মহাভারতে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে কৌরব পক্ষের দিকে তাকিয়ে অর্জুনের মন ব্যাথিত হয়ে পড়ে কারন সেখানে তার আত্মীয়স্বজনরা ছিল যার কারনে অর্জুন যুদ্ধ করবেনা মনস্থিরন করেন, তখনই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে মানব জীবন এবং নীতি সম্পর্কে উপদেশ দেন যা ভগবত গীতা নামে প্রসিদ্ধ।
সম্প্রতি ক্রিস্টোফার নোলানের বিখ্যাত সিনেমা ওপেনহাইমারে ভগবত গীতার এগারো অধ্যায়ের বত্রিশতম শ্লোক ” কালোহস্মি লোকক্ষয়কৃত প্রবৃদ্ধো ” বলা হয়েছে যার অর্থ এখন আমি কাল হয়ে উঠছি যে সংহার করবে। অর্থাৎ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বুঝিয়েছেন জগৎ-এ যখনই অধর্ম, পাপ বৃদ্ধি পায় তখনই তিনি কালের রূপ ধারন করে অধর্মীদের বিনাশ করেন। এর মাধ্যমে তিনি অর্জুনকে মনের দুঃখ ভুলে অধর্মীদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে উজ্জীবিত করেছেন। .
আমেরিকার বিখ্যাত বিজ্ঞানী ডঃ ওপেনহাইমার ১৯৪৫ সালের ১৬ জুলাই ট্রিনিটি টেস্টের সময় বিশ্বের প্রথম পারমানবিক পরীক্ষার সময় এই শ্লোকেরই উচারন করেছিলেন।
আরো পড়ুন- ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভীত নাড়িয়ে দিয়েছিল দক্ষিণেশ্বর বোমা মামলা
বিখ্যাত পদার্থবিদ ও পারমানবিক বোম্বের জনক ডঃ রবার্ট ওপেনহাইমারের জীবনে ভগবত গীতার উল্লেখযোগ্য প্রভাব ছিল। একজন ইহুদি হয়েও ডঃ ওপেনহাইমারের ভারতীয় দর্শন ও ভগবত গীতার প্রতি আগ্রহ ছিল যার কারনে তিনি আর্থার রাইডারের কাছে সংস্কৃত শিখেছিলেন যাতে ভগবত গীতা সংস্কৃততে পড়তে পারেন। তিনি গীতার উপর এতটাই বিশ্বাস করতেন যে তিনি তাঁর সাথে সবসময় একটি গীতা রাখতেন এবং তার বন্ধুদেরও গীতা পড়ার কথা বলতেন। আমেরিকার ৩২ তম রাষ্ট্রপতি ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্টের অন্তেষ্টিক্রিয়ার সময়েও তিনি ভগবত গীতার সতেরো অধ্যায়ের তিন নম্বর শ্লোক পড়েছিলেন। ” সত্ত্বানুরূপা সর্বস্য শ্রদ্ধা ভবতি ভারত, শ্রদ্ধাময়োহয়ং পুরুষো যো যচ্ছ্রদ্ধঃ স এব সঃ ” — যার অর্থ হে ভারত! সবার শ্রদ্ধা নিজ নিজ মনের অনুরূপ হয়। যে যেরকম গুনের অধিকারী সে সেই রকম শ্রদ্ধাবান।
শুধু ডঃ রবার্ট ওপেনহাইমারই নয় ভগবত গীতা এমন অনেক পশ্চিমা মানুষের জীবনে প্রভাব ফেলেছে যাদের মধ্যে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী অ্যালবার্ট আইনস্টাইন থেকে শুরু করে হেনরি ডেভিড থোরেউ, লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংস, অ্যানি বেসান্তের মতো বিখ্যাত ব্যাক্তিত্ব রয়েছে। ভগবত গীতা কোটি কোটি মানুষের জীবন দর্শন বদলে দিয়েছে।
