ভারতের বিদেশনীতির কেন্দ্রে রয়েছে ভারতের উত্তর পূর্ব অংশ কারন অর্থনৈতিক ও কুটনৈতিক ভাবে শক্তিশালী হবার জন্য ভারত আসিয়ানের সাথে জোট করছে যার ফলে ভারত উৎপাদন কেন্দ্রে পরিনত হচ্ছে এবং ভারতের আর্থিক ব্যবস্থা ভবিষ্যতে আরও মজবুত হবে। এর জন্য উত্তর পূর্ব অঞ্চল খুবই গুরুত্বপূর্ন ভারতের জন্য। কিন্তু চীন ও পাকিস্তান উত্তর পূর্ব ভারতে শান্তি বিঘ্নিত করতে বহুদিন ধরেই চেষ্টা করে যাচ্ছে। সম্প্রতি চারদিনের জন্য চীন সফরে গিয়েছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল মুনির। ইনটেলিজেন্স তথ্য অনুযায়ী জেনারেল মুনিরকে চাইনিজ সরকার নির্দেশ দিয়েছে উত্তর পূর্ব ভারতে সমস্যা তৈরি করার, বিশেষ করে অরুনাচল প্রদেশে। গত দুই মাস ধরে আইএসআই এর বাংলাদেশ বিভাগ এই ব্যাপারে কাজ করছে বলে খবর পাওয়া গেছে।
এর জন্য চীন অর্থ সাহায্য করছে। উত্তর পূর্ব ভারতের সাথে সীমানা রয়েছে চীনের কিন্ত এখানে পাকিস্তান এল কীভাবে? এবং অতীতে পাকিস্তান সাথে এই অঞ্চলে কী সম্পর্ক ছিল সেটা জানা দরকার আগে।
ভারতের ব্রিটিশ শাসনের সময়ে ১৯১১ সালের দিকে ভারতের ভাইসরয় ছিল লর্ড কার্জন। সেসময় উত্তর পূর্ব ভারতকে তিনটি অংশে ভাগ করেছিল লর্ড কার্জন। প্রথম অংশের নাম দেওয়া হয়েছিল প্রশাসনিক অঞ্চল। দ্বিতীয় অংশকে বলা হত প্রোটেকটিভ ফ্রন্টিয়ার। এই অঞ্চলে উপজাতিদের দমানোর জন্য ইংরেজরা প্রায়ই পুলিশ বা সেনা পাঠাতো। তৃতীয় অংশকে বলা হত স্ট্রাটেজিক ফ্রন্টিয়ার। এই অঞ্চলে ব্রিটিশ সরকার মাঝেমধ্যে অভিযান করতো যদি নতুন কোন বানিজ্য পথ খুঁজে পাওয়া যায় সেই উদ্দেশ্যে। ব্রিটিশ সরকারের সময়ে উত্তর পূর্ব ভারতের প্রশাসনিক অঞ্চল বলতে মূলত আসামকে বোঝাত। কারন এখানে চা, তেল, কয়লার জন্য এটি অর্থনৈতিক কেন্দ্র ছিল। আসামের ডিগবয়কে আসামের তেলের শহর বলা হয়। ১৮৬৬ সালে এশিয়ায় প্রথম খনিজ তেল এখানেই পাওয়া যায়। ১৯০১ সালে এখানেই দেশের প্রথম তেল কেন্দ্র তৈরি করা হয়। যার কারনে এই অঞ্চল থেকে বহু সংখ্যক স্থানীয় উপজাতিদের জোর করে সরানো হয় এবং সরাসরি ব্রিটিশরা এই এলাকা নিজেদের অধীনে নিয়ে আসে। স্বাধীনতার আগে ভারতে কিছুদিনের জন্য একটি সরকার তৈরি হয়েছিল সেখানেও ভোট দিতে দেওয়া হয়নি। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের মূলধারা থেকেও এখানের মানুষদের আলাদা রেখেছিল ব্রিটিশরা। ব্রিটিশ সরকার সবসময় এই অঞ্চলকে ভারতের মূলভাগের থেকে আলাদা ভাবে একটি দেওয়াল হিসাবে ঘিরে রেখেছিল।
১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হয়। পাকিস্তান গঠন হয় এবং আজকের বাংলাদেশ সেসময়ের পূর্ব পাকিস্তান ছিল। কিন্তু উত্তর পূর্ব ভারতে রাজ্য গঠনে একটা সমস্যা দেখা যায়। উত্তর পূর্ব ভারতে অনেক উপজাতি সম্প্রদায় ছিল। যেমন নাগাল্যান্ড গঠিত হয় নাগা উপজাতিদের নিয়েই কিন্তু নাগা উপজাতি শুধু নাগাল্যান্ডেই নয় আসামের কিছু অংশেও আছে, তাহলে কথা উঠতে শুরু করে যখন একই ধরনের উপজাতি রয়েছে তাদের একই ধরনের সরকারের অধীনেই থাকা দরকার। