন্ধ-কাশীপার-পথক-প্রতিবদ্ধ টিক্করিকা গ্রাম’ দান করা হয়েছিল। ওই তাম্ৰশাসনটি ‘Bengal Asiatic Society’s Plate’ নামে পরিচিত। কিন্তু সেটি কোথা থেকে পাওয়া গিয়েছিল, সেটা জানা যায় না। ‘ক্লিট’ সাহেব ওই ‘টিক্করিকা’ ও ‘কাশী’র চার মাইল দক্ষিণে অবস্থিত বর্তমান ‘টিক্রি গ্রাম’কে একই বলে মনে করেছিলেন। কিন্তু ঐতিহাসিকেরা, ‘বগুড়া’ জেলার ‘পাঁচবিবি’ থানায় ‘বারাণসী’, এবং ঐ জেলার ‘আদমদিঘি’ থানায় ‘সুলতানপুর’ ডাকঘরের অধীনে ‘কাশীপাড়া’ (Kashipara) ও ‘টিকারী’ গ্রামের সন্ধান পেয়েছিলেন। ঐতিহাসিকদের এই অবস্থান নির্দেশ যদি ঠিক হয়, তবে দশম শতাব্দীর মধ্যভাগেও গৌড় প্রতীহারসাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। উপরে ব্রাহ্মণ-সম্বন্ধীয় যতগুলি শ্রাবস্তী পাওয়া গেছে, সেগুলোর কোনটি ‘ভুক্তি’, কোনটি ‘মণ্ডল’, কোনটি ‘বিষয়’, কোনটি ‘দেশ’ এবং কোনটি শুধুই ‘শ্রাবস্তী’। স্পষ্টভাবে শ্রাবস্তী নামের কোন নগরীর উল্লেখ ইতিহাসের কোথাও পাওয়া যায় না। শুধু শ্রাবস্তী, জনপদ কিংবা নগরী, এই উভয়ের কোন একটা হতে পারে। ওই ‘ব্রাহ্মণ-শ্রাবস্তী’ যে অতীতের বঙ্গদেশেই অবস্থিত ছিল, সেটা ‘বালগ্রাম’ (বালিগ্রাম), ‘শিয়ম্ব’ (শিলিমপুর), ‘মহুবালি’ (মোয়াইল), ‘বৈগ্রাম’, ‘কোলঞ্চ’ (কুলাচ বা কালঞ্জ) গ্রামগুলির অবস্থান দ্বারাই প্রতিপন্ন হয়। সেই শ্রাবস্তী ছিল একটি জনপদ, যেটা বর্তমান বাংলাদেশের ‘দিনাজপুর’ ও ‘বগুড়া’ জেলা ব্যাপী ছিল, সেটা কিন্তু স্পষ্টই বোঝা যায়। ‘কূর্মপুরাণ’-এ স্পষ্টই লেখা হয়েছে যে – শ্রাবস্তী, গৌড়দেশে শ্রাবস্তী নামের একটা ‘মহাপুরী’ নির্মাণ করেছিলেন –
“তস্য পুত্রোভবদ্বীরঃ শ্রাবস্তিরিতি বিশ্রুতঃ।
নির্মিতা যেন শ্রাবস্তী গৌড়দেশে মহাপুরী॥”
আজ পর্যন্ত ঐতিহাসিকেরা উত্তরবঙ্গে শ্রাবস্তী কিংবা সেটার সদৃশ নামযুক্ত কোন জায়গার সন্ধান করতে পারেননি। অন্য পক্ষে মধ্যদেশের ‘শ্রাবস্তী’ নগরী বলেই ইতিহাসে প্রসিদ্ধ। সেখানে শ্রাবস্তী নামের কোন প্রদেশের উল্লেখ ইতিহাসে পাওয়া যায় না। সুতরাং পুরাণোল্লিখিত গৌড়দেশ ‘মধ্যদেশেই’ ছিল বলে মনে হতে পারে। কিন্তু বর্তমানে বঙ্গদেশে শ্রাবস্তী নামের কোন নগরীর সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না বলেই যে সেটা কোন কালে ছিল না, এই ধরণের কোন সিদ্ধান্ত করা সমীচীন নয়। ‘সিলিমপুর লিপি’তে লেখা হয়েছিল যে, শ্রাবস্তী প্রতিবদ্ধ ‘তর্কারি’ ও ‘বালগ্রামের’ মধ্যে ‘শকটিগ্রাম’ অবস্থিত ছিল এবং সেটার কাছেই ‘শিয়ম্বগ্রাম’ ছিল। ওই লিপিতে আরও লেখা হয়েছিল যে, ‘বালগ্রাম’ বরেন্দ্র ব্রাহ্মণদের