Bangla Hunt Digital

‘সারদা দেবী ও ঊনিশ শতকের কলকাতা’

সারদা দেবী

রানা চক্রবর্তীঃ শ্রীরামকৃষ্ণ সারদা দেবীকে বলেছিলেন, “কলকাতার লোকগুলো যেন অন্ধকারে পোকার মতো কিল বিল করছে। তুমি তাদের দেখো!” তারপরে তিনি নিজেকে দেখিয়ে বলেছিলেন, “এ আর কি করেছে? তোমাকে এর অনেক বেশী করতে হবে।” নিজের মর্তলীলাবসানের আগে তখন তিনি ভবিষ্যৎকর্মের গুরুদায়িত্ব যোগ্য পাত্রে সমর্পণের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন। নিজের অন্তরঙ্গ পার্ষদদের তখন তিনি ভাবী কালের সঙ্ঘজননীকে চিনিয়ে দিচ্ছিলেন, যেন বলতে চাইছিলেন – আমার কাজ অর্ধেক করা হয়েছে, জগতের কল্যাণের জন্য বাকি কাজ ও করবে। কিন্তু সারদা দেবী একজন নারী হিসেবে নিজের সীমাবদ্ধতার কথা তাঁকে মনে করিয়ে দিলে তিনি তাঁকে বলেছিলেন, “শুধু কি আমারই দায়? তোমারও দায়।” কিন্তু সেই দায় কিসের ছিল, কিসের দায়িত্ব তিনি সারদা দেবীর হাতে তুলে দিয়েছিলেন?

ঊনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণের কেন্দ্র ছিল কলকাতা। গ্রাম তখন শহরের রূপ নিচ্ছিল। আভিজাত্য আর বর্ণশ্রেষ্ঠদের হাত ধরে ছিল না। বিদ্যা নয়, বিত্তই তখন গরিমার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। হিন্দুসমাজ তখন কোণঠাসা ব্যক্তিদের আপনগড়া হৃদয়হীন স্বার্থপর বিধি-নিষেধের পাঁকে জড়িয়ে পড়ে খাবি খাচ্ছিল। সাধারণ মানুষ তখন সহজ, সরল ও সুস্থ জীবনযাপনের স্বাদ ভুলে যেতে বসেছিলেন। নতুন শহরে বিদেশিরাও তখন বিভিন্ন উদ্দেশ্য ও আদর্শ নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন। তাঁদের সঙ্গেই পশ্চিম দিগন্তের একটুখানি আলো এসে পূর্বের আকাশে পড়েছিল। বাঙালির চিত্তলোকে সেই আলো প্রবল আলোড়ন তুলেছিল। প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের সেই ভাবসংঘর্ষ ও সমন্বয়কেই ইতিহাসে নবজাগরণ নাম দেওয়া হয়েছে। ইতিহাস বলে যে এই সময়েই যুগপুরুষদের আবির্ভাব ঘটে। সেবারেও সেটাই হয়েছিল। একে একে উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো মনীষীরা এসেছিলেন। তাঁরা অনুভব করেছিলেন যে, সেই জাগরণ শুধু ভাবের আদান-প্রদান নয়, সার্বিক অর্থে মুক্তির আকাশে বিচরণও বটে। একই সঙ্গে তাঁরা বুঝতে পেরেছিলেন যে, তাঁরা কতটা অসহায়। মুক্তিপ্রয়াস যতই আন্তরিক হোক না কেন, এক পক্ষে পক্ষীর উত্থান কখনোই সম্ভব নয়; এদেশের নারী খাঁচায়-বন্দি পাখির মতোই তখন নিরুপায় ছিল। সেজন্য ঊনিশ শতকের মনীষীদের যাবতীয় ভাবনাচিন্তাতেই নারীর মঙ্গলকামনা ছিল। বাস্তবিকই হিন্দু সমাজপতিদের দাপট এবং কুলগৌরব তখন যত খর্ব হচ্ছিল, ততই