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকর আলি ভুট্টো একটা বই লিখেছিল মিথ অফ ইন্ডিপেনডেন্স যাতে স্পষ্ট লেখা হয়েছে কাশ্মীরের মতোই আসামও গুরুত্বপূর্ন। তার মতে আসাম সহ বেশ কিছু জেলা পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হওয়া উচিত ছিল। যার অর্থ স্পষ্ট ছিল পাকিস্তান আসাম সহ বিস্তীর্ন অঞ্চলে নাশকতার পরিকল্পনা করছিলো। জুলফিকর আলি ভুট্টো এটাও জানিয়েছিল আসামের অহিন্দু জনগোষ্ঠীর সাথে বিশেষ যোগাযোগ রাখা দরকার যতক্ষন আসাম পূর্ব পাকিস্তানে যুক্ত না হচ্ছে। ১৯৫৬ সালে নাগা ন্যাশনাল কাউন্সিল তৈরি হয়। যার লক্ষ্য ছিল নাগাল্যান্ডের স্বায়ত্তশাসন। এই দলকে প্রথমেই সমর্থন করে পাকিস্তান। নাগা ন্যাশনাল কাউন্সিলের নেতা ফিজোকে পাকিস্তান অস্ত্র সাহায্য ও গোরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষন দেবার আশ্বাস দেয়। সাথে নাগাল্যান্ডের দাবীকে আন্তর্জাতিক করবার জন্য ফিজোকে নকল পাসপোর্ট বানিয়ে ব্রিটেনে পাঠায় পাকিস্তান। এদিকে ১৯৬০ এর দিকে মিজোরামের লুসাই পাহাড়ে মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্ট বা এমএনএফ তৈরি হয়। এদের দাবী ছিল স্বাধীন মিজোরাম দেশের। এদেরও সমর্থন করে পাকিস্তান। এভাবে উত্তর পূর্ব ভারতের বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠমকে পাকিস্তান সহায়তা করতে শুরু করে এবং তারা প্রশিক্ষনের জন্য পূর্ব পাকিস্তানে যেতে শুরু করে। যার কারনে পূর্ব পাকিস্তানকে আলাদা করে বাংলাদেশ গঠন ছিল ভারতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন।
১৯৭১ সালে ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের পর বাংলাদেশ গঠন হয় ফলে উত্তর পূর্ব ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন গুলো ধাক্কা খায়। বিশেষ করে এমএনএফের নেতা লালডিঙ্গা ও তার সহকারীরা মায়ানমার পালিয়ে যায়। সেসময় মায়ানমারের আরাকান পাহাড়ে তারা আশ্রয় নেয়। মায়ানমারের কাচিন থেকে চীনের ইউনান প্রদেশে যায় এমএনএফের নেতা লালডিঙ্গা। কারন পাকিস্তান ভেঙ্গে গেছিল সুতরাং তাদের সাহায্য একমাত্র চীন করতে পারতো। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বার্মাতে সরাসরি সাহায্য করা সম্ভব ছিলনা। ১৯৭১ সালের পর থেকে ভারতের উত্তর পূর্ব রাজ্য গুলোতে অস্থিরতা তৈরি করতে সরাসরি কাজ শুরু করে চীন। চীন আবারও পাকিস্তানকে আবারও যুক্ত করে এই পরিকল্পনায়। পাকিস্তান একটা পরিকল্পনা তৈরি করে সমস্ত বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনকে একত্রিত করে একটি যৌথ সংগঠন করা। এই একই পরিকল্পনা পাকিস্তান কাশ্মীর দখল করতেও কাজে লাগিয়েছিল যে স্থানীয় মানুষকে ভারতের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা যখন কাশ্মীর প্রিন্সলি স্টেট ছিল। তবে ভারতীয় সেনাবাহিনী উপস্থিত হয়ে যাওয়ায় কাশ্মীরে পাকিস্তান সফল