আঠারোতম লোকসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে তাদের বিজয় সুনিশ্চিত করতে অনেক আগেই তাদের প্রার্থী তালিকা ঘোষনা করেছে। তবে বিজেপির প্রার্থী তালিকায় এবার যথেষ্ট চমক রয়েছে। এবারে বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে এমন সব প্রার্থী নির্বাচিত করেছে যারা শুধু রাজনীতির সাথেই যুক্ত নয় বরং সমাজের অন্যান্য বিভাগেও তাদের যথেষ্ট অবদান রয়েছে। এই জন্য সমাজের সাধারন স্তরের মানুষের কাছে বিজেপির গ্রহনযোগ্যতা আরও বৃদ্ধি পাবে।
পশ্চিমবঙ্গের যাদবপুর লোকসভা কেন্দ্রের জন্য বঙ্গ বিজেপি এমনই একজন প্রার্থীকে বেছে নিয়েছে যার নাম ডঃ অনির্বান গঙ্গোপাধ্যায়। নতুন দিল্লিতে অবস্থিত ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় রিসার্চ ফাউন্ডেশন বা এসপিএমআরএফের চেয়ারম্যান ও ট্রাস্টি পদে রয়েছেন ডঃ অনির্বান গঙ্গোপাধ্যায়।
এই এসপিএমআরএফ ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপির সাথে যুক্ত। ডঃ গঙ্গোপাধ্যায় বিজেপির জাতীয় কার্যনির্বাহী সংস্থার সদস্য এবং বঙ্গ বিজেপিরও গুরুত্বপূর্ন সদস্য তিনি। ২০১৯ সালে ভারতের ১৭তম লোকসভা নির্বাচনের সময় থেকেই তিনি পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে যুক্ত হন। ২০১৯ সালে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির প্রচারাভিযানে তিনি মোদির জন্য বাংলা – বাংলার জন্য মোদি স্লোগান প্রচার করেন। ২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচনে তিনি আরও বেশী সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। ২০২১ সালের নির্বাচনে তিনি লক্ষ্য সোনার বাংলা স্লোগান প্রচার করেন। ২০২১ সালে তিনি বোলপুর শান্তিনিকেতন কেন্দ্রে বিজেপির প্রার্থী হন। যে বোলপুরে একটা সময় বিজেপির মোট ছিল মাত্র ১৯০০০ সেখানেই তিনি ২০২১ সালে ৯৪,০০০ ভোট পান। অল্পসময়ে জনকল্যানকর কাজের জন্য তিনি বোলপুর বাসীর কাছে জনপ্রিয় হয়ে গিয়েছিলেন। যার জন্য ২০২৪ সালের আঠারোতম লোকসভা নির্বাচনেও বঙ্গ বিজেপি তার উপর ভরসা রেখেছে এবং যাদবপুরের মতো গুরুত্বপূর্ন কেন্দ্রে প্রার্থী হিসাবে মোনোনীত করেছে। তবে রাজনৈতিক কাজকর্ম ছাড়াও ডঃ অনির্বান গঙ্গোপাধ্যায়ের অন্য আরকটি পরিচয় আছে যেটি সম্পর্কে অনেকেই জানেননা।
ডঃ অনির্বান গঙ্গোপাধ্যায় একজন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক। ভারতের রাজনীতি ও বুদ্ধিজীবি মহলে একজন বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব হিসাবে পরিচিত ডঃ অনির্বান গঙ্গোপাধ্যায়। ডঃ গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্ম হয়েছে এমন একটি বিখ্যাত পরিবারে যেখানে রীতিমতো সাহিত্য চর্চা ও দেশাত্মবোধক কাজকর্ম হত। ডঃ গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রপিতামহ উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন একজন বিপ্লবী এবং শ্রী অরবিন্দের ঘনিষ্ঠ সহযোগী। বারীন্দ্র কুমার ঘোষ, উল্লাসকর দত্ত, অবিনাশ ভট্টাচার্য, হেমচন্দ্র কানুনগো সহ অন্যান্য বিখ্যাত বাঙালি বিপ্লবীদের সাথে তিনি ব্রিটিশ শাসনের বিরোধীতা করেছিলেন। আলিপুর বোম্বা মামলায় অভিযুক্ত করে উপেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়কে সেলুলার জেলে পাঠিয়ে দিয়েছিল ব্রিটিশরা। বিপ্লবী কাজকর্মের পাশাপাশি ১৯২০-১৯৪০ এর দশকে বাংলার সাহিত্যেও একটি জনপ্রিয় নাম ছিল তার। উপেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়ের লেখা নির্বাসিতের আত্মকথা বাংলা সাহিত্যের একটি অমূল্য সম্পদ। পরবর্তীকালে তিনি হিন্দু মহাসভায় যোগদান করেন এবং ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর ঘনিষ্ঠ সহযোগী হয়ে ওঠেন। এই জন্যই ডঃ গঙ্গোপাধ্যায়কে শিক্ষার জন্য পন্ডিচেরীতে শ্রী অরবিন্দ আশ্রমে পাঠানো হয়। ডঃ গঙ্গোপাধ্যায়ের পিতামহ ছিলেন কবি দীনেশ গঙ্গোপাধ্যায় যিনি নিজের সময়ের একজন প্রখ্যাত বাঙালি কবি ছিলেন। সেসময় কবি দীনেশ গঙ্গোপাধ্যায়ের সাথে কাজী নজরুল ইসলাম এবং বলাই চাঁদ মুখোপাধ্যায়ের মতোন বিশিষ্ট সাহিত্যিকদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। যার জন্য ডঃ গঙ্গোপাধ্যায় এরকম ঐতিহ্যপূর্ন সাংস্কৃতিক পরিবেশের মধ্যেই বড় হয়েছেন যার প্রভাব তার পরবর্তী জীবনেও পড়েছে। প্রথম জীবনে ডঃ গঙ্গোপাধ্যায় পন্ডিচেরির শ্রী অরবিন্দ ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার অফ এডুকেশন থেকে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন, যেখানে তিনি ভাষা, দর্শন, ইতিহাস এবং সঙ্গীতে পারদর্শী ছিলেন। ইংরেজি, ফরাসি, সংস্কৃত, বাংলা, তামিল, উড়িয়ার মতো একাধিক ভাষায় পারদর্শী ডঃ গঙ্গোপাধ্যায় আন্নামালাই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের উপর মাস্টার ডিগ্রি করেন। এরপর যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গন যোগাযোগ ও সাংবাদিকতার উপর স্নাতকোত্তর ডিপ্লোমা করেন। পরবর্তীকালে তিনি শিক্ষায় পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। পিএইচডিতে তার বিষয় ছিল জাতীয় শিক্ষার উপর শ্রী অরবিন্দের দর্শন। ডঃ গঙ্গোপাধ্যায়ের কর্মজীবন শিক্ষা বৃত্তির সাথে রাজনৈতিক সক্রিয়তার মিশ্রন। তিনি বিবেকানন্দ ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশন বা ভিআইএফে সভ্যতা, শাসন ও রাজনীতি সম্পর্কে গবেষনা করেছেন। এর জন্য তিনি উত্তরপূর্ব ভারত এবং পশ্চিমবঙ্গে ব্যাপক কাজ করেন। কলেজ জীবনেই তিনি রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক বা আরএসএসে যুক্ত হন যা