রানা চক্রবর্তীঃ এবারে ‘ময়নামতির গান’ অনুসরণ করে একাদশ শতকের বাঙালীর সামাজিক রীতিনীতির চিত্তের সন্ধান করা যাক। তখন ব্রাহ্মণদের দরবারী বেশভূষা কি ছিল? ধুতি শালকিরাণি, চটক ও মটক, কোমরবন্ধ, চল্লিশ পাগড়ি (চল্লিশ বার পাক দিয়ে যেটা তৈরী করা হত), এক হাতে অঙ্গদ, অপর হাতে বলয়, কণ্ঠে স্বর্ণ-মালা, গলায় জোড়া জোড়া পৈতা, কক্ষে একরাশি পুঁথি – ঠিক যেন হিন্দুস্তানী ব্রাহ্মণ পণ্ডিত। আলবেরুনি তাঁর লেখায় একাদশ শতকের বাংলার পুরুষদের অলঙ্কার ও প্রসাধন-প্রীতি কথার ঐতিহাসিক সাক্ষ্য দিয়ে গিয়েছেন। তিনি লিখেছিলেন যে, তখন পুরুষেরাও স্ত্রীলোকের মত যেমন প্রসাধন-দ্রব্য ব্যবহার করতেন, তেমনি অলঙ্কারও পড়তেন; যথা – কানে মাকড়ি, হাতে বালা, হাতের আঙুলে আর পায়ের বুড়ো আঙুলে নানা ধরণের আংটি। এর পাশেই ‘হীর নটি’র বেশভূষার বাহারের যে বর্ণনা পাওয়া যায়, সেটা এরকম – নাসের কাকই, বহুপ্রকারের খোঁপা (নিচু করে চুল বাঁধলে সেটাকে বলা হত ‘খোপ্যক’, আর উঁচু করে চুল বাঁধলে সেটাকে বলা হত ‘ঘোড়াচূড়’ বা ঘোড়াচুলা), নিয়র-মেলানি শাটী (মসলিন), নাকের নত (নথ), হেট কানে (কানের লতিতে) পেন্দে ঢেরি, উপর কানে চাকি, শতেশ্বরি হার, পায়ে বাঁকামল, সোনার কাচলি (কাঁচুলি), আর হরে পানের খিলি। বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, ওই সময়ের নিয়র-মেলানি শাড়ি এত সূক্ষ্ম হত যে, রাতে সেটাকে দেখা যেত না; ফলে ওই শাড়ি পরে থাকলেও রাতে নটিকে বিবসনা বলেই বোধ হত – “শাড়ি আর নটি গেইল মিলিয়া।” তখনকার ভদ্র বাঙালী পরিবারের মেয়েদের বেশবাশ ছিল – নিচের হাতে শাঁখা, উপরের হাতে ‘বাহ খড়’, গলায় সাতেসরী বা দেবচ্ছন্দ হার, মাথায় হংসপদিকা, কানে সোনার তারঙ্গ বা কচি তালপাতার অবতংস তালীপত্র (কুণ্ডল হিসাবে), আর পরনে সূক্ষ্ম কার্পাসবস্ত্র, মলমল বা পাটের কাপড়; সেই কাপড়গুলোর নামও ছিল বিচিত্র, যথা – ‘মেঘ-উদুম্বর’, ‘গঙ্গাসাগর’, ‘লক্ষ্মীবিলাস’, ‘দ্বারবাসিনী’, ‘সিলহটি’, ‘গাঙ্গেরী’ ইত্যাদি আরো কত নাম! এছাড়া ছিল পট্ট ও নেতবস্ত্র (সিল্ক)। পাটের শাড়ির প্রচলন বাংলায় এখনো থাকলেও, ‘নেতের’ অধোগতি হতে হতে এখন সেটা ঘর পরিষ্কার করবার ‘ন্যাতা’য় পরিণত হয়েছে, যদিও উড়িষ্যায় সেটার গৌরব এখনো অক্ষুণ্ণ রয়েছে। উপরোক্ত সব কাপড়ই তখন বাংলাতেই তৈরী করা হত। ওই সময়ে বাংলার প্রতিটি ঘরেই ‘মলমলের’ সুতা কাটা হত। তখন বাঙলার তৈরী কাপড়ের কদর সারা উত্তর ভারত জুড়ে ছিল; আর তাতে বাঙলার ঘরে ঘরে আর্থিক স্বচ্ছলতা এসেছিল। তখন শুধু বাংলায় নয়, ভারতবর্ষের সর্বত্রই সবাই পান চিবাতে অভ্যস্ত ছিলেন। তাম্বুল দান ও গ্রহণ তখনকার ভারতীয় সভ্যতার এক অঙ্গবিশেষ ছিল। কবে থেকে যে সেই রীতিটির সৃষ্টি হয়েছিল, সেটা বলা যেমন দুষ্কর, তেমনি তাম্বুল-লতার উদ্ভবের কথাও ইতিহাসে অজ্ঞাত। অথচ, ভারতের ইতিহাসের সব শতকেই কিন্তু তাম্বুলের প্রতিপত্তির কথা পাওয়া যায়। তখন ধনীদের সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের তাম্বুলবাহী সেবকও ঘুরে বেড়াতেন। ওই সময়ে আদর-আপ্যায়নে পানের স্থান সবার উপরে ছিল; পানের জায়গায় ‘তামাক’ এসেছিল অনেক পরে – মাত্র ষোড়শ শতকে। তখন শুধু সধবারাই নন, বিধবারাও পান খেতেন। ‘ময়নামতীর গানের’ ময়না যে পান খেতেন, তাতে থাকত – লং (লবঙ্গ), জায়ফল, এলাঞ্চি (এলাচ), দালচিনি (দারুচিনি), গুআমুরি, ধনিয়া, করপুর ও জৈষ্ঠমধু (যষ্টিমধু)। সেকালেও বিবাহের কথা পাকা হলে ‘দরগুআ’ করা হত; অর্থাৎ, তখনও শুভ সংবাদে ‘গুয়াপান’ বিলানো হত। এই প্রসঙ্গে বলে রাখা দরকার যে, সুপারি কথাটা কিন্তু কোনও আধুনিক শব্দ নয়; চতুর্দশ শতকের বাংলা সাহিত্যে ‘সিপরি’ নামে এর স্পষ্ট উল্লেখ পাওয়া যায়। তখন সবাই ছবিও আঁকতেন; হয়ত গুপ্তযুগে, অর্থাৎ, চতুর্থ, পঞ্চম শতকে চিত্রাঙ্কন-বিদ্যার ব্যাপক প্রসারের ফলেই সেটা সম্ভব হয়েছিল। ওই সময়ের গরীবেরাও নিজেদের ঘরের দেওয়ালে অন্ততঃ দুটো ময়ূরের ছবি এঁকে রাখতেন। বেণেদের বাড়ীর দু’পাশে তখন দুটো টাকার থলি, তার সঙ্গে একপাশে একটা শাঁখ আর অন্যদিকে একটা পদ্ম আঁকা থাকত। ছবি আঁকার ব্যাপারটা তখন গৃহসজ্জার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে ছিল। শুধু তাই নয়, তখন নারী হোন বা পুরুষ, তাঁরা সকলেই কিন্তু নাচতে জানতেন। তবে মেয়েরা যে তাতে বিশেষভাবে পারদর্শী ছিলেন, তাতে কোন সন্দেহ নেই। ওই সময়ের নটীরা শুধু নন, নিতান্ত সাধারণ ভদ্র পরিবারের মেয়েরা, এমনকি রাজবাড়ির রাজবধূও নৃত্য পটিয়সী ছিলেন। ময়না নিজেই রাজবধূ ছিলেন – “ময়না গর খ্যামটা আড়খ্যামটা নাচে হাততালি দিয়া”।
ইতিহাস বলে যে একাদশ শতকে পৌঁছেও বাঙালীর সমাজ কিন্তু তখনও দানা বাঁধতে পারেনি। সমাজের উচ্চপর্যায়ে তখন যেমন ‘গুভাজু’ বা সদ্ধর্মী বা বৌদ্ধ ও ‘দেবভাজু’ বা হিন্দুর মধ্যে একটা লড়াই চলছিল, তেমনি সমাজের নিম্নপর্যায়ে তখন সম্পূর্ণ স্বতন্ত্রভাবে বিপুলসংখ্যক বাঙালী – তাঁতি, ডোম, বাগদী, হাড়ী, শবর ইত্যাদি বাস করছিলেন। ওই সময়ে সমাজের উচ্চপর্যায়ের সঙ্গে নিম্নপর্যায়ের কোনো সম্পর্কই ছিল না, সমাজের নিম্নপর্যায়ের মানুষেরা তখন শহর ও গ্রামের বাইরে থাকতেন। তাঁরা তথাকথিত অন্ত্যজ, অস্পৃশ্য ছিলেন। আলবেরুনি তাঁর লেখাতে একাদশ শতকের বাংলার সমাজের সেই সামগ্রিক বিচ্ছন্নতার কথা