চীন, ভারতবর্ষ রাশিয়ার সাথে নিজেদের মুদ্রাতে ব্যবসা করছে, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ নাকী পূর্ব বনাম পশ্চিম! কোন পথে বিশ্ব রাজনীতি? - Bangla Hunt

চীন, ভারতবর্ষ রাশিয়ার সাথে নিজেদের মুদ্রাতে ব্যবসা করছে, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ নাকী পূর্ব বনাম পশ্চিম! কোন পথে বিশ্ব রাজনীতি?

By Bangla Hunt Desk - May 03, 2023

১৫৫৫ সালে অর্থাৎ প্রায় চারশো বছর আগে ফ্রান্সের বিখ্যাত জ্যোতিষী নস্ত্রাদ্রামুস এমন কিছু ভবিষ্যত বানী করেছিলেন যা আজও মানুষকে অবাক করে দেয়। ওনার প্রায় অধিকাংশ ভবিষ্যত বানীই সত্য হয়েছিল যার মধ্যে রয়েছে ফরাসী বিপ্লব, হিটলারের উত্থান, পারমানবিক বোম্ব বিস্ফোরনের ঘটনা। এই জন্য নস্ত্রাদামুসকে অনেকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ জ্যোতিষী বলেন। এমনকী বর্তমানে হওয়া রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের ভবিষ্যতবানীও তিনি করেছিলেন। নস্ত্রাদামুস এটা বলেছিলেন এই সংঘর্ষকে কেন্দ্র করে শীঘ্রই বিশ্ব ভয়ানক যুদ্ধের সম্মুখীন হবে। বিশ্বের অন্যতম বিখ্যাত সামরিক বিশেষজ্ঞ মাইকেল ই ওহ্যানলোন ২০১৯ সালে তার বই দি সেনকাকু প্যারাডক্স : রাইজিং গ্রেট পাওয়ার ওয়ার ওভার স্মল স্টেকসে লিখেছেন বিশ্বের ছোট ছোট সংঘর্ষ বড় যুদ্ধের জন্ম দিতে পারে যার অর্থ তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ।