বাসস্থান ছিল। গবেষকরা বলেন যে – ‘শকটি’, ‘বালগ্রাম’ ও ‘শিয়ম্ব’ – বারেন্দ্র ব্রাহ্মণের ভরদ্বাজ গোত্রীয়দের গাঞি নাম। সুতরাং এর দ্বারাও প্রমাণিত হয় যে, ঐ গ্রামগুলি বরেন্দ্রে অবস্থিত ছিল। কিন্তু ‘বালগ্রাম’ ও ‘শিয়ম্বের’ সন্ধান পাওয়া গেলেও ‘তর্কারি’ কিংবা ‘শকটি’ গ্রামের কোন সন্ধান পাওয়া যায় না। এই প্রমাণে কি বলা যেতে পারে যে, ‘তর্কারি’ এবং ‘শকটি’ নামের কোন গ্রাম বরেন্দ্রে ছিল না? ‘শকটি’ ও ‘বালগ্রাম’ যখন ‘বরেন্দ্রদেশের’ অন্তর্গত ছিল, তখন সেগুলোর খুব কাছের গ্রাম ‘তর্কারি’ যে অন্য একটি বিভিন্ন প্রদেশের অর্থাৎ শ্রাবস্তী দেশের অন্তর্গত ছিল, এই ধরণের কিছু মনে করা ঠিক নয়। ‘শ্রাবস্তী-প্রতিবদ্ধ তর্কারি’ বলতে বোধ হয়, ‘শ্রাবস্তী নগরী-প্রতিবদ্ধ’ মনে করাই যুক্তিসিদ্ধ হবে। সুতরাং এই শ্রাবস্তী নগরী বগুড়া জেলার সিলিমপুরের কাছেই ছিল বলে মনে হয়। পরবর্তীকালে হয়ত সেটার নামের পরিবর্তন ঘটেছিল।

কোলাঞ্চ কি ভাবে পরবর্তীকালে কান্যকুব্জে পরিণত হয়ে গিয়েছিল, এর কোন সন্তোষজনক কারণ ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যায় না। উপরে একটা অনুমান করা হয়েছে মাত্র, কিন্তু সেটাকে খুব সন্তোষজনক হয়ত বলা চলে না। এই বিষয়ে ঐতিহাসিকদেরআরেকটি অনুমানের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। আসামের ইতিহাসে দেখা যায় যে, ত্রয়োদশ কিংবা চতুর্দশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে ‘কামতারাজ’ ‘দুর্লভনারায়ণের’ নিমন্ত্রণে ‘গৌড়ের’ ‘কনৌজ নগর’ থেকে ‘সপ্ত ব্রাহ্মণ’ এবং ‘সপ্ত কায়স্থ’, কামতার রাজধানী ‘কামতাপুরে’ গমন করেছিলেন। সেই কায়স্থরাই ছিলেন আসামের ‘আদি বারভূঁইয়া বংশের’ মূল। ওই কামতা রাজ্য কামরূপের পশ্চিমে ‘করতোয়া’ থেকে ‘বরনদী’ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। বর্তমান ‘রঙ্গপুর’ এবং ‘কোচবিহার’ ছিল ওই কামতা রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত। কামতাপুরের ধ্বংসাবশেষ, কোচবিহার রাজ্যের ‘দিনহাটা’য় আজও বর্তমান। অনেক গবেষক মনে করেন যে, একাদশ শতাব্দীর পরে এবং চতুর্দশ শতাব্দীর আগে, শ্রাবস্তী দেশ ‘কনৌজ’ এবং শ্রাবস্তী নগরী ‘কনৌজ নগর’ নাম ধারণ করেছিল। সেই কারণেই কোলাঞ্চাগত ব্রাহ্মণরা পরবর্তীকালে ‘কনৌজাগত’ বলে পরিচিত হয়েছিলেন। সেই কনৌজ নগর থেকে যখন আসামে ব্রাহ্মণ ও কায়স্থ গমনের প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে, তখন সেই কনৌজরাজ্য থেকে গৌড়ে ব্রাহ্মণ ও কায়স্থ গমনের প্রবাদও অসম্ভব বলে মনে হয় না। সম্ভবতঃ ঐ সময়ে – কনৌজ ও গৌড় – দুটো ক্ষুদ্র ও ভিন্ন রাজ্য ছিল, তাই কোলাঞ্চ থেকে গৌড়ে গমনের কথা ব্রাহ্মণদের কুলজী গ্রন্থগুলোতে দেখতে পাওয়া যায়। সম্ভবতঃ চতুর্দশ শতাব্দীতে কনৌজ নগর গৌড়রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। ঐতিহাসিকেরা ভারতের নানা প্রদেশ থেকে বিভিন্ন প্রদেশে ব্রাহ্মণ গমনের কথা প্রাচীন লিপিতে দেখতে পেয়েছেন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল, আজ পর্যন্ত কান্যকুব্জ থেকে ব্রাহ্মণ গমনের কথা কোন প্রাচীন লিপিতে ঐতিহাসিকদের চোখে পড়েনি। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, গৌড় রাজ্যে – ‘গৌড়’, ‘শ্রাবস্তী’, ‘কৌশাম্বী’, ‘বারাণসী’, ‘কনৌজ’ ইত্যাদি নামের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্য এবং নগর এক সময়ে বর্তমান ছিল। সুতরাং এই সব নাম প্রাচীন লিপি ও গ্রন্থে পেলেই সেগুলোকে খুঁজতে যে ভারতের উত্তর-পশ্চিম প্রদেশে যেতে হবে – এই মতবাদ ও চিন্তাভাবনা ভুল। ইতিহাস বলে যে, গৌড়ে বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণের কোন সময়েই অভাব হয়নি। দেশে যখন বৌদ্ধ পালরাজারা রাজত্ব করছিলেন, তখনও দেখা যায় যে, এই শ্রাবস্তীর ব্রাহ্মণ ও কায়স্থরা ‘বৈদিকাচারী’ ছিলেন। নবম শতাব্দী থেকে বহু ব্রাহ্মণ যে, ওই গৌড় থেকেই ভারতের অন্যান্য প্রদেশে সসম্মানে উপনিবিষ্ট হয়েছিলেন, সেটারও প্রমাণ ইতিহাসে পাওয়া যায়। তাই শেষে, নিশ্চিন্তে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় যে, বঙ্গীয় ব্রাহ্মণদের রাঢ়ী ও বারেন্দ্র পূর্বপুরুষরা ওই গৌড়মণ্ডলেরই অধিবাসী ছিলেন। তাঁরা অন্য দেশ থেকে বঙ্গদেশে এসে উপস্থিত হননি। পরিশেষে, ‘নগেন্দ্রনাথ বসু’ প্রদত্ত একটি আশ্চর্যজনক তথ্য দিয়ে প্রসঙ্গে ইতি টানা যাক। ‘বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস’ গ্রন্থের এক জায়গায় ‘ফুটনোটে’ তিনি লিখেছিলেন – “আশ্চর্যের বিষয় এই যে, রাজশাহী জেলার নওগাঁ থানায় কনৌজ এবং চারঘাট থানায় কনৌজগরি নামক গ্রাম পাইতেছি (Village Directory of Rajshahi District)।”

(তথ্যসূত্র:
১- বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস, নগেন্দ্রনাথ বসু।
২- সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকা, দ্বিতীয় সংখ্যা, ১৩৪১ বঙ্গাব্দ।
৩- গৌড়ে ব্রাহ্মণ, মহিমাচন্দ্র মজুমদার।
৪- ব্রাহ্মণ সমাজ (মাসিকপত্র), দশম বর্ষ, অষ্টম সংখ্যা, বৈশাখ, ১৩২৯ বঙ্গাব্দ।
৫- জাতি তত্ত্ব বারিধি (ভাগ-২), উমেশচন্দ্র গুপ্ত।
৬- রাজসাহীর ইতিহাস, কমল চৌধুরী।)

Related Post