তাঁরা নারীদের প্রতি রুষ্ট হচ্ছিলেন। কঠোর নিয়মানুবর্তিতার মধ্যে নারীর দেহ ও মনকে শৃঙ্খলিত করে তাঁরা এক ধরনের বিকৃত আনন্দ লাভ করতেন। পশমের আসনের উলটো পিঠের মতো কুশ্রী জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে নারীরা নিজেদের স্বাভাবিক জীবনের ছন্দ ভুলতে বসেছিলেন। যাঁদের ব্যবস্থাপনায় নারীরা তখন বন্দীজীবন কাটাতে বাধ্য হয়েছিলেন, তাঁরা এবং পরনির্ভর, শিক্ষাবঞ্চিত সেকালের কলকাতার নারী – অন্ধকারে থাকা সেই নরনারীকেই কী শ্রীরামকৃষ্ণ কীটের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন? ঊনিশ শতকের মনীষীরাও সমাজ-সংস্কারের কাজে হাত দিয়েই নারীদের অসহায় অবস্থাটি লক্ষ্য করেছিলেন। কিন্তু তাঁদের জন্য বা তাঁদের অবস্থার প্রকৃত উন্নতির জন্য কী করা উচিত, সেটা তাঁরা নির্ণয় করতে পারেন নি। হিন্দুসমাজকে বদলানোর মত ক্ষমতা তাঁদের ছিল না। বিচ্ছিন্নভাবে রাজা রামমোহন রায় সতীদাহ বন্ধ করতে চেষ্টা করেছিলেন, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বাল্যবিধবার পুনর্বিবাহ দিতে চেষ্টা করেছিলেন। তখন বহুবিবাহ ও বাল্যবিবাহ বন্ধ করবার প্রয়াস অসফল হলেও মানুষের মনে সচেতনতা নিয়ে এসেছিল। সেই সময়ের শিক্ষিত মানুষেরা পশ্চিমের নারীদের জীবন লক্ষ্য করছিলেন। তাঁরা দেখেছিলেন যে, ইউরোপে নারীরা শিক্ষিত এবং গৃহবন্দী নন। সেই বিদেশিনীদের আদর্শেই এদেশের নারীকে শিক্ষা দেওয়ার আগ্রহও অনেকের মধ্যে ছিল। তাঁরা সুগৃহিণী হওয়ার উপযুক্ত শিক্ষা দিয়ে নারীদের এবং নিজেদের জীবনেও সুখ-সমৃদ্ধি নিয়ে আসতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বাইরে থেকে হিন্দুসমাজে পরিবর্তন আনা সম্ভব ছিল না। অতিরিক্ত রক্ষণশীল হয়ে সমাজপতিরা নব্যশিক্ষিতদের দূরে সরিয়ে দিতে শুরু করেছিলেন। বহু যুবক ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন। ব্রাহ্ম ধর্মের আশ্রয় নিয়ে আবার অনেকে রক্ষাও পেয়েছিলেন। কিন্তু মূল স্রোতের মানসিক মানচিত্র তখন কারো পক্ষেই বদলানো সম্ভব হয়নি। রিক্ত, ক্লান্ত, অবসন্ন, অপমানিত নারীরাও পশ্চিমী শিক্ষার আলোয় নিজেদের মনের অন্ধকার দূর করতে পারেন নি। তাহলে কি মনীষীদের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল? না, তা হয়নি। বরং যুগপুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণের জীবন ও সাধনাকে আশ্রয় করে তাঁদের আন্তরিক প্রয়াস সার্থক হয়েছিল। অনেকটা দৈবনির্দিষ্ট ঘটনার মতোই ঠাকুর তৎকালীন কলকাতা শহরের এক ভক্তিমতী নারীর প্রতিষ্ঠিত দেবালয়ের মৃন্ময়ী দেবীকে মাতৃভাবে সাধনা করে চিন্ময়ী ভবতারিণীরূপে প্রত্যক্ষ করেছিলেন। নিজের গুরুরূপে তিনি ‘ভৈরবী যোগেশ্বরী’কে গ্রহণ করেছিলেন। নিজের সাধনার শেষপর্বে তিনি সহধর্মিণী সারদা দেবীকে দেবীজ্ঞানে ষোড়শোপচারে পুজো করেছিলেন, মন্দিরের অধিষ্ঠাত্রী দেবী ভবতারিণীর সঙ্গে তাঁকে এক করে দেখেছিলেন, এবং পরম স্নেহ ও সমাদরে স্ত্রীরূপে গ্রহণ করে দেহ-সম্পর্কহীন অপূর্ব দাম্পত্য জীবন অতিবাহিত করেছিলেন। অপমানের অন্ধকার থেকে নারীকে সসম্মানে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করবার জন্য সেই উদাহরণের প্রয়োজন ছিল। ইতিপূর্বে অপর কোনও সাধক ওভাবে মানুষের অন্তরে নারী সম্পর্কিত শ্রদ্ধার বীজ বপন করবার চেষ্টা করেননি। পশ্চিমী আদর্শে নারীর শিক্ষা ও স্বাধীনতার কথা থাকলেও তাঁকে শ্রদ্ধা ও সম্মানের জগতে প্রতিষ্ঠা করা হয়নি। আত্মপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য সেখানেও নারীকে সংগ্রাম করতে হয়েছিল। কিন্তু এদেশে সূচনাপর্বে নারীকে মানসিক শক্তি অর্জন করবার জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছিল। ঊনিশ শতকের মনীষীরা নারীর অন্তঃকরণে জ্ঞানের বীজ রোপণে আগ্রহ প্রকাশ করলেও ভেবেছিলেন, “এখন তাঁহাদিগকে স্বাধীনতা প্রদান করিলে অবশ্যই তাহাতে বিষময় ফল ফলিবে।” যাঁদের নিজেদের মধ্যেই সংশয় ও পরিচালনাশক্তির অভাব ছিল, তাঁরা কীভাবে নেতৃত্ব দেবেন সেটাই ভেবে পাননি। সেই সময়ে রামকৃষ্ণ এবং সারদাদেবী তাঁদের সামনে নিজেদের অলৌকিক জীবনচর্যার চিত্র অত্যন্ত বিশ্বাসযোগ্যভাবে উপস্থিত করেছিলেন।
প্রকাশ্য উদাহরণ হিসেবে সকলে রামকৃষ্ণের কথাই জানেন, কিন্তু সারদা দেবীর কথা ভুলে গেলে চলবে না।

ঊনিশ শতকের সত্তরের দশকে তিনি প্রথম কলকাতা শহরে এসেছিলেন। তখন অবশ্য দক্ষিণেশ্বর কলকাতা-সংলগ্ন একটা গ্রাম ছিল। কলকাতা শহরে তখন নারীজাগরণের প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল। নানা ঐতিহাসিক কারণে সেই দশকটি আধুনিক সময়ের নারীদের কাছে স্মরণীয়, কেননা সেই সময়েই ‘চন্দ্রমুখী-কাদম্বিনী’ প্রবেশিকা স্তরে উন্নীত হয়েছিলেন। ‘রাসসুন্দরী-স্বর্ণকুমারী-ফয়জুন্নেসা’র গ্রন্থ প্রকাশিত হচ্ছিল। ‘নীলকমল মিত্র’ দৌহিত্রী ‘বিরাজমোহিনী’কে চিকিৎসাবিদ্যা শেখাতে চাইছিলেন। নারীর আত্মবিকাশের সেই পর্বে সারদা দেবী দক্ষিণেশ্বরে উপস্থিত হওয়ার পরে শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন, “তুমি কি আমায় সংসারপথে টেনে নিতে এসেছ?” সারদা দেবী সেদিন তাঁকে নির্দ্বিধায় উত্তর দিয়েছিলেন, “আমি তোমাকে সংসার পথে কেন টানতে যাব? তোমার ইষ্টপথেই সাহায্য করতে এসেছি।” এখানেই তিনি আপন বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। শ্রীরামকৃষ্ণগতপ্রাণা কিন্তু আত্মসচেতন। প্রথম থেকেই তিনি “স্বেচ্ছায় স্বামীর ব্রতসাধনের ক্ষেত্রে নিজেকেও পূর্ণভাবে অংশীদার করে সন্ন্যাসিনীর জীবনকে বরণ করে নিয়েছিলেন।” এই নারী অপমানের অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া নারীদের একজন ছিলেন না, বরং তাঁদের উদ্ধারকারিণী দলের নেত্রী ছিলেন। শুধু অপমানিত, লাঞ্ছিত নারীদের নয়, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ধনী- দরিদ্র, সুখী-দুঃখী সব নারীকেই তিনি নিজের আসক্তিবিহীন জীবনাচরণের অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত দিয়ে কূপমণ্ডূকের জীবন থেকে মুক্তি পাওয়ার শিক্ষা দিয়েছিলেন। ঠাকুর সেকথা ভালোভাবেই জানতেন বলে যাবতীয় গুরুদায়িত্ব অর্থাৎ শুধু নারীদের ভার নয়, যাবতীয় পুত্র-কন্যা-গৃহী-সন্ন্যাসী-মুমুক্ষু-দিগ্‌ভ্রান্ত মানবসন্তানের দায়দায়িত্ব তাঁর হাতেই সমর্পণ করেছিলেন। সারদা দেবীও সেই দায়িত্ব এড়াতে পারেন নি। তিনি নিজে ভক্তদের অপূর্ব আশ্বাসবাণী শুনিয়েছিলেন – “ঠাকুরের জগতের প্রত্যেকের উপর মাতৃভাব ছিল। সেই মাতৃভাব জগতে বিকাশের জন্য আমাকে এবার রেখে গেছেন।” সন্তানদের জন্যও তাঁর অভয়বাণী ছিল – “তাঁদের ভবিষ্যৎ আমি দেখব।” অবশ্য না দেখে তাঁর উপায়ই বা কী ছিল – “আমার ছেলে যদি ধুলোকাদা মাখে, আমাকেই তো ধুলো ঝেড়ে কোলে নিতে হবে।” ঠাকুরের লীলাবসানের পরে সারদাদেবীকে দুটি দায়িত্ব নিতে হয়েছিল। ঠাকুর যে ভাবান্দোলনের সূচনা করেছিলেন, সেটাকে বাঁচিয়ে রাখা; এবং তাঁর ভাব সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে যে সন্ন্যাসীবৃন্দ পৌঁছে দিচ্ছিলেন, তাঁদের মাতৃস্নেহ দিয়ে একসুরে বেঁধে রাখা। তখনও তাঁরা গৈরিকধারী সন্ন্যাসী ছিলেন না, তখনও রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের সুষ্পষ্ট সূচনা হয়নি, ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা স্থির হয়নি, অর্থের সংস্থান ছিল না, ঠাকুরের গৃহী ভক্তদের সঙ্গে তাঁদের আদর্শগত বিরোধ ছিল – কিন্তু সেই সঙ্কটপর্বে শ্রীমা নিঃশব্দে তাঁর সন্ন্যাসী সন্তানদের পাশে ছিলেন। সারদাদেবীর সেই নীরব সমর্থন মন্ত্রের মতো কাজ করেছিল। স্বামীজী পরে তাঁর এক বক্তৃতায় সেই চরম দুঃসময়ের কথা স্মরণ করে বলেছিলেন, “একজন ছাড়া কেহই সহানুভূতি জানাইল না। সেই একজনের সহানুভূতিই আশা ও আশীর্বাদ বহন করিয়া আনিল। তিনি এক নারী।” অথচ সেই শতকেই নারীর নিরুপায় স্নানমুখ প্রত্যক্ষ করা গিয়েছিল। দয়ার পাত্রী যে কোন মুহূর্তে প্রেরণাদাত্রী হয়ে উঠেছিলেন, সেটা কেউ তা বুঝতে পারেন নি। রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের পুষ্টিসাধনে সারদাদেবীর ভালোবাসাই ছিল প্রধান শক্তি। স্বামীজী বলেছিলেন, “আমাদের সকলের তাঁহার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা। তিনি কখনও আমাদের উপর হুকুম চালান না।” যদিও সারদাদেবীর ইচ্ছা এবং নির্দেশই ছিল রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের শেষ কথা। একবার বেলুড় মঠে দুর্গাপুজোয় স্বামীজী চেয়েছিলেন ‘বলি’ হবে। সেকথা শুনে শ্রীমা তাঁকে বলেছিলেন, “মঠে দুর্গাপুজো করে শক্তির আরাধনা করবে বইকি। শক্তির আরাধনা না করলে জগতে কোনও কাজ কি সিদ্ধ হয়? তবে বাবা, বলি দিয়ো না, প্রাণিহত্যা কোরো না। তোমরা হলে সন্ন্যাসী, সর্বভূতে অভয়দানই তোমাদের ব্রত।” স্বামীজী নির্দ্বিধায় তাঁর সেই আদেশ মেনে নিয়েছিলেন। একসময়ে প্লেগ যখন কলকাতায় মহামারীর রূপ নিয়েছিল, তখন সেবাকর্মে অর্থের অভাব দেখা দিলে স্বামীজী বেলুড় মঠ পর্যন্ত বিক্রি করে দিতে চেয়েছিলেন। সেবাকর্মে অকুণ্ঠ সমর্থন থাকা সত্ত্বেও শ্রীমা কিন্তু স্বামীজীর সেই প্রস্তাবে সম্মত হননি। তিনি বলেছিলেন, “মঠ-স্থাপনায় আমার নামে সংকল্প করেছ, তোমার ওসব বিক্রির অধিকারই বা কোথায়? বেলুড় মঠ কি একটা সেবাকাজেই নিঃশেষ হয়ে যাবে?” সেদিন সঙ্ঘজননীর কথায় স্বামীজী তাঁর নিজের ভুল বুঝতে পেরেছিলেন। পরবর্তী কালেও শ্রীমাকে বহু জটিল সমস্যার সমাধান করতে হয়েছিল। মায়াবতী অদ্বৈত আশ্রমে স্বামীজীর ইচ্ছানুসারে বিশুদ্ধ অদ্বৈতের সাধনা করা হত, কিন্তু তাঁর দু’-একজন সন্ন্যাসী-শিষ্য একটি ঘরে শ্রীরামকৃষ্ণের পটপূজা করতেন। স্বামীজী সেকথা শুনে তাঁদের উপরে অত্যন্ত বিরক্ত হয়েছিলেন। তাঁর সম্মানে সেই পুজো বন্ধ করে দেওয়া হলেও সন্তানদের মনে সংশয়ের অবসান ঘটেনি। তাঁরা শ্রীমাকে সেই বিষয়ে একটি পত্র লিখলে তিনি তাঁদের উত্তর দিয়েছিলেন, “আমাদের গুরু যিনি তিনি তো অদ্বৈত। তোমরা সেই গুরুর শিষ্য তখন তোমরাও অদ্বৈতবাদী। আমি জোর করিয়া বলিতে পারি তোমরা অদ্বৈতবাদী।” সঙ্ঘজননী হিসেবে সারদাদেবীর দৃঢ়তা এবং গুরুত্ব সেই পত্রটির প্রতি ছত্রে লুকিয়ে ছিল। নিজের দৈনন্দিন জীবনে তাঁকে দ্বৈতবাদিরূপেই দেখতে পাওয়া যেত। পটপূজা, ভোগরাগ, আরতি সবেতেই তাঁর প্রগাঢ় নিষ্ঠা দেখা গেলেও অতি সহজে তিনি পারিপার্শ্বিক থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে প্রকৃত সত্য ব্যক্ত করেছিলেন। প্রশ্ন উঠতে পারে যে, তাহলে শ্রীমা তাঁর দৈনন্দিন আচরণে কিংবা বলা যায় ব্যবহারিক জীবনে কেন অদ্বৈতবাদকে প্রাধান্য দেননি?
কারণ সঙ্ঘজননী হওয়া ছাড়াও তাঁর আরও কিছু দায় ছিল। তিনি বহু সন্তানের জননী ছিলেন। মুষ্টিমেয় কয়েকজন দৃঢ়চেতা ত্যাগী সন্ন্যাসী সন্তানকে নিয়ে তাঁর সংসার ছিল না, তাঁর সংসার আরও বড়ো ছিল। সেখানে কামনাবাসনাতাড়িত, আকণ্ঠ সংসারপঙ্কে নিমজ্জিত অসংখ্য ধূলিধূসরিত মানুষ ছিলেন। ধুলো ঝেড়ে তাঁদের কোলে নিতে হবে, তাঁদের বোঝাতে হবে যে ঈশ্বরলাভই জীবনের শেষ কথা – এটাই ছিল তাঁর সংকল্প। সব সন্তানই তাঁর শিশু মাতৃক্রোড়েই সেরা শিক্ষা পায়। মা তাঁকে স্নেহে-শাসনে, আদরে, ভালোবাসায়, ভুলিয়ে, বুঝিয়ে নানাভাবে শিক্ষা দেন। শ্রীমাও তাঁর সন্তানদের মধ্যে জ্ঞান-ভক্তি সঞ্চারের চেষ্টা শুরু করেছিলেন। প্রথমদিকে তিনি পুরুষভক্তদের সামনে বাইরে বেরোতেন না, বা তাঁদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলতেন না; তবে প্রয়োজনে দীক্ষা অবশ্যই দিতেন, তাঁদের মনে কোনও সংশয় বা প্রশ্ন থাকলেও সেসবের উত্তর দিতেন। তবে মায়ের সঙ্গে নারী ভক্তদের যোগ সব সময়েই ছিল।

দক্ষিণেশ্বরে থাকতেই সারদাদেবী দুই কলকাতাবাসিনীর সান্নিধ্য পেয়েছিলেন, তাঁরা ছিলেন – ‘যোগীন-মা’ ও ‘গোলাপ-মা’। নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনে আরও অগণিত কলকাতাবাসিনীর মতোই তাঁদের দুঃখের জীবন ছিল। ‘যোগীন্দ্রমোহিনী’র স্বামী ‘অম্বিকাচরণ বিশ্বাস’ অমিতব্যয়ী, অসংযত ও উচ্ছৃঙ্খল ছিল। কোন উপায়ান্তর না থাকবার জন্য তিনি শ্বশুরালয় থেকে বাধ্য হয়ে উত্তর কলকাতায় পিত্রালয়ে ফিরে এসেছিলেন। পরে শ্রীরামকৃষ্ণের চরণপ্রান্তে পৌঁছে তিনি শান্তির আশ্রয় পেয়েছিলেন। তাঁর নির্দেশেই তিনি শ্রীমায়ের সেবিকা ও সঙ্গিনী হয়েছিলেন। গোলাপ-মা প্রথমে বাগবাজারে বাস করতেন। তাঁর স্বামী ‘কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়’ অকালেই মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছিলেন। এরপরে নিজের এক পুত্র ও কন্যাকে নিয়ে সেই দরিদ্র ব্রাহ্মণীর জীবন যাপন শুরু হয়েছিল। পুত্রটিও শৈশবে মারা গিয়েছিল। একমাত্র কন্যাকে গোলাপসুন্দরী যক্ষের ধনের মতো আগলে রেখেছিলেন। নিজের আর্থিক অনটনেও সেকালের কৌলীন্যপ্রথাকে অগ্রাহ্য করে তিনি তাঁর কন্যা ‘চণ্ডীকুমারী’কে পাথুরিয়াঘাটার ‘সৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুরের’ সঙ্গে বিবাহ দিয়েছিলেন। কিন্তু দুটি শিশুপুত্র রেখে চণ্ডীকুমারী অকালে মারা যাওয়ার পরে গোলাপসুন্দরী শোকে-দুঃখে উদ্‌ভ্রান্ত হয়ে উঠেছিলেন। তখন