অ্যাটলান্টিক কাউন্সিলের প্রধান ম্যাথিউ ক্রোয়িং বলেছেন বিশ্ব জুড়ে ছোট ছোট সংঘর্ষ ভবিষ্যতের বড় যুদ্ধের দিকে ইশারা করছে। রাশিয়া ইউক্রেনের যু্দ্ধই হোক কিংবা উত্তর কোরিয়ার সাথে আমেরিকার বিরোধ এসব কিছুই ভবিষ্যতের জন্য অশুভ সংকেত। সামরিক বিশেষজ্ঞদের ধারনা আগামী বিশ্বে পূর্ব বনাম পশ্চিমের যুদ্ধ হবার সম্ভবনা বেশী যার কেন্দ্রবিন্দু হবে ইন্দো প্যাসিফিক অঞ্চল। এই অঞ্চলেই রয়েছে চীন, ভারত, দক্ষিন কোরিয়া, জাপানের মতন বড় সামরিক ক্ষমতা ও মজবুত অর্থনীতির দেশগুলো। যার কারনে ইন্দো প্যাসিফিক অঞ্চলকে ভবিষ্যতে বিশ্বরাজনীতির মূলকেন্দ্র বলা হচ্ছে। কিন্তু কী কারনে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এত বছর পর বিশ্বে আবারও একটি বড় যুদ্ধের সম্ভবনা তৈরি হয়েছে? সেবিষয়েই বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয় জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পরমানু বোম্ব ফেলার মাধ্যমে। যার জন্য বিশ্ব সাক্ষী হয়েছিল এক মর্মান্তিক ধ্বংসাত্মক অস্ত্রের ধ্বংসলীলার। এরপরই পরমানু অস্ত্র তৈরি ও ব্যবহারের উপর লাগাম লাগানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। প্রথমদিকে শুধু আমেরিকা ও রাশিয়ার কাছেই এই অস্ত্র ছিল কিন্তু পরে চীন, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, ভারত, ইসরায়েল ও পাকিস্তান এই পরমানু শক্তির অধিকারী হয়ে ওঠে। এই মহূর্তে বিশ্বের সবচেয়ে বেশী পরমানু হাতিয়ার রয়েছে রাশিয়ার কাছে। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমন করে, এরপরই রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিন হুমকী দেয় ইউক্রেনকে সাহায্য করলে রাশিয়া পরমানু অস্ত্র প্রয়োগে বাধ্য হবে। যার জন্য ছোট ছোট দেশ গুলোর নিরাপত্তার ব্যাপারেই প্রশ্ন উঠে যায়। শুধু রাশিয়া নয় পাকিস্তান, চীন, উত্তর কোরিয়ার মতন অস্থিতিশীল দেশ গুলোর কাছেও পরমানু অস্ত্র রয়েছে যা বিশ্বের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকী। উত্তর কোরিয়ার সবচেয়ে বড় শত্রু আমেরিকা। যার জন্য উত্তর কোরিয়া কিছুদিন আগেই ঘোষনা করেছে তাদের উপর আক্রমনের সম্ভবনা হলেই তারা পরমানু হামলা করবে যার কারনে আমেরিকার মত বিশ্বের সুপার পাওয়ার দেশও উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে আর্থিক নিষেধাজ্ঞার বাইরে কিছু করতে পারেনা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মত ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ বা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ যাতে না হয় তার জন্য জাতিসংঘের মতোন সংগঠন তৈরি হয়েছিল যার প্রধান কাজই ছিল বিশ্বজুড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা এবং মুক্তবানিজ্য নীতি। জাতিসংঘে মূলত আমেরিকার নেতৃত্বে পশ্চিমা দেশগুলোর প্রভাব রয়েছে। তবে বর্তমানে জাতিসংঘও দ্বিধাবিভক্ত কারন জাতিসংঘের পাঁচ স্থায়ী সদস্যের মধ্যে চীন ও আমেরিকার মধ্যে বানিজ্য যুদ্ধ শুরু হয়েছে প্রাক্তন আমেরিকার রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের সময় থেকে। আমেরিকার স্পীকার ন্যান্সি পেলোসির তাইওয়ান সফরের পর থেকে আরও জোড়ালো বিরোধীতা শুরু হয়েছে দুই দেশের মধ্যে। চীন তাইওয়ানের চারদিকে যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করেছে। বিশেষ করে রাশিয়া ও চীনের ভাল সম্পর্কের জেড়ে মনে করা হচ্ছে চীন হয়ত তাইওয়ানে আক্রমন করতে পারে তবে এমনটা হলেও জাতিসংঘের কিছু করবার থাকবেনা, কারন চীন পরমানু শক্তিধর দেশ। ঠিক এই ভাবেই ইউরোপে অস্থিতিশীলতা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সৃষ্টি করেছিল। সাধারনত বিশ্বে শান্তি বজায় তখনই থাকে যখন শক্তির ভারসাম্য বজায় থাকে এবং শক্তির ভারসাম্য তখনই সম্ভব যখন বিশ্ব ইউনিপোলার ও বাইপোলারে থাকবে। বাইপোলার মানে দুটি সুপার পাওয়ার থাকবে বিশ্বে যার কারনে বিশ্বে শান্তি থাকবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে বিশ্বে এরকমই দুটি সুপার পাওয়ার ছিল আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন। ইউনিপোলারের ক্ষেত্রে বিশ্বে একটিই সুপার পাওয়ার থাকে যার সমতুল্য কেউ হতে পারে না ফলে শান্তি বজায় থাকে। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাবার পর বিশ্বে একক সুপার পাওয়ার হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে আমেরিকা। কিন্তু বর্তমান বিশ্ব মাল্টিপোলার বা একসাথে অনেকগুলো শক্তিশালী দেশের উত্থান হয়েছে। শক্তিশালী সামরিক ও অর্থনৈতিক দেশ হিসাবে চীনের উত্থান হয়েছে, চীনকে কাউন্টার করার জন্য ভারত ও জাপান রয়েছে এশিয়ায়। রাশিয়া নতুন করে নিজেদের শক্তি বাড়িয়েছে। মধ্য প্রাচ্যে ইরানের মতো সামরিক শক্তিশালী দেশ রয়েছে। এখন পরিস্থিতি অনেকটা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মতন, তখনও পরিস্থিতি মাল্টিপোলার ছিল। মূলত অস্ট্রিয়া হাঙ্গেরি, জার্মানি, অটোমান সাম্রাজ্য, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও আমেরিকার শক্তি প্রদর্শনের জন্যই জন্যই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ হয়েছিল। তবে বর্তমান বিশ্বে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পাশাপাশি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মতন পরিস্থিতিও রয়েছে। অনেক সময় শক্তিশালী দেশ গুলো ক্ষমতা দখলের নেশায় এতটাই মত্ত হয়ে যায় যে তাদের পতন ডেকে আনে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলার ক্ষমতার নেশায় প্রায় গোটা ইউরোপ দখল করে নিয়ে রাশিয়া আক্রমন করেছিল যা তার পতনের সূত্রপাত করেছিল। অন্যদিকে জাপান এশিয়ায় তার প্রভাব বিস্তার করছিল। এখন রাশিয়াও সেই একই ভুল করে ইউক্রেন আক্রমন করেছে। তবে রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিন স্বপ্নেও ভাবেনি ইউক্রেন এতটা প্রতিরোধ করবে। অন্যদিকে সামরিক বিশেষজ্ঞদের ধারনা চীনও দক্ষিন চীন সাগর থেকে শুরু করে ভারত মহাসাগর ও হিমালিয়ান রেঞ্জে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করতে ব্যাস্ত যা ভবিষ্যতে একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের ইঙ্গিত দিচ্ছে। চীন ক্ষমতার নেশায় মত্ত হয়ে বেলট রোড ইনিশিয়েটিভের মতন বিপুল ব্যায়ের প্রকল্প শুরু করেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জার্মানি ও জাপান যেন আজকের রাশিয়া ও চীন। শুধু ক্ষমতার লড়াই নয় বরং পারস্পারিক বানিজ্যও বর্তমানে বিশ্বে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করছে। জাতিসংঘের একটি লক্ষ্য ছিল মুক্ত বানিজ্য নীতি কিন্তু বর্তমানে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় মুক্ত বানিজ্যনীতি প্রায় নেই বললেই চলে। যেমন রাশিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধের পর অ্যাপেল, কেএফসির মতন বড় বড় সংস্থা রাশিয়া ছেড়ে চলে আসে। আবার চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিনপিং ও বড় বড় চাইনিজ সংস্থাকে আমেরিকা থেকে সরিয়ে নিয়ে আসছে। আমেরিকার অ্যাপেলের মতন সংস্থা চীন থেকে ভারতে চলে আসছে। ইউরোপ রাশিয়া থেকে গ্যাস, তেল কেনার বদলে বিকল্প জায়গা থেকে কিনছে বেশী দামে হলেও। ইরান, ভেনিজুয়েলার উপর আমেরিকার নিষেধাজ্ঞার কারনে দেশ গুলো আমেরিকা বিরোধী জোট যেমন চীনের সাথে বানিজ্য করছে। চীন আমেরিকার বদলে এশিয়াও আফ্রিকার বাজার দখলে ব্যাস্ত হয়ে পড়েছে। এর সবচেয়ে ব্যাপক প্রভাব পড়েছে আমেরিকান ডলারে। বলা হয় আমেরিকান ডলার বিশ্বের সবচেয়ে মজবুত কারেন্সি কিন্তু বানিজ্য যুদ্ধের কারনে চীন তার কারেন্সি ইউয়ান, ভারত রুপি, রাশিয়া রুবেলে বানিজ্য করছে। আমেরিকার অন্যতম বন্ধু দেশ সৌদি আরবও তেল রপ্তানির জন্য চীনের সাথে ইউয়ানে বানিজ্য করছে। যার কারনে বিশ্বে ডলারের ৫৯ শতাংশ শেয়ার কমে গেছে। আমেরিকান ডলারের পতন বিশ্বে আর্থিক সংকট তৈরি করতে পারে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে যুদ্ধের ধরনে একটু পরিবর্তন হয়েছে। আগে যুদ্ধ হত দুই বা একাধিক দেশের মত। তবে ২০১৪ সালে ইসলামিক স্টেট, লেবাননের হিজবুল্লাহ এবং সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ প্রচলিত যুদ্ধের ধারনাকে বদলে দিয়ে নতুন ধারার প্রবর্তন করেছে তা হচ্ছে শক্তিশালী দেশের বিরুদ্ধে ছায়াযুদ্ধ যার সবচেয়ে বড় উদাহারন হচ্ছে আফগানিস্তানের তালিবান যারা আমেরিকাকে উচ্ছেদ করে দিয়ে আজ আফগানিস্তানের ক্ষমতায়। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, রোবটিক্স, হাইপারসনিক মিসাইল যুদ্ধের ধরনই পাল্টে দিয়েছে। রাশিয়া, চীন, ইরান, উত্তর কোরিয়া, পাকিস্তান, সিরিয়ার মতন পশ্চিমা বিরোধীদেশ গুলোর জোট যেন ক্রমশ বিশ্বকে পূর্ব বনাম পশ্চিমের গনবিধ্বংসী যুদ্ধের দিকে এগিয়ে দিচ্ছে।

সব খবর পড়তে আমাদের WhatsApp গ্রুপে যুক্ত হোনএখানে ক্লিক করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *


প্রাসঙ্গিক খবর