স্পষ্টভাবেই উল্লেখ করেছিলেন। একাদশ শতকের মধ্যভাগে ভারতে এসে তিনি বহুদিন ধরে এখানে বাস করেছিলেন। তৎকালীন বাংলার সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে তাঁর লেখা থেকে যা জানা যায়, সেটার কিছুটা অংশ এরকম – “অন্ত্যজ গোষ্ঠীর এক-একটি জাতি এক-একরকমে সমাজসেবা করে; সেবাই তাঁদের পেশা। তাঁদের বৃত্তি আট প্রকারের – রজক, চর্মকার, ঐন্দ্রজালিক, বেত ও বাঁশের তৈরী জিনিসের কারিগর, নৌ-চালক, মৎস্যজীবী, ব্যাধ অর্থাৎ মৃগয়াজীবী ও তাঁতী। রজক, চর্মকার ও তাঁতীর সঙ্গে অন্য পাঁচটির কোনো বৈবাহিক সম্পর্ক নেই; নিজ নিজ দলের মধ্যেই তাঁদের বিবাহাদি চলে। অন্য পাঁচটি দলের মধ্যে বিবাহাদি চলে। … হাড়ী, ডোম (ডোম্ব) ও চণ্ডাল শ্রেণীর মানুষ কোনো বিশিষ্ট বৃত্তিভোগী বলে গণ্য হয় না; তাঁরা নানা ধরণের কাজকর্ম করে। যে যে বৃত্তি অবলম্বন করে সেই অনুসারেই তাঁদের শ্রেণীবিভাগ করা হয়। মোটের উপরে তাঁদের সংকরশ্রেণী বলেই ধরা হয়; তাঁরা উচ্চশ্রেণীর বর্ণ-সংকর বিবাহজাত পুত্রকন্যারূপে অধঃপতিত। তাঁদের মধ্যে হাড়ীকে একটু উচ্চপর্যায়ে ধরা হয় – তাঁদের পরিচ্ছন্নতার জন্য। ডোমের স্থান এরই পরে; তাঁরা বাঁশি বাজায় ও গান করে।” তবে ওই সময়ের ডোমেদের বা ডোম্বদের বৃত্তি সম্পর্কে আলবেরুনির মন্তব্য ইতিহাসগতভাবে প্রামাণিক নয়; কারণ সমসাময়িক অন্য সব পুঁথিতেই সেই সময়ের ডোমদেরকে বাংলার দুর্ধর্ষ ঘোড়সওয়ার সেনা হিসাবে চিত্রায়িত করা হয়েছে। ওই সময়ের “ডোমকে নেই যমের ভয়”, “ডোমের পুত যমের দূত” – বর্তমানে বাঙলার প্রবাদবাক্যে পরিণত হয়েছ গিয়েছে, আর –
“আগডোম বাগডোম ঘোড়াডোম সাজে
ডাল, মৃগল ঘাঘর বাজে,
বাজতে বাজতে পড়ল সাড়া
সাড়া গেল বামনপাড়া।”
এই কিছুকাল আগেও বাঙলার শিশুদের ছড়ার বই আলো করে থাকত। ওই বাগদীরা পদাতিকও ছিলেন; তাঁরা ছিলেন দুর্ধর্ষ ও বিশালকায়, তাঁদের মাথায় ছিল বাবরিকাটা চুল, তাঁদের হাতে থাকত একটা বড় বাঁশের লাঠি, যেটার নাম ছিল ‘রায় বাঁশ’। তাঁরাই হয়ত বাংলার ‘রায়বেঁশে নাচের’ আদি কর্তা।
আরো পড়ুন- ‘চর্যাপদের যুগে বাংলার সামাজিক অবস্থা’, (প্রথম পর্ব)
তখনো বাঙালী সমাজে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সৃষ্টি হয়নি, সেটা আরো অনেক পরে হয়েছিল। তখনকার সমাজের একদিকে ছিলেন মুষ্টিমেয় মহাযানী বা শূন্যবাদী বৌদ্ধ সওদাগর ও অভিজাত সম্প্রদায়রা, আর সমাজের অন্যদিকে তাঁদের সঙ্গে পাল্লা দিতেন অল্পসংখ্যক হিন্দু ব্রাহ্মণ ও ব্রাহ্মণেতর জাতি, নানা বৃত্তিজীবী কিন্তু বিত্তশালী মানুষেরা। তাঁরা মূলতঃ পৌরাণিক ধর্মী হলেও, বৈদিক ধর্মী ছিলেন না; হয়ত তাঁদের বেশিরভাগই তখন বিষ্ণু-উপাসক ছিলেন, কারণ পালযুগের সকল ক্ষেত্রেই পালরাজাদের মন্ত্রীরা বিষ্ণু-উপাসক ছিলেন বলে ইতিহাস থেকে দেখা যায়। তাই বলে শাক্তরা যে তখন একেবারেই ছিলেন না, তা নয়। ‘শ্রীধর দাস’ সংকলিত ‘সদুক্তিকর্ণামৃত’ গ্রন্থেই সেই প্রমাণ লিপিবদ্ধ রয়েছে। উক্ত গ্রন্থটি ত্রয়োদশ শতকের আগে সংস্কৃত ভাষায় রচিত বিভিন্ন কবির নির্বাচিত কবিতাংশের একটি প্রখ্যাত ঐতিহাসিক সংকলন। ঐতিহাসিকদের কাছে ওই গ্রন্থটি ভারতের সংস্কৃত সাহিত্যের অন্যতম প্রাচীন সংকলনের মধ্যে একটি বলে গণ্য হয়। গ্রন্থটিতে ‘শতানন্দ’ নামক একজন কবির একটি কালীধ্যান রয়েছে। কালী মার্কণ্ডেয় পুরাণোক্ত চণ্ডিকারই রুদ্র রূপ। পুরাণের মধ্যে ‘বায়ুপুরাণ’ সর্বাপেক্ষা প্রাচীন বলে ইতিহাসে গণ্য হয়; আর তারপরেই প্রাচীনত্বের দিক থেকে মার্কণ্ডেয় পুরাণের স্থান। মার্কণ্ডেয় পুরাণ রচনার কাল সঠিকভাবে বলা দুষ্কর, তবে সেটি চতুর্থ শতক রচিত হয়েছিল বলে ঐতিহাসিকেরা অনুমান করে থাকেন। কালী বাঙালীর প্রিয়তম দেবী। তবে যে রূপে তিনি এখন পূজিত হন, সেটা অবশ্য অনেক পরে এসেছে, এবং কেন উক্ত দেবীটি বাঙালীর জীবন- সূত্রের সঙ্গে একান্তভাবে গ্রথিত হয়ে গিয়েছেন, সেটার মূলও অন্যত্র রয়েছে। কিন্তু এই প্রবন্ধটি সেকথা আলোচনার উপযুক্ত স্থান নয় বলে, এই প্রসঙ্গটি আপাততঃ মুলতবি রাখা যেতে পারে। ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, শতানন্দ নবম শতকের প্রথমার্ধে পালরাজাদের রাজকবি ছিলেন। আর্যা ছন্দে লেখা তাঁর কালীবন্দনার শ্লোকাংশটি নিম্নরূপ –
“জয়তি তব কূপিতেক্ষণমশ্বত্যা দশনপেষমসুরাস্থি।
কল্পশিখিস্ফুটদদ্রিক্কাণকরালঃ কউকার॥”
(ক্ষণ = রাত্রি; পেষ = পিষ্ট করা, চর্বিত করা; কল্প = মাদক দ্রব্য)
তখন ব্রাহ্মণদের মধ্যে যাঁরা পণ্ডিতশ্রেণীর ছিলেন, তাঁরা সবাই স্মার্ত ছিলেন; তাই শ্রুতি নিয়ে তাঁদের কারবার বেশি ছিল না। তাঁদের মতে বেণেরা যেহেতু শূদ্র ছিলেন, তাই গৃহ্যসূত্রোক্ত সংস্কার হলেই তাঁরা চাতুর্বর্ণ্য সমাজে স্থান পেতে পারতেন। মজার ব্যাপার হল যে, ওই সময়ের বাংলার বৌদ্ধেরা যেমন বুদ্ধের মন্দিরে ধূপধুনা দিতেন, তেমনি আবার মনুসংহিতার অনুশাসন মেনে চলতেন, এবং ব্রাহ্মণ পুরোহিত দিয়ে দশকর্মও করাতেন। তবে তখনকার সেই উচ্চতর সমাজের বাইরে বাঙালীর যে বৃহত্তম অংশটি ছিল, তাঁদের সঙ্গে উচ্চতর সমাজের কারো কোন ধরণের যোগাযোগই ছিল না; না বৌদ্ধদের, আর না পৌরাণিক ধর্মীদের। বস্তুতঃ তাঁদের ধর্ম বিভিন্ন আর সমাজ মূলতঃ গোষ্ঠীসীমাবদ্ধ ছিল। ধর্মের দিক থেকে হয় তাঁরা বৌদ্ধ সহজপন্থী, অর্থাৎ লুইসিদ্ধার চ্যালা ছিলেন, আর নয়ত নাথপন্থী ছিলেন; তখন সহজপন্থী