তাঁর পূর্বপরিচিতা যোগেন্দ্রমোহিনী তাঁকে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের চরণাশ্রয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। দক্ষিণেশ্বরের নহবতে তিনিও মায়ের সঙ্গিনীরূপে গৃহীত হয়েছিলেন। পরবর্তী জীবনে শ্রীমায়ের সর্বকালের সঙ্গিনীরূপে তাঁদের উওভয়কে দেখতে পাওয়া গিয়েছিল। শ্রীমা তাঁদের বলতেন ‘জয়া-বিজয়া’। যাই হোক, ঊনিশ শতকের কলকাতার সঙ্গে শ্রীমায়ের যোগ তাঁরাই ঘটিয়েছিলেন। সারদাদেবী স্বেচ্ছায় সেই শতকের অধঃপতিত নারীদের আলোয় ফিরিয়ে আনার কাজ গ্ৰহণ করেছিলেন। ঠাকুর ও শ্রীমায়ের প্রকৃত স্বরূপ জানা সত্ত্বেও গোলাপ-মা তৎকালীন সংস্কারবশত মাঝে মাঝেই বলে ফেলতেন, “… উনি অত বড়ো ত্যাগী, আর মা এত মাকড়ি-টাকড়ি এত গয়না পরেন, এ ভালো দেখায় কি?” বুদ্ধিমতী মা তৎক্ষণাৎ বুঝতে পেরেছিলেন যে, সেকথা শুধু মনোমোহনের মায়ের নয় গোলাপ – মায়েরও। তাই তিনি শুধু সোনার বালাটা হাতে রেখে বাকি সব গয়না খুলে ফেলেছিলেন। কারণটা তাঁর মুখেই অন্য এক প্রসঙ্গে এক সেবক শুনতে পেয়েছিলেন, “গোলাপ কি কম গা? দক্ষিণেশ্বরে আমি ঠাকুরের কাছে যেতুম বলে ওর হিংসে হত। একদিন বলেই ফেললে, তুমি ঠাকুরের কাছে যাও কেন? আমি কারুর কথা সইতে পারিনে। কথা শোনবার মতো কাজ তো করিই না, তবে শুনব কেন? আমি যাওয়া বন্ধ করে দিলুম।” অথচ মা ভালো করেই জানতেন যে, তাঁর গয়না পরা বা ঠাকুরের জন্য খাবার নিয়ে যাওয়া কোনওটাই দোষের নয়; কিন্তু তবুও ভক্তদের চোখে ঠাকুরের ত্যাগের আদর্শ নিয়ে কোনও প্রশ্ন তোলার অবকাশ তিনি রাখতে চাননি। তাঁর অপরূপ সংলাপটিও ঊনিশ শতকের নারীকে অন্য একটি শক্তি দিয়েছিল, সেটা ছিল – কথা শোনার মতো কাজ না করবার শক্তি। একেবারে নিরাভরণভাবেই তিনি নিজের পবিত্র জীবনটিকেই শুধু যে তুলে ধরেছিলেন – তা নয়, অন্য নারীদেরও বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে, পবিত্র ও গ্লানিহীন জীবনযাপনের মর্যাদা কতখানি। বস্তুতঃ, যে সময়ের কথা এখানে বলা হচ্ছে, সেই সময়ের কলকাতা শহরের অধিকাংশ অন্দরমহলে সীতা-সাবিত্রীর পাতিব্রত্য, বীরজননীর আত্মত্যাগ, দ্রৌপদীর মর্যাদাবোধ নিতান্ত গল্পকথায় পর্যবসিত হয়েছিল। গার্গী-মৈত্রেয়ী স্মৃতিতেও ছিলেন না। অবশ্য সহস্র বন্ধনের মধ্যেও তখনও দু’-চারজন নারী যে মুক্তির কথা ভাবেননি তা নয়। মানুষমাত্রেই একটা শান্তির আশ্রয় খোঁজে, ঊনিশ শতকে কিংবা তার আগেও নারী ধর্মের কাছে, ঠাকুরঘরে সেই আশ্রয় খুঁজেছিল। দু’-চারজন সংসারবন্ধন কেটে মুক্তির সন্ধানে বেরিয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু সারদাদেবীই সকলের জন্য শান্তির সন্ধান দিতে পেরেছিলেন। একই সঙ্গে তিনি সকলকে যুগোপযোগী এগিয়ে যাওয়ার পথও দেখিয়ে দিয়েছিলেন।

