Bangla Hunt Digital

নাচতে নাচতে স্ট্রোক হয়ে যাচ্ছে, তবুও নাচ থামছে না! ডান্সিং প্লেগের ঘটনা কতখানি সত্যি?

নাচতে নাচতে স্ট্রোক হয়ে যাচ্ছে, তবুও নাচ থামছে না। ডান্সিং প্লেগের ঘটনা কতখানি সত্যি?

প্লেগের নাম তো আমরা সবাই শুনেছি কিন্তু আপনারা কি ডান্সিং প্লেগের নাম শুনেছে? নামটি শুনতে অদ্ভুত লাগলেও সত্য ছিল এটি। এই রোগটি দেখা দিয়েছিল ১৫১৮ সালে স্ট্রাসবার্গ নামের একটি ছোট্ট শহরে। এই রোগের কারণে সেই সময় মৃত্যু হয়েছিল ৪০০ জনেরও বেশি মানুষের। কিন্তু কিভাবে উদ্ভব হয়েছিল এই রোগের? আর কি কি ছিল এই রোগের লক্ষণ?

প্রথম কার মধ্যে ডান্সিং প্লেগের উপশম দেখা দিয়েছিল?

১৫১৮ সালের জুলাই মাসে স্ট্রাসবার্গের (তখন পবিত্র রোমান সাম্রাজ্য, আজকের আধুনিক ফ্রান্স) একটি ব্যস্ত রাস্তায় হঠাৎ এক মহিলা উম্মাদের মতো নাচতে শুরু করেন। এই মহিলাটির নাম ছিল লেডি ট্রফিয়া (বা ফ্রাউ ট্রফিয়া)। যথারীতি এই মহিলাটির নাচ দেখে সেখানে ভিড় জমে যায় এবং দর্শকরা তার এই নাচ দেখে প্রশংসাসূচক হিসেবে হাত তালি দিয়েছিলেন।

সেই সময় কারোর পক্ষে এই নাচের পিছনে আসল কারণটা জানা সম্ভব ছিল না।

প্রথমে ব্যাপারটা স্বাভাবিক মনে হলেও পরে ব্যাপারটা স্বাভাবিক লাগেনি। কারণ লেডি ট্রফিয়ার এই নৃত্য ক্ষণিকের জন্য ছিলো না। টানা ৬ দিনের মতো উম্মাদের মতো নেচেছিলেন এই মহিলাটি। তিনি সন্ধ্যায় নাচ থামাতো আবার সকাল হলেই শুরু করতো তার উম্মাদ নৃত্য। এই এক সপ্তাহের মধ্যে তার সাথে এই নৃত্যে যোগ দিয়েছিলেন আরো চৌত্রিশ জন স্থানীয় লোক।

আরো পড়ুন- কলেজ ড্রপআউট ছিলেন। গ্যালিলিও গ্যালিলির অজানা কিছু তথ্য

সেই সময় এই বিষয়টি সম্পর্কে চিকিৎসকদেরও কোনোরকম কোনো ধারণা ছিল না। যার ফলে চিকিৎসকরা উল্টো পরামর্শ দিয়েছিল যে মানুষদের শরীরের জ্বর এসেছে এবং রক্ত গরম হয়ে গেছে, তাই তাদের আরো নাচলে এই অসুখ নিরাময় হবে।

চিকিৎসকদের দেওয়ায় এই পরামর্শটি সেই শহরের সিটি কাউন্সিল গ্রহণ করেছিল। এমনকি নৃত্যের জন্য একটি মঞ্চ তৈরি করা, নাচার জন্য মিউজিক হিসেবে ব্যান্ড পার্টির ও ব্যবস্থা করা এবং সঠিকভাবে নাচতে শেখার জন্য নৃত্য প্রশিক্ষক নিযোগ করার মতো ব্যবস্থা করা হয়েছিল।

আগস্টের শেষের দিকে, একটি আধুনিক দিনের কোনো কনসার্টের মতোই অবস্থা হয়ে গিয়েছিল রাস্তাটি। যেখানে অসংখ্য মানুষ নাচছে এবং সেই নাচ দেখে হাসছে হাজার হাজার মানুষ। এরপর নাচ দেখতে থাকা ওই মানুষজনও দলে দলে যোগ দিচ্ছে এই নাচে। সময় বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে মানুষজন অতিরিক্ত ক্লান্ত হয়ে পড়ছে যার ফলে স্ট্রোকে মৃত্যু বরণ করতে শুরু করে এই মানুষজনগুলি। কিছু কিছু স্থানে উল্লেখ রয়েছে যেখানে নাচতে নাচতে প্রতিদিন ১৫ জনের মৃত্যু হত। ১৫১৮ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অব্যাহত ছিল এই নৃত্যের ধারা।

ডান্সিং প্লেগের ঘটনা কতখানি সত্যি?

Time to Dance, A Time to Die: The Extraordinary Story of the Dancing Plague of 1518 (2008) ইতিহাসবিদ ‘জন ওয়ালার’ লেখা এই বইটিতে ব্যাখ্যা করেছেন এর কারণ। ঐতিহাসিক রেকর্ডগুলিতে (ভুক্তভোগীরা) নাচের বিষয়টিতে দ্ব্যর্থহীন। এই মানুষজনরা কেবল কাঁপছিল তবে সেটি খিঁচুনি ছিল না। তারা নৃত্য করেছিল তবে এমনভাবে তারা হাত ও পা নড়াচড়া করছিল তাতে মনে হচ্ছিল যেন তারা উদ্দেশ্যমূলকভাবে নাচছে।

সেই সময়কার রাস্তা, গলি এবং পাবলিক মার্কেটে মানুষদের নাচের বর্ণনা দিয়েছিলেন একজন জার্মান প্রত্যক্ষদর্শী ও পুরাতত্ত্ববিদ জোহান শিল্টার। তাদের বর্ণনা অনুযায়ী, ওই সমস্ত মানুষজন দিনরাত কিছু না খেয়ে নেচে যাচ্ছিল। এদের মধ্যে কেউ অজ্ঞান হয়ে হচ্ছে আবার কেউ মারা যাচ্ছে। এটি যেন এক মৃত্যুনৃত্য।

নাচের প্লেগ যে বাস্তব ছিল সেই নিয়ে কোনো সংশয় নেই।

কেনো এমন উন্মাদ নৃত্যের সৃষ্টি হয়েছিল?

বর্তমান দিনের বিশেষজ্ঞরা অনুমান করে যে এটি Ergot বিষক্রিয়া: Ergot হল একটি ছত্রাক যা রাই এবং সংশ্লিষ্ট গাছে জন্মায়। এতে থাকে সাইকোঅ্যাকটিভ নামক রাসায়নিক পদার্থ যা মারাত্মক হ্যালুসিনেশন এবং খিঁচুনি সৃষ্টি করতে পারে।

ওই সময় একটি সাধারণ খাদ্য আইটেম ছিল রাই রুটি। ১৫৫৮ সালে আবির্ভূত হওয়া প্লেগ নৃত্য রোগটি Ergot বিষক্রিয়ার কারণ সৃষ্টি হতে পারে। তবে জন ওয়ালার একটি বিজ্ঞান জার্নালে এই নিয়ে যুক্তি দেওয়ার পরে বাতিল করা দেওয়া হয়েছিল এই তত্ত্বটি। “এই তত্ত্বটি গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয় না, কারণ এটি সম্ভব নয় যে যারা এরগট দ্বারা বিষক্রিয়া করেছিল তাদের হতে পারে”।

গণ হিস্টিরিয়া: অনেক বিশেষজ্ঞদের মতে, নৃত্য প্লেগকে গণ হিস্টিরিয়ার ক্ষেত্রে যুক্তি দেন। গণ হিস্টিরিয়ার অর্থ হল জনসংখ্যার সংগ্রহ যা একই আচরণ প্রদর্শন করে, প্রায়শই উদ্ভট, অজানা বা ব্যাখ্যাতীত কারণে।

এই তত্ত্বকে সমর্থন করেন এডিনবার্গ ইউনিভার্সিটির সায়েন্স স্টাডিজ ইউনিটের লেকচারার ইভান ক্রোজিয়া। তিনি মনে করেন যে লেডি ট্রফিয়া (প্রথম নর্তকী) ইর্গট বিষের শিকার হয়েছিলেন। তার নাচের উন্মত্ততা প্রভাব ফেলেছিল গণ হিস্টিরিয়ার উপর। এরপর এতে যোগ দান করেছিল বাকিরা। উচ্চ মাত্রায় মানসিক চাপের পাশাপাশি প্রচুর জনসংখ্যার মধ্যে গণ হিস্টিরিয়া প্রাদুর্ভাব ঘটে।

জন ওয়ালারের তত্ত্ব অনুযায়ী, অনাহার, রোগ এবং স্ট্রাসবার্গের মানুষের কুসংস্কারপূর্ণ বিশ্বাস স্ট্রেস-সম্পর্কিত সাইকোসিসকে প্ররোচিত করতে পারে যা ১৫১৮ সালের ডান্সিং প্লেগের রূপ নিয়েছিল।

Related Post