ও নাথপন্থীদের মূলগত দৃষ্টিভঙ্গিতে ও সাধনপন্থায় বিশেষ কোন পার্থক্য ছিল না। ওই নাথপন্থীরা পূর্বভারতীয় তান্ত্রিক পর্যায়ের এক বৃহৎ শৈব সম্প্রদায়ভুক্ত গোষ্ঠী ছিলেন। ঐতিহাসিকদের মতে নবম বা দশম শতকে, সম্ভবতঃ চন্দ্রদ্বীপে, অর্থাৎ পূর্ববাঙলার অধুনাতন বাখরগঞ্জ জেলায় সেই পন্থার জন্ম হয়েছিল। মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে ভেলকি বা নিম্নস্তরের যাদুবিদ্যায় অশেষ পারদর্শিতা অর্জনই তখন নাথপন্থীদের পরম লক্ষ্য ছিল। তাঁদের মধ্যে যাঁরা তখন সেই লক্ষ্যে পৌঁছে যেতেন, তাঁদেরকেই ‘নাথ’ বলা হত। তাঁরা সবাই সমাজের নিম্নস্তরের লোক ছিলেন, তাই তাঁদের রচিত তান্ত্রিক গ্রন্থের সংস্কৃত ভাষাও অশুদ্ধ ও দুর্বোধ্য। তবে আধুনিক সময়ের গবেষকদের মতে হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মন্তব্য হয়ত আংশিক সত্যি। ময়নামতির গানের ময়নামতী ‘গোরক্ষনাথের’ শিষ্যা ছিলেন, ‘হাঁড়িপা’ বা ‘হাঁড়িপাদ’ও তাই ছিলেন। গবেষকদের মতে হাঁড়িপা বাঙালী হলেও গোরক্ষনাথ হয়ত পাঞ্জাবী ছিলেন। প্রবাদ রয়েছে যে, গোরক্ষনাথই নাকি কালীঘাটের কালীকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। অবশ্য এই প্রবাদের কোন ঐতিহাসিক ভিত্তি পাওয়া যায় না। ‘মৎস্যেন্দ্রনাথ’ উক্ত সময়ের নাথসিদ্ধদের অন্যতম শীর্ষমণি ছিলেন, কিন্তু তাঁর প্রকৃত পরিচয় নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে বহু তর্কবিতর্ক রয়েছে। তবে যেটা নিয়ে কোন মতদ্বৈধ নেই, সেটা হল যে, মৎস্যেন্দ্ৰনাথই মহাযান বৌদ্ধপন্থার সঙ্গে নাথপন্থার মিলন ঘটিয়েছিলেন। তাই নাথপন্থা বৌদ্ধমতেরই অঙ্গ হয়ে গিয়েছিল। অনেকের মতে সেই সময়ের নাথপন্থীদের ভেলকিবাজির মূলে হয়ত অথর্ববেদের মন্ত্রই ছিল, যা পরবর্তীকালে তান্ত্রিক সাধনায় পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিল। অথর্ববেদ সংকলিত হয়েছিল ঋগ্বেদের পরে, কিন্তু তা বলে এটা মনে করবার কোন কারণ নেই যে, অথর্ববেদে গ্রথিত অনেকগুলি মন্ত্রই ঋগ্বেদ রচনার আগেই রচিত হয়নি। কারণ, মানুষ সেই আদিম কাল থেকেই মরণাপন্ন রোগে, শত্রুদমনে, পুত্রলাভের আশায়, সর্পভয় দূর করতে, এবং অন্যান্য অনুরূপ কারণে মন্ত্র-তন্ত্র, তুকতাকের আশ্রয় গ্রহণ করেছিল। অথর্ববেদের অনেকাংশই সেই ধরণের মন্ত্র-তন্ত্রে ভর্তি রয়েছে। অর্থবদেবের ভাষ্যকার ‘সায়ণ’ বলেছিলেন যে, অতীতের রাজাদের জন্য অথর্ববেদ অপরিহার্য ছিল; তখন রাজপুরোহিতকেও অথর্ববেদের উপরে দখল রাখতে হত। সেই সময়ের সর্বসাধারণের কাছেও, বিশেষ করে গৃহস্থের কাছে, ওই সব মন্ত্র বা প্রক্রিয়ার মূল্য সমধিক ছিল, তাই সেগুলির