তার পরবর্তী রাজনৈতিক জীবনে যথেষ্ট প্রভাব ফেলে। ডঃ গঙ্গোপাধ্যায় বরাবরই ভারতের ইতিহাস, রাজনীতি ও সংস্কৃতির সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। সভ্যতা ও ইতিহাস সম্পর্কে তার অসামান্য জ্ঞান রয়েছে বিশেষ করে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন এবং প্রথমদিকের জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে তিনি বিশেষ চর্চা করেছেন। শিক্ষা এবং রাজনীতিতে তার ভূমিকা ছাড়াও, ডঃ গঙ্গোপাধ্যায় বিভিন্ন সরকারি ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। তিনি ভারত সরকারের শিক্ষা মন্ত্রকের অধীনে সেন্ট্রাল অ্যাডভাইজরি বোর্ড অফ এডুকেশন (সিএবিই) এবং ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কমিশন ফর কোঅপারেশন উইথ ইউনেস্কো (আইএনসিসিইউ) এর সদস্য হিসাবে কাজ করেছেন। তিনি অরোভিল ফাউন্ডেশন এবং বিশ্বভারতী সংসদের মতো প্রতিষ্ঠান পরিচালনাতেও যুক্ত ছিলেন। এছাড়া তিনি নেহেরু মেমোরিয়াল মিউজিয়াম ও লাইব্রেরি, ভারত সরকারের সংস্কৃত মন্ত্রকের একজন সদস্য। ২০১৩ সালে ডঃ গঙ্গোপাধ্যায় ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি ফাউন্ডেশনের পরিচালক নিযুক্ত হন। ডঃ গঙ্গোপাধ্যায়ের দক্ষ নেতৃত্বে এই প্রতিষ্ঠান বিশ্বের প্রথমসারির একটি প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠে। রাজনীতিবিদের পাশাপাশি ডঃ গঙ্গোপাধ্যায় একজন বিশিষ্ট লেখক এবং পণ্ডিত। তিনি রাজনীতি, শিক্ষা থেকে পররাষ্ট্রনীতি পর্যন্ত বিভিন্ন বিষয়ের উপর বেশ কিছু বই লিখেছেন, সম্পাদনা করেছেন বা সহ-সম্পাদনা করেছেন। মোদী ২.০ : এ রিসলভ টু সিকিউর ইন্ডিয়া, অমিত শাহ এন্ড দি মার্চ অফ বিজেপি, মোদী ডক্ট্রিন, স্বামী বিবেকানন্দ, বুদ্ধ ও বৌদ্ধধর্ম, বিতর্ক সংস্কৃতি, শিক্ষা: দর্শন ও অনুশীলনের মতোন উল্লেখযোগ্য বই লিখেছেন তিনি। এই সমস্ত বই যথেষ্ট প্রশংসিত হয়েছে এবং নিজ নিজ বিভাগে বেস্টসেলারও হয়েছে। এছাড়াও তিনি সভ্যতার সমস্যা, রাজনীতি, শিক্ষা ও সংস্কৃতি নিয়ে অনেক কাগজ, অধ্যায় লিখেছেন। এসপিএমআরএফের এর পরিচালক হিসাবে ডঃ অনির্বান গঙ্গোপাধ্যায়ের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে এই সংস্থাটি রাজনৈতিক দলের সহাকারী সংস্থা হিসাবে বিশ্বের শীর্ষ চল্লিশটি সংস্থার মধ্যে এসেছে। বছরের পর বছর ধরে তার যোগ্য নেতৃত্বে ফাউন্ডেশনটি তার কার্যক্রম প্রসারিত করেছে এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিপুল সংখ্যক শিক্ষাবিদ এবং বিশেষজ্ঞরা সক্রিয় ভাবে সংস্থাটিতে অংশগ্রহন করেছে। আদর্শগত ও রাজনৈতিক সমস্যা থেকে শুরু করে জননীতি, বৈদেশিক ও অভ্যন্তরীন নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা, জলবায়ু পরিবর্তন এবং নদী পর্যন্ত এসপিএমআরএফ একাধিক কর্মকাণ্ড শুরু করেছে। ডঃ গঙ্গোপাধ্যায় ডঃ শ্যামা প্রসাদ মুখার্জীর কৃতিত্বকে ভারতবাসীর সামনে তুলে ধরেছেন। ডঃ অনির্বান গঙ্গোপাধ্যায় রাশিয়া, ফ্রান্স, জার্মানি, সিঙ্গাপুর, বেলজিয়াম, ভিয়েতনাম, মায়ানমার, জাপান, মঙ্গোলিয়া, চীন, তাইওয়ান, স্পেন সহ বিভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন বৈঠকে ফাউন্ডেশনের পাশাপাশি বিজেপির হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেছেন।
দক্ষিন কলকাতার অতি গুরুত্বপূর্ন যাদবপুর লোকসভা কেন্দ্রে এবার ত্রিমুখী লড়াই হতে চলেছে বিজেপি, তৃনমূল ও সিপিআইএমের মধ্যে। বরাবরই বামেদের শক্ত ঘাঁটি এই যাদবপুর। ১৯৭৭ সালে যাদবপুর লোকসভা কেন্দ্র তৈরি হওয়ার পর সিপিএমের সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় যাদবপুরের প্রথম সাংসদ নির্বাচিত হন। ১৯৮৪ সালে সোমানাথ চট্টোপাধ্যায়কে নির্বাচনে পরাজিত করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে তারপরেও যাদবপুরে সিপিএমের একটা বড় অংশের ভোটার রয়েছে। গত চারদশকে যাদবপুর কেন্দ্রে সিপিআইএম, তৃনমূল কংগ্রেস এবং কংগ্রেসের সাংসদ রয়েছে যার জন্য যাদবপুরকে পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন লোকসভা কেন্দ্রগুলোর একটি বলা হয়।
সোনারপুর দক্ষিন, সোনারপুর উত্তর, বারুইপুর পূর্ব, বারুইপুর পশ্চিম, ভাঙড়, যাদবপুর এবং টালিগঞ্জ এই সাতটি বিধানসভা কেন্দ্র নিয়ে গঠিত যাদবপুর লোকসভা কেন্দ্র। ২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচনে যাদবপুর কেন্দ্রের ছয়টি বিধানসভাতেই তৃনমূল কংগ্রেস জয়লাভ করে কিন্ত ভাঙড়ে ইন্ডিয়ান সেক্যুলার ফ্রন্ট বা আইএসএফ জয়লাভ করে। এই সাতটি বিধানসভা কেন্দ্রের মধ্যে অন্তত তিনটিতে মুসলিম ভোটের প্রাধান্য রয়েছে। বিজেপি প্রার্থী ডঃ অনির্বান গঙ্গোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে এবার যাদবপুর কেন্দ্রে তৃনমূল কংগ্রেস প্রার্থী সায়নী ঘোষ। ২০১৯ সালে যাদবপুর কেন্দ্রে জয়লাভ করেছিল তৃনমূল কংগ্রেস প্রার্থী মিমি চক্রবর্তী যদিও এবার তাকে প্রার্থী করা হয়নি। তবে এবার যাদবপুরে নির্বাচনে জেতার সম্ভবনা রয়েছে ডঃ অনির্বান গঙ্গোপাধ্যায়ের। যার প্রধান কারন অতীতে সায়নী ঘোষের হিন্দু আরাধ্য দেবতা ভগবান শিবকে নিয়ে অশালীন মন্তব্যের কারনে হিন্দু ভোটের একটি বড় অংশ হারাবে সায়নী ঘোষ এমনটাই মত ওয়াকিবহল মহলের। যাদবপুর কেন্দ্রে বাম ভোটের একটি বড় অংশ বিজেপিতে যাওয়ার সম্ভবনা রয়েছে। তাছাড়া আইএসএফও যাদবপুর কেন্দ্রে প্রার্থী দেওয়ায় ভাঙড় সহ তিনটি কেন্দ্রের তৃনমূলের মুসলিম ভোটের একটি বড় অংশ আইএসএফ পেয়ে যাবে। যার জন্য ভোট কাটাকাটির এই খেলায় বিজেপির জয়ের সম্ভাবনা অনেক বেড়ে গেছে মত একাধিক বিশেষজ্ঞদের।