হয়নি। হেইন কেসলিং এর লেখা ফেইথ ইউনিটি ডিসিপ্লিন দি আইএসআই অফ পাকিস্তান বইতে তিনি বলেছেন ১৯৮০ সালের পর থেকে আইএসআই উত্তর পূর্ব ভারতে অস্থিরতা তৈরি করার কাজ শুরু করে। পাকিস্তানের উদ্দেশ্য ছিল যদি উত্তর পূর্ব ভারতকে অশান্ত করা যায় তাহলে ভারত কাশ্মীর রক্ষায় পূর্ন শক্তি প্রয়োগ করতে পারবেনা। তাহলে সেই সুযোগে পাকিস্তান কাশ্মীরে আক্রমন করতে পারবে। এই উদ্দেশ্যে আইএসআই উত্তর পূর্ব ভারতে মূলফা, মূলতা, আইএলএএ, হারকাত উল জিহাদ, হারকাত উল মুজাহিদ্দিন নামে বেশ কয়েকটি সন্ত্রাসী সংগঠন তৈরি করে।
১৯৮০ সালে কম্বোডিয়াতে সরকার পরিবর্তন হয় এবং সেখান থেকে লাইট মেশিন গান সহ অ্যাসল্ট রাইফেল সংগ্রহ করে পাকিস্তান। এইসব হাতিয়ার উত্তর পূর্ব ভারতের সন্ত্রাসী সংগঠন গুলোকে সরবরাহ করতে থাকে আইএসআই। এর জন্য বাংলাদেশের কক্সবাজার বন্দরকে ব্যবহার করা হয়। এই বন্দরের মাধ্যমেই উত্তর পূর্ব ভারতে হাতিয়ার পাঠাতে শুরু করে পাকিস্তান। ১৯৯০ সালে এক নাগা বিদ্রোহী ধরা পড়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীর হাতে যে স্বীকার করে আইএসআই তিনটি কিস্তিতে ১.৭ মিলিয়ন ডলার তাদের দিয়েছিল অস্ত্র কিনতে। কিন্তু পরে তারা নিজেরাই টাকা সংগ্রহ করতে শুরু করে হত্যা, লুঠ, অপহরন এবং ড্রাগসের মাধ্যমে। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী মায়ানমার, লাওস এবং থাইল্যান্ডের সীমানায় প্রায় সাড়ে নয় লাখ বর্গ কিলোমিটার অঞ্চলকে সোনালী ত্রিভুজ বলা হয়। এখানে সবচেয়ে বেশী আফিম চাষ হয় এবং এখান দিয়েই হেরোইন সহ বিভিন্ন ড্রাগসের সবচেয়ে বেশী চোরাকারবারি হয়। এখান থেকেই ড্রাগস উত্তর পূর্ব ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন গুলোর কাছে আসে। এসব সংগঠন বর্তমানে বেশীরভাগই লুকিয়ে আছে মায়ানমারের গভীর জঙ্গলে। আইএসআই মূলত তিনটি দেশ থেকে উত্তর পূর্ব ভারতে অশান্তি তৈরি করতে পারে মায়ানমার, বাংলাদেশ এবং নেপাল। সুতরাং উত্তর পূর্ব ভারতে শান্তি বজায় রাখতে মায়ানমার ভারতের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ন। যার জন্য মায়ানমার সেনাবাহিনীর সাথে ভারতের কুটনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। প্রয়োজনে দুইদেশের সেনাই যৌথভাবে অপারেশন করে মাঝে মধ্যে এদের শেষ করতে। এছাড়াও বাংলাদেশের সাথেও ভারতের কুটনৈতিক সম্পর্ক মজবুত যাতে আইএসআই বাংলাদেশের মাটি ব্যবহার করতে পারেনা। বিশেষ করে শিলিগুড়ি করিডরের নিরাপত্তার জন্য বাংলাদেশ ও নেপাল ভারতের জন্য গুরুত্বপূর্ন। নেপালে এর আগেও আইএসআই এর উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। কিছুদিন নেপালের সাথে ভারতের কিছু বিতর্ক ছিল তবে বর্তমানে তা মিটে গেছে এবং নেপালের সাথে আবারও ভারতের কুটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার হয়েছে। তবে চীন ও পাকিস্তান যাই করুক না কেন ভারতের র এবং সেনাবাহিনী সবরকম পরিস্থিতির জন্যই তৈরি আছে।