অনেকাংশ পরে গৃহ্যসূত্রেও স্থান পেয়েছিল। লক্ষ্যণীয় যে, মানুষের, বিশেষ করে হিন্দুদের মন থেকে এই সংস্কার কখনো যায় নি। তাই আজও সিংহভাগ হিন্দু তুকতাকে বিশ্বাস করে থাকেন। বলা বাহুল্য যে, হিন্দুধর্মে যুগযুগ ধরে প্রচলিত শান্তি-স্বস্ত্যয়ন, প্রায়শ্চিত্ত প্রভৃতি ওই সব তুকতাকেরই রকমফের মাত্র; সুদূর অতীতের তাবিজ, কবচ, ঝাড়ফুঁক, সাপের মন্ত্র প্রভৃতিরই সমগোত্রীয়। এই কথাটা রূঢ় হলেও ঐতিহাসিক দিক থেকে সত্যি। কারো কারো মতে, বুদ্ধের জ্ঞাতসারেই তাঁর শিষ্যদের মধ্যে অনেকেই তখন তন্ত্র-মন্ত্রের সাধনাও করতেন। তাঁদের ঐন্দ্রজালিক ক্ষমতার কথা ‘বিনয় পিটকের’ কোনো কোনো গল্পেও পাওয়া যায়। ঐতিহাসিকদের মতে বৌদ্ধসঙ্ঘেই তান্ত্রিক সাধনার সূচনা ঘটেছিল, এবং প্রথম বৌদ্ধতন্ত্র লেখা হয়েছিল ‘গুহ্যসমাজে’ – যেটার জন্মকাল ছিল খৃষ্টীয় তৃতীয় বা চতুর্থ শতক। এটার দ্বিতীয় ধাপ দেখা দিয়েছিল ‘সংগীতি’র আকারে, সেটাও মহাযানপন্থার পরবর্তীকালে; এবং উক্ত পন্থার সহজ ছিদ্রপথের মাধ্যমে সেসব জিনিস বৌদ্ধধর্মের মধ্যে অনুপ্রবেশও করেছিল। এরপরে জনসাধারণের পরম চিত্তগ্রাহী হয়ে এসেছিল হিন্দুদের পৌরাণিক পূজা। ফলে, পৌরাণিক ধর্মের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় মহাযানকেও বিভিন্ন তান্ত্রিক দেবদেবীর সন্ধানে তৎপর হতে হয়েছিল। সেই ক্রমবর্ধমান প্রতিযোগিতার ফলে পৌরাণিক ধর্মেও একটা সময়ে তান্ত্রিক সাধনা ঢুকে গিয়েছিল, যেটা অনেক ক্ষেত্রেই বৌদ্ধতান্ত্রিক সাধনার রূপান্তর মাত্র ছিল। তখন সমগ্র পূর্বাঞ্চলে, বিশেষ করে বাঙলায় ও প্রাগজ্যোতিষপুরে, বৌদ্ধধর্মের মহাযান পন্থা ও হিন্দুদের পৌরাণিক ধর্মের মধ্যে বিষম প্রতিযোগিতা ও দ্বন্দ্ব শুরু হয়ে গিয়েছিল, যার ফলে কালক্রমে ওই উভয় ধর্মকেই অতিক্রম করে সর্বত্র তান্ত্রিকবাদই প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল। তাই বাঙালীর পৌরাণিক ধর্মের মধ্যে বারো আনাই তান্ত্রিক খাদ মেশানো বলে গবেষকরা মনে করে থাকেন। এই তান্ত্রিকতার পটভূমিকাই বাঙালীর প্রকৃত পরিচয় – এই কথা বিস্মৃত হলে বাঙালীর জাতীয়-মানস স্পষ্ট করে বোঝা সম্ভব নয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে যে, ‘ষোড়শমাতৃকা’ পূজা তান্ত্রিক অথচ, এই পূজাটি প্রথমে না করে বৈদিক কর্ম – অন্নপ্রাশন, উপনয়ন, বিবাহ প্রভৃতি করা বাঙালী সমাজে আজও বিধিবহির্ভূত। এরকম আরো দৃষ্টান্ত রয়েছে, কিন্তু সেসব নিয়ে বিস্তারিত লিখতে গেলে পাতার পর পাতা ভর্তি হবে বলে, এখানে শুধু একটি মাত্র দৃষ্টান্তের কথাই উল্লেখ করা হল। আর যে প্রতিযোগিতার কথা আগে উল্লেখ করা হয়েছে, একাদশ শতক পর্যন্ত বাঙলার সর্বত্রই সেটা প্রবল হয়ে উঠেছিল। এবার আবার একাদশ শতকের বাঙলার সমাজ-কথায় ফিরে আসা যাক। উক্ত শতকে সহজপন্থার সিঁড়ি ধরে তৎকালীন বাঙালী সমাজে ব্যভিচারের স্রোত প্রধানতঃ নিম্নশ্রণীর বাঙালীর সাজে, আর নাথপন্থার তুকতাক অগ্নি-পরীক্ষা, জলপরীক্ষা, সর্পপরীক্ষা, জলপড়া, চালপড়া, নলচালা, বাটিচালা প্রভৃতি রূপে এসেছিল। এর ফলেই উদ্ভব হয়েছিল ‘শার্কুন’ শাস্ত্রের; অর্থাৎ, সুলক্ষণ-দুর্লক্ষণ সংহিতার। ক্রমে বাঙালীর মনে সেটা নিজের স্থায়ী আসন গেড়ে বসেছিল। উক্ত ‘শার্কুন-শাস্ত্র’ই বাঙালীর মনে হাঁচি-টিকটিকির এক অলঙ্ঘ্য বাধার প্রাচীর গড়ে তুলেছিল। পরে অনেক ক্ষেত্রেই সেসব প্রায় প্রবাদ-বাক্যরূপে, যেমন ‘ডাকের বচনে’ প্রকাশ পেয়েছিল। এখানে প্রবাদের আগে ‘প্রায়’ বিশেষণটি এই কারণেই জুড়ে দেওয়া হল যে, প্রবাদের প্রাণ শুধু শব্দের স্বল্পতা ও শব্দার্থের আধিক্য নয়, সেটার সঙ্গে সেটার উপযোগিতাও জুড়ে থাকে। এর উপযোগিতা হল যে, প্রবাদ-বাক্যের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত থাকে সেটির অভিপ্রায় ও সংকেত, যা প্রবাদটি শোনামাত্র মর্মের মধ্যে প্রবেশ করে যায়। ময়নামতীর গানেও ‘ডাকের বচনের’ হাঁচি-টিকটিকির কথা পাওয়া যায়।
“হাঁচি জিঠি যে জন বারে
বিঘ্নের সময় সে জন তরে।”
(জিঠি অর্থাৎ জ্যেষ্ঠী = টিকটিকি)
ডাক ও খনার বচনের উদ্ভব একাদশ শতকের পূর্বে হয়েছে বলে ধরা চলে। তবে দুটোর মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। ডাকের বচনে সামাজিক বার্তা, মানুষের চরিত্র প্রভৃতির কথা পাওয়া যায়; আর সেখানে খনার বচন মূলতঃ বাংলার চাষবাস, জলহাওয়া, শুভক্ষণ বা তিথি গণনা নিয়ে। বলা বাহুল্য যে, দুটিরই আদিম ভাষা লোকের মুখে মুখে ক্রমে ক্রমে বদলে গিয়েছে, আর ডালে ও চালে মিশে খিচুড়ির সৃষ্টিও হয়েছে; তবে সেই খিচুড়িতাপে নয়, কালধর্মে তৈরী হয়েছে। ফলে অতীতে দু’য়ের মধ্যে কোনো ভাষাগত আদিম পার্থক্য ছিল কি না, সেটা এখন আর বোঝার কোন উপায় নেই। তবে কৃষিভিত্তিক ও তুকতাক-ভক্ত অতীতের বাঙালী সমাজে যে দুটিরই বহুল প্রচার ও প্রসার ঘটেছিল, তাতে কোন সন্দেহ নেই। পরবর্তীকালে কৃষিকর্ম যতই অনাদর পেয়েছে খনার বচনও তত ক্ষীণ হয়ে এসেছে, কিন্তু বাঙালীর তুকতাক ভক্তি ‘ডাক’কে এখনও পর্যন্ত বাঁচিয়ে রেখেছে। এখনো বাঙালী সমাজের সিংহভাগ মানুষই জানেন –
“অজা জালি, পাকা মেষ, দই-এর আগা, ঘোলের শেষ,
শাকের ছা, মাছের মা, ডাক বলে, বেছে খা৷৷”
(অজা জালি = কচি পাঁঠা)
অথবা, চার্বাকপন্থীদের –
“দধি দুগ্ধ করিয়া ভোগ, ঔষধ দিয়া খণ্ডাব রোগ
বলে ডাক, এই সংসার, আপনে মইলে কিসের আর?”