হিন্দু ধর্মের সবচেয়ে মহান গ্রন্থ বলা হয় সাতশো শ্লোক বিশিষ্ট ভগবত গীতাকে। চার বেদ, উপনিষদ সহ সমস্ত হিন্দু ধর্মীয় গ্রন্থের সার বলা হয় গীতাকে। তবে ভগবত গীতা শুধু ধর্ম গ্রন্থ নয় বরং এটি মানব জীবনে কী করে পরিপূর্ন করা যায় তা নির্দেশ করে। যার কারনে কোটি কোটি মানুষ ভগবত গীতা পড়েন। কুরুক্ষেত্রে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দেওয়া এই জ্ঞান আজ ভারতের সীমানা ছাড়িয়ে গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। এখনও অবধি আশির বেশী ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে ভগবত গীতাকে যার মধ্যে ৬৫ টি বিদেশী ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে। বিদেশীরা নিজ থেকেই গীতার প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে কারন গীতার মধ্যে মানব জীবন যথার্থ ভাবে পালন করার উপদেশ দেওয়া রয়েছে। যার কারনে এই মহান গ্রন্থ আজ সারা বিশ্বে প্রসিদ্ধ হয়েছে। বলা হয় গীতার উপদেশে বিশ্বের সমস্ত সমস্যার সমাধান রয়েছে। যোগের মতোন গীতার জ্ঞান মানুষের জীবনকে সত্য ও জ্ঞানের প্রকাশে আলোকিত করে।
পশ্চিমা বিশ্বে গীতার প্রসার শুরু হয়েছিল ইন্ডোলজির জনক স্যার উইলিয়াম জোনসের এশিয়াটিক সোসাইটির মাধ্যমে। ১৭৮৪ সালের ১৫ জানুয়ারি এশিয়াটিক সোসাইটি অফ বেঙ্গলের প্রতিষ্ঠা করেন স্যার উইলিয়াম জোনস। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য ছিল এশিয়ার সাহিত্যের প্রসার ঘটানো। এই সোসাইটি প্রাচ্য ও প্রাশ্চাত্যকে জ্ঞান ও আধ্যাত্মিক জ্ঞানের মাধ্যমে সংযুক্ত করেছিলো।
স্যার উইলিয়াম জোনস এশিয়াটিক রিসার্চারস নামে একটি জার্নালের মাধ্যমে এশিয়ার সাহিত্য ও দর্শন পশ্চিমে প্রকাশ করতেন। এই ভাবেই পশ্চিমে ভারতীয় সংস্কৃত ভাষার প্রসার ঘটে। এশিয়াটিক সোসাইটির সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব ছিল ভগবত গীতাকে পশ্চিমা দেশ গুলোতে প্রকাশ করা। স্যার চার্লস উইলকিন্স প্রথম ব্যক্তি যিনি ভগবত গীতার প্রথম ইংরেজি অনুকরন প্রকাশ করেন। স্যার চার্লসকে সংস্কৃত শেখবার জন্য বেনারসে পাঠিয়েছিলেন এশিয়াটিক সোসাইটির তরফে ওয়ারেন হেস্টিংস। বাংলার প্রথম গভর্নর জেনারেল ছিলেন এই ওয়ারেন হেস্টিংস। তিনি বিশ্বাস করতেন যদি ভগবত গীতার উদ্দেশ্যকে যদি সঠিকভাবে পালন করা যায় তাহলে মানব সমাজে সুখ ও সমৃদ্ধি বজায় থাকবে।
১৭৮৫ সালে ওয়ারেন হেস্টিংস এর অনুরোধে ভগবত গীতা ইংরেজিতে প্রকাশ করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। সেসময় ভগবত গীতার ভূূমিকা ওয়ারেন হেস্টিংস নিজে লিখেছিলেন। ১৭৮৭ সালে জেপি পরোড নামে এক ফরাসী সাহিত্যিক ভগবত গীতাকে ফরাসি ভাষায় অনুবাদ করেন এবং পরে জার্মান, স্প্যানিশ, রাশিয়ান সহ অনেক ভাষায় প্রকাশ করা হয়। ভগবত গীতা বিশ্বের মহান বৈজ্ঞানিক, দার্শনিক, কবি, বুদ্ধিজীবিদের শুধু প্রভাবিতই করেনি তাদের জীবনও বদলে দেয়।
পদার্থবিদ্যার কথা এলেই প্রথমেই মাথায় আসে স্যার অ্যালবার্ট আইনস্টাইন যাঁর সমতুল্য বৈজ্ঞানিক বিশ্বে কেউ নেই। ১৮৭৯ সালের ১৪ মার্চ জার্মানিতে জন্ম হওয়া স্যার অ্যালবার্ট আইনস্টাইন বিখ্যাত পদার্থবিদ্যায় অসামান্য অবদানের কারনে বিশেষ করে তার আপেক্ষিকতাবাদ তত্ত্বের জন্য। আইনস্টাইন ইশ্বররের অস্তিত্বে তেমন বিশ্বাস করতেননা কিন্তু ভারতীয় হিন্দু দর্শন তিনি পড়তেন৷ বলা হয় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে তাঁর চিঠির মাধ্যমে যোগাযোগ ছিল। ১৯৩০ সালে স্যার অ্যালবার্ট আইনস্টাইন এবং কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মধ্যে সাক্ষাৎ হয় এবং উভয়ে আইনস্টাইনের বার্লিনের বাড়িতে গিয়েছিলেন। এই সাক্ষাৎকার সেসময় আমেরিকার নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশ করা হয়েছিলো। বলা হয় এই সাক্ষাৎকারের পরেই ভারতীয় হিন্দু দর্শনশাস্ত্রের উপর আইনস্টাইন আরও আগ্রহী হয়ে ওঠেন এবং তিনি ভগবত গীতা পড়েন।
আমেরিকার বিখ্যাত কবি ও দার্শনিক হলেন হেনরি ডেভিড থোরিউ। ওয়ালডেন নামক বইয়ের জন্য তিনি পরিচিতি নামে যাতে তিনি প্রকৃতির মধ্যে সাধারন জীবনযাপন সম্পর্কে লিখেছিলেন। তাঁর লেখায় প্রভাবিত ছিলেন মহাত্মা গান্ধী, আমেরিকার রাষ্ট্রপতি জন এফ কেনেডি, রাশিয়ার বিখ্যাত লেখক লিও টলস্টয়ের মতোন বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গ। থরিও ভারতীয় দর্শন ও ভগবত গীতায় এতই প্রভাবিত ছিলেন যে তাঁর বই ওয়ালডনে গীতার কথা উল্লেখ করেছেন তিনি। রালফ ওয়ালডো এমারসন একজন বিখ্যাত আমেরিকান সাহিত্যিক ছিলেন। যিনি ১৮২০-৩০ এর দিকে আমেরিকার নিউ ইংল্যান্ড প্রদেশে তাঁর কাজকর্মের জন্য বিখ্যাত হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর জীবনে ভগবত গীতার বড় প্রভাব ছিল। ব্রিটিশ ঐতিহাসিক থমাস কার্লসওয়েল রালফ এমারসনকে ভগবত গীতা উপহার দিয়েছিলেন। আজও বোস্টনে এমারসনের সেই গীতা সংরক্ষন করে রাখা আছে।
উনিশ শতকে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী ছিলেন নিকোলা টেসলা যিনি প্রথম এসি মোটর ডিজাইন করেন। নিকোলা টেসলা স্বামী বিবেকানন্দের উপর খুবই প্রভাবিত ছিলেন। ১৮৯৬ সালে ফ্রানসের অভিনয় শিল্পী সারা বার্নহার্ডটের মধ্যস্ততায় উভয়ের মধ্যে দীর্ঘক্ষন আলোচনা হয় এবং সেখানে নিকোলা টেসলা স্বামী বিবেকানন্দের কাছে বৈদিক জ্ঞান শুনে খুবই অনুপ্রানিত হয়েছিলেন। নিকোলা টেসলা এরপরে ভারতীয় হিন্দু দর্শনে এতটাই প্রভাবিত হয়ে পড়েছিলেন যে তিনি সংস্কৃত ভাষায় ভগবত গীতা পড়েন। সুনীতা উইলিয়ামস প্রথম ভারতীয় বংশোদ্ভূত নারী যিনি মহাকাশে সবচেয়ে বেশী থাকার রেকর্ড করেছেন। দুটি মহাকাশ মিশনে তিনি মহাকাশে ৩২১ দিন ১৭ ঘন্টা ১৫ মিনিট থেকেছেন। ৫০ ঘন্টা ৪০ মিনিটের সবচেয়ে বেশী স্পেস ওয়াকের রেকর্ডও রয়েছে তার।
সুনীতা উইলিয়ামস মহাকাশ মিশনে তার সাথে একটি ভগবত গীতা ও গনেশজীর একটি মূর্তি নিয়ে গিয়েছিলেন। ভগবত গীতা জোসেফ স্টালিনের মতোন নিষ্ঠুর শাসককেও প্রভাবিত করেছিল।
১৯৪৯ থেকে ১৯৫২ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নে ভারতীয় রাষ্ট্রদূত ছিলেন ডঃ এস রাধাকৃষ্ণন। সেসময় স্টালিনকে প্রায়ই ভগবত গীতা শোনাতেন তিনি। স্টালিন তাকে প্রফেসর বলে ডাকতেন। ডঃ রাধাকৃষ্ণন ভারতে ফিরে আসার সময় স্টালিন নিজে তার সাথে দেখা করতে বিমানবন্দরে এসেছিলেন। এছাড়াও উইলিয়াম ওয়ার্ডসোয়ার্থ, উইল স্মিথ, হিউ জ্যাকম্যান সহ কত বিখ্যাত ব্যক্তির জীবন বদলে দিয়েছে ভগবত গীতা।