প্রথমেই তিনি নারীকে অতিরিক্ত আসক্তির হাত থেকে মুক্তি পেতে শিখিয়েছিলেন। তিনি জানতেন যে, অধিকাংশ নারীই নিজেদের তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয়ে আবদ্ধ করে রাখেন। বিড়ম্বিত দাম্পত্যজীবনে কোনওরকম সম্মান না পেলেও ভোগের মোহিনী-মায়া তাঁদের আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। ঠাকুর এবং শ্রীমার বিবাহের আদর্শটি সেজন্যই এত মূল্যবান। তাঁরা নতুন করে ভারতীয় আদর্শের পুরানো কথা শিখিয়েছিলেন যে, বিবাহ শুধু ইন্দ্রিয় পরিতৃপ্তির জন্য নয়, শুধু সন্তানের জন্ম দেওয়াই নারীজীবনের শেষ কথা নয়। গৃহী ভক্তদের জন্য সেই শিক্ষার প্রয়োজন তখন ছিল। তবে মায়ের দায়িত্ব ছিল আরেকটু বেশি। বাৎসল্য নারীর স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য, কিন্তু সে কি কেবল তাঁর নাড়ী-ছেঁড়া ধনের সঙ্গেই রক্ত মাংসের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে থাকবে? শ্রীমা তাঁদের সামনে বিশুদ্ধ মাতৃত্বের আদর্শ তুলে ধরেছিলেন। তিনি গর্ভধারিণী ছিলেন না, কিন্তু ‘সত্যজননী’ ছিলেন। সাধারণ মানুষকে শিক্ষা দেওয়া বড়ো শক্ত। শুধু উপদেশে কোনও কাজ হয় না। লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, শ্রীমা কাউকে এমন কোনও উপদেশ দেননি, যা তিনি নিজের আচরণের দ্বারা প্রমাণ করে দেখাননি। সর্বত্র অতি সাধারণ পল্লীবধূর মতো বাস করেছিলেন। তাঁকে যাঁরা ঘিরে থাকতেন, আপাতদৃষ্টিতে তাঁরাও অতি সাধারণ মানুষ ছিলেন। শ্রীমায়ের সংস্পর্শে এসে কি তাঁদের মন বদলাত না? বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। ‘স্বামী গম্ভীরানন্দ’ লিখেছিলেন, “ভ্রাতাদের স্বার্থবুদ্ধি, ভ্রাতুষ্পুত্রীদের পরস্পর হিংসা, নলিনীদিদির শুচিবায়ু, রাখুর বাতুলসদৃশ আবদার এবং ছোটোমামীর পাগলামী – এই সকল মিলিয়া যে অবর্ণনীয় আবহাওয়ার সৃষ্টি হইত তাহাতে একমাত্র ধৈর্যময়ী শ্রীমায়ের পক্ষেই সংসারের কাজ করা সম্ভব ছিল।” আসলে তাঁরা সকলেই মায়ের লীলাসঙ্গী ছিলেন। লোকলোচনের সামনে সেটি তাঁর ‘পঞ্চতপা’র সাধনা ছিল। বিড়ম্বিত নারীদের তিনি অশান্তির নিত্যদহনের মধ্য দিয়ে সাধনা করতে শিখিয়েছিলেন।

Related Post