খিচুড়ির নমুনা –
“ভরা হতে শূন্য ভাল, যদি ভরতে যায়
আগে হতে পিছে ভাল যদি ডাকে মায়।
মরা হতে তাজা ভাল যদি মরতেও যায়
বাঁয়ে হতে ডানে ভাল যদি ফিরে চায়।
বাঁধা হতে খোলা ভাল (যদি) মাথা তুলে চায়
হাসা হতে কাঁদা ভাল যদি কাঁদে বাঁয়।”
(ভরা = কলসী, মরা = মৃতদেহ, মরতে চায় = গঙ্গাযাত্রী, “বায়ে হতে ডানে ভাল যদি ফিরে চায়” = শেয়ালের কথা বলা হয়েছে, “বাঁধা হতে খোলা ভাল” = গরুর কথা বলা হয়েছে।)
এগুলি সবই যাত্রার সুলক্ষণ চিহ্ন নিয়ে বলা হয়েছে।
ওদিকে খনার বচনে –
“খাটে খাটায় লাভের গাঁতি, তার অর্ধেক মাথায় ছাতি
ঘরে বসে পুছে বাত, তার কপালে হাভাত।”
“যদি বর্ষে আগনে রাজা যায় মাগনে”
“যদি বর্ষে মাঘের শেষ, ধন্য রাজা পুণ্য দেশ”
(আগনে = অগ্রহায়ণে)
সময়ে সময়ে ডাক ও খনার বচনের মধ্যে নানা শতকের এত ধরণের খাদ মিশে গিয়েছে যে, সেটা থেকে একাদশ শতকের চিত্র বাছাই করা রীতিমত দুঃসাধ্য ব্যাপার। তবে মনে হয় যে, তখন পিঁড়িতে বসে কলাপাতে ভাত খাওয়াই রীতি ছিল; আর সুলক্ষণা কন্যা দেখে তবেই বধূ বাছাই করা হত। কারণ, ‘পিঙ্গল আঁখি’, ‘ডাগর ওষ্ঠ’, ও ‘পেট পিঠ উচ্চ ললাট’-ওয়ালা মেয়েকে ঘরে আনতে বারবার নিষেধ করে দেওয়া হয়েছিল। উক্ত সময়ে বাংলার ফলের মধ্যে আখ, আম, কাঁঠাল, কলা, নারকেল, সুপারি এবং ধনে ও পান যে প্রধান ছিল, তাতে কোন সন্দেহ নেই।
(পরবর্তী পর্বে সমাপ্ত)
(তথ্যসূত্র:
১- হরপ্রসাদ শাস্ত্রী রচনা সমগ্র।
২- বৌদ্ধধর্ম, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী।
৩- বাঙ্গালীর ইতিহাস, আদিপর্ব, নীহাররঞ্জন রায়।
৪- বাঙ্গালার ইতিহাস, রাখালদাস বন্দোপাধ্যায়।
৫- বাংলা দেশের ইতিহাস, রমেশচন্দ্র মজুমদার।
৬- বাংলার সামাজিক ইতিহাসের ধারা, বিনয় ঘোষ।
৭- বাঙ্গালার ইতিহাস (সামাজিক বিবর্তন), ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত।
৮- বাংলা মঙ্গলকাব্যের ইতিহাস, আশুতোষ ভট্টাচার্য।
৯- বাংলা ও বাঙালীর বিবর্তন, অতুল সুর।
১০- পূজা পার্বণের উৎস কথা, পল্লব সেনগুপ্ত।
১১- ইতিহাসের আলোকে বৈদিক সাহিত্য, সুকুমারী ভট্টাচার্য।
১২- প্রাচীন বাঙ্গলা সাহিত্যের ইতিহাস, ডঃ তমোনাশ চন্দ্র দাশগুপ্ত।)